০৮. সুরা এখলাস পড়ে বুকে ফুঁ

খবির হোসেন সুরা এখলাস পড়ে বুকে ফুঁ দিলেন।

তাঁর স্বপ্নের ঘোর এখনো কাটে নি। বুক ধড়ফড় করছে। পানির পিপাসা হচ্ছে। অ্যালুমিনিয়ামের একটি জগে খাবার পানি থাকে। তাঁর কেন যেন মনে হল পানি নেই। আসলেই তাই, জগ শূন্য। তাঁর পিপাসা আরো বেড়ে গেল। তিনি বাইরে এসে দাঁড়ালেন। এমন লাগছে কেন চারদিক? নাকি এখন তিনি স্বপ্ন দেখছেন? কেমন যেন থমথম করছে। আকাশ মেঘে ঢাকা। অনেক উঁচুতে চক্রাকারে ছিল উড়ছে।

তিনি এ-অঞ্চলের মানুষ নন। এখানে দীর্ঘদিন ধরে আছেন, তবু এ-অঞ্চলের আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি ধরতে পারেন না। কিন্তু তাঁর মনে হল, সামনে দুঃসময়। একটি প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি সব শেষ করে দিতে পারে। একটি ভারি বর্ষণ মানেই শস্যশূন্য একটি দীর্ঘ বৎসর। স্বপ্নে কি এর ইঙ্গিতই ছিল? খবির হোসেন বিড়বিড় করে বললেন, ইয়া মাবুদ, ইয়া মালুদ, ইয়া রাহমানুর রহিম।

মনিরউদ্দিনের বাড়িতে কোনো পুরুষমানুষ কেন ছিল না, এখন তা বুঝতে পারছেন। ফসল কাটা শুরু হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শস্য ঘরে তুলতে হবে। মানুষগুলির এখন কোনো বোধশক্তি নেই, এরা কাজ করছে যন্ত্রের মতো। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে তাকিয়েই আরো গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ সব

স্মৃতি আছে তাদের সেই সব নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাচ্ছে।

আছরের নামাজের সময় কি হয়ে গেল? মেঘে সূর্য ঢাকা পড়েছে। সময় বোঝর উপায় নেই। আজান দেবেন, নাকি অপেক্ষা করবেন আরো খানিকক্ষণ। তিনি মসজিদের বারান্দায় উবুহয়ে বসে রইলেন। ভাবতে লাগলেন স্বপ্নটার কথা। স্বপুটা এরকম তিনি যেন বাইরে কোথাও যাবেন। আচকান গায়ে দিয়ে জুতা পরবার জন্যে নিচু হয়েছেন, অমনি গলায় কি যেন ফাঁসের মতো আটকে গেল। প্রথমে হালকাভাবে, কিন্তু ক্রমেই তা শক্ত হয়ে এঁটে বসতে শুরু করল। তিনি হাত দিয়ে তা ছাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। জিনিসটি দারুণ পিছল। হঠাৎ তাঁর মনে হল এটা বোধহয় সাপ। আর তখনি সাপটি কানের কাছে ছোবল বসিয়ে দিল। তীব্র ব্যথায় জেগে উঠে তিনি বুঝলেন স্বপ্ন দেখছেন। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, কানের কাছের জায়গাটা এখনো ফুলে আছে, ব্যথা করছে। সম্ভবত কাঠপিপড়ের কামড়। স্বপ্নে ছোটখাটো জিনিস অনেক বড় হয়ে আসে।

খবির হসেন উঠে দাঁড়ালেন বাড়ি ফিরে যাবেন। পানি পিপাসায় এখন সত্যিসত্যি কাতর হয়েছেন। আছরের আজান দেওয়া হল না। দেওয়া ঠিক হবে না। অজু নেই। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গাঢ় ঘুম হয়েছে। গাঢ় ঘুমে অজু নষ্ট হয়ে যায়।

পথ জনশূন্য। সব মাঠে চলে গিয়েছে। অথচ তিনি কিছুই জানেন না। এরা তাঁকে কিছুই বলে নি। এরা নিশ্চয়ই ভোরবেলাতেই টের পেয়েছে। মেঘ-বৃষ্টির ব্যাপারগুলি এরা খুব ভালো জানে। একবার বৈশাখ মাসে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ এল, দেখেই মনে হচ্ছে পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাবে। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, অথচ গ্রামের মানুষ নির্বিকার। তারা হাসিমুখে বলেছে, এইটা হইল দেখন মেঘ। শক্ত বাতাস দিব। কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ব। ব্যস।

আসলেই তাই। এরা আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু বলে ফেলে। প্রকৃতির উপর যাদের এত নির্ভর তাদের তো প্রকৃতিকে বুঝতেই হবে।

কিন্তু এরা কেউ তাঁকে কিছু বলল না কেন? তিনি কি এদেরই একজন না? এদের সুখ-দুঃখ কি তাঁর সুখ-দুঃখ নয়? অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, কোথাও কেউ তাঁকে আপন করে নেয় নি। দেশে-দেশে ঘুরে জীবন কাটল। যখন যেখানে ছিলেন, তাদের কথাই ভেবেছেন। আল্লাহপাকের কাছে খাস দিলে তাদের জন্যে মোনাজাত করেছেন। তাতে লাভ কী হয়েছে? কেন এই গ্রামের একটি লোক তাঁকে দৌড়ে এসে বলল না—মৌলানা সাব, আমরার বড় বিপদ, আপনে দোয়া-খায়ের করেন।

কিংবা মনিরের বৌটার কথাই ধরা যাক। এই রাতের বেলা একা-একা ছুটে গেছে। তাঁর কাছেও তো আসতে পারত। পারত না? হঠাৎ খবির হোসেনের মনে হল, তাঁর চোখে পানি এসে পড়েছে। তিনি বড় লজ্জা পেলেন। ভাগ্যিস দেখার কেউ নেই। তিনি খুব সাবধানে পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে চোখ মুছলেন। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিতে সুরমার দাগ লেগে গেল। বাড়ি গিয়েই সাবান দিয়ে ধুতে হবে। ময়লা কাপড় তিনি পরতে পারেন না—দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। কাপড় ময়লা থাকলে মনটাও ময়লা হয়ে যায়। এই জন্যেই দিনের নবী রসূলুল্লাহ্ পরিস্কার কাপড় পরতেন, সুগন্ধি মাখতেন। খবির হোসেন গঞ্জ থেকে এক শিশি আতর কিনেছিলেন। গন্ধটা ভালোই, কিন্তু চামড়ায় লাগলেই জ্বালাপোড়া করে। কাপড়ে লাগলে বিশ্রী হলুদ রঙ ধরে। আতরের টাকাটা পানিতে পড়েছে।

খবির হোসেনের জন্যে একটা ছোটখাটো বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। তাঁর একটা চিঠি এসেছে। এখানে চিঠি আসে পনের দিন পরপর। পিওন এতদূর আসে না, কোনো একটা কোয়া নৌকার মাঝির হাতে ধরিয়ে দেয়। সেই মাঝি চিঠি নিজে দিয়ে যায় না। ঘাটে গ্রামের কাউকে পেলে তার হাতে তুলে দেয়। দু মাস তিন মাস আগের লেখা মলিন একটা খাম প্রাপকের কাছে ্কখনো পৌঁছায়, ্কখনো পৌঁছায় না।

দরজার কাছে পডে-থাকা খামটা তিনি গভীর মমতায় তুললেন। তাঁর ভাতিজির চিঠি। এই মেয়েটা তাঁকে চিঠি লিখবেই। এবং এমন সুন্দর করে লিখবে যে ইচ্ছা হবে সব ছেড়েছুঁড়ে মেয়েটার কাছে চলে যেতে। কত বার এরকম হয়েছে। দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে থাকবার সময় এক বার এরকম হল। ব্যাগ, কাপড়চোপড় গুছিয়ে তিনি তৈরি-বাড়ি চলে যাবেন। শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না। যাওয়া না-যাওয়া তো মানুষের ইচ্ছার উপর না। আল্লাহপাকের ইচ্ছার উপর। যেদিন তাঁর হুকুম হবে, সেদিন যেতেই হবে।

তিনি চিঠি খুললেন। হাতের লেখা আগের মতো সুন্দর না। কেমন আঁকাবাঁকা। মেয়েটার শরীর ভালো তো? চিঠির শুরুতেই আছে-চাচাজী, আমার লক্ষ কুটি সালাম নিবেন। খবির হোসেন এই পর্যন্ত পড়েই চোখ বন্ধ করলেন, যেন সালাম নিচ্ছেন। এবং সত্যি-সত্যি শব্দ করে বললেন-ওয়ালাইকুম সালাম গো আত্মা। ওয়ালাইকুম সালাম।

আমি অন্তরে বড় দুঃখিত হইলাম চাচাজী যে আপনি অভাগীর পত্রের জবাব দেন। না। আমি তো কোনো দোষ করি নাই। যদি জানিয়া করিয়া থাকি আপনার পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাই। চাচাজী আমাকে ক্ষমা দেন।

খবির হোসেনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। এই মেয়েটা তাঁর বড় আদরের। চার বছর বয়স থেকে একে বড় করেছেন, পনের বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন। খুব শখ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়েতে মেয়েটার জীবনটানষ্ট। সুন্দর ছেলে, সুন্দর চেহারা, কিন্তু স্বভাব-চরিত্র ইবলিশের মতো। মেয়েটার কষ্ট চোখে দেখা যায় না। দেশ ছাড়লেন তখন। কতকত যুগ আগের কথা। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।

চাচাজী, আমার তো কেউ নাই। এক আপনি আছেন। সেই আপরেও কত দিন দেখি না। এখন দেখার জন্যে মন খুব পেরেশান হয়। শরীরও ভালো না। যদি কিছু হয়, যদি আর আপনার দেখা না পাই।

খবির হোসেনের ভ্রূ কুঞ্চিত হল। ছিঃ ছিঃ, এ কী রকম খোদা-নারাজ কথা! হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। এ নিয়ে কখনো কোনো কথা বলা উচিত না। কখনো না।

চাচাজী, আপনি শুনে খুব খুশি হবেন, আমার বড় মেয়ে আবু এইবার আই. এ. পাস করেছে। এখন বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হইতে চায়। আমার ইচ্ছা না। কিন্তু তার বাবার খুব শখ। চাচাজী, বড় খুশির কথা, আনুর বাবার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন সে আর আগের মতো না। বদঅভ্যাস কিছুই নাই। অবশ্যি নামাজ-কালাম করে না। কিন্তু জুমার নামাজে যায়।

খবির হোসেনের মন আনন্দে ভরে গেল। বড় খুশির কথা! বড়ই খুশির কথা। আলহামদুল্লিাহ্, আলহামদুল্লাহ।

আপনি যদি আমারে এখন দেখতে না আসেন তা হলে খোদার কিরা আমি আপনের জামাতারে নিয়া আপনারে নেওয়ার জন্যে ভাটি অঞ্চলে আসিব। সে অবশ্য পানির দেশে যাইতে ভয় পায়। কিন্তু উপায় কি? এইবার আপনাকে আর যাইতে দিব না। বাকি কয়টা দিন থাকতে হবে আমাদের সঙ্গে। নয়তো আপনার উপর আল্লাহর কিরা।

আহ, কী কথায়-কথায় আল্লাহর কি! কিছুই শিখল না। রাগ করতে গিয়েও তিনি করতে পারেন না। গভীর মমতায় তাঁর চোখ আৰ্দ্ৰ হয়।

চাচাজী, আপনার পবিত্র পায়ে আবার শত কুটি সালাম।

তিনি চিঠি হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মনে-মনে বললেন-ওয়ালাইকুম সালাম মা বেটি। ওয়ালাইকুম সালাম।

চাচাজীগো, আপনার জন্যে আমি খুব কাঁদি। আপনার সেবাযত্ন করিবার ইচ্ছা হয়। মনটা পেরেশান হয় চাচাজী, মাঝে-মাঝে আপনেরে খোয়াবে দেখি। তখন বড় অস্থির লাগে। চাচাজীগো, আমার শরীর ভালো না। আপনেরে দেখতে মন চায়। আল্লাহ্পাক কি আমার আশা পূৰ্ণ করিবেন না?

মেয়েটার জন্যে খুব মন কাঁদতে লাগল। চলে গেলে কেমন হয়? অনেক দিন তো হল এখানে। জীবন প্রায় পার করে দিয়েছেন। শেষ কটা দিন না-হয় থাকলেন নিজের জায়গায়। মরবার আগে-আগে নাকি জন্মস্থানের মাটি ডাকতে থাকে। সেই ডাক অগ্রাহ্য করা মুশকিল। জন্ম-মাটির উপর শুয়ে থাকলে মৃত্যুর সময় আজাব কম হয়। বিদেশে মৃত্যু খুব কষ্ট।

তিনি অজুর বদনা নিয়ে বারান্দায় এলেন। চিলগুলি এখনো উড়ছে। তবে আগের মতো এত উপরে নয়। অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে। কালো রঙের আকাশে কেমন একটা তামাটে আভা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *