শিখার কালরাত্রি
এক – গান শোনার নিমন্ত্রণ
শিখার কাকা মেজর অতুল রায়ের শরীরটা কলকাতায় ভালো থাকছে না—প্রত্যহ একটা—না—একটা উপসর্গ লেগেই আছে! ডাক্তাররা পরামর্শ দিলেন, একবার হাওয়া বদল করলে ভালো হয়। সমুদ্রের ধারে পুরী, কি গোপালপুর—এই দু—জায়গার এক জায়গায় যেতে তাঁরা পরামর্শ দেন।
গোপালপুর দূরে—পুরী তবু কতকটা কাছে। পুরী যাওয়াই ঠিক হলো! কিন্তু বাড়ী? পুরীতে যে—সব বাড়ী সাধারণতঃ ভাড়া পাওয়া যায়, সেগুলোর সম্বন্ধে ভালোরকম খোঁজ—খবর না নিয়ে যাওয়া চলে না—কে জানে, কবে কোনটাতে কে যক্ষ্মারোগী ছিল হয়তো!
মাকে শিখা বললে, ”বাড়ী আছে, মা। আমার ক্লাস—ফ্রেণ্ড মনীষা—তার স্বামী বীচ রোডের উপর একেবারে সমুদ্রের ধারে বাড়ী কিনেছেন। মাস দুয়েক আগে আমি সেই গিয়েছিলুম। চমৎকার বাড়ী। সে বাড়ীতে আমরা সাতদিন কাটিয়ে এসেছি—মনীষা আর তার স্বামী দেবাশীষের আমন্ত্রণে। তারা যাবে পূজার সময়। সে—বাড়ী খালি আছে এখন। আমি যদি বলি—”
মা বললেন, ”তোর বন্ধুকে তাহলে বলে দ্যাখ। কিন্তু অমনি—অমনি নয়—আমরা ভাড়া দেবো।”
শিখা বললে, ”ভাড়া তারা নেবে না মা। তবে তুমি যখন বলছো, আমি বলে দেখবো।”
কাকীমা বললেন, ”তোমার বন্ধুর বাড়ীতে তুমি অমনি থাকতে পারো, তা বলে তোমার কাকা—কাকী অমনি থাকবে? না, এ রকম হলে ওদের বন্ধু—বান্ধব তো কত আছে—তাদের কাকা—কাকীমারাও যদি গিয়ে সে—বাড়ীতে থাকে, তাহলে ওরা যে কোনোকালে সে বাড়ীতে গিয়ে বাস করতে পারবে না, শিখা!”
শিখা হেসে বললে, ”বেশ, এ—কথাও আমি বলবো ওঁদের।”
শিখা গিয়ে বলবামাত্র বাড়ী পাওয়া গেল। মনীষার স্বামী দেবাশীষ ভাড়া নেবেন না। বলেন, ”সে কি! আপনার কাকাবাবু থাকবেন শরীর সারারার জন্যে! বিশেষ আপনার মা যাচ্ছেন—কাকীমা যাচ্ছেন! না, ভাড়া নেবো কি! তাছাড়া ভাড়া দেবার জন্য তো আমি বাড়ী কিনিনি!—আপনা—আপনি সকলের যদি সুবিধা হয়, সে তো আনন্দের কথা। বাড়ী এখন খালিই পড়ে আছে!”
বাড়ী ঠিক হওয়া মাত্র আরম্ভ হলো যাত্রার আয়োজন।
পুরী এক্সপ্রেসে কাকাবাবু, মা আর কাকীমাকে তুলে দিয়ে শিখা ট্যাক্সিতে করে বাড়ী ফিরল। কাকাবাবুর সঙ্গে গেল তাঁর বহুদিনের পুরাতন ভৃত্য ছোটু। তাছাড়া দেবাশীষ বলেছেন, সেখানে তাঁর দরোয়ান আছে—দুলাল সিং দরোয়ান—তাকে চিঠি লিখে দিয়েছেন, কলকাতায় তাঁর কাছে সে ছিল—এখন পুরীতে আছে স্ত্রী—পুত্র—পরিবার নিয়ে। সেখানে মেজর রায়ের কোন অসুবিধা হবে না। রান্নার লোক বা দাসী—চাকর দরকার হলে সে দেখে—শুনে এনে দেবে।
দেবাশীষ কলিকাতা পুলিসে চাকরি করেন—এ্যাসিষ্টাণ্ট কমিশনার।
রতন প্রতীক্ষা করছিল শিখা কখন ফিরবে। রাঁধুনী মোক্ষদা উনানে কেটলিতে জল চাপিয়ে বারান্দায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। রতনের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে তাড়াতাড়ি চা করতে বসলো সে।
শিখা ঘরে এসে বসলে রতন সবিনয়ে রঙিন—কভারে আঁটা একখানা কার্ড তার সামনে দেয়; বলে, ”আগরওয়ালা সাহেব নিজে এসেছিলেন দিদিমণি, নিমন্ত্রণ করতে।”
”আমাকে নিমন্ত্রণ?”
বলতে বলতে শিখা কার্ডখানা বার করে।
রতন বললে, ”কি জানি, ওঁর বাগানে নাকি গান—বাজনা হবে, তাই তাঁর মেয়ে আপনাকে বিশেষ করে যেতে বলেছেন।”
নিমন্ত্রণের কার্ডে ছাপা—
আগামী কাল সন্ধ্যা ছটায় কিশোরদাস আগরওয়ালার দমদমার বাগানে দিল্লীর যমুনা বাইয়ের গান হবে।
কিশোরদাসের কন্যা পান্না শিখাকে নিমন্ত্রণ করেছে। কার্ড ছাড়া একখানি ক্ষুদ্র পত্রও দিয়েছে সে—
শিখা দিদি যেন নিশ্চয় আসেন—যমুনা বাইয়ের গান শুনলে তিনি নিশ্চয় মুগ্ধ হবেন। এমন গান শোনা যায় না।
বড়বাজারে কিশোরদাস আগরওয়ালার বিরাট কারবার। মস্ত বাড়ী। পান্নার সঙ্গে শিখার আলাপ গানের আসরে। নিতান্ত শিশুপ্রকৃতির এই সুন্দরী মেয়েটিকে শিখা সত্যই স্নেহ করে এবং সেইজন্যই সে দু—একবার বড়বাজারে তাদের বাড়ীতে গিয়েছে। মাতৃহীনা পান্নাকে মানুষ করেছেন তার বিধবা মাসীমা। আদর—আবদারের অন্ত ছিল না পান্নার। লেখাপড়ার দিকে পান্নার ঝোঁক তেমন ছিল না—গানের দিকে ভয়ানক মন। গান—বাজনা শেখাবার জন্য বিখ্যাত গায়ক পশুপতিনাথ প্রত্যহ সকালে—সন্ধ্যায় তাদের বাড়ীতে আসেন।
শিখাকে পান্না নিজের বড় বোনের মত দেখে। কতবার সে শিখার বাড়ীতে এসেছে—গান শুনিয়েছে, মায়ের হাতের খাবার খেয়ে কত সুখ্যাতি করেছে।
পান্নার আবদার রাখতে তার পিতা কিশোরদাস আগরওয়ালা ব্যতিব্যস্ত। সারাদিনের কর্ম্মব্যস্ততার পর রাত্রে তিনি সংসারের প্রতি কর্ত্তব্য পালন করতে বসেন। পান্নার গানের পরিচয় নেন—পান্নার মাসীমার অভিযোগ—অনুযোগ শোনেন,—যথাশক্তি প্রতিবিধানও করেন।
আগরওয়ালা মানুষটি ভারী ভালো, অত্যন্ত নিরীহ। শান্ত মেজাজ। শিখা ভেবে পায় না, এমন ভালো মানুষ কিশোরদাস কি করে এত বড় কারবার চালান!
পান্নার মাসীমা কমলা দেবীর মুখে শোনে—আগরওয়ালা ছিলেন গরীবের ঘরের ছেলে—উচ্চ শিক্ষার অবসর বা সুযোগ জীবনে তিনি পাননি। ভাগ্যান্বেষণে বোম্বায়ে যান এবং ভাগ্যবশে দু’বছরের মধ্যে বহু অর্থের অধিপতি হন। এর পর তিনি ফিরে আসেন কলকাতায় এবং এখানে তিনি তাঁর ব্যবসাকেন্দ্র স্থাপন করেন। জন্মস্থান দিল্লী এবং কর্ম্মস্থান বোম্বাই ছেড়ে তিনি বাংলাদেশে কলকাতায় কেন বাস করতে এলেন, তার কারণ, তিনি কলকাতায় বিবাহ করেছিলেন।
পান্নার দাদামশাই আজমীর থেকে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসে এখানেই আস্তানা পাতেন। আগরওয়ালার সঙ্গে পান্নার মায়ের যখন বিবাহ হয়, তখন আগরওয়ালার বয়স সতেরো, স্ত্রীর বয়স মাত্র পাঁচ বৎসর।
আজ আগরওয়ালার নাম জানে না এমন লোক নেই। তাঁর নিজের তিন—চারটা মিল, কারখানা, কলকাতা কর্পোরেশনের বিভিন্ন কন্ট্র্যাক্ট তিনি পাচ্ছেন। একটা ব্যাঙ্কেরও ডিরেক্টর তিনি।
পান্না দু—তিন ছত্রমাত্র লিখেছে—শিখা দিদি যেন অতি অবশ্য দমদমার বাগানে আসেন। না এলে সে আর কোনদিন শিখা দিদির বাড়ী যাবে না, তার সঙ্গে কথাও বলবে না।
শিখা তার এ ছেলেমানুষীতে হাসে। চিঠিখানা ভাঁজ করে কার্ডের সঙ্গে কভারের মধ্যে পোরে।
তারপর কাকাবাবু যে ঘরে ছিলেন, শিখা এলো সেই ঘরে। শূন্য ঘর—চারিদিকে সেবার স্মৃতি! খাটের পাশে ছোট টেবিলের উপর ওষুধের কতকগুলো শিশি, পুরিয়ার ছোট—ছোট কার্ড বক্স! বেছে শিখা সেগুলোর কতক রাখে শেলফে—কতক ফেলে দেয় ওয়েষ্ট—পেপার বাস্কেটে…জঞ্জাল…কাল সকালে ফেলে দেবে।
তারপর শিখা বসে জানালার ধারে ইজিচেয়ারে। কাকাবাবুর কথা ভাবে…সারা জীবন দেশে—দেশে খেটে কাজ করেছেন, কত সুনাম—রিটায়ার করে এখন বিশ্রাম—সুখ ভোগ করবেন, তা নয়, অসুখ! মনে হয়, শুধু অসুখ কি—রায়পুরের সে ব্যাপার! তাঁকে কি—ভাবে ফলো করে কি বিপদে না ফেলেছিল! নেহাৎ ভাগ্যগুণে*—
রতন এসে বলে, ”রাত হয়েছে—খাবার দিতে বলি?”
শিখার চমক ভাঙ্গে…নিশ্বাস ফেলে শিখা বলে, ”হ্যাঁ। বলো।”
শিখা নিঃশব্দে বসে খাচ্ছে, রতন সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করে, ”গান শুনতে যাবে নাকি দিদিমণি?”
শিখা গম্ভীরভাবে বলে, ”তোমাকে তা বলতে হবে?”
রতন জবাব দেয় না; অন্যমনস্কভাবে মাথা চুলকোতে সুরু করে।
শিখা বলে, ”দেখি যদি সময় হয়, যাব। আর তোমাকেও নিয়ে যাব।”
রতন খুশী হয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
দুই – কিশোরদাস
মোক্ষদাকে যথারীতি উপদেশ দিয়ে শিখা ট্যাক্সিতে বসে; ড্রাইভারের পাশে বসে রতন।
আগরওয়ালার বাগান—বাড়ীতে যমুনা বাইয়ের গান শুনতে শহরের বহু গণ্যমান্য লোক আসবেন—শিখা তা জানে; তাই রতনকেও বেশ সভ্য—ভব্য বেশে নিয়ে চলেছে।
দমদমার প্রান্তে আগরওয়ালার সুন্দর বাগান—বাড়ী। এ বাড়ীর কথা শিখা পান্নার মুখে শুনেছে। শিখাকে এখানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পান্না অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু নানা কারণে শিখার যাওয়া ঘটেনি।
আজ যমুনা বাইয়ের গানের মোহ তাকে আকর্ষণ করেছে—তাই আজ সব কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে,—কোন কাজ হাতে রাখেনি।
রতন মহাখুশী, এমন সভ্য—ভব্য বেশ—গর্ব্বে তার বুকখানা ফুলে উঠেছে।
আগরওয়ালার বাগান—বাড়ীর গেটের দু—পাশে উর্দ্দি—আঁটা দরোয়ান—তারা সসম্ভ্রমে অভিবাদন করে।
ভিতরে সুসজ্জিত পাণ্ডালের নীচে যমুনা বাইয়ের নাচ আরম্ভ হয়ে গেছে। নিমন্ত্রিত লোক ধরে না। বাইরের লোক অবশ্য কেউ নেই। যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই নিমন্ত্রিত—আভিজাত্যের ছাপ তাঁদের চেহারায় বেশে—ভূষায় জ্বলজ্বল করছে।
আগরওয়ালার ম্যানেজার জ্ঞানচাঁদ শিখাকে সসম্ভ্রমে অভিবাদন করে সামনের আসনে বসালেন। রতন পিছন দিকে একটু জায়গা করে বসলো। জ্ঞানচাঁদ বসলেন শিখার পাশে।
আগরওয়ালাকে দেখতে না পেয়ে শিখা আশ্চর্য্য হলো—জিজ্ঞাসা করলে, ”মিষ্টার আগরওয়ালা? পান্না? তাঁদের দেখছি না যে!”
জ্ঞানচাঁদ উত্তর দিলেন, ”পান্নার শরীর খুব খারাপ—তাই সে আসতে পারেনি। আগরওয়ালা—জী এখনি এসে পড়বেন জানিয়েছেন। হঠাৎ কি জরুরী কাজ পড়ায় এখনো আসতে পারেননি।”
নিস্তব্ধ হয় শিখা—এতক্ষণে গানের দিকে সে মন দেয়।
যমুনা বাই তখন গান গাইছে—
বরখা লাগি মেরে গুঁইয়া
সেঁইয়া নেহি আওয়ে মেরি।
যেমন সুন্দরী যমুনা বাই, তেমনি সুমিষ্ট তার কণ্ঠ। অভ্যাগতেরা নিস্তব্ধ—কোনখানে এতটুকু শব্দ নেই।
বাইরে অন্ধকার ছেয়ে এলেও বাগান—বাড়ী আলোয় উজ্জ্বল। বাইজীর হীরকালঙ্কারে শুভ্র আলো পড়ে জ্বলছে—শিখা সেইদিকে চেয়ে ভাবছে,—এই সব হীরকালঙ্কারের দাম কত!
আগরওয়ালা যখন এসে পৌঁছলেন, তখন প্রায় আটটা বাজে।
শিখাকে দেখে তিনি খুশী হন। জ্ঞানচাঁদ সসম্ভ্রমে উঠে তাঁকে তাঁর আসনে বসান। অভ্যাগত অতিথিদের অভিবাদন করে, বাইজীকে অভিনন্দন জানিয়ে কিশোরদাস শিখার দিকে ফিরলেন।
শিখা বললে, ”পান্না আমায় আসতে বলে চিঠি লিখল—কিন্তু তার দেখা নেই! শুনলুম, তার শরীর নাকি ভালো নেই—জ্ঞানচাঁদবাবু বললেন!”
কিশোরদাস বললেন, ”হ্যাঁ, অসুখ এমন কিছু নয়, আসল কথা তার রাগ হয়েছে—অভিমান! তাই সে আমার সঙ্গে আসেনি। তার জন্যেই আমার এই এতখানি দেরী হয়ে গেল। তারপর আমায় যেতে হলো কাষ্টমস অফিসের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে, বিলেত থেকে কতকগুলো মালপত্র এসে আটক হয়ে আছে, সেগুলোর ব্যবস্থা করে আসতে হলো—তাই দেরী হয়ে গেল। পান্না আমায় বলেছিল, পশুপতিনাথের সঙ্গে সন্ধ্যার মধ্যে এখানে আসবে, —আমি এসেই খোঁজ নিয়েছি—সে আসেনি।”
শিখা বললে, ”না, সে আসেনি। মনে হয়, আসবে না। অথচ আমাকে সে বিশেষ করে—”
বাধা দেন কিশোরদাস, বলেন, ”আমাকে সে বলেছে, সে আসবেই। পশুপতি তখনও এসে পৌঁছয়নি—তাই সে অপেক্ষা করছিল। আমি যদি সোজা এখানে আসতুম, সে আমার সঙ্গেই আসতে পারতো, কিন্তু আমায় অন্য জায়গায় যেতে হলো কিনা—সেখানে হয়তো দেরী হবে—সেইজন্যে আমিও তাকে সঙ্গে আনবার জন্যে জিদ করিনি।”
শিখা বললে, ”আপনার সঙ্গে না হোক, মাসীমার সঙ্গেও তো সে আসতে পারতো।”
কিশোরদাস একটু হাসলেন, বললেন, ”ওই তো কথা! আদর পেয়ে পেয়ে আমার মেয়েটির ইহকাল তো গেছেই, পরকালও ঝরঝরে হবার উপক্রম! অবশ্য এ জন্যে আমায় দোষ দিয়ো না মা,—পান্নার মাসীকে দোষ দিতে পারো। ও মেয়ের মাথা তিনিই খেয়েছেন। তিনি এসব গান পছন্দ করেন না, বলেন—ততক্ষণ রামজীর ভজন করলে তাঁর পরকালের কাজ হবে। তাই তিনি আসবেন না। পশুপতির আসবার কথা ছিল পাঁচটার মধ্যে। সে এসে পৌঁছোয়নি, তাই মেয়ের হলো রাগ,—বলে, সে আসবে না এখানে। বাধ্য হয়ে পশুপতিকে ফোন করে দিয়ে আমি বাড়ী থেকে বেরিয়েছি। তার পরের কথা কিছু জানিনে।”
শিখা লক্ষ্য করে, কিশোরদাসের কেমন যেন অস্বস্তি—মনে শান্তি পাচ্ছেন না—গানের দিকেও তাঁর মনে নেই।
খানিকক্ষণ বসে থেকে তিনি উঠে পড়লেন, বললেন, ”তুমি একটু বসো মা শিখা, আমি একবার বাড়ীতে ফোন করে খবর নি, পান্না এখনও এলো না কেন!”
তিনি উঠে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলেন জ্ঞানচাঁদ।
পাঁচ—সাত মিনিট পরে ফিরে এলেন কিশোরদাস।
শিখা জিজ্ঞাসা করলে, ”পান্না এলো না কেন, খবর পেলেন?”
কিশোরদাস বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ”শোনো আবদার। পান্না নাকি ওঠেনি, শুয়ে আছে—বলেছে, শরীর অসুস্থ, সে গান শুনতে আসবে না। তার মাসী কমলা আমায় ফোনে জানালেন।”
শিখা বললে, ”পশুপতিনাথও তো আসেননি, দেখছি।”
বেশ একটু কঠিন কণ্ঠে কিশোরদাস বললেন, ”ওই তো কথা। কমলা বললেন, পশুপতি আসেনি, সেইজন্যে পান্না এলো না। কমলা নিজে তাকে আনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মেয়ে আসবে না! যাক, সে না আসুক, তাতে গান বন্ধ থাকবে না। এলে ভালো গান শুনতো—শুনতে পাবে না!”
শিখা মনে শান্তি পায় না। পান্নার আগ্রহে তার এখানে আসা, সেই পান্নাই এখানে অনুপস্থিত, সে আনন্দ পাবে না গান শুনে।
চারিদিকে সে একবার চেয়ে দেখে—শহরের গণ্যমান্য বহু লোক আসরে উপস্থিত। অনেক মহিলা এসেছেন। পিছনে চেয়ে দেখে, রতন গানে ডুবে গেছে,—তার চোখে পলক পড়ছে না।
কখন দশটা বেজে গেছে, রাত প্রায় এগারোটা।
শিখা উসখুস করে।
”আমাকে এবার উঠতে হবে কাকাজী, রাত এগারোটা হলো। আপনাদের এ আসর ভাঙতে নিশ্চয় বারোটা—একটা হবে, বোঝা যাচ্ছে।”
কিশোরদাস স্মিতহাস্যে বলেন, ”তা হবে—রাত একটা পর্য্যন্ত চলবে। বাইজীর গান শুনতে পুলিশের বড় বড় কর্ত্তারাও এসেছেন। ওই ও—পাশে ওঁরা আছেন। আমাদের কমিশনার সাহেব, ডেপুটি কমিশনার সাহেব—সবাই এসেছেন—অবশ্য একটু রাত করেই ওঁরা এসেছেন। তাই গানের সময় খানিক বাড়িয়ে দিয়েছি। তা তোমাকে আর আটকাতে চাই নে। আমার একখানা গাড়ীতে তোমায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিই।”
শিখা উঠল—বাধ্য হয়ে রতনকেও উঠতে হলো। বেচারার ইচ্ছা ছিল শেষ—পর্য্যন্ত শোনে—শিখার জন্যে তা আর হয়ে উঠলো না।
শিখাকে জ্ঞানচাঁদ অফিসের একখানা মোটরে উঠিয়ে দিলেন,—রতন ড্রাইভারের পাশে বসল।
দু’ হাত কপালে ঠেকিয়ে জ্ঞানচাঁদ নমস্কার করলেন, সহাস্যে বললেন, ”রাম রাম শিখা দেবী, আপনার নাম অনেকদিন থেকে শুনেছি, চোখে দেখবার ভাগ্য এ পর্য্যন্ত হয়নি তাই আলাপও হয়নি। আজ এই গান—বাজনার দৌলতে আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ায় ভারী আনন্দ হলো।”
শিখা হাসে—প্রতি—নমস্কার করে।
মোটর অগ্রসর হয়।
খানিক দূর গিয়ে শিখা একবার পিছনের দিকে তাকায়। জ্ঞানচাঁদ তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। দুজন লোক তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে। কি কথাবার্ত্তা চলছে, মনে হলো।
আলোর রাজ্য ছাড়িয়ে মোটর ক্রমে অন্ধকার পথে ছুটলো।
তিন – পথে লাশ
পথের দু’দিকে নিঝুম—নিস্তব্ধ ঘর—বাড়ী—বাগান—মাঝে মাঝে দূরে দূরে এক একটি গ্যাস—লাইট জ্বলছে। তাতে পথের ঘন অন্ধকার সামান্য ফিকে হলেও সে আলোয় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না।
নিস্তব্ধ রাত্রি,—একটা গ্যাসপোষ্টের আলোয় হাতের ঘড়ি দেখে শিখা—বারোটা বাজে।
ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। পাণ্ডাল থেকে বেরুবার সময়েই সে দেখেছে, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন—একটি নক্ষত্রও চোখে পড়ে না।
ঝম ঝম করে অকস্মাৎ বৃষ্টি নামলো।
নিস্তব্ধ জনহীন পথ। আশে—পাশে বাড়ী, বাগান—সব নিস্তব্ধ—জন—মানবের সাড়া পাওয়া যায় না! অকস্মাৎ ঝপ করে মোটরের ব্রেক কষে ড্রাইভার—মোটরখানা লাফিয়ে ওঠে এবং সামান্য একটু এগিয়ে গিয়ে থেমে যায়।
হয়তো একটু তন্দ্রা এসেছিল, চমকে সোজা হয়ে বসে শিখা। রতনের বেশ ঘুম এসেছিল—সে জেগে উঠে দু—হাতে চোখ রগড়ায়।
শিখা দেখতে পায়, হেড—লাইট জ্বেলে ড্রাইভার সামনের দিকে কি দেখছে।
”কি? কি ওখানে?”
দরজা খুলে ড্রাইভার নামে, উত্তর দেয়, ”একটা মানুষ পড়ে আছে, মায়িজী।”
”মানুষ!”
শিখা দরজা খুলতে গিয়ে থেমে যায়। বৃষ্টি পড়ছে। ইচ্ছা থাকলেও বৃষ্টির জন্য নামতে পারে না সে।
হাতের টর্চ ফেলে দেখছে ড্রাইভার।
পথের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ—হাত—দুখানা মাথার দিকে ছড়িয়ে দেওয়া।
শিখা দেখতে পায়—উৎকণ্ঠিত হয়ে শিখা জিজ্ঞাসা করে, ”বেঁচে আছে?”
লোকটির পাশ—ফেরানো মুখের কাছে ড্রাইভার হাত দেয়, সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলে, ”না, কৈ, নিশ্বাস পড়ছে কিনা বুঝতে পারছি না।”
বৃষ্টির বেগ একটু কমে এলেও ড্রাইভারের সমস্ত শরীর জলে ভিজে গেছে। ফিরে মোটরের কাছে এসে সে দাঁড়ায়! উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলে, ”এখন কি করা যায় মায়িজী? মনে হচ্ছে, খুন করে পথের উপর কেউ ফেলে গেছে!”
”খুন!”
শিখা গাড়ীর দরজা খুলে নেমে পড়ে।
হঠাৎ বাঁকের মুখে দুটো উজ্জ্বল আলোর ঝলক ফুটলো! একখানা মোটর আসছে। শিখা বললে, ”ও—গাড়ীখানা থামাও। নিশ্চয় ওতে লোক আছে, সাহায্য পাওয়া যাবে।”
মোটর কাছে এলো। তাকে থামাবার চেষ্টা করতে হলো না—গাড়ী আপনা থেকেই থামল।
পুলিসের গাড়ী।
ঝুপ—ঝাপ করে ক’জন নেমে পড়ে। এগিয়ে আসেন ইনস্পেক্টর অবনীশ মজুমদার।
অবনীশ বললেন, ”এ কি, মিস্ রায় এখানে! এ একেবারে অভাবনীয়!”
শিখা বললে, ”অভাবনীয় মোটেই নয়, অবনীশবাবু। পথের উপর দেখুন, অভাবনীয় এবং আশ্চর্য্য কিছু দেখবেন।”
”তাই তো! এ আবার কি!”
অবনীশ এগিয়ে যান।
তাঁর আদেশে কনষ্টেবলরা দেহটিকে চিৎ করে ফেলে! অবনীশের হাতের টর্চের আলো দেহটির উপর পড়তেই বিদ্যুৎ—চমকের মত শিখা চমকে ওঠে! ”সর্ব্বনাশ, পশুপতিনাথ! নামজাদা ওস্তাদ গাইয়ে পশুপতিনাথ কানোড়িয়া!”
অবনীশের আদেশে সহকারী মতি দত্ত মৃতদেহটি পরীক্ষা করেন। তিনি বলেন, ”ডেড—ষ্টোন ডেড!”
বিবর্ণ—মুখে শিখা চেয়ে থাকে তাঁর দিকে।
ইনস্পেক্টরের আদেশে মৃতদেহ পুলিসের গাড়ীতে তোলা হয়। অবনীশ শিখার মোটরে উঠলেন। তাঁর আদেশে পুলিসের গাড়ী কলকাতার দিকে ছুটল।
রুমাল বের করে মাথার ক্যাপ সরিয়ে মাথা মুখ মুছতে মুছতে অবনীশ বললেন, ”আমরা না হয় ডিউটিতে বেরিয়েছি, কিন্তু আপনি বিনা ডিউটিতে রাত বারোটায় এখানে? চলুন, আপনাকে আগে আপনার বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে আসি—তারপর লাশের ব্যবস্থা করব।”
মোটর তখন কলকাতার পথে চলেছে।
শিখা বলতে যাচ্ছিল, ”কিন্তু আমিও মর্গে—”
বাধা দেন অবনীশ; ধমকের সুরে বলেন, ”না, অতটা আর নাই করলেন। আমার গায়ে বর্ষাতি আছে, দেখছেন—মাথায় বর্ষাতি ক্যাপ। কাজেই আমি এমন কিছু ভিজিনি। কিন্তু আপনার বর্ষাতি নেই—ভিজেছেন! না, কোন কথা নয়—আপনাকে বাড়ী যেতে হবে।”
শিখার বাড়ীর দরজার কাছে মোটর যখন থামলো, তখন একটা বেজে গেছে। রতন আগেই নেমে দরজা খুলে বৈঠকখানায় গিয়ে আলো জ্বেলে দিলে। শিখার সঙ্গে অবনীশও নেমে আগরওয়ালার মোটর ছেড়ে দিলেন—বললেন, ”আপনি কাপড় ছেড়ে বিশ্রাম করুন। আমি কাল সকালে এসে আপনাকে খবর দেব।”
এ—কথা বলে তিনি চলে যান।
শিখা জামা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
কিন্তু চোখে ঘুম আসে না।
এ কি ব্যাপার! পশুপতিনাথকে খুন করে ওখানে ফেলে রাখল কে? আগরওয়ালা ফোনে পশুপতিনাথকে জানিয়েছিলেন, তিনি পান্নাকে সঙ্গে নিয়ে বাগানে গানের আসরে যেন আসেন। তাঁকে কথা দিয়ে দায়িত্ব মাথায় নিয়েও পশুপতিনাথ পান্নাকে সঙ্গে না নিয়ে একা ওদিকে চলেছিলেন কেন—তাও হেঁটে!
পথে যে এ—খুন হয়নি, সে—সম্বন্ধে শিখার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। মনে হয়, অন্য কোথাও খুন করে খুনীর দল দেহটাকে ওখানে পথের উপর ফেলে রেখে গেছে—তারা হয়তো আশে—পাশে আড়ালে কোথাও লুকিয়েছিল, লাশের কি হয়, দেখবার জন্যে। মনে হলো, ভুল হয়ে গেছে—ওখানে একটু সন্ধান করা উচিত ছিল! কিন্তু—
মনে হলো, অন্য কোথাও খুন করলেও এত জায়গা থাকতে ওখানে লাশ ফেলে রেখে দেবে,—নিশ্চয় এর মধ্যে কোন অভিসন্ধি!
কিসের অভিসন্ধি?
বেচারা পশুপতিনাথ!
ওস্তাদ মানুষ—ভারত—জোড়া নাম। যে—কোন গানের আসরে তাঁকে নিয়ে আসতে পারলে সকলে ধন্য হয়। শিখা তাঁকে দেখেছে, তাঁর মার্জ্জিত রুচি—ভদ্র ব্যবহারের পরিচয়ও শিখা পেয়েছে!
পান্নার কাছে শিখা তাঁর পরিচয় পেয়েছে। বিখ্যাত গায়ক—বংশে পশুপতিনাথের জন্ম। উত্তরাধিকার—সূত্রে সঙ্গীতে তাঁর পারদর্শিতা—তাঁর যোগ্যতাও ছিল অপরিসীম।
পশুপতিনাথের পিতা ছিলেন ধনীর সন্তান। কিন্তু অর্থ তিনি রাখতে পারেননি, ঘরও বাঁধতে পারেননি। পশুপতিনাথ পিতার সে—গুণ পেয়েছেন—গানের নেশা তাঁকে ঘর ছেড়ে বাইরে টেনে এনেছে, কবে কোথায় থাকবেন—তার নিশ্চয়তা ছিল না।
পান্নার মুখে পশুপতিনাথের প্রশংসা ধরে না। আগরওয়ালা অনেক বড় ঘরে অনেক সুপাত্র খোঁজ করলেও পান্না বিবাহে রাজি হয়নি—সে পশুপতিনাথকে ছাড়া আর কাকেও বিবাহ করবে না, এই ছিল তার পণ।
কমলা দেবীর দু—চোখ হলো আতঙ্কে বড়—মুখের রঙ হলো কালো। তিনি বললেন, ”শুনেছি মা—আর এও শুনেছি, তুমি বাড়ী আসছিলে—তোমার চোখেই পড়ে তার লাশ! তার পর পুলিস এসে নিয়ে যায়!”
বলতে বলতে তিনি দু—হাতে মুখ ঢাকেন।
সান্ত্বনার সুরে শিখা বলে, ”তা নিয়ে আপনার কোন ক্ষতি—বৃদ্ধি নেই মাসীমা। পুলিস অফিসার যতীন্দ্রবাবু আর অবনীশবাবু এসেছেন। এখানে এনকোয়ারীতে আসবার সময় তাঁরা আমায় নিয়ে এসেছেন! পান্না যা জানে, তাকে বলতে হবে। আপনাকেও হয়তো—”
অধীর কণ্ঠে কমলা দেবী বলে ওঠেন, ”না, না,—আমি কি বলবো মা? আমি কিছু জানি নে। আমি কিছু বলতে পারব না শিখা। আমি—”
শিখা বেশ জোর গলায় বললে, ”সে আপনি ওঁদের কাছে বলবেন মাসীমা।”
”কিন্তু শিখা—”
বলতে বলতে কমলা দেবী কম্পিত হাতে শিখার হাত দুখানা চেপে ধরলেন, রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বললেন, ”তুমি তো জানো আমাকে, মা। পুলিসকে আমি বড় ভয় করি—ওদের দেখলে আমার বুক যেন কাঁপতে থাকে!”
শিখা হাসে, একখানা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তাঁর স্বেদাক্ত হাতখানার উপর বুলোতে বুলোতে স্নেহের সুরে বলে, ”কোন ভয় নেই মাসীমা—পুলিস হলেও ওঁরা জানোয়ার নন যে আপনাকে আঁচড়াবেন কামড়াবেন কি খাবেন! ওঁদের ডিউটি করতে ওঁরা এসেছেন। আপনি যা জানেন, তা বলবেন।”
পান্নার দরজায় ঘা মারে শিখা, ”দরজা খোল পান্না পুলিল এসেছে, তোমার কাছে তাঁদের দরকার আছে।”
পান্না দরজা খুলে দেয়।
একদিনেই তার অসম্ভব পরিবর্ত্তন হয়ে গেছে। চেহারা যা হয়েছে, দেখলে চেনা যায় না! শিখা কবে সেই গান শুনেছিল—
ম্লান নলিনী ভাসে হায় আঁখি—জলে!
অবিকল তেমনি।
ক’দিন আগে যে পান্নাকে শিখা দেখেছে, এ যেন সে পান্না নয়, তার কালো ছায়া।
বাইরে থেকে শিখার ডাক আসে।
পান্নার কাঁধে শিখা একখানা হাত রাখে, শান্ত কণ্ঠে বলে, ”তুমি বোধ হয় শুনেছো, কাল রাত্রে পশুপতিনাথ খুন হয়েছেন। তাই সে খুনের তদারক করতে এসেছেন পুলিসের এ্যাসিষ্ট্যাণ্ট কমিশনার যতীন্দ্রবাবু আর ইনস্পেক্টর অবনীশবাবু। কে তাঁর শত্রু ছিল—পশুপতিনাথের সম্বন্ধে ওঁরা তোমাকে যা—যা জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি যা জানো, তাঁদের বলতে হবে। তাহলে ওঁরা খুনীর সন্ধান করতে পারবেন।”
কম্পিত স্খলিত কণ্ঠে কোনমতে পান্না বলে, ”কিন্তু—আমি—আমি—”
পান্না মুখ নত করে। বেশ বোঝা যায়, তার দু—চোখ জলে ভরে উঠেছে।
শিখা বললে, ”পুলিস সন্দেহ করছে, এ সাধারণ খুন নয়, এর মধ্যে অনেক কিছু আছে। আমি আশা করি, তুমি কোন কথা গোপন করবে না—যা সত্য, বলবে।”
পান্না মুখ তোলে না। শিখা পান্নাকে সাহস দিয়ে বাইরে আসে।
পান্নার জন্য সত্যই সে অত্যন্ত বেদনা পেয়েছে। তাকে সান্ত্বনা দেবে কি বলে, শিখা ভাষা খুঁজে পায় না।
চার ? পাঁচ – সংশয়ের মেঘ
কিন্তু নিষ্ফল প্রয়াস! হতাশ হয়ে ফিরে আসেন যতীন্দ্রনাথ।
শিখাকে তার বাড়ীতে নামিয়ে তিনি চলে যাচ্ছিলেন, শিখা বাধা দেয়—”আসুন, এক কাপ চা খেয়ে যান। রতনকে বলা আছে, গাড়ী থামলো দেখে নিশ্চয় সে জল বসিয়েছে। দেরী হবে না।”
বাধ্য হয়ে নামতে হয় যতীন্দ্রনাথকে, অবনীশও নেমে আসেন।
নীচে বসবার ঘরে সশব্দে চেয়ারখানা সরিয়ে নিয়ে বসলেন যতীন্দ্রনাথ, অবনীশকে বললেন, ”দাঁড়িয়ে কেন হে অবনী? বসো।”
থতমত খেয়ে অবনীশ বসে পড়েন পাশের চেয়ারে।
টেবিলের ওধারে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে শিখা বসল। রতন কখন পর্দ্দা সরিয়ে পলকের দৃষ্টিতে তিনজনকে দেখে সরে পড়েছে। আর কেউ না দেখলেও শিখার চোখে পড়েছে।
যতীন্দ্রনাথ বললেন, ”কিছু হলো না মিস্ রায়, তোমার পান্না একটি কথারও জবাব দিলে না—কোন সূত্র পেলুম না!”
শিখা শান্তকণ্ঠে বলে, ”কিন্তু আমি যেন একটা সূত্র পেয়েছি যতীন্দ্রবাবু।”
”তুমি সূত্র পেয়েছো?”
যতীন্দ্রনাথ সোজা হয়ে বসলেন।
শিখা বললে, ”যা পেয়েছি তা’ অবশ্য আমার সম্পূর্ণ অনুমান—পরে আপনাকে জানাব। শুধু আপনার সাহায্য চাই। আমায় একটা অনুমতিপত্র দিয়ে রাখবেন, যেন যে কোন জায়গায় আমি পুলিসের সাহায্য পেতে পারি।”
উৎসাহিত কণ্ঠে যতীন্দ্রনাথ বললেন, ”নিশ্চয়, আমি কমিশনারের কাছ থেকে তোমায় চিঠি এনে দেব। তাছাড়া যদি বলো, আমি অবনীশকে তোমার সাহায্যে দিতে পারি। মনে হয়, অবনীশ থাকলে তোমার অনেক কাজ হবে।”
রতন চা নিয়ে আসে ট্রেতে সাজিয়ে। শিখা অতিথিদের চা পরিবেষণ করে।
শিখা বলে, ”তা হলে খুব ভালো হয়। হয়তো আজই আমার দরকার হতে পারে। অবনীশবাবুকে পাব তো?”
অবনীশ উৎসাহিত কণ্ঠে বলেন, ”নিশ্চয় পাবেন। আমি সর্ব্বদাই প্রস্তুত। আপনি যদি আজ এখনি কোথাও যেতে বলেন, আমি তাতেও রাজি আছি মিস্ রায়।”
—”তার।”
টেলিগ্রাফ—পিয়নের কণ্ঠ শোনা যায়।
রতন টেলিগ্রামটা নিয়ে আসে শিখার কাছে। শিখা নাম সহি করে সেখানা নেয়। কভার খুলে ত্রস্ত হাতে সে টেলিগ্রাম বার করে।
পুরী থেকে আসছে টেলিগ্রাম। টেলিগ্রাম করেছেন কাকীমা—
”শীঘ্র এসো—বড় বিপদ—”
চকিতে বিবর্ণ হয় শিখার মুখ।
ব্যগ্রকণ্ঠে যতীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ”কি হলো মিস্ রায়, হঠাৎ এমন ভেঙ্গে পড়লে? কার টেলিগ্রাম?”
শিখা চেয়ারে ভর দিয়ে দাঁড়ায়, বলে, ”না, আজ আমার দ্বারা কোন কাজ হবে না যতীন্দ্রবাবু। আমার কাকা, মা, কাকীমা এই ক’দিন হলো পুরী গেছেন, সেখানে হঠাৎ কি বিপদ বোধ হয়! বোধ হয় কেন—নিশ্চয়! আমায় এখনই যেতে বলেছেন।”
যতীন্দ্রনাথ চিন্তিত মুখে বলেন, ”তোমায় বাধা দেব না মিস্ রায়। তবে আমার একটা কথা—যদি দেখ, এমন কিছু ব্যাপার নয়, তা হলে যত তাড়াতাড়ি পারো, চলে এসো। এখানকার সব দায়িত্ব আমি তোমার হাতে দিতে চাচ্ছি! অবশ্য আমরাও থাকবো তোমার সঙ্গে। আমি জানি, তুমিই এ—কেসের সমাধান করতে পারবে।”
”আমি!”
শিখা হাসে, বলে, ”এতখানি নির্ভর আমার উপর রাখবেন না যতীন্দ্রবাবু। আপনারা তদন্ত চালিয়ে যান, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি, ফেরবার চেষ্টা করবো।”
যতীন্দ্রনাথ উঠলেন।
অবনীশ উঠতে উঠতে বললেন, ”কিন্তু কি সূত্র আপনি পেয়েছেন, যদি একটু আভাস পেতুম মিস্ রায়, আমরা হয়তো খানিকটা এগিয়ে যেতে পারতুম।”
শিখা যেন কি ভাবতে থাকে।
শিখার চিন্তা—সূত্রে বাধা দিয়ে যতীন্দ্রনাথ বললেন, ”উনি দু—পাঁচ দিনের মধ্যে ফিরে আসুন, আমরা ততক্ষণ একবার দমদমায় এনকোয়ারীটা করে দেখি।”
তাঁরা বিদায় নিলে শিখা ফোন করে দেবাশীষ দত্তকে।
ফোন ধরে মনীষা জানায়, দেবাশীষ এখানে নেই, বিশেষ কাজে ক’দিন আগে তাঁকে সিমলায় যেতে হয়েছে। তবে শীঘ্রই ফিরবেন।
ফোনেই শিখা জানায়—সে আজই পুরী এক্সপ্রেসে পুরী যাচ্ছে। হঠাৎ কাকীমার তার এসেছে,—তিনি লিখেছেন, বিপদ। কি বিপদ, জানতে না পেরে শিখা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছে!
ওদিক থেকে মনীষার উৎসুক কণ্ঠ শোনা যায়, ”তুমি তার করে দিয়েছো, যাচ্ছো বলে?”
শিখা বললে, ”হ্যাঁ, রতনকে তার করতে পাঠিয়েছি। আচ্ছা—এখন এই পর্য্যন্ত। যাওয়ার আয়োজন করতে হবে।”
সে ফোন ছেড়ে দেয়।
উদ্যোগ—আয়োজনের মধ্যে মনে পড়ে পান্নার কথা—তার মাসীমা কমলা দেবীর কথা।
তাদের সঙ্গে যেটুকু কথাবার্ত্তা হয়েছে, তাতেই শিখা বুঝেছে, এদের মধ্যে গোপনীয় কিছু আছে। বেচারী পান্নার জন্য সত্যই তার দুঃখ হয়। তার সঙ্গে কথাবার্ত্তায় সে যা জেনেছে, তাতে বোঝা যায়, পান্না পণ করেছিল, পশুপতিনাথকে ছাড়া আর কাকেও সে বিয়ে করবে না; কিন্তু আগরওয়ালাকে স্পষ্টাস্পষ্টি মনের কথা জানাবার সাহস তার হয়নি।
আগরওয়ালা নিজে একদিন খুব গরীব ছিলেন বলেই বোধ হয় গরীব—দুঃখীকে আজ সহ্য করতে পারেন না—তাদের তিনি অন্তরে অন্তরে ঘৃণা করেন। এই জন্যই গরীব পশুপতিনাথের অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে কন্যার পাত্র হিসাবে পছন্দ করতে পারেননি। বাধ্য হয়েই শুধু তাঁকে পান্নার গান—শেখানোর চাকরিতে বহাল রেখেছিলেন।
পুরী থেকে ফিরে এসে শিখা একবার চেষ্টা করে দেখবে, যাতে এই নৃশংস খুনের রহস্য—উদ্ঘাটন হয়। শুধু পান্নার জন্যেই সে এ কাজ করবে! তার কারণ, পান্নার মন বড় সরল, বড় ভালো—সেইজন্যই মেয়েটিকে সে স্নেহ করে। কমলা দেবীকে সে কোন দিনই পছন্দ করতে পারেনি, তার মনের অতলে কি আছে, তা শিখার অজ্ঞাত।
পশুপতিনাথকে এঁরা কেউ কোন দিনই সুচোখে দেখতে পারেননি, অথচ তাঁকে সরাতেও পারেননি।
তবে কি পশুপতিনাথের খুনের ব্যাপারে আগরওয়ালা জড়িত আছেন? শিখার মনে কেমন যেন একটা সন্দেহ চাড়া দিয়ে ওঠে। আগরওয়ালার নিজের বাগান—বাড়ীতে উৎসব, নিমন্ত্রিত সকলেই যথাসময়ে এসে পৌঁছুলেন, আসেননি কেবল কর্ম্মকর্ত্তা নিজে। তিনি এলেন অনেক পরে, তাঁর কাজ ততক্ষণ চালিয়েছেন তাঁর ম্যানেজার জ্ঞানচাঁদ।
জ্ঞানচাঁদের উপর শিখার তেমন সন্দেহ হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখেছেন—সভ্য মার্জিতরুচি কৃতী ছাত্র—তিনি এর মধ্যে থাকবেন?
না, এসব অনুমান তার সম্পূর্ণ মিথ্যা! পান্নাকে বিবাহ করার ব্যাপারে হয়তো পশুপতিনাথের কোন ক্রুর প্রতিদ্বন্দ্বী আছে! এ খুন তারই কাজ।
শিখা আর ভাবতে পারে না। কাকীমার টেলিগ্রামের কথা তার মনে পড়ে যায়।
পুরী যাওয়ার আয়োজন করে শিখা।
রতন সঙ্গে যাবে। আগের বারে রতন একা বাসায় ছিল, এবার তাকে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ছয় – পুরীর বাড়ী
পুরী ষ্টেশনে নেমে একখানা রিকশয় উঠে বসে শিখা,—রতন বেডিং আর বাক্স নিয়ে আর একখানা রিকশয় বসলো।
দারুণ রৌদ্র—সূর্য্য প্রচণ্ড কিরণ বর্ষণ করছে।
উঁচু—নীচু অসমতল পথ ধরে রিকশ চলেছে বীচ রোডের দিকে।
মাঝে মাঝে রতনের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ”আরে রাম, এই তোমাদের পুরী শহর দিদিমণি! এত নোংরা—আর এই রকম সব বাড়ী!”
শিখা ধমক দেয়, ”বকিসনে রতন, এই রোদে তোর কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না।”
বীচ রোডে দেবাশীষের বাড়ীর গেট পার হয়ে রিকশ ভিতরে ঢুকে থামলো। শিখা ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ে। রতন নামে—নেমে বাক্স—বিছানা নামায়।
সামনেই লন। সেখানে কাকেও দেখা যায় না। শিখা দ্রুত পায়ে বারান্দায় উঠে ডাকে, ”মা—কাকীমা—”
পাশের দিককার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন কাকীমা।
ঠোঁটের উপর একটা আঙ্গুল রেখে তিনি বলেন, ”চুপ—আস্তে এ ঘরে এসো শিখা।”
তাঁর নির্দ্দেশে পাশের ঘরটায় প্রবেশ করে শিখা, রতনও তার অনুগামী হয়।
একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে শিখা বসে।
”ব্যাপার কি, বলো তো? হঠাৎ তার করবার কারণ বুঝছিনে। এই তো মাসখানেক আগে তোমরা এসেছো—এর মধ্যে এমন কি হ’লো, যার জন্য টেলিগ্রাম!”
বলতে বলতে কাকীমার বিবর্ণ মুখের পানে তাকিয়ে সে থেমে যায়,—”কি হয়েছে কাকীমা? তুমি একেবারে আধখানা হয়ে গেছ! মা কোথায়?”
কাকীমা বললেন, ”ও ঘরে তোমার কাকাকে রাখা হয়েছে। তিনি খুব অসুস্থ। দিদি সেখানে। আমার এদিককার কাজ—কর্ম্ম আমি ততক্ষণ সেরে নিচ্ছি। তুমি বসো, জিরোও—চা আনতে বলি। তারপর সব শুনো।”
তিনি বেরিয়ে গেলেন!
রতন ঘরে আসেনি, বারান্দায় ঘুরছিল, এখন সে এসে দাঁড়াল।
শিখা জিজ্ঞাসা করলে, ”কি রকম দেখছো রতন। বাড়ীটা ভারী চমৎকার—না? এখন স্নানাহার করে খানিক বিশ্রাম করা যাক, তারপর বিকেলের দিকে ভালো করে দেখা যাবে—কি বলো?”
বিষণ্ণ ভাবে রতন বললে, ”কিন্তু দিদিমণি, সত্যি কথা বলি, বাড়ীটাতে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মন যেন কি রকম হয়ে গেল,—আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।”
হেসে শিখা তাকে ধমক দেয়, ”কি যে বলো রতন! ওদিকে আবার দ্যাখো, কি চমৎকার ঘরগুলো বলো তো! আমি সেবার এসে সাত দিন থেকে গেছি। ভারী ভালো লেগেছিল আমার। এই তো দু—মাস পরে এসেছি, তবু মনে হচ্ছে—”
অকস্মাৎ সে থেমে গেল, ট্রেতে করে চা আর খাবার নিয়ে যে লোকটি এলো, পরম বিস্ময়ে তার পানে তাকায় শিখা। রতন এসে শিখার পিছনে দাঁড়ায়। অদ্ভুত চেহারা লোকটির, হঠাৎ দেখলে ভয় হয়। আবলুস কাঠের মত গায়ের রং, মোটা মোটা কালো ঠোঁট—মূলার মত দাঁত; হাসলে তাকে নিশ্চয় অতি কদর্য্য দেখায়। সর্ব্বশরীরে লোম—দেখতে কাফ্রীর মত। মাথার চুলগুলোও কাফ্রীদের মত কালো কোঁকড়ানো। এদিকে অসম্ভব বেঁটে। তাকে বামন বলা চলে।
চায়ের ট্রে শিখার সামনে টেবিলের উপর বসিয়ে সে চটপট করে কাপে চা ঢেলে দেয়, বিস্কুটের টিনটা এগিয়ে দেয়।
রতন বিস্মিত চোখে তার পানে চেয়ে আছে। একটা কাপ শিখা রতনের দিকে এগিয়ে দেয়, ”নাও রতন, এরপর কথাবার্ত্তা হবে।”
লোকটি বিনীতভাবে পাশে দাঁড়িয়ে হাত দু’খানা কচলায়। তাদের চা খাওয়ার অপেক্ষা করে সে।
শিখা দু—একবার তার পানে তাকায়, তার সঙ্গে কথা বলবার মত মনের অবস্থা তখন শিখার নয়।
এমন সময়ে মা আসেন।
শিখা লাফিয়ে ওঠে, ”উঃ, বেশ লোক তুমি মা, একেবারে পরের মত এই বাইরের ঘরটিতে বসে রয়েছি, তোমার তো দেখা পাওয়ার জো নেই!”
বলতে বলতে মাকে সে প্রণাম করতে যায়, মা তাকে বুকে টেনে নেন।
মলিন মুখে মা বলেন, ”কি করি বল মা—তোর কাকার খুব অসুখ। হঠাৎ এমন হলো যে বলা যায় না। কোথায় সামনের মাসে ফিরে যাব ভাবছি, এমন সময় এ কি ব্যাপার বল তো! তোকে কলকাতার বাসায় একলা ফেলে আমিই বা এখানে কতকাল থাকি! যা, স্নান করে আগে খাওয়া—দাওয়া করে নে, তারপর সব শুনিস। অনেক কথা। এখন থাক।”
বেঁটে বিশ্রী চেহারার লোকটি ততক্ষণে ট্রে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। শিখা সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করে, ”এই অদ্ভুত জীবটিকে জোগাড় করলে কোথা থেকে? কলকাতা থেকে যখন এলে, তখন কি এ জন্তুটি এইখানেই ছিল? ওকে দেখে—”
মা বাধা দেন, জিভ কাটেন, ”আহা, অমন কথা বলিসনে বাছা। ওর নাম প্রতাপ সিং। বেহারের লোক। আমরা আসবার পরের দিন এসেছে। দু—তিন দিন বেচারা খেতে পায়নি, তাই ঠাকুরপো ওকে জায়গা দিলে। বিচ্ছিরি চেহারার জন্য বেচারা এত লজ্জা পায়—কারও সামনে বেরুতে চায় না! কথা বলে খুব কম, তাও কি রকম জড়ানে মতন কথা—প্রায় বোঝা যায় না। না, না, লোকটা এদিকে খুব ভালো। দু—দিন থাকলেই বুঝবি।”
এ—প্রসঙ্গ এইখানেই থামে।
খানিক বিশ্রাম করে স্নানাহার সেরে শিখা কাকাকে দেখতে যায়।
পরশু রাত্রে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। কাল ডাক্তার ইনজেকশন দেওয়ার পরে জ্ঞান হয়েছে। জ্ঞান হলেও প্রকৃতিস্থ হতে পারেননি। কেবল চীৎকার করেছেন, পাগলের মত ছুটে যেতে চেয়েছেন, তাই ডাক্তার মর্ফিয়া দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন।
শিখা নিঃশব্দে বিছানার পাশে আসে—লক্ষ্য করে, অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে কাকাবাবু নিশ্বাস ফেলছেন।
ডান হাতখানা ঝুলছিল, অতি সন্তর্পণে সেখানা তুলে শিখা নাড়ী দেখতে যায়!
হাতখানা তিনি টেনে নেন। সঙ্গে সঙ্গে আরক্তিম চোখ মেলে তাকান, গর্জ্জন করে ওঠেন, ”নিপাত যাও, নিপাত যাও। ভয় দেখিয়ে বশ করতে চাও নাগরমল! সেটি হচ্ছে না। না, না—কিছুতে না—কিছুতে না!”
তিনি ধড়মড় করে উঠতে যান—চেঁচিয়ে ওঠেন, ”রিভলভার—ছোটু, আমার রিভলভার! শকুন—ওটাকে গুলি করবো—আমার রক্ত খেতে আসছে—রক্ত খেতে আসছে! উঃ, উঃ, উঃ—”
শূন্যে ক’বার মুষ্টি তুলে ঘুষি ছুড়তে ছুড়তে তিনি কাৎ হয়ে পড়ে যান। শিখা তাঁকে সরিয়ে দিতে গিয়ে দেখে, তিনি অজ্ঞান হয়েছেন!
কাকীমা ছুটে আসেন, কাকার পুরাতন ভৃত্য ছোটু ছোটে ডাক্তার ডাকতে।
শকুন—নাগরমল—রক্ত খাওয়া—
এলোমেলো এই ক’টা কথা শিখার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে!
ডাক্তার আসেন, পরীক্ষা করেন, চিন্তিত মুখে বলেন, ”তাই তো, বার—বার এ—রকম ভালো নয়! পরশু এমনি হয়েছিল, আবার আজ এ—রকম! যাই হোক, আবার ইনজেকশন দিয়ে যাচ্ছি। কেমন থাকেন, ঘণ্টা তিনেক পরে আমায় জানাবেন।”
ডাক্তারের সঙ্গে চলতে চলতে শিখা বললে, ”কাকাবাবুর সম্বন্ধে যা—কিছু কথা, আপনি আমাকে বলতে পারেন, ডক্টর দাস।”
ডক্টর দাস বিস্মিত চোখে শিখার পানে তাকালেন, বললেন, ”কিন্তু আপনি! আপনি নেহাৎ ছেলেমানুষ! আপনাকে—”
শিখা গম্ভীর ভাবে বলে, ”ছেলেমানুষ আমি মোটে নই, ডক্টর দাস। তা ছাড়া উনি আমার কাকাবাবু, আমার আর ভাই—বোন নেই। ওঁকেও আমি ছাড়া দেখবার কেউ নেই! তাই যা—কিছু আমাকেই করতে হয়।”
ডক্টর দাসের চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বললেন, ”চিনেছি আপনাকে। আপনার কথা শুনেছি। মাপ করবেন, আগে আপনাকে চিনতে পারিনি বলে। আপনি আমাদের বাঙ্গালী মেয়ের গৌরব কুমারী অগ্নিশিখা রায়!”
শিখা বললে, ”ও—কথা থাক। কাকাবাবুর অসুখটা কি, জানতে চাই।”
চিন্তিত মুখে ডক্টর দাস বলেন, ”অসুখ এমন কিছু নয়। দেখে মনে হয়, ভয়ানক ভয় পেয়েছেন যে—কোন রকমেই হোক! সেই ঝোঁকটা আজ তিনদিনের মধ্যেও সামলাতে পারছেন না।”
কথা কইতে কইতে দু’জনে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন।
শিখা বললে, ”কিন্তু কাকাবাবুর মত মানুষ—ওঁর ভয় হবে, আশ্চর্য্য! কি এমন—কিসের ভয়? ওঁর অসাধারণ সাহস। মিলিটারীতে কাজ করেছেন—সুনাম আছে। উনি মেজর ছিলেন! ওঁর মত লোক ভয় পেয়েছেন, এ বড় সহজ কথা নয়!”
ডক্টর দাসের ললাট কুঞ্চিত হয়। তিনি শিখার দিকে তাকান—শিখার দু’চোখের দৃষ্টি বিদ্যুতের শিখার মত জ্বলজ্বল করছে!
ডক্টর দাস বললেন, ”আগের কথা আমি তো জানি না। ওঁর সম্বন্ধী সুরনাথবাবু হঠাৎ গিয়ে আমাকে ডেকে আনলেন—খুব অসুখ বলে। আমি এসে দেখি, মেজর রায় বিছানায় পড়ে আছেন—অজ্ঞান আচ্ছন্নের মত। পালশ দেখলুম, র্যাপিড। জ্বর নেই। শুনলুম, সুস্থ মানুষ, বেড়াতে বেরিয়েছিলেন—হঠাৎ এই ব্যাপার! মনে হলো ব্লাড—প্রেশার—এ বয়সে সাধারণতঃ হয়ে থাকে তো। তখন আমার কাছে প্রেশার দেখবার যন্ত্র ছিল না—একটা ইনজেকশন দিলুম। তারপর অবশ্য দেখেছি পরীক্ষা করে—ব্লাড—প্রেশার নয়।”
এই পর্য্যন্ত বলে ডক্টর দাস হাত—ঘড়ি দেখলেন—বললেন, ”এখন তাড়া আছে, মিস্ রায়—এখন আর অপেক্ষা করতে পারবো না। সন্ধ্যার দিকে আর একবার মেজরকে দেখতে আসবো,—তখন এ—সব কথা হবে।”
এ কথা বলে তিনি মোটরের দিকে এগিয়ে যান।
সাত – ভ্যাম্পায়ার
সন্ধ্যার দিকে সমুদ্রের কূলে বেড়ানো শেষ করে শিখা বাড়ী ফিরছে—হঠাৎ বীচ রোডে ডাক্তার দাসের সঙ্গে দেখা। গাড়ী নেই—তিনি হেঁটে এদিকে এসেছেন।
মেজর রায়ের অমন অসুখ—তাঁকে ছেড়ে বেড়াতে বেরুবার ইচ্ছা শিখার মোটে ছিল না—শুধু মা আর কাকীমার পীড়াপীড়িতে আর রতনের কাতর অনুনয়ে সে বেরিয়েছে। সন্ধ্যার সময় ডক্টর দাস আসবেন—কথা আছে। তাই সে বাড়ী ফিরছে।
দেখা হতেই শিখা বলে উঠলো, ”এই যে ডক্টর দাস! আমাদের ওখানে গিয়েছিলেন না কি?”
ডক্টর দাস বললেন, ”না, গিয়ে লাভ হবে না তো। সেই রকমই আছেন, বোধ হয়! বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি—হলে খবর পেতুম নিশ্চয়। আপনার সঙ্গে দেখা হলো, ভালোই হলো। আপনার সঙ্গে ওঁর সম্বন্ধেই কথা আছে। আসুন, ঐ বাঁধানো জায়গাটায় বসি।”
বালির উপর বাঁধানো কতকগুলো বসবার জায়গা। একটা ছিল খালি—সেই খালি বাঁধানো জায়গায় বসলেন তাঁরা। রতন একটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
হু—হু করে বাতাস বইছে। জলের বুকে বড় নৌকায় চড়ে জেলেরা মাছ ধরছে। বালির বুকে সন্ধ্যাচারীদের বেশ ভিড়।
ডক্টর দাস বললেন, ”ভয়ের কথা বলেছিলুম না? মানে, ও—বাড়ীতে এসে আপনারা অন্যায় করেছেন। ও—বাড়ীটা দেবাশীষবাবুর কেনা মোটে উচিত হয়নি। জানেন, ও—অংশে এ পর্য্যন্ত কেউ বাস করতে পারেননি! যাঁরা—যাঁরা কিনেছিলেন—ভাড়া দিয়ে আসছেন।”
ডক্টর দাসের দিকে শিখা তাকিয়ে আছে সাগ্রহ দৃষ্টিতে। সে প্রশ্ন করলো, ”কেন? কারণ?”
ডক্টর দাস একটা নিশ্বাস ফেললেন। নিশ্বাস ফেলে বললেন, ”কারণ? হ্যাঁ, মানে ক’বছর আগে ও—বাড়ী ভাড়া নিয়েছিলেন দিল্লীর এক মস্ত কারবারী—হনুমানপ্রসাদবাবু। ও—বাড়ীতে তিনি মস্ত কারবার ফেঁদে বসেছিলেন—এক্সপোর্ট—ইম্পোর্টের কারবার। তার পর হঠাৎ কারবার গেল ফেঁসে—পুলিস এসে হানা দিলে। তার মানে, এক্সপোর্ট—ইম্পোর্ট কারবারের নামে ওখানে হনুমানপ্রসাদের চোরা কারবার চলছিল।”
শিখা বললে, ”কিন্তু এর সঙ্গে বাড়ী কেনার বা আমাদের আসার কি সম্বন্ধ, ডক্টর দাস?”
ডক্টর দাস গম্ভীরভাবে বললেন, ”সম্বন্ধ আছে, মিস্ রায়। হনুমানপ্রসাদের এক পার্টনার—কলকাতার বেশ নামকরা ভদ্রলোক—হঠাৎ তার সঙ্গে কি নিয়ে ঝগড়া হয়। তার পরই হনুমানপ্রসাদ এই বাড়ীতে মারা যান। খুন হয়ে মারা যাননি অবশ্য!”
শিখা বলতে যাচ্ছিল, মরাটা এমন কিছু বিস্ময়কর নয়, ডক্টর দাস! মানুষ অমর নয়—একদিন তার মৃত্যু হবেই! কিন্তু সে—কথা বলবার উদ্যোগ করতেই—
অসহিষ্ণুভাবে ডক্টর দাস বললেন, ”না, না—ও—বাড়ীটাকে এখানে সকলে বলে, মিষ্টিরিয়স হাউস। আপনারা তো এ—সব খবর জানেন না। এ—বাড়ীতে যতোগুলো লোক মারা গেছে, তাদের ক’জনকে আমি দেখেছি—পরীক্ষা করে দেখেছি। আশ্চর্য্য মরণ! রোগে নয়—কোনো জীব তাদের রক্ত চুষে খেয়েছে! সত্যই এমন আশ্চর্য্য যে কারও গায়ে আমি একফোঁটা রক্ত পাইনি!”
গম্ভীর হয়ে ওঠে শিখা। সে বললে, ”তার মানে?”
ডক্টর দাস বললেন, ”সেইজন্যই এ—বাড়ীর নামে দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে আছে এখানে! শেষে গত দু—তিন বছর ও—বাড়ীতে কোনো ভাড়াটে থাকতে পারেনি। রাত্রে তারা খুব ভয় পেতো! মাটির নীচে কারা হো—হো করে হাসে—ভয়ানক—রকম শব্দ করে। সে—সবে কেউ কেউ ভয় না পেয়ে সাহস করে এগিয়েছিল—যেমন আপনার কাকাবাবু শব্দ শুনে রাত্রে বাহিরে বেরোন খোঁজ করতে। বেরিয়ে তিনি দেখেন, দুটো এই এত বড় শকুন—বিদঘুটে জানোয়ার—বুঝলেন?”
দু—চোখ বিস্ফারিত করে শিখা বলে, ”শকুন!”
”হ্যাঁ, শকুন।”
শিখা বলে, ”কাকাবাবু আজ বলছিলেন বটে শকুনের কথা।”
ডক্টর দাস বললেন, ”আপনার কাকাবাবু বেঁচে গেছেন, খুব বরাত জোর! তাঁর আগে আরও দু’জন লোক—একজন মাদ্রাজের রামস্বামী, আর একজন বোম্বাইয়ের এক পার্সী ভদ্রলোক। এঁরা সাহস করে এগিয়েছিলেন, দু’জনের একজনও বাঁচেননি! গলায় এত বড় ফোকর—আমি দেখেছি। দু’জনের কারো দেহে একবিন্দু রক্ত পাইনি! রীতিমত পরীক্ষা করে আমি দেখেছিলুম। ও—বাড়ীতে আপনারা মোটেই নিরাপদ নন। দেবাশীষবাবুকে শুধু আমি এই ভয়ের কথা বলিনি। তিনি অন্য ক’জন লোকের কাছে এ—সব কথা শোনেন। কিন্তু পুলিসের লোক কিনা—হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।”
শিখা বললে, ”কিন্তু বাড়ী কেনার পর আমরা এসেছিলুম। সাত দিন ছিলুম। কোনরকম ভয় পাইনি তো!”
ডক্টর দাস বললেন, ”যারা এ—কাণ্ড করছে—হয়তো সে—ক’দিন লুকিয়ে কিংবা সরে ছিল—আপনারা চলে যাবার পর আবার তাণ্ডব সুরু করেছে!”
নিতান্ত নিরুপায়ভাবে শিখা বললে, ”কিন্তু এখন আমরা কি করবো, তাই বলুন?”
ডক্টর দাস বললেন, ”হপ্তাখানেক আগে মেজর রায়কে—অর্থাৎ, আপনার কাকাবাবুকে আমি এ—কথা বলেছিলুম। বাড়ীতে মেয়েদের কাছে তিনি কিছু বলেননি, পাছে তাঁরা ভয় পান! ও—বাড়ীতে প্রায় তিনি নানারকম ব্যাপার দেখতেন এবং শুনতেন। সেদিন রাত্রে তিনি ওরকম হয়ে না পড়লে তার পরের দিনই কলকাতায় চলে যাবেন, এ—কথাও আমায় বলেছিলেন।”
শিখা বললে, ”কিন্তু উপস্থিত কোথাও তাঁকে সরানো চলে না তো ডক্টর দাস।”
ডক্টর দাস বললেন, ”না, অন্ততঃ এক হপ্তাহ আগে নয়, মিস্ রায়।”
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, শিখা উঠে দাঁড়ায়, বলে, ”একবার কাকাবাবুকে দেখে যাবেন না? এতদূর যখন এসেছেন—আপনাকে ছাড়ব না।”
”বেশ, চলুন।”
দু’জনে চললেন বাড়ীর দিকে।
চলতে চলতে ডক্টর দাস বললেন, ”বেশী রাত্রে এদিকে আসতে ভয় করে—এ—কথা কিন্তু গোপন করবো না। এখন কত রাত? বড় জোর আটটা—কি সাড়ে—আটটা। দশটার আগে ফিরতে পারবো’খন। দশটার পরে কিন্তু এদিকটায়—হাজার টাকা ফী পেলেও আমি আসতে রাজী নই, মিস্ রায়!”
শিখা আর ডক্টর দাস অগ্রসর হন—পিছনে আসে রতন।
বাড়ীর সম্বন্ধে এ—সব কথা শুনে রতন ভয়ে একেবারে কাঁটা! চোখে ভূত দেখবার সৌভাগ্য না ঘটলেও অনেকরকম ভূতের কথা সে শুনেছে। কিন্তু এমন শকুন ভূত! বাপ রে, গলার নালী কেটে ফুটো করে রক্ত চুষে খায় ভূতে! তার হাড় পর্য্যন্ত কেঁপে উঠলো!
এমন ভূতুড়ে বাড়ীতে এই সব ভূত—প্রেতের সঙ্গে বাস, মনে করতে তার চোখ ফেটে জল আসে!
আট – শিখার চিন্তা
রাত্রিটা নির্ব্বিঘ্নে কাটে।
শিখা যতক্ষণ জেগেছিল, কোন শব্দ শুনতে পায়নি—তার ঘুমও ভাঙ্গেনি।
মায়ের একাদশী। সন্ধ্যা হতেই তিনি শুয়ে পড়েছিলেন। নার্স থাকা সত্ত্বেও কাকীমা কাকাবাবুর ঘরেই ছিলেন। ছোটু আর অন্য চাকর—বাকর ঘরে গিয়ে গল্প করে, তারপর ঘুমায়।
সকালে শিখার ঘুম ভাঙ্গে। মা কখন উঠে গেছেন। কাকীমা বাথরুমে; কাকাবাবু শুয়ে আছেন—একজন নার্স তাঁর কাছে আছে। এ—নার্সকে ডক্টর দাস কাল এখানে পাঠিয়েছেন।
মাকে শিখা কোন কথা বলে না, বাড়ীখানা ঘুরে—ফিরে সে দেখে।
প্রকাণ্ড বাড়ী—এর এক অংশ দেবাশীষ দত্ত কিনেছেন, অপর অংশ কোন মাড়োয়ারি কোম্পানি ভাড়া নিয়েছে—এখানে তাদের ব্যবসা—বাণিজ্য। দিন—রাত মেশিন চলছে—দু—ভাগের মাঝখানে মস্ত দেওয়াল—শুধু ওদিককার মেশিন চলার ঘস—ঘস শব্দ কাণে আসে।
রতন পাশের ঘরে শুয়েছিল।
এক রাত্রেই তার পরিবর্ত্তন চোখে পড়ে! মনে হয়, হঠাৎ তার জীবনে বার্দ্ধক্য এসেছে! শিখা ডাকতে সে বসবার ঘরে এসে দাঁড়ালো। তার পানে তাকিয়ে শিখা আশ্চর্য্য হয়ে গেল!
জিজ্ঞাসা করলে, ”কি হয়েছে রতন? কাল রাত্রে ঘুম হয়নি বুঝি?”
রতন শুষ্ককণ্ঠে বললে, ”না দিদিমণি, এক্কেবারে ঘুম হয়নি!”
শিখা হাসে, বলে, ”বুঝেছি। ডাক্তারবাবুর মুখে ও—গল্প শুনে ভয় হয়েছে! কিন্তু গল্প শুনে ভয় হওয়া অন্যায়। যুদ্ধের সময় চাটগাঁয়ে অমন বমিং হয়ে গেল—মংপোদের নিয়ে কত কি ঘটলো, তখন তো এতটুকু ভয় পাওনি তুমি! তুমিই আমাকে সমানে সাহস দিয়েছিলে। শুধু তাই নয়, কত সাহসের কাজ করেছিলে! আর আজ তুমি এক অদ্ভুত গল্প শুনে ভয়ে এমন কাতর!”
রতন মুখ তোলে, বলে, ”কিন্তু দিদিমণি, এমন রক্ত—চোষা শকুন!”
”তাই এত ভয়?” শিখা হেসে ওঠে, ”এ কখনও হতে পারে রতন—রাত—দুপুরে শকুন বেড়ায়, মানুষের রক্ত চুষে খায়? এমন কখনো শুনেছ? পাগল! লোকের মন—গড়া গল্প এ—সব, বুঝছ না?”
রতন বললে, ”কিন্তু দিদিমণি, ওই প্রতাপ সিং লোকটা—ওকে কেমন আমার মোটে ভালো বোধ হয় না। রাত—দুপুরে পাশের ঘরে পায়ের শব্দ শুনে আমি উঠেছিলুম। জানালার কপাটের ফাঁক দিয়ে দেখি, প্রতাপ সিং আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল—আর একটা লোক ছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে—অন্ধকারে। দেখি, দু’জনে উঠান পার হয়ে ওই দেওয়ালটার কাছে গেল!”
বাড়ীর দু—অংশের মাঝখানকার পাঁচিলটা সে দেখায়।
শিখা বললে, ”তুমি কি করে দেখলে অন্ধকারে—বিশেষ ওখানে কতকগুলো গাছপালা রয়েছে?”
রতন বললে, ”সত্যি দেখেছি দিদিমণি। আমি নিজের চোখে দেখি, ওরা ওখানে টর্চ ফেলে কি দেখলো, তারপর ওদের আর দেখতে পেলুম না।”
”হুঁ।”
শিখা চিন্তিত মুখে প্রশস্ত প্রাঙ্গণের ওধারে দেওয়ালটার পানে তাকায়। ওখানে কতকগুলো ফুলের গাছ। জায়গাটায় বেশ ঝোপ—ঝাড় গজিয়েছে।
শিখা বললে, ”প্রতাপ সিং কখন ফিরেছে, জানো?”
রতন বললে, ”না, তা বলতে পারব না দিদিমণি—শেষ—রাতের দিকে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।”
শিখা বললে, ”আচ্ছা, ও—সব আমি দেখবো—তুমি নিশ্চিন্ত থাকো রতন। আমি যতক্ষণ আছি, তোমার কোন ভয় নেই!”
শিখা আজ জেগে থেকে দেখবে। কিন্তু তার আগে দেখবে ওই দেওয়ালের মধ্যে কোন গুপ্ত—পথ আছে কিনা!
কাকার বিছানার পাশে একখানা চেয়ারে সে বসে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর বাইরে এসে দাঁড়ায়।
মার কাছে সে কিছু খবর পেয়েছে। মা বলেছেন, এ বাড়ীতে মাস—দেড়েক তাঁরা এসেছেন—অনেক রকম শব্দ শুনেছেন—তবে তাতে ভয় পাননি। দশ—বারো দিন আগে মেজর রায়কে যেন একটু উত্তেজিত দেখা যায়—রাত্রেও তিনি ভালো করে ঘুমোতে পারেন না! এমন সময় বাড়ীর বাইরে পথে একটা লোকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। মা সে—দেহ দেখেছেন। লোকটার গলায় খানিকটা খোবলানো—লোকটাকে দেখেছেন কাগজের মত সাদা—যেন দারুণ অ্যানিমিয়ায় ভুগছিল!
সে—মৃতদেহ দেখে মেজর রায় আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এমন সময় তাঁর শ্যালক সুরনাথ এখানে আসেন শান্তিপুর থেকে। কথা ছিল, সুরনাথ যেদিন দেশে ফিরবেন, তার আগের দিন শিখাকে টেলিগ্রাম করা হবে, তাঁরা সুরনাথের সঙ্গে ফিরছেন বলে!
কিন্তু হঠাৎ এই বিপত্তি!
সেদিন সকালে সুরনাথ গেছেন ভুবনেশ্বরে বেড়াতে—যদি সময় থাকে, সেইদিনই ফিরবেন; নাহলে পরের দিন ফিরবেন। মেজর রায় রোজ যেমন সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যান, তেমনি বেড়াতে গিয়েছিলেন। অন্য দিন ঘড়ি ধরে রাত আটটায় তিনি ফিরে আসেন। সেদিন ন’টা বেজে গেল, দশটা বাজে—তবু তাঁর ফেরবার নাম নেই! তখন ছোটুকে পাঠালেন। প্রায় সাড়ে—দশটার সময় মেজর রায়কে নিয়ে ছোটু ফিরলো। তার কাছে শোনেন, মেজর রায়ের সঙ্গে ক’জন লোকের খুব তর্কবিতর্ক চলেছিল। শেষে মারামারি বাধে বুঝি, এমন! অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ছোটু তাঁকে বাড়ী এনেছে।
তারা কে? কেন বিবাদ? মেজর রায় সে—সম্বন্ধে একটি কথাও কাকেও বলেননি। কেবল গর্জ্জন করেছেন, ”রোসো, আজ রাতটা কাটুক—কাল সকালেই সব ক’টাকে ধরিয়ে দেব—জেল খাটাব—তবে আমার নাম! আমি সহজে ছাড়ব না ওদের।”
কিন্তু মা বা কাকীমা তাদের নাম বা পরিচয় জানেন না।
মেজর রায় পাশের ঘরে একা শয়ন করেন। সেই দিনই গভীর রাত্রে তাঁর আর্ত্তনাদে বাড়ীসুদ্ধ সকলের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সকলে ছুটে তাঁর ঘরে যান।
মা বলেন, তিনি যেন আবছামত দেখেন দুটি জীবকে—মস্ত বড়! কিন্তু মানুষ নয়, চারপা—ওলা কোন জন্তু! আর—বলতে বলতে মার মুখ বিবর্ণ হয়—সভয়ে তিনি রাম নাম উচ্চারণ করেন।
তারপর তিনি আচ্ছন্নমত থাকেন—অচেতন যেন! মাঝে—মাঝে চমকে জেগে ওঠেন, আর চীৎকার!
সকাল হতেই সুরনাথ গিয়ে ডাক্তার দাসকে ডেকে আনে। তিনি এসে কিছু ঠাহর করতে পারেন না—বলেন, ব্লাডপ্রেশার। তারপর বলেন, তা নয়। আসেন, দেখেন—ইনজেকশন দেন! কি রোগ, নির্ণয় হয় না! কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে—কিন্তু ভরসা হয় না, এই অবস্থায় ট্রেনে তোলা!
কাকার প্রলাপ শুনে মনে হয়, আসলে শকুন নয়—নাগরমল শকুন সেজেছে, তাঁর বিশ্বাস! নিগূঢ় রহস্য! তখনি তাঁরা শিখাকে টেলিগ্রাম করেন।
মার মুখে এ—কথা শুনে শিখা দেবাশীষকে চিঠি লিখে আভাসে এখানকার খবর জানায়; সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে এখানে আসবার জন্যে অনুরোধ করে। পত্র পাবামাত্র তিনি যেন এখানে চলে আসেন।
তারপর থেকে সে লক্ষ্য রাখছে ঐ প্রতাপ সিংয়ের ওপর।
গোপনে ছোটুকে জিজ্ঞাসা করে সে জানে, প্রতাপ সিং কারও সঙ্গে মেশে না—হাঁ—না ছাড়া কোন কথা সে বলে না। খুব সম্ভব, তার জিভের দোষ আছে। সেইজন্য সে কথা বলতে চায় না! তবে এ—কথা সত্য, তার কর্ম্মতৎপরতার জন্য সাহেব তাকে যেমন ভালবাসেন, মায়েরাও তার চেয়ে বড় কম ভালোবাসেন না।
সে—কথা শিখাও জানে। প্রতাপ সিংয়ের অদ্ভুত চেহারা শিখার দৃষ্টি বেশ আকর্ষণ করেছে। কিন্তু কথা বলে শিখা তার কাছ থেকে কোন জবাব পায়নি। রতন ক’বার তার সঙ্গে কথা বলতে গেছে—প্রতাপ সিংয়ের মুখে বিরক্তির ভাব দেখে রতনের আর কথা বলবার ভরসা হয়নি।
শেষে শিখা তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করে।
প্রতাপ সিং ম্লান হাসি হাসে। কতক ইঙ্গিতে—ভঙ্গীতে, কতক মুখের ভাষায় সে বোঝায়, তার কেউ নেই। হাসপাতালে ছ’মাস থেকে বেরিয়ে এসে পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছিল, দয়াবতী মা—জীরা তাকে দেখে আশ্রয় দিয়েছেন—তাঁদের জন্যেই সাহেব তাকে তাড়াতে পারেননি।
শিখার এত খবরাখবর নেওয়া দেখে সুরনাথ হাসেন, টিপ্পনী কাটেন, ”তাই তো বড়দি, তোমার মেয়ে মস্ত বড় ডিটেকটিভ হয়েছে গো। সেই যে সব ডিটেকটিভ, যাদের গল্পের বই আমরা পড়ি। তবে বাপু, মেয়ে ডিটেকটিভ একমাত্র কৃষ্ণা ছাড়া আর কাকেও দেখিনি! এবার দেখছি অগ্নিশিখা রায়ের ডিটেকটিভ—কাহিনী পড়তে হবে।”
মার মুখ মলিন হয়। শিখা উত্তর দেওয়ার আগেই কাকীমা বললেন, ”তা পড়বে বই কি ভাই, নিশ্চয় পড়বে। শিখার কীর্তি তো জানো না, তাই এ নিয়ে ঠাট্টা করছ! আমি বলছি সুরনাথ, তুমি দেখে নিও, এখানকার এ ব্যাপার কেউ যদি বার করতে পারে তো শিখাই করবে!”
সুরনাথ কি বলতে যাচ্ছিলেন, শিখা বাধা দিয়ে বলে, ”না, না মামা, কাকীমার ও—সব বাড়ানো কথা। বাঙ্গলাদেশের মেয়েরা চিরকাল যা করে আসছে—সেই রান্না—বান্না, বাটনা বাটা, বাসন মাজা, কুটনো কোটা—”
গম্ভীর মুখে সুরনাথ বাধা দেন, ”না, না, আজকাল মেয়েরা রান্নাঘরে ঢুকতে চায় না বাপু। তারা রুজ পাউডার মেখে, ঠোঁটে গালে রং লাগিয়ে—”
কাকীমা সহ্য করতে পারেন না, চেঁচিয়ে ওঠেন, ”তুই থামবি সুরনাথ! ও—ঘরে অমন রোগী, আর ও কিনা বসেছে মেয়েটার উপর টিপ্পনী কাটতে! বাঙ্গলার মেয়েরা আজ কতখানি কাজ করছে—কতখানি তারা এগিয়েছে, তুই তার কি জানবি? দু—একটা মেয়েকে রুজ পাউডার মেখে ভূত সেজে রাস্তায় চলতে দেখে থাকিস যদি, তাই নিয়ে বাঙ্গলাদেশের সমস্ত মেয়েদের একেবারে চিনে—জেনে ফেলেছিস—শোনো একবার কথা!”
দিদির সঙ্গে কথায় পারা যাবে না বুঝে সুরনাথ চুপ করে যান।
নয় – ছোটু
চিঠির জবাবে দেবাশীষের টেলিগ্রাম আসে, ”আমি যাচ্ছি।”
শিখা নিশ্চিন্ত হয়।
কাল রাত্রে একটা বীভৎস চীৎকারে শিখার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। ধড়মড় করে সে বিছানায় উঠে বসে হারিকেনটা পুরোপুরি জ্বালায়।
মানুষের চীৎকার নয়, কোন জন্তু—জানোয়ারের চীৎকার! এখানে পুরী টাউনের মধ্যে বীচ রোডের ধারে জানোয়ারের এমন অদ্ভুত চীৎকার! কি জানোয়ার, সে বুঝতে পারে না!
মা বললেন, ”এ—রকম চেঁচানি রাত্রে আমরা অনেক শুনেছি শিখা! আমাদের বুড়ো মালী বলে, সমুদ্রের জানোয়ার এ—সব দিকে আসে মাঝে—মাঝে, হয়তো ডাঙ্গায় উঠে এমনি চীৎকার করে। এ সেই সমুদ্রের জানোয়ারের চীৎকার!”
পাশের ঘরে রতনের আর্ত্ত চীৎকার শোনা যায়, ”দিদিমণি, দিদিমণি—”
সঙ্গে সঙ্গে রতন ছুটে আসে, শিখার পায়ের কাছে অচৈতন্যের মত লুটিয়ে পড়ে একেবারে!
এ আবার কি?
শিখা আর মা দু’জনে রতনের মুখে—চোখে জল দেন—পাখার বাতাস করেন। রতনের জ্ঞান হয়। সে চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে চকিতের জন্য তাকায়—তারপর আবার চোখ বোজে।
বিপুল আগ্রহে শিখা তাকে ঝাঁকানি দেয়, ”এই, কি হয়েছে—সকালে এ—রকম করছো কেন?”
রতন কেবল উঁ—উঁ করে, কথা বলতে পারে না। মুখে কথা ফোটে না—দু—চোখ যেন কেমন ধারা!
মায়ের ওপর রতনের ভার দিয়ে শিখা ওঠে। দেখা যাক, রতন যে—ঘরে শুয়েছিল, সে—ঘরে কি দেখেছে—যাতে হঠাৎ এমন ভয় পায়!
লম্বা বারান্দার কোণের ঘরে কাল রাত্রে শুয়েছিল ছোটু আর রতন। ঐ ঘরেই তারা শোয়। ঘরের দরজা খোলা। দরজায় দাঁড়ালো শিখা, তার পিছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন সুরনাথ। রতনের চীৎকারে তিনিও ঘর থেকে ছুটে এসেছেন।
একটা বড় বিছানায় শুয়েছিল ছোটু আর রতন। রতন উঠে গেছে, ছোটু এখনও শুয়ে ঘুমোচ্ছে। আশ্চর্য্য! রতনের অমন চীৎকারেও তার ঘুম ভাঙ্গেনি!
”ছোটু—এই ছোটু—বাপ রে, কি ঘুম! ওঠো—ওঠো—” শিখা ডাকে, ”রতনের এই চেঁচানিতেও ঘুম ভাঙ্গলো না! বেলা অনেক হয়েছে। ওঠো—”
ছোটুর সাড়া নেই।
শিখার পাশ দিয়ে মুখ বাড়ান সুরনাথ। তারপর ভয়ার্ত্ত কণ্ঠে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, ”মরে গেছে শিখা! ওর মুখ দেখছো? আর চোখ দুটো?”
মা ছুটে আসেন। শিখার পাশ দিয়ে পলকের জন্যে দৃষ্টিপাত করেই তিনি সরে যান।
শিখা ছোটুর বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়। চিত হয়ে পড়ে আছে ছোটু—তার চোখ দুটি বিস্ফারিত। ভীষণ ভয়ের চিহ্ন তার মুখে ফুটে রয়েছে। গলার কাছে মস্ত বড় ফোকর—দেহে রক্তের লেশ নেই! দেখেই বোঝা যায়!
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে শিখা।
মাতুল সুরনাথ বেশ কাঁপছেন! কাঁপতে কাঁপতে তিনি বলেন, ”বেরিয়ে এসো শিখা, বেরিয়ে এসো। ভূতে গলা ফুটো করে রক্ত চুষে খেয়েছে! ওরে বাপরে, এ—বাড়ীতে নাকি মানুষ থাকে! আমি আজই পালাবো। আর নয়, বাবা। পুরী দেখা আমার মাথায় থাকুক! পৈতৃক প্রাণ নিয়ে কোনমতে—”
”আপনি থামুন তো।”
শিখা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ওঠে, ”ও—সব কথা পরে হবে। এখন আগে ছুটে গিয়ে থানায় খবর দিয়ে আসুন। তাড়াতাড়ি যান। যাবার সময় ডক্টর দাসকে অমনি খবর দিয়ে যাবেন।”
মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে সুরনাথ নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যান।
ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় শিখা। পুলিস না আসা পর্য্যন্ত সে অপেক্ষা করে।
পুলিস আসতে দেরী হয় না, দেরী হয় ডক্টর দাসের আসতে। সুরনাথ বললেন, ডাক্তারকে তিনি আগেই খবর দিয়ে গেছেন, ডাক্তার তখন এক হিন্দুস্থানী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা কইছিলেন। বললেন, জরুরী একটা কেস এসেছে, দেখে তারপর তিনি আসবেন।
পুলিস—অফিসার নীলকণ্ঠ এখানকার লোক—অনেকদিন এ—থানায় আছেন। শিখার নাম তিনি জানেন, আজ তার সঙ্গে পরিচয় হতে তিনি ভারি খুশী হন।
মৃতদেহ পুলিসের জিম্মায় পরীক্ষার্থে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি সখেদে বলেন, ”আমাদের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জা আর দুঃখের কথা, শিখা দেবী! পর—পর এই ধরণের খুন হয়ে চলেছে, অথচ আমরা কিছুতে ধরতে পারছিনে! ডাক্তারী পরীক্ষায় জানা গেছে, কোন পাখী—বেশ লম্বা আর ধারালো ঠোঁটওয়ালা অতিকায় পাখী—তারা ঠোঁট দিয়ে মানুষের গলা ঠুকরে ফোকর করে চক্ষের পলকে রক্ত চুষে খেয়ে এমনি করে মারছে! নিঃশেষে রক্ত চুষে খায়। এ যে কি জীব, তা আজও আমরা ধরতে পারিনি! ধরবার জন্য আমরা এই বীচ রোডের সব জায়গায় রীতিমত পাহারার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু পাহারাদারদের মধ্যে দু’জন মারা গেছে এ—পাখীর ঠোঁটের ঘায়! এ—পাখীর ভয়ে কোন লোক সন্ধ্যার পর থেকে এ—পথে কেন—সাগরের ধারে পর্য্যন্ত বেড়াতে আসতে চায় না।”
শিখা মাথা নীচু করে কি দেখছিল; এতক্ষণে মুখ তুললো, বললে, ”আমি যদি বলি, এ—কাজ শকুনের দ্বারা হয়েছে, আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন?”
”শকুন!”
পুলিস—অফিসার নীলকণ্ঠ যেন আকাশ থেকে পড়লেন! বললেন, ”শকুন এ—কাজ কেন করবে? তারা রাত্রে বেরিয়ে এলেও এমন ভাবে ঘরে ঢুকে মানুষ খুন করবে, এ কখনও সম্ভব হতে পারে?”
ধীর কণ্ঠে শিখা বললে, ”জগতে অসম্ভবই বা কি আছে, বলুন? মানুষ যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, এটা তো স্বীকার করবেন।”
তার কথার মর্ম্ম বুঝতে পারেন না নীলকণ্ঠ। বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শিখার পানে চেয়ে থাকেন।
শিখা বললে, ”সার্কাসে দেখেছেন, মানুষ হিংস্র বাঘ, সিংহ, দুর্দ্দান্ত হাতী, জেব্রা, উট—এ—সব জানোয়ারকে বশ করে তাদের দিয়ে কতরকম খেলা দেখিয়ে পয়সা উপার্জ্জন করে। এখানেও তাই। ধরুন, কোন লোক দু—তিনটি অতিকায় জাতের শকুন পুষে তাদের এমন ট্রেনিং দিয়েছে যে, তাদের নির্দ্দেশে শকুনরা এ—কাজ করে—মানুষকে আক্রমণ করে এই ভাবে তারা মারে!”
নীলকণ্ঠ মাথা চুলকোন। শিখার কথা তিনি বুঝেছেন, তাঁর ভাব দেখে তা মনে হয় না।
দশ – দুলিচাঁদ
সব কথা শুনে দেবাশীষ আশ্চর্য্য হয়ে যান। শিখাকে নিয়ে তিনি বাড়ীটা ঘুরে—ফিরে দেখেন।
দেখে এসে বলেন, ”আমি বলি, মেজর রায়কে যেমন করে হোক, এ—বাড়ী থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার সঙ্গে এসেছেন কলকাতার মেডিকেল কলেজের ডাক্তার মোহিত চক্রবর্ত্তী। বিলাতে উনি বহুকাল কাটিয়েছেন—অনেক রিসার্চ করেছেন। তিনি আসছিলেন পুরীতে। ট্রেনে আলাপ হলো। তাঁকে এ—ব্যাপারের একটু আভাস দিলুম। তিনি এখানে এসে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ীতে উঠেছেন। বলেছেন, স্নানাহার সেরে এ—বাড়ীতে আসবেন। তিনি এসে মেজর রায়কে দেখুন—দেখে এ—বাড়ী থেকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা—”
শিখা বললে, ”ডক্টর দাসকে খবর দেব? ডক্টর দাস এত দিন দেখছেন। রোগটার সম্বন্ধে—”
বাধা দিয়ে দেবাশীষ বলেন, ”ডক্টর দাসকে তিনি মোটে বিশ্বাস করেন না। দাসের কথা তিনি মানতে চান না নিজে দেখে ব্যবস্থা করবেন।”
বৈকালের দিকে মোহিতবাবু এলেন। মেজর রায়কে ভালো করে দেখলেন…বিছানার পাশে নতজানু হয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। কি—ভাবে নিশ্বাস পড়ছে…কতক্ষণ চোখ বুজে আছেন, কখন চোখ খুলছেন…চোখ খুললে তাঁর চাহনির ভঙ্গী…সব বেশ ভালো করে দেখলেন। দেখে চিন্তিত হলেন, এ—ঘরে এসে বললেন, ”আমার মতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। ঐ যে বিড়—বিড় করেন, কত কি কথা ওর মধ্যে বলে যান—এ—উন্মাদের লক্ষণ, মনে হয়। কোন রকম আঘাত বা অতিরিক্ত ভয় পেয়ে অর্থাৎ, অকস্মাৎ কোন দুঃখ—কষ্টের আঘাত দুর্ব্বল ব্রেণ সইতে না পারলে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়। এ তাই।”
বাড়ীর প্রত্যেকটি স্থান পরীক্ষা করা হয়। যে দেওয়ালটা শিখার মনে হয়, রহস্যে আচ্ছন্ন—সে দেওয়াল পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সন্দেহ করবার মত কিছু পাওয়া যায় না।
সেদিন যতীন্দ্রনাথের কাছ থেকে চিঠি এলো। যতীন্দ্রনাথ এখানকার খবর জানতে চেয়েছেন।
তিনি লিখেছেন—
টেলিগ্রাম পেয়ে যেভাবে তুমি পুরী চলে গেলে—তারপর ওখানকার কোন খবর দিলে না, এজন্য চিন্তিত আছি। তোমার কাকাবাবু কেমন আছেন—কি বিপদ—জানাবে।
পশুপতিনাথের খুনের সম্বন্ধে ভালো খবর আছে—শুনলে তুমি খুশী হবে। খুনী আসামী ধরা পড়েছে। লোকটার নাম দুলিচাঁদ। কিশোরদাস আগরওয়ালার কাছে চাকরি করতো। পশুপতিনাথের ওপরে লোকটার কি কারণে অত্যন্ত আক্রোশ ছিল। কিশোরদাস এবং জ্ঞানচাঁদ দুজনেই বলেছেন। পশুপতিনাথকে জব্দ করবে বলে অনেকবার শাসিয়েছিল, এ—কথা বাড়ীর অনেকে জানে। সাক্ষ্যেও তাঁরা সে—কথা বলেছেন। তুমি যেদিন চলে গেলে, তার পরের দিনই তদন্তে এ খবর জেনে তাকে আমরা গ্রেপ্তার করি মেছোবাজারে এক চায়ের দোকানে। সে নিজেও এ খুন স্বীকার করেছে।
যতীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন—
কিন্তু আসামী ধরলে কি হবে—লোকটা পাগল। আবোল—তাবোল বকে—হাসে, গান গায়—নাচে। পুলিস সার্জ্জন দেখে বলেছেন—পাগল। ডেপুটি—সাহেব তাকে ম্যাজিষ্ট্রেটের হুকুম নিয়ে ”অবজার্ভেশনে” পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। কাজেই আক্রোশের প্রমাণ এবং আসামীর স্বীকারোক্তি থাকলেও দায়রা—কোর্টে তার সাজা হবে না, নিশ্চিত। ইতি
চিঠি শেষ করে পুনশ্চ বলে আরো ক’টি ছত্র যোগ করেছেন—
পুনশ্চ,—পান্নাকে কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ী থেকে সে কোথায় পালিয়ে গেছে। সন্ধান করে কোথাও এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায়নি। তার মাসীমা দিন—রাত পড়ে পড়ে কাঁদছেন। মেয়ের শোকে বাপ কিশোরদাস অভিভূত—কাজকর্ম্ম দেখেন না, কারো সঙ্গে দেখা করেন না—উপরতলা থেকে নীচেও নামেন না।
চিঠি পড়ে দেবাশীষকে শিখা জানাল আনুপূর্ব্বিক কাহিনী।
শুনে দেবাশীষ বললেন, ”একসঙ্গে এতগুলো ব্যাপার! এমন শোনা যায় না, শিখা দেবী।”
মৃদু কণ্ঠে শিখা বললে, ”আমারও কেমন—কেমন লাগছে দেবাশীষবাবু! যে—আসামীকে ওঁরা ধরেছেন, আমার বিশ্বাস, পশুপতিনাথকে ও খুন করেনি! এর মধ্যে রহস্য আছে। আপনার কি মনে হয়? তার উপর পান্না নিখোঁজ!”
দেবাশীষ বললেন, ”থাকা সম্ভব! আমি শুধু এটুকু কাহিনী শুনে এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারি না। বলা উচিত হবে না। তাছাড়া মাথাটা এখন আপনার কাকাবাবুর কথায় ভরে আছে! আগে এদিককার কিনারা হোক, তারপর চিন্তা করা যাবে।”
এগারো – কাল-রাত্রি
কলকাতায় যাবার দিন স্থির হয়েছে। ডাক্তার চক্রবর্ত্তী রোগীকে নিজের হাতে নিচ্ছেন—মেজর রায়ের অবস্থা একটু ভালো বোধ হচ্ছে। ডাক্তার চক্রবর্ত্তী বেলা দশটায় দেখে বলেছেন, কলকাতায় না গেলে তিনি চিকিৎসা করতে পারবেন না। দূর থেকে চিকিৎসা করা অসম্ভব!
তাঁর কথায় প্রতিবাদ তুলে ডক্টর দাস বলেন, ”এ—রোগীকে এখান থেকে এখন সরানো কিছুতেই উচিত হবে না। যে—কোন মুহূর্ত্তে হার্টফেল হতে পারে।”
শিখা জিদ করে, ”তবু আমরা নিয়ে যেতে চাই, ডক্টর দাস। এখানে থাকলে কাকাবাবু বাঁচবেন না! হার্টফেল হয় যদি তো ট্রেনেই হোক।”
যথাসময়ে খাওয়া—দাওয়া সারা হলো। দেবাশীষের দেখা নেই, সকালে চা—জলখাবার খেয়ে সেই যে বেরিয়েছেন, বেলা বারোটা বাজে, এখনো ফেরেননি!
খাওয়া—দাওয়া চুকতে শিখা এল মেজর রায়ের ঘরে—তিনি জেগে শুয়ে আছেন। শিখা বললে, ”বারোটায় ওষুধ খাবেন কাকাবাবু। ডাক্তার চক্রবর্ত্তীর ওষুধ। তিনি কাল কলকাতায় গেছেন। আমরা কাল যাবো, পরশু ডাক্তার চক্রবর্ত্তী আমাদের বাড়ী আসবেন, বলে গেছেন। আপনাকে দেখতে আসবেন।”
কাকাবাবু এ—কথার কোন জবাব দিলেন না, উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলেন শিখার পানে। শিখা বিছানার পাশে বসে তাঁর পায়ে হাত বুলোতে লাগল।
মা এলেন, কাকীমা এলেন—বারোটা বাজল। শিখা ওষুধ খাওয়াল। দেবাশীষ এখনো ফেরেননি! শিখার মনে হলো, নিশ্চয় তিনি এ—ব্যাপারের খবরাখবরের সন্ধানে বেরিয়েছেন।
শিখা ভাবল, সে একবার চারিদিক ঘুরে দেখবে—কাকাবাবু তো ভালোই আছেন—দু—তিন ঘণ্টা সে ঘুরে আসবে।
শিখা বেরুলো—এ—পথে, ও—পথে ঘুরে বেড়াল। মন্দিরের ধার দিয়ে ওদিকে—এদিকে—পথের লোকজনদের ওপর বেশ একটু সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে! কোথাও সন্দেহ করবার মত কিছু দেখল না। শিখা বাড়ী ফিরলো, তখন দুটো বেজে দশ মিনিট—রতনের কাছে শুনল, দেবাশীষ ফিরেছেন একটার পর, এসে স্নানাহার করে শুয়েছেন, বড় ক্লান্ত!
শিখা একটু স্বস্তি বোধ করলো, দেবাশীষ ফিরেছেন। একা নিজেকে কেমন নিঃসহায় মনে হচ্ছিল! মনে নানা—রকম চিন্তা—অথচ সে—চিন্তার কথা কাকেও বলতে পারে না! দেবাশীষকে পেলে তাঁর সঙ্গে তবু—
শিখা বসলো হলের সামনে বারান্দায়—ইজিচেয়ারে! শ্রান্ত দেহ, দুশ্চিন্তায় অবসন্ন মন, বসে ভাবনার তরঙ্গে মনকে দিল ভাসিয়ে।
ভাবতে—ভাবতে কখন দু—চোখ ঘুমে বুজে এসেছে, খেয়াল নেই!
ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের আহ্বানে। শিখা ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।
মা বললেন, ”এখানে ঘুমোচ্ছিস কেন মা? ঘরে গিয়ে একটু শো বরং।”
শিখা উঠে দাঁড়াল। বললে, ”না মা, ঘুমোনো হবে না। হঠাৎ কেমন তন্দ্রা এসেছিল! তা কাকাবাবুর কি খবর?”
মা বললেন, ”ভালো। ঘুমোচ্ছেন। সে—রকম চমকে—চমকে ঘুমভাঙ্গা নেই, মা।”
”সমানে ঘুমোচ্ছেন?”
মা বললেন, ”তা ঠিক নয়। মাঝে—মাঝে চোখ খুলছেন, তবে সে—ভয় বা চীৎকার আর নেই। তবে কেমন আতঙ্ক ভাব যেন!”
শিখা বললে, ”হ্যাঁ। ডাক্তার চক্রবর্ত্তী বলে গেছেন, তিনি যে ওষুধ দিয়েছেন, তাতে শান্ত থাকবেন—আচ্ছন্নের মত থাকবেন।”
নিশ্বাস ফেলে মা বললেন, ”ভালোয়—ভালোয় দেশে একবার নিয়ে যেতে পারলে বাঁচি, মা!”
আশ্বাস দিয়ে শিখা বললেন, ”ভাবনা করো কেন মা? ভয়ের কিছু থাকলে ডাক্তার চক্রবর্ত্তী কখনই কলকাতায় নিয়ে যেতে বলতেন না। তিনি বলেছেন, চিকিৎসা হলেই সেরে উঠবেন।”
দেবাশীষ এলেন, বললেন, ”ঘুমিয়ে নিলুম একটু।”
শিখা বললে, ”কোন খবর পেলেন?”
দেবাশীষ বললে, ”না। থানায়—থানায় নানা—রকমে নানা প্রশ্ন করেছি—সন্দেহ করবার মত কোনো কিছু পেলুম না কোথাও।”
মা বললেন, ”চারটে বাজলো, তোমাদের চা—জলখাবারের ব্যবস্থা করি।”
মা চলে গেলেন।
দেবাশীষ বললেন, ”আপনিও তো বেরিয়েছিলেন, কিছু পেলেন?”
”না।” শিখা বললে, ”কিছু না পেলেও আমার মন বলছে, আজ রাত্রে একটা কিছু—”
তার কথা শেষ হলো না, দেবাশীষ বললেন, ”তার মানে?”
”মানে জানি না। আমার মন বলছে, দেবাশীষবাবু!”
যেদিন কলকাতায় যাওয়া হবে, তার আগের দিন—
ডক্টর দাসের শেষ কথা! দশটার সময় যাবার আগে ডক্টর দাস শিখাকে একান্তে ডেকে বলে গেলেন, ”এ—রাতটা আগে কাটুক মিস্ রায়! উনি চুপচাপ আছেন দেখে এঁরা যত ভরসা পান, আমার ভালো লাগছে না! আমি তো এতদিন দেখছি ওঁকে—রোগীর অবস্থা আজ মোটেই ভালো নয়! আপনিও বুঝবেন!”
শিখা হতভম্ব! তবু মনে হচ্ছে ডক্টর দাসের মুখে যেন বাঁকা হাসির রেখা দেখেছে!
আজ রাত্রি! কাকাবাবুর সম্বন্ধে ডক্টর দাসের ও—কথায় শিখার মনে হচ্ছে, যেন কাল—রাত্রি।
কোন রকমে এ—রাত কাটাতে পারলে হয়! প্রথম থেকেই শিখার মনে হয়েছে, এ—বাড়ী বাড়ী নয়—যমপুরী! আজ আট—দশদিন মাত্র সে এসেছে, এর মধ্যে ঘটলো বেচারা ছোটুর অপমৃত্যু, পথের উপর একজন কনষ্টেবল—ঠিক ঐ একভাবে তারও মৃত্যু হয়েছে! বৃদ্ধ মালির একমাত্র পুত্র সেদিন রামলীলা দেখতে গিয়ে আর বাড়ী ফেরেনি! দু’দিন বাদে সমুদ্র—তীরে দেখা গেছে তার খাবলানো মৃতদেহ! মনে হয়, কোন জন্তু তার দেহের মাংস কামড়ে খুবলে খুবলে খেয়েছে! মা কেঁদে ভাসাচ্ছেন, কাকীমা পাথর হয়ে গেছেন! এখানে আর এক দিন নয়!
রতন সেদিনকার সে ঘটনার পর থেকে আর অন্য ঘরে থাকে না, শিখার ঘরের লাগাও ছোট ঘরটাতে শোয়।
আজ রাত্রে বিপর্য্যয়—রকম কিছু ঘটবে—শিখার যেন মনে হচ্ছে! মনে যেন ভারী পাথর চাপানো! অথচ মনের এ—সংশয়, এ—শঙ্কা কারো কাছে প্রকাশ করেনি—বেশ সহজ ভাবেই সকলের সঙ্গে হাসছে, গল্প করছে!
বেলা যত পড়ে আসছে, মনের মধ্যে গুমট ততই নিবিড় হয়ে জমছে! কাকাবাবুর কাছে সে গিয়ে কতবার বসছে—কাকাবাবু ঘুমোচ্ছেন—মাঝে মাঝে জাগছেন, জাগলে তাঁর চোখে বিস্ময়—আতঙ্ক—রাগ রেখায়—রেখায় ফুটে উঠছে! তবে তেমন চীৎকার করছেন না! মাঝে—মাঝে কথা কইছেন—শিখা তাঁকে বলেছে—কাল কলকাতায় ফেরা হবে—কেন না, শিখার কলেজ আছে—এখানে তার আর থাকা চলে না! মা আর কাকীমার ভরসা হয় না, কাকাবাবুকে নিয়ে এখানে থাকবার! এ—কথায় কাকাবাবু কোন কথা বলেননি—কোন প্রশ্ন করেননি—তাঁর চোখের দৃষ্টিতে শুধু কেমন ভাব যেন!
তারপর সূর্য্য অস্ত গিয়ে রাত্রি হলো। বারান্দায় বসে শিখা আর দেবাশীষ।
দেবাশীষ বললেন, ”কাল সন্ধ্যায় ট্রেন—কিন্তু আমি ভাবছি, এখানকার এ—রহস্য এমনি রহস্য থেকে যাবে? আমার মনে হচ্ছে, এর মীমাংসা—”
শিখা বললে, ”আমারো সেই কথা মনে হচ্ছে দেবাশীষবাবু। কিন্তু কাকাবাবুকে নিরাপদ না করে কিছু করা চলে না। আপনি যদি রাজী থাকেন—কাকাবাবুকে কলকাতায় একটু সুস্থ হতে দেখলে আমি আসতে রাজী!”
দেবাশীষ উৎসাহভরে বললেন, ”নিশ্চয়! আমি আসতে খুব রাজী, কমিশনার সাহেবকে বলে ছুটি নিয়ে আসবো।”
”বেশ কথা।”
তারপর রাত্রির খাওয়া—দাওয়া সেরে সকলে শুতে গেলেন।
শিখা ঘুমোলো না—সে প্রতীক্ষা করছে। রিভলভারে গুলি ভরে উঠানের দিককার জানালা খুলে সেই জানালার কাছে অন্ধকারে সে বসে আছে।
ঘড়িতে ঢং করে একটা বাজে।
চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, কেবল সমুদ্রের ভৈরব গর্জন চলেছে একটানা ভীম—রোলে!
উঠানের ওদিকে খট করে শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে একটা নীল আলো দপ করে জ্বলে নিভে যায়!
বিরাটকায় দুটি মূর্ত্তি এগিয়ে আসছে!
কি ও—দুটো?
শিখার কাছে টর্চ আছে, জ্বাললো না—আলো দেখে যদি পালায়। দেখতে হবে, এ—জীব দুটি কি?
থপ—থপ—থপ—থপ—থপ—থপ শব্দ!
দুলে দুলে অথচ ক্ষিপ্র পায়ে তারা এগিয়ে আসে—উঠান পার হয়ে বারান্দায় ওঠে।
শকুন! বিরাটকায় দুটি শকুন!
শিখা স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
শকুনরা এগিয়ে আসে।
অকস্মাৎ শিখার চেতনা ফেরে। শকুন দুটো ওদিককার ঘরের দিকে চলেছে—সে—ঘরে দেবাশীষ আর সুরনাথ।
গুড়ুম—গুড়ুম—গুড়ুম—গুড়ুম—
শিখার হাতের রিভলভার মুহুর্মুহু গর্জ্জন তোলে! আগুনের ঝলকানি!
অব্যর্থ লক্ষ্য। গুলি লাগে অতিকায় জীব—দুটোর গায়ে—সঙ্গে সঙ্গে আর্ত্ত চীৎকার শোনা যায়!
কি ভীষণ চীৎকার! মনে পড়ে, এমনি চীৎকার শুনে একদিন ঘুমের ঘোরে শিখা ধড়মড় করে উঠে বসেছিল!
সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীর প্রত্যেক ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। সকলে হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন—শিখাও আসে বেরিয়ে।
বিরাটকায় দু’টি শকুন—তখনও তারা মরেনি, ঝটপট করছে।
বিস্ময়ে সকলে নির্ব্বাক! শিখাকে মা সভয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠেন। রতনকে সেখানে দেখা যায় না।
দেবাশীষ আর সুরনাথের অগ্রসর হতে সাহস হয় না। পলকহীন নেত্রে শকুন দু’টির পানে তাঁরা তাকিয়ে আছেন। দেবাশীষের মুখে শুধু একটি শব্দ ফোটে, ”সর্ব্বনাশ! এ আবার কি রকম পাখী।”
শিখা শান্ত কণ্ঠে বলে, ”এই শকুনের কথাই আমি বলেছিলুম, দেবাশীষবাবু। আপনারা সকলে হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন! সাক্ষাৎ এই যমদূত দু’টি আপনাদের দু’জনকে লক্ষ্য করেই আজ চলেছিল। আমি আজ সারা রাত অন্ধকার ঘরে জানালায় বসে আছি, শত্রুপক্ষ তা জানতে পারেনি। অনেক সৌভাগ্য আপনাদের, এ—দু’টি শকুনের ঠোঁটের ঘায়ে কণ্ঠনালী ফুটো হয়ে আপনাদের রক্ত নিঃশেষে ওদের পেটে যেতে পারেনি! খুব রক্ষা পেয়েছেন!”
দেবাশীষ বিস্ময়ে স্তম্ভিত! তিনি বলেন, ”এ—কথা কোনদিন ভুলবো না, মিস্ রায়, আপনার জন্যই আজ আমরা বেঁচেছি!”
সুরনাথ বললেন, ”হ্যাঁ মা, তোমার বাহাদুরি আছে। এমন নিঃশব্দে এত বড় ব্যাপার করলে, কখন কি ভাবে—আশ্চর্য্য!”
শিখা বললে, ”এখন আশ্চর্য্য হবার সময় নয় মামাবাবু! এখানকার পুলিস—অফিসার পাশের বাড়ীতে ঢুকেছেন এতক্ষণে। আমি আজ বৈকালেই তাঁকে আমার মতলব জানিয়েছি। দেখবেন, এখনি এ—খেলার খেলোয়াড়দের পাবেন হয়তো।”
বলবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র পুলিস—বেষ্টিত যে ক’জন লোককে নিয়ে পুলিস অফিসার নীলকণ্ঠ এ—বাড়ীতে এলেন—উজ্জ্বল আলোয় তাদের পানে তাকিয়ে দেবাশীষ পরম বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, ”পরমেশ্বরী!”
সুরনাথ ততোধিক বিস্ময়ে বলেন, ”আপনি একে চেনেন?”
দেবাশীষ বললেন, ”খুব বেশী রকম চিনি। আমাদের পুরানো দোস্ত! বহু বারের দাগী আসামী। লালবাজারের খাতায় নাম লেখা—ফটো আঁটা মহাপুরুষ। জাল নোট—সিঁধ, কত কীর্ত্তি করেছেন! এখানে কিন্তু—”
দেবাশীষ তাকালেন পরমেশ্বরীর দিকে, বললেন, ”পুরীতীর্থে হঠাৎ! ব্যাপার কি পরমেশ্বরী? এইখানেই জাল নোট তৈরী হচ্ছে এখন, কলকাতায় সুবিধা হলো না—তাই?”
শিখা বললে, ”আস্তানা সার্চ করলেই সব জানতে পারবেন দেবাশীষবাবু।”
পরমেশ্বরীর সঙ্গে আরও তিন—চারজন লোক।
নীলকণ্ঠ বললেন, ”এই ক’জনকে একসঙ্গে পেয়েছি। ঘর সার্চ এখনো করিনি, ওখানে কনষ্টেবল মোতায়েন রেখে এসেছি। সার্চের জন্যে দু’জন সাক্ষী আনতে একজন কনষ্টেবলকে পাঠিয়েছি। আপনারা আসবেন তো?”
দেবাশীষ বললেন, ”নিশ্চয় আসবো। শিখা দেবীও আসবেন বোধ হয়?”
”আসবো বৈ কি!”
আসামীদের নিয়ে নীলকণ্ঠ বেরুলেন; সঙ্গে সঙ্গে শিখা আর দেবাশীষও চললেন! সুরনাথকে শিখা বললে, ”আপনি বাড়ীতে থাকুন মামাবাবু, দরজা বন্ধ করে দিন। কে জানে, ওদের কোন চরটর যদি থাকে কাছাকাছি!”
নীলকণ্ঠ বললেন, ”বন্দুকওয়ালা দুজন শান্ত্রীকে আমি রেখে যাচ্ছি—সদরে থাকবে। ভয়, বাড়ীতে রোগী! জেগে উঠে গোলমাল শুনে তিনি পাছে কিছু করেন! আপনারা শুধু তাঁকে দেখুন।”
বারো – অতঃপর
বাড়ীর ওদিককার অংশ সার্চ করতে যে রহস্য প্রকাশ হলো, যেন পুরাণের কাহিনীর মত অলৌকিক! অনেক চিঠিপত্র, খাতা, প্যাকিং বাক্স, চালান, ভাউচার—এবং সে সব কাগজপত্র আর প্যাকেট—খাতা পরীক্ষা করে দেখা গেল, এখানকার এ ব্যবসা পুরুষোত্তমদাসের নামে এবং এই পুরুষোত্তমদাস নামটি গ্রহণ করে দাগী পরমেশ্বরী এখানে প্রকাশ্যে চালানী—কারবার পত্তন করেছে। প্রকাশ্য চালানী—কারবারের তলে চলেছে চোরা—কারবারের বিরাট সমারোহ—এবং এ—সবের সঙ্গে যোগ আছে বড়বাজারের ধনী ব্যবসায়ী কিশোরদাস আগরওয়ালার। বেশ ঘনিষ্ঠ যোগ। তিনিই কর্ম্মকর্ত্তা টাকা—দেনেওয়ালা।
একখানা চিঠি পাওয়া গেল, কিশোরদাসের লেখা—তলায় কিশোরদাসের নাম—সহি। সে—চিঠিতে লেখা—
পশুপতিনাথের খুনের দায়ে দুলিচাঁদকে আসামী বলে গ্রেফতার করিয়ে ওদিককার দায়ে নিশ্চিন্ত। পুলিসও তাকে পেয়ে সে—খুনের ব্যাপারে উচ্চবাচ্য থামিয়ে সরে গেছে। তবে শুনছি, শিখা রায় পুরী গেছেন, এবং আমাদের ও—বাড়ীর অপর—অংশে আছেন তাঁর কাকার ওখানে। তাঁর কাকার নাম অতুল রায়। মিলিটারীতে ছিলেন। আমাদের খবর জেনে তিনি হুমকি দিয়েছিলেন—নাগরমলকে তিনি চেনেন কি না—তাই! তাঁর ভাইঝি শিখা রায় বুদ্ধিমতী মেয়ে—পুলিসের সঙ্গে যোগ দিয়ে সাহস এবং বুদ্ধি খুব শানিয়ে তুলেছেন। এখানে পশুপতিনাথের লাশ ঐ শিখা রায়ই প্রথমে দেখেন; তার পর আমাদের উপরেই সন্দেহ। পুলিসের সঙ্গে মিশে এ খুনের রহস্য—উদ্ঘাটনে কোমর বাঁধছিলেন—হঠাৎ পুরী চলে গেছেন। খুব সাবধান! শিখা রায় যদি একটু সন্ধান পান—জানি না, পরিণাম কি!
আর একখানা চিঠি। এ চিঠিও কিশোরদাসের লেখা। এ চিঠিতে খবর লেখা—আফিংয়ের চালান কলকাতা থেকে আসছে, প্যাকিং—বাক্সে লেবেল আঁটা প্রোভিজনস! টাকা—কড়িরও হিসাব আছে। সেই সঙ্গে লেখা,—পান্না নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত জ্বালাচ্ছে—সে জন্য কোনো দিকে মন দিতে পারছেন না! তাকে ঘরে চাবি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তার মাসী কমলাও অত্যন্ত জ্বালাতন করছে। সে বলে, ডাক ছেড়ে কেঁদে পাঁচ—বাড়ীর লোককে জানান দেবে। কাজেই পান্নার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত না হতে পারলে পুরীতে আসা যত প্রয়োজনই হোক—তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
এ—সব চিঠিপত্র পড়ে এবং এখানকার ব্যাপার দেখে শিখা বললে, ”তাহলে একটা কথা বলি। দু—চার দিন আগে স্বর্গ—দ্বারের কাছে সন্ধ্যার সময় পাঁচ—সাতজনকে দেখি—তাদের মধ্যে একজন যেন জ্ঞানচাঁদের মত! তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে—কাজেই মনে হয়েছিল, হয়তো আমার দেখার ভুল! কিন্তু তা নয়, সত্যই তাহলে জ্ঞানচাঁদকে দেখেছিলুম! কিশোরদাস আসতে পারেনি—তার এজেণ্ট হয়ে তিনি এখানে এসেছেন। কিন্তু এদের দলে—কৈ, তাঁকে দেখছি না তো।”
নীলকণ্ঠ বললেন, ”হয়তো কর্ত্তব্য করে কলকাতায় চলে গেছেন!”
তারপর নীলকণ্ঠ তাকালেন শিখার দিকে, ”আপনাকে জ্ঞানচাঁদ দেখতে পেয়েছিল?”
শিখা বললে, ”না। জ্ঞানচাঁদ তখন আরো দু—তিনজন লোকের সঙ্গে কথা কইছিলেন। আমি তাঁকে দেখি চকিতের জন্যে, তখন আমি অন্য কথা ভাবছি—ভেবে একটা থিওরী খাড়া করে ঘুরছি! অবশ্য কিশোরদাস যে পশুপতিনাথের খুনের সঙ্গে জড়িত আছে, এ আমি তদন্তের গোড়া থেকেই অনুমান করছিলাম।”
দেবাশীষ বললেন, ”আমি বলি, ট্রাঙ্ক—কল করে যতীন্দ্রবাবুকে জানিয়ে দিই খবর—তাঁরা ওদিকে রুই—কাৎলা ধরবেন জাল ফেলে—এখনি। এই কিশোরদাসের সম্বন্ধে যখন এমন লিখিত প্রমাণ—তাকে ঘিরে এখনি জাল ফেললে আমার বিশ্বাস বহুৎ লাভ হবে! ইতিমধ্যে এখানকার কাজ—কারবার সম্বন্ধে এ—সব আসামীকে জেরা করলে বহু রহস্য প্রকাশ পাবে। তার আগে কিন্তু আমাদের প্রধান কাজ—মেজর রায়কে নিয়ে কলকাতায় যাওয়া।”
তাই হলো। মেজর রায়কে নিয়ে কলকাতায় ফেরা হলো এবং সব কথা পরে নিঃসংশয়ে জানা গেল।
পরমেশ্বরীকে কিশোরদাস দলভুক্ত করে। তাকে এবং তার সঙ্গে নাগরমল বলে কিশোরদাসের এক অনুচরকে এখানকার কারবার চালাবার জন্যে পাঠানো হয়। এদের সাহায্যেই কিশোরদাসের ব্যবসার এমন প্রসার।
পুরীর বাড়ীর ও—অংশ নাগরমলের বেনামিতে কেনেন কিশোরদাস এবং নিরাপদে কারবার চালান। তারপর পুলিস অফিসার দেবাশীষ বাড়ীর এদিককার অংশ কিনতে ওরা বিব্রত হলো। মাঝখানের ও—দেওয়াল কিশোরদাস তৈরী করান এবং কৌশলে ও—দেওয়ালের মাঝখানে গুপ্তদ্বার রাখা হয়। বাইরে থেকে ও—গুপ্তদ্বার এমনিতে নজরে পড়ে না।
শকুন দুটি পরমেশ্বরী আনায় আফ্রিকার উগাণ্ডা থেকে—উগাণ্ডার বাজ—পাখী। এদের শিক্ষা এমন যে, দু—তিনদিন উপবাসী রেখে কারও উদ্দেশে লেলিয়ে দিলে শিক্ষামত এরা ঠিক তাদের আক্রমণ করবে—ঠোঁটে কণ্ঠনালী ফুটো করে নিঃশেষে রক্ত চুষে খাবে। এ—বাড়ীর ঐ প্রতাপ সিং—ও—ও ওদের লোক। ছোটু, পথের কনষ্টেবল—ক’জনই মারা গেছে ঐ শকুনের ঠোকরানিতে। ওরাই শকুনদের লেলিয়ে দিচ্ছিল।
আরো জানা গেল, ডাক্তার দাস ওদের সহকর্ম্মী। তাই শিখাকে তাঁর ভয় দেখিয়ে সরাবার প্রয়াস। মেজর রায়কে ইনজেকশন দিয়ে রাখা—তাঁকে আরোগ্য করবার জন্যে বা আরাম দেবার জন্যে নয়—অজ্ঞান করে রাখাই ছিল উদ্দেশ্য। পরমেশ্বরী এ—সব কথা পুলিসকে বলল। ডাক্তার দাসকেও গ্রেফতার করা হলো।
কলকাতায় ওদিকে দেবাশীষের ট্রাঙ্ক—কল পাবা মাত্র যতীন্দ্রনাথ এবং অবনীশ গিয়ে তখনি কিশোরদাস আর জ্ঞানচাঁদকে গ্রেফতার করেন। পান্নার সন্ধান পাওয়া গেল না। পশুপতিনাথ ছাড়া পান্না আর কাকেও বিবাহ করবে না, পান্নার ছিল দুর্জ্জয় পণ—কিশোরদাস চেয়েছিলেন দলের তরুণ ধনী—নন্দন টাণ্ডনের হাতে পান্নাকে করবেন সমর্পণ। তা করলে টাণ্ডনের সর্ব্বস্ব কিশোরদাস করতলগত করতে পারবেন। পশুপতিনাথকে সরাবার কোন উপায় না পেয়ে ঐ গানের জলশার রাত্রে দুলিচাঁদকে দিয়ে তাকে খুন করানো হয়। এর জন্যে এক হাজার টাকা দেওয়া হয় দুলিচাঁদকে। তার পর ভয় হয়, টাকার উপর দুলিচাঁদের যেরকম লোভ—খুন করে এক হাজার টাকা পেয়ে যদি খুনের রহস্য ফাঁস করে পুলিসের কাছ থেকে আরো এক হাজার পায়! এই ভয়ে মদের সঙ্গে মারাত্মক কি বিষ তাকে খাওয়ানো হয়। সে বিষ খেয়ে দুলিচাঁদ মরেনি, জন্মের মত উন্মাদ হয়ে গেছে।
পান্না নিখোঁজ হবার পাঁচ—সাতদিন পরে তার লাশ পাওয়া যায়—দমদমার বাগান—বাড়ীর পিছনে একটা পচা পুকুরে। বিকৃত মূর্ত্তি—দেখে চেনা যায় না। পরণের শাড়ী আর গায়ের গহনা দেখে বোঝা যায়, পান্নার দেহ!
বিচারে অপরাধীদের দণ্ড হয়। কিশোরদাস আগরওয়ালার হয় দীর্ঘকালের জন্যে কারাদণ্ড।
মুখে জোর করে হাসি আনলেও কিশোরদাস যে ভেঙ্গে পড়েছেন, তা বেশ বোঝা যায়।
শিখার পানে তাকিয়ে তিনি কি বলতে গেলেন—মুখে কথা ফুটল না! দু’ হাতে তিনি চোখ চাপলেন। হয়তো পান্নার কথা তাঁর মনে জেগেছিল!
_____
মেজর রায়ের সে-কাহিনী কুমারিকা সিরিজের (৬ নং বই) ‘’দুর্গম পথে শিখা” উপন্যাসে সবিস্তারে বর্ণিত আছে।
***