৮. সঙ্গী যখন মিতি
রাত্রে ডাইনিং টেবিলে বসে যখন আমরা খাচ্ছি তখন মিতি আর তার মা আমাদের সাথে এসে বসলেন। আমি মিতির দিকে তাকিয়ে মোটামুটি চিৎকার করে বললাম, “এই যে মিতি!” তারপর তাকে একটা ফিস্ট বাম্প দিলাম।
মিতির মা হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, “মিতি বলেছে তুমি নাকি মিতির পাঁচ রকম চিকিৎসা করেছ?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “জি! আজকে সকালে মামী আমাকে এই পাঁচটা চিকিৎসা শিখিয়ে দিয়েছিলেন।”
মিতির মা বললেন, “খুবই ভালো চিকিৎসা হয়েছে। মিতি খুব খুশী!”
আমি বড়ো ডাক্তারের মতো মুখ করে বসে রইলাম। মিতি ফিক করে হেসে ফেলল। এই মেয়েটা নাকি কানে শুনতে পায় না কথা বলতে পারে না কিন্তু আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে সে সবকিছু বুঝতে পারে। কীভাবে সম্ভব?
মামী বললেন, “তুই মিতির চিকিৎসা করলি তাহলে জালালের ছোটো ভাইটার চিকিৎসা করলি না কেন? তার তো খারাপ অবস্থা। বমি টমি করে কেবিন ভাসিয়ে দিয়েছে। এখনো বিছানায়।”
জালালের ছোটো ভাই মানে নিশ্চয়ই জহির–আমি বললাম, “আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার কোনো কথা শুনতে রাজী হয় নাই। উলটা আমাকে গালিগালাজ করেছে। মারতেও চেয়েছে।”
মামী মাথা নাড়লেন, বললেন, “রোগী যদি ডাক্তারকে মারতে চায়। তাহলে অবশ্য চিকিৎসা করা কঠিন।”
মিতি হাসল। তার মানে মামীর কথাও সে বুঝতে পারছে? কী আজব!
মিতির মা আমার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে আমাকে ছুঁলেন, তারপর বললেন, “থ্যাংক ইউ টুলু। তুমি মিতির সি সিকনেসের চিকিৎসা করেছ সেজন্য না। জাহাজে আসবে আর একটু সি সিকনেস হবে না সেটা তো হয় না। তোমাকে অন্য একটা জিনিসের জন্য থ্যাংক ইউ।”
আমি একটু অবাক হলাম, জিজ্ঞেস করলাম, “কোন জিনিসের জন্য?”
“তোমার ম্যাচুরিটির জন্য।”
আমি একটু বিষম খেলাম, বলার চেষ্টা করলাম, “ম্যা ম্যা ম্যা–” একেবারে ছাগলের ডাকের মতো শোনাল।
মিতির মা বললেন, “হ্যাঁ। মিতির এই প্রবলেমের জন্য কেউ তার সাথে ঠিক করে ব্যবহার করতে পারে না। হয় তাকে তাচ্ছিল্য করে, মিতি মনে কষ্ট পায়। না হয় তাকে করুণা করে তখন মিতি আরও বেশী কষ্ট পায়। তুমি তার সাথে একেবারে পারফেক্ট ব্যবহার করেছ–এক বিন্দু বেশী কিংবা কম করো নাই। আমার মেয়েটা তোমার ব্যবহারে মুগ্ধ—”
মিতি একটু লজ্জা পেল, কনুই দিয়ে তার মাকে ছোটো একটা ধাক্কা দিল। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম তার মায়ের কথা বুঝতে পেরেছে। কীভাবে সম্ভব?
আমি মিতির মায়ের কথায় কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। বললাম, “ইয়ে তার মানে আসলে আমি মানে যেটা হয়েছে আসলে কিন্তু কিন্তু–” যখন কোনোভাবেই বাক্যটা পুরো করতে পারলাম না, তখন হাল ছেড়ে দিয়ে আবার আমি আমার মার্কা মারা বেকুবের হাসি দিয়ে বসে থাকলাম।
মামী আমার দিকে তাকালেন, বললেন, “ভেরি গুড টুলু।”
আমি তখন বললাম, “কিন্তু মিতি তো সব কথা বুঝতে পারে।”
মিতির মা মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ। মিতি লিপ রিডিং করতে পারে।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী করতে পারে?”
“লিপ রিডিং। মানে ঠোঁট নাড়ানো দেখে কথা বুঝতে পারে।”
“সত্যি? খোদার কসম? এটা কীভাবে সম্ভব?”
মিতির মা মাথা নাড়লেন, “সম্ভব। মানুষ প্র্যাকটিস করে কী না করতে পারে!” মিতির মা মিতির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাই না আম্মু?”
মিতি মাথা নাড়ল, একটু হাসল। আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে একজন মানুষ শুধুমাত্র ঠোঁট নাড়াচাড়া দেখে সব কথা বুঝে ফেলতে পারে! কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারলাম যে প্রত্যেকবার যখন কেউ কথা বলে তখন কেন মিতি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তখন তার লিপ রিডিং করে! আমার তখন হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল, বললাম, “তার মানে, তার মানে–মিতি অনেক দূর থেকে শুধু কারো ঠোঁট নাড়া দেখে তার কথা বুঝে ফেলবে! তার কাছে যেতেও হবে না?”
মিতি আমার প্রশ্নটা বুঝে গেল, একটু হাসল তারপর একটুখানি মাথা নাড়ল, হাত দিয়ে দেখাল, অল্প একটু।
আমি বললাম, “কী আজব! কী ডেঞ্জারাস!” তারপর অনেক দুরে বসে থাকা দুজনকে দেখিয়ে বললাম, “বলো দেখি ঐ দুজন কী বলছে।”
মামী বললেন, “দেখ টুলু এগুলোতে কারো প্রাইভেসি নষ্ট হতে পারে। হয়ত ব্যক্তিগত কথা বলছে—”
“হোক ব্যক্তিগত! শুনতে ক্ষতি কী?”
মিতি তাকাল তারপর হঠাৎ ভুরু কুঁচকাল, মাথা নাড়ল, কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে বুঝতে পারলাম। তার বুকে গুঁজে রাখা নোটবই আর কলমটা বের করে খাবার মাখা হাতের আঙুল দুটো কীভাবে জানি ভাঁজ করে কলমটা ধরে লিখল,
‘গলদা চিংড়ির ব্যাটারি চার্জ?
আজব কথা। অর্থ নাই কথা–’
.
আমি বললাম, “অর্থ আছে। এই জাহাজের রোবটের নাম গলদা চিংড়ি। তাই না মামী?”
মামী মাথা নাড়লেন, হাসলেন, তারপর বললেন, “এখন বেচারিকে খেতে দে, সে খেতেই পারছে না তোর যন্ত্রণায়।”
আমি বললাম, “এরকম আজব মানুষ হলে খাওয়ার সময় তার একটু সহ্য করতে হবে।”
মামী বলল, “অনেক দিন পাবি তাকে জ্বালাতন করতে–আজকে মাত্র প্রথম দিন!”
আমি বললাম, “তার মানে মিতির ক্ষমতা আমরা যারা কানে শুনি তার থেকে বেশী?”
মিতির মা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “সবসময় না। স্পিকারে গান বেচারী এনজয় করতে পারে না, গিটার সেতার বাঁশী এগুলোও শুনতে পারে না—”
মামী বললেন, “ব্যস! একদিনের জন্য অনেক অ্যানালাইসিস হয়েছে এখন আমরা মিতিকে খেতে দিই।”
কিন্তু আমি এত অবাক হয়েছি যে তাকে এখনই খেতে দিলাম না, বললাম, “সে তো সাইন ল্যাংগুয়েজ কথা বলতে পারে হাত নেড়ে নেড়ে–”
মিতুর মা বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা তো ওদের মতন যারা তারা সবাই পারে। পারতে হয়। মিতু তার গলা দিয়ে কথা বলা শিখছে। আমাদের মতন।”
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “সত্যি?” এত জোরে বললাম যে অনেকে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ। তবে গলার স্বরটা এখনো স্বাভাবিক মানুষের মতো হয়নি তাই বলতে চায় না।”
“কেন বলতে চায় না?” আমি মিতির দিকে তাকালাম, বললাম, “মিতি, একটু কথা বলবে?”
মিতি মাথা নাড়ল, সে বলতে চায় না। আমি বললাম, “শুধু একবার, একটা কথা! প্লিজ। প্লিজ।”
মিতি তার মায়ের দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে তাকাল তারপর বলল, “কী কথা বলব?”
কথাটা একটু অন্যরকম বারো তেরো বছরের মেয়ের মতো না, কেমন যেন খসখসে বলেছে থেমে থেমে কিন্তু পরিষ্কার কথা। আমি অবাক হয়ে কপালে হাত দিলাম এবং হঠাৎ মনে পড়ল হাতে ডাল এবং ঝোল। কপাল মাখামাখি হয়ে গেছে।
মিতি হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল, তার হাসিটা অবশ্য একেবারে খাঁটি বারো তেরো বছরের মেয়ের মতো, মোটেও অন্যরকম না!
.
রাত্রে আমি যখন শুয়েছি মামী তখন ছেলেদের মতো পায়জামা আর কুর্তা পরে আধশোয়া হয়ে একটা বই নিয়ে বসলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “লাইট জ্বালানো থাকলে তোর ঘুমাতে অসুবিধা হবে?”
“না। আমার কখনো অসুবিধা হয় না। আপু তোমার মতন রাত জেগে পড়ে।”
“তুই পড়িস না?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “মাঝে মাঝে পড়ি।” আসলে কখনোই পড়ি নাই, তাই মিছে কথাটা বলে একটু খারাপ লাগল। শেষ পর্যন্ত সত্যি কথাটা বলেই ফেললাম, “আসলে পড়ি না মামী! আমার বই পড়তে ভালো লাগে না। কঠিন লাগে।”
“কঠিন লাগে? সোজা বই পড়লেই পারিস।”
“ঠিক আছে।”
“তোকে অনেকগুলো বইয়ের নাম লিখে দেব, পড়িস সেগুলো।”
“ঠিক আছে মামী, তুমি বললে নিশ্চয়ই পড়ব।”
“অন্য কেউ বললে পড়বি না!”
“নাহ।” এবারে সত্যি কথা বলে শান্তি পেলাম।
আমি প্রথমে ডান কাত হয়ে শুলাম, বেশী সুবিধা হলো না, তখন বাম কাত হয়ে শুলাম তখনো সুবিধা হলো না। তখন চিত হয়ে শুয়ে দেখলাম তাতেও সুবিধা হলো না, উপুড় হয়ে শুয়ে দেখব কিনা চিন্তা করছিলাম তখন হঠাৎ টের পেলাম বাসা থেকে বের হয়েছি মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা হয়েছে এর মাঝে কত কী হয়ে গেছে! মনে হচ্ছে কতদিন পার হয়ে গেছে। তার চাইতে বড়ো কথা আমি এখন মাটির ওপরে নাই। কী আশ্চর্য! আমি একটা জাহাজের ওপর শুয়ে আছি। নিচে অতল পানি সেই পানিতে হাঙর তিমি অক্টোপাস আরও কত কী! জাহাজটা চলছে তো চলছেই, চলায় আর শেষ নাই কী রহস্যময় একটা ব্যাপার!
চিন্তা করতে করতে উপুড় হয়ে শোয়ার আগেই কখন জানি ঘুমিয়ে গেলাম।
.
সকালে ঘুম ভাঙার পর মনে হলো কিছু একটা অন্যরকম, ঠিক কোন ব্যাপারটা অন্যরকম বুঝতে একটু সময় লাগল, প্রথমে বুঝলাম আমি আমার ঘরে আমার বিছানায় শুয়ে নাই, আমার পাশে পিলু শুয়ে নাই এবং একটু পরে পরে আমার ওপরে তার পা তুলে দিচ্ছে না! (আমি যখন এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলি তখন অবশ্য পা না বলে ঠ্যাং’ শব্দটা ব্যবহার করি।) যখন বুঝতে পারলাম আমি জাহাজে কেবিনে শুয়ে আছি তখনো মনে হলো কিছু একটা অন্যরকম। তখন বুঝলাম জাহাজটা চলছে না, এটা থেমে আছে জাহাজের ইঞ্জিনের কাঁপুনিটা নাই। পাশের কেবিনে মামী নাই তাই কেন থেমে আছি জিজ্ঞেস করতে পারলাম না ।
আমি উঠে বসে বাইরে তাকালাম এবং আমার ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো, যতদূর তাকাই শুধু পানি আর পানি। এর আগে কখনোই এরকম কিছু আমি দেখি নাই, যেদিকে তাকাই যতদূরে তাকাই শুধু পানি, কী আশ্চর্য!
আমি উঠে কেবিন থেকে বের হয়ে দাঁড়ালাম, তখন দেখলাম মামী হেঁটে আসছেন, এর মাঝে মামী পুরোপুরি রেডি হয়ে গেছেন। আমাদের বাসায় যখন মামী আসেন তখন সবসময় শাড়ীর সাথে বুট জুতো পরে আসেন, এখানে মামীর কাজকর্ম অন্যরকম পোশাকটাও ভিন্ন! আমাকে দেখে বললেন, “ঘুম ভেঙেছে?”
“হ্যাঁ মামী।”
ভালো ঘুম হয়েছে? “হ্যাঁ মামী।”
“ঘুমের মাঝে কার সাথে এত কথা বলিস?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কথা বলেছি? ঘুমের মাঝে?”
“হ্যাঁ।”
“কার সাথে?”
মামী বললেন, “আমি কেমন করে বলব, স্বপ্নে তোর সাথে কে দেখা করতে আসে। ঠ্যাং নিয়ে কিছু একটা সমস্যা!”
“পিলু, নিশ্চয়ই পিলু। ঘুমের মাঝে সবসময় আমার ওপর ঠ্যাং তুলে দেয়!”
মামী হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, “বেচারা পিলু, এখানে নাই তারপরেও তোর ঝাড়ি খেলা।
“স্বপ্নে খেয়েছে মামী। এটাতে সমস্যা নাই।”
মামী কেবিনে ঢুকে গেলেন, আমি বললাম, “জাহাজটা এখানে থেমেছে কেন?”
“এটা আমাদের একটা পয়েন্ট! কিছু স্টাডি করা হবে, ডাটা নেওয়া হবে। ছবি ভিডিও তোলা হবে–আমি সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকব। বুঝলি?”
“বুঝেছি।”
“নিজে নিজে থাকতে পারবি না?”
“পারব।”
“চকলেট খেয়ে পেট ভরাবি না। ঠিকভাবে ব্রেকফাস্ট করবি লাঞ্চ করবি। ডিনারের সময় আমি থাকব।”
“তুমি কোথায় যাবে?”
“এই তো–” বলে মামী একটু হাসার ভঙ্গী করলেন, বুঝলাম ঠিক বলতে চাইছেন না, আমি তাই আর জানতে চাইলাম না।
মামী ব্যাকপেক থেকে কিছু জিনিসপত্র বের করলেন, ল্যাপটপে কিছু দেখলেন তারপর আবার বের হয়ে গেলেন।
আমি হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নিচে ডাইনিং রুমে গেলাম নাস্তা করতে। কী নাস্তা করব সেটা কখনোই আমার ঠিক করতে হয় নাই। সকালে আম্মু কোনো একটা নাস্তা আমাদের খেতে দেন। যেটাই খেতে দেন সাধারণত সেটা নিয়েই আমি একটু ঘ্যানঘ্যান করি। আজকে অন্য ব্যাপার কয়েক ধরনের নাস্তা আছে, কোনটা খাৰ আমাকে সেটা ঠিক করতে হবে। সেটা নিয়ে কারো কাছে ঘ্যানঘ্যানও করতে পারব না, নাস্তা করার আনন্দটাই মাটি।
আমি মনে মনে চাইছিলাম মিতি যেন থাকে কিন্তু ডাইনিং রুমে সে নাই। যে দুই চারজন আছে তারাও খুব ব্যস্তভাবে নাস্তা করছে। সবার মাঝেই কেমন যেন তাড়াহুড়া। আমি প্লেট নিয়ে গেলাম, কয়েক রকম নাস্তা আছে কোনটা নিব নাকি সবকিছুই নিব সেটা নিয়ে চিন্তা করছি তখন কে যেন আমার প্লেটে খপ করে এক খাবলা খিচুড়ি দিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে সামনে তাকালাম, জাহাজের বাবুর্চি হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে। আছে, বলল, “খেয়ে দেখো। ফার্স্ট ক্লাস।” তারপর বালিশের মতো একটা ডিম ভাজা দিয়ে দিল। সাথে উপদেশ, “বেশী করে খেতে হবে। এই বয়সে হাড্ডিতে ক্যালসিয়াম দরকার।”
“হাড়িতে ক্যালসিয়ামের সাথে খিচুড়ি আর বালিশের সাইজের ডিম ভাজার কী সম্পর্ক আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু শরীরে ক্যালসিয়ামের পর ম্যাগনেসিয়াম সোডিয়াম এগুলোর জন্য প্লেটে আরও কিছু দিয়ে দেয় কিনা সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি সরে এলাম। একটা কোনায় জানালার কাছে ডাইনিং টেবিলে বসে এদিক সেদিক তাকালাম তখন দেখলাম জহির আরেকজনের সাথে ডাইনিংরুমে ঢুকছে। একদিনে জহির কাবু হয়ে গেছে, চোখ গর্তের ভেতর, তার সাধের চুলগুলি কেমন যেন নেতিয়ে গেছে, মুখটা ফ্যাকাশে, গায়ের কাপড় ব্র্যান্ডের কিনা বোঝা গেল না। সাথে নিশ্চয়ই তার ভাই, জহিরকে রীতিমতো ঠেলেঠুলে নাস্তার ট্রের দিকে নিয়ে গেলেন। বোঝা গেল তার খাওয়ার রুচি নাই। নাস্তা নিয়ে আবার আমার সাথে না বসে যায়, তাই আমি তাড়াতাড়ি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। এখনো আমাকে খুন করে ফেলতে চাইছে কিনা কে জানে!
জহির আমার সাথে বসার চেষ্টা করল না, অন্য একটা টেবিলে তার ভাইয়ের সাথে বসল। বোঝা যাচ্ছিল তার খাওয়ার রুচি নাই, প্লেটের খাবার হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার ভাই নিশ্চয়ই খাওয়ার জন্য জোর করছে।
আমি কোনোমতে বাবুর্চির “ফার্স্ট ক্লাস” খিচুড়ি শেষ করে বের হয়ে এলাম। বোঝাই যাচ্ছে জাহাজে উত্তেজনা, সবাই হাঁটাহাঁটি করছে, একটা বোট পানিতে নামানো হয়েছে। সেখানে একজন বোটের ইঞ্জিনটা পরীক্ষা করে দেখছে। লোকজন কথা বলছে, ডাকাডাকি করছে। নানা রকম যন্ত্রপাতি বোটে তুলছে। দেখলাম কয়েকজন ধরাধরি করে গলদা চিংড়িকেও নিয়ে আসল।
হঠাৎ টের পেলাম পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, তাকিয়ে দেখি মিতি। তাকে দেখেই আমি খুশী হয়ে উঠলাম, সে যেহেতু ঠোঁট দেখে কথা বুঝতে পারে তাই তার সাথে কথা বলতে সমস্যা নাই, বললাম, “কী খবর মিতি?”
মিতি হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল খবর ভালো।
“নাস্তা করেছ?”
মিতি মাথা নাড়ল।
“শরীর ভালো আছে?”
মিতি আবার মাথা নাড়ল।
ঠিক তখন বারান্দা দিয়ে দুজন হেঁটে আসল, কালো রবারের মতন পোশাক পরা, পেছনে অক্সিজেন সিলিন্ডার। কপালের ওপর একটা গগলস। তার মানে এরা স্কুবা ডাইভার, সমুদ্রের নিচে যাবে। কী সাংঘাতিক! মানুষ দুজন আমাদের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় একজন আমার মাথায় হাত দিয়ে
আমার চুলগুলো এলোমলো করে দিয়ে গেল। আমি তখন মানুষটাকে চিনতে পারলাম, নীরা মামী!
আমি চিৎকার করে বললাম, “মামী!” মামী দাঁড়ালেন, বললেন, “কী হলো? চাঁচাচ্ছিস কেন?”
“তুমি? তুমি স্কুবা ডাইভিং করো?”
“কেন? সমস্যা আছে?”
“না মামী—কিন্তু—মানে—” আমি আবার আমার বাক্য শেষ করতে পারলাম না।
মামী বললেন, “তুই ভালো ছেলের মতো থাকবি। কাউকে ডিস্টার্ব করবি না।”
মামী হেঁটে চলে যাচ্ছিলেন, আমি তখন আবার মামীকে ডাকলাম, “মামী, মামী!”
মামী থামলেন, “কী হলো?”
“তুমি আমাকে স্কুবা ডাইভিং শিখাবে?”
মামী হেসে ফেললেন, বললেন, “ঠিক আছে, সময় হলেই শিখাব।” তারপর হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে জাহাজের পাশে বোটের দিকে এগিয়ে গেলেন।
মিতি তার বুক থেকে নোট বই আর কলমটা বের করে কুটকুট করে লিখল, তোমার মামী চমৎকার মানুষ।
আমি পাশে লিখলাম, এবং ফাটাফাটি।’
আমার হাতের লেখা জঘন্য, তারপরেও মিতি পড়ল এবং মাথা নাড়ল তারপর লিখল, এবং অসাধারণ।
ঠিক এই সময় জহির আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল, নির্জীবের মতন মিতির নোট বইটা দেখল তারপর পিচিক করে থুতু ফেলল। বলল, “কোন দুঃখে যে এখানে এসেছিলাম!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন? কী হয়েছে?”
জহির বলল, “আসার পর থেকে শরীর খারাপ। বমি আর বমি।”
আমি বললাম, “এখন জাহাজ থেমে আছে। জাহাজ দুলছে না। তোমার শরীর ভালো হয়ে যাবে।”
জহির আমার কথা শুনল কিনা বুঝতে পারলাম না, শুনলেও বুঝল কিনা কে জানে। সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চারিদিকে তাকিয়ে দেখ। দেখার মতো কিছু আছে? খালি পানি আর পানি। পানি আর কত দেখব? পানি দেখতে হলে জাহাজে করে সমুদ্রে আসতে হয়? ঘরে বসেই বাথরুমে গেলে পানি দেখা যায়। ট্যাপ খুললেই পানি।”
ট্যাপের পানি আর সমুদ্রের পানি যে এক ব্যাপার না সেটা বলব কিনা চিন্তা করলাম কিন্তু কিছু বললাম না। জহির বড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, “ভাবছিলাম আমার বয়সী ছেলেমেয়ে আসবে পার্টিফাটি করব। সারারাত তাস খেলব—”
“তাস?”
জহির আমার কথার উত্তর দিল না, বলল, “আর শালার এইখানে ছেলেমেয়ে বলতে তোরা দুইজন, একটা বোবা আরেকটা ঘাড়ত্যাড়া। দুইটাই আন্ডা বাচ্চা।”
জহিরের কথা শোনার আমার আর কোনো আগ্রহ নাই কিন্তু জহির কানের কাছে দাঁড়িয়ে ভ্যাদর ভ্যাদর করে যেতে লাগল, “খাবারের নমুনা দেখেছিস? ফ্রাইড চিকেন নাই বার্গার নাই, পিৎজা নাই খালি মাছ মাংস ভাত রুটি–এইটা খাবারের নমুনা হলো?”
আমি কিছু বললাম না, ইচ্ছা করলে বলতে পারতাম যে বাবুর্চি আমাকে বলে রেখেছে আমি যেটা খেতে চাই সেটা রান্না করে খাওয়াবে।
জহির ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, “গত দুই দিন একটা সিগারেট পর্যন্ত খেতে পারছি না—”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি সিগারেট খাও?”
“খাই তো খাই? তোর কী?”
“এই জাহাজে একটু পরে পরে লেখা আছে, ধূমপান নিষেধ।”
“এরা লিখছে বলে আমি সিগারেট খেতে পারব না? আমি কি এদের। বাপের চাকরি করি?” কথা শেষ করে জহির অশ্লীল একটা কথা বলল, ভাগ্যিস মিতি সমুদ্রে বোটের দিকে তাকিয়েছিল তাই তার জহিরের অশ্লীল কথাটা বুঝতে হলো না।
জহিরের কাছ থেকে সরে যাওয়ার জন্য আমি মিতিকে বললাম, “চলো, আমরা ছাদে গিয়ে ভালো করে দেখি।”
জহির বলল, “কার সাথে কথা বলিস? এই মেয়ে বোবা, কানে শুনে।”
“তোমার থেকে ভালো শুনে।”
মিতি সামনের দিকে হাঁটতে লাগল, হঠাৎ থেমে গিয়ে, তার নোট বইটা বের করে বলল, আমি আমাদের বাইনোকুলারটা নিয়ে আসি।
আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, “ইয়েস! ভেরি গুড।”
একটু পরে আমরা জাহাজের ছাদে উঠে বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে লাগলাম। বোটটা অনেক দূরে গিয়ে থেমেছে। সেখানে যন্ত্রপাতি নামাচ্ছে। কয়েকজন মিলে গলদা চিংড়িকে পানিতে নামিয়ে দিল, সেটা বোটটা ঘুরে এসে আস্তে আস্তে পানিতে তলিয়ে গেল তখন মামী বোটের পাশে বসলেন।
মামী পায়ে দুটো ফিন লাগালেন, দেখে মনে হতে লাগল ব্যাঙের পা! গগলসটা চোখের ওপর টেনে দিলেন। মুখে একটা টিউবের মতো কিছু একটা লাগালেন, এটা দিয়ে নিশ্চয়ই নিঃশ্বাস নেয়। আমি ভেবেছিলাম নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেয় কিন্তু দেখতে পাচ্ছি মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়।
মামী তারপর বোটের পাশে বসে পানির মাঝে শুয়ে পড়লেন। তার পা দুটো একমুহূর্তের জন্য দেখা গেল তারপর মামী পানিতে তলিয়ে গেলেন। এখন নিশ্চয়ই মামীর সামনে পানির নিচের একটা আজব জগৎ! কোনো বিপদ হবে না তো?
আমি মনে মনে খোদার কাছে দোয়া করলাম। শুধু নিজের দরকারের সময় খোদাকে ডাকি, সেজন্য খোদা আমার ওপরে বিরক্ত হয়ে আছেন কিনা কে জানে।
দিনের বেশীর ভাগ সময় জহির ডেকে মুখ ভোঁতা করে শুয়ে রইল। আমি আর মিতি পুরো জাহাজে ছোটাছুটি করে বেড়ালাম। ল্যাবরেটরির ভেতরে দুজন উঁকিঝুঁকি মারছিলাম বলে একজন সায়েন্টিস্ট আমাদের ভেতরে ডেকে নিয়ে সবকিছু দেখাল। বিশাল স্ক্রিনে সমুদ্রের তলাটা দেখা যাচ্ছে। নানারকম গাছ, মাঝে মাঝে কোনো একটা মাছ লাট সাহেবের মতো আস্তে আস্তে যাচ্ছে। নানারকম যন্ত্রপাতি নানারকম শব্দ করছে। কয়েকজন কম্পিউটারের স্ক্রিনের সামনে, প্রিন্টার প্রিন্ট করছে। সবকিছু মিলিয়ে একটা হুলুস্থুল অবস্থা। আমরা দেখি আর অবাক হয়ে যাই।