০৮. সাইটীয় মিশর

৮. সাইটীয় মিশর

গ্রিকগণ

মিশরে দ্বিতীয়বারের মতো সেমিটিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিক্সসদের এক হাজার বছর পরে এসিরীয়দের দ্বারা। এসিরীয় আক্রমণ আরও অভ্যন্তরে থিবিস পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। তবে এটি তেমন প্রবল আক্রমণ ছিল না। যেসব মিশরীয় নুবীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপরায়ণ ছিল তাদেরকে ডেপুটি হিসাবে নিয়োগ করে এসিরীয়রা দেশ শাসন করেছিল। নিম্ন মিশরে তারা নেকো নামে এক মিশরীয় রাজপুত্রকে ডেপুটি নির্বাচন করেছিল। এই রাজপুত্রটি দীর্ঘদিন এসিরীয়দের হাতে বন্দী থেকে বুঝতে পেরেছিল তার প্রভুরা কোন চরিত্রের। তাই তিনি মিশরীয় রাজপ্রতিনিধি হিসাবে কাজ করতে রাজী হয়েছিলেন। এই কাজটি তিনি বেশ আনুগত্যের সাথে নির্বাহ করেছিলেন। অবশেষে আসুরবানিপালের পক্ষ নিয়ে নুবীয়দের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান। তদীয়পুত্র সামটিক, যাকে গ্রিকরা বলত সামেটিকোস, তিনি উত্তরাধিকার লাভ করেন।

তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন এসিরীয়দের কবলমুক্ত হওয়া যায়। কারণ তাদের গৌরবের দিনগুলি ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছিল। আসুরবানিপাল বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। বেবিলনীয়ায় অবিরাম বিদ্রোহ ঘটছিল। বেবিলনীয়ার পূর্বে অবস্থিত এলাম নামে একটি স্বাধীন জাতি এসিরীয়ার বিরুদ্ধে নাছোড়বান্দা হয়ে যুদ্ধ করছিল। কৃষ্ণসাগরের উত্তর থেকে সিমেরীয় নামে একটি যাযাবর জাতি স্রোতের মতো এশিয়া মাইনরের দিকে ধেয়ে আসছিল এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো দেশটিকে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছিল। আসুরবানিপাল সক্ষমতার সাথে বিষয়টির মোকাবেলা করছিলেন। দুইটি অভিযানে তিনি তাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন এবং বিশ শতাব্দীর পুরনো একটি রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেন, যার কোনো নিশানা আজ আর টিকে নাই।

সামটিক খুব সর্তকতার সাথে এই বিজয়ীর থেকে দূরে সরে রইলেন। তিনি ভূমধ্যসাগরের ওপারে এশিয়া মাইনরের একটি রাজ্য লিডিয়া থেকে ভাড়াটিয়া সৈন্য সংগ্রহ করেন। মিশরের মতো লিডিয়াও ছিল এসিরীয় সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে এবং সে-ও স্বাধীনতা লাভের জন্য উদ্গ্রীব ছিল।

লিডীয় ভাড়াটিয়া সৈন্যরা সামটিকের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছিল এবং ৬৫২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ থিবিসের পতনের মাত্র নয় বছর পর মিশর থেকে এসিরীয় সৈন্যবাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। এসিরীয় অধ্যায় স্থায়ী হয় মাত্র বিশ বছর। মোটের উপর মিশর সব সময় বহিঃশত্রুর বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় এবং সামটিক, প্রথম সামটিক উপাধি ধারণ করে শাসনভার গ্রহণ করেন। এবার মিশর সত্যিকারের একজন স্বদেশীয়কে ফারাও হিসাবে পেল।

মানেথোর মতে সামটিক ষড়বিংশ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। সমুদ্র থেকে ত্রিশ মাইল দূরে নীল নদের পশ্চিমের এক শাখানদীর পাশে সাইস নামে এক স্থানে তিনি তার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে এই বংশকে বলা হয় সাইটিক রাজবংশ এবং এই যুগের মিশরকে বলা হয় “সাইটিক” মিশর।

সামটিক ছিলেন একজন সুযোগ্য শাসক। তার অধীনে মিশর যে শুধু অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করেছিল তাই নয়, তিনি শিল্পেরও পুনর্জীবন ঘটিয়েছিলেন। সুচিন্তি তভাবে অতীতের দিকে ফিরে যাওয়া হয়, যেন মিশর তার গা থেকে সব ধূলি ময়লা ঝেড়ে ফেলতে চায়। তারা সেই সোনালি যুগে ফিরে যেতে চায়, যে যুগে শুধু মিশর সভ্যতাই বর্তমান ছিল এবং অবশিষ্ট পৃথিবীকে অবহেলার চোখে দেখা হতো।

পিরামিড নির্মাণের সময়কে উচ্চ প্রশংসা করা হয়েছিল এবং প্রাচীনকালের সমাধিতে যে সব মন্ত্রতন্ত্র ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা লিপিবদ্ধ ছিল সেগুলি আবার পাঠ করা শুরু হল। মধ্য রাজবংশের ধ্রুপদী সাহিত্য পুনর্জীবিত হল। এসিরীয়দের দ্বারা থিবিসের যে ক্ষতিসাধন হয়েছিল, তা মেরামত করা হয়। এসব কাজে সাইটিক বংশ নুবীয় ফারাওদের পথ অনুসরণ করেছিল। তবে সমসাময়িক পৃথিবীকেও অবহেলা করা সম্ভব হয়নি। যদি সামটিককে মিশর সুরক্ষিত রাখতে হয় তাহলে বর্তমানের কিছু রীতিনীতিকেও মান্য করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক অনুষঙ্গ ছিল গ্রিক ধারার। গ্রিকদের অন্ধকার যুগ অতিক্রম করতে হয়েছিল ট্রয়ের যুদ্ধের পরে এবং তারপর তারা এক গৌরবের যুগে প্রবেশ করে। তারা ক্ষমতা ও সংস্কৃতিতে ক্রমবর্ধমান শক্তি সঞ্চার করে। তারা উত্তরাধিকার লাভ করেছিল পূর্বসূরি মাইসেনীয় ও ক্রিটীয়দের থেকে। মিশরীয়রা যাকে অত্যন্ত মূল্যবান হিসাবে গ্রহণ করেছিল।

আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম এবং নিজেদের মধ্যে বিরোধ গ্রিকদের অনেক অতুলনীয় সামরিক কৌশল শিখিয়েছিল। তখন এবং পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী তারা সর্বশ্রেষ্ঠ ভাড়াটিয়া সৈন্য হিসাবে গ্রীসের বাইরের সেনাবাহিনীকে সেবা প্রদান করেছিল। গ্রিকরা পদাতিক বাহিনীর জন্য বিশেষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করেছিল যা মিশরীয় এবং এশীয় বাহিনীর তুলনায় চলমান ট্যাংকের মতো মনে হতো।

দ্বিতীয়ত গ্রিকরা ছিল সমুদ্রচারী। তাদের সমুদ্রগামিতা শুধু ফিনিসীয় ছাড়া আর সবাইকে অতিক্রম করেছিল। গ্রীসের অন্ধকার যুগে গ্রিকরা ঈজিয়ান সমুদ্রের মধ্য দিয়ে এশিয়া মাইনরে যেত। তারপর খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে যখন মিশরে অবক্ষয় চলছে তখন গ্রিক নাবিকরা কৃষ্ণসাগর দিয়ে সিসিলি এবং ইতালিতে যাতায়াত করত।

সামটিক এ সব কিছুই জানতেন এবং তিনি তার সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন। তিনি ইখনাতনের মতো জানতেন কী করা সম্ভব আর কী করা সম্ভব নয়। তিনি তার সেনাবাহিনীতে গ্রিক ভাড়াটিয়াদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং ব-দ্বীপের পূর্বভাগে তাদের জন্য একটি শক্তিশালী সেনানিবাস স্থাপন করেছিলেন যাতে করে পূর্বদিক থেকে আগত যে কোনো অভিযান প্রতিরোধ করা যায়। তবে এটি ছিল একটি সাময়িক ব্যবস্থা। গ্রিক প্রতিভাকে কেন যুদ্ধ ও শান্তি উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না? মিশরীয়রাও গ্রিকদের মতো বাণিজ্যে অভ্যস্ত ছিল, তবে তাদের কোনো সমুদ্রগামি জাহাজ ছিল না। ৬৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সামটিক গ্রিকদের উৎসাহ দেন মিশরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার (সন্দেহ নাই এতে করে মিশরীয়দের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল, যারা সব সময়ই বিদেশিদের সন্দেহের চোখে দেখত)।

সাইসের মাত্র দশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্রিকদের একটি সামুদ্রিক বাণিজ্য ঘাটি গড়ে উঠেছিল। তারা সেখানে নক্রেটিস (সমুদ্রের শাসক) নামে একটি সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ৬৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ গ্রিকরা লিবীয় উপকূলে একটি কলোনী গড়ে তোলে। মিশরীয় প্রভাবের বাইরে সাইসের প্রায় পাঁচশত মাইল পশ্চিমে গ্রিকরা সাইরেনি নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করে যা একটি উন্নত গ্রিক ভাষাভাষী অঞ্চল রূপে বহু শতাব্দীব্যাপী টিকে ছিল। চুয়ান্ন বছর রাজত্ব করার পর ৬১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরেনির মৃত্যু হয়। ছয় শতাব্দী পূর্বে দ্বিতীয় রামেসেসের পর এটাই মিশরে দীর্ঘতম ও সফলতম একক ব্যক্তির রাজত্ব। সামটিকের জীবৎকালে তিনি এসিরীয়ার সম্পূর্ণ ধ্বংস সাধন দেখে যেতে পেরেছিলেন। তবে তার রাজত্বের শেষ দিকে এক অন্ধকার কালো মেঘ নেমে এসেছিল।

.

ক্যালদীয়গণ

আসুরবানিপাল, যিনি স্বল্পকালের জন্য মিশরে আধিপত্য করতে পেরেছিলেন, ৬২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যু হয় এবং একশত পঁচিশ বছরে প্রথমবারের মতো এসিরীয়ায় একজন শক্তিশালী রাজার অভাব হল। বেবিলনীয়া তখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি আর এসিরীয়ার দুর্বলতাকে তারা কাজে লাগায়। নগরটি এবং তৎসংলগ্ন এলাকা ছিল একটি সেমিটিক গোত্র ক্যালদীয়দের অধীনে যারা এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আসুরবানিপালের শেষ বছরগুলিতে ক্যালদীয় রাজা নাবোপোলেসার এসিরীয় রাজ-প্রতিনিধি হিসাবে বেবিলনীয়া শাসন করত। এসিরীয় শক্তি যখন অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন সামটিকের মতো তিনিও আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এ জন্য তিনি বিদেশি মিত্রদের সহায়তা কামনা করেন।

নাবোলেসার মেডীয়দের কাছ থেকে এ সহায়তা পেলেন। মেডীয় জাতির লোকেরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলত। যারা ৮৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এসিরীয়ার পূর্বাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। এসিরীয়া যখন ক্ষমতার শীর্ষে মেডীয়া তখন করদ রাজ্যরূপে রয়ে গিয়েছিল।

তবে আসুরবানিপালের মৃত্যুর সময় সাইয়াক্সারেস নামে একজন মেডীয় দলপতি কিছু উপজাতীয় লোকজনকে তার অধীনে সংঘবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সাইয়াম্লারেস নাবোপোলেসারের সাথে মিত্রতা বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

এসিরীয়া পূর্ব দিকে মেডীস এবং দক্ষিণ দিকে বেবিলনীয়া কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল। প্রতিক্রিয়া হিসাবে এসিরীয় বাহিনী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে বিগত দুই শতাব্দী ধরে তাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয়েছিল। তারা বিধ্বস্ত হয়ে দেশের অভ্যন্ত রভাগে আবদ্ধ হয়ে পড়ল।

৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এসিরীয় রাজধানী নিনেভ দখল হয়ে যায় এবং এর অধিবাসীদের কণ্ঠে উল্লাসধ্বনি শোনা যায়, যারা দীর্ঘদিন এসিরীয় দুঃশাসনে নিষ্পেষিত হয়ে আসছিল (বাইবেলে উল্লিখিত জুডীয় নবী নাহুম-এর কণ্ঠেও এই উল্লাসের প্রতিধ্বনি শোনা যায়)।

এই চূড়ান্ত ঘটনার দুই বছর পর প্রথম নেকো তার পিতার উত্তরাধিকারী হিসাবে মিশরের সিংহাসনে আরোহণ করেন। নেকো দেখতে পেলেন তার সামনে পরিস্থিতি অন্ধকারাচ্ছন্ন। দুর্বল এসিরীয়া মিশরের জন্য সুবিধাজনক। সেখানে যদি নতুন কোনো শক্তিশালী সাম্রাজ্য-পিপাসু শক্তির আবির্ভাব হয় তাহলে সেটা মিশরের দুর্ভাগ্য।

তবে নেকোর মনে হয়েছিল সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। এমনকি নিনেভের পতনের পরও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এসিরীয় সৈন্য যুদ্ধ করে চলেছিল। একজন এসিরীয় সেনাপতি নিনেভের দুইশত পঁচিশ মাইল পশ্চিমে হারানে ফিরে এলেন এবং সেখানে বেশ কয়েক বছর ক্ষমতা ধরে রাখলেন।

নেকো স্থির করলেন এ ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার। মহান তৃতীয় থুতমসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল ধরে তিনি এগিয়ে যেতে পারেন। তার মনে হয়েছিল এটাই সর্বোত্তম পলিসি। যদি তিনি হারান উদ্ধার না-ও করতে পারেন তাহলেও তিনি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল সুরক্ষিত রাখতে পারবেন এবং ক্যালদীয়দেরকে মিশর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন।

নেকোর যাত্রাপথ ছিল সংকীর্ণ রাষ্ট্র জুড়ার মধ্যদিয়ে। ডেভিডের ক্ষণস্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চারশ বছর পার হয়ে গেছে। তার অবশেষ জুডা তখনও বর্তমান এবং তার এক বংশধর যশিয়া তখনও সেখানকার শাসক। উত্তরের রাজ্য ইসরায়েলের পতনের পরও জুডা টিকে ছিল এবং তারা সেনাকেরিবের সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছিল।

এবার তারা নেকোর সম্মুখীন হল। যশিয়া নেকোকে নির্বিরোধে জুডার উপর দিয়ে যেতে দিতে পারেন না। সে সময় যদি নেকো জয়ী হতেন তাহলে তিনি জুডার উপর কর্তৃত্ব করতেন আর যদি পরাজিত হতেন তাহলে ক্যালদীয়রা প্রতিশোধ নিতে দক্ষিণ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কাজেই যশিয়া তার ক্ষুদ্র সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

নেকো জুডাকে নিয়ে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছুক ছিলেন না, তবে তার গত্যন্তরও ছিল না। ৬০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নেকো মেগিরে যুদ্ধে যশিয়ার সম্মুখীন হলেন। পনেরো শতাব্দী পূর্বে তৃতীয় থুতমস এখানেই কেনানীয়দের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। এবারও মিশরের জয় হল এবং জুডার রাজাকে হত্যা করা হল। ছয় শতাব্দী পরে সিরিয়া আবার মিশরীয় কর্তৃত্বে এসে গেল।

তবে ক্যালদীয়রাও এগিয়ে আসছিল। ইতিমধ্যে তারা ইউফ্রেতিস টাইগ্রিসের সমগ্র এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। নেবুলোলেসার বৃদ্ধ ও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তবে তার সুযোগ্য পুত্র নেবুচাদ্ৰেজার ক্যালদীয় সেনাবাহিনীকে পশ্চিম দিকে পরিচালিত করেন। যশিয়া নেকো কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন কিন্তু তিনি মিশরীয় সৈন্যকে ততদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন যতদিন না নেবুচাদ্রেজার রাহান অবরোধ করতে পারেন। ৬০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নেবুচাদ্রেজার শহরটি দখল করে নেন এবং এসিরীয় শক্তির শেষ চিহ্ন মুছে ফেলেন। এসিরীয়া ইতিহাস থেকে মুছে গেল।

এবার ক্যালদীয় ও মিশরীয়রা পরস্পরের মুখোমুখি হলো ইউফ্রেটিসের তীরে কার্কেমিশ নামক স্থানে, যেখানে প্রথম থুতমসের নেতৃত্বে মিশরীয় সেনাবাহিনী প্রথমবারের মতো উপস্থিত হয়েছিল। ফলত এই স্থানটিতে যদি কোনো যাদুকরী শক্তি থেকে থাকে তা মিশরের অনুকূলে ছিল না। নেকো জুডার ক্ষুদ্র বাহিনীকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন ঠিকই তবে নেবুচাদ্রেজারের বিশাল বাহিনী অন্যরকম ছিল। মিশরীয়রা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল আর নেকো যে গতিতে এশিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন তার চেয়ে দ্রুতগতিতে এশিয়া থেকে পলায়ন করেছিলেন। তিন বছরের মধ্যেই মিশরের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল এবং তারপর তিনি আর এ চেষ্টা করেননি।

প্রকৃতপক্ষে এ সময় যদি নেবুলোলেসারের মৃত্যু না হতো এবং নেবুচাদ্রেজারকে তার উত্তরাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বেবিলনে ফিরে না যেতে হতো, তাহলে হয়তো তিনি মিশর আক্রমণ করে বসতেন।

ভাগ্যবলে মিশর এবার বেঁচে যায়। মিশর তার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সুদৃঢ় করতে মনোনিবেশ করে। নেকো জলপথ উন্নত করতে আত্মনিয়োগ করেন। মিশর নদীমাতৃক দেশ এবং তার রয়েছে হাজার হাজার খাল তবে তার দুই পাশে দুই সমুদ্র, ভূমধ্যসাগর ও লোহিতসাগর। দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সমুদ্রের উপকূল ধরে খুব সতর্কতার সাথে মিশরীয় জাহাজ চলাচল করত ফিনিসিয়া এবং পান্টের দিকে। মিশরীয় ম্রাটদের প্রায়ই মনে হতো যে, নীল নদ থেকে একটি খাল খুঁড়ে যদি লোহিতসাগরের সাথে সংযুক্ত করা যায় তাহলে বাণিজ্যিকভাবে অনেক লাভবান হওয়া যাবে।

মিশরীয় ইতিহাসের উষালগ্ন থেকে নীল নদ ও লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগকারী ক্যানাল পরবর্তী যে কোনো সময়ের চাইতে অধিকতর জল ধারণ করত এবং সিনাই সীমান্তে কিছু হ্রদ অবস্থিত ছিল যেটি এখন আর নেই। সম্ভবত একটি খালের মাধ্যমে এই হ্রদের পানি ব্যবহার করা হতো। যে খালটি প্রাচীন ও মধ্য সম্রাজ্যের আমলে বর্তমান ছিল, তবে সর্বদাই এটির যত্ন নিতে হতো। ক্রমবর্ধমানভাবে জলবায়ু অধিকতর শুষ্ক হওয়ার কারণে এটির পুনরুদ্ধার করা কষ্টসাধ্য ছিল।

দ্বিতীয় রামেসেস এটি পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। সম্ভবত এ কারণে যে নিজের মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই তার অধিক শক্তি ব্যয় হয়ে যায়। নেকোও এই চেষ্টা করেছিলেন, তিনিও ব্যর্থ হন। হয়তো এ কারণে যে এশিয়া অভিযানে তাকে অনেক শক্তি ক্ষয় করতে হয়।

দৃশ্যত তার অন্য একটি অভিপ্রায় ছিল। যদি ভূমধ্যসাগর এবং লোহিতসাগরকে একটি কৃত্রিম জলপথ দ্বারা সংযুক্ত করা না যায় তাহলে সম্ভবত প্রাকৃতিক জল পথেই সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব। হেরোডোটাসের ধারণা নেকো সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন যদি কেউ ভূমধ্যসাগর থেকে আফ্রিকা পরিক্রমা করে লোহিতসাগরে পৌঁছাতে পারে। এই উদ্দেশ্যে তিনি ফিনিসীয় নাবিকদের সাহায্য নিয়েছিলেন (এ সময় নৌবিদ্যায় তারাই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ)। এ ব্যাপারে তারা সাফল্য লাভ করেছিল এবং এই সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন করতে তাদের তিন বছর সময় লাগে। অবশ্য হেরোডোটাসের বিবরণ কতটা সত্য তা বলা যাবে না।

অবশ্য হেরোডোটাস নিজেই উল্লেখ করেছেন তিনি এটা বিশ্বাস করেননি। তার সন্দেহের মূল কারণ মনে করা হয় ফিনিসীয় নাবিকগণ যখন দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বদক্ষিণ বিন্দু অতিক্রম করছিল তখন মধ্যাহ্ন সূর্যকে তারা খমধ্যরেখার উত্তরে দেখেছিলেন। হেরোডোটাসের মতে এটা অসম্ভব কারণ সে কালে পরিচিত সমস্ত পৃথিবীতেই মধ্যাহ্নকালে সূর্যকে খমধ্যরেখার দক্ষিণে দেখার কথা।

পৃথিবীর আকৃতি সম্বন্ধে হেরোডোটাসের ধারণা ভ্রান্ত ছিল। নিশ্চিতভাবে বলা যায় উত্তরের নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে মধ্যাহ্ন সূর্য সর্বদাই খমধ্যরেখার দক্ষিণে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকার দক্ষিণপ্রান্ত দক্ষিণ নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত। কাজেই ফিনিসীয় নাবিকগণ মধ্যাহ্ন সূর্যকে খমধ্যরেখার উত্তরে দেখবে এবং তারা যে আফ্রিকা প্রদক্ষিণ করেছিল সেটা সত্য বলেই মনে হয়।

তৎসত্ত্বেও আফ্রিকা প্রদক্ষিণ সফল হয়ে থাকলেও সেটা ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযান। বাণিজ্য পথ হিসাবে এটির গুরুত্ব ছিল না কারণ এই যাত্রাপথটি ছিল অতি দীর্ঘ। বাস্তবিক পক্ষে এর দুই হাজার বছর পরেই সত্যিকারভাবে আফ্রিকা প্রদক্ষিণ সম্ভব হয়েছিল।

.

ইহুদিগণ

নেবুচাদ্রেজারের চল্লিশ বছরের শাসনকালে মিশর সব সময় আতঙ্কে ছিল। কার্কেমিশের পর মিশরীয়রা কখনোই আর তাকে ঘাটাতে সাহস করেনি। তৎপরিবর্তে নেকো এবং তার উত্তরাধিকারীরা নুবীয় ফারাওদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এসিরীয়ার দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। অর্থ ও মিষ্ট বাক্যের দ্বারা তারা সব সময় ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহে উস্কানি দিত যাতে ক্যালদীয়দের ভারসাম্য নষ্ট করা যায়।

এক শতাব্দী পূর্বে এই পলিসি মিশরীয়দের শান্তিতে থাকতে সাহায্য করেছিল। তবে সিরিয়া এবং ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। যে জুডা এসিরীয় সাম্রাজ্যের সময়ও টিকে ছিল, তারা উত্তরের প্রতিবেশীদের দুর্ভাগ্য থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি। শক্তিশালী ক্যালদীয়র পরিবর্তে দুর্বল মিশরকে বেছে নিয়ে এবং মিশরীয়দের কূটকৌশলে ক্যালদীয়দের জালে ফেঁসে গিয়েছিল।

৫৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুডা নেবুচাদ্রেজারকে কর দিতে অস্বীকার করে, যে কারণে যেরুজালেমকে অবরুদ্ধ করা হয় এবং এখানকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যার মধ্যে রাজাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তাদেরকে বেবিলনে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

প্রফেট জেরেমীয়ার সর্নিবন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও নতুন রাজার আমলে এই পুরাতন খেলাটি চালিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জেরেমীয়া অনুরোধ করেছিলেন মিশরের সঙ্গ ছেড়ে ক্যালদীয়দের আপোসরফায় আসতে। এক দশক পরে জুডা আবার বিদ্রোহ করে এবং এবার নেবুচাদ্রেজার যেরুজালেম দখল করে নেন এবং সেখানকার মন্দির ধ্বংস করে ফেলেন এবং প্রকৃতপক্ষে সকল অভিজাতকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এভাবেই জুডীয় রাজবংশের অবসান ঘটে সেই সাথে ডেভিডের বংশেরও।

এর পরেও নেবুচাদ্রেজার মিশর আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেননি। ফিনিসীয় নগরী টায়ার তখনও তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল এবং একটি শক্তিশালী শত্রুকে রেখে তিনি দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেননি।

ইহুদি নবী ইজেকিয়েল, যিনি তখন বেবিলনীয়ায় নির্বাসনে ছিলেন, তিনি আস্থার সঙ্গে ভবিষ্যৎবাণী করেন যে টায়ার ধ্বংস হয়ে যাবে এবং মিশর মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে (বাইবেলে এ সব কথা আছে)। তবে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়নি।

ফিনিসীয় উপকূলে টায়ার নগরীটি একটি পাহাড়ী দ্বীপে অবস্থিত। যেখানে জাহাজে করে খাদ্যসামগ্রী আনা হতো। আর সেমিটিক জাতিগোষ্ঠীর স্বভাব অনুযায়ী এখানকার জনগণ মরণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকত। তারা নেবুচাদ্রেজারকে তেরো বছর ঠেকিয়ে রেখেছিল। নেবুচাদ্রেজারও মরিয়া হয়ে শহরের উপকণ্ঠে অবস্থান নিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল সেমিটিক জাতির একগুয়েমি। তবে তিনি সফল হননি। শেষ পর্যন্ত একটি সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে বাধ্য হন এবং শর্ত থাকে যে, টায়ার তার ক্যালদীয় বিরোধী-নীতি থেকে সরে আসবে এবং স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করবে। নেবুচাদ্রেজারও যুদ্ধ করে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়েছিলেন।

নেবুচাদ্রেজারের রাজত্বের শেষার্ধ সম্বন্ধে আমরা খুব কমই জানতে পারি এবং তিনি মিশরে একটি খাপছাড়া ধরনের আক্রমণ চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মিশরের কৌশল তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে পেরেছিল, তবে সে জন্য যথেষ্ট মূল্যও দিতে হয়।

৫৯৫ খ্রিস্টাপূর্বাব্দে নেকোর মৃত্যুর পরও যেরুজালেমের অস্তিত্ব বজায় ছিল। তার পুত্র দ্বিতীয় সামটিক সিংহাসনে আরোহণ করেন। নেবুচাদ্রেজার জুডার সাথে জড়িয়ে পড়ায় সামটিকের সুবিধা হয়েছিল আর একদিকে দৃষ্টি দেওয়ার, দক্ষিণ দিকে। নাপ্টায় তখনও নুবীয় রাজার শাসন চলছে এবং তারা কখনো ভুলতে পারেনি যে তাদের পূর্বপুরুষরা এক সময় মিশর শাসন করত এবং সেখানে ফিরে যাওয়ার তাগিদ বোধ করে। তাছাড়া রয়েছে মিশরীয় অহঙ্কারের প্রশ্ন। তাদের পূর্বানুমানের জন্য নুৰীয়ানদের প্রাপ্য শাস্তি দেওয়া।

কাজেই দ্বিতীয় সামটিক দক্ষিণে নুবীয়ার দিকে একটি সৈন্যদল পাঠিয়ে দিলেন এবং তারা সাফল্যের সাথে নাপ্টায় গিয়ে পৌঁছাল। যদিও সেখানে তাদের থাকার ইচ্ছা ছিল না। মিশরে ষড়বিংশ রাজবংশ নতুন রাজত্বের মতো ছিল না। অভিযানটি যথেষ্ট ছিল, এবং নুবীয় রাজারা কিছুটা অপমানজনকভাবে শান্তির প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল।

এই অভিযানটির কথা আমাদের মনে থাকবে বিশেষ একটি মানবিক ঘটনার জন্য যা ঘটেছিল তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময়। এই অভিযানে মিশরীয় সৈন্যদলে বহুসংখ্যক গ্রিক ভাড়াটিয়া ছিল। ফিরতি পথে ভাড়াটিয়া সৈন্যরা আবু সিম্বেলের নিকটে তাবু খাটায়। সাড়ে ছয় শতাব্দী পূর্বে এখানেই দ্বিতীয় রামেসেস তার নিজের এবং সূর্যদেবতার মন্দির স্থাপন করেছিলেন, সেই সাথে ছিল চারটি উপবেশনরত মূর্তি।

গ্রিকদের এসব অতীত স্মৃতির প্রতি তেমন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না এবং কিছুসংখক সৈন্য গ্রিক লিপিতে স্তম্ভের গায়ে নিজেদের নাম খোদাই করে দেন। আধুনিক পুরাতাত্ত্বিকগণ এসব লিপিতে প্রাচীন গ্রিক বর্ণমালার সন্ধান পান। এতে আরও প্রমাণিত হয় অতীত এবং বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে একই ধরনের বালখিল্যতা রয়েছে। দ্বিতীয় সামটিককে সব সময় সতর্ক থাকতে হতো পাছে নুবীয়রা প্রতিশোধ মূলক কোনো আক্রমণ করে না বসে। পথে ছিল প্রথম প্রপাতের দুরূহতা, তবে এসব অসুবিধা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য ছিল না। ভাটির দিকে নীলনদের একটি দ্বীপে মিশরীয় সেনানিবাস বর্তমান ছিল। এটাই মিশরের সর্ব দক্ষিণের প্রতিরক্ষা লাইন।

এলিফ্যান্টাইন দ্বীপের এই সেনানিবাসটির অধিকাংশ সৈন্যই ছিল ইহুদি ভাড়াটিয়া। নেবুচাদ্রেজারের বিরুদ্ধে জুডার নিষ্ফল অভিযানে পরাজিত ইহুদিরা মিশরে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা ছিল প্রশিক্ষিত যোদ্ধা এবং তাদেরকে নিয়োজিত করতে পেরে সামটিক খুশি ছিলেন।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে এলিফ্যান্টাইন দ্বীপে কিছু দলিলপত্রের একটি ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়। এই সেনানিবাসটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দুই শতাব্দী ধরে ইহুদিদের জীবন পদ্ধতি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে যেসব ইহুদি বেবিলনে নির্বাসনে গিয়েছিল তারা বিভিন্ন পর্যায়ে জুডায় প্রত্যাবর্তন শুরু করে। ৫১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। এলিফ্যান্টাইনের ইহুদিরা এসব কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিল না। বেবিলনিয়ার ইহুদিদের দ্বারাই আধুনিক ইহুদিবাদের গোড়াপত্তন হয় এবং এই নতুন মন্দিরে এই ধারাটি শিকড় গাড়ে এবং গোড়া ইহুদিবাদের সূচনা করে। এই জীবনধারায় উদ্দীপ্ত হয়ে এলিফ্যান্টাইনের ইহুদিরা অস্বাভাবিক একটি ধর্মীয় পদ্ধতি শুরু করেছিল যা যেরুজালেম মন্দিরের পুরোহিতরা ঘোর বিরোধীতা করত।

৫৮৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় সামটিকের পুত্র আপ্রাইজ সিংহাসনে আরোহণ করেন (বাইবেলে তাকে উল্লেখ করা হয়েছে ফারাও হা নামে)। আপ্রাইজের রাজত্বকালে যেরুজালেমের পতন ঘটে এবং তাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। অনেক ইহুদি শরণার্থীকে এ সময় মিশরে স্বাগত জানানো হয়। এরাই ছিল পরবর্তী সাত শতাব্দী ধরে মিশরে ইহুদিগোষ্ঠী। তারা মিশরীয় জীবনযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আপ্রাইজের রাজত্বকালের প্রায় পুরো সময়টাতেই নেবুচাদ্রেজারের টায়ার অবরোধ বজায় ছিল। আপ্রাইজ টায়ারকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন তবে তা বিশেষ কাজে লাগেনি। তবে মিশর অন্যত্র তার দৃষ্টি দিতে পেরেছিল। টায়ারীয়দের সাহায্যেই ক্যালদীয় নেকড়েকে মিশর থেকে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল।

গ্রিক ভাড়াটিয়াদের ব্যাপারে আপ্রাইজ তার বংশের পূর্বসূরিদের নীতির অনুসরণ করেছিলেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মিশর একটি নৌবহর নির্মাণের প্রচেষ্টা করেছিল। আপ্রাইজ তার নৌবহরে অভিজ্ঞ গ্রিকদের নাবিক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন এবং তাদের সাহায্যে ব-দ্বীপের দুইশত পঞ্চশ মাইল উত্তরে সাইপ্রাস দ্বীপ দখল করে নেন। এটা শুধু মিথ্যা অহঙ্কার ছিল না। এই দ্বীপে একটি শক্তিশালী নৌবহর নেবুচাদ্রেজারের মিশরকে নিরাপদ রাখতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। ক্যালদীয়দের আক্রমণের আশঙ্কাও এর দ্বারা দূরীভূত হয়েছিল।

লিবীয় গোত্রের লোকজনকে তাড়িয়ে দিয়ে সাইরেনীতে প্রতিষ্ঠিত গ্রিক কলোনী সম্প্রসারিত হচ্ছিল আর সাইরেনীয়রা তাদের নিরাপত্তার জন্য ফারাওকে অনুরোধ করেছিল। সাইরেনী পশ্চিমে অবস্থিত গোত্রগুলিকে অস্থির ও প্রতিশোধপরায়ণ রাখতে চায়নি কারণ সে ক্ষেত্রে পূর্ব দিকে ক্যালদীয়দের সাথে সংগ্রামে হয়তো তারা মিশরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তাই তিনি সাইরেনীর বিরুদ্ধে একটি সেনাদল পাঠিয়েছিলেন।

এক্ষেত্রে তিনি একটি উভয়সংকটে পতিত হলেন। তার সেনাবাহিনীর মূল শক্তিই ছিল গ্রিক ভাড়াটিয়ারা। তাই গ্রিক নগরীর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধে পাঠানো বোকামি হতো। সাধারণত ভাড়াটিয়ারা অর্থের বিনিময়ে যে কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকত তবে অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। আপ্রাইজ ভয় করেছিলেন কোনো একটি বিশেষ মুহূর্তে হয়তো তার ভাড়াটিয়া সৈন্যদলের একটি অংশ হঠাৎ দলত্যাগ করে গ্রিকপক্ষে যোগ দিয়ে তার বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে পারে। তাই তিনি গ্রিকদের স্বদেশে রেখে দিয়ে শুধু মিশরীয় সৈন্যদেরকেই সাইরেনীতে প্রেরণ করলেন।

তবে মিশরীয় সৈন্যরা গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সন্ত্রস্ত ছিল। অনেক বছর ধরে নিঃসন্দেহে বিদেশিদের প্রতি মিশরীয়দের একটা আক্ষেপ ছিল। তাদের প্রধান ক্ষোভ স্বদেশীয় সৈন্যদের চাইতে গ্রিক ভাড়াটিয়াদের প্রতি অধিকতর সহানুভূতি দেখানো হতো। তারা অক্ষেপের সাথে লক্ষ করত সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের উচ্চপদ দেওয়া হতো, অধিকহারে বেতন দেওয়া হতো এবং সম্মান প্রদর্শন করা হতো (তবে এসব আপত্তিকারীরা মোটেই লক্ষ করত না গ্রিক ভাড়াটিয়ারা কতটা আন্তরিকতার সাথে যুদ্ধ করত)।

তাই মিশরীয় জাতীয়তাবাদী মুখপাত্ররা বক্তৃতা দিত যে, সাইরেনীর বিরুদ্ধে বেছে বেছে মিশরীয় সৈন্যদের পাঠানো হচ্ছে যাতে করে গ্রিকরা তাদের হত্যা করতে পারে এবং তখন সম্রাট শুধু গ্রিক সৈন্যদের নিয়েই তার সেনাবাহিনী গঠন করতে পারবেন।

সৈন্যরা বিদ্রোহ করল এবং আপ্রাইজ তাদের শান্ত করার জন্য তার একজন অফিসার স্বদেশী মিশরীয় আমহোসকে পাঠালেন যিনি সৈন্যদের নিকট জনপ্রিয় ছিলেন। তবে আমহোস সৈন্যদের নিকট অত্যন্ত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন এবং সৈন্যরা চিৎকার শুরু করে দিল যে তাকেই নতুন ফারাও হতে হবে।

আমহোস বিষয়টি ভেবে দেখলেন আর সিদ্ধান্ত নিলেন ফারাও হওয়াটা খারাপ কিছু না এবং তিনি বিদ্রোহীদের হাতে নিজেকে সমর্পণ করলেন। তারা মহা উৎসাহে ব-দ্বীপের দিকে যাত্রা শুরু করল এবং উৎসাহের আতিশয্যে একটি গ্রিক ভাড়াটিয়া সৈন্যদলকে পরাস্ত করল (এই ভাড়াটিয়া সৈন্যদলটি মিশরীয় সৈন্যদের চাইতে সংখ্যায় অনেক কম ছিল)।

ঘটনাচক্রে ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আপ্রাইজকে হত্যা করা হল। দ্বিতীয় আমহোস নিজেকে মিশরের ফারাও ঘোষণা করলেন। তিনি দ্বিতীয় সামটিকের এক কন্যাকে বিবাহ করলেন (এই কন্যাটি পদচ্যুত আপ্রাইজের সৎ বোন), এভাবেই তিনি তার সিংহাসন আরোহণকে বৈধতা দিলেন এবং মানেথো তাকে ষড়বিংশ রাজবংশের অন্ত ভুক্ত করেন। গ্রিক ভার্সনে তিনি আমেসিস নামে অধিক পরিচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *