সুমির সঙ্গে অজয় লুকোচুরি খেলিতেছিল। আত্মরক্ষা করিতে সে এক-এক লাফে তিনটা করিয়া সিড়ি ডিঙাইয়া উপরে উঠিতেছে, মাঝপথে হঠাৎ নমিতাকে নামিতে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি বলিয়া বসিল,—“আমি এই দরজার আড়ালে গিয়ে লুকোচ্ছি, সুমি খুজতে এলে ভুল পথ দেখিয়ে দিয়ো।” বলিয়া অজয় দরজার পিছনে আত্মগোপন করিল। দুইটা দুয়ার যেখানে আসিয়া মিশিয়াছে তাহারই সামান্য ফাঁক দিয়া সে দেখিতে পাইল, নমিতা নীচে না নামিয়া সুমিকে ভুল সংবাদ দিবার জন্য সেইখানে নিস্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। প্রায় মিনিট দুই কাটিল, নমিতার নড়িবার নাম নাই।
সুমি হঠাৎ চীনে-বাদাম-ওলার ডাক শুনিয়া যুদ্ধে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিয়া রোয়াকে দাঁড়াইয়া ততক্ষণ বাদাম চিবাইতেছে-সে-খবর ইহাদের কানে পৌঁছাইবার সম্ভাবনা ছিল না। জয়-দা যে তাহার আক্রমণের ভয়ে এমন সন্ত্রস্ত হইয়াছেন ও তঁাহার দুর্গ-দুয়ারে প্রহরী মোতায়েন রাখিয়াছেন, তাহা জানিলে সুমি নিশ্চয়ই এত অনায়াসে রণে ভঙ্গ দিত না।
আরো কিছুক্ষণ কাটিলে অজয় বাহির হইয়া আসিল। দেখিল, নমিতা তখনো কুণ্ঠিতকায়ে সেইখানে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। এমন একটা নিভৃত মুহুর্তে কিছু না বলিয়া ধীরে ধীরে পাশ কাটাইয়া অন্তর্হিত হইলেই সৌজন্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখানো হয় কি না, সেই বিষয়ে মনে মনে কোনো প্রশ্ন না তুলিয়াই অজয় আবার কহিল, “সুমি বোধ হয় কয়লার ঘরে আমাকে খুঁজতে গেছে। সত্যি, সেখানে গিয়ে লুকলে আমাকে ওর আর এ-জন্মে বার করা চলত না।”
এটা অবশ্য অত্যুক্তি, কেননা বর্ণসম্পদে অজয় এতটা হেয় নয় যে, একেবারে কয়লার উপমেয় হইয়া উঠিবে। তবু, অতিশয়োক্তিটার দরুণ একটা প্রত্যুত্তর পাইবার আশা আছে মনে করিয়া, অজয় নিজের গায়ের রঙ সম্বন্ধে এমন একটা বিনয় করিয়া বসিল। নমিতা স্বল্প একটু হাসিল, ঘোমটা টানিয়া একটু চঞ্চল হইয়া উঠিল এবং সরিয়া যাওয়া সমীচীন হইবে মনে করিয়া এক পা বাড়াইয়া আর যাইতে পারিল না।
কয়েক ধাপ নীচে নামিয়া অজয় নমিতার প্রায় নিকটে আসিয়া কহিল,—“বাড়িটা কঁকা-ফঁকা ঠেছে। দিদি ওঁরা কোথায় গেলেন?”
এ-প্রশ্নটা এমন নয় যে ইহার উত্তরে বাক্যস্ফুরণ করিলে নমিতার অঙ্গহানি হইবে, যদিও কড়া শাসনের অত্যাচারে তাহার আত্মকর্তৃত্বহীনা অবামুখী হইয়া থাকিবারই কথা ছিল। কিন্তু উত্তরটা এত সহজ ও সময়টি এত নিভৃত যে, নমিতা চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। স্পষ্ট করিয়াই কহিল,—“কাকিমারা সবাই ম্যাটিনিতে থিয়েটার দেখতে গেছেন।”
—“ছেলেপিলেরাও গেছে?”
