হযরত দানিয়াল (আ)-এর বিবরণ
ইব্ন আবিদ দুনিয়া …….. আবদুল্লাহ ইব্ন হুজায়াল থেকে বর্ণনা করেন যে, বুখত নসর দুটি সিংহ ধরে একটি কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করে এবং নবী দানিয়ালকে এনে ঐ দুটি সিংহের মধ্যে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সিংহ দুটি তার উপর কোনরূপ আক্রমণ করেনি। তিনি দীর্ঘক্ষণ সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই অবস্থান করার পর মানুষেব জৈবিক চাহিদা অনুযায়ী তার খাদ্য পানীয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে নবী আরমিয়াকে দানিয়ালের জন্যে খাদ্য পানীয় প্রস্তুত করতে বলেন। তিনি বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি থাকি বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকায়, আর দানিয়াল আছেন সুদৃঢ় ইরাকের বাবিল শহরে। সেখানে আমি কিভাবে খাদ্য পানীয় পৌছােব? আল্লাহ বললেন, হে আরমিয়া, আমি তোমাকে যা আদেশ করেছি, তুমি তা-ই কর; প্রস্তুতকৃত খাদ্য সামগ্ৰীসহ তোমাকে সেখানে পৌঁছিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা শীঘ্রই আমি করছি। আরমিয়া (আ) খাদ্য তৈরি করলেন। তারপর এমন একজনকে প্রেরণ করা হলো, যিনি খাদ্য পানীয়সহ আরমিয়াকে উক্ত কুপের পাড়ে পৌঁছিয়ে দিলেন। দানিয়াল ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কে? আরমিয়া (আ) নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন- আমি আরমিয়া। দানিয়াল (আঃ) বললেন, কেন আপনি এখানে এসেছেন? আরমিয়া (আ) জানালেন, আপনার প্রভু আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। দানিয়াল (আঃ) বললেন, তা হলে আমার প্রভু আমাকে স্মরণ করেছেন? আরমিয়া বললেন, জী হ্যাঁ। তখন বলে উঠলেন : সমস্ত প্ৰশংসা সেই আল্লাহর যাকে কেউ স্মরণ করলে তিনি তাকে ভুলেন না; সমস্ত প্ৰশংসা সেই আল্লাহর, যাকে কেউ আহবান করলে তিনি সে আহবানে সাড়া দেন; সমস্ত প্ৰশংসা সেই আল্লাহর, যার প্রতি কেউ নির্ভরশীল হলে তিনি তাকে অন্যের দিকে ঠেলে দেন না; সমস্ত প্ৰশংসা সেই আল্লাহর, যিনি উত্তম কাজের উত্তম বিনিময় দান করেন; সমস্ত প্ৰশংসা সেই আল্লাহর, যিনি ধৈর্যের বিনিময়ে মুক্তি দান করেন; সমস্ত প্ৰশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন : সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদের বিশ্বাস ও কর্মদ্যোম শিথিল হয়ে পড়লে দৃঢ়তা দান করেন; সমস্ত প্ৰশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদের সকল উপায় শেষ হবার পর একমাত্র ভরসা স্থল।
ইউনুস ইব্ন বুকায়ার ……. আবুল আলিয়া থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা যখন তুস্তর শহর জয় করি, তখন হরমুযানের বাড়িতে একটি খাটের উপর একটি মৃত দেহ দেখতে পাই। তার লাশের শিয়রের কাছে একটি আসমানী কিতাব। আমরা তা নিয়ে আসি এবং হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবকে দেখাই। তিনি হযরত কবকে ডেকে তার দ্বারা তা আরবীতে অনুবাদ করান। আবুল আলিয়া বলেন, আরবদের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম ঐ কিতাবখানার অনূদিত কপি পাঠ করি, যেভাবে আমি কুরআন পাঠ করে থাকি। খুলদ ইব্ন দীনার বলেন, আমি আবুল আলিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, তাতে কী লেখা ছিল? তিনি বললেন, তাতে লিখিত ছিল তোমাদের কর্মকাণ্ড, ঘটনাবলী, কথাবার্তা ও পরবর্তীকালে ঘািটতব্য সার্বিক অবস্থা। আমি বললাম, আপনারা সে লোকটিকে কী করলেন? তিনি বললেন, আমরা দিনের বেলা তেরটি কবর খুঁড়লাম এবং রাত্রিকালে একটি কবরে তাঁকে দাফন করে সবকটি কবর একই রূপ করে দিলাম। এ ব্যবস্থা করলাম যাতে সাধারণ লোক তার কবরের সন্ধান না পায় এবং কবর খুঁড়ে না ফেলে।
বর্ণনাকারী জিজ্ঞেস করলেন, মানুষ তার কাছে কী প্রত্যাশ করে? আবুল আলিয়া বললেন, বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ হয়ে গেলে লোকজন এ খাট নিয়ে ময়দানে এসে বৃষ্টি কামনা করতো এবং এর ফলে বৃষ্টিপাত হত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ মৃত লোকটিকে জানেন কি? আবুল আলিয়া বললেন, তার নাম দানিয়াল বলে শোনা যায়। রাবী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কত বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন? আবুল আলিয়া বললেন তিনশ বছর পূর্বে। রাবী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এ সময়ের মধ্যে তার মৃতদেহের কোন পরিবর্তন হয়েছিল কি? আবুল আলিয়া বললেন, না, তবে মাথার পিছনের দিকের কয়েকটি চুলের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। নবীদের দেহ মাটিতেও পাচে না এবং জীবজন্তুও খায় না। এ ঘটনাটি আবুল আলিয়া থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। তবে তার মৃত্যু তারিখ যদি তিনশ বছর পূর্বে হওয়া সঠিক হয় তা হলে তিনি নবী নন, বরং কোন পুণ্যবান ব্যক্তি হবেন। কেননা, সহীহ বুখারী শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সা) ও ঈসা ইব্ন মারিয়ামের মধ্যে অন্য কোন নবীর আগমন ঘটেনি। আর এ দুই নবীর মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান চারশ বছর। কারও মতে ছয়শ বছর, কারও মতে ছয়শ বিশ বছর। কোন কোন লেখক ঐ ব্যক্তির মৃত্যু আটশ বছর পূর্বে হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
ঐতিহাসিক মতে দানিয়ালের মৃত্যুও প্রায় এই সময়ে হয়েছিল। এ হিসাব অনুযায়ী মৃত ব্যক্তি দানিয়ালও হতে পারেন, বা অন্য কোন নবীও হতে পারেন, কিংবা কোন নেককার লোকও হতে পারেন। তবে দানিয়াল হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কেননা দানিয়াল নবীকেই পারস্য সম্রাট ধরে নিয়ে বন্দী করে রেখেছিল। আবুল আলিয়া থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, মৃত ব্যক্তিটির নাক এক বিঘত লম্বা ছিল। আনাস ইব্ন মালিক (রা) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তার নাক এক হাত লম্বা ছিল। এ দিকে লক্ষ্য করলে বলা যেতে পারে যে, এ লাশ বহু পূর্বের, দূর অতীতের কোন নবীর লাশ।
আবু বকর ইব্ন আবিদদুনিয়া … তাঁর রচিত কিতাবু আহকামিল কুবুর গ্রন্থে আবুল আশআছের বরাতে লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : নবী দানিয়াল আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন যে, তার দাফনকার্য যেন উম্মতে মুহাম্মাদীর হাতে সুসম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে আৰু মূসা আশআরীর হাতে তুস্তর নগরী বিজিত হলে তার লাশ একটি সিন্দুকের মধ্যে দেখতে পান। এ সময় তাঁর দেহের শিরা ও কাঁধের মোটা রাগ দুটি নড়াচড়া করছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, যে ব্যক্তি দানিয়ালের লাশ সনাক্ত করিয়ে দেবে, তাকে জান্নাতের সু-সংবাদ দিবে। হার কুস নামক এক ব্যক্তি দানিয়ালের লাশ সনাক্ত করেছিলেন। আবু মূসা (রা:) হযরত উমর (রা)-কে এ বিষয়ে অবহিত করেন। তখন হযরত উমর (রা) পত্র মারফত তাকে জানান যে, দানিয়ালকে ওখানে দাফন কর এবং হার কুসকে আমার নিকট পাঠিয়ে দাও- কেননা, নবী করীম (সা) তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করেছেন। বর্ণিত সূত্রে হাদীছটি মুরসাল এবং এর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
ইব্ন আবিদ দুনিয়া … আম্বাসা ইব্ন সাঈদ থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু মূসা মৃ দানিয়ালের সাথে একখানা আসমানী কিতাব, চর্বি ভর্তি একটি কলস, কিছু সংখ্যক দি; ১২:ম ও তার ব্যবহৃত আংটি পান। এরপর হযরত উমর (রা)-কে এ সম্পর্কে অবহিত করে আবু মূসা (রা) পত্র লিখেন। হযরত উমর (রা) চিঠির মাধ্যমে আবু মূসাকে জানান, আসমানী কিতাবখানা আমাদের নিকট পাঠিয়ে দাও, চর্বির কিছু অংশ আমাদের জন্য পাঠাও এবং অবশিষ্ট অংশ থেকে আরোগ্য লাভের জন্যে মুসলমানদেরকে তোমার পক্ষ থেকে ব্যবহার করতে দাও, আর দিরহামগুলো তাদের মাঝে বণ্টন কর এবং আংটিটি তুমি ব্যবহার কর! ভিন্ন সূত্রে ইব্ন আবিদ দুনিয়া থেকে বর্ণিত, আৰু মূসা (রা) যখন দানিয়ালের লাশ পেলেন, তখন তিনি ত জড়িয়ে ধরেন, ও চুম্বন করেন। অতঃপর তিনি হযরত উমর (রা)-কে এ বিষয়ে অবহিত কবেন এবং জানান যে, তার লাশের সাথে প্রায় দশ হাজার দিরহাম মূলোয় ধন-সম্পদ পাওয়া গিয়েছে; বিভিন্ন লোক তাথেকে ধার নেয় এবং পরে ফেরত দিয়ে যায়। কেউ ফেরত না দিলে রোগে আক্রান্ত হয়। তার পাশে আন্তর ভর্তি একটি কোটাও রয়েছে। হযরত উমর (রা:) আবু মস্যাকে জানান যে, তাকে বরই পাতা মিশানো পানি দ্বারা গোসল করিয়ে, কাফন পরিয়ে দাফন কর এবং তার কবরটি এমনভাবে গোপন রাখা যেন কেউ তার সন্ধান না পায়! মালামাল সম্পর্কে জানান যে, সেগুলো বায়তুল্যমালে জমা কর, আতরের কৌটা। পাঠিয়ে দাও এবং আংটিটি তুমি নিজে ব্যবহার কর।
আবু মূসা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তার নির্দেশক্ৰমে চারজন বন্দী নদীর মধ্যে বাধ দিয়ে তার তলদেশে কবর খুঁড়ে সেখানে হযরত দানিয়ালের লাশ দাফন করে। পরে আবু মূস, (রা) ঐ চার বন্দীকে ডেকে এনে হত্যা করে দেন ॥১ ফলে আবু মূসা আশআরী (রা:) ব্যতীত উক্ত কবরের সন্ধান জানার মত আর কেউ অবশিষ্ট থাকল না। ইব্ন আবিদ দুনিয়া ……. আবুয-যিনাদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমি আৰু মূসা আশআরীর পুত্র আবু বুরদার হাতে একটি আংটি দেখেছি, যাতে দুটি সিংহ এবং সিংহদ্বয়ের মাঝে জনৈক ব্যক্তির চিত্র অংকিত রয়েছে; আর সিংহ দুটি ঐ লোকটিকে জিহবা দ্বারা চাটছে। আবু বুরদা বললেন, এটি ঐ লোকটির আংটি-যাকে এই শহরের লোক দানিয়াল নামে জানে। তাকে দাফন করার সময় আবু মূসা (রা) তা নিজের কাছে তুলে রাখেন।
আবু বুরদা বলেন, আবু মূসা আশাআরী (রা) উক্ত জনপদের লোকজনের নিকট আংটিতে অংকিত এ চিত্রের কারণ জানতে চাইলে তারা জানায়, দানিয়ালের আবির্ভাবকালে দেশের যিনি শাসনকর্তা ছিলেন, তার নিকট জ্যোতিষী ও গণকদল এসে ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, অমুক রাত্রে আপনার রাজ্যে এমন একজন শিশুর জন্ম হবে, যে এ রাজ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
১. সম্ভবত এরা ছিল মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কয়েদী।
রাজা বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ রাত্ৰে যত শিশুর জন্ম হবে, আমি তাদের সকলকে হত্যা করব। বাস্তবে রাজা তাই করলেন। অবশ্য, শিশু দানিয়ালকে রাজার লোকজন সিংহ পালের মধ্যে নিক্ষেপ করে চলে যায়। কিন্তু সিংহ তার কোন ক্ষতি করল না; বরং দুটি সিংহ শিশুটিকে জিহ্বা দ্বারা চেটে সুস্থ রাখে। অতঃপর শিশুটির মাতা এসে সন্তানকে এ অবস্থায় দেখে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। এভাবে আল্লাহ দানিয়ালকে রক্ষা করেন এবং স্বীয় ইচ্ছা কার্যকরী করেন। আবু মূসা (রা) বলেন, ঐ জনপদের লোকজন জানায় যে, দানিয়ালের প্রতি আল্লাহর এ অনুগ্রহ স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্যে দানিয়াল তাঁর আংটিতে নিজেকে সিংহদ্বয়ের চাটারত অবস্থা চিত্রাংকিত করে রাখেন। এ বর্ণনার সূত্রটি হাসান পর্যায়ের।
বিধ্বস্ত বায়তুল মুকাদাস পুনঃনির্মাণ এবং বিক্ষিপ্ত বনী-ইসরাঈলের পুনরায় একত্রিত হওয়ার বর্ণনা এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী :
—অথবা তুমি কী সে ব্যক্তিকে দেখনি, যে এমন এক নগরে উপনীত হযেছিল, যা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। সে বলল, মৃত্যুর পর কিরূপে আল্লাহ একে জীবিত করবেন? তারপর আল্লাহ তাকে একশ বছর মৃত রাখলেন। পরে তাকে পুনজীবিত করলেন। আল্লাহ বললেন, তুমি কতকাল অবস্থান করলে? সে বলল, একদিন অথবা একদিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি। তিনি বললেন, না, বরং তুমি একশ বছর অবস্থান করেছ। তোমার খাদ্য সামগ্ৰী ও পানীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য কর, তা অবিকৃত রয়েছে এবং তোমার গাধাটির প্রতি লক্ষ্য কর, কারণ তোমাকে মানব জাতির জন্য নিদর্শন স্বরূপ করব। আর অস্থিগুলোর প্রতি লক্ষ্য কর, কিভাবে সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই। যখন এ তার নিকট সুস্পষ্ট হল তখন সে বলে উঠল, আমি জানি যে, আল্লাহ নিশ্চয়ই সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। (२ बादशद्धी 8 २१०)।
হিশাম, ইব্ন কালবী বলেন, অতঃপর আল্লাহ আরমিয়া নবীর নিকট ওহী প্রেরণ করে। জানালেন যে, আমি বায়তুল-মুকাদাসকে পুনরায় আবাদ করব। সুতরাং তুমি সেখানে যাও ও অবস্থান কর। নির্দেশ মতে আরমিয়া (আ) সেখানে গেলেন এবং দেখলেন যে, গোটা নগরী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। অবাক বিস্ময়ে তিনি ভাবলেন, সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ আমাকে এ নগরীতে অবস্থান করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন যে, তিনি একে পুনরায় আবাদ করবেন; কিন্তু তা কবে? এমন বিধ্বস্ত নগরীকে তিনি কতদিনে কিভাবে আবাদ করবেন? এসব চিন্তা করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে গেলেন। তার সাথে ছিল একটি গাধা ও কিছু খাদ্য দ্রব্য। এ ঘুমের মধ্যে তাঁর সত্তর বছর কেটে যায়। ইতিমধ্যে বুখত নসর ও তার মনিব সম্রাট লাহ্রাসার মৃত্যু হয়। লাহ্রাসার একশ বিশ বছর যাবত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বাশতাসােব তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁরই রাজত্বকালে বুখত নসরের মৃত্যু হয়। বাশ্বতসাব সিরিয়া (শাম) সম্পর্কে অবগত হলেন যে, দেশটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে আছে, সমগ্ৰ ফিলিস্তান হিংস্র শ্বাপদে ভরে গিয়েছে এবং মানুষের কোন অস্তিত্ব সেখানে নেই। তাই যারা নিজেদের দেশে সিরিয়ায় ফিরে যেতে চাও, যেতে পার। তিনি দাউদ বংশের একজনকে তাদের রাজা বানিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসসহ অন্যান্য মসজিদ পুনর্নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। বনী ইসরাঈলরা তাদের রাজার সাথে আপন দেশ সিরিয়ায় চলে গেল এবং বায়তুল মুকাদ্দাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল।
আল্লাহ তখন আরমিয়ার চোখ খুলে দিলেন। তিনি নগরীর আবাদ হওয়া দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন। এভাবে তাঁর আরও ত্রিশ বছর কেটে যায়। ফলে পূর্ণ নিদ্ৰাকাল একশ বছর পূর্ণ হয় এবং তারপরে তিনি জাগ্রত হন। কিন্তু তিনি ধারণা করতে থাকেন যে, তার নিদ্ৰাকাল কয়েক ঘণ্টার বেশি হয়নি। অথচ নগরীকে তিনি দেখেছিলেন ধ্বংস ও বিধ্বস্ত। আর নিদ্রা থেকে জেগে এখন দেখতে পাচ্ছেন আবাদ নগরী হিসেবে। তাই সহসা বলে উঠলেন, আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন। অতঃপর বনী ইসরাঈলরা তথায় বসবাস করতে থাকে। আল্লাহ তাদের রাজত্ব ফিরিয়ে দিলেন। এভাবে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়। তারপর তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে দ্বন্দু কলহে লিপ্ত হয়। এ সুযোগে রোমান সম্রাট তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের দেশ দখল করে নেয়। রোমীয় খৃষ্টানদের শাসনাধীনে থেকে বনী ইসরাঈলের শক্তি ও ঐক্য-সংহতি কিছুই অবশিষ্ট থাকল না।
ইব্ন জারির (র) তার ইতিহাস গ্রন্থে উক্ত ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও লিখেছেন যে, লাহ্রাসাব ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক। প্ৰজাবৰ্গ, সামন্ত রাজগণ, অধিনায়কগণ ও শহর-নগর সবই ছিল তার অনুগত আজ্ঞাবহ। নগর তৈরি, নদী খনন ও সরাইখানা নির্মাণে তিনি ছিলেন অতিশয় বিজ্ঞ ও পারদশী। একশ বছরের উর্ধের্ব রাজ্য শাসনের পর দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়লে আপন পুত্র বাশতাসবের নিকট ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বাশতাসবের আমলে সেদেশে মাজুসী ধর্মের (অগ্নিপূজার) উদ্ভব হয়। এ ধর্মের
সূচনা করেন যারদাশত নামক এক ব্যক্তি। তিনি নবী আরমিয়ার সঙ্গে থাকতেন। নবীর উপর কোন এক কারণে তিনি রাগান্বিত হন। নবী তাকে অভিশাপ দেন। ফলে যারদাশত কুণ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়। অতঃপর তিনি আজার-বাইজানে গিয়ে বাশতাসবের সাথে মিলিত হন এবং তাকে নিজের উদ্ভাবিত মাজুসী ধর্মে দীক্ষিত করেন। এই ধর্ম গ্রহণ করার জন্যে বাশতাসব জনগণের উপর ভীষণভাবে চাপ সৃষ্টি করে। যারা স্বীকার করতে রাজি হয়নি তাদেরকে সে পাইকারীভাবে হত্যা করে। বাশাতাসবের পরে তার পুত্ৰ বাহমান পারস্যের সম্রাট হয় এবং রাজ্য শাসনে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে।
বুখত নসর উপরোক্ত তিনজন সম্রাটের অধীনে আঞ্চলিক শাসনকর্তা ছিল এবং দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিল। উপরোক্ত বর্ণনার সারমর্ম হল— ইব্ন জারিরের মতে, উক্ত জনপদের মধ্য দিয়ে অতিক্রমকারী ব্যক্তি হলেন হযরত আরমিয়া (আ)। কিন্তু ওহাব ইব্ন মুনাববিহ, আবদুল্লাহ ইব্ন উবায়দ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ হযরত আলী, আবদুল্লাহ ইব্ন সালাম, ইব্ন আব্বাস, হাসান, কাতাদা, সুদন্দী, সুলায়মান ইব্ন বুরায়দা প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, উক্ত অতিক্রমকারী ব্যক্তি হযরত উযায়র (আ)। শেষোক্ত বর্ণনার সূত্র উপরের মতের বর্ণনার সূত্রের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী এবং প্রথম যুগের ও পরবর্তী যুগের আলিমগণের অধিকাংশের নিকট বেশি প্ৰসিদ্ধ।