আট
সেপাইরা গাড়িটাকে ঘিরে ফেলল। প্রত্যেকেই অস্ত্র উঁচিয়ে রেখেছে। নির্দেশ পাওয়ামাত্র গুলি ছুটবে। ভার্গিস চুরুট চিবোতে চিবোতে গাড়িটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘রাস্তায় নেমে আসতে হবে।’
স্বজন পৃথার দিকে তাকাল। এত কাণ্ডের পরে শহরে ঢুকে এ রকম অভ্যর্থনা কপালে জুটবে তা ওরা ভাবতে পারেনি। পৃথার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। কোনওরকমে দরজা খুলে স্বজন আগে নামল, পৃথাকে নামতে সাহায্য করল। তারপর ভার্গিসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা এই শহরে এইমাত্র ঢুকেছি। কিন্তু আপনারা যেভাবে আমাদের ঘিরে ধরেছেন তাতে মনে হচ্ছে আমরা অপরাধী।’
‘এত রাত্রে এই শহরে কোনও ভূদ্রমানুষ আসে না। পরিচয়টা কি?’
‘আমি একজন ডাক্তার। ইনি আমার স্ত্রী।’
‘যে কেউ যখন ইচ্ছে এমন পরিচয় দিতে পারে। লিখিত প্রমাণ কিছু আছে?’
স্বজন আবার গাড়ির ভেতর মাথা গলিয়ে নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বের করে ভার্গিসকে দিল। দিয়ে বলল, ‘এই জিনিসটা যে কেউ যখন ইচ্ছে তৈরি করিয়ে রাখতে পারে।’
‘আচ্ছা।’ ভার্গিস ছোট চোখে স্বজনকে দেখলেন, ‘শরীরে দেখছি চমৎকার তেল আছে। আমার এখানে ওই তেল বের করে নেবার যন্ত্র নেই এমন ভেবো না ডাক্তার। আমি এখানকার সি পি, কথা বলবে বুঝেসুঝে। গাড়িটার এই হাল হল কি করে?’
‘অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।’
ভার্গিস গাড়িটাকে পাক দিয়ে এলেন, ‘মিথ্যে কথা বলার অপরাধে তোমাকে গ্রেপ্তার করা হল। কাল সকালে এক প্রস্ত কথাবার্তা বলার পর সিদ্ধান্ত নেব।’
‘কি বললেন? আমি মিথ্যে কথা বলছি?’ প্রায় চিৎকার করে উঠল স্বজন।
একশো বার, অ্যাকসিডেন্টে গাড়ির একটা দিক আঘাত পায়। এ গাড়ির কোনও দিকই বাকি নেই। তুমি কি আমাকে নির্বোধ মনে করছ? তোমার এই টিনের বাক্সটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে আঘাত করা হয়েছে। কোন অ্যাকসিডেন্টে এমন হয়?’ ভার্গিস সেপাইদের ইশারা করতে তাদের দুজন এগিয়ে এসে স্বজনকে ধরে ফেলল। ভার্গিস এবার পৃথার সামনে দাঁড়ালেন, ‘ম্যাডাম। আমি অত্যন্ত দুঃখিত। এই মুহূর্তে আমরা এমন এক উদ্বেগে আছি যে কোনও ঝুঁকি নিতে পারি না। তবে যেহেতু আপনি একজন মহিলা এবং সুন্দরী তাই এই শহরে আপনি নিরাপদ যতক্ষণ আপনি রাষ্ট্রবিরোধী কোনও কাজ না করছেন। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের রেস্ট হাউসে যেতে পারেন অথবা কোনও ঠিকানা থাকলে সেখানে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে।’
এতক্ষণে যেন নিজেকে ফিরে পেল পৃথা, ‘আমার স্বামীকে আপনি গ্রেফতার করছেন কেন?’
‘শুনতেই পেয়েছেন কেন ওকে আমার প্রয়োজন। এই শহরে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত কিছু মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাকে নিঃসন্দেহ হতে হবে যে আপনার স্বামী তাদের দলে নেই।’
‘আমরা যদি সেইরকম কেউ হতাম তা হলে কি এমন প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম?’
‘আপনার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না ম্যাডাম। আপনারা কোথায় যাচ্ছিলেন?’
‘টুরিস্ট লজে।’
‘ওখানে কি জায়গা পাবেন?’
‘আমাদের জন্যে ঘর বুক করা আছে।’
‘আচ্ছা! শহরে আসার উদ্দেশ্য কি?’
‘আমরা বেড়াতে এসেছি।’
‘সেটা সত্যি হলে আমি খুশি হব। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।’ ভার্গিস ইশারায় নিজের গাড়ি দেখালেন। পৃথা মাথা নাড়ল, ‘না আমরা একসঙ্গে যাব। আমি আবার বলছি ওকে মিছিমিছি সন্দেহ করছেন। ও একজন বিখ্যাত ডাক্তার। বিদেশেও কাজ করেছে।’
ভার্গিস এ-কথায় কান দিলেন না। তাঁকে অনুসরণ করে সেপাইরা স্বজনকে জোর করে টেনে নিয়ে জিপে তুলল। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ভার্গিস চিৎকার করলেন, ‘এখান থেকে সোজা পাঁচ মিনিট এগিয়ে গেলেই টুরিস্ট লজ দেখতে পাবেন। গুডনাইট।’
একটি সুন্দরী মহিলাকে এমন সময়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে যাওয়া ভার্গিসের পক্ষেই সম্ভব, হায়দার মনে মনে বলল। পুরো দৃশ্যটা সে দেখেছে আড়াল থেকে। দেখতে দেখতে যে সন্দেহটা মনে আসছিল তা শুধু ওই মহিলার উপস্থিতিতেই গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তারের আসার কথা একা। আর ওই গাড়িটার দিকে তাকালে শুধু অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে শুনলে কিছুই শোনা হয় না। কোনও গাড়িকে এমন উদ্ভট চেহারা নিয়ে চলতে হায়দার কখনও দেখেনি। তাই ভার্গিস সন্দেহ করে ভুল করেনি।
পৃথা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। এমন একটা ঘটনা ঘটবে তা সে কল্পনা করতে পারেনি। যে পুলিশ অফিসারকে ওরা মাঝরাস্তায় নামিয়েছিল তাকে দেখেই কেমন অস্বস্তি হয়েছিল। লোকটা তাদের সাহায্য না করলে বাংলো থেকে বের হওয়া মুস্কিল হত বলেই উপেক্ষা করতে পারেনি। আজকের রাতটা খুব খারাপ, একই সঙ্গে এতগুলো বিপদ তার কল্পনার বাইরে। ভোর হতে আর দেরি নেই। পৃথা ঠিক করল সে কোথাও যাবে না। এই ভাঙাচোরা গাড়ির মধ্যে সে অনেক নিরাপদ বোধ করবে আলো ফোটা পর্যন্ত। তারপর এখানকার পুলিশ-হেডকোয়াটার্সে যাবে স্বজনের খোঁজ নিতে। সে যখন ড্রাইভিং সিটের দিকে এগোচ্ছে তখনই লোকটাকে দেখতে পেল। খুবই সন্তর্পণে রাস্তার পাশের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে।
পৃথার হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠল। লোকটা কে? নির্জন রাজপথে একটা উদ্দেশ্যেই এরা এগিয়ে আসে। কিন্তু যেহেতু মানুষটা একা সে সহজে আত্মসমর্পণ করবে না। গাড়ির ভেতরে পা বাড়াবার সময় তার কানে এল, ‘নমস্কার ম্যাডাম। আপনি আমাকে শত্রু ভাববেন না।’
‘আপনি কে?’ প্রায় চিৎকার করে উঠল পৃথা।
‘আমি এই শহরেই থাকি। পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যে জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আপনার স্বামীকে কমিশনার সাহেব যেভাবে গ্রেপ্তার করল তা আমি দেখেছি। আপনি যে ভেঙে পড়েননি তার জন্যে ধন্যবাদ।’ হায়দার বলল।
‘আপনার নাম?’
‘নাম বললে আপনি চিনতে পারবেন না ম্যাডাম। আচ্ছা, শুনলাম আপনার স্বামী ডাক্তার। উনি কি এখানে কোনও বিশেষ কাজে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন, না যা বললেন, বেড়াতেই আসা!’
‘আমি জানতাম বেড়াতেই আসছি, কিন্তু— ।’
‘শেষ করুন।’
‘আজ রাত্রে জানতে পারলাম ওঁর কিছু কাজ এখানে’।
‘টুরিস্ট লজে আপনাদের জন্যে রুম কে বুক করেছিল?’
‘আমি জানি না।’
‘বেশ। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন, ডাক্তারসাহেবকে আমরাই আমন্ত্রণ জানিয়েছি। কিন্তু ওঁর বয়স এত অল্প তা আমার জানা ছিল না। এখনই ভোর হবে, আপনি কি টুরিস্ট লজে গিয়ে বিশ্রাম করবেন? এখানে কেন অপেক্ষা করবেন?’
‘আমি সকাল হলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে যাব।’
‘নিশ্চয়ই যাবেন। কিন্তু সকাল নটার আগে সেখানে কেউ কথা বলবে না। আপনি টুরিস্ট লজে চলুন। ডাক্তারসাহেবের নাম বললে ওরা ঘর খুলে দেবে।’
পৃধা গাড়িতে বসে স্টার্ট দেবার চেষ্টা করল। শব্দ করে কেঁপে উঠল গাড়িটা, একটুও এগোল না। হয় তেল শেষ হয়ে গেছে নয়তো—! প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে রাস্তায় নেমে পৃথা বলল, ‘এই গাড়িতে সমস্ত জিনিসপত্র পড়ে আছে— ।’
‘দামি জিনিস কিছু থাকলে সঙ্গে নিয়ে যান।’ হায়দার বলল।
পৃথা হায়দারকে দেখল। এতক্ষণ কথা বলে তার মনে হয়েছে লোকটা আর যাই হোক চোর-ছ্যাঁচোড় নয়। লোকটা ঠিক কি তা না বুঝতে পারলেও সে ব্যাগটা তুলে নিল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি আমার সঙ্গে আসবেন?’
‘না ম্যাডাম। এতক্ষণ বেশ ঝুঁকি নিয়েছি আমি। এরপর প্রকাশ্য রাজপথে হেঁটে গেলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্তে যান, কোনও বিপদ হবে না।’
‘আপনারা কি বিদ্রোহী?’
‘আমরা অত্যাচারিত। ও হ্যাঁ, অনুগ্রহ করে কমিশনারসাহেবকে আমার কথা বলবেন না। তাতে আপনার স্বামীর বিপদ আরও বেড়ে যাবে।’ হায়দার দ্রুত ফুটপাথে চলে এল। পলক ফেলার আগেই পৃথার মনে হল হারিয়ে গেল লোকটা।
একদিকে স্বজন অন্যদিকে নিজের নিরাপত্তার দুশ্চিন্তা নিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর টুরিস্ট লজটাকে দেখতে পেল পৃথা। এখনও রাস্তার আলো নেভেনি। লজের দরজায় পৌঁছে বেল বাজাতেই সেটা খুলে দিল দারোয়ান গোছের একজন, ‘গুডমর্নিং ম্যাডাম।’ ‘আমাকে বলা হয়েছে এখানে আমাদের জন্যে ঘর বুক্ড আছে। আমার স্বামী ডাক্তার—।’
কথা শেষ করতে দিল না লোকটা, ‘আসুন ম্যাডাম। সাত নম্বর ঘর আপনাদের জন্যে তৈরি রাখা আছে। আমি এইমাত্র টেলিফোনে জানতে পারলাম আপনি একাই আসছেন।’
হাঁ হয়ে গেল পৃথা, ‘টেলিফোন করল কে?’
দারোয়ান হাসল, ‘এ নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমি জিনিসপত্রগুলো গাড়ি থেকে নিয়ে আসব। আসুন।’
ঘরটা সুন্দর। রাস্তার ধারেই। দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে ভোরের আকাশ দেখল পৃথা। দু-একজন মানুষ এখন রাস্তায়। টুপ করে রাস্তার আলো নিভে গেল। স্বজনকে ওরা কেন ধরে নিয়ে গেল? শুধুই যদি তারা এখানে বেড়াতে আসত তাহলে কি এমনটা হত? পৃথার মনে হল তার কাছে অনেক কিছু লুকিয়েছে স্বজন। ওই বিপ্লবী কথা-বলা লোকটা, টুরিস্ট লজে পৌঁ ছানোর আগেই তার সম্পর্কে খবর দিয়ে টেলিফোন আসা—এই সবই রহস্যময়। আর এই রহস্যের সঙ্গে স্বজন জড়িয়ে আছে। কক্ষনো এর বিন্দুবিসর্গ সে জানত না। স্বজন তাকে কেন জানায়নি? আজ যদি ওর কোনও বিপদ হয় তবে তার ফল তো তাকেই বইতে হবে। ওরা যদি স্বজনকে না ছাড়ে? হৃৎপিণ্ড যেন মুচড়ে উঠল পৃথার। না, সে একটুও ঘুমাতে পারবে না। সকাল ন’টা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। এই শহর যতই সুন্দর হোক কোনও দিকে তাকাবে না সে।
দরজায় শব্দ হল। চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে পৃথা জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’
ঘরে আলো জ্বলছে। দারোয়ান দরজা খুলে সুটকেসগুলো একপাশে নামিয়ে রাখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘চা এনে দেব ম্যাডাম?’
‘চা!’ কি বলবে বুঝতে পারছিল না পৃথা।
লোকটা মাথা নাড়ল। দরজার দিকে যেতে যেতে হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল, ‘আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম ম্যাডাম। নইলে এগুলো আর পাওয়া যেত না।
‘কেন?’
‘ওগুলোকে নিয়ে যখন ফিরছি তখন আওয়াজ হতে ঘুরে দেখলাম কেউ অথবা কারা আপনাদের গাড়িতে আগুন-ধরিয়ে দিয়েছে। ওপাশের ব্যালকনিতে গেলে কিছুটা টের পাবেন’। দারোয়ান চলে গেল।
ভোর রাতে বিছানায় শুয়েও ভার্গিসের ঘুম আসছিল না। একসময় তাঁর মনে হল বেঁচে থাকলে এই জীবনে অনেক ঘুমানো যাবে। কিন্তু তাঁর হাতে এখন যে কয়েক ঘন্টা বেঁচে আছে তা ঘুমিয়ে নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। আকাশলালকে তার চাই। একটা সূত্র দরকার। ইতিমধ্যে তিনি এই শহরের টেলিফোন সিস্টেমকে সতর্ক করে দিয়েছেন। কাল সকাল নটায় আকাশলাল যেখান থেকেই তাঁকে টেলিফোন করুক না কেন তাঁর বাহিনী সেখানে তিন মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে। ওটা শেষ সুযোগ। এই টেলিফোনটা কি কারণে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। লোকটা নির্বোধ নয়। যে ব্যবস্থা তিনি নিয়েছেন তা যে নেবেনই লোকটার অজানা নয়। তাহলে? বিছানা ছেড়ে উঠে বসে ভার্গিসের দৃঢ় বিশ্বাস হল লোকটা আগামীকালের উৎসবটাকে কাজে লাগাতে চাইছে। কিন্তু কিভাবে কাজে লাগাবে, সেইটে জানা দরকার। যদি কোনও ভাবে আগামীকালের উৎসবটাকে বাতিল করে দেওয়া যেত। এ ক্ষমতা একমাত্র মিনিস্টারের আছে। না, মিনিস্টারকেও বোর্ডের কাছে অনুমতি নিতে হবে। মিনিস্টারকে রাজি করাতে পারেন ম্যাডাম। ভার্গিস ঘড়ি দেখল। এখন যদি তিনি ম্যাডামকে টেলিফোন করেন তাহলে আর দেখতে হবে না।
টেলিফোন বাজল। ছোঁ মেরে রিসিভার তুললেন তিনি, ‘হ্যালো!’
‘স্যার, যে কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলে আপনাকে জানাতে হুকুম করেছেন বলে বিরক্ত করছি।’ ডেস্কের অফিসারের বিনীত গলা কানে এল।
ভার্গিসের নাক ঘোঁত শব্দটি তৈরি করল, ‘বলো, বলে ফেল।’
‘আজ শেষ রাত্রে যে গাড়িটাকে আপনি আটকেছিলেন সেটা আগুনে পুড়ছে।’
‘তার মানে?’
‘আমরা আসামিকে নিয়ে চলে আসার পর গাড়িটাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘লোকটার বউ ওখানে ছিল?’
‘না স্যার। তিনি টুরিস্ট লজের সাত নম্বর ঘরে আছেন। তাঁর জিনিসপত্রও সেখানে। আমরা এইমাত্র সব চেক করে আপনাকে খবর দিলাম।’
‘খবর দিলে। ইডিয়ট। আগুনটা নেভানোর কথা মাথায় ঢুকল না। নিশ্চয়ই ওই গাড়িতে এমন কোনও ক্লু ছিল যা আমার হাতে পড়ুক ওরা চায় না। দমকল গিয়েছে?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
রিসিভার রেখে দিলেন ভার্গিস। নিজেকে নিতান্ত গর্দভ বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। নিশ্চয়ই এই ডাক্তার লোকটার সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে। গাড়ি থেকে প্রমাণ সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয় বলে ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ইস, তখন যদি একবার সন্দেহ হত!
পোশাক পরতে পরতে ভার্গিস ইন্টারকমে নির্দেশ দিলেন স্বজনকে তাঁর চেম্বারে নিয়ে আসার জন্যে। এখন তাঁকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। স্বজনকে জেরা করে খবর বের করতে তাঁর একটুও অসুবিধে হবে না। কত ডেডিকেটেড বিপ্লবীর বারোটা তিনি বাজিয়ে ছেড়েছেন, এ তো এক বিদেশি ছোকরা। নিজের চেম্বারে ঢুকে জানলার বাইরে ভোরের আকাশ দেখলেন ভার্গিস। আহা, মনে হচ্ছে ভাগ্য তাঁর সহায় হচ্ছে।
নিজের চেয়ারে বসে স্বজনকে ঘরে ঢুকতে দেখলেন তিনি। যারা ওকে এখানে এনেছে তারা দরজার বাইরে হুকুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। ভার্গিস লক্ষ করলেন। ছিমছিমে এক সাধারণ চেহারার যুবক। তাঁর হাতের একটা চড় খেলে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু প্রথমেই তিনি শক্তি প্রয়োগ করবেন না বলে ঠিক করলেন, ‘বসুন।’
স্বজন টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসল, ‘আমি তীব্র প্রতিবাদ করছি।’
‘আমি হলেও করতাম।’ গম্ভীর মুখে ভার্গিস জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চা না কফি?’
‘আমার কিছুই চাই না। আমাকে কেন ধরে এনেছেন?’
‘নিশ্চয়ই কারণ আছে। আপনি চা না খেলে আমি কি এক কাপ খেতে পারি?’
‘যা ইচ্ছে করুন আপনি। আমার স্ত্রী কোথায়?’
‘তিনি এখন টুরিস্ট লজের সাত নম্বর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন।’
‘আমি কি করে বিশ্বাস করব?’
ভার্গিস ইন্টারকমে চা দিতে বললেন, এক কাপ। তারপর টুরিস্ট লজের সাত নম্বর ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে বললেন। তারপর স্বজনের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গাড়িতে কি ছিল?’
‘কি ছিল মানে?’
‘আমি সরল প্রশ্ন করছি, গাড়িতে কি ছিল?’
‘যা থাকে। সুটকেস।’
‘ওগুলো নামিয়ে নেওয়ার পরে তাহলে আগুন ধরিয়ে দিতে হল কেন?’
‘সে কি?’ চমকে উঠল স্বজন, ‘আমার গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে?’
‘হ্যাঁ। কেন?’
‘কে ধরাল।’
‘প্রশ্নটা আপনাকে আমি করছি।’
‘বিশ্বাস করুন আমি জানি না। এই শহরে আমার কোনও শত্রু আছে বলে জানা ছিল না।’
‘কাজটা শত্রুরা করেনি, আপনার বন্ধুরাই করেছে।’
‘বন্ধুরা?’
‘হ্যাঁ। কোনও বিশেষ প্রমাণ লোপ করে দিয়ে তারা আপনাকে বাঁচাতে চায়।’
‘বাজে কথা! আমার গাড়িতে তেমন কিছুই ছিল না।’
এইসময় টেলিফোন বাজল। ভার্গিস সাড়া দিলেন প্রথমে, তারপর বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনার স্বামীকে বলুন আমরা আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি কি না!’ রিসিভারটা স্বজনের হাতে তুলে দিলেন তিনি।
রিসিভার কানে চেপে ধরে স্বজন বেশ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যালো, পৃথা?’
‘হ্যালো।’ পৃথার গলা।
‘কেমন আছ তুমি? কোথায় আছ?’
‘টুরিস্ট লজে। তুমি কখন ছাড়া পাচ্ছ!’
‘জানি না। আমাকে বিনা দোষে ওরা ধরে নিয়েছে পৃথা!’
‘তাই?’
‘তার মানে?’ চিৎকার করে উঠল স্বজন।
সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিলেন ভার্গিস। লাইনটা কেটে দিতেই বেয়ারা চা নিয়ে ঢুকল। স্বজনের দিকে না তাকিয়ে মন দিয়ে কাপে দুধ চিনি মেশালেন তিনি। এই সময় একজন অফিসার তাঁকে একটা কাগজ দিয়ে গেল। চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে কাগজটায় চোখ বোলালেন ভার্গিস, ‘আপনার স্ত্রী দেখছি একদমই ইনোসেন্ট।’
মাথা ঠিক ছিল না স্বজনের। সে ভার্গিসের দিকে তাকাল।
‘আপনাকে আমরা বিনাদোষে ধরে নিয়ে এসেছি শুনে তিনি একটাই শব্দ উচ্চারণ করেছেন, তাই? এছাড়া তিনি আর কি বলতে পারতেন?’
স্বজন বুঝল পৃথার সঙ্গে তার টেলিফোনের সংলাপগুলো ওই কাগজে লেখা আছে। সে সামান্য ঝুঁকে বলল, ‘আপনাকে স্পষ্ট বলছি এমন কোনও অন্যায় আমি করিনি যাতে আমি অপরাধী হতে পারি।’
‘আকাশলালের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?’
‘কে আকাশলাল?’
চোখ বড় করে ভার্গিস একবার স্বজনকে দেখে নিয়ে চা শেষ করলেন। তারপর বললেন, ‘এই অসময়ে আপনি শহরে এলেন কেন?’
‘বললাম তো রাস্তায় দৃর্ঘটনা হয়েছিল।’
‘কোথায়?’
‘জায়গাটা আমি চিনি না। আমার গাড়ির পেট্রল ট্যাঙ্কে লিক হয়ে যায়। আমরা বাধ্য হই একটা বাংলোয় আশ্রয় নিতে। সেখানে চিতা বাঘের পাল্লায় পড়ি। ওই জন্তুটার আক্রমণে গাড়ির চেহারা অমন হয়েছিল।’
‘কোন বাংলো?’
স্বজন যতটুকু পারে সঠিক বর্ণনা দিল। ভার্গিস বললেন, ‘বাবু বসন্তলালের একটা বাংলো ওদিকে আছে। তার সঙ্গে আপনার বর্ণনা মিলছে। কিন্তু চিতার গল্পটা একটা বাচ্চাছেলেও বিশ্বাস করবে না। ঠিক আছে, ওখানে কে ছিল?’
‘কেউ না। চিতার হাত থেকে বাঁচার জন্যে আমরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকি!’
‘কেয়ারটেকার?’
‘না, কেউ ছিল না। বাড়িটার নীচে একজনের মৃতদেহ পচছে কফিনে।’
‘গুড গড। কার মৃতদেহ?’ সোজা হয়ে বসলেন ভার্গিস।
‘আমি চিনি না।’
‘ওখান থেকে আবার গাড়ি সরিয়ে এলেন কি করে?’
‘আমাদের পরেই একজন এক্স পুলিশ অফিসার ওখানে যান। তিনিই সাহায্য করেছেন।’
ভার্গিসের মুখ শক্ত হয়ে গেল। ইন্টারকমে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সোমকে খুঁজতে যে সার্চ পার্টি গিয়েছিল তারা কি ফিরে এসেছে?’