–“হ্যাঁ।“
—“সুমি গেল না কেন?”
একটু থামিয়া নমিতা বলিল,-“মা যেতে দিলেন না।”
এই থামিবার অর্থ টুকু অজয় বুঝিল। সাহস করিয়া কহিল,-“কিন্তু তুমিও বাড়িতে রইলে যে। গেলেই ত’ পারতে।”
দৃঢ়নিবদ্ধ ঠোঁট দুইটি ঈষৎ প্রসারিত করিয়া নমিতা আবার একটু হাসিল! কিছু বলিবার আর প্রয়োজন ছিল না। এই হাসিটিতে বিষাদের স্বাদ পাইয়া অজয় বলিল,—“তোমার বুঝি আনন্দ করবার অধিকার নেই?”
নমিতার মুখ সহসা গম্ভীর হইয়া উঠিল, অজয় সিড়ির যেখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, নামিতে হইলে তাহার স্পর্শ হইতে আত্মরক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠে; তাই সচকিত হইয়া নমিতা কহিল,—“সরুন।”
—“নীচে কেন যাচ্ছ?”
—“মা-র আহ্নিকের জন্যে গঙ্গাজল আতে।”
-“তুমি আহ্নিক কর না?”
অজয় ভাবিয়াছিল ইহার উত্তরে নমিতার মুখে আবার হাসি ফুটিবে। কিন্তু নমিতা সত্যভাষণের উপযুক্ত সহজ ও স্পষ্টস্বরে বলিল,—“পূজোর পরে আমাদের গুরুদেব আসবেন—তার কাছ থেকে আমার মন্ত্র নেবার কথা আছে।”
কথাটা শুনিয়া অজয়ের সমস্তগা যেন জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু চিত্তের অসন্তোষ দমন করিয়া সংযত শান্তকণ্ঠে কহিল,—“এই অল্প বয়সেই স্বর্গের জন্যে তোমার এত লোভ?”
উদাসীনকণ্ঠে নমিতা উত্তর দিল : “এ-ছাড়া আমার আর কী-ই বা করবার আছে?” বলিয়া সিড়ি দিয়া একটু তাড়াতাড়িই নীচে নামিয়া গেল।
ঘটে করিয়া গঙ্গাজল লইয়া উপরে উঠিবার সময় নমিতা দেখিতে পাইল অজয় তেমনি সিড়ির উপর দাঁড়াইয়া আছে—যেন তাহারই প্রতীক্ষায়। সঙ্কুচিত হইয়া স্পর্শ বাচাইয়া আবার সে উঠিতে যাইতেছে, অজয় বলিল,-“তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে—অনেক কথা। তোমার সঙ্গে এতদিন এক বাড়িতে বাস করে’ও যে আলাপ হয় নি, তার কারণ আমার সৌজন্যের আতিশয্য আর তোমার ভীরুতা। কিম্বা সত্য কথা বলতে গেলে আমাদের সমাজের অনুশাসন। আজ যখন দৈবক্রমে তোমার সঙ্গে আলাপ হ’লই, তখন একটু সবিস্তারে তোমার সঙ্গে কথা ববার অনুমতি আমাকে দেবে না?”
কি বলিবে নমিতা কিছু ভাবিয়া পাইল না; যেন তাহার গ্রীবা সম্মতিসূচকসঙ্কেত করিয়া বসিল।
উপরে উঠিবার পথ ছাড়িয়া দিয়া অজয় আবার কহিল,—“অনুমতি ত’ তুমি দেবে, কিন্তু তোমার অভিভাবকরা যে তাতে আলাদে আটখানা হবেন তার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এতদিন একসঙ্গে থেকে আমি এটুকু যে একেবারেই বুঝিনি তা তুমি মনে কোরো না। আচ্ছা, সে-কথা পরে হবে—মাকে গঙ্গাজল দিয়ে এস। আজকে বিকেলে অন্তত অভিভাবকদের শুভেচ্ছা তোমাকে স্পর্শ কবে না।”
বলিয়া অজয় চলিয়া যাইতেছিল, নমিতা সোৎসাহে প্রশ্ন করিল, “কোথায় যাচ্ছেন?”
—“এই আসছি—আমার ঘরের জালাগুলো ভোলা আছে, কী রকম মেঘ করেছে দেখেছ? একবার বৃষ্টি নামলে আর রক্ষে নেই— বিছানা-বালিশ সব কাদা! অভিজ্ঞতাটা অবশ্যি নতুন হতো না, কিন্তু কাল থেকে জ্বর-ভাব হয়েছে বলে একটু সাবধান হচ্ছি। আমি যাচ্ছি ওপরে-বারান্দায়। দু’ মিনিট।”
বারান্দা বলিতে ঐ দক্ষিণের বারান্দাটিই বুঝায়,—মাকে আহ্নিকে বসাইয়া, দুয়েকটি গৃহকৰ্ম্ম সারিয়া নমিতা ধীরে বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার আগেই অজয় রেলিঙ ধরিয়া দাঁড়াইয়া রাস্তার দিকে চাহিয়া আছে। প্রথম অজয় নমিতার আবির্ভাবটিকে লক্ষ্য করিল না বলিয়া, আর দুয়েক পা অগ্রসর হইয়া আরো একটু কাছে আসিতে নমিতার ভারি লজ্জা করিতেছিল, কিন্তু আরো একটু কাছে না আসলে আলাপ অন্তরঙ্গ হইয়া উঠিতে পারে না। নুমিতা কি করিবে কিছু ভাবিয়া না পাইয়া তেমনি রেলিঙ ধরিয়া দূরে কালো আকাশের পানে তাকাইয়া রহিল।
অজয়ই হঠাৎ সজাগ হইয়া কাছে সরিয়া আসিল। কোনো রকম ভূমিকার সূচনা না করিয়া সোজাসুজি প্রশ্ন করিল : “পূজো-আহ্নিক করা ছাড়া তোমার আর কোনো বড় কাজ করবার সত্যিই কি কিছু নেই?”
নমিতা কথা বলিতে জোর পাইল না বটে, কিন্তু তবু কহিল, “ওঁদের মতে পূজো-আহ্নিক করে বাকি জীবনটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেওয়াই আমার লক্ষ্য হওয়া উচিত।”
—“বাকি জীবন?” অজয় যেন আকাশ হইতে পড়িল : “বাকি জীবন সম্বন্ধে তুমি কিছু স্পষ্ট ধারণা করতে পারো? তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে এই ছোট সঙ্কীর্ণ আকাশটুকু দেখে সমস্ত পৃথিবীর ছবিটা মনে মনে একে নিতে পারো? বাকি জীবন! অসৌজন্য মাপ করো, তোমার বয়েস কত?”
নমিতা লজ্জায় মুখ নামাইল। অজয় আবার কহিল,-“তোমার মতো বয়সে ফ্রান্সে জোয়ান অব আর্ক দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছিলো—বাকি জীবনটাকে খরচের ঘরে ফেলে দেউলে হয় নি। সেসব খবর তুমি নিশ্চয়ই রাখে না, তাই এমন স্বচ্ছন্দে নিজের সম্বন্ধে এতটা উদাসীন হ’তে পেরেছ। তোমাকে তিরস্কার করছি না, কিন্তু এটা মনুষত্ব নয়।”
নমিতার স্বর ফুটিতেছিল না, তবু প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া কহিল,–কিন্তু বিধবার আর অপর কর্তব্য নেই। ভগবৎ-ভক্তিই তার একমাত্র ভরসা।”
অজয় হাসিয়া উঠিল; কহিল,—“তোমাকে এ-সব কথা কে শেখালে? বিধবা তুমি কি ইচ্ছে করে’ হয়েছ? তুমি কি সাধ করে স্বেচ্ছায় এই বৈরাগ্যের বেশ নিয়েছ? নিয়তির বিধানের চেয়েও সমাজের শাসন যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন অন্ধের মতো তার কাছে। বশ্যতা স্বীকার করা মানে নিজেকে অপমান করা। তোমার ভগবান তোমাকে ঘরে বসে’ মুড়ি নিয়ে ছেলেখেলা করতে উপদেশ দিয়েছেন? এই যে দলে দলে লোক যুদ্ধে প্রাণ দিচ্ছে, দেশ স্বাধীন কতে কারাগারকে তীর্থ করে তুলছে, তারা সব ভগবানের বিরুদ্ধাচারী?”
