০৮. সন্ধ্যা মিলাবার পর

সন্ধ্যা মিলাবার পর

সন্ধ্যা মিলাবার পরপর খানিকটা সময় হাসানের খুব অস্থিরতার মধ্যে কাটে। মনে হয় কিছুই করার নেই। ঘরে মন টেকে না, বাইরেও মন টেকে না। ব্যাপারটা কি শুধু তার একারই হয় না কমবেশি সবার হয়? এই প্রশ্ন মাঝে মাঝে তার মনে এলেও উত্তর জানার সে কোনো চেষ্টা করে নি। এ রকম এক সন্ধ্যায় মনের অস্থির ভােব কাটাবার জন্যে সে সুমিদের বাসায় উপস্থিত হলো। উপস্থিত হয়ে সে খানিকটা লজ্জায় পড়ে গেল। সুমি পড়ছে তার স্যারের কাছে। স্মার্ট ধরনের যুবক। চোখে চশমা। ঠোঁটের ওপর ঘন গোফ। মনে হচ্ছে সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক। এরা ছাত্রীর সঙ্গে গল্প করে সময় নষ্ট করে না। পড়া শেষ করে যাবার সময় একগাদা হোমওয়ার্ক দিয়ে যায়। সুমির মা হাসানকে ছাড়িয়ে দিয়ে নতুন এই টিচার রেখেছেন। হাসানের ওপর আস্থা রাখতে পারে নি। ভদ্রমহিলা যদিও তাকে বলেছিলেন মেয়েকে তিনি নিজেই পড়াবেন। হাসান। তাই বিশ্বাস করেছিল।

সুমি হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনি কিন্তু চলে যাবেন না। এক্ষুণি আমার পড়া শেষ হবে।

সুমির এই কথাতেও তার নতুন শিক্ষক ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছে। এটিও সিরিয়াস শিক্ষকের নমুনা। সিরিয়াস শিক্ষক পড়াশোনা ছাড়া যে-কোনো কথায় ভুরু কুঁচকবেন। তিন বছরের মাথায় তার কপালে পার্মানেন্ট ‘ভুরু-কুঁচকা’ দাগ পড়ে যাবে। হাতের রেখা দেখে ভবিষ্যৎ বলার মতো ভুরু-কুঁচকা দাগ দেখে বলে দেয়া যাবে ইনি একজন আদর্শ শিক্ষক।

হাসান চুপচাপ বসে আছে। ঘরের পরদা সরিয়ে সুমির মাও তাকে এক ঝলক দেখেছেন। তাকে দেখে খুশি হয়েছেন না বিরক্ত হয়েছেন হাসান তা বুঝতে পারে নি। তিনিও কি হাসানের মতো অস্বস্তিতে পড়েছেন? অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা অবশ্যি ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি। তারা যে-কোনো পরিস্থিতি অতি দ্রুত সামাল দিতে পারে। পরম শক্রকেও হাসিমুখে জিজ্ঞেস করতে পারে–তারপর ভাই কী খবর?

সুমির পড়া শেষ হয়েছে। তার টিচার এখন হোমওয়ার্ক দাগিয়ে দিচ্ছেন।

সুমি।

জ্বি স্যার।

আগামীকাল আমার আসতে আধঘণ্টা দেরি হবে।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

জ্বি আচ্ছা বললে হবে না, তোমার মাকে বলতে হবে, তিনি যেন আধঘণ্টা পরে গাড়ি পাঠান।

আমি বলব।

নতুন টিচার উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন হাসানের দিকে। সেই দৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ সন্দেহ— ‘এ আবার কে?’–টাইপ দৃষ্টি।

হাসান নতুন শিক্ষকের ভাগ্যে সামান্য ঈর্ষা অনুভব করল। ইনাকে গাড়ি দিয়ে আনা-নেয়া করা হয়। হাসানের বেলা কখনো তা করা হয় নি। একবার খুব বৃষ্টি হচ্ছিল–সুমি বলল, ‘মা স্যারকে গাড়ি দিয়ে আসুক’। সুমির মা বলেছিলেন, ড্রাইভার আজ সারাদিন গাড়ি চালিয়েছে। এখন রেস্ট নিচ্ছে। গাড়ি বের করতে বললে রাগ করবে। হাসান ড্রাইভারকে রাগ করতে দেয় নি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রওনা হয়েছিল।

সুমি পা দোলাতে দোলাতে বলল, স্যার আজ যে আপনি আসবেন তা কিন্তু আমি জানতাম।

হাসান একটু চমকাল। জগতের অনেক বিস্ময়কর রহস্যের মতো একটি রহস্য হলো আট বছরের বালিকা এবং একুশ বছরের তরুণীর কথার ভেতরও মিল আছে। তারা একই ভঙ্গিতে কথা বলে। সুমি সামনের খালি সোফায় বসেছে। পা নাচাচ্ছে। তিতলীও সুমির মতো পা নাচায়। এবং তিতলীও প্রায়ই বলে তুমি যে আজ আসবে তা কিন্তু আমি জানতাম।

আমি যে আজ আসব তুমি জানতে?

জ্বি।

কীভাবে জানতে? শালিক দেখেছিলে?

শালিক দেখি নি। শালিক দেখলে তো কেউ আসে না। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হয়েছে আপনি আসবেন।

হাসান সিরিয়াস শিক্ষকদের মতো ভুরু কুঁচকে ফেলল। মেয়েটি কি সত্যি কথা বলছে? না তাকে খুশি করার জন্যে বাক্য তৈরি করছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। যেদিন যেদিন বাবার চিঠি আসে। আমি আগে আগে বলে দেই। এই জন্যেই না বিশ্বাস করেছে।

তুমি কেমন আছ সুমি?

ভালো আছি। তোমার নতুন স্যার কেমন?

ভালো।

আমার চেয়ে ভালো?

হুঁ।

তোমার ধারণা আমি বেশি ভালো না?

আপনি তো ভালো পড়াতে পারতেন না।

ও আচ্ছা।

আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?

না রাগ করি নি। শোন সুমি আমি তোমার জন্যে একটা বই নিয়ে এসেছি।

ইংরেজি বই?

না, বাংলা। পথের পাঁচালী।

সত্যজিত রায়ের? না। সত্যজিত রায় তো ছবি বানিয়েছিলেন–এটা মূল বই বিভূতিভূষণের লেখা।

বাংলা গল্পের বই পড়তে আমার ভালো লাগে না।

হাসান বইটি বাড়িয়ে দিল। সুমি বইয়ের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাল না। সে পা দোলাচ্ছে এবং হাসানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে।

হাসছ কেন সুমি?

এমনি হাসছি।

তোমার পরীক্ষা কবে?

পরীক্ষা দেরি আছে। আপনি এত রোগা হয়ে গেছেন কেন স্যার?

