ট্রেন থেকে আমরা দুই প্রবাসী হাওড়ায় নেমে তারপর বাসে চড়ে এসে পৌঁছলাম যাদবপুর। এ ছাড়া আর যাবই বা কোথায়! যাদবপুর ছাড়া আর তো কোনো জায়গা এত গভীরভাবে চিনি না। সে চেনা ঘামের চোখের জলের রক্তের। হ্যাঁ, শরীর থেকে ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা তরল গরম লাল রক্তের। লবণাক্ত এই ত্রিবেণী বন্ধনে যে আমাকে বেঁধে রেখেছে–সে এই যাদবপুর। দক্ষিণ কলিকাতা।
প্রথমে এলাম সুলেখা কালি কোম্পানির সামনে শ্যামা কলোনির মোড়ে। এখন আর সেই কালি কোম্পানিটা নেই। কারখানার গেটে ঝুলছে পেতলের বড় তালা। বাঙালির বড় গর্ব বড় অহঙ্কারের সেই সুলেখা কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল ছটা থেকে বেলা দুটো, আবার দুটো থেকে রাত দশটা দুশিফটে কাজ চলত। বেলা ন’টায় সাইরেন বাজত, হাজার বারোশো মানুষ কাজ করত, এখন কে কোথায় গেছে, কে জানে।
শুধু সুলেখা নয় এখানে অনেক কল কারখানাই বন্ধ। ওদিকে ঊষা, বেঙ্গল ল্যাম্প, এদিকে কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরি তার পাশে অন্নপূর্ণা, আর একটু এগিয়ে ডাবর। সবই বামফ্রন্টের অবদান। শুনতে পাই সারা পশ্চিমবঙ্গে নাকি পঁয়ষট্টি হাজার কারখানা এদের শাসনে বন্ধ হয়ে গেছে। ‘শ্রমিক শ্রেণির পার্টি’-র বদান্যতায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিক মরছে না খেতে পেয়ে।
দেখলাম শ্যামা কলোনি মোড়ের কাছে যে জায়গাটায় আমরা থাকতাম সেখানে এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা বিল্ডিং। আমরা এখান থেকে চলে যাবার পর আগের মালিক জায়গাটা যদুবাবু নামে একজনকে বিক্রি করে। যদুবাবু মুলিবাঁশ টালির দোকান করেছিল। সেই দোকানে কিছু বিহারি মজুর কাজ করত। জীবনের এক পর্বে গৃহহারা এক যুবক রাতের আশ্রয় খুঁজতে এখানে এসে তাদের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ত। সেই পর্বে পুলিশ তাকে খুঁজত।
সুলেখার গেট থেকে রামকৃষ্ণ উপনিবেশের সি-ব্লকের মসজিদের সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকা সেই লাইট পোস্টটাকে দেখতে পেলাম। যেটায় একদিন আমাকে পিছমোড়া করে বেঁধে চোরের মতো ঠেঙিয়েছিল সিপিএম নেতা পিন্টু সেন। সেটা ঊনসত্তর সালের শেষ ভাগ। আমার অপরাধ ছিল এই যে, আমার বন্ধু রামকৃষ্ণ উপনিবেশের ‘আলু স্বপন’ এক অলস দুপুরে নিতান্ত ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে একটা দেওয়ালে সিপিএম লেখা তিনটে অক্ষরের পাশে আর একটা অক্ষর ‘এল’ বসিয়ে দিয়েছিল। আমি তখন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
তবে সেই লাইট পোস্টটা এখন আর ফুটপাতে নেই, চলে এসেছে রাস্তার অনেকটা উপরে। কারণ রাস্তাটা অনেক চওড়া হয়ে গেছে। কেননা গাড়ির সংখ্যা আগের তুলনায় হাজারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বামফ্রন্টের শাসনে এক শ্রেণির লোকের হাতে এই সময়ে প্রচুর টাকা। পরিবর্তিত পরিস্থিতি যেমন লক্ষ কোটি লোককে নিঃস্বনির্ধন বেঘর-সর্বহারা বানিয়ে ছেড়েছে, কিছু স্বঘোষিত ভিখারির বাচ্চারা হাজার কোটির উপর নাচছে।
এই সেদিন যে বাম নেতাকে ছেঁড়া পাঞ্জাবী পরে, ভাঙা চায়ের দোকানে বসে বিড়ি ফুঁকতে দেখে গেলাম তার ঠাটবাট বিলাস বৈভব দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছে আমার। শুধু এক কাউন্সিলার হয়ে যদি এত সম্পত্তি তাহলে যারা এম.এল.এ. মন্ত্রী তাদের কত হাজার কোটি কে জানে!
সেই পিন্টু সেন আজ আর নেই, মরে গেছে। মরে গেছে সেই আলু স্বপনও। আমি আছি, আছে সেই লাইট পোস্টটা, আছে একটা যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি। পিন্টু সেনের দিয়ে যাওয়া হাঁটুর ব্যথাটা এখন বড় বেগ দেয়। যখন বয়স কম ছিল অতটা মালুম পাইনি। এখন বয়স যত বাড়ছে ব্যথাটা বেড়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন পরে সে আমাকে চলৎশক্তিহীন অথর্ব বানিয়ে দেবে।
শ্যামা কলোনির যে জায়গাটায় আমরা থাকতাম তার উল্টোদিকে একটা বড় খাল ছিল। শহরের যত নোংরা জল এই খাল দিয়ে বানতলার দিকে চলে যেত। এখন সেখানে বানানো হয়েছে কবি সুকান্তের নামে একটা সেতু। আমি চলে যাবার পর এর নির্মাণ হয়েছে।
খালপার ধরে উত্তর দিকে কিছুটা হেঁটে এলে বাঁদিকে যাবার একটা সরু পথ ছিল টিবি হাসপাতালে যাবার। পথের ডাইনে-বাঁয়ে দুই দিকে দুটো ডোবা ছিল। তেমন একটা বড় ডোবা নয়, বাঁ দিকেরটায় পচা পাক হোগলা জোঁক ছিল, ডানদিকেরটায় সবুজ জল।
স্মৃতি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে সেই জায়গাটা চিনে নেবার চেষ্টা করি। এক সন্ধ্যায় মুখে মুড়ি নিয়ে বুকে গুলি খেয়ে যে সবুজ জলে ডুবে গিয়েছিল বাবলু। আমার বন্ধু। আর প্রাণভয়ে উল্টো দিকের পচা ডোবায় ঝাঁপিয়ে প্রায় চারঘন্টা লাশ হয়ে পড়েছিলাম আমি। সারা শরীরে প্রায় একশো নানা সাইজের জোঁক লেগেছিল।
দেখলাম সেই হাসপাতালের লাশ ঘরের ছাদটা, ভীত শিশু যেমন মায়ের কোলে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আমি সেইভাবে কত রাত যে ওখানে লুকিয়ে কাটিয়েছি। সেই যেবার কার্তিককে কোপাই–দু’দিন এক রাত লুকিয়ে ছিলাম ওই লাশ ঘরে। দেখলাম টিবি হাসপাতালের সেই মাঠটা, যার ওপাশে একটা ময়লা পোড়ানো চুল্লি ছিল। তুলো, ব্যান্ডেজ, গজ, রোগীদের ব্যবহৃত বাতিল বিছানাপত্র এখানে পোড়ানোনা হতো। চুল্লির ওধারে ঝোঁপঝাড় ছিল, শুয়োর চরত। এধারে ছিল জমাদারদের কোয়ার্টার। দিলীপ, শিবুয়া, এইসব ছেলেদের সাথে কাটত আমার দিন। এখানেই নানুর চোলাই মদের ঠেক ছিল। যে নানু এক সময় পরম শত্রু ছিল আমার, পরে প্রাণের বন্ধু। একদিন সে আমাকে আর একটু হলে মেরে ফেলত, আর একদিন তার বল্লমের আঘাতে অর্ধমৃত দেহটা আমি কাঁধে করে বয়ে এনেছিলাম রণভূমি থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে।
সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নীচে দেখলাম বড়লাল সাউয়ের সেই চায়ের দোকান। এখন তার ছেলে বাবুলাল এই দোকানের মালিক। ছোট বেলায় বাসা থেকে পালিয়ে এসে এই চা দোকানে চাকরি নিয়েছিলাম।
দেখে এলাম রামকৃষ্ণ উপনিবেশের সেই দেওয়ালটা। আর সেই কালী মন্দিরটা। দরমার ভাঙাচোরা বেড়ার মন্দিরের সেই দরিদ্র প্রতিমা এখন আর নেই। পাকা দেওয়াল, ছাদ, ছাদে গম্বুজ। এই মন্দিরের যজ্ঞের পোড়া কাঠে কপালটা পুড়ে গেছে আমার, রক্তখাকি দেবী বলি নিয়েছে আমার গোটা জীবনটা।
আজ ভাবি, সেদিন যদি স্বপন সেই শিল্পকর্মটা না করত, সেই অপরাধে পিন্টু সেন আমাকে মারত আর বদলার আগুন আমার বুকে এমন দাউ দাউ করে না জ্বলে উঠত, কেমন হতো সেই জীবনটা? তাহলে কী আমি মেতে উঠতাম মরা আর মারার মর্মন্তুদ খেলায়? পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথে পথে ঘুরে কাটালাম শেকড় ছাড়া জীবন?
সব ওলোট পালট হয়ে গেছে এই কালীর জন্য আর কাঁপালিক পিন্টু সেনের জন্যে। সিপিএম যে কতখানি হিংস্র একটা দল, সে বিষয়ে তো আগে আমি যা বলার বলে দিয়েছি। সেই নকশাল বাড়ির সাত রমণীর মৃতদেহ মাড়িয়ে যে যাত্রা তারা শুরু করেছিল তা থামবে নেতাই পর্যন্ত এসে আরও কিছু নারীমেধের পরে। আর চৌত্রিশ বছর কালের যাত্রাপথের দু’ধারে পড়ে থাকবে লক্ষাধিক লাশ আর পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি ধর্ষিত নারীর দেহ।
এরপর দেখতে গেলাম কামার পাড়ার সেই কালভার্ট। এই সেই কালভার্ট যেখানে আমাকে ধরে এনে বসিয়ে রাখা হয়েছিল একদিন খুন করবার জন্য। বন্দুকে গুলিও ভরা হয়ে গিয়েছিল, বাকি ছিল শুধু ট্রিগারটা টিপে দেওয়া। দেখলাম, সেই ঘরটাও, যে ঘরে ঢুকিয়ে কার্তিকনামের এক সিপিএম চাকু চালিয়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করেছিল। আর আমি ওরই চাকু কেড়ে নিয়ে ওকেই শুইয়ে দিয়েছিলাম সেই ঘরের ধুলোময় মেঝেতে।
সেই সময় কামারপাড়া সম্বন্ধে মুখে মুখে একটা প্রবাদ চালু হয়েছিল–এখানে যে আসে হেঁটে, ফিরে যায় খাটে। আমার ভাগ্য আমাকে দুবারই ফিরিয়ে দিয়েছিল জীবিত। অনাত্মীয় শহরের পথে পথে কী খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি খুঁজছিআমাকেই। এইসব পথের ধুলোয়, ইট-পাথর-কংক্রীটের জঙ্গলে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে থাকা আমার আমিকে জুড়ে জুড়ে দেখে নিতে চাইছি আজকের আমির অখণ্ড স্বরূপটাকে। অদৃশ্য অক্ষরে এখানকার দেওয়ালে লেখা হয়ে আছে আমার জীবনের ইতিহাস। সেই লেখাগুলো একটু পড়ে নিতে চেষ্টা করছি।
সুকান্ত সেতুর পাশে একটা চায়ের দোকান। বিহারি এই চা-অলার নাম বড়ভাই। আগে কৃষ্ণা গ্লাস ফ্যাক্টরির শ্রমিক ছিল। ডিউটির পরে চা বেচত। সে কাজটা গেছে, দোকানটা আছে, আমি তাকে চিনতে পারি, সে আমাকে চিনতে পারে না। মনে আছে একদিন কাছে পয়সা ছিল না, খুব খিদে পেয়েছিল, এক কাপ চা বাকিতে দেবার জন্য ভিখারির চেয়েও কাতর হয়েছিলাম এর কাছে, দেয়নি। পরে অবশ্য বাকি তো বাকি, বিনা পয়সায় চা খাওয়াতে পারলে ধন্য হয়ে যেত। তার এই মানসিক পরিবর্তন ঘটেছিল আমি পরিবর্তিত হয়ে যাবার ফলে।
সে যাইহোক, এখন আমরা সেই দোকানে বসে চা খাই। তারপর বড়ভাইকে জিজ্ঞাসা করি, এখানে মদন বলে একটা ছেলে থাকত না? সে এখন কোথায়?
বড়ভাই বুড়ো হয়ে গেছে, চোখে ভালো দেখতে পায় না। বলে-কৌন মদন, যে সুলেখায় কাজ করত?
না না, যে নরেশ ঠাকুরের সাথে রান্নার কাজে যেত। পরে রিকশাও চালিয়েছে।
ও তো মরে গিছে।
সে কী! কী করে?
বুরা সঙ্গত হোয়ে গিছিলো তো। এই সব লোক জাদা দিন বাঁচে না। কোথায় না কোথায় গিয়ে মার্ডার হয়ে গিসে।
বড়ভাই এটা জানে মদন মার্ডার। জানে না, কে তাকে মেরেছে–আর কেন মেরেছে।
আমিই মেরেছি। না মেরে উপায় ছিল না। বীজের মৃত্যু না ঘটলে বৃক্ষের জন্ম হয় না। মদনের মৃত্যু না হলে মনোরঞ্জন কী করে জন্ম নিত? রত্নাকরের মৃতদেহের উপর যে বাল্মীকির আসন পাততে হবে। তাই রত্নাকরকে মরতে হবে। মারবে সে নিজেকে নিজে। তারই কণ্ঠ থেকে একই সঙ্গে বর্জন এবং আবাহন ধ্বনিত হবে, দুর হটো রত্নাকর, কাছে এসো বাল্মীকি।
চা খেয়ে ব্রীজের সিঁড়িদিয়ে নেমে এসে দাঁড়ালাম যাদবপুর রেল স্টেশনের দুনাম্বার প্ল্যাটফর্মে। যে জায়গাটায় গামছা বিছিয়ে শুয়ে রাতের পর রাত, দিন মাস বছর কাটিয়েছি, সেই জায়গাটায় চোখ পড়তে বুক জুড়ে একটা হাহাকার একটা সর্বহারার বেদনা তুফান তুলল। সেইসব দিনে নিজেকে আমার রাজা বলে মনে হতো। কালীঘাট: শানে এক ডোমকে দেখেছিলাম, যে নিজেকে রাজা বলেছিল। বলেছিল, সে রাজা হরিশচন্দ্রের বংশধর। পৃথিবীর যেখানে যত শ্মশান সবশ্মশানের মালিক রাজা হরিশচন্দ্র। উত্তরাধিকার সূত্রে সেও সেই রাজত্বের অংশীদার–এক রাজা।
আমি ছিলাম সেইরকম এক রাজা। সম্পূর্ণ রেল স্টেশন, এটা ছিল আমার রাজত্বের সীমা। রাজধর্ম পালনই ছিল আমার কর্তব্য। এই কাজে দশ বারোজন সঙ্গী ছিল আমার। ওরাই মন্ত্রী, ওরাই সেনাপতি। কত তাদের নাম, নামের সাথে উপনাম। হাতকাটা গণেশ।বড় গোপাল, কালো গোপাল, বাঙাল নারান, মেদিনীপুরিয়া নারান, লাথখোর বিমল, কালিয়া, ভোলা, ভীম, কালাচাঁদ, বাচ্চা অমল। এরা কেউ রিক্সা চালাত, কেউ স্টেশনে মোট বইত, কেউ মাছের দোকানে মাছের আঁশ ছাড়াতো, কেউ কাগজ কুড়াত, মদের দোকানে কাজ করত বাচ্চা অমল। এদের কারো মা কারো বাবা ছিল না, কারো মা বাবা দুজনেই মারা গেছে, কারও মা বাবা থেকেও নেই। কেউ বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে, কাউকে কেউ স্টেশনে বাসয়ে দিয়ে পালিয়ে গেছে। এদের মা বাবা দাদা অভিভাবক সব ছিলাম আমি। ওরা আমার জন্য জীবন বাজি রেখে যে কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত, আমি পারতাম ওদের জন্য যে কোনো কাজে ন্য, অন্যায় বিচার না করে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে।
সেই যেবার কালিয়ার ট্রেনে অ্যাকসিডেন্ট হল, স্টেশন এলাকার পকেটমার সর্দার হারার হাতের শিকো ঘড়ি কেড়ে নিয়ে বেচে তার চিকিৎসা করিয়েছিলাম। আর যেবার সেই বাঘা যতীন মাঠে দুটো মেয়ে খুন হল, পুলিশ কাউকে না পেয়ে যাদবপুর থেকে গণেশকে তুলে নিয়ে গিয়ে জুড়ে দিল সেই কেসে। ওকে ছাড়িয়ে আনার জন্য উকিল ধরে কেস লড়ার জন্য টাকার প্রয়োজনে ডাকাতি করেছিলাম আমি। হ্যাঁ যেটা করেছিলাম সেটা ডাকাতিই।
আর গণেশ? একবার কোটা পূরণ করার জন্য জি.আর.পি. আমাকে ধরলে স্টেশনের ক্যাম্পে হামলা করে সে আমাকে ওদের হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। গুলি খেয়ে মরতে পারে তবু পরোয়া করেনি।
স্টেশন এলাকায় ভদ্রলোক জনদের কাছে আমাদের পরিচয় ছিল সমাজবিরোধী, সমাজ বিরোধীরা আমাদের জানত তাদের শত্রু বলে। আর নকশাল দলের কাছে আমরা ছিলাম লুম্পেন প্রলেতারিয়েত।
এক সময়ে এসে দাঁড়ালাম স্টেশনস্থ সেই রিক্সা লাইনটার সামনে। যেখানে বহু বছর রিক্সা চালিয়েছি আমি। যার পিছনে সেই বুড়ো বটবৃক্ষ। আমার জীবনের বহু ঘটনার সাক্ষী এই বৃদ্ধ বট। এক বৃষ্টির অন্ধকার রাতে একজন এই বৃক্ষের নীচে আমাকে আলিঙ্গন দিয়েছিল। দিয়েছিল এক ডজন চুমু। বলেছিল আজ এইটুকু। বাকিটা দেব বিয়ের পরে।
বিয়ের পরে সে বিহারে চলে গেছে। আর দেখা হয়নি, অপেক্ষায় আছি প্রায় তিরিশ বত্রিশ বছর। জানিনা কবে এসে বাকিটা দিয়ে যাবে।
বটগাছের গোড়ায় একটা মন্দির। সেখানে নানান দেব-দেবীর ভিড়। কেউ জানে না, একদা এখানে দেবস্থান বানাবার প্রথম উদ্যোগ আমিই নিয়েছিলাম। তখন বটগাছের গোড়ায় লোকে প্রস্রাব করত। বারণ করলেও শুনত না। প্রস্রাবের নাক জ্বালা গন্ধে আমরা রিক্সার লাইনে টিকতে পারতাম না। তাই সেটা বন্ধ করার জন্য কৌশল করেছিলাম। বিবেক নগরের মাঠ থেকে এক পরিত্যক্ত শীতলা মূর্তি তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছিলাম বটবৃক্ষের নীচে। শীতলার ভয়ে আর কেউ সেখানে প্রস্রাব করার সাহস করেনি।
এক ধুরন্ধর বামুনের মাথায় আসে জায়গাটা মন্দ নয়, লক্ষ লোকের চলাচলের পথ। এখানে একটা দেবালয় হলে একটা আয়-উপার্জনের দরজা খুলতে পারে। তাই সে একে একে শনি, মনসা, কালী, বহু দেবদেবীর মূর্তি এনে ভিড় বাড়ায়। যার যাকে ভক্তি প্রণাম করুক আর প্রণামী দিক। যা এক সময় পরিণত হয়ে যায় এক ভব্য মন্দিরে।
দেব দেবতার অসীম ক্ষমতা, চাইলে সে দীনদুঃখী মানুষের সব দুঃখ কষ্টের নিবারণ করতে পারে। স্টেশনের এই দেবদেবীরা আমাদের সেই চরম দারিদ্রের দিনে অনেক উপকার করেছে। সে সময় একবেলা না খেয়ে থাকলে পরের বেলা খাওয়া জোগান দিত এরাই। ভাঙা বেড়ার ফাঁক থেকে হাত গলিয়ে কাঠের বারকোষ থেকে তুলে নিতাম একমুঠো পয়সা। হোটেলে খাবার খরচা পরের দিন সকালে বামুন গাল পাড়ত–শনি, কালীকচাখেকো দেবতা। যে তার পয়সা নিয়েছিস মুখে রক্ত উঠে মরবি। আমরা হাসতাম আর বলতাম বাপ মায়ের পয়সা ছেলে খেলে কোনো পাপ হয় না।
দেখলাম সেই দেওয়ালটা, যেখানে এখন গণশক্তি সাঁটা হয়। সেই কবে কতযুগ আগে এক কিশোর জ্বর গায়ে নিয়ে সারারাত বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল এই দেওয়ালের পাশে পানের পিক, ধুলো, ছেঁড়া কাগজ, বিড়ির টুকরোর মধ্যে। দেওয়ালটা এখন আমাকে চিনতে পেরেছে। সে হাসছে আমাকে দেখে। গলায় একরাশ স্নেহ এনে জিজ্ঞাসা করে–আবার এলি?জানতাম আসবি। আসতে তোকে হবেই।
মনে পড়ল, বুড়ো হরেন ঘোষ বলত—যেই হালায় একবার যাদবপুরের জল খাইছে দুনিয়ার কোনখানে গিয়া টিকতে পারবো না। আইজ হোউক কী কাইল ঠিক ফিইরা আসোন লাগবো।
একটু অবাক হলাম আমি। এই যাদবপুরে এক সময় লক্ষ লোক আমাকে চিনত। তারা সব গেল কোথায়? কেউ সামনে এসে বলল কিরে কেমন আছিস? আসলে তারা চিনতে চাইছে না। চেনা দিলেই দাঁড়িয়ে দুমিনিট কথা বলতে হবে। সেইটুকু সময় আর অপচয় করার মতো কারও কাছে নেই।
মনে হচ্ছে শহরের সব মানুষ যেন পায়ে ঘোড়ার নাল লাগিয়ে ছুটছে। কে পিছনে রয়ে গেল, কে পিষে গেল পায়ের নীচে ফিরে দেখার সময় নেই। সে ছুটছে সামনের লোকটাকে অতিক্রম করে যাবার জন্য। অনবরত এক ভয় তাড়া করছে তাকে–আমি দৌড় থামালে আমাকে পিছনে ফেলে অন্য কেউ এগিয়ে যাবে। শহরের এত বিত্তবৈভব, এত জৌলুস, এত প্রাপ্তি সারা
দেশটাকে জোঁকের মতো শুষে একার পেট মোটা করছে এবং তার মরণদৌড় চলছে ‘আরও চাই’-য়ের পিছনে।
আরও চাই। আর কত চাই? কতখানি খেলে মিটবে শহরের রাক্ষসী খিদে? আমি ছত্তিশগড়ে ছিলাম। দেখে এসেছি কত অল্প পেয়েও আনন্দে থাকা যায় কত কম খেয়েও সুখে থাকা যায়।
এখন একটা গল্প মনে পড়ছে। একজন বিশাল বিত্তবান লোকের কী এক অসুখে যেন ডান চোখটা নষ্ট হয়ে গেছে। পরীক্ষা পর ডাক্তার বলে একে তুলে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। বিত্তবান ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়ে। আমার একটা চোখ থাকবে না। লোকে কানা বলবে।বলে ডাক্তার কোনো চিন্তা করবেন না। ওখানে আমি এমন একখানা পাথরের চোখ বসিয়ে দেব কেউ আসল নকল বুঝতেই পারবে না।
তখন তাইকরলেন তিনি, লাগিয়ে নিলেন একটা পাথরের চোখ। আয়না ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন সত্যিই বোঝা যাচ্ছে না। কোনটা আসল কোনটা পাথর। তবুও মনটা একটু খুঁতখুঁত। মানুষ তো। তাই বাড়ি ফিরে চাকরকে ডাকলেন-বলতে আমার কোন চোখটা পাথর? চাকর একবার তাকিয়ে বলে দিল–ডান চোখ। ড্রাইভারকেডাকলেন, সেও বলেদিল ডান চোখ। দারোয়ান সেও বলে দিল–ডান।
এবার বিত্তবান লোকটা ছুটে গেল ডাক্তারের কাছে, আপনি বলেছিলেন কেউ বুঝতে পারবে না, কিন্তু আমার চাকর বাকর সবাই তো বুঝে যাচ্ছে কোনটা নকল। এটা কেন?
তখন শান্ত গলায় বলে ডাক্তার–এই পাথরের চোখটা যাতে আসল চোখের মতো দেখতে হয়, মানুষের আসল চোখে যে যে উপাদান থাকা দরকার সেই দয়া দরদ করুণা এতে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে আপনার কর্মচারীরা ওই চোখে সেগুলো দেখতে পেয়েছে তাই চিনে ফেলেছে। তবে এতে আপনার অত বিচলিত হবার কিছু নেই। এক দুমাস অঙ্গে লেগে থাকার পর দেখবেন ওসব মুছে গিয়ে ঠিক আপনার আসল চোখের আকার নিয়ে নেবে।
ভাগ্যিস এই দেওয়ালটা কোনো উচ্চতল ইমারতের দেওয়াল নয়। যে দেওয়ালের মধ্যে বাস করে কতগুলো হৃদয়হীন যান্ত্রিক জীব। তাই সে আমাকে চিনতে পেরে ডেকে কথা বলছে।
এরপর গেলাম পালের বাজার, গড়ফার শিব মন্দির, বিবেক নগরের মাঠ, সেলিমপুর রেলগেট। সেই সত্তর দশকে একদল দুরন্ত দামাল তরুণ দুচোখে সমাজ বদলের স্বপ্ন নিয়ে জীবনমরণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের অগণিত মানুষের দুর্দশা মোচনে। তারা আমূল পরিবর্তন চেয়েছিল পোড়া দেশটার। সব মানুষের পেটে থাকবে অন্ন, পরিধানে বস্ত্র, মাথার উপর ছাউনি। সেই দেশই তাদের পরিবর্তন করে দিয়েছে। সব এখন মানুষ থেকে পরিবর্তিত হয়ে গেছে মোড়ে মোড়ে ইট পাথরের বেদীতে।
একদিন সময় আমাকে তাদের সঙ্গী বানিয়ে দিয়েছিল। এক সাথে হেঁটে গিয়ে ছিলাম কয়েক পা। তারপর আর পারিনি পায়ে পা মিলিয়ে সমান তালে হাঁটতে। অনেক পিছুটান পিছিয়ে দিয়েছে আমাকে। এখন তাদের এক পলক দেখার জন্য মনটা বড় কাঁদে। আশুদা, বড়দা, তুলসিদা, বাবলাদা, গৌতমদা, সেলিমপুর বস্তির কত ছেলে–কে কোথায় চলে গেছে কে জানে। রাজনীতি আমি বুঝতাম না, এখনও বুঝি সে দাবি করব না। তবে এটা বুঝতাম এরা যা করছে তার পিছনে কোনো স্বার্থ নেই। আছে গভীর ভালোবাসা। ভালোবাসা এমন একটা ভাষা যা অনুবাদ ছাড়াই বোঝা যায়। মানুষ বুঝতে পারে। শঙ্কর গুহনিয়োগী একজন বাঙালি, তিনি ছত্তিশগড়ের গোণ্ড মুরিয়াদের কাছে গিয়েছিলেন। উনি তাদের ভাষা জানতেন না, তারা জানত না ওনার ভাষা। তবু তাদের পরস্পরকে চিনে নিতে বিশ্বাস করতে বিলম্ব ঘটেনি।
তখন সেলিমপুর রেল লাইনের ধারে হোগলা, পাতাকাঠ, চট পচা, টিনের অনেক ঝুপড়ি ছিল। সেই সব ঝুপড়িতে বাস করত দিন আনা দিন খাওয়া অসংখ্য পরিবার। কেউ এসেছিল দেশভাগের বলি হয়ে। কারও ঘর বাড়ি ভেসে গেছে সুন্দরবনের কোনো নদীর ভাঙনে।নকশালদের এখানে একটা ঘাঁটি সেই সন্দেহে পুলিশ বস্তি থেকে তুলে দেয়। কী যে ভালো তারা বাসত আমাদের। যাকে আমরা মাসি বলে ডাকতাম, সেই দুলালী মাসি বাবুর বাড়ি বাসন মাজত, কাপড় কাঁচত ঘর মুছত। সারাদিন খেটে বাসায় এসে আমাদের জন্য রুটি তরকারি বানাতে বসে যেত হাসিমুখে। প্রায় দু-তিন কিলো আটার রুটি হতো রোজ। তবু তাকে কোনোদিন বিরক্ত হতে দেখেনি। মুখে হাসিটা লেগেই থাকত। আর সেই ভালোবাসা মাখা ঘুঁটের মতো মোটা রুটির স্বাদ আজও যেন মুখে লেগে রয়েছে।
এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে দিন ফুরিয়ে গিয়ে রাত নামল। এক সস্তার হোটেলে ডাল ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লাম রেল স্টেশনে। আমরা পরিব্রাজক তাই পথে রাত কাটাবার মতো কিছু চাদর কাপড় আমাদের সাথেই থাকে। রাখতে হয় কিছু শুকনো খাবার, জলের পাত্র।
শুয়ে পড়ার পর আমি যেন কান পেতে কংক্রীটের চাঙ্গরের নীচে মাটির বুকের হৃদপিন্ডে ধ ধক্ আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে যেন আমাকে কিছু বলছে। মাটি কী কথা বলে? বলতে পারে? তাহলে আমার কেন মনে হচ্ছে সে কিছু বলছে। শুধু মাটি নয়, এই নির্জন হয়ে আসা রাত, ওই বট গাছের পাতার শনশন, পাশের পচা পুকুরের কালো জল সবাই এখন আমার সাথে কথা বলছে মৌনতার ভাষায়। মানুষ আমাকে চিনতে চায়নি, কথা বলেনি, সে কষ্ট আর থাকে না।
রাত কেটে যাবার পর সকাল বেলায় সেই পুরাতন নিয়মে মুখে নিমডাল নিয়ে রেল লাইনের ধারে গভীর আত্ম বিশ্বাসের সাথে বসে সেরে নিলাম প্রাতঃকৃত্য। পাশের পুকুরে জলশৌচ করে মুখ হাত ধুয়ে এসে দাঁড়ালাম প্ল্যাটফর্মে। এবার এককাপ চা খেয়ে ট্রেনে চাপব। খোঁজ নিয়ে জেনেছি আমার সেই ভাইয়ের চেয়ে বেশি গণেশ সুভাষগ্রামে বাড়ি করেছে। যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করেছে তারই বাবা কিনে দিয়েছে দুকাঠা জমি। কলকাতায় এসে গণেশের সাথে দেখা না করাটা পাপ হবে।
এমন সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল সেই লোকটার সাথে যে আমাকে একদিন পিঠে গুলিভরা রিভলবারের গুঁতো দিতে দিতে নিয়ে গিয়েছিল সেই কামারপাড়ায়। যেখানে মানুষ যায় তো হেঁটে ফিরে আসে লাশকাটা ঘর ঘুরে।
সেদিন যে কী বাঁচাটা বেঁচে গিয়েছিলাম, ভাবলে আজও বুকের রক্ত বরফ হয়ে যায়। শুধু মাত্র একটা পদবির জন্য প্রাণটা রক্ষা পেয়ে গেছে আমার। যদি থোকা চক্রবর্তী না হয়ে থোকা দাস হতো আমার নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যেত।
অনেকদিন পরে একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিনানা পাটেকরের। সেই ছবিতে দুই অফিসারের মধ্যে এই নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা চলছিল কে কটা খুন করে এক নাম্বার হতে পারে। সেই রকম একটা গোপন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থোকা দাস আর মোহিত বর্মনের মধ্যেও ছিল। কে কাকে টপকে যাবে। সেই অবস্থায় নাগালে পেয়ে আমাকে না মেরে ছেড়ে দেবার পাত্র খোকা দাস ছিল না। সে সব আমি বিস্তারিত লিখে দিয়েছি প্রথম ভাগে। তবে সেদিনের সেই ঘটনার পর ওই লোকটার সাথে আমার আর কোনো বিবাদ বিরোধ ছিল না। তার বেশ কটা রিক্সা ছিল, ভাড়া খাটত। তার একটা আমিও নিয়েছিলাম দৈনিক দু’টাকা ভাড়ায়।
সব লোকের একটা করে নাম থাকে। এরও আছে। ধরা যাক তার নাম দত্তদা। যখন আমি যাদবপুর স্টেশনে ঘাঁটি গেড়ে ছিলাম সেই সময় গায়ে সিপিএম গন্ধ মাখা কিছু গুণ্ডাদের সাথে মাঝে মধ্যে ছোট ছোট গণ্ডগোল হয়েছিল আমার। তারা আমাকে মারুক কী আমি তাদের মারি–এমন কী খোকা দাসের শাগরেদ কার্তিককে কামারপাড়ার ভিতরে চাকু মেরে চিৎ করে দিয়ে আসার পরেও উনি আমাকে দোষারোপ করেননি। যেন একটুখানি আক্ষেপ ছিল তার গলায় এ তুই কী করে দিলি। কামারপাড়ার ইতিহাসে যা কোনোদিন ঘটেনি কোনোদিন ঘটবে কেউ ভাবতে পারেনি তাই করে ফেললি।
এটা সত্যি যে আজ পর্যন্ত কেউ কামারপাড়ার বুকের ভিতর ঢুকে এক মহাবীরকে চাকু গেঁথে চলে আসবে, কারও কল্পনায় ছিল না। কী করে সেটা আমার দ্বারা সংঘটিত হয়ে গিয়েছিল কে জানে। তবে সেই ঘটনার পর মানুষের মনে হয়েছিল মাস্তানির ময়দানে আর এক মল্ল অনুপ্রবেশ করল। যে কয়দিন না মরে, জেলে না যায় খুব দাপাবে।
দত্তদা আগে টিবি হাসপাতালের এক কোয়াটার্সে থাকতেন। ওনার বাবা ওখানে চাকরি করতেন। তিনি মারা যাবার পর দত্তদাকে কোয়াটার্স ছেড়ে দিতে হয়। তখন উনি জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে বাইপাশের ওদিকে এক সদ্য গড়ে ওঠা উপনগরিতে চলে আসেন। আজকাল আর খুব একটা স্টেশনের দিকে আসা হয়ে ওঠেনা। বহুদিন পরে মর্নিংওয়াক করতে কেন কে জানে এদিকে এসেছিলেন, তাই আমার সাথে দেখা হয়ে গেল।
আমার জীবনে এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। আমি যাকে মণিহারা ফণীর মতো পাগল হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি, ক্ষ্যাপা যেমন খোঁজে পরশ পাথর–খুঁজে বেড়াচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না। পেয়ে গেলাম তাকে যাকে কোনোদিন খুঁজিনি। আর সেই আকস্মিক সাক্ষাৎ আমার জীবনে এক একটা মাইল ফলক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।
আমি গিয়ে দত্তদার সামনে দাঁড়াই, আর আমাকে দেখে যেন সে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। শেষে এক মহাবিস্ময় গলায় ঢেউ খেলে, তুই মদন না। এখনও মরিসনি। কোন্ ভাগাড়ে গিয়ে পড়েছিলি? জেলে ছিলি নাকি?
খ্রিস্টানের যেমন যিশুর সামনে কনফেস করে সেইভাবে বলি, আমি ছত্তিশগড়ে চলে গিয়েছিলাম। কাল ফিরেছি।
আমি একটু ভাবনা চিন্তা করেই ছত্তিশগড় বলেছি। দণ্ডকারণ্য বলিনি। এতে সেই অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ বলার মতো সত্য বলা হল আবার বলা হল না। এক সময় দণ্ডকারণ্য থেকে হাজার হাজার বাস্তুহারা মানুষ এই বাংলার এক কোণে একটু আশ্রয়ের জন্য এসেছিল। তখন সিপিএম দল প্রচার চালিয়েছিল ওই সব লোক স্রেফ বিরোধীদের উস্কানিতে গরিব দরদী বামফ্রন্টকে বিপন্ন বিব্রত করার বদ উদ্দেশ্য নিয়ে এমনভাবে ঝাঁকে ঝাকে পশ্চিমবঙ্গে আসছে। এরপরই ক্ষুধার্ত হায়নার মতো বামফ্রন্টের পুলিশ আর ক্যাডাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উপরে। খুন, জখম, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ, মিথ্যে মামলায় জেল–এইসব অস্ত্রের প্রয়োগে মরিচঝাঁপি থেকে উৎখাত করা হয় তাদের।
দত্তদা সিপিএম কর্মী। যদি সে জেনে যায়, দণ্ডকারণ্য থেকে এসে মরিচঝাঁপিতে বুকের হাড় ভেঙে আবার দণ্ডকারণ্যে ফিরে গিয়ে মরে যাওয়া এক বাপের সন্তান আমি, কে জানে যদি সেই বামফ্রন্টকে বিপদে ফেলা দ্বেষ উথলে ওঠে। আমার প্রতি ভুলে যাওয়া রাগ চাগাড় দেয় আবার। তাহলে যে বিপদে পড়ে যাব। কে আমাকে বাঁচাবে সেই বিপদ থেকে? তাই ছত্তিশগড় বলা। তবে ছত্তিশগড় নামটাও তার ত্রাসের বিষয়। আঁতকে উঠে বলে দত্তদা, ওখানে শুনি নকশালদের জব্বর ঘাঁটি। তুই সেখানে কী করতিস? আবার ওদের সাথে ভিড়ে গেছিস নাকি?
বলি আমি, নিয়োগীজির সংগঠনের কাজ করি।
নিয়োগী। কোন্ নিয়োগী?
শঙ্কর গুহনিয়োগী।দল্লী রাজহরায় থাকতেন। মস্ত বড় নেতা। পশ্চিমবঙ্গের লোক।ভিলাইয়ের শিল্পপতিরা ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে খুন করে দিয়েছে ওনাকে। এখানকার পত্র পত্রিকায় তো খুব হৈ চৈ হয়েছিল।
ও ওইটা। ওতো একটা নকশাল ছিল।
শঙ্কর গুহ নিয়োগী কোনো সাধারণ নেতা নন। সারা দেশে বীরসা-মুণ্ডা, সিধু-কানহু বীর নারায়ণ সিং, ভগৎ সিং–এই সব শহিদের সমতুল্য–সৎ, সাহসী নির্ভীক এক জননেতা হিসাবে সম্মানের আসন দখল করে আছেন। সেই মহান মানুষের নাম এমন তাচ্ছিল্য সহকারে উচ্চারণ করতে শুনে মনটা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে আমার।
বলি,উনি বন্দুকের উপর আস্থা রাখতেননা। আস্থা রাখতেন মানুষের উপর। গণআন্দোলনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ন্যায় দাবি আদায় করতেন। এই কারণে মানুষ তাকে ছত্তিশগড়ের গান্ধি বলে।
একটু থেমে আবার বলি, আমি ওনাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। ওনার সংগঠনের কাজ করতাম যে।
কী কাজ করতি?
যে কাজের ভার দিতেন।
কথাটা বলার পরে আমার মনে হল, অনেক বেশি বলা হয়ে গেছে। এসব কথা একে বলার কোনো দরকার ছিল না। আমরা এসেছি ঘুরতে, ঘুরে চলে যাব। এখানে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। তাই সামলে নেবার জন্য বলি, পশ্চিমবঙ্গে তো কোনো কাজ-টাজ পাইনি। আমার এক কবিদাদা বলতেন ছত্তিশগড়ে যাও, ওখানে কাজের লোক খুব দরকার। গেলে কাজ করতে পারবে। তাই গেছিলাম।
তবে যে বললি সংগঠনের কাজ করি।
সংগঠনেরই কাজ তো। একটা সংগঠনে কত রকম কাজের লোক লাগে। সব কাজ কী সদস্য সমর্থকরা করে, না করতে পারে।
দত্তদা বুঝতে পারলেন আমি যে কাজ করতে ওখানে গিয়েছিলাম তার নাম শ্রমদান। যার জন্য একটা পারিশ্রমিক ধার্য করা থাকে। পশ্চিমবঙ্গের পার্টিরও এমন সব লোক লাগে। যে ঘরদোর সাফ সাফাই করে, জমাদার, ড্রাইভার এরা মাইনে নেয় কাজ করে। মদন সেই রকম কোনো কাজ করত। দত্তদা বেশ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। দাবার বোর্ডের সামনে বসে পাকা খেলোয়াড় যেমন অনেক ভেবে বুঝে সামনে ঘুটি ঠেলে দেয় উনি আমার দিকে কথা ঠেলে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গে কী ফিরে আসতে চাস? তাহলে বল, তোকে এখানে কোনো একটা কাজে কর্মে লাগিয়ে দিই।
বলি, বাংলার মানুষ। কাজের জন্যই তো বাংলা ছেড়ে অতদূরে যেতে হল। যদি এখানে একটা কাজ পেয়ে যাই সেখানে আর কেন যাব।
দত্তদার চোখে মুখে খেলে গেল চালাক হাসি। সঠিক চালটা দিয়ে আমাকে কাত করে ফেলেছেন। আমার সঙ্গী কেনারামকে দেখিয়ে জানতে চান, এ কে?
বলি–আমার সাথে ঘুরতে এসেছে।
এখন কোথায় যাচ্ছিলি? আর
আমার এক ভাই গণেশের বাড়ি।
যা, তাহলে ঘুরে আয়। সন্ধের সময় একবার আয়। দেখি তোর জন্য কী করতে পারি। কথা যখন দিয়েছি কিছু একটা তো নিশ্চয় করব।
এরপর কেনারামের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে আমাকে বলে, তুই একা আসিস। তোকে নিয়ে আমি এক জায়গায় যাব।
কিছু লোক আছে সারা পৃথিবী জুড়ে যতই পরিবর্তন হয়ে যাক সে নিজেকে কিছুতেই পরিবর্তিত করবে না। এক সাথে আমরা যারা রিক্সা চালাতাম কেউ কেউ এখন ড্রাইভারি শিখে বাস ট্যাক্সি চালাচ্ছে। রিক্সাওয়ালা অনন্ত এখন জমির দালালি করে মোটর বাইক চেপে ঘোরে। কেউ কেউ পার্টির নেতা ধরে কর্পোরেশনে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু গণেশ রয়ে গেছে অবিকল আগের মতোই। এখনও সে রিক্সাই চালায়।
এই সব লোক যেখানে থাকে সবাই তাকে চিনবে। ঘরের খেয়ে অথবা না খেয়ে পরের মোষ চরিয়ে বেড়াবার বদ অভ্যাস আছে যে। কার কী সমস্যা একবার তার কানে গেলে হলো, নিজের সমস্যা ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে ওর স্ট্যান্ড। সেই যে আমার ইউনিয়নে থাকার জন্য কামারপাড়ার পার্টি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল তারপরে আর স্টেশনের রিক্সা লাইনে জায়গা পায়নি। সেই থেকে এখানে থাকে।
খুঁজে খুঁজে ওখানে গিয়ে শুনলাম বেশ কয়েক দিন গণেশ আসছে না। একজন বলে দিল কী ভাবে তার বাড়ি যেতে পারব, সুভাষ গ্রাম স্টেশনে নামবে। একটু রেল লাইন ধরে হেঁটে আসবে পিছন দিকে। দেখবে একটা রাস্তা উত্তর দিকে চলে গেছে! হাঁটার পথ মিনিট দশ। ফের বাঁদিকে একটা রাস্তা। ওটা ধরে কিছুটা গিয়ে বাঁদিকে দেখবে একটা ক্লাব। ক্লাবের পিছনে গণেশের বাড়ি। যাকে বলবে দেখিয়ে দেবে। সুভাষগ্রামে পৌঁছে সেই পথে হেঁটে পেয়ে গেলাম গণেশের বাড়ি। একটু শরীর খারাপ, তাই রিক্সা চালাতে যেতে পারছে না, বাড়িতেই পেয়ে গেলাম ওকে।
প্রায় দশ বছর পরে দেখা। এত বছরের জমে থাকা সব কথা কী বলে শেষ করতে পারে? হাউ হাউ করে বলে গেল সে, বড় গোপাল তালদির গোবিন্দনগরে বাড়ি করেছে, অটো চালায়। বড় বিমল সন্ধ্যা বাজারে দোকান দিয়েছে। তাদের সাথে কখনো কখনো দেখা হয়, অন্য সবাই কে কোথায় ছিটকে গেছে, কোনো খবর নেই। আর গণেশ সেই মার্ডার কেস দুটোয় চার বছর মামলা লড়ে বেকসুর খালাস পেয়েছে। বিয়ে করেছে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। আমিও আমার কথা বলি। আরও বলি, দত্তদা আমাকে একটা কাজ দেবে বলেছে। যদি দেয় আর যাব না। এখানেই থাকব।
গণেশ দত্তদাকে চেনে। বলে সে, দেখ গিয়ে। আমার তো মনে হয় দিতে পারবে না। ওর কথা কে মানে। খুব বদনাম হয়ে গেছে না। তবু বলেছে যখন গিয়ে দেখ।
কেনারামকে গণেশের বাড়ি রেখে সেদিন সন্ধেবেলায় এলাম দত্তদার বাড়ি। জামা প্যান্ট পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আমার আসবার অপেক্ষায় প্রস্তুত হয়ে বসেছিল সে। এত দেরি করলি কেন? চল তাড়াতাড়ি চাটা সেখানে গিয়ে খাব।
আমাকে কাজে লাগিয়ে দেবে। আমি মাস গেলে মাইনে পাব। আমার উপকার হবে। আমার উপকার–। আবার আমি আমার ছেলে মেয়ে বউকে দণ্ডকারণ্যের গভীর অরণ্যের অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারব। আবার ওরা বাংলার জল মাটি হাওয়া গায়ে মেখে বাঙালি হয়ে উঠবে। বাংলা ভাষায় কথা বলবে হাসবে, বাংলায় স্বপ্ন দেখবে। বিশ্বাস হয় না এমন পরোপকারি বাংলাদেশে কী কেউ আছে। এক ছিলেন শঙ্কর গুহনিয়োগী তিনি মারা গেছেন। এক বাঙালি বিনায়ক সেন তিনি বাংলা ছেড়ে চলে গেছেন। যোগীন সেনগুপ্ত দিল্লিতে থাকেন, শৈবাল জানা বাংলায় আসেন না। তাই দত্তদার এমন উপকারি প্রবৃত্তি দেখে একটু অবাক না হয়ে পারি না আমি। ছিঃ, সিপিএম পার্টি সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা ছিল আমার। আমি ধারণা করে বসেছিলাম,বিজয়গড়ের খোকা চক্রবর্তী মারা যাবার ফলে এই পার্টির সর্বশেষ ভালো লোকটা মারা গেছে। আর একজনও অবশিষ্ট নেই। ভুল, এই তো দত্তদা আছেন।
আমাকে তিনি নিয়ে গেলেন বালিগঞ্জের এক বাড়িতে। যে বাড়ির কম বয়সের ছেলেমেয়েরা তাকে মামা ডাকে। একজন বলে, কী মামা হঠাৎ করে আমাদের বাড়ি। পথ ভুলে নাকি? সেই যে বলে গেলে তোমার ভেরির তাজা মাছ এনে খাওয়াবে, আর তোমার দেখা নেই।
বলেন দত্তদা, মাছের কথা পরে হবে, আজ তোদের সবাইকে একটা আশ্চর্য জিনিস দেখাব। যা তোরা কেউ কোনোদিন দেখিসনি। গল্প শুনেছিস বইয়ে পড়েছিস সিনেমায় দেখেছিস। সামনা সামনি দেখবি আজ।
দত্তদার গলার শব্দে বলার ভঙ্গিতে বাড়ির সব লোক জমা হয়ে যায় আমাদের চারপাশে। সবার চোখে মুখে ঝিলিক মারছে একটা হালকা কৌতুকমাখা হাসি। বোঝা যাচ্ছে কেউ তার কথা গভীরতার সাথে নিচ্ছে না। একজন বলে–তাহলে দেখিয়ে দাও তোমার ঝুলিতে কী ম্যাজিক আছে।
দত্তদা আমার দিকে তর্জনি তুলে দেখালেন–একে দ্যাখ, তোদের দেখাব বলে সাথে করে নিয়ে এলাম। চিনিস একে?