নমিতা ঘাড় নীচু করিয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল,—“কিন্তু সংসারের শান্তি রাখতে হলে প্রতি পদে আমাকে তার মুখ চেয়ে চলতে হবে। সংসার চায় আমি বসে বসে কড়ি নিয়ে ছেলেখেলা করি।”
অজয় উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে : “কাদের নিয়ে সংসার? জান, সমাজ আমরা সৃষ্টি করেছি, আমরাই তাকে ভাঙবো। আমাদের আবার অধিকার না থাকলে আমরা তাকে মাম্বো কেন? যা তোমাকে তৃপ্তি দেয় না বরং সমস্ত জীবনকে সঙ্কুচিত খর্ব করে রাখে, সেই আচার তোমাকে পাড়ার পাঁচজনকে খুসি করতে অম্লানবদনে পালন করতে হবে, সেটা খুব উচ্চাঙ্গের সতধৰ্ম্ম নয়। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনের উপর প্রভুত্ব খাটাতে পারে এমন একটা কৃত্রিম শক্তিকে যদি তুমি মাননা, তবে সেই হবে তোমার সত্যিকারের মৃত্যু। আমরা এমন মরবার জন্যে জন্মাইনি।”
ঝর ঝর করিয়া শরৎকালের বৃষ্টি নামিয়া আসিল। নমিতা কণ্ঠস্বর আর্ল করিয়া কহিল,—“কিন্তু সংসার বা সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার শক্তি বা ঘোগ্যতা আমার কিছুই নেই। যারা দেহে মরবার আগে আত্মায় মরে থাকে, আমি তাদেরই একজন। আমাকে দিয়ে আমার নিজেরো কোনো আশা নেই।”
কথা শুনিয়া অজয় মুগ্ধ হইয়া গেল,বৃষ্টির সঙ্গে এই কথা কয়টি মিলিয়া আকাশে ও মনে এমন একটি মাধুৰ্য বিস্তার করিল যে, ক্ষণকালের জন্য সে অভিভূত হইয়া রহিল।
পরমুহূর্তেই উদ্দীপ্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করিল : “ভারতবর্ষ বহু বৎসর ধরে’ স্বাধীনতার সাধনা করছে, সে খবর তুমি রাখ?”
একটু হাসিয়া নমিতা বলিল,—“রাখি বৈ কি।”
—“কিন্তু কেন সফল হচ্ছে না জান?”
—“কেন?”
—“আমরা এত সব ছোটখাটো শাসন ও সংস্কারের দাসত্ব করছি যে বড়ো একটা মুক্তির পথে আমাদের পদে-পদে বাধা ঘটছে। আমরা যে মন্দির-বেদী গড়তে চাই তার থেকে অস্পৃশ্য বলে’ অনেক কাউকে সরিয়ে রাখি। নিজের কাছে মুক্ত, স্বতন্ত্র না হতে পারলে বাইরের মুক্তি আমরা কি করে পেতে পারি বলল? প্রকৃতির রাজ্যে সব কিছুই নিয়মাধীন—আমাদের বেলায়ই তার ব্যতিক্রম ঘটবে সেটা আমাদের প্রকাণ্ড দুরাশা। আমরা সমাজে ছ’শো ছত্রিশটা দেওয়াল গেঁথে একে অন্যের থেকে পৃথক হয়ে কোটি কোটি স্বার্থপরতার সর্ষ বাধাবো, সমাজগঠনে সুবিধে না দিয়ে নাবীকে রাখব পদদলিত, চাষা-মজুরকে রাখবো পায়ের ক্রীতদাস আর হাতের ক্রীড়নক—আমরা কি করে বৃহত্তর স্বাধীনতার দাবি করতে পারি? তার মানে, সাফল্য আমাদের সেইদিনই অনিবাৰ্য নমিতা, যেদিন আমরা প্রত্যেকে বর্তমানের এই শূন্য না থেকে এক হয়ে উঠেছি। আমরা প্রত্যেকে যদি এক হই, তবে কেউ আর একাকী থাকবে না। তেত্রিশ কোটি শূন্য যোগ দিলে সেই শূন্যই থেকে যাবে—শত যোগবলেও সেই যোগফল তুমি বদলাতে পারবে না কখনো।”
