সাবের ঝিম মেরে পড়ে ছিল।
রাত প্রায় তিনটা। সুরমা ছেলের পাশে শুয়ে আছেন। এতক্ষণ তিনি জেগেই ছিলেন, কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন। নার্স মেয়েটি বারন্দার চেয়ারে জেগে বসে আছে। মিস্টার আগস্টকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। রুগীর ঘরে ঢুকতে নিষেধ করতে যাচ্ছিল–কি ভেবে যেন করল না।
মিস্টার আগস্ট ঘরে ঢুকলো। সাবেরের কপালে হাত রাখতেই সে চোখ মেলে বলল, আমি জেগে ছিলাম।
তাই না-কি?
জ্বি। জীবাণুদের সঙ্গে কথা বলছিলাম।
কি কথা?
ওদের একটা কবিতা শুনালাম–আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কি জানেন, ওরা কবিতা পছন্দ করে। তবে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে হয়। যেমন দরজা–দরজা ব্যাপারটা কি ওরা জানে না–মজার কথা না!
মজার কথা তো বটেই।
আপনাকেও কবিতাটা শোনাই।
আমাকে শুনাবে কেন? আমি তো আর জীবাণু না।
সাবের হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই কবিতা শুরু করল–
দু’হাতে দরজা খুলতেই দেখি তুমি
যে ব্যথা বুকের মাঝে গোপনে পুষেছি
এতোকাল ধরে, সারক্ষণ সাথী ছিল
[তোমার বিকল্পরূপে–শুধু এই ব্যথা]
কি করে নামাই বলো, তোমাকে দেখেই।
চারচোখ অপলক শুধু মেলে রাখা
কারো কোন কথা নেই, অথচ কখন
অবাক চোখের ভাষা অতিদ্রুত গতি
কেড়ে নিল দুজনের প্রিয়-সম্ভাষণ
কেন যে এমন হলো, কেন যে এমন।
মিস্টার আগস্ট বলল, জীবাণুরা আপনার এই কবিতা পছন্দ করেছে?
জ্বি–ঐ যে বললাম, কয়েকটা জিনিস বুঝিয়ে দিতে হয়ছে। যেমন চার চোখে চেয়ে থাকা মানে কি, দরজা মানে কি, দুহাত ব্যাপারটা কি? ওদের জগৎ আর আমাদের জগৎ তো ভিন্ন।
তাতো বটেই। ওরাও কি কবিতা লেখে?
জিজ্ঞেস করিনি।
একবার জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন।
জি আচ্ছা।
আরেকটা কথা–আপনার মৃত্যু মানে তো ওদেরও মৃত্যু। তা নিয়ে ওরা কি দুঃখিত না?
না। ওদের জীবনটা ক্ষণস্থায়ী। স্ফুলিঙ্গের মত। উড়ে যাবে, নিভে যাবে। ওরা এই ব্যাপারটায় অভ্যস্ত।
আপনার সঙ্গে তো ওদের এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছে–আপনার মৃত্যুতে তারা কি কষ্ট পাবে না?
জিজ্ঞেস করি নি।
দেখুন না–জিজ্ঞেস করে।
সাবের খানিক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল। এক সময় চোখ মেলে বলল, ওরা বলেছে ওরা অসম্ভব কষ্ট পাবে।
তাহলে ওদের আপনি বলুন না–আপনাকে মুক্তি দিতে। ওদের তো ক্ষণস্থায়ী জীবন। সেই জীবন তো ওরা ভোগ করল–আর কত।
বলব?
হ্যাঁ বলুন?
এটা বলতে লজ্জা করছে।
লজ্জার কিছু নেই, আপনি বলুন।
সাবের চোখ বন্ধ করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে বলল, ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে। ওরা চায় না আমার মৃত্যু হোক।
এখন তাহলে অষুধ খাবেন?
অষুধ খেতে হবে না। ওরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করবে। ওদের সে ক্ষমতা আছে। আচ্ছা আমি যেসব কথাবার্তা বলছি তা কি আপনি বিশ্বাস করছেন?
করছি। অবশ্যই করছি। ভাই, আমি তাহলে যাই?
কোথায় যাবেন?
জানি না।
আমার মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
হতেও পারে, কিছুই বলা যায় না। এই জগৎ বড়ই রহস্যময়–ভাই, আমি যাই। সূর্য ওঠার আগে আমাকে বিদেয় হতে হবে।
মিস্টার আগস্ট ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র সাবের তার মাকে ডেকে তুলল। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, এক কাপ চা খাওয়াতে পার, মা।
সুরমা ছেলের গায়ে হাত রাখলেন। জ্বর নেমে গেছে। সাবেরের মুখ হাসি-হাসি।
মা, কড়া করে চা বানাবে। নোন্ত বিকিট থাকলে চায়ের সঙ্গে নোন্তা বিসকিট দিও–প্রচণ্ড ক্ষিদে লেগেছে।
হরিপ্রসন্ন বাবু ঘুমিয়ে ছিলেন।
মিস্টার আগস্ট তাকে ডেকে তুলে বলল, আপনার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি–আমি কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হব। বেশ কয়েকদিন আপনার সঙ্গে একসঙ্গে কাটালাম। কথাবার্তা তেমন হয় নি। হলে ভাল লাগতো।
হরিপ্রসন্ন বাবু বললেন, রাতের বেলা কোথায় যাচ্ছেন?
আসতে হয় দিনে–যাবার জন্যে তো রাতই ভাল।
আপনার কথা বুঝলাম না।
কথার কথা বলেছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সরি, ঘুম থেকে ডেকে তুললাম।
না, না, অসুবিধা নাই।
আচ্ছা ভাল কথা–আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে?
হরিপ্রসন্ন বাবু চমকে উঠে বললেন, আমি! আমি কোথায় যাব? না, না, কি বলছেন আপনি?
আপনি রাজি থাকলে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম।
আরে না।
আচ্ছা, ভাই, তাহলে ঘুমান। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। চাদরটা গায়ে দিয়ে নিন।
মিস্টার আগস্ট দরজা ভেজিয়ে বারান্দায় এল।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে সে নেমে গেল নিঃশব্দে। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেত–দোতলার বারান্দা থেকে মতিন সাহেব তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।