রোগা হয়ে গেছি নাকি?

হুঁ। আপনার খুব জ্বর হয়েছিল তাই না?

জুর অবশ্যি হয়েছিল। তুমি জানলে কীভাবে?

সুমি জবাব দিল না। আগের মতো রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল এবং পা দোলাতে লাগল। ট্রেতে করে শিঙাড়া এবং চা নিয়ে সুমির মা ঢুকলেন। এটি একটি বিশেষ ভদ্রতা। অন্য সময় কাজের মেয়ে আসে।

হাসান সাহেব কেমন আছেন?

জ্বি ভালো।

আপনার ছাত্রী আজ সকালেই বলছিল। আপনি আসবেন।

হাসান চুপ করে রইল। সুমির মা বসতে বসতে বললেন, আপনার জন্যে আপনার ছাত্রী খুব ব্যস্ত থাকে। প্রতিদিন সে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার সঙ্গে আপনার গল্প করবে।

আমাকে নিয়ে গল্প করার মতো তেমন মালমসলা তো তার কাছে নেই।

গল্প করার জন্যে। ওর কোনো মালমসলা লাগে না। বানিয়ে বানিয়ে সে অনেক কিছু বলতে পারে। আপনার ছবিও সে এঁকেছে। সেগুলো কি দেখেছেন?

জ্বি না।

সুমি স্যারকে তোমার ছবি দেখাও।

না।

না কেন? ছবিগুলো তো সুন্দর হয়েছে। এনে দেখাও।

না।

সুমি পা দোলানো বন্ধ করে উঠে চলে গেল। তার জন্যে আনা বইটিও নিয়ে গেল না। ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে রইল অনাদরে। সুমির মা বললেন, আপনার ছাত্রী যে কীসে রাগ করে কীসে রাগ করে না তা বুঝা খুব মুশকিল। এখন রাগ করে উঠে গেল।

রাগ করল কেন?

একমাত্র সেই জানে কেন। হাসান সাহেব চা খান। আপনি এসেছেন আমি খুশি হয়েছি। সামনের মাসে সুমির বাবা আসবেন—তখন আপনাকে খবর দেব। আপনি এসে আমাদের সঙ্গে একবেলা ডালভাত খাবেন।

জ্বি আচ্ছা। আজ উঠি?

একটু বসুন সুমিকে ডেকে নিয়ে আসি। ওকে হ্যালো বলে যান। জানি না সে আসবে কি না।

সুমি এল না। তবে সুমির মা প্ৰথমবারের মতো আর একটা ভদ্রতা করলেন। ড্রাইভারকে বললেন–হাসানকে গাড়িতে পৌঁছে দিতে। ড্রাইভার বিরক্ত হলো–গাড়িতে চড়ার যোগ্য নয় মানুষকে গাড়িতে চড়তে দেবার ব্যাপারে ড্রাইভারদের খুব অনগ্ৰহ থাকে।

বাজছে মাত্র আটটা। এখন বাসায় ফিরে হবে কী? ছাত্র অবস্থায় বাসায় ফেরার একটা তাড়া থাকে। বই নিয়ে বসতে হবে। এখন সেই তাড়া নেই। এম.এ. পরীক্ষাটা দিয়ে দেখলে হয়। সাহসে কুলৈাচ্ছে না। তারপরেও মনে হয় দেয়া উচিত। তখন কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে তাকে বলা যাবে এম.এ. পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করছি। কী করেন? ‘আমি কিছু করি না’ বলা খুব কষ্টের।

ড্রাইভার বিরক্ত গলায় বলল, আপনে যাবেন কই?

হাসান বলল, কোথাও যাব না। তোমার যেখানে ইচ্ছা আমাকে নামিয়ে দিতে পার।

আপনার বাসা কোন দিকে?

বাসা অনেক দূর। এতদূর আমাকে নিয়ে যাবার মতো ধৈর্য তোমার নেই–কোনো এক জায়গায় নামিয়ে দাও।

ড্রাইভার রাস্তার পাশে গাড়ি থামাল। হাসান নেমে গেল। ড্রাইভারের সঙ্গে সামান্য রসিকতা করলে কেমন হয়? পকেট থেকে ছেড়া ন্যাতন্যাতে একটা এক টাকার নোট যদি ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলা হয়–এই নাও বকশিশ। ড্রাইভারের চোখমুখের ভাব কেমন হবে? যত ইন্টারেস্টিংই হোক চোখমুখের ভাব দেখাটা ঠিক হবে না। বেকারদের অনেক কিছু নিষিদ্ধ। সেই অনেক কিছুর একটা হচ্ছে রসিকতা। বেকারদের কিছু ধর্ম আছে। তাদের সেই ধর্ম পালন করতে হয়। হাসানের স্কুল জীবনের বন্ধু জহিরের মতে বেকার ধর্মের চারটি স্তম্ভ

(১) কচ্ছপ বৃত্তি।

সব সময় কচ্ছপের মতো নিজেকে খোলসের ভেতর লুকিয়ে রাখতে হবে। মাঝে মাঝে মাথা বের করে চারপাশ দেখে আবার টুক করে মাথা ঢুকিয়ে ফেলা।

(২) গণ্ডার বৃত্তি।

চামড়াটাকে গণ্ডারের চামড়ার মতো করে ফেলা। কোনো কিছুই যেন গায়ে না লাগে। গায়ে এসিড ঢেলে দিলেও ক্ষতি হবে না।

(৩) প্যাচা বৃত্তি।

কাজকর্ম সবই রাতে। গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে হবে রাত এগারটা থেকে বারটার দিকে যখন বেশিরভাগ মানুষ শুয়ে পড়ে।

(৪) কাক বৃত্তি।

কাকের মতো যেখানে যা পাওয়া যাবে তাই সোনামুখ করে খুঁটিয়ে খেয়ে ফেলা। কোনো অভিযোগ নেই।

বেকার ধর্মের চারটি স্তম্ভ যে মেনে চলে সে আদর্শ বেকার। তার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাও হবে না। হাসানের নিজের ধারণা সে একজন আদর্শ বেকার। আদর্শ বেকার রাত এগারটার আগে বাসায় ফেরে না। রাত এগারটা পর্যন্ত হাসানের করার কিছু নেই। জহিরের কাছে যাওয়া যায়। জহির থাকে। আগামসি লেনের এক মেসে; রাত বারটার আগে তাকে পাওয়া যাবে না। বারটা পর্যন্ত তার জন্যে অপেক্ষা করা যায়। অনেকদিন জহিরের সঙ্গে দেখা হয় না। জহিরের ‘প্রোজেক্ট বাংলা হোটেলে’ কিছু টাকা দিয়ে আসা যায়। গত কয়েক মাসে কোনো টাকা-পয়সা দেয়া হয় নি।

জহির নানান সময়ে নানান ধরনের স্বপ্ন দেখে। তার বর্তমান স্বপ্ন হলো–সাধারণ ডালভাতের হোটেল দেয়া। বিভূতিভূষণের আদর্শ হিন্দু হোটেলের মতো আদর্শ বাং হোটেল। সে হোটেলে আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, করলা ভাজি, ডালের চচ্চড়ি টাইপ খাবার ছাড়া কোনো খাবার পাওয়া যাবে না। নতুন ধরনের এই হোটেল দেখতে দেখতে জমে যাবে। বন্যার স্রোতের মতো হু-হু করে টাকা আসতে থাকবে।

বুঝলি হাসান ফালতু চাইনিজ খেতে খেতে আমাদের মুখ পচে গেছে। চাইনিজদের মতো নাকিও খানিকটা ডেবে গেছে। আগে বাঙালি জাতির যে খাড়া নাক ছিল এখন নেই। আমাদের নতুন ধরনের খাবার, নতুন ব্যবস্থা–লোকজন পাগলের মতো হয়ে যাবে। ভাত খাবার জন্যে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

নতুন ব্যবস্থাটা কী?

পাটি পেতে খাবার ব্যবস্থা। আয়েশি ব্যবস্থা। পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে খাবে।

প্যান্ট পরে তো পাটিতে বসতেই পারবে না।

যারা বসতে পারবে না তারা খাবে না। আমাদের হোটেল এমন হবে যারা আসবে তারা তৈরি হয়েই আসবে।

জহির আদর্শ বাংলা হোটেল ফান্ড খুলেছে। ফান্ড চালু হয়েছে এক বছরের মতো। প্ৰতি মাসেই রোজগারের একটা অংশ হাসানের সেই ফান্ডে দেবার কথা। গত তিন মাস কিছু দেয়া হয় নি। ফান্ডে দেবার মতো রোজগারই হয় না–দেবে কী? আজ কিছু টাকা আছে জহিরকে দিয়ে এলে সে খুশি হবে। হাতে টাকা বেশিদিন থাকবে না। দিতে হলে এখনই দিয়ে আসা দরকার।

জহিরকে পাওয়া না গেলে সে যাবে লিটনের খোজে। লিটন বেচারা খুব খারাপ অবস্থায় আছে। তাকে কিছু টাকা দিয়ে আসবে। সে নিতে চাইবে না। জোর করে দিতে হবে। তার চাকরি হচ্ছে না–ঠিক আছে। কিন্তু জহিরের মতো একটা ভালো ছেলের চাকরি হবে না। এটা খুব কষ্টের।

হাসান আগামসি লেনের দিকে রওনা হলো। জহিরের জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। হেঁটে হেঁটে যাওয়াই ভালো–সময় কাটবে। স্বাস্থ্যটাও ভালো থাকবে। বেকাররা ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। কারণ তাদের প্রচুর হাঁটতে হয়।

রাত বারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও জহিরের দেখা পাওয়া গেল না। ইদানীং নাকি জহিরের ফেরার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কয়েক দিন রাত তিনটায় ফিরেছে। এত রাত পর্যন্ত সে বাইরে কী করে তাও কেউ বলতে পারছে না। আর অপেক্ষা করার মানে হয়। না। এত রাতে লিটনের খোজে যাওয়াও অর্থহীন। হাসান রাত একটায় বাড়ি ফিরে এল।

রীনা দরজা খুলে কাদো কাদো গলায় বলল, তুমি কোথায় ছিলে?

রীনার পাশে লায়লা। সেও কাঁদছে। বেশ শব্দ করেই কাঁদছে।

হাসান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে ভাবি?

তোমার ভাই তো মরতে বসেছিল।

মরতে বসেছিল মানে কী?

রীনা কী হয়েছে বলার আগে বাচ্চা মেয়েদের মতো কেঁদে ফেলল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। হাসান হাত ধরে ভাবিকে চেয়ারে বসাল।

ঘটনা যা ঘটেছে তা ভয়াবহ তো বটেই।

ঘটনাটা এ রকম–তারেক অফিস থেকে ফিরে চা খেল। রীনা একবাটি মুড়ি ভেজে দিয়েছিল। সে মুড়ি খেল না। তার নাকি শরীরটা ভালো লাগছে না। রাত আটটার সময় হঠাৎ দেখা গেল তারেক শার্ট-প্যান্ট পরছে। রীনা অবাক হয়ে বলল, এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?

তারেক বিরক্ত গলায় বলল, এত রাত কোথায় দেখলে রাত মোটে আটটা বাজে।

যাচ্ছ কোথায়?

ফ্রিজ সারাইয়ের দোকানে যাব। ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। গ্যাস ভরে দেবে।

রাত আটটার সময় যাবার দরকার কী? দিনের বেলা যেও।

তারেক বিরক্ত গলায় বললেন, দিনের বেলা আমার অফিস থাকে। দিনের বেলা যাব কীভাবে?

তাহলে থাক তোমাকে যেতে হবে না। ফ্রিজের দোকানের ঠিকানাটা দিও। হাসান যাবে।

সবকিছু নিয়ে হাসানকে ডাকার আমি কোনো কারণ দেখি না। ওদের সঙ্গে কথা হয়ে আছে—সামান্য ব্যাপার।

তুমি বলছিলে শরীরটা ভালো লাগছে না।

এখন ভালো লাগছে। দেখি এক গ্ৰাস পানি দাও।

রীনা পানি এনে দিল। তারেক সেই পানিতে এক চুমুক মাত্র দিল। তারপর গভীর মুখে বের হয়ে গেল। রীনা খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগল, যদিও অস্বস্তির তেমন কোনো কারণ নেই। রীনা বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক শেষ করে তাদের খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।

বাসায় তার শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই নেই। শাশুড়ির রাগ এখনো ভাঙে নি। রীনার শ্বশুর। স্ত্রীর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা হিসেবে গত তিন দিন হলো মেয়ের বাড়িতে আছেন। রীনা লায়লার সঙ্গে গল্প করতে গেল। প্ৰায় এক ঘণ্টার মতো গল্প করল। লায়লার সঙ্গে গল্প করার জন্যে কোনো বিষয়বস্তু লাগে না। যে-কোনো বিষয়ে গল্প শুরু করলে লায়লা কীভাবে কীভাবে সেই গল্প সাজগোজের দিকে নিয়ে আসে। আজ গল্প হলো ইটালিয়ান স্যান্ডেল নিয়ে। ইটালিয়ান ঘাসের স্যান্ডেল লায়লার এক বান্ধবীর বাবা মেয়ের জন্যে নিয়ে এসেছেন। লায়লা সেই স্যান্ডেল পায়ে পরে দেখেছে। তার সমস্ত হৃদয় এখন স্যান্ডেলে। তার কথা শুনে মনে হতে পারে সে তার সমগ্ৰ পৃথিবী একজোড়া ঘাসের স্যান্ডেলের জন্যে দিয়ে দিতে পারে।

বুঝলে ভাবি স্যান্ডেল পায়ে দিয়েছি–মনে হচ্ছে স্যান্ডেল না, পায়ে খানিকটা মাখন মেখেছি। এত সফট আর কেমন ওম ওম ভাব।

ঢাকায় পাওয়া যায় না?

পাগল হয়েছ ভাবি–এইসব জিনিস ঢাকায় কোথায় পাবে!

গুলশানের দোকানে নাকি অনেক বিদেশী স্যান্ডেল পাওয়া যায়।

পাওয়া গেলেও সব সেকেন্ড গ্রেড জিনিস পাওয়া যায়। গরিব দেশে ভালো ভালো জিনিস। এনে লাভ কী? কে কিনবে? স্যান্ডেল জোড়ার দাম কত জান?

ইউএস ডলারে দুশ কুড়ি ডলার। ডিউটি-ফ্রি শপ থেকে কিনেছে বলে সস্তা পড়েছে। সাধারণ শপিং মল থেকে কিনলে–আড়াই শ ডলার মিনিমাম লাগত। আড়াই শ ডলার মুম্বাদশী টাকার দশ হাজার টাকা। দশ হাজার টাকা দামের স্যান্ডেল। চিন্তা করা যায় ভাবি?

চিন্তা করা যায় না। আমি যদি এই স্যান্ডেল পরি তাহলে আমার পায়ে ফোসকা পড়ে যাবে।

আমি একদিন স্যান্ডেলগুলো তোমাকে দেখাবার জন্যে নিয়ে আসব। তুমি পায়ে পরে কিছুক্ষণ হাঁটলে তোমার কাছেই মনে হবে–দশ হাজার টাকা কোনো দামই না।

লায়লা ভাত খেতে গেল এগারটার দিকে। তারেক তখনো আসে নি। লায়লা বলল, ভাইয়া কোথায় গেছে ভাবি?

ফ্রিজ সারাইয়ের দোকানে।

রাতদুপুরে ফ্রিজ সারাইয়ের দোকানে কেন?

কী জানি কেন? চলে আসবে।

আমার তো টেনশন লাগছে ভাবি। ঢাকা শহরের যে অবস্থা। আমার এক বান্ধবীর মামাকে হাইজ্যাকাররা পেটে ছুরি মেরেছে। নাড়ির্ভুড়ি বের হয়ে পড়েছিল। আমি উনাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম।

রানার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল।

ভাবি তুমি টেনশন করছ নাকি?

না।

তোমাকে দেখে মন হচ্ছে টেনশন করছি। প্লিজ টেনশন কোরো না। তোমাকে গল্পটা বলাই ঠিক হয় নি।

রাত এগারটার পর থেকে রীনা বারান্দায় হাঁটাহাটি করতে লাগল। বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়। বাসার সামনে রিকশা বা বেবিট্যাক্সি থামলে চোখে পড়ে। ফ্রিজের দোকানে তারেকের এত সময় লাগার কথা না। রাত ন’টার ভেতর দোকান বন্ধ হয়ে যাবার কথা। সে এত দেরি করছে কেন? সত্যি সত্যি হাইজ্যাকারদের হাতে পড়লে ভয়াবহ অবস্থা হবে। ছুরি মেরে ফেলে রাখলেও কেউ আগাবে না। মানুষের বিপদে এখন আর মানুষ এগিয়ে আসে না। এই যুগের নীতি হচ্ছে বিপদগ্ৰস্থ মানুষের কাছে থেকে দূরে চলে যাওয়া। যে যত দূরে যাবে সে তত ভালো থাকবে। টেনশনে রানার বুক ধকধক করা শুরু হলো। তার এই অসুখ ছোটবেলা থেকেই আছে। যত দিন যাচ্ছে অসুখ তাত বাড়ছে। আগে শুধু বুক ধকধক করত। এখন শুধু যে বুক ধকধক করে তাই না–প্ৰচণ্ড ব্যথাও হয়। নিঃশ্বাস আটকে আটকে আসে। খুব শিগগিরই ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তারের কাছে যেতেও ভয় লাগে। রীনা নিশ্চিত জানে–ডাক্তারের কাছে যাওয়ামাত্ৰই ডাক্তার ইসিজি ফিসিজি করিয়ে একগাদা খরচ করাবে। তারপর বলবে–আপনার হার্টের অসুখ আছে। একটা আর্টারি ব্লক। এনজিওগ্রাম করাতে হবে। তারচে’ বুকের ব্যথা সহ্য করা ভালো। এই ব্যথা বেশিক্ষণ থাকে না। টেনশন চলে যাওয়া মাত্র ব্যথাও চলে যায়।

ঠিক বারটার সময় বাসার সামনে এসে একটা বেবিট্যাক্সি থামল। হতভম্ব রীনা দেখল দুজন অপরিচিত ভদ্রলোক বেবিট্যাক্সি থেকে ধরাধরি করে তারেককে নামাচ্ছে। তারেক ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না, মনে হচ্ছে মাথা এলিয়ে পড়ে যাচ্ছে। সে কি মদ টদ খেয়ে এসেছে? গল্প-উপন্যাসে এ রকম বর্ণনাই তো থাকে। মাতাল স্বামীকে বন্ধুরা পৌঁছে দিতে আসে। দুদিক থেকে দুজন তাকে ধরে রাখে। রীনা দৌড়ে এসে দরজা খুলল। তারেক এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন রীনাকে চিনতে পারছে না। মোটাসোটা ধরনের অপরিচিত ভদ্রলোক বললেন–আপা উনি কি এখানে থাকেন?

রীনা হতভম্ব গলায় বলল, ওর কী হয়েছে?

আমরাও বুঝতে পারছি না। রাস্তার মাঝখানে চুপচাপ বসে ছিলেন। বিড়বিড় করে কী বলছিলেন। তারপর ঠিক মাঝরাস্তায় বসে পড়লেন।

আপনারা এইসব কী বলছেন!

চিন্তা করবেন না। আপা। শুরুতে উনি তার নাম, বাসার ঠিকানা কিছুই বলতে পারছিলেন না। শেষে বলেছেন। উনার কথামতোই আমরা এসেছি। একজন ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বললেন–কাউন্ড অব নাৰ্ভাস ব্ৰেক ডাউন। ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিয়েছেন। রাতে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে বলেছেন।

রীনা অস্পষ্ট গলায় কী একটা বলল। কী বলল সে নিজেও বুঝতে পারল না। তারেক স্পষ্ট গলায় বলল, রীনা বাচ্চারা কি স্কুল থেকে ফিরেছে?

এই হলো ঘটনা।

হাসান পুরো ঘটনা নিঃশব্দে শুনছে। রীনা ঘটনাটা খুব গুছিয়ে বললেও মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। রানা যতবার কেঁদে উঠছে, লায়লাও তার সঙ্গে কেঁদে

ভাইজান এখন কী করছে?

ঘুমাচ্ছে।

তুমি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছ?

হুঁ।

তোমার সঙ্গে ভাইজানের কোনো কথা হয় নি? তুমি জিজ্ঞেস কর নি ব্যাপার কী?

জিজ্ঞেস করেছিলাম–কিছু বলে না।

রাতে খাওয়াদাওয়া করেছে?

রুটি বানিয়ে দিয়েছিলাম। একটা রুটি খেয়েছে।

তার মানিব্যাগ কি আছে না খোয়া গেছে?

মানিব্যাগ আছে।

যে দুজন ভদ্রলোক নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন—তাদের ঠিকানা কি রেখেছ?

না, ঠিকানা জিজ্ঞেস করার কথা মনেও হয় নি। আমি তাদের থ্যাংকস পর্যন্ত দেই নি। মাথা তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। আমার এখন এত খারাপ লাগছে।

খারাপ লাগার কিছু নেই ভাবি। এই জাতীয় কাজ যারা করে–তারা থ্যাংক-এর আশা করে না।

তোমার কি ধারণা তোমার ভাইজানের মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

ভাইজানের কিছু হয় নি। মানুষের মাথা খুব শক্ত। চট করে খারাপ হয় না। মাথার কোনো সমস্যা হলে বাসার ঠিকানা বলতে পারত না। কাল সকালে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

যদি ঠিক না হয়?

অবশ্যই ঠিক হবে। ভাবি তুমি দয়া করে কাদা বন্ধ করা। ঘুমের ওষুধা তুমিও একটা খাও, খেয়ে ঘুমাতে যাও।

তারেক সারা রাত মরার মতো ঘুমাল। তার পাশে তার গায়ে হাত দিয়ে রীনা বসে রইল। একপলকের জন্যেও চোখ বন্ধ করল না।

সকালবেলা তারেক খুব স্বাভাবিকভাবে বিছানা থেকে নামল। রীনার চোখ তখন ধরে এসেছে। সে খাটে হেলান দিয়েছে, এই অবস্থাতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসল। চিন্তিত গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছে? তারেক বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় যাই মানে! বাথরুমে যাই–আবার কোথায় যাব?

তোমার শরীরটা কি এখন ভালো লাগছে?

শরীর খারাপ লাগবে কেন?

রাতের প্রসঙ্গ টেনে আনা ঠিক হবে কিনা, রীনা বুঝতে পারছে না। মনে হয় ঠিক হবে না। সে খাটে বসে রইল। তারেকের বাথরুমে ঢোকার শব্দ, কল খোলার শব্দ, দাঁতে ব্ৰাশ ঘষার শব্দ সবই শুনল কান খাড়া করে। শব্দগুলোর ভেতর কি কোনো অস্বাভাবিকতা আছে? ব্রাশ কি অন্যদিনের চেয়ে দ্রুত ঘঁষছে? কলটা বন্ধ করছে না কেন? পানি ছড়ছড় করে পড়েই যাচ্ছে। ব্রাশ ঘষার সময় কলটা বন্ধ করছে না কেন? কলের পানি পড়েই যাচ্ছে। স্বাভাবিক একজন মানুষ তো এই সময় কলটা বন্ধ করবে।

তারেক বাথরুম থেকে বের হয়ে বলল, রীনা চা দিতে বল তো। চা খাব।

এটাও তো অস্বাভাবিক। তারেকের কোনো অস্বাভাবিক চা-প্ৰীতি নেই। বাসিমুখে কখনো চা খেতে চায় না। আজ চাচ্ছে কেন? রীনা চিন্তিত মুখে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। টগর এবং পলাশ দুজনেরই ঘুম ভেঙেছে। কমলার মা তাদের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে কলঘরের দিকে। টগর বলল, মা আমি কিন্তু আজ স্কুলে যাব না। পলাশও সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিও যাব না।

অন্যদিন হলে রীনা কঠিন গলায় বলত, অবশ্যই স্কুলে যাবে। স্কুলে যাব না। এইকথা যেন না শুনি। আজ রানা বলল, আচ্ছা যেতে হবে না।

টগর, এবং পলাশ বিম্বিত হয়ে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা তাদের কাছে এতই অপ্রত্যাশিত যে আনন্দের বিকট চিৎকার দিতেও ভুলে গেছে।

আজ তাদের স্কুলে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে নিয়ে যাবার মানুষ নেই। হাসানকে পাঠানো যায়। রীনা তা করতে রাজি না। তারেককে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। সে একা যাবে না, হাসানকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। শ্বশুর-শাশুড়িকেও বাসায় নিয়ে আসতে হবে। মাথার ওপর মুরুকিব কেউ থাকলে ভরসা থাকে। যে-কোনো দুশ্চিন্তার ভাগ মুরুকিবরা নিয়ে দুশ্চিন্তা হালকা করে ফেলেন। কাল তাঁর শাশুড়ি বাসায় থাকলে তিনিও রীনার সঙ্গে সারা রাত জাগতেন।

তারেক চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, তোমার চোখমুখ এমন শুকনো কেনো, কী ব্যাপাৱ?

রীনা বলল, রাতে ঘুম হয় নি।

শোবার আগে আমার মতো গোসল করে শুবে তাহলে দেখবে ভালো ঘুম হবে।

রীনা ইতস্তত করে বলল, কাল রাতে তুমি ফ্রিজের দোকানে গিয়েছিলে?

তারেক বলল, ফ্রিজের দোকানে যাব কেন?

যাবে বলছিলে এই জন্যে জিজ্ঞেস করলাম। তা

রেক চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। রীনা বুঝতে পারছে না, কাল রাতের প্রসঙ্গটা নিয়ে আরো কথা বলাটা ঠিক হবে কিনা। মনে হয় ঠিক হবে না। রীনা বলল, এক কাজ কর, আজ তোমার অফিসে যাবার দরকার নেই।

তারেক বলল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না। শুধু শুধু অফিস কামাই করব কেন? খবরের কাগজ এসেছে কি না একটু দেখ তো। হকারটাকে বদলাতে হবে। ঠিক অঠিসে যাবার আগে আগে কাগজ এনে দেয়। অফিসে যেতে হয় কাগজ না পড়ে।

তারেক খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নাশতা খেল, অফিসের জন্য তৈরি হতে লাগল। রীনা বলল, হাসান তোমার সঙ্গে যাবে।

আমার সঙ্গে কোথায় যাবে?

মতিঝিলে ওর নাকি কী কাজ আছে। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে সে তার কাজে যাবে। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?

তারেক বিস্মিত হয়ে বলল, কী উদ্ভট কথা আমার আপত্তি থাকবে কেন?

মতিঝিলে হাসানের কোনো কাজ নেই। সে ঠিক করে রেখেছে কাজ না থাকলেও সে আজ মতিঝিলেই ঘোরাফেরা করবে। দুপুরে কোনো সস্তা হোটেলে কিছু খেয়ে নিয়ে বিকেলে ভাইকে নিয়ে একসঙ্গে ফিরবে। ভাবি বেশি রকম চিন্তিত। যদিও সে চিন্তার তেমন কিছু দেখছে না।

হাসান ভাইকে নামিয়ে দিয়ে ঘুরতে বের হলো। বিশাল কর্মকাণ্ডের মতিঝিলের সঙ্গে তার যোগ নেই। আশ্চর্য ব্যাপার। অঞ্চলটা কেমন গমগম করছে। কাজ ছাড়া হাঁটতেও ভালো লাগে। অপরিচিত এক ভদ্রলোক চোখ ইশারায় হাসানকে ডাকল। হাসান এগিয়ে গেল। ভদ্রলোক গলা নিচু করে বললেন, ডলার কিনবেন?

জ্বি না।

ডলার আছে? বিক্রি করবেন?

জ্বি না।

লোকটা উদাস হয়ে গেল। হাসান ভেবে পেল না। তার চেহারায় ডলারের কেনাবেচার কোনো ছাপ কি আছে? ছাপ না থাকলে শুধু শুধু তার সঙ্গে ডলার নিয়ে ভদ্রলোক কথা বলবেন কেন? এরা অভিজ্ঞ ধরনের মানুষ। চোখ দেখে অনেক কিছু বলে ফেলে। এদের তো ভুল করার কথা না।

এক জায়গায় টেবিল-চেয়ার পেতে ফরম বিক্রি হচ্ছে। লোকজন লাইন দিয়ে ফরম কিনছে। হাসান কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে গেল। আমেরিকা যাবার ইমিগ্রেশন ফরম। দুদিন পর পর আমেরিকানরা একটা তাল বের করে, বাংলাদেশের কিছু লোকজন তাতে মোটামুটি ভালো ব্যবসা করে। ফরম বিক্রি হচ্ছে কুড়ি টাকায়। পুরোপুরি ফিলাপ করলে পঞ্চাশ টাকা।

ফরম যে বিক্রি করছে তার চোখেমুখে খুব সিরিয়াস ভাব। যেন ফরম ফিলাপ করামাত্র আমেরিকান ভিসা সে দিয়ে দেবে। সমানে বেনসন সিগারেট টেনে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্যবসা তার ভালোই হচ্ছে।

হাসান লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম কিনল। সময় কাটানো দিয়ে হচ্ছে কথা। লম্বা লাইনে দাঁড়ানোয় কিছু সময় কেটে গেল। লাইনে দাঁড়ানো নিয়েও সমস্যা। একজন আগে ঢুকে পড়েছিল তাকে বের করে দেয়া হলো। সে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে শাসাচ্ছে। ভালো যন্ত্রণা।

আরেক জায়গায় বিক্রি হচ্ছে নিউজিল্যান্ড যাবার ফরম। এই ফরমের দামও বেশি। এদের পোজপাজও বেশি। ফরমের দাম দুশ টাকা। দাম বেশি বলেই কোনো লাইন নেই। বেকারদের পকেটে দুশ টাকা থাকে না। যে ফরম বিক্রি করছে তার পেছনে নিউজিল্যান্ডের ছবি। নীল পাহাড়, পাহাড় মনে হচ্ছে লেকের পানি ফুঁড়ে বের হয়ে এসেছে। পালতোলা নৌকায় তরুণ-তরুণী। তরুণী যে পোশাক পরে আছে তাতে তাকে, নগ্নই বলা যায়। যারা নিউজিল্যান্ডের ফরম কিনবে তারা অবশ্যই মেয়েটির কথা মনে রাখবে।

ভাই আপনি কি ফরম কিনবেন?

জ্বি না।

তাহলে শুধু শুধু ভিড় করবেন না।

ভিড় তো করছি না। আপনার এখানে তো লোকই নেই।

হাসান চলে এল। বিমান অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর ঢুকে গোল অফিসে। এখানেও প্রচণ্ড ভিড়। এই ভিড়ের জাত আলাদা। যারা ভিড় করে আছে তাদের চোখ অনেক উজ্জ্বল। সেই চোখে স্বপ্নের ছায়া।

দুপুরে হাসান এক ছাপড়া হোটেলে খেতে গেল। ছাপড়া হোটেল হলেও কায়দাকানুন আছে। মিনারেল ওয়াটারের বোতল আছে। যারা খাচ্ছে তারাও শার্ট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোক। হোটেলের মালিককে গিয়ে হাসান জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা ভাই সাহেব, বড় বড় হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার কি আছে? কাস্টমারদের না খাওয়া খাবার জমা করে পরে বিক্রি করে সেই জাতীয় কিছু?

হোটেলের মালিক চোখমুখ কুঁচকে বলল, দুই নম্বরী কোনো কিছু এইখানে পাবেন की।

কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারবেন? একটু খাওয়ার শখ ছিল।

জানি না। আমাদের সব টাটকা ব্যবস্থা। বাসির কারবার নাই। খেতে চাইলে হাত ধুয়ে আসেন।

 

চারটার পর হাসান তার ভাইয়ের অফিসে উপস্থিত হলো। সে ভেবেছিল তারেক তাকে দেখে খুব বিরক্ত হবে।

তারেক বিরক্ত হলো না, অবাকও হলো না। হাসানই বরং বিব্রত গলায় বলল, মতিঝিলের দিকে এসেছিলাম ভাইয়া, ভাবলাম দেখি তোমার ছুটি হয়েছে কি না। ছুটি হলে একসঙ্গে বাসায় ফিরব।

তারেক বলল, চল যাই। এখন বেবিট্যাক্সি-রিকশা কিছুই পাওয়া যাবে না। হাঁটতে হবে। আমার হাঁটতে ভালোই লাগে। এক্সারসাইজ হয়। ফোর্স সেভিংসের মতো–ফোর্স এক্সারসাইজ।

রাস্তায় নেমে তারেক নিচু গলায় বলল, তোকে একটা কথা বলি তোর ভাবি যেন না জানে। তোর ভাবি জানলে দুশ্চিন্তা করবে।

কথাটা কী?

মাঝে মাঝে আমার মেমোরি লিসের মতো হয়। খুবই অল্প সময়ের জন্যে হয়—কিন্তু হয়।

ব্যাপারটা বুঝলাম না।

এই যেমন ধর অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। হঠাৎ মনে হয় কিছু চিনতে পারছি না। আমি কোথায় যাচ্ছি—বাসা কোথায় কিছুই মনে করতে পারি না। খুব অল্প সময়ের জন্যে হয়–কিন্তু যখন হয় তখন খুব ভয় লাগে।

ভয় লাগারই তো কথা।

একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

চল। আজই চল।

আজ না–যাব একদিন। তোর ভাবিকে কিছু বলিস না–দুশ্চিন্তা করা হলো তার ess

তোমার মেমোরি লিসের ব্যাপারটা শেষ কবে হয়েছে ভাইয়া?

তারেক জবাব দিল না। দাঁড়িয়ে পড়ল। কেমন যেন উসখুসি করছে। চারদিকে তাকাচ্ছে। হাসান শঙ্কিত গলায় বলল, কী হয়েছে?

তারেক বলল, কিছু হয় নি। চা খাবি?

চা?

চল নিরিবিলিতে কোথাও বসে চা খাই।

অফিস ছুটির সময় নিরিবিলি কোথায় পাওয়া যাবে? চায়ের দোকানগুলোতে রাজ্যের ভিড়। এর মধ্যেই আকবরিয়া রেস্টুরেন্টের একটা কেবিন হাসান যোগাড় করল। শিক কাবাব তৈরি হচ্ছে, তার ধোঁয়ার সবটাই সরাসরি কেবিনে ঢুকে যাচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে।

চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে ভাইয়া? শিক কাবাব?

খাওয়া যায়।

শিক কাবাব চলে এসেছে। নোংরা একটা বাটিতে খানিকটা সালাদ। অন্য একটা বাটিতে হলুদ বর্ণের কী একটা তরল পদার্থ। সম্ভবত টক জাতীয় কিছু। তারেক বলল, তুই খাবি না?না। তুমি খাও।

তারেক আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। মনে হয় সে দুপুরে কিছু খায় নি।

চা দিতে বলেছিস?

বলেছি। কাবাব কি তোমাকে আরেকটা দিতে বলব?

বল।

আরেকটা কাবাবের অর্ডার দিয়ে হাসান বসে আছে। সে তার ভাইয়ের ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছে না।

হাসান।

বল।

আমি আসলে বিরাট একটা সমস্যায় পড়েছি। কাউকে বলতেও পারছি না।

সমস্যাটা কী? চাকরি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা?

না। চাকরি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা না। পারসোনাল।

বল আমাকে শুনি।

তোর কাছে সিগারেট আছে? দে তো একটা।

সিগারেট তো তুমি খাও না।

একদম যে খাই না তা না। মাঝেমধ্যে অফিসে এসে একটা-দুটা খুচরা কিনি।

তুমি বস আমি তোমাকে সিগারেট এনে দিচ্ছি। কী সিগারেট খাও।

বাংলা ফাইভ। আর শোন, যাচ্ছিস যখন তখন জর্দা দিয়ে একটা পানও নিয়ে আসিস।

হাসান সিগারেট-পান নিয়ে ফিরল। তারেক আনন্দিত গলায় বলল, এরা চা-টা খুব ভালো বানায়। মনে হয় আফিং টাফিং মেশায়–ভেরি গুড টেষ্ট। এরপর থেকে অফিস ফেরতের সময় এদের এখানে এক কাপ করে চা খেতে হবে।

আরেক কাপ চা দিতে বলব?

বল।

নাও ভাইয়া সিগারেট ধরাও। এই নাও ম্যাচ।

হাসান লক্ষ করল তার ভাইয়া সিগারেট ধরাতে পারছে না। তার হাত কাঁপছে।

ভাইয়া।

হুঁ।

তোমার সমস্যাটা কী বল শুনি।

তেমন কোনো সমস্যা না। আবার তুচ্ছ করাও ঠিক না।

আমি তুচ্ছ করছি না, তুমি বল।

বলছি দাঁড়া সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে নেই। পান এনেছিস?

এনেছি।

জর্দা দিয়ে এনেছিস তো?

হ্যাঁ জর্দা দিয়েই এনেছি।

এই রেস্টুরেন্টটা মনে হচ্ছে খুব চালু। কাস্টমারে একেবারে গমগম করছে। ভাগ্যিাস আমরা একটা ফাঁকা কেবিন পেয়েছিলাম।

ভাইয়া তোমার সমস্যার কথা বল।

আমাদের অফিসে একজন মহিলা কলিগ আছেন–নাম হচ্ছে গিয়ে লাবণী। বয়স অল্প-কুড়ি-একুশ হবে। গত বছর বি.এ. পাস করেছে পাসকোর্সে।

দেখতে কেমন?

আছে ভালোই। এভারেজ বাঙালি মেয়েরা যেমন থাকে।

আনিমেরিড?

বিয়ে হয়েছিল হাসবেন্ড মারা গেছে। বিয়ে হয়েছিল খুব অল্প বয়সে-ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। হাসবেন্ড মারা যায় বিয়ের দু বছরের মধ্যে। সে আরিচা থেকে ফিরছিল। রাস্তায় একটা কুকুর দাঁড়িয়েছিল। কুকুরকে সাইড দিতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্টটা হয়।

ও আচ্ছা।

লাবণীর একটা মেয়ে আছে। খুবই সুইট চেহারা। মেয়েটার নাম কেয়া। লাবণীর হাসবেন্ডই শখ করে নাম রেখেছিল। কেয়া এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। কলাবাগানে ওমেন ফেডারেশনের একটা স্কুলে। খুব ভালো ছাত্রী। প্রতি বছর ফার্স্ট হচ্ছে। গান জানে, নাচ জানে, টেলিভিশনে ‘নতুন কুঁড়ি’-তে গিয়েছিল। টিকতে পারে নি। ওইসব জায়গায় সবই তো ধরাধরির ব্যাপার। লাবণীর ধরাধরি করার কেউ নেই।

সমস্যার ব্যাপারটা বল।

না মানে হয়েছে কী, একদিন অফিসে কাজ করছি লাবণী এসে খুব লজ্জিত গলায় বলল, সে ক্যান্টিনে আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে চায়। আমি একটু অবাক হলাম, তবে এর মধ্যে দোষের কিছু দেখলাম না। চা খেতে গেলাম। সেইখানেই লাবণী বলল যে আমার চেহারা স্বভাব চরিত্র সব নাকি তার হাসবেন্ডের মতো।

তাই নাকি?

লাবণী তার হাসবেন্ডের একটা সাদাকালো ছবিও নিয়ে এসেছিল। মিল কিছুটা আছে। তবে সে যতটা বলছে ততটা না। তবে মেয়ে মানুষ তো বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু দেখে।

লাবণী কি তোমাকে প্রায়ই ক্যান্টিনে নিয়ে চা খাওয়াচ্ছে?

আরে না। ও সেই রকম মেয়েই না।

তোমার কামরায় প্রায়ই আসে?

এক অফিসে কাজ করছি। আসবে না? ধর আমি একটা চিঠি টাইপ করতে দিলাম–চিঠি নিয়ে তাকে তো আসতেই হবে।

সমস্যাটা কোথায়?

তারেক বলল, না সমস্যা আবার কী? সমস্যা কিছু না।

তুমি যে বললে তুমি একটা সমস্যায় পড়েছি।

লাবণীকে দেখে খারাপ লাগে–এই আর কী? দুঃখী মেয়ে। একে তো রূপবতী মেয়ে, তার ওপর অল্প বয়স, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিধবা টাইটেল। এই তিন সাইনবোর্ডের মেয়ে আমাদের দেশে টিকতে পারে না। লাবণী থাকে তার বড় বোনের সঙ্গে। বেশ ভালোই ছিল। ইদানীং সমস্যা হচ্ছে। বড় বোনের হাসবেন্ডের ভাবভঙ্গি সুবিধার মনে হচ্ছে না। গত সপ্তাহে ওই হারামজাদা রাত তিনটার সময় লাবণীর দরজায় টোকা দিয়েছে। লাবণী দরজা খুলে হতভম্ব। লাবণী বলল, দুলাভাই কী ব্যাপার? হারামজাদাটা বলে কী–মাথা ধরেছে, তোমার কাছে ঘুমের ট্যাবলেট আছে? লাবণী কি তার ঘরে ফার্মেসি দিয়েছে যে তার কাছে ঘুমের ট্যাবলেট খুঁজতে হবে?

এইসব গল্প কি লাবণী তোমার সঙ্গে করেছে?

হাঁ। দুঃখের কথা ঘনিষ্ঠ দু-এক জনের কাছে বললে মনটা হালকা হয়।

তুমি কি তার ঘনিষ্ঠজন?

তারেক জবাব দিল না। পান মুখে দিল। হাসান বলল, ভাইয়া তুমি কি প্রায়ই লাবণীদের বাসায় যাও?

তারেক বলল, আরে না। প্রায়ই যাব কী! মাঝেমধ্যে যাই। কেয়ার জন্মদিন হলো। জন্মদিনে গোলাম। সেও গতি সপ্তাহে। এই সপ্তাহে এখনো যাই নি।

হাসান বলল, ভাইয়া চল উঠি।

তারেক উঠে দাঁড়াল।

হাসান বলল, ভাইয়া একটা কথার জবাব দাও তো। তুমি কি লাবণী মেয়েটার প্রেমে পড়েছ?

তারেক জবাব দিল না। ভাইয়ের চোখের দিকে সরাসরি তাকালও না। তবে তার মুখে এক ধরনের শান্তি শান্তি ভাব দেখা গেল। যেন ভাইকে ব্যাপারটা বলতে পেরে সে শান্তি পেয়েছে।

 

তারেকের অফিসে যাবার পর থেকে রীনার মন উতলা হয়ে ছিল। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে সে অফিসে একবার টেলিফোনও করেছিল। তারেকের সঙ্গে কথা হয়েছে তাতেও রানার উতলা ভাব দূর হয় নি। দুপুরে সে তার শাশুড়িকে নিয়ে এল। রীনার শাশুড়ি এতদিন রাগ করে তার বড় মেয়ের বাসায় ছিলেন। কঠিন রাগ অনেক চেষ্টা করেও ভাঙানো যাচ্ছিল না। আজ তারেকের ঘটনা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছেন। তিনি বাসায় পা দেয়ামাত্র রানার মনে হয়েছে–আর ভয় নেই। দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

মনোয়ারা তসবি টিপতে টিপতে রীনার কাছে পুরো ঘটনা দু’বার শুনলেন। তারপর গাষ্ঠীর মুখে বললেন, বউমা কোনো চিন্তা করবে না। একটা মুরগি ছদকা দিয়ে দাও। আর শোেন–সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না। যা কাজকর্ম দিনে করবে। সন্ধ্যার পর সংসার দেখবে। চিরকালের নিয়ম। রীনা বলল, মা আপনি একটু বলে দেবেন।

মনোয়ারা বললেন, আমি তো বলবই। বিয়ের পর মার কথার ধার থাকে না। তার ওপর আমি হলাম পরগাছা মা। ছেলের রক্ত চুষে বেঁচে আছি। আমার কথার দাম কী। তুমি বলবে। শক্ত করে বলবে।

জ্বি আচ্ছা।

বিবাহিত ছেলে সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে থাকবে এটা কেমন কথা!

শাশুড়ির কথা রীনার এত ভালো লাগল। তার মনের সমস্ত চিন্তাভাবনা এক কথায় উড়ে গেল। বিকেলে আরো আনন্দের ব্যাপার হলো। রকিব একগাদা উপহার নিয়ে বাসায় উপস্থিত। পলাশ এবং টগরের জন্যে দুটা ফুটবল। তার জন্যে কালির কলম। লায়লার জন্যে ঘড়ি। রানার কাছ থেকে ধার করা টকাটাও ফেরত দিল। রীনা হতভম্ব গলায় বলল, তুমি এত টাকা পেলে কোথায়?

রকিব বলল, কিছুদিন ধরে একটা ফার্মের সঙ্গে থেকে একটা পার্টটাইম চাকরি করেছি। ওরা থোক কিছু টাকা দিয়েছে।

কত টাকা?

সেটা তোমাকে বলব না। ভাবি শোন আজ রাতে ভালোমন্দ কিছু রান্না কর তো। পোলাও-কোরমা-রোষ্ট। আমি বাজার করে নিয়ে আসছি।

সন্ধ্যা হয়েছে।

বাচ্চারা ফুটবল নিয়ে খেলছে। তাদের চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না। রকিব গিয়েছে বাজার করতে। তারেক ও হাসান দুজনই ফিরেছে। আশ্চর্য কাণ্ড–তারেক তার জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছে। আহামরি কিছু না-সবুজ জমিন লাল পাড়। তবুও তো সে কিনল। এই প্রথম তারেক তার জন্যে শাড়ি কিনল।

তারেক গভীর গলায় বলল, শাড়িটা পর দেখি।

রীনা লজ্জিত গলায় বলল, হঠাৎ শাড়ি কেন?

আনলাম আর কী? সবুজ রঙ কি তোমার পছন্দ না?

খুব পছন্দ।

রীনার লজ্জা লাগছে। আনন্দও লাগছে। তার চোখ ভিজে উঠছে। সে বুঝতে পারছে। না। এত সুখী আল্লাহ তাকে কেন বানিয়েছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *