সূর্যকুমার বছরে একবার কলকাতায় আসে। হাজারিবাগের সাহেবি স্কুলে সে পড়ে, সেখানে বছরে দু’বার লম্বা ছুটি। গ্রীষ্মে পাহাড়ি জায়গায় এক্সকারশানে যায়, বড়দিনের ছুটি কাটায় কলকাতায় বড়দিনের সময়ও চার-পাঁচ সপ্তাহ ছুটি থাকে।
সূর্যকুমারের কলকাতায় আসবার সময় হলে আমি ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজনা ও চাপা আনন্দ বোধ করতাম। এই সময় সারা বাড়িতেই বেশ একটা উৎসাহের সঞ্চার হত। এ বাড়িতে আমিই একমাত্র ছেলে, আর একজন ছেলে এলে আমি তবু একজন সঙ্গী পেতাম। আমার দিদিরাও খুশি হত। আমার দিদিরা তো আমাকে পুরুষমানুষ হিসেবে গ্রাহ্যই করত না–একমাত্র মা-জ্যাঠাইমার সঙ্গে হাসাহাসির গল্পের সময় আমাকে তাড়া দিত, এই তুই এখানে কেন রে? তুই তো ছেলে-তোর এসব গল্প শুনতে নেই। আমাদের পাশের বাড়িতে একটা নতুন বাচ্চা হওয়ায় হিজড়েরা এসে নেচেছিল সেটাও আমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি, কারণ ছেলেদের নাকি ওসব দেখতে নেই।
সূর্যকুমার বয়সে আমার থেকে ছ’ বছরের বড়, আমি দাদা বলতাম, কিন্তু বন্ধুর মতন সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে সূর্যকুমারের একটা ঘর রাখা ছিল আলাদা, বছরের অন্য সময় আমার দুই দিদি রাত্তিরে শুত ওই ঘরে, কিন্তু বড়দিনের সময় তাদের আবার চলে আসতে হত মায়ের ঘরে। বড়দিন যত কাছে এগিয়ে আসত, আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম। তারপর একদিন বড়বাবু স্কুল কর্তৃপক্ষের চিঠি পেয়ে আমাদের জানাতেন, পরশুদিন সূয্যি আসছে, তোমরা যাবে নাকি হাওড়া স্টেশনে?
প্রথম বার সূর্যকুমারকে দেখে আমরা অবশ্য খুব নিরাশ হয়েছিলাম। যদিও তাকে আনতে গিয়েছিলাম কত উৎসাহের সঙ্গে। তখন আমরা নতুন কলকাতায় এসেছি, কলকাতার সবকিছুই বিস্ময়কর লাগে। বাড়ির সব ছেলেমেয়ে বড়বাবুর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ি চেপে স্ক্র্যান্ড রোড ধরে গিয়েছিলাম চাঁদপাল ঘাটে। যাবার পথে মাঝ রাস্তায় দুটো ষাঁড় মল্লযুদ্ধ বাঁধিয়ে থামিয়ে দিয়েছিল সব গাড়ি, আমাদের গাড়ির ঘোড়াদুটোও ভয় পেয়ে পা তুলে চিহিহি করে চ্যাঁচাচ্ছিল। আমি জানলার ধারে বসতে পাইনি বলে ভালো করে দেখতে পাইনি অবশ্য। চাঁদপাল ঘাটে আমরা বেশ খানিকক্ষণ আগেই এসেছিলাম, তখন জাহাজ চলাচল করছে বলে ব্রিজ খুলে দেওয়া হয়েছে। জাহাজগুলো অবিকল ছবির বইতে জাহাজের মতন। জাহাজের ভোঁ শুনলে সব সময়ই আমার মন খারাপ লাগে।
হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আমরা সবাই সুশৃঙ্খল ভাবে দাঁড়িয়ে আছি, ট্রেন আর আসে না! সওয়া ঘণ্টা লেট। মা আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, হাওড়া স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে একটু এদিক-ওদিক গেলেই আমি হারিয়ে যাব, আর আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বড়দি আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে। জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে শ্রীলেখা আমাদের সবার বড়দি। আমাদের কাছেই কয়েক জন চিনেম্যান দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের দেখে দেখেই সময় কেটে যাচ্ছিল বেশ। তখন আমরা পথেঘাটে কোনও চিনেকে দেখলেই বলতাম, চিনেম্যান চ্যাং চুং মালাই কা ভ্যাট! অবশ্য একজন মাত্র চিনেম্যানকেই আমরা দেখেছি তখন, যে একসঙ্গে ছটা বল নিয়ে লোফালুফির খেলা দেখাত পাড়ায় পাড়ায়।
শেষ পর্যন্ত ট্রেন এল, অনেক লোকজন নামল, কিন্তু সুকুমারের দেখা নেই। বড়বাবু সুস্থির হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তখন পর্যন্ত সুর্যদাদাকে দেখিইনি, সুতরাং যে-কোনও কিশোরের দিকে উৎসুক ভাবে তাকাচ্ছি। বেশ খানিকটা বাদে দেখলাম, একজন আলখাল্লা পরা বুড়ো সাহেব তিন-চারটি ছেলেকে নিয়ে দূর থেকে আসছেন। বড়বাবুর সামনে এসে থেমে গিয়ে হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে বললেন, হ্যালো, মিঃ ভাদুড়ি! গড় ব্লেস ইউ!
সাহেবটি একটি ছেলের কাঁধে হাত রেখে বড়বাবুর সঙ্গে কিছুক্ষণ কী সব যেন বললেন ইংরেজিতে। আমরা ভেবেছিলাম, সে ওই সাহেবেরই ছেলে। আমাদের চমকে দিয়ে বড়বাবু তাকেই বললেন, এই যে সূর্য, মিট ইয়োর কাজিনস।
ছেলেটি আমাদের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে হেসে শুধু মাথা নোয়াল।
নাবিকদের মতন নীল রঙের প্যান্ট ও কোট পরে আছে সূর্য, কোটের বুকের কাছে সোনালি সুতোয় কী যেন আঁকা। গলায় টাই, বুটজুতোয় ঝকঝকে পালিশ। তার গায়ের রং সাহেবদের মতন ফরসা, চোখের তারাদুটোও খয়েরি। এসবের জন্যও কিছু না, কিন্তু সে আমাদের নিরাশ করে দিল একটা ব্যাপারে। সূর্য এক বর্ণও বাংলা জানে না। আমি তখন প্যারি সরকারের ফাস্ট বুক পর্যন্ত পৌঁছেছি, ওয়ান মর্নিং আই মেট আ লেম ম্যান-এর পাতা পড়তে পারি। আমি হাঁ করে আমার এই নতুন দাদার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বড়দি ক্লাস এইটে পড়ে তিনখানা ইংরেজি বই–কিন্তু নিজের মন থেকে এক লাইনও বানিয়ে বলতে গেলে কান লাল হয়ে যায়।
সূর্যকুমারের আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল–তার মুখখানা অদ্ভুত ধরনের বিষণ্ণ আর ম্লান। প্রথম যখন তাকে দেখি, তখন তার বয়স তেরো বছর–অথচ তার মুখে হাসি দেখা যেত কদাচিৎ। কারওর সঙ্গে কথা বলার সময় চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত, সেই খয়েরি রঙের অচেনা চোখ।
সূর্যকে মনে হত আমাদের মধ্যে যেন একটা অন্য জগতের মানুষ। ভুল করে এখানে এসে পড়েছে। তার চেহারা, ব্যবহার সবই আলাদা। সে প্রত্যেক রাত্তিরে শুতে যাবার আগে মোজা আর গেঞ্জি নিজের হাতে কেচে নেয়। বাড়িতেও কক্ষনও সে খালি পায়ে থাকে না। প্রথম দু-একদিন সে চামচে দিয়ে ভাত খেয়েছিল, তারপর যখন হাত দিয়ে খেতে শুরু করল, তখনও সব কটা আঙুল উঁচু করে এমন ভাবে ভাত তোলে যে দেখলেই হাসি পায়। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, সে খেতে বসেও বাঁহাত দিয়ে জলের গেলাস ধরে এবং সেই হাত আবার জামায় লাগায়। দু’হাত দিয়ে মাছের কাঁটা বাছে। কেউ তার এসব দেখে হাসলে সে স্থির চোখ তুলে তাকায়, হাসে না, কথা বলে না।
সূর্যদাদার দেখা পাবার জন্য আমি এত উদগ্রীব হয়ে ছিলাম, কিন্তু সে আসার পর আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম, তার সামনেই যেতাম না। একদিন আমি ছেলেমানুষি অভিমান নিয়ে বড়বাবুর কাছে নালিশ করেছিলাম, বড়বাবু, সূর্যদাদা কেন বাংলায় কথা বলে না? আমরা কিছু বুঝতে পারি না।
বড়বাবু হেসে বলেছিলেন, তোমরা সবাই মিলে ওকে শেখাও! ও তো বিহারের স্কুলে পড়ে, সেখানে কেউ বাংলা জানে না তাই সব ভুলে গেছে। খুব ছোটবেলায় কিন্তু বাংলা শিখেছিল তোমার পিসির কাছে।
আমি অবশ্য পরে সূর্যদার কাছে জেনেছিলাম, ওদের স্কুলে বেশ কিছু বাঙালি ছেলে আছে, কিন্তু তারাও বাংলা বলে না। শিক্ষকদের কড়া নির্দেশ ছিল, হস্টেলেও পরস্পরের সঙ্গে সবসময় ইংরেজিতে কথা বলতে হবে।
শুরু হয়ে গেল সূর্যকুমারকে বাংলা শেখানো। শ্রীলেখা আর সান্ত্বনাবড়দি আর মেজদি পাখি-পড়ানোর মতন সূর্যকুমারকে বাংলা শব্দ মুখস্থ করাতে লাগল। কিন্তু উচ্চারণ কিছুতেই শুধরোয় না–সূর্যদা মাছের ঝোলকে বলে মাচ্ছের জোল, পোকাকে বলে পকা। আমাদের রান্নার ঠাকুর মহাজনকে বলবে মৌজন। গেলাস কিংবা টেবিল কিছুতেই বলবে না, বলবে গ্লাস আর টে। সেবারে ছুটির শেষে ফিরে যাবার সময়। সূর্যদা এইরকম বাংলা শিখেছিল : বড় মামিমা, তোমার আচার খুব বিউটিফুল, বাট এত জাল না দাও (এত ঝাল দিয়ো না), আমি সুটকেস-ভরতি আচার নিয়ে যাব একশিশি। …মৌজন খুব ডার্টি, নুনের ভেতরে পকার পা, নট ওনলি ওয়ান বাট টু!
একবার নুনের ভেতরে আরশোলার ঠ্যাং বেরিয়েছিল ঠিকই। সূর্যদার মুখে এরকম আধো আধো বাংলা খুব মিষ্টি শোনাত।
সূর্যকুমার এলে আমাদের অনেক জায়গায় বেড়ানো হত। শীতের কলকাতায় অনেক রকম উৎসব আর আকর্ষণ। বড়বাবু কিংবা বাবার সঙ্গে আমরা যেতাম ইডেন গার্ডনসে ব্যান্ড শুনতে। গার্ডনসের গোল উঁচু জায়গাটায় ঝলমলে পোশাক-পরা সাহেব সিপাহিরা ব্যান্ড বাজাত। আমরা প্যাগোডার নীচে বসে কমলালেবু আর চিনেবাদাম খেতে খেতে বিভোর হয়ে সেই বাজনা শুনতাম। ক্রিসমাস উপলক্ষে ফোর্ট উইলিয়ামের সামনেও এই রকম বাজনা শুনেছি সবাই সেটাকে বলত গড়ের বাদ্যি।
কিংবা আমরা গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়া যেতাম সার্কাস দেখতে। সার্কাসের খেলোয়াড়রা অধিকাংশই মাদ্রাজি, কয়েকজন সাহেব এবং জাপানি। বিরাট উঁচু উঁচু ট্রাপিজে ফ্রক-পরা মেয়েরা একটা থেকে লাফিয়ে চলে যেত অন্য একটায়নীচে জাল পাতা থাকত না। তখন। বাঘ আর হাতির খেলাতেই সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চিত হতাম–আগাগোড়া সোনালি পোশাক-পরা একজন বেঁটে লোক মস্ত লম্বা চাবুক নিয়ে বাঘদের হুকুম করত। অদ্ভুত ধরনের সট সট শব্দ হত সেই চাবুক থেকে সবাই বলত ইলেকট্রিকের চাবুক।
একটা সিনেমাও দেখেছিলাম সূর্যদার দৌলতে। তখন ছোটদের সিনেমা দেখা মহাপাপ। ইস্কুলের ছেলেদের পক্ষে সিনেমা দেখা মানেই চূড়ান্ত বখে যাওয়া। সূর্যকুমারের বায়নাতেই আমাদের একবার একটি মাত্র ছবি দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সিনেমাকে আমরা বলতাম বাইসকোপ, সূর্যদা বলত মুভি। মনে আছে। বাইসকোপটার নাম, মার্ক অব জোরো–তরোয়াল হাতে মুখোশ-পরা একটা লোক ঘোড়া ছুটিয়ে এসে সব জায়গায় ক্রস এঁকে দিয়ে যেত। সেইসঙ্গে ছিল আর একটা ছোট ছবি, সেটাই বেশি ভালো লেগেছিল। ছেঁড়া জুতো, ছেঁড়া টুপি, হাতে ছড়ি ও ছোট গোপওয়ালা চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়।
সূর্যকুমার এইসব নানা জায়গায় বেড়ানো উপভোগ করত ঠিকই কিন্তু কথা খুব কম বলত। তা ছাড়া তার মুখে একটা বিষণ্ণ ভাব লেগে থাকত সবসময়। সূর্যদার ছেলেবেলার চেহারাটা আমি যখনই ভাবি–তার সেই বিমর্ষ মুখের ছবিটাই চোখে ভেসে ওঠে। ওইটুকু বয়সে অতখানি গাম্ভীর্য আমি আর কোনও ছেলের দেখিনি।
তখন আমরা মনে মনে ভাবতাম সূর্যদার মা নেই তো, তাই অত কষ্ট। মা না-থাকার ব্যাপারটা ভাবাই যায় না। মা থাকা তো একটা অবধারিত সত্যের মতন, আর সবারই মা আছে, শুধু সূর্যদার নেই। সূর্যদার মুখে ছেলেবেলায় কখনও তার মায়ের নাম শুনিনি।
সূর্যদা বদলে গিয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। পরের বছর ছুটিতে এসে আমাদের সঙ্গে অনেক খোলামেলা ভাবে মিশেছিল, বাংলাও শিখে গিয়েছিল বেশ ভালোই, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়া কিংবা মুখের সেই বিষণ্ণ ভাবটি যায়নি অনেকদিন।
দু-তিন বছরের মধ্যেই আমি সূর্যদার ভক্ত চ্যালা হয়ে উঠলাম। যে কদিন সূর্যদা কলকাতায় থাকত, আমি সব সময় ছায়ার মতন ওর পেছন পেছন ঘুরতাম, ওর হুকুম তামিল করার জন্য আগে থেকেই তৈরি। সূর্যদা অবশ্য কোনও হুকুমই করত না। সাহেবি কায়দায় রপ্ত হলেও হস্টেলে থাকার জন্য কয়েকটি অন্যরকম গুণও ছিল। নিজের কাজ অন্যকে করতে দিত না কক্ষনও–এমনকী খাওয়ার পর নিজের এঁটো থালাও নিজেই তুলে নিয়ে যেত। মা-জ্যাঠাইমার আপত্তি কিছুতেই মানেনি। নিজের জামাকাপড় তো নিজে কাঁচতই। কখনও এক গেলাস জলও অন্যকে দিতে বলেনি। আমরা তো কিছুতেই নিজে জল গড়িয়ে খেতাম না–মনে হত, ওটা বিশুদ্ধ মেয়েদের কাজ। দিদিরা কখনও জল আনতে আপত্তি করলে নালিশ করতাম মায়ের কাছে। সূর্যকুমারের দেখাদেখি আমি নিজে এঁটো থালা তুলতে শুরু করলেও জল খাওয়ার ব্যাপারে দিদিদের হুকুম করতে ছাড়িনি।
রোজ সকালবেলা সূর্যদা নিজেই বিছানা ছেড়ে ছাদে চলে যেত। শীতের মধ্যেও হাফপ্যান্ট হাফশার্ট পরে ব্যায়াম করত একা একা। আবার রাত্তিরে ঘুমোতে যাবার আগে বাইবেল খুলে প্রেয়ার করত কয়েক মিনিট। অত কম বয়সি একটি ছেলের এ রকম নিয়ম-শৃঙ্খলাবোধ দেখে আমাদের খুব চমক লাগত। আমি তো অন্ধের মতন নকল করতে শুরু করলাম সূর্যদাকে, দিদিরা তাই নিয়ে আমাকে খ্যাপাত। সূর্যদা অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যে বাইবেল পড়া ছেড়ে দিয়েছিল এবং ক্রমে ক্রমে ঘোরতর ইংরেজবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিল।
সূর্যদা ছিল বাড়ির সকলের নয়নের মণি। সবাই সূর্যদাকে খাতির করার জন্য শশব্যস্ত। একে তো তার অমন সুন্দর চেহারা, সেইসঙ্গে ভদ্র বিনীত ব্যবহার, পড়াশুনোতেও ভালো। তা ছাড়া যে-ছেলে সাহেবদের মতন ইংরেজিতে কথা বলতে পারে–তার প্রতি বিশেষত বাড়ির মেয়েদের একটা সমীহের ভাব থাকবেই। একমাত্র জ্যাঠামশাই মনে মনে পছন্দ করতেন না সূর্যদাকে–গোড়া থেকেই একটা বিরূপ ভাব নিয়েছিলেন। সূর্যদার সঙ্গে কথা বলার সময় জ্যাঠামশাই এমন একটা কাষ্ঠহাসি ও শুকনো স্নেহের ভাব দেখাতেন–যা আমাদের ছেলেমানুষি চোখেও ধরা পড়ত।
জ্যাঠামশাইয়ের স্নেহের অভাব পুষিয়ে দিয়েছিলেন জ্যাঠাইমা। জ্যাঠাইমার পর পর তিন মেয়ে হবার পর একটি ছেলে জন্মেও কয়েক মাস বাদে মারা যায়। জ্যাঠাইমা আমাকেও খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু সূর্যদাকে ভালোবাসতেন অনেক অনেক বেশি। সে জন্য আমার কোনও দিন হিংসে হয়নি। আমি সবদিক থেকেই সূর্যদাকে আমার চেয়ে অনেক বড় মনে করতাম। এবং মনে হত, এ সবকিছুই সূর্যদার প্রাপ্য। কিন্তু যারা যারা ওকে ভালোবেসেছে, তাদের প্রত্যেকের মনে একটা করে গভীর আঘাত দেবার অদ্ভুত প্রতিভা ছিল সূর্যকুমারের।
স্কুলজীবনের শেষদিকে সূর্যদা বছরে দু’বার করে কলকাতায় আসতে লাগল। তখন সূর্যদা বেশ বড় হয়েছে বলে ওর একাই রাস্তায় বেরোবার অনুমতি মিলেছিল, আমি অনেক সময় থাকতাম সঙ্গে। সূর্যদাকে আমি গ্রে স্ট্রিটে রেণুদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। বিষ্ণু কিংবা জীমূত ওরা অবিলম্বেই সূর্যদার ভক্ত হয়ে গেল। এমনকী সুপ্রকাশদা পর্যন্ত একদিন সূর্যকুমারের ইংরেজি জ্ঞান পরীক্ষা করে মুগ্ধ হলেন, তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন এই প্রতিভাবান কিশোরের।
রেণুদের বাড়ির কাছেই একদিন একটা ঘটনা ঘটল। আমি আর সূর্যদা দাঁড়িয়ে ছিলাম হাতিবাগানের বাজারের সামনে, ট্রামে ওঠবার জন্য। শ্যামবাজারের দিক থেকে কীসের যেন একটা মিছিল আসছিল, তেরঙ্গা ঝান্ডা নিয়ে একদল লোক খুব চিৎকার করছে। আমরা সেদিকেই তাকিয়েছিলাম। মিছিলটা যখন আমাদের খুব কাছে এসে পড়েছে, তখন দুটো পুলিশের গাড়ি এসে থামল টপাটপ পুলিশরা নেমেই তাড়া করে গেল মিছিলকে, মুহূর্তে সব ছত্রভঙ্গ রাস্তার সব লোকজন যে দৌড়োচ্ছ আর পালাচ্ছে আমরা সেটা খেয়ালই করিনি। তা ছাড়া পালাবার কথা আমরা জানতামই না–তখনকার কলকাতার ছেলেরা পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় এখনকার মতন দক্ষ ছিল না। আচমকা একটি গোরা পুলিশ আমাদের দিকে তেড়ে এল–আমাকে এক ধাক্কায় ছিটকে ফেলে দিল রাস্তায়–সূর্যদার মাথায় ব্যাটন দিয়ে মারল। সেই আমি বৃটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ স্পর্শ পেলাম।
পুলিশ আমাদের ছোট ছেলে বলে বুঝতে পারেনি–এলোপাথাড়ি মারতে মারতে আমাদের গায়ে লেগেছে তা কিন্তু মোটেই নয়। স্পষ্ট মনে আছে সেই ঘটনা। একজন পুলিশ সার্জেন্ট প্রথমে তাকাল আমাদের দিকে, তার প্রকাণ্ড মুখখানা তখন লালচে রঙের, আমাদের দেখে তার চোখে যেন বেশি করে রাগ জ্বলে উঠল–এগিয়ে এসে একটা হাত বাড়িয়ে দিল আমার মুখের দিকে। হাত না বলে থাবাই বলা যায়–পাঁচটা আঙুলের বিস্তারে ঢেকে যায় আমার গোটা মুখ–সেই আঙুলগুলো আমার মুখখানা চেপে ধরে একটা ধাক্কা মারল। একটি ছোট ছেলেকে মারার জন্যই মারা।
মাথায় ব্যাটনের ঘা খেয়ে সূর্যদা প্রথমে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপর ইংরেজিতে অনর্গল বকতে বকতে ছুটে গেল সেই পুলিশ সার্জেন্টেরই দিকে। তার বিষণ্ণ ধরনের মুখখানায় তখন অসম্ভব রাগ। সার্জেন্টের সামনে দাঁড়িয়েই কী যেন বলতে লাগল। সার্জেন্টটি সূর্যদার ঘাড়ে আর এক ঘা মেরে উঠে গেল গাড়িতে। আমি ধূলো ঝেড়ে উঠে এসে দেখলাম, সূর্যদার মাথা থেকে রক্ত পড়ছে।
সূর্যদাকে নিয়ে আবার রেণুদের বাড়িতে চলে এলাম। রেণু আর দীপ্তি নীচের তলাতেই ছিল, আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, রেণু, শিগগির যা, সুপ্রকাশদাকে ডাক, ওর মাথা ফেটে গেছে।
রেণু বলল, মাথা ফেটেছে? কই? কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো!
এই যে রক্ত দেখতে পাচ্ছিস না!
রেণু কাছে এসে খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে সূর্যদার মাথাটা দেখে বলল, একটু তো মোটে রক্ত বেরিয়েছে, মাথা তো ফাটেনি!
রেণু তখন খুব ছোট, ও ভেবেছিল মাথা ফেটে যাওয়া মানে নারকোলের মালার মতন মাথার খুলিটা ফাঁক হয়ে যাওয়া।
দীপ্তি গিয়ে সুপ্রকাশদাকে ডেকে আনল। সুপ্রকাশদা বললেন, একী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! তোমরা মিছিলে গিয়েছিলে! যাওনি! এমনি এমনি মারল? যাক গে মেরেছে। মেরেছে-ভাগ্যিস ধরে নিয়ে যায়নি–তা হলে আর জীবনে কখনও গভর্নমেন্টের চাকরি পেতে না। সূর্য নিশ্চয়ই আই সি এস হবে।
সুপ্রকাশদা যত্ন করে বেঞ্জিন আর তুলো দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তারপর আমরা রিকশা করে চলে এলাম বাড়িতে।
এরপর দু-তিন দিন সূর্যদা খুবই বিমর্ষ হয়ে রইল। কারওর সঙ্গেই প্রায় কথা বলেনি। ওর মনে নিশ্চয়ই একটা আঘাত লেগেছিল। স্কুলের সাহেব শিক্ষকরা কত ভালো, কী চমৎকার তাদের ব্যবহার–ইংরেজ সভ্যতা ও সংস্কৃতি যে কতটা উন্নত সে কথাও সূর্যদাকে পড়তে হয়েছে তার সঙ্গে এই ঘটনাটা যে একদম মেলে না।
বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যদার চরিত্রে দুটি ব্যাপার খুব প্রকট হয়ে ওঠে। একটি হচ্ছে, ইচ্ছে করে বিপদে পড়ার ঝোঁক, অন্যদিকে বলা যায় বেশি রকমের নারী-প্রীতি। পৃথিবীতে যে কয়েক জন বিখ্যাত প্রেমিক তাদের অসম্ভব নারী-লিপ্সার জন্য অমর হয়ে আছেন, সূর্যকুমারের নাম তাদের পাশে অনায়াসে লিখে রাখা যায়। আমরা সব মিলিয়ে যাকে প্রেম বলি, এটা ঠিক তাও নয়, সম্ভোগ বাসনাই বলা উচিত। যৌবনে একমাত্র নারীদের সান্নিধ্যেই সূর্যদার বিষণ্ণ ভাবটা খানিকটা কেটে যেত। সূর্যদার প্রথম এই ধরনের প্রেম হয় আমার বড়দির সঙ্গে।
বিপদে পড়ার ঝোঁক কী রকম ছিল তার একটা উদাহরণ দিই। সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষা দেবার পর সূর্যদা যখন কলকাতায় এসে রয়েছে, তখন আমরা কয়েক জন মিলে ইডেন গার্ডেনসে একদিন বেড়াতে এসেছিলাম। বড়রা কেউ সঙ্গে আসেননি, সূর্যদাই আমাদের গার্জেন। ওখানকার ঝিলে কয়েকটা নৌকো ভাড়া পাওয়া যায়–তাতে চড়ে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলেমেয়েরা খুব হইহল্লা করছিল।
আমার মেজদি সান্ত্বনা হঠাৎ বলল, আঃ, আমরাও যদি নৌকো চড়ে বেড়াতে পারতাম, কী মজাই না হত!
সূর্যদা উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর ভাবে বলল, চলো, নৌকোতেই চড়ব।
আমরা তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি। বড়দি সূর্যদাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি নৌকো চালাতে জানো?
সূর্যদা এবারও গম্ভীর ভাবে বলল, জানি না। তবে শিখে নিতে কতক্ষণ?
প্রথম তো নৌকো পাওয়ার ব্যাপারেই অসুবিধে দেখা দিল। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলেদের প্রতাপ বেশি–তারা তখন নিজেদের শাসক-সমাজের প্রতিচ্ছায়া মনে করে খুব তেজ দেখাত। তারা দু’ঘণ্টার আগে কোনও নৌকো ছাড়বে না। সূর্যদা নেবেই। শেষ পর্যন্ত সূর্যদার চোস্ত ইংরেজি শুনে অ্যাংলো ছেলেরা পিছু হটল।
নৌকো ঝিলের মাঝামাঝি যেতেই ভীষণ দুলতে লাগল আর ঘুরতে লাগল এদিক-ওদিক। সূর্যদা একদম চালাতে জানে না, আনাড়ির মতন তো বইঠা চালাতে গিয়ে আরও মুশকিল। দিদিরা ভয় পেয়ে চ্যাঁচামেচি করতে লাগল, পার থেকে লোকেরা দেখে হাসছে। আমরা অবশ্য সাঁতার জানতাম, আমি হেদোতে দিদিদের সঙ্গে চান করতে করতে সাঁতার শিখে নিয়েছি। শেষ পর্যন্ত এমন হল, নৌকো আর পারে এনে ভেড়ানোও যায় না–অ্যাংলো ছেলেদের অসহ্য টিটকিরিতে কান পাতা যায় না, কিন্তু সূর্যদার ভ্রুক্ষেপ নেই।
ভয় পেয়ে দিদিরা উঠে দাঁড়াতেই কাণ্ডটা ঘটল, নৌকো উলটে গেল। আমরা সাঁতরে পারে পৌঁছে দেখলাম সূর্যদা ডুবে যাচ্ছে। বাগানের দু’জন মালি তক্ষুনি জলে ঝাঁপিয়ে না পড়লে সূর্যদার কপালে কী ছিল সে-দিন কে জানে। তখন আমরা টের পেলাম, সূর্যদা সাঁতারই জানে না। সাঁতার না জেনে, নৌকো চালাতে না জেনে, আর কে ঝিলের মাঝখানে নৌকো নিয়ে যায়, সূর্যদা ছাড়া?