সকাল থেকেই সুপ্তির খুব মন খারাপ।
মন খারাপ হবার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু মনে হচ্ছে খুব বড় কিছু ঘটবে। ভয়ংকর কিছু। সেই ভয়ংকর কিছুটা কী তা সে জানে না। কেউ কি মারা যাবে? এ বাড়ির একমাত্র অসুস্থ মানুষ তার নানীজান খাদিজা বেগম। তিনি বেশ সুস্থ। রাত্রে সুপ্তি তাঁর সঙ্গে ঘুমায়। তিনি মহানন্দে গভীর রাত পর্যন্ত গল্প করেন। মানুষ হুট-হাট করে মারা যায় ঠিকই কিন্তু নানীজান হুট করে মারা যাবেন সুপ্তির তা মনে হয় না। তাহলে এত মন খারাপ লাগছে কেন? সুপ্তি কারণটা ধরতে পারছে না। সে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আবার নিজের ঘরে ঢুকল। ঘর-বাড়িগুলি কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। এরকম তার কখনো হয় না, আজ হচ্ছে কেন?
সুপ্তি বাড়ির পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। নিজের বাড়িতে সে যত স্বাভাবিকভাবে ঘুরতে পারে এ বাড়িতে পারে না। প্রতিদিনই জায়গাটা তার নতুন লাগে। বাড়ির উঠোনে একটা ডালিম গাছ আছে, এই ডালিম গাছটাও যেন জায়গা বদলায়।
সুপ্তির নানীজান খাদেজা বেগম লক্ষ্য করলেন সুপ্তি তাঁকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন মাইয়া কই যায়?
পুকুর পাড়ে যাই নানীজান।
কী সর্বনাশ, একলা একলা ক্যামনে যাবি?
পারব নানীজান।
আয় আমি লইয়া যাই।
নানীজান এসে হাত ধরলেন। কেউ হাত ধরে তাকে টেনে টেনে নিয়ে গেলে তার খুব খারাপ লাগে। নিজেকে অন্ধ অন্ধ লাগে। যদিও সে অন্ধ, তারপরেও অন্ধ অন্ধ লাগাটা কুৎসিত। একমাত্র নানীজান হাত ধরলে খারাপ লাগে না।
পুসকুনি তোর ভাল লাগে রে মাইয়া?
খুব ভাল লাগে।
আমারও লাগে। নয়া বউ হইয়া যখন এই বাড়িত আসি তখন কী করতাম জানিস?
না জানি না। কী করতেন?
পুসকুনির পাড়ে বইয়া বইয়া খালি কানতাম। আর তোর নানাজান রাগ ভাঙ্গাইয়া আমারে ঘরে আনত। একদিন কী হইছে শোন, আমার রাগ আর ভাঙ্গে না। শেষমেষ তোর নানাজান আমারে কোলে কইরা আনা ধরছে– হঠাৎ দেখা হইল আমার শাশুড়ির সাথে। তোর নানাজান ধপাস কইরা আমারে ফেলাইয়া দিল। হি হি হি।
নানাজান তোমাকে খুব ভালবাস?
ওমা ভালবাসব না? কী কস তুই?
এত ভালবাসতো তাহলে পুকুর পাড়ে বসে তুমি কাঁদতে কেন?
কানতাম যাতে তোর নানাজান আইসা আমার কান্দন থামায়। হি হি হি। তখন আমার বয়স ছিল কম। দুষ্টু বুদ্ধি ছিল বেশি।
তোমার বয়স কত ছিল নানীজান?
তের বছর।
ও আল্লা আমারও তো তের বছর বয়স। কিন্তু নানীজান আমি পুকুর পাড়ে বসে যতই কাঁদি, আমার কান্না থামানোর জন্যে নানাজানের মতো কেউ আসবে না।
খাদিজা বেগম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। এবং হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তার চোখে পানি এসে গেছে। তার এই নাতনীটিকে তিনি খুব পছন্দ করেন। এত পছন্দ তিনি এই জীবনে কাউকে করেছেন বল তার মনে পড়ে না।
নানীজান!
কী গো মাইয়া। ‘আমি তোমার খুব মন খারাপ করিয়ে দিয়েছি তাই না? তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে তোমার চোখে পানি। আমার কারোর মন খারাপ করতে ইচ্ছা। করে না। তারপরেও নিজের অজান্তেই সবার মন খারাপ করিয়ে দেই। আমার মাঝে মাঝে কী ইচ্ছা করে জান?
কী ইচ্ছা করে?
ইচ্ছা করে তোমাদের এই পুকুরটায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে যাই। একবার সাহস করে পড়তে পারলে তোমরা শুরুতে প্রচণ্ড কষ্ট পেলেও পরে আর কষ্ট পেতে না।
সুপ্তি কাঁদছে। অনেক দিন পর ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। নানীজান তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়েও তাকে শান্ত করতে পারছেন না।
কি-যে সুপ্তির হল। সে সারাদিনই কাঁদল। নানীজান রাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে গেলেন। এবং তিনি লক্ষ্য করলেন—সুপ্তি বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে।
.
সুপ্তি ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যদিও তার কাঁদার কথা না—কারণ সে খুব আনন্দময় একটা স্বপ্ন দেখছে। আনন্দময় স্বপ্ন দেখেও মানুষের চোখে পানি আসে। তারও হয়ত তাই হচ্ছে। সে দেখছে যেন ম্যাজিক ভাইয়া তার সামনে বসে আছেন। হাসছেন।
ম্যাজিক ভাইয়া আপনি কেমন আছেন?
ভাল আছি।
আপনি কি জানেন আজ আমি সারাদিন কেঁদেছি।
জানি।
কীভাবে জানেন?
আমি জানব না কেন? আমি যাদুকর না?
আমি এখনও কাঁদছি আর আপনি হাসছেন?
তোমার কান্না থামার ব্যবস্থা করছি বলেই হাসছি—ভোরবেলা যখন তোমার ঘুম ভাঙ্গবে তখন আর কান্না থাকবে না।
কেন?
আমি তোমার জন্যে ভয়ধারণ একটা ম্যাজিকের ব্যবস্থা করেছি। তোমার ঘুমের মধ্যেই ম্যাজিকটা ঘটবে। ম্যাজিকটা হল তোমার জন্যে আমার উপহার।
আপনার গলার স্বরটা এমন করুণ শুনাচ্ছে কেন?
আমার মনটা খুব খারাপ এই জন্যেই বোধহয়।
মন খারাপ কেন?
তাতো তোমাকে বলব না।
.
লুপ্তির ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। খুজরের আজান হয়ে গেছে। ঘরে সামান্য আলো এসেছে। সুপ্তি বিছানা থেকে নামল। তার মনে হচ্ছে সে যেন অন্য কোথাও চলে এসেছে। সব কিছুই কেমন এলোমেলো—কেমনঅপরিচিত। যে খাটটা থেকে নেমেছে সেই খাটটা অপরিচিত। যে ঘরে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘর অপরিচিত। তার শরীরও যেন কেমন ঝিমঝিম করছে। কিছু একটা ঘটেছে, কী ঘটেছে সে বুঝতে পারছে না। সুপ্তি দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার দিল। সুরমা নামাজ ফেলে ছুটে এলেন। সুপ্তি মার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটেছে–আমি চোখে দেখতে পারছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে থাক। আমি সহ্য করতে পারছি না। পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন মা?
সুরমা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। সুপ্তি জ্ঞান হারিয়ে মা’র কোলে এলিয়ে পড়ল।
.
পরিশিষ্ট
অনেক অনেক দিন কেটে গেছে। সুপ্তির বিয়ে হয়েছে। তাদের একটা বাবু হয়েছে। তারা বাবুর নাম রেখেছে টগর। টগরকে নিয়ে সুপ্তিকে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। খুবই দুষ্ট ছেলে। সুপ্তির জীবন হয়েছে আনন্দময়। সে সারাক্ষণই গভীর বিস্ময় এবং গভীর আনন্দ নিয়ে তার চারপাশের জগৎ দেখে। সামান্য একটা পোকাও যদি তার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় সুপ্তি চেঁচিয়ে বলে—টগর দেখে যাও, দেখে যাও কী সুন্দর একটা পোকা।
মাঝে মাঝে সুপ্তি একটা অদ্ভুত স্বপ্নও দেখে–যেন গভীর একটা বন, সেই বনে একটা কদম গাছ। এই গাছটা অন্য গাছগুলির চেয়ে আলাদা। অন্য গাছগুলি চোখে দেখতে পায় এই গাছটা পায় না। কারণ এই গাছ তার দুটো চোখ একটা মানুষকে দিয়ে দিয়েছে। এই অদ্ভুত স্বপ্নের মানে কী সুপ্তি বুঝতে পারে না।
Odvut dhoroner golpo.