সকালে চায়ের পেয়ালায় দুধ ঢেলে চিনির পট হাতে নিয়ে অত্যন্ত সহজ সুরে, যেন কিছুই হয়নি এমনি কণ্ঠে শুধালো তাহমিনা, কচামচ চিনি দেব?
একটা।
এখনো চিনি কম খাও? আশ্চর্য।
কিশোরী–কুমারীর মত সুন্দর হাসি মাখল ও সারা মুখে। রিনটিন চুড়ি বাজলো চিনি নাড়তে গিয়ে। বুকের শাড়ি একটু নত হল সমুখের দিকে।
ফারুক বিস্মিত হলো। গত রাতের সমস্ত কিছু, বিশেষ করে মাঝরাতের সেই ঘটনা, এখন তার কাছে বিরাট এক অবাস্তব স্বপ্ন বলে মনে হলো। দিনের আলো বড় উজ্জ্বল আর প্রখর। দিনের আলোয় কত সহজ হয়ে এসেছে পৃথিবী। আর তাহমিনারও যেন কিছু মনে নেই, সব ভুলে গেছে। হাসছে। যেন এই প্রথম দেখা হলো। যেন এই হঠাৎ তাদের মুখোমুখি।
খাবার ঘরে টেবিলের দুপ্রান্তে দুজন বসে। মাথার ওপরে সৌখিন রংবাতির ঝাড়। কালো কাঁচে ঢাকা সমস্তটা টেবল–টপ। তার মাঝামাঝি ছায়া উল্টো হয়ে এসে পড়েছে রংবাতির। উবু হলে মনে হয় নিমেষে পায়ের তলায় যেন সারা সিলিং চলে এসেছে। তাহমিনা চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে দেখল তারো এক অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি পড়েছে টেবিলের ওপর। ফারুকেরটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।
তাহমিনা ভাবল, ফারুক কি ভাবছে এখন? একবার তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আঁচ করতে চাইল কিছু। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না। ফারুক নিশ্চিন্ত মনে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। একবার ভ্র তার কুঁচকে এলো। কি হলো? না, কিছু না। তিন বছরে বলিষ্ঠতর হয়েছ তার দেহ। দিনের আলোয় সে দেখল, মুখে তার আত্মবিশ্বাস আর পৌরুষত্বের রেখা। তার নিজের চিঠির কথা মনে পড়ল। ভীষণ লজ্জ্বা হলো। ছি, ছি, ফারুক হয়ত কী না কী ভেবেছে। এতটা উন্মাদ সে হয়ে গিয়েছিল কী করে। তারপর কি ভেবে তাহমিনা মন থেকে এখন মুছে ফেলতে চাইল এই ভাবনা। সে দৃঢ়া হলো। ফারুক বলল, কি ভাবছ?
কই, কিছু নাতো। এমনি। ঢাকার খবর কী?
ভালো।
অনেকদিন যাইনি, একবার যেতে ইচ্ছে করছে।
গেলেই তো পার।
কই আর পারি!
তাহমিনা হাসল। তারপর বলল শেষ যেবার ঢাকা গিয়েছিল সেই গল্প। ফারুক ধরালো সিগারেট। তাহমিনা শুধালো, আমাদের ওখানে যাও?
না।
ও।
অন্যমনা সুরে অনুমোদন করল তাহমিনা।
তুমি আজকাল কি করছ? তোমার মা?
ভালোই আছেন। তবুও বুড়ো মানুষ তো?
সেতো ঠিকই। আর তুমি?
জার্নালিজম করছি।
তাই নাকি? তোমার তো ওদিকে ন্যাক ছিলো। কোন কাগজে আছো?
ইংরেজি কাগজে। সম্পাদকীয় লিখি। ফরুক দৈনিকের নামটা বলল। তারপর একটু পরে, ছুটি নিয়ে এসেছি। এর আগে ছুটি নেবার বড় একটা দরকার হয় নি। বলেই বিসদৃশভাবে কথাটা গুটিয়ে নিল। এবথা তো তাহমিনা শুনতে চায় নি। তাহমিনার দিকে চোর চোখে সে তাকাল। তারপর মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্য বলল, ও গুলোই বুঝি সুন্দরী গাছ, না?
বাইরে, দূরে যেখানে কাল বাতে অন্ধকার দেয়ালের মত মনে হয়েছিল, এখন সেখানে লম্বা মাথা উঁচু গাছের সার চোখে পড়ল। তবু এমন কিছু ঘন নয়। প্রায়ই কেটে ফেলা হয়েছে। অনেকদি আগে–কাটা গুঁড়ির মুখ চকলেটের মত তামাটে হয়ে গেছে। আর ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। তাহমিনা সেদিকে তাকিয়ে তার উত্তর করল, হ্যাঁ। বোধহয়।
আর রাস্তাটা?
অনেকদূর চলে গেছে ভেতরে। আমি একবারই মাত্র গিছলুম—-দুমাইল হবে। বারান্দায় দাঁড়ালে দেখতে পেতে ওই পথের ওপরে কাছেই আশরাফ সায়েবদের বাড়ি।
ও। বেশ লোক কিন্তু।
হুঁ।
তোমাদের আবদুলটি কিন্তু বিনয়ের অবতার।
তাহমিনা একটু হাসল, হুঁ তাই। চব্বিশ পরগনায় দেশ ছিল। রিফুজি হয়ে এসেছে। অত্যন্ত নিচু কাটা কাটা সুরেলা সুরে কথা বলছে ও। নিজের কানেই বড় ভালো লাগছে সেই সুর। সে এবার শুধালো ঘাড় একটু বাঁকিয়ে কানের লতিতে মৃদু চাপ দিয়ে, কেমন লাগছে তোমার জায়গাটা?
ভালো, খুব ভালো।
কিন্তু তারপরেই ফারুকের মনে হোলো বড় কম বলা হোলো। তাই আবার বলল অদ্ভুত এক ধরনের ভাঙা আর গম্ভীর গলায়, নতুন পৃথিবীতে এসেছি যেন! এত সবুজ, আর এতো আলো আমি আর কোনদিন দেখিনি। আমার কেমন ভালো লাগছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে, ফারুকের এই কথা উচ্চারণ করবার পর, দ্রুত শূন্য দৃষ্টিতে তাহমিনা উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। চকিতে বিরাট ছায়া পড়ল টেবিলের ওপর তার নাভিমূল অবধি। ডাকল আবদুল,আবদুল।
জি মেমসাব।
আবদুল অদৃশ্য সাবানে হাত ধুতে ধুতে এসে দাঁড়াল।
টেবিল সাফ করো। চলো, তুমি না বাংলো দেখতে চেয়েছিলে ভোরে। এসো আমার সাথে। ফারুক উঠে দাঁড়াল। তারপর সামনের প্রশস্ত বারান্দা হেঁটে ডান দিকের করিডর পেরিয়ে পেছনের বারান্দায় এলো। পাশাপাশি, কিছুটা সমুখে তাহমিনা। মসৃণ সুডৌল শখসাদা পায়ে কালো চিকন ফিতের চটি। হাটবার ভন্দিতে মন্থর ঢেউ উঠছিল সারা শরীরে। মিলিয়ে যাচ্ছিল। ফারুক বলল, কাঠের বাংলো এতবড় হয়, এর আগে আমি জানতাম না।
হ্যাঁ তা বড় বৈকি?
সত্যিই যথেষ্ট বড় বাংলো। লাল রং টিনের ছাদ দেয়া। সমুখে সবটা দৈর্ঘ্য জুড়ে বিশাল প্রশস্ত বারান্দা। বাঁ দিকে একটা সরু প্যাসেজ আছে। আর ডান দিকে আরো কিছুটা চওড়া করিডর। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে প্রথমেই তাহমিনাদের কামরা। তারপরে ডাইনিং হল। বসবার ঘর। তার এক কামরা পরে ফারুকের শোবার ব্যবস্থা হয়েছিল। এর পাশ দিয়ে করিডরটা ভেতর দিকে চলে গেছে। শেষ প্রান্তে বাথরুম। তারপরেই বাঁ হাতে ঘুরলে ভেতর দিকের বারান্দা। এদিকে সমুখের দুটো কামরার প্রশস্ত জুড়ে একটা কামরা। তালাবন্ধ। তারপরে খাবার ঘরে ঢুকবার দরজা। তারপর আবার তাহমিনাদের কামনা করিডরের মুখ বন্ধ করে। দিয়েছে। এই পেছনের বারান্দা থেকে সরু শেড় দেয়া প্যাসেজ চলে গেছে দূরে রান্নাঘরে। ওর পাশেই ছোট ছোট দুটো কুঠিতে খানসামাদের থাকবার ব্যবস্থা।
আগাগোড়া বাংলোর বার দিকটা বটল গ্রীন রংয়ে পেন্ট করা। ভেতরে ক্রীম। তাহমিনা প্রায় সবকটা কামরাই দেখাল। টুকরো টুকরো মন্তব্য করল মাঝে মাঝে ফারুক। তারপর পেছনের বারান্দায় দাঁড়াল ওরা একটুখন। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে রান্নাঘরে কয়েকজন বাবুর্চি রান্না করছে। আবদুল মাঝে মাঝে গিয়ে তদারক করছে তাদের। সবশুদ্ধ বুঝি প্রায় পাঁচ ছজন হবে। ফারুক তাহমিনার দিকে তাকাল আশেপাশের সবুজ আর রৌদ্র থেকে চোখ ফিরিয়ে। বলল, এত উঁচু উঁচু সব থামের ওপর বাংলোটা। বেশ লাগে।
শুধু বেশ লাগার জন্যে নয়। দরকারও। বরষার দিনে নদী বাড়লে তখন পানি প্রায় এদিকটায় এসে পড়ে। তাছাড়া জংলা জায়গা।
বাঘ থাকে বুঝি এদিকে? সাপ?
থাকে, থাকে বৈকি? ওসব কথা বোলো না। আমার ভয় করে বড্ড।
দিনের বেলাতেও?
তবু।
আমি তো আছি। বন্দুক চালাতে জানি, ভরসা রেখো।
তাহমিনা তখন একটা কামরা খুলে বলল, আব এইটে আবিদের বসবার ঘর।
ওইটে বুঝি ওর ছবি?
দেয়ালে একটা বাঁধানো ফটোর দিকে তাকিয়ে ফারুক শুধালো।
হ্যাঁ।
ঢাকায় একবার দেখেছিলুম। অদ্ভুত তীক্ষ্ণ চেহারা।
তাই নাকি?
হাসলো তাহমিনা। জানালা খুলে দিল। সে হাসির বাকা ধ্বনি স্পর্শ করে গেল ফারুককে। সারাটা সকাল এমনি করে ঘুরে ঘুরেই কাটল। সমস্ত বাংলো দেখাল তাহমিনা তাকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল তারা ঘাট অবধি। ফিরে এসে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে তাহমিনা বলল, তুমি বোসো, বাইরে ডেকচেয়ার পেতে দিচ্ছি। আমি আর এক পট চা বলি তোমার জন্যে। না থাক। শোনো
কী?
একটা জিনিস তুমি আমাকে দেখালে না কিন্তু।
কী ফারুক।
তাহমিনা ওর দিকে তাকাল। যেন চোখের তেরে কিছু আবিষ্কার করতে চাইল।
আবিদের শিকারের কিউরিও। তাহমিনা হঠাৎ চমকে উঠে, শঙ্কিত গলায় বলল, কে তোমাকে বলেছে?
আবদুল—আবদুল বলেছে।
না, সে চাবি আমার কাছে নেই। না, নেই।
সে চলে গেল। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারল ফারুক, চাবি তাহমিনার কাছেই আছে। তাহমিনা দেখাতে চায় না বুঝি কামরাটা। কিন্তু কেন? কি আছে ওখানে? কেন, ও এমন করল? অনেকক্ষণ কেটে গেল। তবু তাহমিনা ফিরল না।
আবদুল ডেক চেয়ার পেতে দিয়ে গেছে বাইরের বারান্দায়। ফারুক সেখানে বসে তাকিয়ে রইল দূরে।