আট
‘সত্যি কথা বল, কি করে অ্যাকসিডেণ্ট হল?’ সুরুচি সোম কেটে কেটে উচ্চারণ করলেন। অর্ক তখনও পেছন দিকে তাকিয়ে। বিলুর মুখ হাঁ হয়ে রয়েছে। ওরা গেট পেরিয়ে ট্যাক্সিতে যখন উঠেছিল তখন যেন কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল বিলু। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে জুলজুল করে দেখছিল। অর্কর মনে হয়েছিল বিলুকে ডাকা দরকার। এক সঙ্গে যখন এসেছে তখন ওকে ফেলে রেখে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু সুরুচি সোমের পেছনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মন মোচড় খেল। বিলুর মুখ চোখ এবং পোশাক সুরুচি পছন্দ করবেন না। সত্যি বলতে কি বিলুকে এই প্রথম অর্কর খুব খারাপ লাগছিল। এই বাড়ি এবং এই পরিবারের সঙ্গে বিলু কিছুতেই মানায় না। ওকে ডাকলে সুরুচি যে অবাক এবং বিরক্ত হবেন এটুকু বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না অর্কর।
ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করা মাত্র খারাপ লাগল অর্কর। সে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল এটা তার দোষ নয়। সুরুচি এত দ্রুত ট্যাক্সিতে উঠলেন এবং এমন গম্ভীর হয়েছিলেন যে তার কিছু করার সুযোগ ছিল না। সে শেষবার দেখল বিলু দৌড়ে রাস্তার মাঝখানে চলে এসে দুটো হাত শূন্যে নাড়ছে। এই সময় সুরুচি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হল, শুনতে পাচ্ছ না?’
অর্ক ফিরে তাকাল। সুরুচি দুটো বড় চোখে ওকে দেখছেন। দৃষ্টিতে এখনও সন্দেহ। অর্ক কোনরকমে বলল, ‘হয়ে গেল।’
‘হয়ে গেল মানে? তুমি কোথায় থাকো?’
‘আমি? বেলগাছিয়ায়।’
‘কি কর?’
‘পড়ি।’
‘বাবা কি করেন?’
‘কিছু না।’
‘তোমার মতন ছেলেকে ও লিফট দেবে বিশ্বাস হচ্ছে না। অন্য কোন গোলমাল আছে। তাছাড়া অ্যাকসিডেণ্টে তোমার কিছু হল না আর বিলাস হাসপাতালে?’
অর্কর মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, ‘যাঃ শালা! অ্যাকসিডেণ্ট কি আমার ইচ্ছেয় হয়েছে?’ বাক্যটি বলা মাত্র বুঝতে পারল সুরুচির সামনে এ ধরনের কথা বলা ঠিক হয়নি। কারণ শোনামাত্র ভদ্রমহিলার মুখ আচমকা থেবড়ে গিয়েছে। বিস্ফারিত চোখে তিনি এখন অর্ককে দেখছেন। যেন এক দলা নোংরা ওঁর গায়ে কেউ ছুঁড়ে দিয়েছে এমন বসার ভঙ্গী। গলার স্বর জড়িয়ে গেল তাঁর, ‘তুমি, তুমি আমাকে শালা বললে? স্কাউন্ড্রেল।’
অর্ক একটু সংকুচিত হয়েছিল কিন্তু শেষ শব্দটি কানে যাওয়া মাত্র সে মাথা তুলল। ওটা যে ইংরেজি গালাগাল তা অনুমানে বুঝতে পারছে, বলার ধরনে সেটা স্পষ্ট। কেউ যদি তাকে গালাগাল দেয় তবে তার কি দরকার ভদ্রতা করার। সে চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘তখন থেকে আপনি ন্যাকড়াবাজি করছেন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন উনি মাল খেয়ে তাই অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছিল। শালা আমারই জান কয়লা হয়ে যেত আর একটু হলে। তবু আমি যেচে আপনাদের খবর দিতে এলাম আর আপনি—।’
‘ন্যাকড়াবাজি! ন্যাকড়াবাজি মানে কি?’