সব চোখ আমার দিকে ছোট টর্চের মতো ঘুরে যায়। আঁতিপাঁতি জরিপ করে। বুনো বুনো, মজুর মজুর, না খাওয়া না খাওয়া চেহারায় তারা বিশেষ কিছু খুঁজে পায় না।
বলেন দত্তদা, আসল মাওবাদী, ছত্তিশগড়ে থাকে। আগে এখানে থাকত। নকশালদের নেতা আশু মজুমদারের ডানহাত ছিল। এক সময়ে এর ফটো লালবাজারের বোর্ডে টাঙানো ছিল–যে ধরে দেবে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার। তাই এখান থেকে পালিয়ে ছত্তিশগড়ে চলে যায়।
এখন সব নাবালক আমাকে দেখে, যেন চিড়িয়াখানার বাঘ। এই মাত্র খাঁচা খুলে বাইরে বের হয়ে এসেছে।
দত্তদা বলে চলেন, দেখতে এই রকম হলে কী হবে এক সময় পাঁচটা থানার এলাকা ওর নামে থরথর করে কাঁপত। তোরা তখনও জন্মাসনি। তখন ওর সামনে যাবে এমন বুকের পাটা কারও ছিল না। সে সময় ও কত যে খুন করেছে গোনা গাঁথা ছিল না।
আমার এখন অস্বস্তি লাগছে, অসহ্য লাগছে দত্তদার বুকনি। সেই সত্তরের দশকে দুদিন কী একটু করেছিলাম, তাকে এত বছর পরে এমন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে বলার কোনো মানে খুঁজে পাই না। যা সে আমার সম্বন্ধে বলে চলে তাতে যে কেউ মনে করবে আমি সেই শোলে ছবির গব্বর সিংয়ের মতো এক নির্দয় ডাকাত। খুন যার কাছে পিঁপড়ে মারার মতো তুচ্ছ ব্যাপার।
আসলে এটা হচ্ছে মূল কাহিনির ভূমিকা। যে কাহিনির নায়ক উনি নিজে, উনি আমাকে যদি কাহিনিতে গব্বর সিং না বানান নিজে বচ্চন বনবেন কেমন করে? আমাকে যা বানানো হচ্ছে সে নাটকের দাবি মেটাতে। দর্শক শ্রোতাদের তৃপ্তি দিতে।
চা এসে গেছে সাথে নিমকি। চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে পিছনে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে চোখ নাচিয়ে মুখে এক গর্বিত হাসি এনে ফের বলেন দত্তদা, ও আমাদের পার্টির সে সময় খুব ক্ষতি করেছিল। যখন তখন কামারপাড়ায় ঢুকে আমাদের মূল ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে চলে যেত। কোনোমতে ওকে ঠেকানো যাচ্ছিল না। কেউ সাহসই পাচ্ছিল না ওর মুখোমুখি হতে।
চায়ে চুমুক। তখন আমাদের নেতা চৌধুরিদা আমাকে বলল আর কেউ পারবে না, তোকেই এই দায়িত্বটা নিতে হবে। যেভাবে পারিস ওকে থামিয়ে দে। থামিয়ে কথার মানে বুঝিস? বললাম চৌধুরিদাকে দায়িত্ব নিলাম। সাতদিন-মাত্র সাতটা দিন সময় দাও। ওকে জ্যান্ত ধরে কামারপাড়ায় নিয়ে আসব।
গল্প শোনা বছর বারোর একজন বড় অবাক, তোমার ভয় করেনি? যদি মেরে দেয়?
ভয়! হাসলেন দত্তদা, ভয় কাকে বলে এই শর্মা কোনোদিন তা জানে না। এখন বয়স হয়ে গেছে, দেখিসনি তো আমার সেই অল্প বয়সের মূর্তি। জানে এই মদন। বল তো রে তোকে যে কামারপাড়ায় ধরে নিয়ে গেছিলাম সেই গল্পটা বল। এরা সব সময় বলে আমার নাকি সাহস নেই। বলত সেই ঘটনাটা।
তখন সন্ধে নেমেছে। দোতলার এক কোণের ঘরে বসে আছি আমরা। সে ঘরে আলো অপ্রতুল। ভয়ের গল্প শোনার পক্ষে একেবারে যথাযথ পরিবেশ। চার পাঁচজন নাবালক ঘিরে বসে আছে আমাদের। তারা এত মারাত্মক মানুষ আগে আর দেখেনি। যে মুরগির মতো মানুষ ধরতো আর কচ করে গলাটা কেটে ফেলত। এমনিতে তাকে দেখে ভয় পাবার কথা। সেটা পাচ্ছে না, কারণ সেই দত্ত মামা সন্নিকটে আছে, যে লোকটার চেয়েও মারাত্মক।
দত্তদার আদেশে বলা শুরু করি–আমি সেদিন যাদবপুর স্টেশনে ছিলাম। আমার তো তখন ঘরবাড়ি ছিল না, স্টেশনেই থাকতাম। তো সেদিন ভোরবেলায় একদল ছেলে ফুটবল খেলতে খেলতে স্টেশনের পুলিশ ক্যাম্প থেকে রাইফেল ছিনতাই করে পালাল। দু’পক্ষের মধ্যে চাকু গুলি চলেছিল, তাই ভয় পেয়ে আমি হাসপাতালের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে রাজা সুবোধ মল্লিক রোডের দিকে যাচ্ছিলাম। যেই আমি ক্যান্টিনের কাছে এসেছি কোথা থেকে কে জানে উনি আর নানু দুজনে আমাকে ধরল। ছুট মেরে যে পালাব শরীরে শক্তি ছিল না। চারদিন পেটে একদানা খাবার পড়েনি, শুধু জল, তার উপর আট নয়দিন আমাশা হয়ে হাসপাতালে থেকে এসেছি। কী করব, ওনারা ধরে নিয়ে গেলেন।
সেই কথাটা বললি না?
কোন কথাটা!
তোর পিঠে রিভালভার ঠেকানো হয়েছিল।
ওঃ হ্যাঁ, নানুর হাতে রিভালবার ছিল একটা, সেই ভয়ে আরও ছুটতে পারিনি, ছুটলে যদি গুলি করে। এই আর কী!
এই গল্প এতই সাধারণ যে কারোরই ঠিক মন ভরল না। কোথায় সেই রহস্য রোমাঞ্চউত্তেজনা? এদিক থেকে গুলি চলবে, গুড়ুম। ওদিক থেকে গুলি চলবে গুড়ুম। কয়েক ঘন্টা ধরে যেন গুলির বৃষ্টি হবে। যেমন সিনেমায় হয়। এরপর দত্ত মামা বুকে হেঁটে গুলি বৃষ্টি উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে গিয়ে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে ধরে ফেলবে। টানতে টানতে কামারপাড়ায় নিয়ে যাবে। এমন কিছু না ঘটায় দত্তদার মুখটা এখন মেঘের মতো কালো। আমি যেন তাকে বঞ্চিত করে দিয়েছি তার প্রাপ্য সম্মান থেকে। যেন তার পকেট থেকে হারিয়ে গেছে শেষ পারানির সম্বল। সব হারিয়ে বেচারা এখন নিঃস্ব রিক্ত–সর্বস্বহারা পথের পথিক।
আর অল্প কিছুক্ষণ সেখানে বসে কিছু এলোমেলো কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। শুধু শুধু বসে কী বা হবে কোনো গল্পই যে জমছে না। সব কেমন ছানা কেটে যাচ্ছে। গড়িয়াহাটের দিকে যেতে যেতে ক্ষুব্ধ গলায় বলে, মদ তোর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
বলি, মদ আমি আর খাই না। ছেড়ে দিয়েছি।
কবে ছাড়লি?
আঠাশে সেপ্টেম্বর উনিশো বিরানব্বই। সেদিন নিয়োগীজির অন্তিম সংস্কার হল। আমার এক বন্ধু বলল যে, নিয়োগীজিকে মদের কারবারিরা মেরেছে। তার প্রতি আমাদের এই শ্রদ্ধাঞ্জলি রইল আর মদ খাব না। সেদিন থেকে ছেড়ে দিয়েছি।
আর ছেড়ে কী হবে। যা ক্ষতি হবার সে তত হয়েই গেছে। মদে মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলে, স্মৃতিশক্তি ধ্বংস করে দেয়। তোর আর কিছু মনে রাখার ক্ষমতা নেই। যারা মদ খায় এইরকম হয়। কী সব ভুলভাল বকে গেলি। রিভালবারটা তো আমার হাতে ছিল। আমি তোর বুকে এইরকম চেপে ধরেছিলাম। আর তুই বললি নানুর নাম?
আমার মনে আছে, নানুর ডান হাতে–
বাল মনে আছে তোর। পথচলা লোকজন অস্বীকার করে দত্তদা চিৎকার করে ওঠে–আমি বলছিআমার হাতে ছিল। মেড-ইন চায়নার মাল। মোট চারখানা এসেছিল কামারপাড়ায়। আমাদের চারজনের কাছে থাকত। শিবুদা, খোকা, মোহিত আর আমি।নানু জীবনে ওই মাল চোখে দেখেছে?
একজন দুঃখী মানুষ। এই সময়কালে এই দেশে একজন সবচেয়ে দুঃখী মানুষ আমাদের দত্তদা। রামপ্রসাদের গান আছে–সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল সকলি ফুরায়ে যায় মা। জীবনে তার কত কিছু আশা ছিল সাধ ছিল কিছুই আর পূরণ হল না।
প্রথমে ভেবেছিল একজন নামকরা মস্তান হবে। সেইমতো সে হাঁটা চলা কথাবলার অভ্যাস করেছিল। তবে শুধু ওতেই তো হয় না একটা বলবান দেহও দরকার। সবল শরীরের মধ্যেই সাহসী মন নিরাপদে বাস করে। সাহসী মনের সাহায্য ছাড়া মাস্তানি মনোবৃত্তি উদ্বাহু হয়ে উড়ে যায়। দত্তদার উচ্চতা মাত্র পৌনে পাঁচ ফুট। তার উপরে দেহে নানা রকম বংশানুক্রমিক রোগের উৎপাত। ফলে হাড়ের কাঠামোয় মাংসের প্রলেপ খুবই কম। এই দেহকাণ্ড নিয়ে মেরে শেষ করে ফেলব’ হুমকি দিলে লোকে ভয় পায় না। মুখ লুকিয়ে হাসে। পরে ভাবল নেতা হবে। সে সময় অনেক মস্তানই পার্টিতে ঢুকে নেতা হচ্ছিল। তাই, সেই আশায় ঢুকে পড়ল সিপিএম পার্টিতে। কিছুদিন তাদের সাথে ঘুরে বুঝল নেতা হতে গেলে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে গর্জন করে বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা দরকার। রোগগ্রস্ত হাড় গিলগিলে শরীরে ততখানি দম নেই। একটা দুটো কথা বলার পরে বুকে হাঁপ ধরে। তাছাড়া বক্তৃতা দিতে হলে প্রচুর তথ্য তত্ত্ব সংগ্রহে রাখা দরকার। সে জন্য মোটা মোটা বই পড়তে হয়। বইটই পড়ায় ওনার চিরদিনের বিতৃষ্ণা। সেটা করলে তো কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণিটা উত্তীর্ণ হতে পারতেন।বই তো দূর, উনি ওনার পার্টির মুখপত্র গণশক্তিটাও ঠিকমতো পড়েন না। রাখতে হয়, তাই একটা রাখেন। মাসের শেষে কাগজগুঅলাকে পয়সাটা দিয়ে দেন।
নেতা হয়ে উঠতে হলে আর একটা গুণ দরকার–যাকে বলে জনসংযোগ। মানুষের কাছে যাও, তাদের কথা শোন। তাদের বিপদে আপদে বন্ধুর মতো পাশে গিয়ে দাঁড়াও। বিশ্বস্ত হয়ে ওঠো …।
ওসব করতে গেলে সঠিক সময়ে চান খাওয়া ঘুম, সব যাবে মায়ের ভোগে। আজ হাসপাতাল, কাল থানা, পরশু পঞ্চায়েত ভবন, তারপরের দিন আর কোথাও, সেই করতে গেলে ঘর সংসার, ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছু হবে বরবাদ। যাদবপুর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন স্থানে প্রায় শ’খানেক পুকুর ভেরি লিজে নিয়ে তাতে মাছের চাষ করেন। উনি যদি জনসংযোগ করে বেড়ান। সে সব কে সামলে রাখবে?
তাই, তার অনেক পরে পার্টিতে ঢুকে অনেকে অনেক উঁচু পদে চলে গেছে, উনি এখনও পড়ে আছেন এক সাধারণ সদস্য হয়ে।
জীবন এক কঠিন সাধনার নাম। জীবন এক কঠিন লড়াইয়ের নাম। সেই যে একজন লোক বলেছিল “চালাকির দ্বারা কোনো মহৎকার্য সিদ্ধ হয় না”। ফাঁকিবাজি দিয়েও জীবনের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া যায় না কোনো মহোত্তম দান। তাকে পেতে হলে এক নিরলস সাধনার দ্বারা, হার না মানা লড়াইয়ের দ্বারা প্রাপ্ত করতে হয়। যে তা পারে পৃথিবী তাকে বরণ করে নেয়, যে তা পারে না বিস্মৃত হয়ে যায়। বুদ্ধ কিংবা আলেকজান্ডার, হিটলার কিংবা লেনিনমত পথ তাদের যাই হোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু ওই উচ্চতা ছুঁতে হলে শুধু ভাগ্য হলে চলবে না, সেই ভাগ্যকে চাবুক মেরে চালিয়ে নিতে নিজের মধ্যে প্রচণ্ড পুরুষকারকে জাগাতে হয়।
দত্তদার এটাই ব্যর্থতার বড় কারণ। উনি সবকিছু বড় আরামে, অনায়াসে পেয়ে যাবেন, আশা করেছিলেন। অনেক বছর পরে যখন হিসাব নিকাশের ঝুলি উবুর করলেন, দেখলেন, শুন্য ঝুলি শূন্যই রয়ে গেছে। কাউকে দেখাবার মতো ঝুলতে কিছু অবশিষ্ট নেই।
এই ব্যর্থতা দুঃখবোধের মধ্যে সারা জীবনের সঞ্চয় আর সান্ত্বনার-সফলতার অবলম্বন ছোট সেই ঘটনাটা। যাকে স্মরণ করে তিনি নিজেকে এক মহাকাব্যের নায়ক ভেবে পুলকিত হন।
তোরা জানিস না, এই যে পার্টিটাকে আজ এতবড় দেখছিস একে এই জায়গায় নিয়ে আসার জন্য আমরা কত কী না করেছি। তখন মরব না বাঁচব সে চিন্তা করিনি। এখন আমাদের বয়েস হয়ে গেছে, যখন অল্প বয়স ছিল বাঘের মতো সাহস ছিল আমার। নাম শুনেছিস মদন। তোরা কী করে জানবি, তখন তোরা কোথায়? সে জানে তোদের বড়রা। মদন, সে একখানা জিনিস ছিল। কামারপাড়ার মধ্যে একা ঢুকে কার্তিককে চাকু মেরে চলে গিয়েছিল। মারত মণি, শিবশংকরকেও। ওরা কোনোমতে পালিয়ে প্রাণে বাঁচে।
তোরা টিবি হাসপাতালের হরেরামের নাম শুনেছিস? মার্ডার হয়েছিল।হরেরামকেবাঁচাতে গিয়ে সেইদিন সেই জায়গায় তার এক বন্ধু কী যেন নাম–সেও মারা যায়। দুজনকেই গুলি করে মারে। যে হরেরামকে গুলি করে মারে কোথায় গিয়ে লুকিয়ে ছিল জানিস? পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না–মদন তাকে খুঁজে বের করে কুপিয়ে মারে।
সেই মদন যখন নকশাল করত, ভাবতে পারিস, আমি তার বুকে রিভালবার ঠেকিয়ে তুলে সোজা কামারপাড়ার নিয়ে এসেছিলাম। তুই যদি শের হোস তো আমিও সোয়াসের। বাপের বাপ।
সত্যিই আজ আমার দত্তদার মনে কষ্ট দেওয়া ঠিক হয়নি। যেটা হয়েছে সবটা একেবারেই অজ্ঞাতসারে। আগে ভাগে একটু জানান দেওয়া থাকলে একটা স্টেজ রিহর্সাল দিয়ে মূল মঞ্চে আসতাম। কিছু চোখা চোখা সংলাপ মুখস্থ করে রাখতাম। জীবনটাই যখন নাটক, এখন না হয়। আর একটু নাটকীয় হয়ে উঠতাম।
বুঝিয়ে বলি তাকে, অনেকদিন আগের কথা তো, মনে হয় সেটা বাহাত্তর সালের ঘটনা তাই? এতদিন পরে সে সব কী আর ঠিকমতো মনে থাকে। তাই কেমন করে যেন একটু ভুলভাল হয়ে গেছে।
মেঘ সরে গিয়ে ওনার চোখেমুখে ঝলমল করে উঠল রোদ–চল! গড়িয়াহাট থেকে বাসে করে আমরা এসে নামলাম বাঘাযতীন মোড়ে। এলাম আর এক বাড়িতে। এখানে তার এক অতি পরিচিত মহিলা থাকে। সে এক অঙ্গনওয়ারি শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষিকা।
এই মহিলার সঙ্গে মেলামেশা দত্তদার বউ মেয়ে যেমন সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি, পারেনি এই মহিলার স্বামীও। পুকুরে জাল দিয়ে বড় মাছটা এ বাড়িতে দিতে আসা দু পক্ষেরই অপছন্দের।
তবে স্বামী বেচারার দত্তদাকে যতই অসহ্য লাগুক কিছু বলতে পারে না চোখ কুঁচকে তাকানো ছাড়া। সিপিএম পার্টির সদস্য মানে দারোগার মত পাওয়ার। বিপদে ফেলতে কতক্ষণ।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে দত্তদা এমন হাঁকডাক শুরু করে দিলেন যেন বাড়ির কর্তা অফিস থেকে বাড়ি ফিরল। মহিলার শাশুড়ির জন্য কিছু ফল পাকুড় এনে ছিলেন, ডেকে সেগুলো তাকে দিলেন দত্তদা। বললেন–মা, তোমাকে সামনের মাসে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। মহিলার মেয়েকে কাছে ডেকে গাল টিপে আদর করে হাতে ক্যাডবেরি দিলেন। মহিলাকে বললেন তোমার জন্য কিছু আনিনি, পাওনা থাকুক। পরে দেব। সে কথায় মহিলা মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন-কবে? পুকুরে যেদিন জাল নামাবে? কেন কে জানে এ কথায় দত্তদা লজ্জিত হলেন।
এইসব টুকটাক একথা সে কথার পরে শুরু করে সেই কথা। যে কথা বলার জন্য এই সময়ে এখানে ছুটে আসা। শুরুটা এই রকম–একে চেনো? এক সময়ে এই অঞ্চলে নামকরা মাস্তান ছিল। বাঘাযতীন থেকে যাদবপুর, ওদিকে পালবাজার থেকে সেলিমপুর–এক ডাকে সবাই চিনত। এর নাম মদন। শুনেছ নাম? কী করে শুনবে, তোমরা এখানে আসার অল্প কয়েক মাস আগে ও ছত্তিশগড়ে চলে যায়। চার পাঁচটা থানা লালবাজার সব ওকে খুঁজছিল। ধরলেই গুলি। আশু মজুমদারের ডান হাত ছিল যে। একটু থেমে চোখে মুখে একটা আত্মপ্রসাদ এনে ফের বলে সে, পুলিশ যা পারেনি, আমাদের পার্টির কেউ যা পারেনি সেটা করেছিল এই দত্ত। ওকে যাদবপুর স্টেশন থেকে ধরে মাথায় রিভালবার ঠেকিয়ে সোজা কামারপাড়ায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। বল, নিয়ে যাইনি?
এখন আর কথা নয়, নাটকের এক চরিত্রের মতো ডান হাতের তর্জনিটা ট্রিগার টানার ভঙ্গিতে বাঁকা করে সেটা সজোরে আমার কানের পাশে রগের উপর চেপে ধরল। এই ভাবে–জায়গাটা ব্যথায় টনটন করে উঠল আমার।
হাত সেইভাবে চেপে রেখে দত্তদা গর্জে ওঠেন, যদি পালাবার চেষ্টা করত, খুলি উড়িয়ে দিতাম। বলেও দিয়েছিলাম, বাঞ্চেৎ চুপচাপ চল। যদি না যাস, যদি চেল্লাস কুকুরের মতো গুলি করে মারব। কোন বাপ আজ তোকে বাঁচাতে পারবে না।
হাত সরিয়ে নিয়ে এবার আমাকে হুকুম করেন, বলতো, সেদিন কীভাবে তোকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম, তুই তোর নিজের মুখেই বল। এ তাও
দত্তদা জানেন না, তার জানবার কথা নয় যে আমি এক সময় গল্প লিখতাম। শহর কলকাতার এবং জেলারও অনেক কাগজে আমার লেখা ছাপা হয়েছিল। পত্র পত্রিকার কারণে বহু মানুষ জানত যাদবপুরের এক রিক্সাওয়ালা লেখে।
এখন আমি দত্তদাকে সন্তুষ্ট করবার চেষ্টায় একখানা জব্বর শিকার এবং শিকারি বিষয়ক কাহিনীর নির্মাণ করি। আমি যেন এক ভয়ঙ্কর অরণ্য গভীরে থাকা নরখাদক। যে মাঝে মাঝে বন থেকে বের হয়ে এসে হানা দেয় লোকালয়ে আর তুলে নিয়ে যায় ঘুম কাতর মানুষ। এইভাবে কত যে মানুষ খেয়েছি গুনেও রাখিনি।
আর আমাদের পৌনে পাঁচ ফুট দত্তদা হচ্ছেন সেই শিকারি যে আমাকে মারবার জন্য মেড-ইন-চায়নার একটা ছ’ঘড়া রিভালবার নিয়ে প্রাণ হাতে করে সেই জঙ্গলে ঢুকেছে। সে যে কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার। কখনও বাঘ আগে শিকারি পিছনে, কখনও শিকারি আগে বাঘ পিছনে। কে যে কার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কিছু ঠিক নেই। যে আগে কঁপাতে পারবে সে জয়ী হবে। যে একটু হিসাবে ভুল করবে তার মৃত্যু অবধারিত। জীবন মরণের খেলা, এখানে দয়াক্ষমার কোন প্রশ্নই নেই।
বলে চলি আমি, একবার খবর পেলাম যে উনি, নয় নাম্বার বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন। একা। ওনার তো খুব সাহস ছিল, যেখানে যেতেন সবখানে একাই চলে যেতেন। তো আমরা আট জনের একটা দল বানিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে চলে এলাম নয় নাম্বার বাসস্ট্যান্ডে। আমাদের কাছে দুটো হেভি বোমাও ছিল। দূর থেকে দেখলাম খবর পাক্কা। উনি দাঁড়িয়ে আছেন মেঘনার সামনে। খইনি ডলছেন। তখন খইনি খেতেন। এখন খান? ব্যাস ছুড়লাম একটা বোমা। আমাদের ভাগ্য খারাপ না ওনার ভাগ্য ভালো তা জানিনা, বোমাটা ফাটল না। সাথে সাথে আর একটা ছুড়লাম, সেটা পিছলে মেঘনার মধ্যে ঢুকে গেল, সেখানেইফাটল। শোকেস-ফোকেস সব চুরমার।
তারপর? প্রশ্নটা মহিলার বাচ্চা মেয়ের।
আমরা তো বোমা মেরেই ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর যে কী হল কী করে জানব। তারপর আপনি কী করলেন দত্তদা?
আমার একটুখানি জিরোনো দরকার। অনেক খেলিয়েছি। মুখ ব্যথা হয়ে গেল। এবার সে খেলুক। গল্পের বলটা দত্তদার গোলে ঠেলে দিলাম। উনি লুফে নিলেন। তারপর সে যা বলে শুনে সারা শরীর কেঁপে ওঠেআমার।কীবরাত জোরে বেঁচে গেছি সেদিন। জানতে পারি দশ সেকেন্ড-মাত্র দশটা সেকেন্ড পালিয়ে যেতে দেরি করলে আট জনই লাশ হয়ে যেতাম। প্রথম বোমটা পড়ার পর দত্তদা একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। কী পড়ল ওটা? পরের বোমাটা পড়ার সাথে সাথে বুঝে যান ব্যাপারটা। আর চকিতে কোমর থেকে হাতে তুলে নেন থ্রি এইট ক্যালিভারের মেড-ইন চায়না। ধাওয়া করে যান আমাদের দিকে লেভেল ক্রশিং পর্যন্ত। সেদিন তার কোমর থেকে হাত পর্যন্ত রিভালবার উঠে আসতে যেটুকু সময়–সেই সময়টুকু এগিয়ে থাকায় উনি আমাদের রিভালবারের রেঞ্জে পাননি। না হলে সব কটাকে শুইয়ে দিতেন।
এইভাবে গল্প এগিয়ে চলে শেষ পরিণতির দিকে। বলে চলেন তিনি-কী ভেবেছিলি সেদিন, আমাকে এ্যাটাক করে পার পেয়ে যাবি? পারলি? আমি সেইদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি তুই দশ হাত মাটির তলে গিয়েও লুকাস, আমি তোকে টেনে বের করব।
একটু থামলেন তিনি। একটু হাসলেন–বুঝলে রমা, ওকে ধরে তো নিয়ে গেলাম। নিয়ে গিয়ে ভাবলাম–মেরে তো ফেলতেই পারি সেটা কোনো ব্যাপার না। শত হলেও গরিব ঘরের ছেলে। কেউ ওকে ভুল বুঝিয়ে ওই পথে নিয়ে গেছে। যদি একটা চানস দিই, যদি কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক বুঝতে পারে আমাদের একজন লোক বাড়বে। তাই শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলাম।
শেষ পর্যন্ত তাহলে গল্পটা, না না গল্প নয় সত্যি কাহিনিটা এই দাঁড়াল যে উনি আমাকে ধরে নিয়ে যান এবং উনিই আমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসেন। আর যেভাবে জেনারেল নিয়াজি পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে মেজর জেনারেল মানেকশার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল–আমি স্বীকার করে ছিলাম দত্তদার বশ্যতা। সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম–আজ থেকে আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব। ন্যায় অন্যায় বুঝি না, আপনার হুকুম হলে দিনকে রাত বানিয়ে দেব।
সেদিন সেইরাতে সেই বাড়িতে বসে লক্ষ লক্ষ মিথ্যা এই জন্য বলতে হচ্ছিল শুনতে হচ্ছিল, শুনে দাঁত কেলাতে হচ্ছিল–দত্তদা আনন্দ পাচ্ছেন। তিনি আনন্দ পেলে আমাকেও আনন্দিত হবার ব্যবস্থা করে দেবেন, পাইয়ে দেবেন একটা কাজ। যে কাজে মাইনে মেলে। যে মাইনেয় খেয়ে পরে বেঁচে থাকা যায়। আর তা হলে আমি আমার বউ বাচ্চাদের সেই আদিম অরণ্য থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারব আধুনিক শহরে। বাংলার কোনো এক কুঁড়ে ঘরে। আবার ওরা বাংলার জলমাটি হাওয়া গায়ে মেখে বাঙালি হয়ে উঠতে পারবে। বাংলা ভাষায় কথা বলবে বাংলায় হাসবে বাংলা স্বপ্ন দেখবে।
আমার বন্ধু দিবারাত্রির কাব্য পত্রিকার সম্পাদক আফিফ ফুয়াদ একবার দণ্ডকারণ্যে আমার ঠিকানায় আমাকে খুঁজতে গিয়েছিল। চারপাঁচ দিন ছিল আমার ওখানে। তখন সে আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখে বড় কষ্ট পেয়েছিল। ওরা আর বাংলায় কথা বলতে পারে না। যে ভাষায় কথা বলে সে বাংলা হিন্দি ছত্তিশগড়ি আর গোণ্ডবুলির এক জগাখিচুড়ি। দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বলেছিল ফুয়াদ–এ কী করলে মদনদা, ছেলেমেয়ে দুটোকে আদিবাসী বানিয়ে দিলে।
আদিবাসী আমার কাছে এক সম্মানীয় শব্দ। এক সহজ সরল অনাবিল জীবন। বাংলার এক কবি সেই জীবন চেয়ে করুণ স্বরে বলে ছিলেন দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ এ নগর। নাগরিক সভ্যতার নাগপাশ ছিঁড়ে সে জীবনে যুক্ত হওয়া সোজা কথা নয়। আমার চেনা একজনই তা পেয়েছিলেন তিনি শঙ্কর গুহনিয়োগী।
আমি পারিনি। আজও আমার মন কাঁদে বাংলাদেশ বাংলা ভাষা বাঙালি সাহিত্য সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতা মহানগরের জন্য। আমার মনেহয় আমার ছেলেমেয়েকে সেই মহান উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। ওদের জন্যই আমার বড় কষ্ট। এখন আমার একটাই কামনা–ওদের শেকড়ের কাছে নিয়ে আসা। বাঙালি হয়ে উঠতে সাহায্য করা। এই কারণে হজম করে চলি এক আত্মপূজা-আত্মস্তুতি ভরা বাঁচাল বাখান।
অনেক রাত তখন। তা প্রায় দশটা তো হবেই। গল্প শেষ হবার পর পথে বের হই আমরা। দত্তদা এখন খুবই তৃপ্ত। খুউব খুশি। হাঁটতে হাঁটতে বলেন তিনি, যার কাছে তোকে নিয়ে যাব বলেছিলাম, আজ তো যাওয়া হল না। কাল নিয়ে যাব। কাল সকাল সাতটার মধ্যে আমার বাড়ি চলে আয়।
রাতে ফিরে এলাম সুভাষগ্রাম–গণেশের বাড়ি। আমিই কিছু টাকা দিলাম আমাদের খাবার খরচা। গণেশ কিছুতে নেবে না। বললাম টাকা না নিলে খাব না। শেষে নিল।
রাতটা সেখানে কাটিয়ে পরের দিন আবর এলাম দত্তদার বাড়ি। আজ উনি আমাকে নিয়ে গেলেন এক বৃদ্ধার কাছে। যাকে এই অঞ্চলের ছোট বড় সব সিপিএম বড়মা বলে ডাকে। বড়মার ছেলে বলা বাহুল্য এক বড় নেতা। বড় নেতার বাড়িখানাও বড়। সেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার আর এক বাড়ি। তারপর আর এক বাড়ি। এরা সব নেতা। প্রতিবার প্রত্যেকটা বাড়িতে সেই এক গল্প ফেনিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলিয়ে বলা হচ্ছে। অভিনয় করে দেখানো হচ্ছে। আমি এক সময় দিন কয়েক বিজন ভট্টাচার্যের পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যের নাটকের দল নবান্নতে যুক্ত হয়েছিলাম। ‘দেবী গর্জন’ নাটকে অভিনয় করেছিলাম। সেই শিক্ষা এখন বেশ কাজে লেগে যাচ্ছে।
সেদিনও তার কাছে যাওয়া হল না যার কাছে গেলে আমি একটা কাজ পেতে পারি। সকাল দুপুর হলে দত্তদার বাড়ি এসে, সেখানে খেয়ে, একটু বিশ্রাম নিয়ে ফের বিকেল নাগাদ যেতে হয় আর এক বাড়িতে গল্পের ঝুলি নিয়ে। সেখান থেকে আবার আর এক বাড়ি। প্রতিবার সেই গল্পে কিছু না কিছু নতুন সংযোজন করে পরিবেশন করে গেলাম দক্ষ কথক ঠাকুরের মতো অঙ্গভঙ্গি সহকারে।
এইভাবে চার পাঁচ দিন কেটে গেল। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটায় আসি, রাত দশটায় ফিরে, যাই। বকর বকর করতে করতে মুখ ব্যথা হয়ে গেল আমার। যেটা একটা ছোট গল্প ছিল তা এখন থানইট মার্কা উপন্যাস। আর ভালো লাগে না। ওদিকে কেনারাম সেও বিরক্ত হয়ে উঠেছে। এসেছিল বাংলাদেশটাকে একটু নয়নভরে দেখতে, এখন তাকে সারাদিন একা একঘরে লকআপে বন্দী আসামির মতো শুয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।
গণেশ এখন সকাল বেলায় রিক্সা চালাতে চলে যায়। তার বউ যায় রান্নার কাজে। একটা ছেলে একটা মেয়ে, তারা যায় স্কুলে। ফাঁকা বাড়িতে একা কেনারাম কী করে সময় কাটাবে? ক্ষুব্ধ গলায় বলে সে–আর বাংলা দেখার দরকার নেই, এবার বাড়ি যাব।
শেষে একদিন অধৈর্য হয়ে বলি, কী হল দত্তদা, কার কাছে যেন আমাকে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন। যাবেন না?
দত্তদা মানব চরিত্র সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান রাখেন। তিনি জানেন খুড়োর কলের অপার মহিমা। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল কোনো একটা ছলছুতোয় প্রলোভনের শেকলে বেঁধে দিন কয়েক আমাকে আটকে রেখে আমারই স্বকণ্ঠে তার সেই বীর কথন পরিচিতজনের মধ্যে প্রচার দ্বারা এইটেই প্রমাণ রাখা যে উনি একদা যোদ্ধা ছিলেন। আজকের পার্টিটা দাঁড়িয়ে আছে তাদের সেই কর্মকাণ্ডের ভিত্তিমূলে।
সে কাজ সারা হয়ে গেছে। এখন আর তার এমন কোনো পরিচিত মুখ মনে পড়ছে না, যার কাছেগিয়ে এই গল্প শোনানোয় কোনো লাভ আছে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক সূত্র ব্যবহারিক মূল্যে। এখন আর আমাকে ব্যবহার করার সুযোগ নেই। ফলে আমি থাকলাম, না গেলাম একই গুরুত্বের।
আমার কথায় যেন একটু বিব্রত বোধ করেন দত্তদা। দিয়ে ফেলা প্রতিশ্রুতি থেকে পরিত্রাণের পথ খোঁজেন। বলেন, দ্যাখ, তোকে বলেছিলাম নিয়ে যাব। সে তো যেতেই পারি, কোনো ব্যাপার না। ভাবছি যদি মুখের উপর না বলে দেয়, তখন কী হবে!
তখন কী হবে! কী আর হবে? সজোরে বলি, আমার বোঁচকা বাঁধা আছে। সেনা বলবে, আমি গিয়ে ট্রেনে চেপে বসব। চলে যাব যেখানের লোক সেখানে। এখানে থাকার জন্য তো আসিনি। এসে ছিলাম একটু ঘুরতে। থাকার যদি সুযোগ পাই–ভালো। না পাই আরও ভালো। আপনি একবার নিয়ে তো এবার হাসি ফোটে দত্তদার মুখে। চোখ চকচক করে। যে আত্মগ্লানি তাকে পীড়ন করেছিল তা থেকে অনায়াসে মুক্তি পেয়ে গেছেন। বলেন, তা হলে ঠিক আছে। আজকের সন্ধেবেলায় নিয়ে যাব তার কাছে। সে অনেককে কাজ দিয়েছে। দেবার ক্ষমতা আছে তার। ইচ্ছা করলে তোকেও দিয়ে দিতে পারে। যদি ভাগ্য ভালো থাকে পেয়ে যাবি। দ্যাখ কী হয়।
কার কাছে নিয়ে যাবেন আমাকে? নাম কী?
তুই তাকে চিনিস। গেলেই দেখবি।
তবু! নামটা বলেন না?
বড় সাহেব।
বড় সাহেব! অনেক আগে তখন আমি খুব ছোট, তবু মনে আছে আমার সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির একজন আর একজনকে দেখা হলেই কমরেড বলে সম্বোধন করত। এটা তাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় সম্ভাষণ ছিল। যে বলত আর যাকে বলা হতো দুজনের বুকে কী যেন এক মাদলের গুড়গুড় বাজত। এই সম্ভাষণের মধ্য দিয়ে একটা সুমহান বার্তা ছড়িয়ে যেত চারিধারে। শোষণ শাসন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে যে যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে–যার সর্বশেষ পরিণাম আমূল পরিবর্তন-বিপ্লব, সেই বিপ্লবী যুদ্ধের, শেষ যুদ্ধের আমরা সৈনিক।
সে কাল কবে চলে গেছে। সে যেন এক বিস্মৃত অতীত। আর কোন কমিউনিস্ট–যাদের আমরা আমাদের চারপাশে ঘুরতে দেখি–কেউ আর কাউকে হৃদয়ের উত্তাপ মিশিয়ে সেই গালভরা নাম–কমরেড বলে ডাকে না।
মনে আছে আমার, এখনও মনে আছে সেই দিনটার কথা যেদিন একজন আমাদের কমরেড বলে ডেকেছিল। সেদিন গর্বে বুকটা যেন দশহাত ফুলে গিয়েছিল আমার। সেইদিন তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কমরেড কথার অর্থ আর বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয় প্রতিক্রিয়াশীল কাকে বলে। বোড়ালের ওদিক থেকে সাদা পায়জামা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি কাঁধে সাইড ব্যাগ নিয়ে তিনি এসেছিলেন। বিড়ি চেয়ে খেয়েছিলেন আমার কাছ থেকে। আর ফিরে যাবার সময় দোতলা বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন–চলি কমরেড।সবার দেখাদেখি আমিও মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলেছিলাম।
সেই বিগত কালে বলা হয়েছিল–প্রত্যেকটি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীকে অবশ্যই ডি-ক্লাসড হতে হবে। বর্ণ ব্যবস্থায় যেমন চতুর্থবর্ণ–অর্থাৎ শুদ্ৰশ্রেণির মানুষ, বাম রাজনীতিতে ডি-ক্লাসড় মানে যারা কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবন নির্বাহন করেন। প্রত্যেকটি পার্টি কর্মীর বাক্যে ব্যবহারে মননে, শ্রদ্ধা এবং সম্মানীয় স্থানে সর্বোচ্চ স্থান থাকবে শ্রম জীবনের প্রতিশ্ৰম পুত্রদের প্রতি। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকশ্রেণির পার্টি।
তখন বামপন্থীরা ক্ষমতার স্বাদ পায়নি। চরণদাস চোর যখন প্রতিজ্ঞা করেছিল রাণীকে বিয়ে করবে না, সোনার থালায় ভাত খাবে না, হতিতে চড়বে না–তখন তার দূরতম কল্পনাতে ছিল না যে, কোনোদিন এমন অবস্থা আসতে পারে। তাই প্রতিজ্ঞা করা সহজ হয়েছিল। যেমন বামপন্থীরা জানত না একদিন রাজ সিংহাসনে বসবে। তখন এদের ডালভাতের জোগান আসত শ্রমিকদের চাঁদার টাকায়। তাই তাদের মন ভোলানো একটা দুটো বাণী। যার মধ্যে একটা চটক ছিল সদিচ্ছা ছিল না।
এইসব পার্টিতে যেসব নেতা–তারা এসেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। মনের গোপন অন্দরে লালসা ছিল উচ্চে যাবার। যেদিন তারা ক্ষমতা হাতে পেল–পার্টি আর সরকারি ক্ষমতা, দুটোকে সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে এক একজন হয়ে গেল এক একটা ধনকুবের। যারা একদিন জবরদখল কলোনির দরমার ঘরে বাস করত, এখন তারা কে যে কত হাজার কোটির মালিক সে জানে বিদেশের ব্যাঙ্ক।
এই নেতাও তাই। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এপার বাংলায় এসে এনার বাবা কালীঘাটের এক ডালার দোকানে কাজ করতেন। শোনা যায়, বাবা মারা গেলে তাকে দাহ করে শ্মশান থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন এই নেতা। বাস ভাড়ার দশ পয়সাও কাছে ছিল না।
আর এখন? চল্লিশ বছর পার্টি করার পর যত টাকার তিনি মালিক পশ্চিমবঙ্গের কতজন শিল্পপতির তা আছে কে জানে! ইনি এখন আর ডি ক্লাস, কমরেড এই সব পাতি শব্দ পছন্দ করেন না। তাই সাহেব। বড় সাহেব।
এক সময় এ দেশেইংরেজ শাসন ছিল। লোকে ইংরেজদের সাহেব বলত। সাহেব এই শব্দটার সাথে জড়িয়ে আছে ভয় মিশ্রিত সম। সাহেব মানে শাসক, কোনো হেঁজিপেঁজি লোক নয়।
এদেশের মানুষ দুশো বছর গোলাম ছিল। বাঙালি রক্তধারায় সেই গোলামির বীজ আজও সুপ্তাকারে বিদ্যমান। এরা একজন স্বাধীন কৃষিজীবীর চেয়ে চাকরিকে বেশি সম্মানের মনে করে। চাকরি যে চাকর বৃত্তি এটা তাদের মনেও থাকে না। সেই গোলাম সুলভ মানসিকতা থেকে চাটুকার প্রবৃত্তি থেকে এরা ওই নেতাকে বড় সাহেব বলে ডাকে। শুনে নেতা খুশি হন।
এখন সব বাম নেতাদের জীবনে বিপ্লব–অর্থাৎ আমূল পরিবর্তন এসে গেছে। অন্য কোন বিপ্লব তাদের দরকার নেই। এখন এসি বসানো ঘরে বাস করেন। এসি গাড়িতে ভ্রমণ করেন। কোথাও নামতে হলে ড্রাইভার আগে নেমে দরজা খুলে দেয়। বড় বড় অফিসার স্যালুট মারে। আগে পিছে বডিগার্ড ঘোরে। পুরো দস্তুর সাহেবি জীবন। আর তিনি শোষিত নন–শাসনকর্তা।
.
সেদিন আর অন্যথা করলেন না, দত্তদা আমাকে নিয়ে গেলেন সেই বড় সাহেবের দরবারে।
তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। আমি আর দত্তদা গিয়ে পৌঁছেছিশহরের কলরব কোলাহল থেকে বেশ খানিকটা দূরে বাইপাশের সন্নিকটে এক স্টেডিয়ামে। চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। অনেক গাছগাছালি। আলো আছে প্রচুর তবে সেই গাছগাছালির কারণে এখানে ওখানে জমাট বেঁধে আছে চাপ চাপ অন্ধকার। এখানে এসে এই সময় জায়গাটাকে কেন কে জানে ভীতিকারক বলে মনে হল। সেই যেমন কোনো পাহাড়ি স্টেশনে গভীর রাতের নির্জনতায় গা ছমছম করে, তেমনই এক অজানা ভয় আঁকড়ে ধরল আমাকে। মনে হল যেন ওই সব অন্ধকারে কোনো অতৃপ্ত বিদেহী আত্মা বসে আছে। কাঁদছেনিঃশব্দে। তার বেদনা বিধুর তপ্ত নিঃশ্বাস বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
এখানে অল্প কিছু লোক আছে। কর্মচারি বলে মনে হয়। তারা চারদিকে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হয় সব যেন এক প্রেতপুরীর বাসিন্দা। মাটি থেকে কিছুটা শুন্যে তাদের জোড়া জোড়া পা ভাসছে, ছায়া মানুষের মতো তারা দূর থেকে দুরে সরে সরে যাচ্ছে।
বড় সাহেব রোজ সন্ধ্যায় এখানে আসেন, অনেক রাত অবধি থাকেন। বিশেষ বিশেষ লোকের সাথে বিশেষ পরামর্শ করেন। আগামীকাল কী ঘটবে তারই পরিকল্পনা রচেন। সব মানুষেরই ক্ষুধাতৃষ্ণা ঘুম আছে, জৈবিক তাড়না আছে, প্রিয়স্থান পছন্দের গান আছে। সেই রকম শহরের শব্দ দূষণ থেকে দুরে কিছুটা নির্জন কিছুটা নিরিবিলি–এই জায়গাটা বড় সাহেবের বড় প্রিয়। উনি এখানে এসে মনে বড় শান্তি পান।
আমার ব্যাপারটা ভিন্ন। আমি এই স্টেডিয়ামের জন্ম রহস্যের নেপথ্য ইতিহাস কিছুটা জানি। অনেক রক্তপাতময় সেই ইতিহাস। এই স্টেডিয়ামের নামের সাথে জড়িয়ে আছে আঠারোজন অবধূত সন্ন্যাসীর জীবন্ত দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারাবার সেই মর্মন্তুদ কাহিনি। আমার সেই ৮২-র দাউ দাউ দেহ নিয়ে ছুটে বেড়ানো মানুষগুলোর আর্ত মখগুলো চোখের সামনে ভাসে। তাই বুকটা বড় পোড়ে।
আমি আর বেঁটে খাটো দত্তদা দাঁড়িয়ে থাকি গাড়ি পার্কিং-এর জায়গায়। বড় সাহেব যখন বাড়ি যাবেন তখনই আমরা গিয়ে দাঁড়াব তার সামনে। এখন উনি দেখা দেবেন না। জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন।
রাত বাড়ছে, আমাদের চারপাশে ঘনগাঢ় হচ্ছে এই শতাব্দীর তীব্র অন্ধকার। দমচাপা অশরীরী অবয়ব অস্বস্তি আমাকে ছিন্নভিন্ন করছে। বুঝতে পারছি না কী ঘটবে। মনে হচ্ছে কিছু একটা নিশ্চয় ঘটে যাবে আজ। অনেকক্ষণের অধৈর্য অপেক্ষার পর দেখতে পেলাম একটা দরজা খুলে গেল। বের হয়ে এলেন বড় সাহেব। ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন গাড়ি পার্কিং-এর জায়গায়।
আমি এই সাহেবকে চিনি যখন তিনি সাহেব হননি সেই ৬৪ সাল থেকে। বলতে গেলে আমি তো এই যাদবপুরেরই মানুষ। সেই যে বাল্যকালে এখানে এসেছিলাম আর ফিরে যাওয়া হয়নি। তাই এখন ওনাকে দেখে সারা শরীরে কেমন একটা অস্থির স্পন্দন অনুভব হল। তিনি ফিনফিনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে আছেন। সেইপোষাককে আমার মনে হল টকটকে লাল। যেন বহু মানুষের রক্তে ভিজে চুপচুপে। আমার চোখের সামনে সারি দিয়ে উঠে এল অসংখ্য মৃত মানুষের মুখ। তাদের সবাইকে চিনি না, কাউকে কাউকে চিনি।
উনি দত্তদাকে চেনেন। দূর থেকে চোখ কুঁচকে তাকালেন আমাদের দিকে। আমি ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠলাম। আশঙ্কায় দুলে উঠল আমার মন–আমাকে চেনে নাকি! যদি চেনে, আর কী কাজ দেবে?
কী ব্যাপার রে? কাছে এসে দত্তদাকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি।
একটু তোমার কাছে এসেছি। একটা কথা বলতাম।
কী কথা তাড়াতাড়ি বল।
এই ছেলেটা আমার চেনা। আমাকে দেখান দত্তদা, একে একটা কাজে লাগিয়ে দাও।
কী কাজ?
যে কাজ হোক খাটুনে ছেলে, সব কাজ পারবে।
বাড়ি কোথায়? ভালো করে চিনিস তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ স্টেশনে রিক্সা চালাত, স্টেশনেই থাকত।
দত্তদাকে নিয়ে বড় সাহেবের এই এক ভয়, যাকে তাকে যেখান সেখান থেকে ধরে নিয়ে এসে বলে–আমার অনেকদিনের চেনা। সেই সত্তরের দশকে কোথা থেকে কে জানে কল্যাণ নামের একটা ছেলেকে পাড়াছাড়া পার্টি কর্মীদের কামারপাড়ার শেল্টারে রেখে দিয়েছিল। একদিন সে সুযোগ বুঝে ছয় হাজার টাকা আর দুখানা রিভালবার নিয়ে পালায়। কিছুদিন পরে সেই রিভলবার দিয়ে আসানসোলে এক ব্যাঙ্কে ডাকাতি করে ধরা পড়ে। তবে সে একটাই ভালো কাজ করেছিল
অস্ত্র কোথা থেকে পেয়েছে পুলিশকে বলেনি। সেটা বললে মহা কেলো হয়ে যেত।
এখন দত্তদার জবাবে নিঃশঙ্ক হয়ে বলেন তিনি, কী কাজ দেব বল দেখি! তারপর হঠাৎ কী যেন ভেবে বলেন–রান্না জানে?
এবার আমি জবাব দিই, জানি।
আমি যে রান্নাও করতে জানি সেটা দত্তদা কী করে জানবেন! তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে একটা বিস্ময়।
সিডিউল কাস্ট?
আমি যে সিডিউল কাস্ট, আমার নাম যে মদন দত্ত নয়, মনোরঞ্জন ব্যাপারী সেটাও দত্তদার জানবার কথা নয়। সেই কবে কতকাল আগে এক বুড়ো রাঁধুনি নরেশ ঠাকুরের সাথে এক অনুষ্ঠান বাড়িতে রান্নার কাজে গেলে যে বলেছিল নামটা বদলে বলিস, নাহলে উঁচু জাতের লোক তোর হাতে জল খাবে না। তাই মদন দত্ত হয়েছিলাম, সে কাজটা ছেড়েছি অনেক দিন আগে, নামটা আমাকে কিছুতে ছাড়ছিল না।
বড় সাহেব প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। জবাব আমিই দিলাম–সিডিউল কাস্ট।
সেই যে এক দাড়িঅলা বুড়ো বলেছেন জীবনের ধন, কিছুই যাবে না ফেলা। আজ মনে হচ্ছে সত্যিই ফেলা যায় না। তখন আমার বয়স উনিশ কুড়ি সেই সময় নরেশ ঠাকুরের সাথে কাজে যেতাম। তার কাছেই শিখেছিলাম বিবিধ রান্না। তারপর এক গ্রাম্য বামুনবাড়ি নাম ভঁড়িয়ে রান্না করে ধরা পড়ে অপমান অপদস্ত হয়ে ক্ষোভে দুঃখে সে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আজ জীবনের এক কঠিন মোড়ে এসে সেই বিদ্যা যে এমন উপকারে আসবে তা কী কোনোদিন ভাবতে পেরেছিলাম। হ্যাঁ, আমি রান্না জানি, বলার সময় তাই আমার গলা কেঁপে ওঠেনি।
দত্তদা আমার অনেক কিছু জানে, চা দোকানে গেলাস ধুয়েছি মুটে মজুর খেটেছি, রিক্সা চালিয়েছি, বোমা ছুঁড়েছি, জেল খেটেছি। এই প্রথম জানল আমি রান্নাও করেছি।
দেখি বড় সাহেবের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। যেন হারানিধি খুঁজে পেয়ে গেছেন। হয়ত এখন ওনার ইচ্ছে করছে ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। তবে সেটা পদমর্যাদার পক্ষে শোভন হবে না এই বিবেচনায় সংযত থাকেন।
যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখেন বিশেষ করে বৈষ্ণব ধর্মমতের তারা বলে থাকেন–ভক্ত যেমন পাহাড়ে জঙ্গলে তীর্থে শ্মশানে পাগল হয়ে ভগবানকে খুঁজে বেড়ায়, ভগবানও অনুরূপভাবে হন্যে হয়ে খুঁজে ফেরে তার প্রকৃত ভক্তকে। পেলেই বুকে তুলে নেন।ঠিক সেইভাবে আমি যেমন একটা কাজ পাবার আশায় পায়ের চপ্পল ক্ষুইয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি, একটা কাজও দেখি আমার জন্য কাম কাতর কামিনীর মতো দুবাহু তুলে দাঁড়িয়ে আছে, এসো সবল, এসো সক্ষম, আমাকে গ্রহণ করো।
সেই কবে থেকে শুনে আসছি–এই পোড়া পশ্চিমবঙ্গে নাকি লক্ষ লক্ষ লোক বেকার। তারা যেমন তেমন একটা কাজ পাবার জন্য পাগলের মতো পায়ের চটি ক্ষয় করে এদিকে ওদিকে ছুটে মরছে। এই তথ্য যদি সত্য হয় তবে এই বঙ্গে যে পত্রিকার ষাট লক্ষ গ্রাহক, যেখানে মাত্র দশ সেন্টিমিটার একটা বিজ্ঞাপনের ধার্য মূল্য নাকি দশ হাজার, যেখানে বিজ্ঞাপন দিয়ে কেউ কেউ কাতর আবেদন জানায় কেন? এসো হে বেকার যুবকগণ প্রচুর কর্মখালি আছে, লোভনীয় বেতন–তোমরা এসে চাকরিটা গ্রহণ করে আমাকে উদ্ধার করো–এটাও তো সত্য। একজন কাজ খুঁজছে পাচ্ছে না, একজন কর্মী খুঁজছে পাচ্ছে না, এই দুই সত্যের মধ্যে আছে সেই মহাসত্য–যাকে বুঝতে হলে সত্যকে শব-চোরাই টেবিলে চিৎ করে ফেলে চিরে চিরে দেখতে হবে।
এই বড় সাহেব বহুঁকায়লিশ বছর পার্টি করছেন। এক সাধারণ সদস্য থেকে পরিণত হয়েছেন ডাকাবুকো প্রথম সারির নেতায়। এর জন্য তিনি কত কী না করেছেন। যেটা করা হয়নি সেটা হল জনসেবা। এবার তিনি সেটাই করবেন। সেই উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছেন একটা প্রতিবন্ধীদের জন্য সংগঠন। সেই সংগঠনের অধীনে গড়ে তোলা হয়েছে মুক এবং বধিরদের জন্য একটা আবাসিক স্কুল।
শহরের সীমার বাইরে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বছর খানেক আগে, এই স্কুলের যেখানে স্থাপনা করা হয়েছে, সেখানকার অধিকাংশ মানুষই বড় গরিব। দিন আনি দিন খাই লোক। এদের কেউ রিক্সা চালায়, ভ্যান চালায় জনমজুর খাটে কেউ কেউ অনুষ্ঠান বাড়িতে রান্নার কাজও করে। এদের স্ত্রী মেয়ে যায় বাবুর বাড়ি বাসন মাজতে কাপড় কাঁচতে রান্নার কাজ করতে।নারী পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ কোথাও কোনো ছোট ছোট কারখানায় সাপ্তাহিক মজুরিতে কাজ করে। এমন একটা দুঃস্থ দরিদ্র অঞ্চলে একটা স্কুলের কাজে লোক পাওয়া যাচ্ছে না এর কারণ কী?
পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ সেই কর্মীকে এখন শুধু কাজই করে যেতে হবে, কোনো মাইনে পত্র হাতে পাবে না। পাবে সেদিন–যেদিন সরকার দেবে। কবে দেবে সরকার? না, তা এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। সেই কর্মীর নামধাম–কাগজ পত্র বিকাশ ভবনে পাঠানো হবে। পাঠাবে স্কুলই। বলা হবে এই হচ্ছে হোস্টেলের কুক। তখন সরকার তাকে স্বীকৃতি দিলে বেতন পাঠাবে, তবেই সে বেতন পাবে।
এ যেন সেই গাছ পুঁতে ফলের আশায় পেটে গামছা বেঁধে বসে থাকার মতো ব্যাপার। কবে গাছ বড় হবে, কবে ফল ধরবে তারপর সেই ফল পাকবে তবে আমি খাব। যদি গাছটা ঝড়ে উপড়ে যায়, যদি গাছটা বন্ধ্যা হয়, ফল না ধরে যদি ফল পেকে ওঠার পর অন্য কেউ ছিঁড়ে খেয়ে নেয়, তখন কী হবে? এমন শতেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে কর্মখালির পশ্চাতে।
তাই সেই বোবা স্কুলে রান্নার লোক পাওয়া যায়নি। স্কুল স্থাপন হয়েছে প্রায় এক বছর। এর মধ্যে গোটা চল্লিশ বোবা বাচ্চা ভর্তি হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের নানান জেলা–এমনকী আসাম, ত্রিপুরার এক এক জন আছে। এই ধরনের একটা মাধ্যমিক স্তরের স্কুল শুধু স্থানীয় বাচ্চা দিয়ে চালানো যায় না। রান্নার লোক না থাকায় তাদের খাওয়া দাওয়ায় খুবই সমস্যা হচ্ছে।
এখন দত্তদাকে বলেন বড় সাহেব, একে কালকে সকালে ঘোষবাবুর কাছে নিয়ে যাস আমি বলে দেব। উনি কাজে লাগিয়ে দেবেন।
ঘোষবাবু ভদ্রলোক শহরের উপান্তে সদ্য নির্মিত এক চোখ ধাঁধানো বুকে জ্বালা ধরানো বিশাল ভবনে বাস করেন। উনি আগে আয়কর বিভাগের অফিসার ছিলেন। এমন অফিসার যিনি কোনোদিন ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে সি.বি.আই.-এর পাতা জালে ধরা পড়েননি। এবং তিনিও আত্মবিশ্বাসের সাথে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরেন।
পরের দিন সকালবেলায় আমাকে সাথে নিয়ে দত্তদা গেলেন সেই ঘোষবাবুর বাড়িতে। ওই বোবাদের স্কুলের ইনি হচ্ছেন বর্তমান সেক্রেটারি। কলিংবেল বাজাবার পর কে একজন এসে দরজা খুলে দিল। আমরা বিনা বাধায় পৌঁছে গেলাম দোতলার বসার ঘরে। ঘোষবাবু দত্তদাকে চেনেন, দত্তদাও চেনেন তাকে। ফলে, দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যের হাসি হাসেন।
ঘোষবাবুর একটা বিশেষ ব্যাপার এই যে উনি ভদ্র ভাষায় পরিচিত জনের সাথে কথা বলতে পারেন না। যে ভাষায় পুঁথি পুস্তক লেখা হয় তাকে পুঁথি পুস্তকের জন্য বরাদ্দ রেখে উনি নিজের মনোভাব প্রকাশের জন্য বেছে নেন পদ্মাপারের বাঙাল বুলি। এখন তিনি স্মিত হেসে সামনে রাখা ধূমায়িত চায়ের কাপে একটা চুমুক মেরে জানতে চাইলেন, কী জইন্য তোমাগো এই সাত সকালে আমার এ্যাইখানে আগমন?
যেমন গান তার সাথে তেমন বাজনা না হলে জমে না। আমাদের দত্তদাও এখন নিজস্ব বক্তব্য পেশ করার জন্য বাঙাল বুলির শরণাপন্ন হলেন–আপনের কাছে বড় সাহেব পাঠাইল। এই পোলাডারে বোবা ইকুলে রান্নার কামে লাগাইয়া দেবার জইন্য।
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন ঘোষবাবু–কতো তো লাগাইলাম। এ্যাক জোনও তো টেকে না। কেউ এ্যাকদিন কেউ এ্যাক বেলা কইরা পালান দেয়। কয় জোন তো আমার বাড়ি বইয়া কামের কতা শুইন্যা আর ইসকুলেরে দ্যাখতে পর্যন্ত গেল না। এ্যাইখান থিকা হাঁটা দিছে।
না, না, এ করবে। আর বাঙাল বুলির উপর আস্থা রাখতে পারলেন না দত্তদা, কলকাত্তাইয়া শুদ্ধ ভাষায় বলেন, একে লাগিয়ে দিয়ে দেখেন এ টিকে যাবে।
কইতে আছো যখন দিমু লাগাইয়া, দেহ কয়দিন টেকে।
দত্তদা, আমার জ্ঞানমতে কোনদিন জ্যোতিষ বিদ্যার চর্চা করেননি। তবু সেদিন যেভাবে বলেছিলেন “টিকে যাবে” মনে হয় আমার ভবিতব্য মানস নেত্রে অবলোকন করে নিতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন একবার ফাটা বাঁশে আটকে গেলে আর রেহাই পাবার পথ পাবো না।
এবার ঘোষবাবু কোন পথে কোন্ বাসে কী ভাবে সেই বোবাদের স্কুলে যেতে হবে পথ বলে দিলেন। ওই মোড় থিকা বাস পাইবা। এক্কেবারে লাস্টস্টপে গিয়া থামবা, একটু দূরেই যোবা ইসকুল, হাইট্যাও যাইতে পারো, রিকশাতেও যাইতে পারো। তবে পেরথম দিন তো রিকশাতেই যাইও নাইলে চেনবা কী চেনবা না। হোস্টেল সুপারেরে গিয়া আমার কথা কইবা। রাইখ্যা নিবো।
আমি সত্যিই বোকা, বিশ্বজগত সম্বন্ধে একেবারে অনভিজ্ঞ। কদিন আগে ভেবেছিলাম যার কাছে দত্তদা আমাকে নিয়ে যাবে একটা কাজ পাবার জন্য আমার হাত কচলাতে হবে। কাতর হয়ে বলতে হবে, বাবু গো আমি খুব গরিব মানুষ। বউ আর দুটো ছোট ছোট বাচ্চা আছে আমার। বউটা একটা আদিবাসী গ্রামে আই.সি.ডি.এস.-এর একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায়। যার মাইনে মাত্র সাড়ে চারশো টাকা। এতে সংসার চলে না। প্রায়দিন একবেলা অনাহারে থাকি। দয়া করে আমাকে একটা কাজ দিন। যে কোন কাজ, যাতে খেয়ে পরে বাঁচতে পারি। এসব কথা বলার কোনো দরকারই পড়ল না।
আর এখন? এখন তো কাজই আমার সামনে কাতরাচ্ছে–আমাকে করো। সুখ পাবে।
বলেন ঘোষবাবু, কাজটা কইরো, ছাইড়া দিও না। গরমে কষ্টো হইবো, মাইনা পাইতেও দেরি হইবো, কিন্তু যদি লাইগ্যা পাইড়া থাকো সুখ পাইবা।
চা খেতে দিলেন আমাদের সাথে মুচমুচে নিমকি। বুদ্ধিমান লোক ঘোষবাবু বুঝলেন কিছু লোকের ইহ জগতের চাইতে পরলোকের চিন্তা বড় প্রবল। এই জীবনের সময় সীমা তো পঞ্চাশ একশো বছর। তারপর যে লক্ষ কোটি বছরের অনন্ত জীবন সেটা কাটবে কী করে? উনি ধর্মগুরুর ব্যবসায়িক কৌশলে সেই জীবনের সুখময় সম্ভাবনার দিকটাও তুলে ধরলেন, জগতে যতো রকম মানব স্যাবা আছে সব স্যাবার চাইয়া বড় স্যাবা হইল গিয়া–এইসব কানা খোঁড়া বোবা কালা মাইনষের স্যাবা। এয়ার চাইয়া পুণ্যকাম আর নাই, সেই জইন্য আমি রিটায়ার করনের পর এই কামে মোন দিছি। বড় সাহেব জানে এ্যাক পয়সাও নিইনা। বিনা পয়সায় স্যাবা করতাছি। তোমারেও কই কামডা করো দেখবা ভগবান তোমার ভালো করবে। কী? করবা তো কামড়া?
আমি এক অভাগা মানুষ। সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় জেনে গেছি জীবন আমার জন্য ভালো কিছু করবে না। সব শুভ সব মঙ্গল সরে থাকবে আমার নাগালের শত হস্ত দূরে। কিছু ভাগ্যবান আছে যারা ধুলো মুঠো করে ধরলে সোনা হয়ে যায়। আর কিছু অভাগা পোড়া শোল মাছ পুকুরে ধুতে গেলে সাঁতরে ছুটে পালায়। আমি এই শেষ দলের।
তাই ঘোষবাবুর কথায় খুব একটা নেচে ওঠার কারণ দেখি না। শুধু মনকে বলি দেখা যাক কী হয়।
একজন বিশ্ববিখ্যাত কবি বলেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। আর যারা নিরক্ষর, গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ–কবিতা পড়তে পারে না, তারা বলেছে বিশ্বাসের মা বহুকাল আগে মরে গেছে। বিশ্বাসী মানুষ আর পয়দাই হচ্ছে না। যেহেতু কবির ভাষা কবিরাই বোঝে, অকবির ভাষা বোঝে অকবিরা, সাধারণ মানুষ অভিজ্ঞতায় বুঝেছে যে, এই চাকরি চাই না। তাই যেন আমারই জন্য ওই পদটা আজও খালি পড়ে আছে। আমি আসব আর পেয়ে যাব। এ যেন বিধির নিবন্ধ।
কে যেন বলেছে ”পৃথিবীটা হচ্ছে গোল”। এর যেখান থেকেই যাত্রা শুরু করা হোক অনবরত চলতে থাকলে এসে পড়তে হবে সেখানে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল। একবার উত্তর ভারত ঘুরে ফিরে এসেছিলাম। এবার ফিরে এলাম মধ্য ভারত ঘুরে। এখন মনে হচ্ছে একটা পরিক্রমার অবসান অনিবার্যভাবে ঘটে যেতে চাইছে। একে প্রতিহত করা সঠিক হবে না।
কিছুদিন এখানে থেকে একটু বিশ্রাম নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা করে তৃতীয় পরিক্রমা শুরু করতে হবে। যদি সেই রকম অবস্থা ব্যবস্থা সুযোগ ঘটে। দেখা যাক না শেষ পর্যন্ত কী হয়।
***
বাইপাশের উপর দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে আকাশে যতদূর চোখের নাগালে আসে সেই বিশাল এলাকার প্রায় সবটাই ছিল জলাভূমি। মাছের চাষ হতো এখানে। এই সব জমি ভেরির মালিক ছিল বিহারী মণ্ডল, খগেন নস্কর পরিবার। সেই যে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার জমির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দেন, যার ফলে এই সব জমির অধিকাংশ খাস জমিতে পরিণত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সেইসব জমি সিপিএম পার্টির লোকজন ঝাণ্ডা পুতে দখল করে নেয়, বা দখল করিয়ে দেওয়া হয়। যদিও যেসব মানুষ একে দখল করে রাখে তাদের কোনো মালিকানা স্বীকৃতি মেলে না। সে মালিকানা থাকে সরকারের হাতেই। কিছুকাল পরে সরকার বা বলা চলে সিপিএম পার্টি কৃষক বা মৎস্যজীবীদের দখল থেকে ওইসব জমি কেড়ে নিয়ে অন্য আর কাউকে দিয়ে দিতে থাকে। যারা এখানে গড়ে তুলতে থাকে হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, বাজার, হোটেল, লজ, বিবিধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ফলে খুব দ্রুত এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে যায়।
ঘোষবাবুর নির্দেশমতো আমি সেই শেষ বাসস্টপে নেমে চারদিকে তাকাই, কীভাবে বধির স্কুলে পৌঁছাব ভাবি। শেষে জীবনে সেই প্রথম আমি এক রিক্সা সওয়ারি হই। সারা জীবনে আমি কত লোককে রিক্সা টেনে নিয়ে গিয়েছি। কেমন লাগে টেনে নিয়ে যেতে সেটা খুব জানি। জানা ছিল না আমাকে কেউ টেনে নিয়ে গেলে রিক্সার গদিতে বাবু সেজে বসে থাকলে কেমন লাগে। আজ সেটা জানা হয়ে গোখরাপ! একজন তোক লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, একজন লোক গলদঘর্ম হয়ে দুহাতে দুটো ভারি ব্যাগ বইছে, দুটি বাচ্চা স্কুলে যাবার জন্য বাসের আশায় দাঁড়িয়ে আছে, একজন অসুস্থ হাসপাতালে যাবে ভিড় বাসে উঠতে পারছেনা। এসব দেখে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে, আরাম করে বসতে পারছি না আরামদায়ক গদিতে।
জানতে চায় রিক্সা চালক, কোথায় যাবা?
বলি–বধির বিদ্যালয়।
কেন কে জানে রিক্সা চালকের মুখটা ঘৃণায় বিকৃত হয়ে যায়। এক বিজাতীয় আক্রোশে সে আমাকে দেখে। আমি ওই ক্রোধ ওই ঘৃণাকে চিনি। শনাক্ত করতে পারি একে শ্রেণিঘৃণা বলে। এটা কেন হবে? এক বাম নেতার দ্বারা স্থাপিত বামপন্থী কর্মীদের দ্বারা সঞ্চালিত এক স্কুলের প্রতি একজন খেটে খাওয়া মানুষের চোখে এই বিরূপতার প্রতিভাস কেন থাকবে? আমি বুঝতে পারি না।
বলে সে–পাঁচ টাকা ভাড়া লাগবে।
বলি–ঠিক আছে, চলো।
খুচরা আছে তো? আমার কাছে খুচরা নাই।
দশ টাকার নোট দেব, তুমি পাঁচ টাকা দিতে পারবে না?
না।
না, এই শব্দটা যেন প্রবল এক অস্বীকার হয়ে চারদিকে অনুরণিত হতে লাগল, এই না শুধু আমাকে নয়, একটা গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি স্ফুলিঙ্গ। একটি ছোট কিন্তু সশক্ত দ্ৰোহানল।
এবার আমি পকেট হাতড়াই। গুনে দেখি খুচরো পাঁচটাকা আছে। বলি তাকে–চলো, খুচরো আছে।
রিক্সা চালক দাঁতে দাঁত ঘসে, আমি জানতাম তোমার কাছে আছে। বার কত্তি চাচ্ছে না। তাই চাপ দেলাম। চাপ দিলি সবজনা বাপ বলে।
রিক্সা চালাতে চালাতে সে জানতে চায়, বোবা ইসকুলি কে থাকে তোমার?
কেউ না, এমনি যাচ্ছি।
এমনি এমনি কেউ যায় না।
কিছুদূর এসে আবার বলে সে, ওই ইসকুলির সামনে গেলি বুক জ্বলে যায়। কী করব লাইনি গাড়ি রেখেছি, প্যাসেঞ্জার উঠলি না বলার উপায় নি।
কেন বুক জ্বলে যায় কেন?
ওই জমি আগে আমাগের দখলে ছেলো। আমরা চার চাষি চাষাবাদ কত্তেম। আমাগার উচ্ছেদ করে ওভেনে ইসকুল বসেছে। ইসকুল না ছাই, কতগুলোর বোবা কালারে রেখে দেছে। আমরা কোনো ক্ষতিপূরণ আজও পাইনি।
এতক্ষণে আমি তার ক্রোধের কারণ কিছুটা বুঝতে পারি। ছিল চাষির বেটা, এখন হয়ে গেছে গাড়িটানা ছোঁড়া। রাগ তো হবেই। আলাপ জমাবার চেষ্টায় জানতে চাই, ইসকুলের লোকগুলো কেমন?
তুমি জানো না কেমন? সে পাল্টা প্রশ্ন।
জানি না। বলি আমি।
তোমাগার পার্টির লোক, তুমি জানো না।
আমি পার্টি করি না।
তবে সিপিএম পার্টির ঘাটিতি যাচ্ছো!
যাচ্ছি একটা কাজের জন্য।
কী কাজ?
ওই আর কী!–রান্নাবান্না। সেইজন্য জানতে চাচ্ছি যাদের সাথে কাজ করব লোকগুলো কেমন।
আমি আর কী বলব–বলে রিক্সাওয়ালা, ওই সিপিএম পার্টির নোক যেমন হয় তেমনই।
একটু গলির মধ্যে সেই আবাসিক স্কুল। দূর থেকে তার লোহার গেট দেখা যাচ্ছিল। রিক্সা সেখানে এসে থামল। নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দুরু দুরু বুকে আগালাম সামনের দিকে। এত ভয় আমি জেলে ঢোকার সময়ও পাইনি। যেখানে এক দুজন বদ লোক থাকলেও অধিকাংশই ভালো লোক। অবস্থা বিপাকে জেলে এলেও তাদের বুক থেকে দয়া দরদ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এরা কেমন হবে কেমন হয় তার কিছু পূর্ব পরিচয় আমার জানা, ভয়টা সেকারণেই।
আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে একজন লোক পথরোধ করে দাঁড়াল–কাঁহা জানা হ্যায়?
লোকটা দারোয়ান। সাড়ে চার ফুট উচ্চতার রোগা এই বিহারি দারোয়ানকে দেখলে লোকের করুণা হতে বাধ্য। হায়, বোবা বধির স্কুলের কী করুণ দশা। অতি কষ্টে খুঁজে পেতে বিহার থেকে একজনকে আনানো হয়েছে বটে তবে সে মোটেই বিহারি লেঠেলের মতো নয়। ইয়া মোচ, ইয়া বুকের ছাতি, ডন-বৈঠক মারা বলবান শরীরের পাহারাদার যে হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়ালে দেখে মনে হবে হ্যাঁ পাহারাদার, তাহলে তো আসলি বিহারি। এ যদি রাতে পাহারায় থাকে পাঁচিলের ওপার থেকে চোর একে দেখে হেসে মরে যাবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কী করবে, তেমন কেউ যে গাছ পুতে ফল হলে খাব বলে বসে থাকতে রাজি হয়নি। তাই ধরে বেঁধে এক কানা মামা, একেবারে না থাকার চেয়ে কেউ তো থাকুক।
আমি বস্তার কা বাঙাল। হিন্দিটা ভালোই জানি। নিজের গরজে শিখেছিলাম। যেমন একদা শিখেছিলাম বাংলা বর্ণমালা। এখন তো দুটো ভাষা বলা এবং পড়ায় আমি সড়গড়।
বলি, সুপার সাহেব সে মিলনা হ্যায়।
আজ ইসকুল বন। বাচ্চা ভর্তি করা না হ্যায় তো কাল আইয়ে।
বাচ্চা নেহী, হামে ভর্তি হোনা হ্যায়।
আমার কথায় বিহারি অবাক–আপকো ভর্তি হোনা হ্যায়!
হাম এক কামকে লিয়ে আয়া, খানা বানানেকা কাম।
সমঝ গয়া। বলে সে আমাকে আঙুল তুলে তিনতলা দেখায়, আভি তো ‘সুইপার’ সাহেব নেহী, ওয়ার্ডেন সাহাব হ্যায়, যাকে উনসে মিলিয়ে। ওহ সব বাতায়েঙ্গে।
আজকে এই আবাসিক স্কুলের যে আকার প্রকার তখন তা ছিল না। ছিল বিশাল লম্বা একটা তিনতলা বিল্ডিং। নীচের তলায় স্কুলের জন্য কয়েকটা কক্ষ, অফিস, টিচার্স রুম, বড় সাহেবের একটা বসার এবং প্রয়োজনে শোবার ঘর। টিচার ইনচার্জের অফিস। আর একটা পরে কোন কাজে ব্যবহার করার জন্য বড় ফাঁকা ঘর।
দোতলার আট ঘরে আটটা ক্লাশরুম। তিনতলায় বাচ্চাদের থাকার জন্য লম্বা হলঘর। আর ছাদের একটা চিলে কোঠায় রান্নাঘর। রাতে বাচ্চারা ছাদে বসে খায়, দিনে সিঁড়িতে সার দিয়ে।
আমি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠি। আজ আমি যে সময় এসেছি অন্যদিন হলে সব বোবা বাচ্চাদের খেয়ে দেয়ে ক্লাসে চলে যাবার কথা। আজ যেন কীসের জন্য স্কুল ছুটি তাই টিচাররা কেউ আসেনি বাচ্চারা ক্লাসে যায়নি।
আমি গিয়ে যখন দরজার সামনে দাঁড়ালাম, শুনতে পেলাম এক ভীম গর্জন। কে যেন চিৎকার করছে–মেরে শেষ করে ফেলব। এরপরই কয়েকটা গুম গুম আওয়াজ। সেগুলো পড়ল একটা দশবারো বছরের বাচ্চার পিঠে। কিলের গুঁতোয় বাচ্চাটা যেন বেঁকে ধনুক হয়ে গেল। ঝাঁকিয়ে কেঁদে উঠল।
একজন লোক–লোক না বলে তাকে আফ্রিকান সুমো পালোয়ান বলা ভালো। সে তার বিশাল দেহ নিয়ে লাফিয়ে বাচ্চাদের শোবার জন্য পেতে রাখা এক খাট থেকে আর এক খাটে গিয়ে পড়েছে আর যাকে ধরছে, মেরে ধনুক বানিয়ে দিচ্ছে।
ভয়ে ভয়ে তাকাই লোকটার দিকে। বড় বড় দুটো লাল চোখ। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল। গায়ের রঙ মহিষবর্ণ। উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। সবটা মিলিয়ে সে যেন এক জীবন্ত আতঙ্ক।
সত্যিই সে এক আতঙ্কই। যে পাড়ায় সে থাকে প্রতিটা লোক একান্তে সভয়ে সে কথা স্বীকার করে। শুধু এ একা নয় এদের ছয় ভাই সব যেন এক একটা মূর্তিমান ত্রাস। বহু বছর আগে এদের বিচক্ষণ বাবা সব কয় ভাইকে ডেকে নীতিমালার সেই গল্পটা বলে ছেলেদের বুঝিয়ে ছিলেন–একটা কাঠি যে কেউ এক চাপে মটু করে ভেঙে দিতে পারে। এক গোছা একসাথে থাকলে কিছুতে পারে না। পিতৃবাক্যের সারমর্ম বুঝে ছয় ভাই এক বাড়িতে থাকে এক হাঁড়িতে খায়। ছয় ভাই হাতে ছয়খানা ঝাণ্ডা বাঁধা ডাণ্ডা নিয়ে পথে নামলে আর কাউকে সাথেনা পেলেও বিজয় অনিবার্য।
এর বড়দা, বড় সাহেবের বাল্যবন্ধু এবং সিপিএম পার্টির আঞ্চলিক এক দাপুটে নেতা। বন্ধুর ভাই বলে বড় সাহেব একে ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন। তিনি ডেকে একে এই চাকরিটা দিয়েছেন। এমনিতে এর চাকরির খুব একটা দরকার ছিল না। পাঁচ ভাই পার্টি (প্রমোটারি) করে যা কামিয়েছে পায়ের উপর পা তুলে বসে খেলেও পাঁচ পুরুষে শেষ হবে না। তবু বড় সাহেবের কথার মান রাখতে চাকরিটা নিয়েছে। বেলা দশটা নাগাদ একবার এসে ঘণ্টাখানেক থেকে বাড়ি চলে যায়। দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে জিরিয়ে রাতের দিকে আর একবার এসে পাক মেরে যায়।
লোকটার পোস্টের নাম ওয়ার্ডেন।
এই ওয়ার্ডেন আগে–যখন বেকার ছিল, এক লেকের পাড়ের বটগাছের তলায় অনেক বেকারের সাথে আড্ডা দিত। বলা বাহুল্য সেইসব বেকার সবই সিপিএম পার্টির যুব সংগঠনের সদস্য। তারা মাঝে মাঝে বিরোধীদলের লোকজনকে ঠেঙানোর মতো পবিত্র কর্তব্যও করত। তখন এই ওয়ার্ডেন মানুষকে মারার নিত্য নতুন যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতির আবিষ্কার করত। যা দেখে বন্ধুরা তার নাম দিয়েছিল রুনু গুহ নিয়োগী।
কিছু লোকের এখনও মনে আছে যে রুনু গুহ নিয়োগী সেই সত্তরের দশকের এক কুখ্যাত পুলিশ অফিসার। যে নকশাল বন্দী মহিলাদের যোনিতে গরম ডিম সেদ্ধ ঢুকিয়ে দিয়ে বড় আনন্দ পেতেন। চুরুটের ঝাঁকা দেওয়া ছিল তার প্রিয় খেলা। যে কোন নকশাল বন্দীর কপালে দগদগে পোড়া দাগ দেখে বোঝা যেত এটা কার কীর্তি।
যখন ৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয় সবাই বড় আশা করেছিল ওই অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের অপরাধের বিচার হবে সাজা পাবে। কোনো সাজা হয়নি প্রোমোশান পেয়েছিল। কারণ পূর্ববর্তী সরকারের মতো জ্যোতি বসুর সরকারও তাকে স্বার্থসিদ্ধির জন্য যথেচ্ছ ব্যবহার করেছিল। তাই সে রিটায়ার করার পরেও লালবাজারের অতি সুরক্ষা বলয়ে বাস করার কোয়ার্টার্স পেয়েছিল। দিয়েছিল এই বামফ্রন্ট সরকারই।
ওয়ার্ডোনের খুব ইচ্ছা ছিল চাকরি যদি করে তবে পুলিশ বিভাগে করবে। রুনু গুহ নিয়োগীর মতো নাম কামাবে। সে তো আর হল না। কী আর করা যাবে, হাতের কাছে যাদের পাচ্ছে, মেরে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে।
ওয়ার্ডেন লাফাতে লাফাতে হল ঘরের শেষ প্রান্তে চলে গিয়েছিল। লাফাতে লাফাতে ফেরার সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ল দরজায় এক অচেনা আগন্তুক। চমকে উঠল সে। কে লোকটা? কোনো বাচ্চার গার্জেন নয় তো? এই গার্জেনগুলো মহাহারামি। কিছু একটু হলেই হুজ্জতি বাধায়। সুপ্রিম কোর্ট দেখায়। সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে বলেছে বাচ্চাদের কোনোরূপ শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা চলবে না। ওরা কী জানে বাচ্চা হচ্ছে একতাল মাটির মতো। তাকে আগে ভালো করে থেততে হয় তারপর ছানতে হয়। তারপর ছাঁচে ফেলতে হয়, রোদে শুকাতে হয়ে, আগুনে পোড়াতে হয়। তবে তৈরি হয় ব্যবহারযোগ্য হাঁড়ি কলসিতে। বাচ্চাদের ঘেঁতবার সময় দয়ামায়া দেখালে ওরা আর মানুষ হবে? মানুষ যদি না বানাতে চাও এখানে দিলে কেন? নিয়ে যাও বাড়ি।
আমার সামনে এসে বলে সে, কে আপনি?
বলি–আমি রান্নার কাজ করব বলে এসেছি।
ফোঁস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে রুনুবাবুর। যা এ তাহলে কোনো ঝামেলা দায়ক অস্তিত্ব নয়। বিশাল দেহ নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে একটা খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে বলে–একটু বসুন। সুপার সাহেব বাজারে গেছে। সে এলে তাকে যা বলার বলবেন।
বাচ্চাদের একটা চৌকির এক কোণে বসে পড়ি আমি। বোবা বাচ্চারা আমাকে দেখে, আমি ওদের দেখি। ছয় থেকে ছাব্বিশ নানা বয়সের বাচ্চা। এত বোবা এক সাথে আগে আর দেখিনি। ভাষা মনের ভাব প্রকাশের বাহন। ওদের মুখে ভাষা নেই তাই জানি না, ওরা আমাকে দেখে কী ভাবছে।
এই সময় এক ষাট বাষট্টি বছরের মহিলা একটা কেটলিতে করে চা নিয়ে এলেন। অন্য হাতে দুটো কাপ। ওনাকে স্কুলের কিছু স্টাফ মাদার কিলার বলে ডাকে। মাদার মানে তো মা আর কিলার মানে খুনি। খুনিমা? এই নাম কেন? কেন সে আমি জানতে পারব দিন কয়েক পরে। যখন উনি কোনো বাচ্চাকে ধরে নির্দয়ভাবে পিটবেন, আর আমি বলব ছেড়ে দিন মাসিমা, না হলে ও মরে যাবে।
মাসিমার তিনকুলে কেউ নেই। খুব অল্প বয়সে স্বামী মারা গেছে। কেউ কেউ বলে আত্মহত্যা। তবে তারপর উনি আর বিয়ে করেননি। বর্ধমানের এক অজগাঁ থেকে বের হয়ে পড়েন পথ পরিক্রমায়। তারপর কী করে কেমন ভাবে কে জানে পৌঁছে যায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভাইয়ের বাড়ি। হেঁসেল সামলাবার দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। সেই সুবাদে বাড়ির চাকর বাকরদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারও পেয়ে যান। সে বহু বছর আগের কথা, তখনও সিপিএম নেতারা শাসক হয়ে যায়নি। দম্ভ দর্প অহঙ্কার তখনও ভ্রুণাকারে সুপ্ত, মহীরূহ হয়নি। ফলে, অনেক নেতার সাথে পরিচিত হয়ে যান। মিলতে মিশতে তাদের সম্মান আহত হয় না। তবে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হতে পারেন সেই সাঁইবাড়ি হত্যা মামলার এক আসামি যে নাম ভাড়িয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার হয়ে গেছে, তার সাথে।
এরপর প্রকৃতির নিয়মে তিনি এক সময় বুড়ো হয়ে যান। তখন তার শরীর অশক্ত হয়ে পড়ে। যে গরু হাল টানতে পারে না, দুধ দেয় না মালিক তাকে গোয়ালে রাখে না–বিদায় করে দেয়। তবে বুদ্ধদেবের সেই ভাই একে কষাইয়ের কাছে বেচার বিকল্প হিসাবে বড় সাহেবকে সমর্পণ করে দিয়েছেন। তিনি একে আশ্রয় দিয়েছেন এই আবাসিক স্কুলে। সবাইকে বলে দিয়েছেন বড় সাহেব, এনাকে মায়ের মতো সম্মান দিবি। যা বলে মেনে চলবি। যদি কারও নামে কোনো নালিশ করে, তাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেব।
কথায় বলে বাঘ বুড়ো হয়ে গেলেও ঘাপ ভোলে না। উনি যেখানে ছিলেন, যে বোয়াবে ছিলেন সেই রোয়াব এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। বোবা বাচ্চাদের তো কথায় কথায় পিটিয়ে দেন তবে সাধারণ কর্মচারীদের ওটুকু ছাড় আছে। শুধু গালাগালি দিয়েই তাদের মারের চেয়ে বেশি করে ছাড়েন।
মাদার …. কাপে চা ঢালবার আগেই হোস্টেল সুপার এসে গেল। উনি জানতেন তিনি আসবেন। তাই ওয়ার্ডেন এবং সুপারের জন্য দুটো কাপ এনেছেন। নিজের জন্য এনেছেন একটা গেলাস।
এই স্কুলের ছোট বড় সব কর্মচারী সিপিএম দলের কর্মী বা সমর্থক! হয় আগে থেকে তা ছিল নয় পরে দায়ে পড়ে হয়েছে। লোকে ব্যঙ্গ করে বলে হিন্দু যদি মুসলমান হয় তাহলে গরু খাবার যম হয়। আরবি জানে না তাই কোরান পড়তে পারে না, অভ্যাস নেই তাই নামাজ পড়ে না। খিদেয় কষ্ট হয় তাই রোজা রাখতে চায় না। এই অবস্থায় নিজেকে মুসলমান প্রমাণের সহজ পথ কিলো কিলো গরু খাওয়া।
নব্য সিপিএমরাও তাই। পাটি ক্লাসে যেতে মন চায় না। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিয়ে মাথা ঘামায় না। পত্র পত্রিকা পড়ে না। মার্কসবাদ কী বুঝতে চায় না। শুধু তাদের একমাত্র কাজ সিপিএম পার্টির পক্ষে জোর গলায় পেঁচানো আর বিরোধীদের বিরুদ্ধে আরো জোরে চেঁচানো। এই দিয়ে প্রমাণ করতে চায় পুরোনোদের চেয়েও আমি কট্টর সিপিএম।
এই ভিড়ে একমাত্র ব্যতিক্রম হোস্টেল সুপার গাইনবাবু। উনি সেই চুল ভেজাবো না গো আমি বেনি ভেজাবো না গোছের পণ করে–আছেন তো সিপিএমের সাথে, সিপিএমের কাজে। তবু নিজের রাজনৈতিক পরিচয় দেবার বেলা বলেন, আমি জাত কংগ্রেসি বাপের ছেলে। আমার রক্ত কংগ্রেসের রক্ত।
সত্যিই হোস্টেল সুপার দক্ষিণবঙ্গের এক প্রাক্তন এম.এল.এ.-র ছেলে। যে সময়ে তিনি এম.এল.এ হন সেই সবদিনের এম.এল.এ-রা আজকের মতো এত চালাক চতুর ছিল না। কিছু এম.এল.এ তো এমন ছিল যারা সম্পূর্ণ নিরক্ষর। টিপছাপ দিয়ে এম.এল.এ ভাতার টাকা তুলত। ফলে তারা জানত না বালি নিঙড়ে কী করে তেল বের করতে হয়।
বহুদিন পূর্বে একখানা ছেঁড়া নবকল্লোলের পাতায় একটা কার্টুন দেখেছিলাম। একজন মোটা লোক ধুতি গেঞ্জি পরে বসে বসে তেলেভাজা ভাজছে। পাশে বোর্ড ঝোলানো, প্রাক্তন এম.এল.এ-এর তেলেভাজা। বক্তৃতার মতোই ঝাঝালো এবং গরম। সেই প্রাক্তনকে কার্টুনে ব্যঙ্গ করা হলেও একটু লুকানো সত্য ছিল। তা এই যে সেই লোকগুলো আজকের নেতাদের মতো শঠ ধূর্ত ছিল না। তাই এম.এল.এ গিরি চলে গেলে ভয়ানক আর্থিক অনটনে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হতো।
আর আজ? এম.এল.এ. তো অনেক বড় পদ! সামান্য পঞ্চায়েত মেম্বার হতে পারলেই ছোটখাটো জমিদারি কিনতে পারে।
ওই প্রাক্তন এম.এল.এ. ছিল সেই শ্রেণির মানুষ যে আখের গুছিয়ে নিতে জানতেন না। ওনার পরে ওই সিটে কংগ্রেস যে প্রার্থী দাঁড় করায় তার কাছে আমাদের বড় সাহেব বিগত দুই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছেন। সামনে আর এক নির্বাচন আসছে। কংগ্রেস এমন একটা দল যার মধ্যে উপদলীয় কোন্দল চিরদিন ছিল আছে এবং থাকবে। পরের বারে ভোটে জেতার জন্য বড় সাহেব সাম দাম দণ্ড এবং ভেদ সব কটি ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োেগ করে চলেছেন। উনি জানতেন বর্তমান কংগ্রেস এম.এল.এ-এর সাথে ওই প্রাক্তন এম.এল.এ-র বিশেষ সদ্ভাব নেই। তা ছাড়া পদ হারিয়ে তিনি বড় অভাবে দিন কাটাচ্ছেন। তাই একদিন গিয়ে ধরলেন তাকে, আপনাকে কংগ্রেস টিকিট দেয়নি। বেইমানি করছে আপনার সাথে। এবার তার বদলা নিন। হারিয়ে দিন কংগ্রেসকে এই সিটে। জিতিয়ে দিন আমাকে। পুরোপুরি তরমুজ হয়ে যান। থাকুন ওই দলে, কিন্তু কাজ করুন আমার। আমি তার উপযুক্ত দাম দেব।
কথাটা তার মনে ধরে। তবে জাতে বাঙাল বর্ণে বামুন রাজনীতিতে সিপিএম। এদের কোন বিশ্বাস নেই। তাই শর্ত রাখে সে–আগে দাম, পরে কাম। এখন তো আপনাদের সরকার। ইচ্ছা করলে আপনি পারবেন। আগে আমার ছেলেকে একটা চাকরি দিন। কথা দিচ্ছি আমি আপনার হয়ে প্রকাশ্যে প্রচারে যাবো।
এই কারণে সেই প্রাক্তন কংগ্রেস এম.এল.এ-এর ছেলে এই স্কুলে হোস্টেল সুপারের চাকরিটা পেয়ে গেছে। সেই যে একদা রামকৃষ্ণ দেব রাণী রাসমণির চাকরি করে পেটের অন্ন যোগাড় করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে সারা জীবন নিজের ভাগ্যকে আর মা ভবতারিণীকে দোষারোপ করতেন, কী পাপ করেছিলুম যে ছোট জাতের অন্ন খেতে হচ্ছে, ইনিও তেমনই নিজের বাপ আর কংগ্রেসকে দোষারোপ করেন।
চাকরি তো পেয়েছে এম.এল.এ.-র ছেলে। তবে সেই প্রাক্তন যদি চলেন ডালে ডালে আমাদের বড় সাহেব চলেন পাতায় পাতায়। এখনও তিনি সুপারকে কোন নিয়োগপত্র দেননি। সে দেবেন ভোট ফোট মিটে যাবার পরে, প্রাক্তনের সক্রিয় ভূমিকার পর্যালোচনা করে।
সুপার আর ওয়ার্ডেনের জন্য দুটো কাপে চা ঢালবার পরে মাদার… এর চোখে পড়ল আর একটা লোক বসে আছে। এ কে? আগে তো কোনদিন দেখিনি।
বলে ওয়ার্ডেন–বড় সাহেব পাঠিয়েছে। রান্নার লোক।
নাম কী?
প্রশ্নটা আমাকে। আমি জবাব দিই, মনোরঞ্জন ব্যাপারী।
ব্যাপারী। কীসের ব্যাপার তোমাদের? এই রকম পদবি আগে কোনোদিন শুনিনি।
বলি–আগে আমাদের পদবি মণ্ডল ছিল। ঠাকুরদার সময় থেকে বদলে গেছে। কেন তা জানি না।
বামুন না?
না! আমি নমঃশূদ্র।
সে আবার কী জাত? বামুন কায়েত বদ্যি শুনেছি, পোঁদ কাহার বাগদি শুনেছি, চাড়াল শুনেছি, নমোশূদ্র তো শুনিনি।
মাদারের কথা বলার ধরণ আমার ভালো লাগে না। ভালো লাগেনা বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত এক সংস্থায় জাত পাত নিয়ে খোঁচাখুঁচি। এই জাতের কারণে এক সময় আমাকে চরম অপমানিত হতে হয়েছিল এক অন্নপ্রাশন বাড়িতে রান্নার কাজে গিয়ে। সে কথা আজও ভুলিনি। এখন আমি সেদিনের মতো দুর্বল নই। প্রতিপক্ষ সামনে পেয়ে তোপ দাগি–আমাদের আগে চাড়াল চণ্ডাল এই সব বলা হতো। এখন নমঃশুদ্র বলা হয়।
আমার জাতি পরিচয় শুনে মুখটা বিকৃত হয়ে যায় মাদার কিলারের। আমি এই বর্ণবাদী হিন্দু ধর্মে জল অচল-অচ্ছুৎ। আমাকে ছুঁলে উচ্চবর্ণের লোককে স্নান করে শুদ্ধ হতে হয়।
মনের ক্ষোভ মনে চেপে রাখতে পারেন না মাদার, উগড়ে দেন–ভাই কী আর কোনো রান্নার লোক পেল না। শেষকালে চাড়াল? এখানে সবাই তো আর ছোট জাত নয়। বাচ্চাদের মধ্যে বামুন বদ্যি আছে। তারা কী করে এর হাতের রান্না খাবে?
কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে আমার। এ আমি কোথায় কাদের মাঝখানে এসে পড়লাম। আমি যে জানি বামপন্থীরা কোন্ জাতপাত মানে না। ভাগ্য ভগবান মানে না। বিশ্বাস করে সব মানুষ সমান–সব মানুষ সমান সম্মানীয়। তাহলে এখন এ আমি কী শুনছি! যা শুনছি, কেন শুনছি। হেসে হেসে বলে ওয়ার্ডেন–খেলে কী হবে?
পাপ হবে। বলে মাদার।
আজকাল এসব কেউ মানে না।
যে মানে সে মানে, যে মানে না সে মানে না। ভাই পার্টি করে বলে চাড়াল ডোম মানে না। অজাত কুজাত সবার হাতে খায়। ভাইয়ের বউ কী তা করে? ভাই তো গলায় পৈতে রাখে না পূজার্চনা করে না। বউদি সব করে। ঘরে কত বড় কালী ঠাকুর।
ভাই মানে বড় সাহেব। কয়েক মাস আগে ভাইফোঁটা গেছে। সেদিন মাদার বড় সাহেবের বাড়ি গিয়ে তার কপালে ফোঁটা দিয়ে এসেছে। সেই থেকে তার নাম নয়–ভাই বলে সম্বোধন করছে। এতে মানুষের কাছে কিছু বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে।
মাদারের পদবি সাহা। সেটা কোনো কুলীন জাতি নয়। তবে উনি দীর্ঘকাল এক নিষ্ঠাবান ভট্টাচার্য বামুনের বাড়িতে কাটিয়ে এসেছেন। যে কুলীন বামুনের পূর্ব পুরুষেরা পুরোহিত দর্পণের প্রণেতা। এটা ঠিক যে এই ভট্টাচার্য পরিবারের কেউ বামপন্থী ঘরানার কিছু কবিতা টবিতা নাটক টাটক লিখেছেন। সেসব একান্তভাবে বাড়ির বাইরের বিষয়। বাড়িতে এনারা পূজাপাট, উপনয়ন, উপবীত ধারণ, শ্রাদ্ধ শান্তি সব ক্রিয়াকর্ম যথাযথ মেনে চলেন। ফলে, লোহা যেমন চুম্বকের সংস্পর্শে থাকলে চুম্বক হয়ে যায়, উনি কুলীন বামুনের স্পর্শ পেয়ে মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি ছোঁয়াচে বামনি হয়ে বসে আছেন।
তবে সেটা শুধু আচার-বিচারের ক্ষেত্রে। আহারের ক্ষেত্রে নয়। খাদ্যদ্রব্যের বেলায় উনি আমিষ-নিরামিষ কারও প্রতি ভেদভাব রাখেন না। সবার প্রতি সমদৃষ্টি–সম সমাদর দেখান।
মাদারের মনোভাবে হাসি চওড়া হয়ে যায় ওয়ার্ডেনের। বলে–এখন তাহলে কী করবেন মাসিমা। বড় সাহেব পাঠিয়েছে এখন এতো থাকবে। এর হাতের রান্না যে না খেয়ে উপায় নেই।
বলে মাদার, কী করব সে বুন্ধি আমার আছে।
কী করবেন?
বলব?
বলুন না, শুনি।
অগ্নি সর্বদোষ বিনাশক। আমি ভাত তরকারি নিয়ে আগুনে ফুটিয়ে নেব। আর কোন দোষ থাকবে না।
রোজ ফোটাবেন?
দু-বেলাই।
আপনার কষ্ট হবে।
হোক। ওটুকু কষ্ট আমি পারব।
এর চেয়ে সবাই যে রকম খাবে আপনিও খান। কিছু হবে না। ছাড়েন তো ওসব ছুৎ অচ্ছুৎ।
না না। শেষ বয়সে আর অধর্ম করব না।
এখন মাদার বড় সমস্যায় পড়ে গেলেন। আমি সামনে বসে আছি। সবাই চা খেলে এক কাপ যে আমাকেও দিতে হয়। চা তো অনেক আছে, কাপ নেই। কাপ আছে ছাদের চিলে কোঠায়, রান্না ঘরে। কে এখন সিঁড়ি ভেঙে ছাদে যায়। চারদিকে তাকান তিনি। হঠাৎ তার চোখ যায় একটা জানলার দিকে। আছে, ওখানে একটা ডাণ্ডাভাঙা চটা ওঠা ফাটা কাপ রাখা আছে। এই কাপে জল নিয়ে এক মেদিনীপুরের সিংহ মাস্টার দাড়ি কামায়। সে ছুটিতে বাড়িতে গেছে। কাপটা আছে।
সেই মাস্টার অনেক দিন আগে মেদিনীপুর থেকে এসে সাহেবের বাড়িতে বাজার হাট-রান্না এইসব কাজ করত। উদ্যমী লোক, কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছিল। আজকাল তো এমন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ভর্তি হলে পাশের গ্যারান্টি থাকে। আর রোজ ক্লাসেও যেতে হয় না, মাসেকী সপ্তাহে একদুবার গেলেই চলে। সেইভাবে সে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। ব্যবহারটা তার বড় ভালো। বড় সাহেব তার উপর খুবই প্রীত থাকেন। ফলে এখানে এনে একটা চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। পদটার নাম স্পোর্টস টিচার।
স্পোর্টস-এর মানে ক্রীড়া। এর সাথে শিক্ষাদীক্ষার খুব একটা সংশ্রব না থাকলেও চলে। টিচার তো অতি তুচ্ছ পদ, এই সরকারের প্রথম দিকে এমন একজন লোক ক্রীড়ামন্ত্রী হয়ে গিয়েছিল যে মাত্র এইট পাশ। তার জীবনের সাথে খেলাধূলার কোনো যোগ আছে এমন অপবাদ বোধহয় তার চরম শত্রুও দেবে না। সে ছিল এক নিখাদ মাস্তান। সে যদি মন্ত্রী হতে পারে ইনি মাস্টার হতে পারবেন না কেন? তবে তফাৎ একটা আছে, মন্ত্রীত্ব করতে সার্টিফিকেট লাগে না মাস্টারগিরি করতে লাগে। এ সেটা যোগাড় করেছে। এই জমানায় ওটা যোগাড় করা কোনো সমস্যাই নয়। এই তো কদিন আগে এক কোর্টে প্র্যাকটিশরত পাঁচ ছয় জন উকিল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেছে যাদের এল.এল.বি. সার্টিফিকেট জাল। কটা ডাক্তারও ধরা পড়েছে যাদের এম.বি.বি.এস ডিগ্রি ভুয়ো। আর জনৈক পবিত্র পেশার এক বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক তো ভুয়ো পি.এইচ.ডি ডিগ্রির জোরে বহাল তবিয়তে চাকরি করে গেলেন বহু বছর। কিছু বাম বিরোধী পুলিশ বামফ্রন্ট সরকারকে বদনাম করার অপচেষ্টায় ধরপাকড় না চালালে এসব গুপ্ত ব্যাপার চির দিন গুপ্তই রয়ে যেত। কাক পক্ষীতে টের পেত না।
এখন মাদার…. আমাকে চা দেবার জন্য সেই স্পোর্ট টিচারের কাপটা বেছে নিলেন। এটা করতে কোনো উচ্চবর্ণ হিন্দুর বিবেক দংশন হবার কথা নয়। কারণ মহান হিন্দুধর্মের পুস্তকাদিতে পরিষ্কার ভাষায় বলা আছে যদি কোনো চণ্ডালকে খাদ্যদ্রব্য প্রদান করা হয় তবে তা করতে হবে ভগ্ন পাত্রে এবং অবশ্যই তা যেন উচ্ছিষ্ট বা ভুক্তাবশেষ হয়।
উনি সেই কাপটা তুলে কেটলি থেকে সামান্য চা ঢেলে কাপটা দুবার গোল গোল করে ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন অর্থাৎ কাপটা ধুয়ে নিলেন। এরপর তাতে চা ঢেলে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। নাও চা খাও। আমি আজই এসেছি তাই এখনও এই কাপটার জীবন যাপন জানি না। সেটা জানব দুদিন পরে। কিন্তু এখন যে অনাদর আর অবজ্ঞায় চা দেওয়া হল তাতে মনটা তেতো হয়ে গেল আমার।
মনকে বোঝাই ওরে পাগল দুঃখ করিস না। নীলকণ্ঠ হ, গরল গিলতে শেখ। দেখবি তোর পাকস্থলিতে পড়ে গরল অমৃত হয়ে যাবে একদিন। তোর মতো কত মানুষ ডাস্টবিন খুঁটে খেয়ে বেঁচে থাকে। যদি বাঁচতে চাস সবকিছু খেতে শেখ। তা না হলে খিদে তোকে খেয়ে নেবে।
***
অনুর বেতন এখন বেড়ে চারশো পঁচাত্তর টাকা হয়ে গেছে। তাছাড়া গ্রামের আদিবাসী মানুষরা ওকে ভালোবাসে। যার ক্ষেতে যা নতুন ফসল ওঠে ওকে না দিয়ে খায় না। ওদের ভরসায় যেভাবে হোক অনু দুটো বাচ্চা নিয়ে দিন চালিয়ে নেবে। এই অবস্থায় আমি একদান জুয়ো খেলে ভাগ্য পরীক্ষা করে নিতে পারি। যদি দান লেগে যায়–ওদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারব স্বভূমিতে স্বদেশে শিকড়ের কাছে। তাই স্থির করি করব কাজটা।
জীবন আমাকে দিয়ে কত কিছুই তো করিয়ে নিল, ছাগল চড়ানো থেকে ভিক্ষে। যা করেছি মনে একটা বিশ্বাস সর্বদা ছিল, এই শেষ নয়। এরপরও কিছু একটা আছে। অন্ধকারই চরম সত্য নয়–এরপর আছে উজ্জ্বল দিন। এ আমি গভীর ভাবে বিশ্বাস করেছি যে স্থবির হয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাকে চলতে হবে–আর চলতে চলতে যেখানে গিয়ে থামব অবশ্যই তা হবে মহৎ মঙ্গলময় সুন্দরতম।
আমাদের বেদ উপনিষদ প্রতিটা ধর্মগ্রন্থ বলেছে–প্রত্যেকটা সৃষ্টির পিছনে সৃষ্টিকর্তার নিগূঢ় কোন উদ্দেশ্য থাকে। আস্তিক্যবাদী যদি নাও বা হই তবু আমার অটল ধারণা, আমার জীবনের নিশ্চয়ই একটা উদ্দেশ্য আছে, পরিণতিআছে। সারা জীবন ধরে যে এইকষ্টসাধ্য সঞ্চয় তা একেবারে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে না।এক না একদিন এই অর্জন কোন না কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-অভীষ্ট পূরণের নিমিত্ত হবে।
হাজার হাজার কুইন্টাল সোনা মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। কজন মানুষ তার কথা জানে? মানুষ জানে আর চেনে সেটুকু যা অলঙ্কার হয়ে সুন্দর অঙ্গের শোভা বাড়ায়। আমার ছেঁড়া থলিতে “সোনা” আছে, ধুলো বালি মাটি পাথর মেশানো। খনি থেকে তোলর পর যেমন থাকে। একে গলিয়ে অলঙ্কার বানাতে হবে। যে সোনা চেনে তার কাছে নিয়ে যেতে হবে। তবে এর যথার্থ মূল্য পাবো। এ কাজ বস্তারের ঘন জঙ্গলে বসে হবে না।
আমি জানি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি একদিন আমার সঞ্চয় সম্পদ জীবনের কাজে লাগবে। অন্ধকার রাতে অকুল দরিয়ায় মাঝি যেমন ধ্রুব তারার দিকে চোখ রেখে নদী পার হয়ে যায়। আমি সেই আশার ছোট চারাটি বুকে আগলে ভবিষ্যতের দিকে চোখ পেতে বসেছিলাম। আজ সেই সুবর্ণ সুযোগ এসে গেছে। যে ভাবেই হোক এসে পৌঁছেছি সেই মানুষদের পাড়ায় যারা সোনাকে সোনা বলে চেনে।
আমি এক সময় গল্প লিখতাম। লেখার কাজটা আমার বড় প্রিয় ছিল। যখন কেউ আমাকে লেখক বলতো ভীষণ গর্ববোধ হতো। মনে হতো আমি একজন শিল্পী একজন স্রষ্টা। বাংলা ভাষার মূল ভূখণ্ড থেকে এতদূরে থাকার জন্য বাংলা সাহিত্য জগতের সঙ্গে সব সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এবার ছিন্ন হয়ে যাওয়া যোগসূত্রটা আবার নতুন করে স্থাপন করতে পারব। আমার দুর্গ গল্পটা এক সময় খঙ্গাপুরের কাগজ ডুলুংয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। যেটা পড়ে নিয়োগীজি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। উবু দশ পত্রিকার সম্পাদক দণ্ডকারণ্যে চিঠি লিখে তাদের কাগজের জন্য গল্প চেয়ে নিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে আমার ভাগ্য যেন আমার জন্য সব দরজা বন্ধ করে এই দিকে ঠেলে এই জন্য নিয়ে এসেছে–আমি যেন আবার লিখি। আমার ভবিতব্য নির্দেশ দিচ্ছে–লেখো। আর তোমার কোন কাজ নেই, বিশ্বের কাজ থাক বিশ্ব পরে, তুমি শুধু লেখো। লিখবে বলেই আমি তোমাকে পরিণত করেছি অভিজ্ঞ করেছি এত অভিজ্ঞতায়। সারাটা জীবন ধরে যে দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা যা ছিল তোমার একার সঞ্চয়, তার স্বাদ-ভাগ মানুষকে দাও–তাকে শরিক করো। তা যদি পারো তোমার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য সার্থক হবে। শেষ নিঃশ্বাস পড়বার আগে গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারবে–জীবন তোমাকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করতে পারেনি। বলতে পারবে আমি সেই পরম এবং চরম সুখের সন্ধান পেয়ে গেছি, যা পাওয়ার পরে অপ্রাপ্তি অপূর্ণতা বলে তার কিছু থাকে না। জীবন সফল ও সার্থক হয়ে যায়।
আমি তোমাকে সেই সুযোগটা দিয়েছি। বাংলায় থাকার সুযোগ বাংলা ভাষায় লিখবার সুযোগ। বাংলা পত্র পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবার সুযোগ। এ সুযোগ গ্রহণ করো।
এটা সেই সময়–যখন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এমন ঘোরালো হয়ে ওঠেনি। তখন যে এমন সংগঠিত শক্তিমান বামফ্রন্ট সরকার উচ্ছেদ হতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা কারো দুরতম কল্পনাতেও ছিল না। সাধারণ সব মানুষদের ধারণা ছিল এরা আছে এরা থাকবে। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটুক ভেঙে যাক বার্লিনের প্রাচীর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের লাল দূর্গ টিকে থাকবে অনন্তকাল।
এই ভাবনার বাইরে যে সব লোক, তারা সাধারণ নন–দূরদর্শী প্রাজ্ঞ।
কিছুকাল আগে সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্যবাদ স্থাপনার একটা জোয়ার এসেছিল। শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবক ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই আন্দোলনে। যার রেশ আমাদের দেশেও এসে পৌঁছেছিল। উত্তাল হয়ে উঠেছিল আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু সেই আন্দোলন কয়েক বছর যেতে না যেতে ক্রমে নির্জীব হয়ে গেছে। কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক গবেষক এর অনেক কটা কারণ আবিষ্কার করেছেন। তবে সবচেয়ে বড় কারণ যেটা তা হল ওই আন্দোলনের বড় নেতারা মনে প্রাণে কেউ সাম্যবাদী ছিলেন না। ছিল না তাদের সত্যিকারের জনদরদ আর আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা। আসলে এরা ছিল ক্ষমতালোভী উচ্চাকাঙ্খী ভ্রষ্ট রাজনেতা। ক্ষমতা হাতে পেয়েই এদের পা ভোগবাদের বিষ্ঠা গহ্বরে পতিত হয়েছিল। এরা হয়ে উঠেছিল দর্পী দম্ভী অহঙ্কারী আর অত্যাচারী। তাই অন্য দেশ তো দুরের কথা, ভেঙে গিয়েছিল বার্লিনের প্রাচীর, পতন ঘটেছিল সাম্যবাদীদের তীর্থভূমি সোভিয়েত রাশিয়ার। সে দেশের সাধারণ মানুষ লেনিনের মুর্তি পর্যন্ত ভেঙে গুঁড়ো, গুঁড়ো করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল।
কিছু লোক আছে যারা চাকরি করে, ব্যবসা করে বা বিশাল পৈত্রিক সম্পত্তি আছে। তারা নিজের কাজ সামলে অবসর সময়ে রাজনীতি করে। এদের রাজনৈতিক জোয়ার ভাটা অগ্রগমন বা পশ্চাদপসারণ পদ গ্রহণ বা পদ বর্জনে মূল ক্ষমতার বিশেষ একটা তারতম্য ঘটে না। কিন্তু যাদের রাজনীতিটাই চাকরি ব্যবসা সম্পত্তি সবকিছু তাদের পাশে-পিছনে জন জমায়েত হ্রাস পেলে তার অস্তিত্বেরই সংকট দেখা দেয়। প্রাপ্তিসুখের ভাঁড়ারে টান পড়ে।
আগে যখন বিশ্বজোড়া মার্কসবাদ লেনিনবাদের মোহময় বিস্তার ছিল, শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবাদের শ্রেণিসংগ্রাম, বিপ্লব, শোষণমুক্ত সমাজ এই সব খুড়োর কল ঝুলিয়ে আশেপাশে জন। জমায়েতকরা নেতাদের পক্ষে খুবই সহজ ছিল। কিন্তু এখন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর উল্টোযাত্রার ঢেউ এদেশেও এসে পড়েছে। এখন আর শ্রেণিসংগ্রাম বলে মানুষকে চেতানো যাচ্ছে না। বিশ্বায়নের এই যুগে আগেকার সে শ্লোগানও তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে।
আগে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিষ্ট পার্টির উঁচুতলার কিছু নেতাকে বাদ দিলে মাঝারি বা ছোট নেতাদের সবারই আগমন ঘটেছিল শোষিত বঞ্চিত দরিদ্র পরিবার থেকে। ফলে তখন তাদের সত্যিই শোষক এবং তাবেদার শাসক শ্রেণির প্রতি চরম ঘৃণা আর শোষণহীন সমাজ গড়ার একটা আন্তরিক আকুলতা ছিল। কিন্তু এখন বঙ্গে পাকেচক্রে কমিউনিস্টরা শাসন ক্ষমতায় পৌঁছে সুদীর্ঘকাল শাসন ক্ষমতায় টিকে যাওয়ায় এই দলের বড় মেজ সেজ ছোট কোন নেতা কর্মী আর দরিদ্র নেই। প্রমোটারি, দালালি, ঠিকেদারি, তোলাবাজী করে সব টাকার পাহাড় জমিয়ে ফেলেছে। এমন অবস্থায় তাদের আর পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। কে আর কালিদাস হতে চায়। যে, যে ডালে বসবে সেই ডাল কাটবে।
এখন বিপ্লব হলে তাদের পাবার কিছু নেই, হারাবার অনেক কিছু আছে। তাই তারা বিপ্লব নয়, চায় যেন তেন প্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। এর জন্য নৈতিক অনৈতিক যে কোন পথ পন্থা গ্রহণে এদের আপত্তি নেই।
সেটা এরা সুচারুরূপে করেও থাকে। কে লোকটা? বিরোধী দলের! দে ওর নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে। আর এই লোকটা? আমাদের। এর নাম চার কেন্দ্রে লিস্টে তুলে দে। এক কেন্দ্রে ভোট দিয়ে আসবে, ক্যামিকেল দিয়ে আঙুলের দাগ তুলে দিবি, আর এক কেন্দ্রে চলে যাবে ভোট দিতে। আর এই লোকটা? ঠিক বোঝা যায় না আমাদের না ওদের। ওকে বলে দে, আমাদের বিরোধী দলের বোতামে সেন্ট দিয়ে রাখা আছে। যদি আঙুল ঠেকায় গন্ধ পাওয়া যাবে।ভোট দিয়ে যাবার সময় যেন আঙুল শুকিয়ে যায়। যদি গন্ধ পাই রে….! আরে ওকে? ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে কেন! বলে দে বাড়ি চলে যাক, ওর ভোট পড়ে যাবে। যদি না যায় বন্দুক দেখা। বউকে থান কাপড়ের কথা বল। এমন আরো শতেক রকম ফন্দি ফিকির।
ভোট মানে যুদ্ধ। যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য ছলে বলে কলে কৌশলে জয়। আর কিছু নয় একমাত্র বিজয়। রক্তের নদী বয়ে যাক, লাশের পাহাড় জমুক কোন পরোয়া নেই, জয় পেলেই হবে।
তবে এটা ঠিক যে একমাত্র নির্বোধ ছাড়া আর কেউ এমন ধারণা পোষণ করে না যে মানুষ সবদিন এই দমন-পীড়ন-ভয়ের সামনে হাঁটু গেড়ে থাকবে। কোনদিন মাথা উঁচু করে সামনে হেঁটে যাবে না। যাবে, যায়। যায় যে তার প্রমাণ ২০১১।
জাহাজ ডোবার আগে যেমন ইঁদুরেরা টের পায়, তেমনই যারা রাজনীতি দ্বারা করে কম্মে খায় তারা সমাজদেহের অভ্যন্তরে অন্তঃশীলা ফল্গুর চোরাস্রোত অনেক আগে ধরতে পেরেছিল। তাই তারা সংগোপনে শুরু করে দিয়েছিল শ্রেণি সমন্নয় ও জনসাধারণকে নিজের বৃত্তে আবদ্ধ রেখে নেতাগিরির ধান্দা চালিয়ে যাবার কাজ। এই পদ্ধতির একটার নাম নারীবাদ।
যার হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে যায়, সে যে দুর্বল অক্ষম অসহায় মানুষকে নিপীড়ন করে–এটা হাজার হাজার বছরের প্রচলিত সত্য। রাষ্ট্র দেশের জনগণকে, মালিক শ্রমিককে, জমিদার তার প্রজা-কৃষককে, পুরুষ নারীকে, গৃহকর্তা বা কর্তী বাড়ির কাজের লোককে।
একটা বাড়ি যেমন দাঁড়িয়ে থাকে চার কোণের চার পিলারের ক্ষমতায়, এবং বাড়িটা ভেঙে ফেলতে হলে ওই পিলারগুলো ভাঙা দরকার। যা দাঁড়িয়ে আছে এই ধনবাদী রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় অটল পাহাড় হয়ে। যদি কেউ নারীকে নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে চায়, তবে তাকে স্বাধীনমুক্ত স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ওই ব্যবস্থাটাকে অটুট রেখে করা সম্ভব নয়। আর সেটা করতে হলে সেই দাড়িওলা বুড়ো লোকটার দর্শনের শরণাপন্ন না হয়ে অন্য কোন উপায় নেই। গোদা বাংলায় যার অর্থ বিপ্লব। এ ছাড়া হবে না।
কিন্তু সেই সব নেতা, যারা নারীবাদী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকেছে, তারা তো শ্রেণি সংগ্রাম চায়। চায় শ্রেণি সম্বন্বয়। তাই খানিকটা আবেগ খানিকটা সুড়সুড়ি খানিকটা নাটুকে দরদ গলায় ফুটিয়ে জনমানস তাতিয়ে তোলার তাড়নায় মঞ্চ গড়ে মাইক বেঁধে গলার শিরা ফুলিয়ে হাঁক পাড়ে নারী শক্তি জিন্দাবাদ। নারীরা সব ওঠো, জাগো। পুরুষতন্ত্রের অত্যাচার মেনে নিও না। সংগ্রাম করো সাবলীল হও, স্বাধীন হও।
এর ফলে ধনী আর দরিদ্রের যে ব্যবধান তা আর থাকে না। সব বিভেদ বিদ্বেষ মুছে যায়, অনৈক্য দূর হয়। বণিক বাড়ির সেই স্বামী দ্বারা নিগৃহীত মহিলা যে লিমুজিন কার-এ চেপে পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়ি পরে কোন পাঁচ তারা হোটেলে ক্যান্ডেললাইট ডিনার সারে। আর খালপাড়ের সেই বাবুবাড়ির বাসন মাজা, ঝুপড়ি ঘরের মেয়েছেলেটা, যার রিকশাওলা বর মদ খেয়ে রোজ তাকে পেটায়, দুজনে এক মিছিলে হাঁটে একই শ্লোগান দিয়ে–পুরুষতন্ত্র মুর্দাবাদ।
তখন সেই ঝি মেয়েছেলেটার আর মনেও থাকে না, যে বাড়িতে সে বাসন মাজে সেই বাড়ির এই রকম এক বিত্তবান গৃহিনী তার স্বামীর কাছে যা অত্যাচার পায় তার দশগুণ তাকে ফিরিয়ে দেয়। তখন তার মনেও থাকে না যে সে এক মহিলা। আর যাকে সে নিপীড়ন করছে সে-ও তাই।
নারী আন্দোলনের আর একটা প্লাটফর্ম গড়া হয়েছে যৌনকর্মীদের নিয়ে। যৌনকর্মী নামটা হালফিলের। এর আগে বেশ্যা রেন্ডি বারবণিতা খানকি এমন সব শতাধিক নাম ছিল এদের। এই সব মেয়েদের নিয়ে গড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে আর পাঁচটা পেশা–যেমন নার্স, আয়া, রাধুনি, পরিচারিকা, কারখানার কর্মী এদের মতো তাদের পেশাকেও একটা সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হবে। পুলিশি ধরপাকড় চলবে না। মাস্তান, বাড়িউলি এবং অভদ্র কাস্টমার–এদের জুলুম থেকে সরকার তাদের রক্ষা করার ভার নেবে। নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষা, বিনামুল্যে ঔষধপত্র এবং বিমা সেবা প্রদান করতে হবে।
এ অতি মানবিক দাবি। এ দাবির বিরোধিতা করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সুচারু রূপে সেই কাজটি সুসম্পন্ন করা যাচ্ছে। তা হল ওই শ্রেণি সমন্বয়। এখন বিলাসবহুল নামী হোটেলে রাত্রি যাপন করা সেই যৌনকর্মী যার মজুরি পঁচিশ-পঞ্চাশ হাজার আর হাড়কাটার গলিতে দাঁড়ানো পঁচিশ-পঞ্চাশ টাকার খেদি এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে একই সরণিতে। দুজনেই আকাশে হাত ছুঁড়ছে–পুলিশি জুলুম বন্ধ কর। ন্যায্য পারিশ্রমিক দাও। সামাজিক স্বীকৃতি দাও।
এই রকম আর একটি আন্দোলন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে গড়ে তোলা হয়েছে খেলা নিয়ে। এ খেলা রাজার খেলা, খেলার রাজা–নাম ক্রিকেট। আলালের ঘরের এগারো জন দুলাল একটা বল আর একটা কাঠের তক্তা দিয়ে যা খেলে। যখন এই খেলা চলে–টেলিভিশন-পত্রিকায়-রেডিওতে এমন মাতামাতি শুরু হয় যেন দেশে আর কোন সমস্যাই নেই। বেকার সমস্যা মিটে গেছে। দ্রব্যমূল্য কমে গেছে।বন্ধ কলকারখানা খুলে গেছে। আর আমলাশোলে কেউ না খেয়ে নেই। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে।
ক্রিকেট খেলা যখন চলে, তখন শুধু খেলা চলে। যখন খেলা চলে না, রাজনীতি চলে। একবার ইণ্ডিয়ান টিম থেকে এক বঙ্গ সন্তান বাদ পড়েছিল। তা নিয়ে তখন বিধান সভায় পর্যন্ত আলোচনা হয়। পানীয় জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, বিপিএল কার্ড নেই, একশো দিনের কাজ নেই, ও সব পরে–আগে খেলা।
সারাদেশকে এই খেলায় এমন মাতিয়ে দেওয়া গেছে যে নিঃশব্দে এখানেও ঘটে গেছে শ্রেণি সমন্বয়। সৌরভ গাঙ্গুলি দল থেকে বাদ গেলে সল্টলেকের সেই মূল্যবান বাড়ির বাসিন্দা যেমন গর্জে ওঠে–এটা অন্যায়, সমস্ত বাঙালি জাতির প্রতি অবিচার। গর্জায় রেল লাইনের ধারের ঝুপড়িবাসি–আমাগার ময়রাজারে নেয়নে, ঠিক করেনে।
এই শ্রেনি সমন্বয়ের এক অপূর্ব নিদর্শন দেশজোড়া উথাল পাতাল দলিত আন্দোলন। আর কেউ নয়–শুধু উচ্চবর্ণ মানুষেরাই আমাদের সব দুর্ভোগ সব অপমানও পিছিয়ে পড়ার কারণ। চাকরি বাকরি ব্যবসা রাজনীতি শিল্প সাহিত্য সব কিছুতে আমাদের বঞ্চিত করে, দখল করে নিয়েছে মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণ। ওদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। কেড়ে নিতে হবে অধিকার। এই আন্দোলনও কিছু মানুষকে নেতাগিরির ব্যবসা চালানো ধূর্ত লোকের পাশে-পিছনে এনে দাঁড় করিয়েছে। তারা জানে না যে ব্রাহ্মণ্যবাদ আসলে পুঁজিবাদেরই খণ্ডিত রূপ। যার বৃহৎ এবং বিকশিত রূপ সাম্রাজ্যবাদ। যদি সঠিক নেতৃত্বে সঠিক দিশায় পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা হয়–সব শোষণ আপনা আপনি মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। তা জানা না থাকায় এই দলিত আন্দোলনের যে নেত্রী–কোটি কোটি টাকার মালকিন সেই চামার কি বেটি–আর রাস্তার মোড়ে বসে জুতায় পেরেক ঠোকা রুইদাস হয়ে গেছে এক লড়াইয়ের সহযাত্রী। কিন্তু যদি কোনদিন রুইদাস তার বহিনজির বাড়ি যায়–ভিতরে ঢুকতে পারবে না, যতই এক জাত হোক। ঢুকবে সে যার চেহারায় চটক থাকবে। জাত যাই হোক।
এই রকম আরও একটি দুটি সংস্থা বা সংগঠন গড়া হয়েছে প্রতিবন্ধী মানুষজনদের নিয়ে। এই সব কর্মকাণ্ডের মূলেও রয়েছে সেই শ্রেণি সমন্বয়। বহুতল বাড়ির বিত্তবান সেই বাসিন্দা, হতে পারে যার একটা পা বা একটা হাত প্লেন দুর্ঘটনা বা দামি মোটরকারের রেসে খোয়া গেছে। আর অন্য একজনের পা বা হাত গেছে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে কুমির কামটের ধারালো দাঁতে অথবা কাঠ বা মধু সংগ্রহ করতে গভীর জঙ্গলে গিয়ে বাঘের থাবায় কিংবা কামড়ে।
একজন ধনবান আর একজন নিঃস্বনির্ধন, দুজন সেই পুরনো শ্রেণি দ্বন্দ্ব ভুলে অঙ্গহানি জনিত কষ্ট এবং সমস্যার কারণে এসে দাঁড়িয়েছে এক সংগঠনের ছাতার তলায়। একজনের দাবি রেলে প্রতিবন্ধীদের ভাড়া মুকুব করার। অন্যজনের? আমি ঠিক জানি না, হতে পারে রাজ্য সভায় প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন।
আমি এক প্রতিবন্ধী স্কুলে কাজ পেয়েছি।
এই স্কুলে চারজন দারোয়ান! একজন সেই বিহারি। যে এখনও কোনো বাসস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারায় চব্বিশ ঘন্টাই স্কুলে থাকে। হোস্টেলে খায়, অফিস ঘরে ঘুমায়।
একজনের নাম পালদা, তার বাড়ি যাদবপুর স্টেশনের দক্ষিণদিকে এক পাড়ায়। লোকটা খুবই সাদাসিধা কারও কোনো সাতে পাঁচে থাকে না। আসে, ডিউটি করে, চলে যায়। লোকটার ছোটবেলায় পোলিও হয়েছিল। সেই রোগে শরীরের একটা দিক পঙ্গু হয়ে গেছে।
আর একজন-এর নাম সাহা। সে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ থেকে দালাল ধরে চোরা পথে ভারতে এসেছিল। তখন এক ভাড়া বাসায় থাকত আর মজুরের কাজকর্ম করত। সে কেমন করে কী ভাবে কে জানে একদিন পৌঁছে যায় বড় সাহেবের প্রাসাদোপম ভবনে। যেখানে কাজ পেয়ে যায় বাগান পরিচর্যার। চালাক লোক। বুঝতে পারে এই সাহেবকে ধরে থাকলে বিদেশ বিভূঁইয়ে কোনো বিপদ আপদ স্পর্শ করতে পারবে না। পাসপোর্ট নেই ভিসা নেই এদেশের ভোটার লিস্টে নাম নেই রেশন কার্ড নেই। সব নেই আছে হয়ে যাবে, যদি বড় সাহেবের কৃপাদৃষ্টি পড়ে। ইতিহাস বলে হজরত মহম্মদ, আকবর বাদশা, বীর শিবাজী, রামকৃষ্ণ পরমহংস এনারা সব নাকি সেই অর্থে শিক্ষিত ছিলেন না। তবু তাদের কেউ নির্বোধ বলতে পারবে না। বিদ্যা বুদ্ধিতে এরা যে কোন বোদ্ধার চাইতে শ্রেষ্ঠ মহান।
ওই বাংলাদেশী সাহাও জীবনে সাক্ষরতা মিশনের কোনো ক্লাশে একদিনও যাবার সদিচ্ছা দেখায়নি। তবু তাকে বোকা বা অশিক্ষিত বলা যাবে না। জীবনের যে শ্রেষ্ঠ পাঠ তা পেয়েছে জীবনেরই কাছ থেকে। হিন্দিতে একটা কথা আছে–চাহে মরদ বনো ইয়া তো মরদকা বনকে রহো। যদি তুমি সমাজে যোগ্য হতে পারে অতি উত্তম। যদি তা না পারো একজন শীর্ষস্থানীয় কারও পদপ্রান্তে বসে পড়ো, শরণাগত হও। সমস্যা কেটে যাবে। বুদ্ধিমান সাহা তাই করেছিল। সেবা-আনুগত্যে হৃদয় জয় করে ফেলেছিল বড় সাহেবের। তার ফল মিলেছে হাতে হাতে। চাকরি পেয়ে গেছে এই স্কুলে। নদীর ওপারের এক গ্রাম্য স্কুল থেকে এসে গেছে একখানা অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ মার্কসিট। এখন সে রাত দশটায় স্কুলে আসে। বিছানা করে পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে যায় বড় সাহেবের বাড়ি, কিছুক্ষণ সেখানে থাকে। কিছু ফাঁই ফরমায়েস ঘাটে। তারপর নিজের বাসায়। বেশ সুখে আছে সে এদেশে এসে।
অন্যজনের নাম দাসদা, সে আগে এক মাছের দোকানে কাজ করত। আরও আগে বালক বেলায় বড় সাহেবের সাথে এক স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। তারপরে এক সাথে পাটি করেছে, বাহাত্তরে পাড়া ছেড়ে পালিয়েছে এক সাথে। ভাগ্য খারাপ সে এখনও রয়ে গেছে পার্টির এক সাধারণ সদস্য হয়ে আর বড় সাহেব তরতর করে উঠে গেছেন একেবারে শীর্ষে। সে জন্য তার মনে পার্টির প্রতি একটা চাপা রাগ আছে। কী পেলাম এত বছর পার্টি করে। শেষকালে এই বুড়ো বয়সে একটা দারোয়ানের চাকরি। ছ্যাঃ
শোনা যায় যখন সিরাজদৌল্লা নবাব হন, প্রথম দিনই ডেকে পাঠান তার বাল্যকালের শিক্ষককে। নবাবের ডাক পেয়ে বৃদ্ধ শিক্ষিত তো মহাখুশি। ভাবলেন সিরাজের জীবনে আজকের দিন সবচেয়ে আনন্দের দিন। এই দিনে আমাকে ডাকছে নিশ্চয় কোন পুরস্কার দেবে, সম্মান জানাবে। কিন্তু একি। যেই সেই শিক্ষক গিয়ে দরবারে দাঁড়ালেন, নবাব সিরাজ তার গালে কষিয়ে দিলেন পেল্লায় এক চড়। কী? না, কবে সেই শিক্ষক সিরাজকে চড় মেরেছিলেন তারই প্রতিশোধ।
কে জানে বড় সাহেবের এককালের বাল্যবন্ধু দাসের উপর কী কারণে খুব রাগ। হতে পারে সেই বালক বেলায় কিছু একটা হয়েছিল। এখন বড় সাহেব তার বদলা নেন। তিনি মাঝে মাঝে তাই দাসকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে দেন।
আমি এই বোবা স্কুলে রান্নার কাজে বহাল হয়েছি তখন প্রায় এক মাস হয়েছে। এখন পর্যন্ত জনা চল্লিশ বাচ্চা ভর্তি করা হয়েছে। বলা হয়েছে সর্বমোট পঞ্চাশজনকে রাখা হবে।তাদের খাওয়ানো দাওয়ানোর দায়িত্ব আমার। খোঁজ চলছে, পাওয়া গেলে আমাকে একজন সহকারি দেওয়া হবে। দিন কয়েক আগে একজন এসেছিল। সে উড়িয়া রাঁধুনি, বড় সাহেবের চেনা। সে ঘন্টা খানেক ঘুরে ঘুরে কাজের জায়গায় পরিবেশ, কর্মচারিদের আচার ব্যবহার প্রত্যক্ষ করে যা বোঝার তা বুঝে ‘আসছি’ বলে সরে পড়ে। আর আসে না। বাধ্য হয়ে আমি এখনও একাই বঁদির গড় রক্ষা করে চলেছি।
.
রান্নাঘর তিনতলার ছাদে।বাথরুম একতলায়।দুটো সর্বসাধারণের জন্য। একটা বড় সাহেবের আলাদা। সেটায় তালা মারা থাকে। উনি এলে তালা খোলা হয়। আজ উনি এসেছেন। বাথরুমের তালা খোলা হয়েছে। উনি বড় বাথরুমে গেছেন।
আমারও বাথরুমে যাবার প্রয়োজন। ছাদ থেকে নীচে নেমে দেখি অনেক লোক। সব বড় সাহেবের কাছে এসেছে। আর এককোণে কান ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দারোয়ান আধবুড়ো দাসদা।
একজন লোক যার বয়স কবে ষাট পেরিয়ে গেছে, যদিও চাকরি পাবার প্রয়োজনে কোনো স্কুল থেকে যে সার্টিফিকেট বানানো হয়েছে তাতে বয়স তিরিশ বত্রিশ। সেই বুড়ো লোকটা কান ধরে স্কুলের দুষ্টু বাচ্চার মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি হাসব না কাঁদব ভেবে পাই না। জানতে চাই–কী হয়েছে দাসদা?
কিছু না। বিব্রত জবাব দাসের।
তবে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
উনি কইলেন কান ধর। ধরলাম।
পরে শুনেছি, একা এই দাস নয়, এই রকম অকে বড় সাহেব কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। ওঠবস করান। এটা তার একটা প্রিয় খেলা। সব ক্ষমতাবানদেরই এই রকম এক একটা প্রিয় খেলা থাকে। যা করে তারা মজা পান। মন ভালো করেন।
সত্যি মিথ্যা জানি না, আমি শুনেছি নবাব সিরাজউদৌল্লা নাকি হাজার দুয়ারির গবাক্ষ থেকে পাশের নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া নৌকার যাত্রীদের মৃত্যু দৃশ্য দেখতে খুব ভালোবাসতেন। সৈন্যরা তার নির্দেশে অকারণে বহু নিরীহ লোককে এই জন্য ডুবিয়ে মারে।
এখন আমার কেন জানিনা মনে হয় দাস মরে গেল। আত্মসম্মান হারিয়ে ডুবে গেল অবমাননার অতল তলে।
.
আমি যেদিন এই বোবা স্কুলে আসি আমার ধারণায় ছিল যাদবপুর থেকে এতদুরে এত বছর পরে আমাকে কেউ চিনবে না। সেটা ছিল ভুল ধারণা। এই দাস আমাকে চিনত।
সে যখন মাছ বাজারে এক মাছের দোকানে কাজ করত আমি সে সময় রিক্সা চালাতাম। যারা মাছের কারবার করে তাদের একটা অতি প্রিয় শব্দ আছে সেটা হল ডান্ডিমারা। সেই যে এক সময় কাঠের দাড়িপাল্লা ছিল তখন থেকে কথাটার প্রচলন। যার নিহিতার্থ–মাপে কম দেওয়া। সেই কাঠের ডান্ডার পাল্লাকে মাছ ব্যাপারীরা এমন শকুনির পাশার মত বশ করে ফেলেছিল যে চোখের সামনে তিন পোয়া মাছকে এক সের বানিয়ে দিতে পারত। কারো ক্ষমতা ছিল না ধরার।
এরপর এল কাটা পাল্লা। সেই পাল্লাকেও বশ করে নিল তারা। তবে কথাটা আর কাটামারা না হয়ে সেই ডান্ডিমারাই রয়ে গেল। কী রে খুব তো ডান্ডি মারলি, চা খাওয়া।
সেদিন সেই মাছের দোকানে এক অনুষ্ঠান বাড়ির জন্য প্রচুর মাছমাপা হচ্ছিল। বেশ প্রাণভরে ডান্ডা মারছিল সে। আমি সেখানে ছিলাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়ে যায় পাল্লার তলার দিকে একটা ছোট চুম্বক সাঁটানো রয়েছে। ওজনে প্রায় একশো। ক্রেতাকে আমি সেটা দেখিয়ে দিই। তারপর যা হয় আর কী, দাসের বেইজ্জতির একশেষ। সেই দিন সে আমার মুখটা চিনে রেখেছিল। রিক্সা চালাতাম, ফলে পথেঘাটে বহুবার আমাকে দেখেছে। মনের মধ্যে একেবারে গেঁছে গিয়েছিল আমার মুখটা। তাই প্রথম দিনই আমাকে দেখে চিনতে পেরে গিয়েছিল। এই সেই বদমাশ। সেদিন ছিল তার দুটো দশটার ডিউটি, আমাকে দেখেছিল বিকেল চারটে নাগাদ। তখন থেকেই ছটফট করছিল কতক্ষণে আমার পরিচয় সবাইকে বলবে। মনোরঞ্জন–ওর আসল নাম মদন। শালা আগে রিক্সা চালাত। মহা বদমাশ। আমাদের ছেলেরা একবার ঝাড় দিয়েছিল।
রোজ রাত আটটায় স্কুলে একটা জমাটি আড্ডা বসে। সে আড্ডায় হোস্টেল সুপার থাকে, থাকে স্পোর্টস টিচার, ওয়ার্ডেন আর এক অন্য শিক্ষক। ইনি আবার বড় সাহেবের ডান হাত। হাত তার অনেকগুলো। প্রত্যেককে এক একটা এলাকার দায়িত্বে রাখা হয়েছে। এই হাত স্কুলের কাজকর্ম দেখাশোনা করেন। অনেক কটা নির্মাণ প্রকল্প চলছে। তৈরি হচ্ছে কয়েকটা বড় বড় বিল্ডিং। তার ইট, বালি, সিমেন্ট, রড কোথা থেকে কেনা হবে সে সব ভার তার। এছাড়া সে বড় সাহেব এখানে এলে, কখন কী লাগে না লাগে, কী বলে আর না বলে, তারই জন্য বড় সাহেবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।
আজ অবশ্য আড্ডায় স্পোর্টস টিচার নেই। আর ওয়ার্ডেনও একটু আগে এসে গেছে। সাধারণত সে সাড়ে আটটার আগে আসতে পারে না। তাদের অনেকগুলো পারিবারিক ব্যবসা। প্রমোটারি, ক্যাটারিং, ক্যাডবেরির, মোবাইলের ডিলারশিপ। সব ভাইয়েরাই সামলায় তবে তাকেও কিছু কিছু দায় দায়িত্ব বহন করতে হয়। এই সব করে ডিউটিতে আসতে একটু দেরি তো হবেই।
তবে এটা ঠিক যে রোজ দু’বেলাই তিনি আসেন। প্রথম আসেন বেলা দশটা নাগাদ। থাকেন ঘন্টা খানেক। বাচ্চারা খেয়ে ক্লাসে চলে গেলে তারপর উনি বাড়ি যান। রাতে আসেন সাড়ে আটটায়। এবেলা থাকেন প্রায় দেড় ঘন্টা। বাচ্চারা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লে দরজায় তালা দেওয়া হলে সেদিনের মতো শেষ হয় তার কাজ। এই দুবেলাই তিনি নিয়ম করে বাচ্চা গোনেন। দেখেন সব ঠিক আছে না কেউ পালিয়েছে।
শোনা যায় কোথায় কোন এক রাজার নাকি এক মন্ত্রী ছিল। যার কাজ ছিল নদীর ঢেউ গোনা। এখানে এক নেতার দুজন কর্মচারি আছে যাদের কাজ বাচ্চা গোনা। সেই রাজার গল্প শুনে লোকে যেমন বিশ্বাস করবে না সত্যিই তার এমন কোনো মন্ত্রী ছিল, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। বোবা স্কুলে এমন এক ওয়ার্ডেন আছে। আছে একজন আয়াও। যাদের কাজ বাচ্চা গোনা।
আজ আকাশে গোলাকার পূর্ণিমার চাঁদ ছিল। এই চাঁদ ক্ষুধার্ত মানুষের চোখে দেখা সেই ঝলসানো রুটি মার্কা চাঁদ নয়। এই চাঁদ বড় মোহ মদির আলো ছড়ানো মায়াবি চাঁদ। এক কিশোর কবি ঘুন ধরা বুকে গভীর যন্ত্রণায় কবিতায় একদা যে চাঁদের ছবি এঁকেছিল। যে কবিতা একদিন বামপন্থী পার্টির কর্মীদের মুখে মুখে ফিরত, সে কাল–অনেক কাল আগে কবরে গেছে। অনেক ভেবেচিন্তে তাকে কবরে দফন করা হয়েছে। আজকের চাঁদ চকচকে রূপোর টাকার প্রতিরূপ। এই চাঁদ তাই উচ্চাশা প্রিয় মানুষের উপাস্য। পার্টির অদৃশ্য প্রতীক।
সেই প্রিয় চাঁদের আলোয় বেঞ্চির উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে তার উপর মুড়ি চানাচুর মাখা হয়েছে। সকালবেলা দিনের আলোয় একাগজখানা সব সিপিএম কর্মীর কাছে একটা বিরক্তির কারণ ছিল। প্রথম পাতাতেই পরিবেশন করেছিল একটা চরম মিথ্যা সংবাদ। আমলাশোলে অনাহারে নাকি মানুষ মারা যাচ্ছে। সব বকেয়াস। স্বাধীনতার পর এ দেশের কোথাও কোন লোক না খেয়ে মরেনি। মরলে মরেছে অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে। কেন ওসব খায়?
আর পশ্চিমবঙ্গে? এখানে বামফ্রন্টের সুশাসন চলছে। এখানে অনাহার তো বহুদুর–কিছু লোক অতি ভোজনে স্থলবপু হয়ে গেছে। এখন তারা বাড়তি ওজনের কারণে কঠিন সমস্যায় ভুগছে।
বিশ্বকবি বলেছেন–আমি দেখছি তাই চাঁদটা ওখানে আছে। না দেখলে নেই। বলেছেন আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ।
ওনার ওই মহাপ্রাজ্ঞ বাণীর সমর্থন আমাদের ধর্মগ্রন্থেও পাওয়া যায়। যাহা নাই ভান্ডে তাহা নাই ব্রম্মান্ডে। এর সরল সোজা মানে–আমি যা জানি সেটাই সঠিক যা জানি না সেটা ভুল। তাহলে আমি যে জানি–আমার মতো বহু বহু মানুষ যারা নিজেরাই স্বীকার করে বামফ্রন্ট ক্ষমতা আসার আগে ভিখারির বাচ্চা ছিলুম, এখন তাদের ফ্রিজ ভর্তি খাবার পচে যায়। সে ক্ষেত্রে কী করে মেনে নেব না খেয়ে লোক মরে। সব ঝুট হ্যায়।
এখন পাকার মুড়ি চানাচুর ঢেকে ফেলেছে পত্রিকার পাতার সেই বামফ্রন্ট বিরোধী মিথ্যাচার। মুড়ি খাচ্ছে আর গল্প করছে কজন সুখী লোক। সেখানে গিয়ে কোনো ভনিতা না করে জানায় সেই দুঃখিত দাস-বড় সাহেব এ কারে নিয়া আইল আমাগো মইধ্যে! আমরা যারা আছিলাম, বেবাক আছিলাম একই রকম। একটা উটকা লোক। কী দরকার আছিল আনার।
কার কথা বলছ? জানতে চায় ওয়ার্ডেন।
ওই যে আইজ রান্নার কামে আইছে।
চেনো নাকি ওকে?
তিরিশ বছর আগে থিকা চিনি।
মুড়ির পরে গরম চা। আমি গরম চায়ের কেটলি নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দুজনে তখনকার মতো কথা বন্ধ করে। তোমারে পরে সব কমু। জানিয়ে রাখে দাসদা।
***