খানিক থামিয়া অজয় আবার কহিল,—“হ্যাঁ, বিদ্রোহ করবার যোগ্যতা তোমার নেই—নিজের অসম্পূর্ণতা সম্বন্ধে তোমার এই জ্ঞানটুকু আছে বলে তোমার ওপর শ্রদ্ধা আমার বেড়ে গেলো। কিন্তু সেই যোগ্যতা তোমাকে অর্জন করতে হবে। তুমি চম্কে উঠো না। যোগ্য না হয়ে আজ যদি তুমি সংসারের বিরুদ্ধাচরণ কর, সেটা তোমাকে শোভা পাবে না বলেই লোকের চোখে লাগবে প্রখর দৃষ্টিকটু, এবং স্বয়ং আমি পৰ্যন্ত বলববা অন্যায়—তোমাকে ধিক্কার দেবব। কিন্তু যেদিন তুমি আত্মার শৌর্য্যে ঐশ্বৰ্য্যশালিনী হয়ে উঠে এই সব তুচ্ছ সংস্কার ও মিথ্যাচারকে ছুঁড়ে ফেলে বাইরে বেরিয়ে আসবে—সেদিন সব্বারই আগে যার প্রণাম পাবে সে আমাব।”
নমিতার হৃদয় উদ্বেল হইয়া উঠিতেছিল; ধীর সংযতকণ্ঠে সে কহিল,—“কিন্তু সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণটাই কি বড়ো কীর্তি হবে?”
—“যাকে তোমার এখন মাত্র বিদ্রোহাচরণ মনে হচ্ছে, তখন দেখবে সেই তোমার জীবন। তখন যেটা তোমার কাছে একান্ত সহজ, ন্যায্য ও স্বাভাবিক মনে হবে—সেটাই অন্যের মতে হবে অন্যায়, কেউ-কেউ বা তার সংজ্ঞা দেবে পাপ। পরের পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলবার জন্যে আমরা হাটতে শিখিনি। অনবরত সীমারেখা টেনে-টেনে জীবনকে আমরা কুণ্ঠিত ও সঙ্কীর্ণ করে রেখেছি বলেই আমরা অহর্নিশ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সাদৃশ্য বাঁচিয়ে চলতে চাই। কিন্তু জীবনের পরিধিকে বিস্তৃত করে দিতে থাক, ব্যক্তিত্বের সাধনায় তুমি ক্রমোন্নতি লাভ কর, দেখবে তুমি অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছ। তাকে যদি বিদ্রোহ বল, আমরা সেই বিদ্রোহ নিশ্চয়ই করব। তখন বিদ্রোহ না করাটাই হবে আত্মহত্যা।”
শরৎকালের বৃষ্টি স্বল্পায়ু—অনেকটা নারীর ভালবাসার মত। বৃষ্টির পরে আকাশ আবার স্নিগ্ধ ও বেদনাতুর চোখের মত ভাবগম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে। আবার কথা সুরু বরিতে দেরি হইতেছিল। চুপ করিয়া কত ক্ষণ কাটিল কাহারো কিছু খেয়াল ছিল না। হঠাৎ অজয় প্রশ্ন করিল : “সমস্ত দিন তুমি কি করে কাটাও?”
নিমেষে নমিতার ঘোর কাটিল বুঝি,—আবার সে তাহার নিরানন্দ পৃথিবীর মুখোমুখি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কহিল,–“কি করে আর কাটাই? কাজ কৰ্ম্ম করি আর ঘুমুই।”
—“এ রকম করে’ ক’দিন কাটাবে? তোমার মুখের সেই অসার উত্তরটা আমি শুনতে চাই না। বলতে চাই, এম্নি করে অমূল্য সময় অপব্যয় করে তোমার কোন পরমার্থ লাভ হচ্ছে?”
—“কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কী-ই বা করবার আছে?”
—“তুমি পড় না কেন? সুমিকে দিয়ে তোমাকে যে একটা বই। পাঠিয়েছিলুম তা পড়েছিলে?”
নমিতার মুখে অল্প একটু হাসি দেখা দিল; কহিল,-“তা পড়া বারণ হয়ে গেছে।”
—“বারণ হয়ে গেছে? কারণ?”
—“কারণ, কাকা ও-সব উপন্যাস-পড়া নিষেধ করেছেন।”
অজয় অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল; “উপন্যাস? ও ত’ একটা ইতিহাস মাত্র—শাদা সত্য ঘটনা। আর, মাছ মাংস মশুর ডালের মত উপন্যাসও তোমাদের নিষিদ্ধ নাকি? মনুর কোন্ অধ্যায়ে তা লেখা আছে?”
নমিতার কণ্ঠস্বরে ব্যঙ্গের আভাস স্পষ্ট হইয়া উঠিল : “আমাকে গীতা পড়তে বলেছিলেন। সংস্কৃত শব্দরূপই জানি না তা তার মাথামুণ্ডু আমি কি বুঝবো ছাই? ওটা আমার চমৎকার ঘুমুবার ওষুধ হয়েছে।”
আরো একটু কাছে সরিয়া আসিয়া অজয় কহিল,—“এটা তোমার কাছে জুলুম মনে হয় না?”
—“জুলুম কিসে?”
-“মানুষকে ভালো করার মধ্যেও একটা পরিমাণ জ্ঞান থাকা উচিত। জামাইবাবুকে একখানা টিগোনোমেট্রির বই দিয়ে আঁক কষতে বল না।”
—“কিন্তু ধর্মগ্রন্থ ছাড়া আর আমাদের পাঠ্য কী হতে পারে?”
—“আমাদের আমাদের করে তুমি নিজেকে একটা গণ্ডীর মধ্যে টেনে এনে ছোট করে তুলছ কেন? তুমি কি মানুষ নও? তোমার কপালে সিদূর নেই বলেই যে তোমার জীবনধারণে কোনো সুখ থাকবে না—এ যারা তোমাকে বোঝাতে চায় তারা তোমার আত্মার অত্যাচারী। তাদেব তুমি মেনো না। আমি আছি তোমাব বন্ধু। কী করে সময় কাটাবে? খুব করে পড়ে। প্রথমত তাই পড়ে। যা বুঝতে ব্যাকরণ লাগে না, লাগে শুধু অনুভূতি। যেমন ধরো কবিতা। তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে।”
নমিতা একটু ভীত হইয়া বলিল,—“কিসের জন্যে?”
—“নিজেকে আবিষ্কার করবার জন্যে।”
—“ও-সব কথার মানে আমি বুঝি না।”
—“সে বোঝবার সময়টুকু পৰ্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। আমি আনছি বই। জীবনকে দেখবার জন্যে বই হচ্ছে বাতায়ন, সে বাতায়ন দিকে দিকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে।” বলিয়া দ্রুতপদে অজয় অদৃশ্য হইয়া গেল।
মধ্যরাত্রে নমিতা আবার ঘুম হইতে উঠিয়া বারান্দার ধারটিতে আসিয়াছে। কয়েকবার বৃষ্টি হইয়া যাইবার পরেও আকাশের স্তম্ভিত ভাবটা এখনো কাটিয়া যায় নাই—সেই নিরানন্দ বিবর্ণ আকাশের তলে সমস্ত শহরটা যেন অবসন্ন হইয়া ঝিমাইতেছে—পৃথিবী আর চলিতে পারিতেছে না। বিকাল হইতে নমিতার মন-ও রাতের আকাশের মত ঘোলাটে হইয়া রহিয়াছে—নানা সমস্যা ও সংস্কারের আবর্তে পড়িয়া সে হাঁপাইয়া উঠিতেছিল। তাহার জীবনের ভবিষ্যৎ মুহূর্তগুলি যেন তাহাকে আর নিশ্চিন্ত থাকিতে দিবে না—প্রত্যেকটি মুহূৰ্ত্ত ফলবান হইবার জন্য তাহাকে উদ্বস্ত করিয়া তুলিয়াছে। এই আত্মবিস্মৃতিময় আরাম তাহাকে আর পোষাইবে না। কিন্তু এই দুঃখের আরামকে শতধা বিদীর্ণ করিয়া নবজীবনের ঝড় আসিবে কবে?
হঠাৎ তাহার খেয়াল হইল রাস্তায় কে একজন পাইচারি করিতেছে। আজ তাহার চোখ কৌতূহলী হইয়া উঠিয়াছে, ভালো করিয়া ঠাহর করিয়া দেখিল, অজয়। রোজই ত’ এই সময় এমনি একটি লোক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে, এমন করিয়া কোন দিনই সে লক্ষ্য করে নাই। এত দিনের সেই লোকটিই যে অজয় ইহার সম্বন্ধে লেশমাত্র সন্দেহও তাহার মনে রহিল না এবং এই বিশ্বাসটুকুকেই অন্তরে লালন করিতে গিয়া নিমেষে নমিতা রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। আজ দূর হইতে অজয়কে স্পষ্ট করিয়া দেখিবার জন্য তাহার দৃষ্টি একাগ্র হইয়া উঠিল এবং এমন আগ্রহ সহকারে চাহিয়া থাকাটার মধ্যে কোথাও যে এতটুকু অসৌজন্য থাকিতে পারে, তাহা তাহার ঘুণাক্ষরেও মনে হইল না। লোকটিকে অজয় জানিয়া চোখ ফিরাইয়া লইলে এই রাত্রি বোধ করি আর কাটিত না। চলিতে চলিতে অজয় যখন মোড়ের গ্যাস-পোসটের কাছে আসিতেছে, তখন অনতিস্পষ্ট আলোতে তাহাকে একটু দেখিয়া লইতে না লইতেই অন্ধকার আসিয়া সব কালো করিয়া দিতেছে। তবু যেটুকু সে দেখিতে পাইতেছে না, সেইটুকুর জন্যই তাহার মন উচাটন হইয়া উঠিল।
কাকিমার ছোট খুকিটা অভ্যাসমত চেচাইয়া উঠিয়াছে। একটা হাত-পাখা দিয়া কাকিমা তাহাকে খুব পিটাইতেছেন : “মর মরু শুনি। সারা থিয়েটার জালিয়ে এসে হারামজাদির এখনো কান্না থামে না। কোনো দেবীর কৃপা হলেও ত’ বেঁচে যাই।”
পাশের খাট হইতে কাকা হাকিলেন : “নমি উঠে আসে না কেন?”
কাকিমার উত্তর শোনা গেল : “ধুমুসসা হয়ে গিলতেই পারে সব। নমি আসবেন! মায়ে-ঝিয়ে দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে। পরের পয়সায় খেলে ডানিও নবাবের বেটি হয়ে ওঠে। ‘
এইবার সামনের ঘর হইওে মা’র ডাক অসিল : “নমিতা।”
অজগর সাপের মত কুণ্ডলী পাকাইয়া বিপুল রাজপথ ঘুমাইয়া রহিয়াছে; আকাশ নিৰ্বাক, অন্ধের চক্ষুর মত সঙ্কেতহীন, গম্ভীর। অজয় আরেকবার মোড় ফিবিয়া গ্যাস-পোসটের তলা দিয়া ঘুরিয়া আসিল, আবার চলিয়াছে। দেয়ালের প্রান্তটুকু ঘেঁসিয়া বসিয়াও তাহাকে আর দেখা গেল না, ফিরিতে আবার এক মিনিট লাগিবে। না, খুকিকে কাঁধে ফেলিয়া হাঁটিয়া-হাটিয়া ঘুম পাড়াইতে হইবে। অজয়ের চোখে কি ঘুম নাই? না, নমিতাকে উঠিতে হইল।