অষ্টম অধ্যায় — সত্যবাদিতা
সত্য বলার অভ্যাস গঠন করা নৈতিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সত্য বলিতে সত্য কথা ও সত্য চিন্তা উভয়ই বুঝাইতেছি; বস্তুত এই দুইটির মধ্যে শেষোক্তটিই আমার কাছে বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়। মিথ্যাবাদীকে দুইটি পৃথক দলে ভাগ করা যায় : একদল লোক সজ্ঞানে মিথ্যা বলে অর্থাৎ তাহারা যে মিথ্যা কথা বলিতেছে তাহারা তাহা জানে; অপর দল প্রথমে মিথ্যা দ্বারা নিজেদের অচেতন মনকে বঞ্চনা করে তাহার পর কল্পনা করে যে তাহারা ধার্মিক ও সত্যবাদী। প্রথম দল মিথ্যাবাদী, দ্বিতীয় দল ভণ্ড কপটাচারী। এই দুই দলের মধ্যে যদি একদলকে বাছিয়া লইতে হয় তবে আমি প্রথম দলকে পছন্দ করিব। যাহারা সত্যভাবে চিন্তা করেন তাহারা মিথ্যা কথা বলা যে সর্বদাই অন্যায় তাহা বিশ্বাস করেন না। যাহারা এইরূপ মনে করেন, যাহারা কোনও অবস্থাতেই সত্যভাষণ হইতে বিরত হওয়ার পক্ষপাতী নন, তাঁহাদিগকে ধর্মাচার দ্বারা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করিয়া অনেক সময় নিজেদের অভিমতের পরিবর্তন করিতে হয়। ইহার ফলে মনকে ফাঁকি দিয়া নিজেদের মিথ্যাচার স্বীকার না করিলেও ক্ষেত্রবিশেষে তাঁহারা প্রকৃতই মিথ্যাচারী। তবে যেইরূপ ক্ষেত্রে মিথ্যাবাদিতা সমর্থনযোগ্য সেইরূপ অবস্থা মানুষের জীবনে খুব কমই আছে। প্রায় সকল সময় দেখা যায় এইরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয় অত্যাচারী শক্তিমানের উদ্ধত অবিচারে অথবা যুদ্ধের ন্যায় কোনো দেশব্যাপী ব্যাপক বিপদের সময়ে। মানব-সমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটিলে এইরূপ অবস্থা কমই সংঘটিত হইবে।
প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখা যায় ভয় হইতে মিথ্যাবাদিতার উৎপত্তি। যে শিশু নিঃশঙ্কভাবে বাড়িয়া ওঠে সে কখনো মিথ্যা কথা বলে না; কোনোপ্রকার নৈতিক উপদেশ বা চেষ্টা ইহার কারণ নয়, প্রকৃত কারণ এই যে, মিথ্যা কথা বলার কোনো প্রয়োজন সে অনুভব করে না। যে শিশু গৃহে উপযুক্ত অভিভাবকের নিকট হইতে সদয় ব্যবহার লাভ করে তাহার চোখে ফুটিয়া উঠে সরলতার দীপ্তি এবং অপরিচিত লোকের সঙ্গেও তাহার আচরণ হয় নির্ভীক ও সঙ্কোচহীন। কিন্তু যে শিশু সর্বদা অত্যাচার এবং কঠোরতার মধ্যে লালিতপালিত হয়, শাস্তি পাওয়ার ভয়ে সে সর্বক্ষণ সঙ্কুচিত হইয়া থাকে, তাহার ভয় কখনো বা কি অন্যায় করিয়া ফেলে, সর্বদা ভীতি ও সঙ্কোচের মধ্যে থাকিতে হয় বলিয়া তাহার আচরণের স্বাভাবিকতা আসে না।
শিশু আপনা হইতে মিথ্যা কথা বলিতে শেখে না। মিথ্যা বলিয়া যে কিছু আছে এবং মিথ্যা কথা যে বলা যায় তাহা প্রথমে শিশুর ধারণায় আসে না। বয়স্কদের নিকট হইতে শিশু এ শিক্ষা পায়; ভয় ইহাকে দ্রুততর করে। শিশু বুঝিয়া ফেলে যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা তাহার নিকট মিথ্যা কথা বলে এবং তাহাদের নিকট সত্য কথা বলার বিপদ আছে; কাজেই সে মিথ্যা বলিতে শুরু করে। যে কারণগুলি শিশুকে মিথ্যাভাষণে উৎসাহ দেয় বা বাধ্য করে সেইগুলি দূর করুন, দেখিবেন সে মিথ্যা বলার চিন্তা তাহার মনেই আসিবে না।
মিথ্যাবাদিতা ও শিশুমনের বৈশিষ্ট্য : শিশু প্রকৃতই মিথ্যা কথা বলিতেছে কি না সে সম্বন্ধে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। শিশুদের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল, তাহারা অনেক সময় বয়স্কদের প্রশ্নের উত্তর কি হইবে তাহা জানে না কিন্তু বয়স্করা হয়তো মনে করেন তাহারা ঠিক জানে। শিশুদের সময় সম্পর্কে ধারণা খুবই অস্পষ্ট; চার বৎসরের কম বয়স্ক শিশুর কাছে গতকাল ও এক সপ্তাহ পূর্বের মধ্যে কিংবা গতকাল ও ছয় ঘণ্টা পূর্বের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। আপনার প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকিলে তাহারা আপনার প্রশ্ন করার ভঙ্গি ও কণ্ঠস্বর অনুসারে হ্যাঁ কিংবা না বলিবে। আবার অনেক সময় কল্পনার আশ্রয়ে কোনো কিছু ভান করিয়াও তাহারা কথা বলে। তাহারা যখন বলে যে পিছনের বাগানে সিংহ আছে তখন এ ভান সহজেই বোঝা যায়; শিশু তখন কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করিতেছে; সিংহ সম্বন্ধে সে শুনিয়াছে বা ছবি দেখিয়াছে; সিংহ গাছপালার মধ্যে থাকে তাহাও সে জানে না; কল্পনায় সিংহকে সে নিজের বাড়ির কাছেই আনিয়াছে মাত্র। এ ক্ষেত্রে শিশুর কথা কল্পনাপ্রসূত বলিয়া সহজেই বোঝা গেল; অনেক সময় তাহার কল্পনাপ্রণোদিত কথা ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। বাস্তবতার কষ্টিপাথরের এইগুলিকে মিথ্যা বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। বাস্তবতার কষ্টি পাথরের এইগুলিকে মিথ্যাভাষণ বলা যায় সত্য কিন্তু ইহাতে কাহাকেও বঞ্চনা করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য বক্তার নাই। বস্তুত বয়স্ক ব্যক্তিকে ঠকানো বা ফাঁকি দেওয়ার কোনো চিন্তাই শিশুদের মনে উঠিতে পারে না; তাহাদের নিকট বয়স্ক ব্যক্তিরা সর্বজ্ঞ; কাজেই তাহাদিগকে বঞ্চনা করা অসম্ভব। আমার পৌনে চার বছর বয়সের ছেলে শুধু গল্প শোনার আনন্দের জন্যই, আমি যখন বর্তমান ছিলাম না তখন তাহার কি হইয়াছিল সে সম্বন্ধে গল্প শুনিতে চায়। তাহার ধারণা তাহার পিতার অজানা কিছু নাই। তাহাকে বোঝানো কষ্ট যে তাহার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। শিশুরা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধির সঙ্গে বয়স্কদের জ্ঞানের তুলনা করিয়া এত পার্থক্য দেখে যে, বয়স্কদের জ্ঞানের যে সীমা আছে তাহা ধারণা। করিতে পারে না। গত ইস্টারের সময় ছেলেকে কতকগুলি চকোলেট দেওয়া হইয়াছিল। আমরা তাহাকে বলিয়াছিলাম বেশি খাইলে অসুখ করিবে; শুধু বলিয়াই ক্ষান্ত ছিলাম, চকোলেটগুলি তাহার কাছেই রাখা হইয়াছিল। বেশি খাইয়া সে অসুখে পড়িল। অসুখসারিলে সে একদিন হাস্যোজ্জ্বল, কতকটা বিজয়োৎফুল্ল কণ্ঠে বলিল : বাবা আমার অসুখ হয়েছিল–বাবা বলেছিলেন যে আমার অসুখ হবে। তাহার পিতার ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা পরীক্ষা করিয়া শিশু বিস্মিত হইয়াছিল। সে যেন পরীক্ষা দ্বারা কোনও বৈজ্ঞানিক নিয়মের সত্যতা প্রমাণ করিয়াছিল। ইহার পর হইতে তাহার হাতে অধিক পরিমাণে চকোলেট দিয়াও নিশ্চিন্ত হওয়া গিয়াছে। যদিও চকোলেট পাইত তবু কখনো লোভের বশে বেশি খাইয়া অসুখ সৃষ্টি করিত না। ইহা ছাড়া আরও একটি সুফল হইয়াছে এই যে তাহার খাদ্য সম্বন্ধে আমরা যাহা বলি তাহা সে একান্তভাবে বিশ্বাস করে। তাহার মনে এই ভাব জাগ্রত করার জন্য নৈতিক উপদেশ শাস্তি অথবা ভয়ের প্রয়োগ করিতে হয় নাই। প্রথম অবস্থায় শিশুর সঙ্গে আচরণে ধৈর্য ও দৃঢ়তার প্রয়োজন হইয়াছে। সে এমন এক বয়সে আসিয়া পৌঁছিতেছে, যখন সকল ছেলের পক্ষেই মিষ্টি খাবার চুরি করা এবং এ সম্বন্ধে মিথ্যা বলা স্বাভাবিক। আমার ছেলেও খাবার চুরি করিবে নিশ্চয় কিন্তু এ বিষয়ে মিথ্যা কথা বলিলে আমি বিস্মিত হইব। শিশু যখন মিথ্যা কথা বলে তখন তাহাকে ইহার জন্য দায়ী না করিয়া পিতামাতার নিজেদিগকেই দায়ী মনে করা উচিত। তাহাদের কর্তব্য হইবে–কি জন্য মিথ্যা কথা না বলা ভালো তাহা শান্তভাবে শিশুকে বুঝানো এবং যে যে কারণে শিশু মিথ্যা কথা বলিতে অভ্যস্ত হয় তাহা দূর করা। শাস্তি দিয়া মিথ্যা ভাষণ বন্ধ করার চেষ্টা ঠিক হইবে না, ইহার ফলে বরং তাহার ভয় বেশি হইবে এবং ভয় তাহার মিথ্যা ভাষণের প্রবণতা আরও বাড়াইয়া দিবে। আঘাত করিয়া আগুন নিভানো চেষ্টাই মতোই শাস্তিদিয়া মিথ্যা বলার অভ্যাস ত্যাগ করাইতে গেলে বিপরীত ফল ফলিবে।
শিশুদিগকে যদি মিথ্যা ভাষণ অভ্যাস করা হইতে বিরত রাখিতে চাহেন তবে তাহাদের সহিত ব্যবহারে বয়স্ক ব্যক্তিদের সত্যবাদিতা একান্তভাবে অপরিহার্য। যে পিতা-মাতা শিক্ষা দেন যে, মিথ্যা কথা বলা পাপ তাহাদের ছেলে-মেয়েরাই যদি তাহাদিগকে মিথ্যাবাদী বলিয়া জানে তবে সে পিতা-মাতার উপদেশ দিবার নৈতিক অধিকার থাকে না। সন্তান-সন্তুতির নিকট সত্যকথা বলার নীতিটা সম্পূর্ণ নূতন; বর্তমান প্রজাতির [Generation] পূর্বে বড় বিশেষ কেহ ইহা মানিয়া চলিতেন না; ইভ তাহার ছেলে Cain এবং Abel কে আপেলের সম্বন্ধে সত্য কথাটি বলিয়াছিলেন কি-না আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে; আমার বিশ্বাস তিনি বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার পক্ষে যাহা কল্যাণকর নয় এমন কোনও খাদ্য তিনি গ্রহণ করেন নাই। পিতামাতা সন্তানের নিকট নিজদিগকে সর্ব শক্তিসম্পন্ন, মানুষের স্বাভাবিক কাম, ক্রোধ প্রভৃতি রিপুর তাড়না হইতে মুক্ত এবং সর্বদা বিশুদ্ধ বিচারবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত বলিয়া জাহির করিতেন। শিশুদিগকে তিরস্কার করিবার সময় ক্রোধে অপেক্ষা দুঃখের ভাবই বেশি দেখাইতেন। যত গালমন্দই করুন না কেন তাহারা মেজাজ ঠিক রাখিয়া সন্তানদের মঙ্গলের জন্যই বলিতেছেন এরূপ ভাব দেখাইতেন। তাঁহারা বুঝিতেন না যে শিশুরা বিস্ময়করভাবে স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন; তাহারা ভাওতা বা ভণ্ডামির রাজনৈতিক কারণ বোঝে না কিন্তু ইহাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। আপনার যে হিংসা-বিদ্বেষ সম্বন্ধে আপনি নিজেই জানেন না তাহা শিশুদের নিকট সহজে ধরা পড়ে; ইহার পর আপনি হিংসা-বিদ্বেষের দোষ সম্বন্ধে শিশুদিগকে যতই উপদেশ দিন না কেন তাহারা কিছুই মানিবে না। কখনওই নিজেকে দোষত্রুটিশূন্য, অতিমানব বলিয়া ভান করিবেন না; ইহাতে শিশু আপনাকে বিশ্বাস করিবে না, পছন্দও করিবে না। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, অতি অল্প বয়সে আমি কেমন করিয়া আমার উপর প্রযুক্ত ভিক্টোরিয়া যুগের ভাওতা ভণ্ডামি বুঝিয়া ফেলিয়াছিলাম এবং প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যে, আমার যদি কখনো সন্তান-সন্ততি হয় তবে তাহাদের প্রতি আচরণে এইরূপ ভুল করিব না। যথাসাধ্য আমি এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিয়া চলিতেছি।
বয়স্কের পক্ষে আর এক প্রকার মিথ্যা হইল–শিশুকে যে শাস্তি দেওয়া হইবে না, তাহার ভয় দেখানো। ডক্টর ব্যালার্ড তাঁহার চিত্তাকর্ষক পুস্তক [The Changing School] এই নীতি বিশেষ জোরের সঙ্গে বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন : শাসাইবেন না। যদি শাস্তির ভয় দেখান তবে আপনাকে শাস্তি দিতেই হইবে। আপনি যদি ছেলেকে বলেন, আবার যদি এ কাজ করো তবে তোমাকে মেরে ফেলব এবং সে যদি সেই কাজ আবার করে তবে ছেলেকে হত্যা করিতেই হইবে। আপনি যদি তা না করেন, তবে ছেলে আপনার প্রতি সকল শ্রদ্ধা হারাইবেন। পরিচারিকা এবং অশিক্ষিত পিতা-মাতা শিশুদের সঙ্গে ব্যবহারে যে শাস্তির ভয় দেখায় তাহা হয়তো এমন চরম নয় কিন্তু এ ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য। বিশেষ যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকিলে শিশুকে দিয়া কোনও কিছু করাইবার জন্য জেদ করিবেন না কিন্তু একবার যদি জেদ শুরু করেন তবে (ফল যাহই হউক) শেষ পর্যন্ত আপনাকে ইহা বজায় রাখিতেই হইবে। যদি কোনও শাস্তির ভয় দেখান তবে আপনি যাহা প্রয়োগ করিতে প্রস্তুত আছেন সেইরূপ শাস্তির ভয় দেখাইবেন; আপনার শাস্তিদানের হুমকিতেই কাজ হইবে, বাস্তবিক শাস্তি দিতে হইবে না, এরূপ ধারণা করিবেন না। অশিক্ষিত জনসাধারণকে এই নীতি বুঝানো বড় কঠিন। পুলিশ লইয়া গিয়া আটকাইয়া রাখিবে; দৈত্য আসিয়া ধরিয়া লইয়া যাইবে, প্রভৃতি ধরনের অবাস্তব ভীতি প্রদর্শন বিশেষ আপত্তিজনক। ইহা প্রথমে শিশুর মনে নিদারুণ ভীতি সঞ্চার করে, পরে যখন বুঝিতে পারে যে সবই ভাঁওতা-মাত্র তখন বয়স্ক ব্যক্তিগণের কথা ও ধমকানির উপর তাহার আর কোনো আস্থা থাকিবে না। আপনি জেদ করিয়া শেষ পর্যন্ত শিশুকে আপনার মনোমতভাবে চলিতে বাধ্য না করান তবে সে শীঘ্ৰ বুঝিয়া ফেলিবে যে এইরূপ ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া নিষ্প্রয়োজন; সে বরং তৎক্ষণাৎ মুখে স্বীকার করিবে কিন্তু কার্যত কিছুই করিবে না। শাস্তির ভয় দেখাইয়া সংশোধন করিতে চাহিলে মনে রাখিতে হইবে যে বিশেষ উপযুক্ত কারণ না থাকিলে কখনওই শিশুকে ভয় দেখানো বা ধমকানো উচিত নয়।
আর এক ধরনের অবাঞ্ছনীয় ভাঁওতা হইল প্রাণহীন পদার্থের প্রতি জীবন্ত প্রাণীর মতো আচরণ করিতে শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু টেবিল বা চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়া আঘাত পাইলে তাহার পরিচারক পরিচারিকারা দুষ্ট টেবিল, দুষ্ট চেয়ার প্রভৃতি বলিয়া এইগুলিকে আঘাত করিতে শিখাইয়া দেয়। শিশুর আঘাত লাগার জন্য টেবিল বা চেয়ার যেন দায়ী এইরূপ ধারণা শিশুর মনে আনিয়া দেওয়া হইল। ইহার ফলে স্বাভাবিক উপায়ে শৃঙ্খলা বিধানের একটি অতি প্রয়োজনীয় সূত্র নষ্ট করিয়া ফেলা হয়। নিজের বুদ্ধিতেই শিশু অল্প দিনেই বুঝিতে পারে যে প্রাণহীন পদার্থের সঙ্গে রাগ খাটাইয়া বা তোষামোদ করিয়া কোনো লাভ নাই। এইগুলি নাড়াচাড়া করিতে নিজের শারীরিক পটুতা অর্জন করিতে হইবে। এই বোধ তাহাকে দৈহিক কৌশল বা পটুতা অর্জন করিতে উৎসাহ দেয় এবং শিশু নিজের ব্যক্তিগত ক্ষমতার সীমা কতদূর তাহা উপলব্ধি করিতে শেখে।
যৌন জীবন বা যৌন আচরণ সম্বন্ধে শিশুর নিকট মিথ্যা কথা বলা অনেক কালের রেওয়াজ হইয়া গিয়াছে। আমার কাছে ইহা অত্যন্ত অপকারী মনে হয়। পরবর্তী এক অধ্যায়ে যৌন শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হইবে।
যদি রূঢ় আচরণ দ্বারা শিশুদের কৌতূহল দমিত না হয় তবে তাহারা অসংখ্য প্রশ্ন করিবে, কতক প্রশ্ন হইবে বুদ্ধির পরিচায়ক, কতক বা ইহার বিপরীত। প্রশ্নগুলি প্রায়ই বিরক্তিকর, কখনো বা অসুবিধাজনক। তথাপি আপনার সাধ্যানুসারে ইহাদের সদুত্তর দিতে হইবে। কিন্তু যদি ধর্ম সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করে তবে এ সম্বন্ধে আপনার নিজের যাহা অভিমত তাহাই বলুন; ইহাতে যদি অন্য ব্যক্তির সঙ্গে মতের পার্থক্য প্রকাশ পায় তাহাতেও কিছু আসে যায় না। সে যদি এমন প্রশ্ন করে যাহার উদ্দেশ্য আপনাকে দুষ্ট বা বোকা বলিয়া প্রতিপন্ন করা, তাহারও উত্তর দিন। সে যদি যুদ্ধ অথবা মৃত্যুদণ্ড সম্বন্ধে প্রশ্ন করে, উত্তর দিন। কতক প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জটিলতা জড়িত থাকে–যেমন- বৈদ্যুতিক আলো কেমন করিয়া উৎপন্ন করা হয় ইত্যাদি। এই ধরনের কঠিন প্রশ্ন ছাড়া অন্য প্রশ্নের উত্তরে তুমি এখন সব বুঝতে পারবে না বলিয়া শিশুকে থামাইয়া দিবেন না। যদি কখনো এরূপ উত্তর দিতে হয় তবে তাহাকে বুঝাইয়া দিবেন যে, প্রশ্নের উত্তরটি খুবই আনন্দদায়ক; তাহার জ্ঞান আরও কিছু বেশি হইলে তবে সে ইহার আনন্দ উপলব্ধি করিতে পারিবে। কোনো প্রশ্নের উত্তরে শিশুকে কিছু বলিবার সময় কম না বলিয়া সে যাহা বুঝিতে পারে তাহার চেয়েও কিছু বেশি বলিবেন; যেটুকু সে বুঝিতে পারিল না তাহা তাহার কৌতূহল ও জ্ঞানবুদ্ধির বাসনা জাগাইয়া তুলিবে।
শিশুর সঙ্গে যদি সর্বদা সকল অবস্থাতেই সত্য কথা বলা যায় তবে ইহার সুফলস্বরূপ তাহার আস্থা এবং শ্রদ্ধালাভ করা যায়। আপনি যাহা বলিলেন তাহা বিশ্বাস করার প্রবণতাই শিশুর বেশি থাকে যদি না আপনার কথা তাহার কোনো প্রবল বাসনার বিরুদ্ধে যায়, যেমন হইয়াছিল ইস্টারের সময় খোকার চকোলেট খাওয়ার ব্যাপারে। একথা একটু পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। আপনার মন্তব্যের সত্যতা পরীক্ষিত হইলে সহজেই আপনি শিশুর বিশ্বাস উৎপাদন করিতে পারিবে। কিন্তু আপনি যদি মিথ্যা শাস্তির ভয় দেখান তবে শিশু আর সহজে ভীত হইবে না এবং আপনার কথামত চলিবেও না; তখন আপনাকে আরও বেশি কড়াকড়ি ও ভীতি প্রদর্শন করিতে হইবে; ফলে শিশুর অস্থিরচিত্ততা সৃষ্টি হইবে। একদিন আমার ছেলে স্রোতের জলের মধ্যে হাঁটিতে চায়। সেখানে ভাঙা কাঁচ। প্রভৃতির টুকরা থাকিলে তাহার পা কাটিয়া যাইতে পারে, এজন্য আমি তাহাকে বারণ করি। জলে নামার বাসনা তাহার এমন প্রবল হইয়াছিল যে, সে কাঁচের টুকরা সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া ওঠে কিন্তু আমি যখন একটি টুকরা পাইয়া তাহার ধারালো কিনারা দেখাইলাম তখন সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিল। আমি যদি আমার নিজের সুবিধার জন্য অর্থাৎ তাহাকে জলে নামা হইতে বারণ করার জন্য বাসনাপত্রের ভাঙা টুকরা আছে বলিয়া মিথ্যা ভাঁওতা দিতাম তবে সে আমার উপর বিশ্বাস হারাইত; সেখানে কোনো ভাঙা ধারালো টুকরা না পাইলে আমি তাহাকে নিশ্চয়ই জলে নামিতে দিতাম। এই ধরনের নানা পরীক্ষার ফলে শিশু আমার যুক্তি ও বিবেচনা সম্বন্ধে আর কোনও প্রকার সন্দেহ পোষণ করে না।
আমরা ছলনা ও প্রতারণাময় সংসারে বাস করিতেছি। যে শিশু ইহার আওতায় বর্ধিত হয় না সে সাধারণত যাহা শ্রদ্ধার যোগ্য বলিয়া অনেকে মনে করে তাহার ভিতরকার ভণ্ডামির জন্য অনেকে কিছুই ঘৃণা করিবে। কোনও কিছুর প্রতি ঘৃণার ভান পোষণ করা বাঞ্ছনীয় নয়। আমি এরূপ অবস্থার প্রতি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করার পক্ষপাতী নই, তবে সে যদি স্বেচ্ছায় জানিতে চায় তবে তাহার কৌতূহল নিবৃত্ত করিতেই হইবে। ভণ্ডামিপূর্ণ সমাজে জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা কতকটা বাধাস্বরূপ হয় বটে কিন্তু সত্যবাদিতাকে ভিত্তি করিয়া মানুষের যে নির্ভীকতা লাভ হয় তাহার মূল্য অনেক বেশি। আমাদের সন্তানগণ সৎ, সরল এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হউক ইহাই আমরা কামনা করি। আমি তো মনে করি এই সকল গুণে ভূষিত হইয়া তাহারা যদি কর্মক্ষেত্রে অকৃতকার্য হয় তাহা বরং ভালো তবু তাহারা যে ক্রীতদাসের কলাকৌশলে অর্থাৎ মিথ্যা, কপটতা ও ভণ্ডামির সাহায্যে কৃতকার্য হইবে তাহা চাই না। প্রত্যেক খাঁটি চমৎকার ব্যক্তির সততা এবং নিজের সততা সম্বন্ধে প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ থাকা উচিত। [এই গর্ববোধকে তুলনা করা চলে মাংসপেশির অভ্যন্তরস্থিত অস্থির সঙ্গে। শক্তি অস্থি দেহকে উন্নত ও দৃঢ় রাখে; অস্থিহীন প্রাণী উন্নত মস্তকে চলিতে পারে না। কিন্তু অস্থি যদি মাংস দ্বারা আবৃত না থাকে তবে অপরের সংস্পর্শে আসিলে তাহা অন্যকে রূঢ় আঘাত দেয়। বিনয় ও ভদ্রতারূপ মাংসপেশির আড়ালে অস্থিরূপ গর্ববোধ মানুষকে অনেক হীনতা ও নীচতা হইতে রক্ষা করে। এইরূপ গর্ববোধ থাকিলে বিশেষ কোনো মহত্তর উদ্দেশ্য ব্যতীত সে ব্যক্তির পক্ষে মিথ্যা কথা বলা অসম্ভব। আমি চাই আমার ছেলেমেয়েরা চিন্তায় ও বাক্যে সত্যবাদী হউক; ইহার জন্য যদি তাহাদিগকে জাগতিক ব্যাপারে দুর্ভাগ্য ভোগ করিতে হয় তাহাতেও আমি রাজি, কেন না সত্যকে পরিত্যাগ করা ধন, মান অপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান সম্পদ বিসর্জন দেওয়ারই শামিল।