সুরুচির মুখের চেহারা আচমকা যেন সহজ হয়ে আসছিল। মুখের যে পেশীগুলো এতক্ষণ টান টান ছিল তা শিথিল হয়ে এল।
অর্কর মনে পড়ল ন্যাকড়াবাজি কথাটা শুনে বাবাও মানে বুঝতে পারেনি। এরা মাইরি কোন জগতের মানুষ? কথা বললেও বুঝতে পারে না ? সে তো আর ইংরেজি বলছে না। সুরুচির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে বাইরে তাকিয়েই দত্তবাগানের মোড়টাকে দেখতে পেল। পাইকপাড়া দিয়ে না ঘুরে ট্যাক্সি সোজা পাতাল রেলের রাস্তা দিয়ে আর জি কর যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর না পেয়ে সুরুচি বললেন, ‘তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে তুমি ভদ্রঘরের ছেলে নও!’
অর্ক কাঁধ নাচাল, ‘যান যান, কোঠাবাড়ির লোক কত ভদ্র তা জানা আছে।’ কোঠাবাড়ি কথাটা বিলু প্রায়ই ব্যবহার করে।
‘কোঠাবাড়ি!’ সুরুচি ঢোক গিললেন, ‘তুমি কোথায় থাক?’
‘তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন। ওই যে বস্তিটা দেখলেন, ওখানে।’ গাড়িটা তখন ব্রিজে উঠছে।
‘ও। তাই তোমার মুখের ভাষা এরকম।’
‘আবার কিচাইন করছেন! আমি কোন খারাপ কথা বলিনি।’
বলনি? তোমার সে বোধই নেই।’
‘আমার মাথা গরম করে দিচ্ছেন আপনি। একটু আগে কে ইংরেজিতে গালাগাল দিল, আমি?’
‘আমি দিয়েছি? ও, স্কাউণ্ড্রেল, স্কাউণ্ড্রেল মানে জান?’
‘ওইটাই তো আপনাদের সুবিধে। আমরা মানে বুঝি না আর আপনারা টপ করে ঝেড়ে দেন। এই যেমন, ফাক্ দি টাইম।’
সঙ্গে সঙ্গে সুরুচির কান থেকে যেন গরম হাওয়া বেরুতে লাগল, মুখ চোখ ছাড়ানো তরমুজ। ঠোঁট দাঁতে চেপে উচ্চারণ করলেন, ‘কি বললে?’
‘আমি বলিনি। কাল রাত্রে উনি গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিলেন। কথাটার মানে কি?’
সুরুচি রাগতে গিয়ে না হেসে পারলেন না। ট্যাক্সি তখন আর জি করের দরজায়। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘না বলে চলে যেও না, তোমার সঙ্গে আমার দরকার আছে।’
অর্ক অবাক হয়ে গেল। সুরুচি সোম যে এত তৎপর হতে পারেন তা ওঁর চেহারা দেখে মনে হয়নি। একে জিজ্ঞাসা করে ওকে ধমকে তার কাছে গলে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বিলাস সোমের শরীরের অবস্থা জেনে নিলেন। এখন রোগীদের সঙ্গে দেখা করার সময় নয়। কিন্তু সুরুচি সেটাও ম্যানেজ করলেন। করে এসে বালিকার ভঙ্গীতে অর্ককে বললেন, ‘জানো ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। কয়েকটা কথাও বলেছে। ওরা বলছে আর কোন ভয় নেই।’ অর্কর প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ছুটলেন সুরুচি আবার ভেতরে।
লোকটা বেঁচে গেল? অর্ক চারপাশে তাকাল! কেউ তার দিকে লক্ষ্য করছে না। এই ভরদুপুরে হাসপাতালটায় একটা সিরসিরে হাওয়া বইছে। সে কি ফেঁসে গেল! ফেঁসে যাবার আর কি আছে! হার পায়নি বললে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। ওটা পকেটে না থাকলে ভাল লাগত। মুখের ওপর মিথ্যে কথা বলতে পারবে তো সে? হঠাৎ বিলুর ওপর তার রাগ হল। মাল কামানোর জন্যে বিলু তাকে যদি লেকটাউনে নিয়ে না যেত তাহলে এই নকশায় পড়তে হত না। আর কোথায় মাল? ওই জিনিসের কাছ থেকে মাল খসাবে সে সম্ভাবনা নেই। যত সব বাতেলা।
কিন্তু এখন কেটে যাওয়া ঠিক কাজ হবে না। যদি হারখানার কথা ওঠে তাহলে ওরা নিশ্চয়ই তাকেই সন্দেহ করবে। কিন্তু সে যদি সঙ্গে সঙ্গে থাকে তাহলে অবিশ্বাস করার কোন কারণ থাকবে না। অর্ক একটু এগিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসল। এবং বসা মাত্রই তার খিদে পেয়ে গেল। এখন পকেটে যা আছে তাতে বেশ ভাল খাওয়া যায়। আজ সকালে কিছুই খাওয়া হয়নি, কাল রাত্রেও, দূর, ওটাকে খাওয়া বলে নাকি!
এই সময় সুরুচি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। দু পাশে মুখ ফিরিয়ে প্রথমে তাঁর কপালে ভাঁজ এবং ঠোটের কোণে বিরক্তি ফুটছিল কিন্তু বেঞ্চির ওপর চোখ পড়ামাত্র তিনি উজ্জ্বল হলেন। দ্রুত কাছে এসে বললেন, ‘তোমার নাম কি যেন?’
‘অর্ক।’
‘ও বাবা, দারুণ তো। শোন, তুমি একবার আমার সঙ্গে এস।’
‘কোথায়?’
‘বিলাস তোমাকে ডাকছে।’
‘কেন?’
‘বাঃ, আমি জানবো কি করে? প্রথমে তো তোমাকে মনেই করতে পারছিল না, তারপর একটু একটু করে খেয়াল হয়েছে। আর হ্যাঁ, তুমি ওর সামনে ওই সব শ্ল্যাং বলো না।’
‘শ্ল্যাং?’
‘হ্যাঁ।’
‘শ্ল্যাং মানে কি?’
‘খারাপ কথা।’
‘আপনি আমাকে ধুর পেয়েছেন নাকি?’
‘ধুর! ধুর মানে কি?’
অর্ক অবাক গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে ঢপ্ দিচ্ছেন।’
দুটো কাঁধ নাচালেন সুরুচি, ‘ওফ্! আমার বলতে ইচ্ছে করছে, কি কথা বলিস তুই, আমি যে তোর ভাষা বুঝিনে! শোন, তোমার এই কথাগুলো আমি পরে লিখে নেব। কিন্তু তুমি বিলাসের কাছে গিয়ে ওই সব শব্দ একদম ব্যবহার করবে না। বিলাস যখন ড্রাঙ্ক থাকে তখন ও সব কিছু সহ্য করে কিন্তু নর্মাল অবস্থায় হি ইজ এ ডিসেন্ট ম্যান। কাম অন।’
এই শব্দগুলো অর্কর পরিচিত। স্কুলে পড়তে গিয়ে আর যাই হোক ইংরেজি গালাগালগুলো শেখা যায় না। সে সুরুচির পেছন পেছন ভেতরে ঢুকল। লম্বা করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় একজন নার্স ওদের দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল, সুরুচি মধুর হাসলেন, ‘তখন যে বললাম ভাই, জাস্ট এ মিনিট।’
একটা কেবিনের পর্দা সরিয়ে সুরুচি ঢুকলে অর্ক অনুসরণ করল। বিলাস সোম খাটে শুয়ে রয়েছেন। মাথা ব্যাণ্ডেজে ঢাকা, হাত এবং কাঁধে চোট লেগেছে। মাথার পেছনে বেশ কয়েকটা নল ঝুলছে। বিলাস শীতল চোখে অর্ককে দেখলেন। অর্কর মনে হল, এই লোকটাকে সে চেনে না। অন্তত গত রাত্রে যাকে গাড়ি চালাতে সে দেখেছিল, এ সে নয়। তার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সুরুচি প্রথম কথা বললেন, ‘এ তোমার সঙ্গে গাড়িতে ছিল?’ বিলাস অর্কর মুখ থেকে চোখ সরায়নি একবারও। এবার খুব দুর্বল গলায় বলল, ‘বোধহয়।’
‘আর য়ু নট শিওর?’
বিলাস উত্তর দিলেন না কিন্তু চোখও সরালেন না। সুরুচি চকিতে ঘাড় ঘোরালেন, ওঁর চোখে সন্দেহ চলকে উঠল। তারপর চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ যেচে আমার বাড়িতে খবর দিতে গিয়েছিল, তুমি চিনতে পারছ না?’
‘পারছি।’
‘ওঃ। তাই বল!’ নিঃশ্বাস ফেললেন সুরুচি।
‘আমার কণ্ডিশন কিরকম?’ খুব দুর্বল গলা বিলাসের।
‘ফাইন।’
‘কবে ছাড়বে?’
‘জিজ্ঞাসা করিনি। নিশ্চয়ই দু’ পাঁচদিন রাখবে।’
‘আমি চলে যেতে চাই। দরকার হলে বণ্ড সই করে। ইট্স এ হেল।’ মুখ বিকৃত করলেন বিলাস।
‘কিন্তু যাব বললে কি যাওয়া যায়? অ্যাকসিডেণ্ট করার আগে তোমার ব্যাপারটা ভাবা উচিত ছিল।’
‘ড্যাম ইট! ভেবেচিন্তে অ্যাকসিডেণ্ট করলে ঈশ্বর এতক্ষণে আমাকে শান্তিতে রাখতেন।’
‘আমার সঙ্গে থাকা মানে তোমার অশান্তি তা জানি। চেঁচিয়ে না বললেও চলত। তুমি কাল রাত্রে কোথায় গিয়েছিলে জানি।’ সুরুচি সোম হিসহিসিয়ে উঠলেন।
বিলাস সোমের দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য স্ত্রীর ওপর পড়েছিল, চট করে অর্কর ওপর সরে এল। তারপর চোখ বন্ধ করলেন তিনি। বেশ বড় নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক থেকে, ‘ডাক্তারের কাছে খোঁজ নিয়ে দ্যাখো আমায় কবে ছাড়বে। অনেক কাজ পড়ে আছে।’
সুরুচি সোম অনেক চেষ্টায় নিজেকে সংযত করলেন। তারপর ঘুরে দরজার দিকে যেতে যেতে ডাকলেন, ‘এসো অর্ক।’
ঘরে ঢোকা অবধি অর্ক একটাও কথা বলেনি। এই ওষুধের গন্ধ-চাপা ঘরে এতক্ষণ যে ঘটনা ঘটল সেটা ওর কাছে সিনেমা সিনেমা মনে হচ্ছিল। সুরুচি বেরিয়ে যেতে সে তাঁকে অনুসরণ করার জন্য পা বাড়াতে যেতেই দেখল বিলাস সোম নিঃশব্দে দু চোখে ইশারা করে তাকে ডাকছেন। ডাকটা এত স্পষ্ট যে অর্কর বুক ছ্যাঁত করে উঠল। কি ব্যাপার, ডাকছে কেন! এখন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সে পায়ে পায়ে বিছানার পাশে চলে এল। বিলাস সোম বললেন, ‘কাল তুমিই ছিলে, না?’
‘হ্যাঁ। বিডন ষ্ট্রীট থেকে উঠেছিলাম।’
‘আমার কিছু মনে নেই। তোমাকে তুললাম কেন?’
‘আপনার গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আমি ঠেলেছিলাম।’
‘ওফ্। তুমি কি ওকে কিছু বলেছ? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি, এই যেমন কোথায় গিয়েছিলাম—।’
‘না।’
‘তুমি কিছু বলনি?’
‘শুধু আপনার নেশা হয়েছিল—।’
‘সেটা না বললেও সবাই বুঝতে পারে। আমার গাড়ি কোথায়?’
‘জানি না। বোধহয় খালের পাশেই আছে।’
‘গাড়ির ভেতরটা দেখেছ?’
‘না।’
‘আমার হার?’
চট্ করে গলা শুকিয়ে গেল অর্কর। সে যেন আর কথা বলতে পারছে না। শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে।
‘আমার হার ও পেয়েছে?’
‘না।’ মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা মাত্র নিজেকে লাথি মারতে ইচ্ছে করছিল ওর।
বিলাস সোমের মুখ উজ্জ্বল হল, ‘ওটা তোমার কাছে আছে?’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল সে। হ্যাঁ।
‘গুড। আপাতত রেখে দাও। তুমি কি কর?’
‘পড়ি।’
‘কোন স্কুলে?’
নাম বলল অর্ক। একি করল সে? হারখানা যে তার পকেট আছে তা বলে ফেলল? কিন্তু লোকটা বউ-এর কাছে চেপে যাচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই গোলমাল আছে কিছু।
‘তুমি ওটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমাকে এরা যেদিন রিলিজ করবে তার পরদিন আমার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করবে। আমার বাড়ি তো তুমি জানো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার ঠিকানা কি?’
‘তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন। বেলগাছিয়ায়।’
‘কি! ওটা তো বস্তি। তুমি বস্তিতে থাকো?’
‘হ্যাঁ।’
‘মাই গুডনেস!’ চোখ বন্ধ করলেন বিলাস। আর তখনই সুরুচি আবার প্রবেশ করলেন। বিলাসের বিছানার পাশে অর্ককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওঁর মুখে বিস্ময় ফুটল। কিন্তু গলার স্বরে সেটা বোঝালেন না তিনি, ‘দিন চারেক থাকতেই হবে। ওরা রিস্ক নিতে রাজি নয়। এতক্ষণ তুমি কথা বলছ জানলে আর দেখা করতে দেবে না। আমি বিকেলে আসব। চলে এসো অর্ক।’
এবার ডেকে নিজে বেরিয়ে গেলেন না। অর্কর দরজা পর্যন্ত যাওয়া অবধি অপেক্ষা করে তবেই পা বাড়ালেন। অর্কর মনের মধ্যে তখন অনেকগুলো ঢেউ তোলপাড় করছিল। হারখানা হাতছাড়া হয়ে গেল!
বাইরের বারান্দায় এসে সুরুচি বললেন, ‘ও তোমাকে কি বলছিল?’
অর্ক সুরুচির দিকে তাকাল, তারপর মাথা নাড়ল, কিছু না।
‘তুমি মিথ্যে কথা বলছ।’
‘বেশ করছি। এবার আমাকে যেতে দিন।’
‘তুমি, তুমি এইটুকু ছেলে—।’
‘আমি বাচ্চা নই। আপনাদের কারবার আপনারা বুঝে নিন। এই সব পিনিক আমার ভাল লাগে না।’
সুরুচি বললেন, ‘না, তুমি যাবে না। আমি অফিস থেকে ঘুরে আসছি অন্তত ততক্ষণ এখানে থাকো।’
সুরুচি ওঁর মাথায় মাথায় কিন্তু এই বয়সেও স্বাস্থ্য চমৎকার বলে অর্কর নিজেকে ছোট লাগছিল। সুরুচির শরীরে অনেক রকম নরম নরম ব্যাপার আছে যা মাধবীলতার নেই। এদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে জব্বর কিচাইন হচ্ছে—সুরুচির পেছন দেখতে দেখতে অর্ক মাথা নাড়ল। হারখানা যখন দিয়ে দিতেই হচ্ছে তাহলে লোকটাকে বাঁশ দিলে কেমন হয়! সুরুচিকে বলবে নাকি! বোঝাই যাচ্ছে হারখানার কথা সুরুচি জানে না। না, মাথা নাড়ল অর্ক। লোকটা বিছানায় শুয়ে যে ভাবে কথা বলছিল তাতে ওর ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং সেরে উঠে যখন বাড়ি যাবে তখন হারখানা দেবার সময় কিছু মাল খিচে নেওয়া যাবে। ব্যাপারটা এইভাবে ভাবতেই অর্কর মন প্রফুল্ল হল। দোকানে গিয়ে হার বিক্রি করার কোন অভিজ্ঞতা তার নেই। সে সব করতে গেলে কাউকে সঙ্গে নিতেই হতো। দোকানদার নিশ্চয়ই রশি টানতো, ঢপ খেতে বেশী সময় লাগত না, তার ওপর বখরা দিতে হত সঙ্গীকে। আর এই ব্যবস্থায় কোন ঝামেলা থাকল না। যার জিনিস তার কাছেই যাচ্ছে মাঝখান থেকে পকেটে মাল আসবে। অন্তত চুরির বদনাম গায়ে লাগবে না।
বেশ হালকা হয়ে সামনে তাকাতেই অর্কর বুক ধক্ করে উঠল। বিলু আসছে। ভাঙ্গা এবং চোয়াড়ে মুখ এখন শক্ত। সামনে এসেই বলল, ‘লাইন করেছ গুরু?’
‘কিসের লাইন?’
‘যা বে! আমাকে দেওয়াল ধরে দাঁড় করিয়ে তুমি ট্যাক্সিতে উঠলে কি ওই বুডির সঙ্গে পেরেম করতে? কত মাল দেবে?’
‘মাল দেবে কেন?’
‘কেন দেবে না? ওর স্বামী অ্যাকসিডেণ্ট করে তোকে চোট দিয়েছে। তার দাম দিতে হবে না?’
অর্ক বলল, ‘দূর! ও আমি চাইতে পারব না।’
‘যাঃ শালা। তাহলে আমরা লেকটাউনে গেলাম কেন?’ প্রচণ্ড হতাশ দেখাচ্ছিল বিলুকে। তবু তারই মধ্যে সে আড়চোখে অর্ককে দেখছিল, ‘গুরু, আমাকে নকশা দেখাচ্চ না তো!’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘না। লোকটার অবস্থা খারাপ। এ সময় অন্য কিছু বলা যায়, তুই বল?’
‘ও তোর পিরীতের নাঙ না কি বে! ওই যে আসছে, আমি সরে যাচ্ছি, তুই মাল চা।’ বিলু সট করে সরে একটা থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল।
সুরুচি এসে বললেন, ‘আজ সারাদিন ওয়াচে রাখবে। মাথার এক্সরে হয়েছে। বিকেলে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তুমি বিকেলে আসতে পারবে!’
‘কেন?’
সুরুচি তাকালেন, ‘আমাকে যদি একটু সাহায্য কর—। আমি বুঝতে পারছি না ওকে নার্সিংহোমে ট্রান্সফার করব কিনা? বাড়িতে আর দ্বিতীয় কোন পুরুষ নেই—।’
‘আপনার আত্মীয়স্বজন—।’
‘না ভাই, আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ কাছাকাছি থাকেন না।’
‘ঠিক আছে।’
‘তুমি আসবে?’
‘দেখি?’
‘ওফ্। তোমরা সরাসরি কথা বলতে পারো না। চল, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাই। ওই তো একটা ট্যাক্সি খালি হল! ধরো, ধরো ওকে।’
অর্ক একটু দৌড়ে গিয়ে ট্যাক্সিটাকে থামাল। সুরুচি কাছে আসা মাত্র সে বিলুকে দেখতে পেল। থামের আড়াল থেকে বিলু বেরিয়ে এসেছে। সুরুচি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। একটু ইতস্তত করে সে চট করে গাড়িতে উঠে পড়ল। এখন বিলুর সঙ্গ তার মোটেই ভাল লাগছে না। চোয়াড়ে ভাঙ্গা মুখে বিলু শুধু মালের কথা বলে যাবে। তার লাগল চোট আর ও কামাবে মাল। নিজেকে মুরগি বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না মোটেই। তাছাড়া সুরুচির কাছাকাছি হলেই অদ্ভুত একটা সুবাস নাকে আসে, শরীর জুড়িয়ে যায়। সেটা তাদের বস্তিতে কারো শরীর থেকে বের হয় না। ওটা হয়তো সেন্ট কিংবা কে জানে, বড়লোকদের সুখী মানুষদের রক্ত মাংস থেকেই বেরিয়ে আসে।
ট্যাক্সিটাকে চলতে দেখে বিলু ছুটে আসছিল। কিন্তু গাড়ির গতির সঙ্গে তাল রাখতে পারল না। খুব মজা লাগছিল অর্কর। সে লক্ষ্য রাখছিল ব্যাপারটা সুরুচির চোখে পড়ে কিনা! কিন্তু ভদ্রমহিলা নিজের চিন্তায় এতটা ডুবে ছিলেন পেছন দিকে তাকাননি।
সারাটা পথ সুরুচি একটাও কথা বললেন না। পেছনের সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। বেলগাছিয়ার মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে অর্ক চেচিয়ে উঠল, ‘দাঁড়ান, ট্যাক্সি থামান।’
গাড়িটা থামতেই দরজা খুলে নামল অর্ক। সুরুচি মুখ বার করে জায়গাটা দেখলেন, ‘এখানে থাকো?’
‘হ্যাঁ। ওই গলির মধ্যে।’
‘চলুন।’
ট্যাক্সিটার চলে যাওয়া দেখল অর্ক। তারপর অলস পায়ে গলির মধ্যে ঢুকল। এখন নিশ্চয়ই বারোটা বেজে গেছে কারণ মোড়ের লণ্ড্রী বন্ধ। তার মানে মা এসে গিয়েছে। শরীরটা আচমকা শিথিল হয়ে এল ওর। গতকাল থেকে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি তার।
তিন নম্বরের সামনে আসতেই হাঁক শুনতে পেল, ‘আ বে অক্ক।’
ঘাড় ঘুরিয়ে চমকে উঠল সে, খুরকি আর কিলা শিবমন্দিরের রকে বসে আছে। দুজনের দৃষ্টি এদিকে। ওরা কখন ছাড়া পেল কে জানে কিন্তু দুজনেই দারুণ মাঞ্জা দিয়েছে। অর্ক হাসবার চেষ্টা করল, ‘কখন এলি?’
ওরা উত্তর দিল না কথাটার, খুরকি বলল, ‘তোমার আশায় বসে আছি গুরু। শুনলাম কাল নাকি অ্যাকসিডেণ্ট করেছিলে!’
‘হ্যাঁ!’
‘সকাল থেকে চিড়িয়া ফুরুত হয়েছিলে এদিকে আমরা শালা খাবি খাচ্ছি। মালটা দাও।’
‘কিসের মাল?’ অর্ক রাস্তা পেরিয়ে এসে শিবমন্দিরের রকে পা তুলে দাঁড়াল।
‘পাবলিকের মাল কাল তোর কাছে রেখেছিলাম।’
‘কত আছে?’
‘সে আমি জানি না, আছে তাই জানি।’
‘তাহলে আমি যা বলব তাই বিশ্বাস করতে হবে। দশ আছে।’
‘দশ!’ দুজনেই একসঙ্গে চমকে উঠল।
পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে দেখাল অর্ক।
‘বাকি টাকা?’
‘কিসের বাকি!’ অর্ক চোয়াল শক্ত করল।
খুরকি তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। ওর হাত কোমরে। অর্ক জানে কোমরের কাছে একটা খোপে খুরকি খুর রাখে। কিন্তু সে একটুও ঘাবড়াবার লক্ষণ দেখাল না, ‘রঙবাজি ছেড়ে দাও গুরু। যেভাবে বসেছিলে সেইভাবে না বসলে কোন কথা হবে না।’
খুরকির মুখ বিস্ময়ে থেবড়ে গেল। অর্ককে এই ভঙ্গীতে কথা বলতে কেউ দ্যাখেনি আগে। কিলা খুরকির হাত ধরে টানল। অর্ক খুরকির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি বে, কানে শিবু ঢুকেছে?’
ধীরে ধীরে খুরকি রকে কিলার পাশে বসতেই অর্কর মনে হল সে এই প্রথম জিতে গেল। কিন্তু সেই আনন্দের প্রকাশ তার মুখ চোখে এল না, ‘আমি একা হাঁড়ি চাটতে চাই না। যে টাকা কাল বেঁচেছিল তা দিয়ে ব্ল্যাকের টিকিট কেনা হয়েছে। ব্যবসা হবার পর চারজনে সমান ভাগ হবে। ঠিক আছে?’
খুরকির মুখে এবার হাসি ফুটল। কিলা বলল, ‘চারজন কেন?’
‘বাঃ বিলু কি ভোগে যাবে?’
কথাটা বলে আর দাঁড়াল না অর্ক। বড় পা ফেলে রাস্তা পেরিয়ে তিন নম্বরের খাঁজে ঢুকে পড়ল। নিজেকে এখন বেশ লম্বা চওড়া মনে হচ্ছে। কিন্তু ন্যাড়াদের ঘরের সামনে এসে সে আবার গুটিয়ে যেতে লাগল। মাধবীলতা যদি তাকে, যদি কেন নিশ্চয়ই ঝাড়বে—! সে দেখল অনু তাদের ঘরের মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আর একটু ঘুরতেই নিজেদের আধভেজানো দরজা নজরে এল। প্রায় নিঃশব্দে দরজার সামনে দাঁড়াতেই মাধবীলতার গলা কানে এল অর্কর, ‘এটা সুপ্রিয়ার বই, পরশু ফেরত দিতে হবে। দুবার পড়েছি তবু পড়তে ইচ্ছে করল।’
‘কি বই?’ অনিমেষের গলা শুনল অর্ক। অত্যন্ত নিস্পৃহ।
‘পথের পাঁচালি।’