০৮. সেদিন রবিবার

সেদিন রবিবার। দুপুরবেলা একলাটি বসিয়া পড়িতেছি এমন সময় বৌদিদি প্রবেশ করিয়া বলিলেন, ঠাকুরপো, কি দেবে দাও-বাজিমাত। তাঁহার গণ্ড হাস্যরঞ্জিত।

আমি লাফাইয়া উঠিয়া বলিলাম, অ্যাঁ, কি বলিলে বল দিদি শুনি গো আবার মধুর বচন।

বৌদিদি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিলেন, আর মধুর বচন! তোমার বৌদিদিকে প্ৰণাম কর। তোমার বড়দাদা যদি একশটা বিয়ে করতেন তাহলেও এমন বৌদিদি আর পেতে না বলে দিলুম।

আমি সত্যসত্যই বৌদিদিকে প্ৰণাম করিয়া বলিলাম, বেশ, তা না হয় প্ৰণাম করলুম। কথাটা খুলে বল। আমি যে ঠিক বুঝতে পারছিনে, কি কথা হায় ভেসে যায় ঐ চঞ্চল নয়নে।

বৌদিদি ঠানদিদিসুলভ গাম্ভীর্যের সহিত তাঁহার চম্পকাঙ্গুলি দ্বারা আমার চিবুক স্পর্শ করিয়া তাহা চুম্বন করিয়া বলিলেন, বেঁচে থাক। কথাটা হচ্ছে মেয়েমানুষের প্রতিজ্ঞা জগৎ শেঠের প্রতিজ্ঞার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।–

সাধিতে প্ৰতিজ্ঞা যদি হয় প্রয়োজন–

আমি। ঐ তোমার ভারি দোষ বৌদি। তুমি একটা কথা সোজা করে কিছুতে বলতে পার না। ঐ জন্যেই তো দাদা তোমার ওপর অত রাগেন।

বৌদিদি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ওগো, এখন আর তিনি রাগবেন না–তা হাজার ঘুরিয়েই বলি না কেন।

বৌদি, এটা কি তোমার উচিত হচ্ছে?

কি?

আমাকে এরকম সংশয়ের যন্ত্রণা দেয়া?

বৌদিদি হাসিয়া আসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, তবে শোন। আজ আমি বীণাদের বাড়ি গিয়েছিলুম। বীণার মা কি বললেন জান? কথায় কথায় হঠাৎ বললেন, শুনেছ বৌমা, সরস্বতীর যে সম্বন্ধ হয়েছিল। উনি তা ভেঙ্গে দিলেন। আমি অবাক হয়ে বললুম, সেকি মাসীমা? তিনি বললেন, ছেলেটি ওঁর তেমন পছন্দ হল না। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ বৌমা, তোমার দেওরটির সঙ্গে হয় না? আমি বললুম, কোন দেওর? তিনি বলিলেন, কেন গো, ঐ যে সন্তোষের খুড়তুত ভাই! ওঁর। কিন্তু ঐ ছেলেটিকে ভারি পছন্দ। আমি বললুম, মাসীমা, তা যদি হয় তাহলে আমরা আর কিছু চাই না। তিনি বললেন, তবে একবার চেষ্টা করে দেখ না বৌমা। আমরা তো বলবেই।

সত্য বলিতে কি এই কথা শুনিয়া আমার এত আনন্দ হইতেছিল যে ইচ্ছা হইতেছিল আবার বৌদিদির পায়ের ধূলা লই। কিন্তু সে প্রবৃত্তিকে সংযত করিয়া বলিলাম, আর বৌদি, সরস্বতীর সঙ্গে দেখা হল না?

বৌদিদি বলিলেন, হল না। আবার?

কি বললে সে?

বৌদিদি মুখখানি একটু রাঙ্গা করিয়া বলিলেন, সত্যি কথা বলব ঠাকুরপো, এই আমাদের মেয়েমানুষ জাতটা ভারি বাঁদর। সরস্বতীর কাছে গেলুম, মুখখানা এমন গোমড়া করে রইল যেন আমি কিছুই জানি না মনের মধ্যে কি হচ্ছে। আমি যখন গালটা টিপে দিয়ে বললুম, কি লো, মুখখানা অমন করে আছিস যে? তখন কিন্তু হেসে ফেললে আবার কেঁদেও ফেললে। বলিয়া হাসিতে হাসিতে বৌদিদির চোখেও জল আসিয়া পড়িল।

আমি উৎফুল্ল হইয়া বলিলাম, তবে সব ঠিক! বাকি শুধু পুরুত ডাকা?

বৌদিদি বলিলেন, তোমার দাদার কাছে কথাটা ভাঙ্গতে হবে। আগে।

আমি বলিলাম, তুমিই ভাঙ্গ।

দাদার ঘরে ঢুকিয়াই বৌদিদি বলিলেন, ঠাকুরপো, তোমার একটা সম্বন্ধ এসেছে।

দাদা চমকাইয়া উঠিলেন, তারপর বিরস স্বরে কহিলেন, চীনের রাজকন্যার সঙ্গে নাকি?

বৌদিদি বলিলেন, অত দূরে কি বিয়ে করতে আছে?

দাদা একটু হাসিয়া বলিলেন, তবে বুঝি মন্দোদরীর সহোদরার সঙ্গে?

না গো না, অত দূরে নয়। দাদা বলিলেন, তবে ভেঙ্গেই বল।

বৌদিদি বলিলেন, খুব কাছে—ওঃ ভারি কাছে। আন্দাজ কর।

দাদা। পারলুম না।

বৌদিদি। যদি বলি আমাদের পাড়ায় তাহলে পারবে তো?

দাদার মুখ রক্তিম হইয়া উঠিল, আবার তখনি অন্ধকার হইয়া গেল। তিনি ব্যথিত স্বর গোপন করিতে করিতে বলিলেন, তাহলেও পারলুম না বৌদি।

বৌদিদি আস্তে আস্তে বলিলেন, সরস্বতীর সঙ্গে।

দাদার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। কথাটা সহজে বিশ্বাস হইবার নয়। তিনি একটু চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আর শরৎ?

বৌদিদি বলিলেন, সরস্বতী তাকে বিয়ে করবে না, বলে দিয়েছে! সে সম্বন্ধ ভেঙ্গে গেছে।

দাদার রক্তহীন মুখখানা অত্যন্ত শুষ্ক দেখাইতেছিল। তিনি বলিলেন, ঠাট্টা করছ বৌদি–?

তোমার গায়ে হাত দিয়ে বলছি ঠাট্টা নয়, ঠাকুরপো। এই নিয়ে ঠাট্টা করব!

কিছুক্ষণ পরে দাদা ঘাড় তুলিলেন; আমি স্মিত মুখে বলিলাম,—

যদি অবহেলা করি রুষিবে সম্বর-অরি
কে সম্বরে স্মরশরে এ তিন ভুবনে!

এইবার দাদা সস্মিত ভর্ৎসনার চোখে আমার পানে চাহিলেন।

 

সেইদিন বিকালবেলা ঘটনাচক্রে শরতের সহিত দাদার দেখা হইয়া গেল। দেখা না হইলেই ভাল হইত। দাদা অপ্ৰস্তুত হইয়া বলিলেন, শরৎ যে–ভাল তো?

শরৎ তাঁহার দিকে না তাকাইয়াই ভ্রূকুটি করিল। তারপর ভ্রূ তুলিয়া তাঁহাকে দেখিয়া বলিল, কে? ওঃ ক্যাদারবাবু যে। বলিয়া ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিল।

দাদা অপরাধীর মত বলিলেন, এ কদিন তোমার ওখানে যেতে পারিনি–

শরৎ বিদ্রুপের হাসি হাসিয়া বলিল, তাতে আমার কোন ক্ষতি হয়নি। মিছিমিছি আপনাকে অ্যাপোলজি চাইতে হবে না।

শরৎ দাদাকে আঘাত দিবার জন্যই কথাটা বলিয়াছিল। দাদা চুপ করিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে শরৎ মুখ তুলিল, তাহার ওষ্ঠে একটা ক্রুর হাসি খেলা করিতেছিল। সে বলিল, তারপর ক্যাদারবাবু, এবার পাসটাস হবেন তো? তা হতেও পারেন—আপনার ওপর সরস্বতীর কৃপা আছে। আর নেহাৎ যদি না হন—আমাকে একটা খবর দেবেন। আমি আপনার বন্ধু তো—একটা ঠিকেদারী জুটিয়ে দেব। ঠিকেদারী খাসা কাজ মশাই—দেদার ফুর্তি—

এই পর্যন্ত বলিয়া তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া শরৎ হঠাৎ চলিয়া গেল। দাদা বিস্ময়ে ক্ষোভে নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *