শাঁখ আর ঘণ্টা বেজে উঠল, ঢাক তো বাজছেই। বাড়ির আর সমাগত গ্রামের মেয়েরা উলু দিচ্ছে। কামারের হাতে ঝকঝকে খাড়া উঠছে নামছে, এঁটেল আর বালিমাটি মিশিয়ে তৈরি বেদীর ওপরে পরপর বলি হয়ে যাচ্ছে একশো আটটা চালকুমড়ো, কলা, আখ, সুপুরি। মুখুজ্যেবাড়ির পূজো হয় দেবীপুরাণ অনুযায়ী, পশুবলি এ বাড়িতে নিষেধ। তার। মধ্যে সুপুরি বলি ব্যাপারটা দেখার মত। মাটির বেদীতে রাখা ওইটুকু একটা জিনিসের ওপর অতবড় ভারি খাড়া নির্ভুলভাবে নামিয়ে আনা রীতিমত কঠিন কাজ। সুপুরি শক্ত এবং গোল জিনিস, খাঁড়া যথেষ্ট ধারালো এবং কামার যথেষ্ট কুশলী না হলে ফলটা ফকে পাশে সরে যাবে। তা হলে মহা অকল্যাণ। কিন্তু বলি হয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।
সন্ধিপূজো শেষ হল। মেয়েরা গলবস্ত্র হয়ে ঠাকুরপ্রণাম করছেন, লোকজন সব উত্তেজিত হয়ে গড়ের তোপের প্রসঙ্গ আলোচনা করছে। এতদিনের কিম্বদন্তী, কিন্তু সেভাবে কেউ শোনেনি কামানের শব্দ। গ্রামের সরল বিশ্বাসী মানুষের মনে আলোড়ন তৈরি করবার মত ঘটনা এটা। মুখুজ্যেবাড়ির দুর্গোৎসবের মাহাত্ম্য নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হল।
দেবদর্শন প্রণাম সেরে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখে জল।
–শুনলেন ঠাকুরমশাই?
—শুনলাম। আপনার নিমন্ত্রণ রেখে ভালই করেছি।
—চলুন, আমরা বৈঠকখানায় গিয়ে বসি। রঘু, আমাদের তামাক দে-আর প্রসাদ। নিয়ে আয়।
উৎসব উপলক্ষে বাড়ি সাজানো হয়েছে দেখলাম। বৈঠকখানার দরজায় ঝুলছে আমপাতা আর শোলার কদমফুল। ভেতরে তক্তাপোশে গদির ওপর নতুন ধপধপে ফরাস পাতা, ধারে ধারে কটা মোটা গির্দা। আমরা গিয়ে বসার একটু পরেই রঘু দুজনকে তামাক দিয়ে গেল। পেছনে এল পুরোহিতের তন্ত্রধার, তার হাতে দুখানা কাঠের বারকোশে পূজোর প্রসাদ। দেবদর্শন বললেন—প্রসাদ খেয়ে আপাতত চালান ঠাকুরমশাই। দুপুরে খেতে কিন্তু দেরি হবে। লোকজন সব এতক্ষণ সন্ধিপূজো দেখছিল, এইবার রান্না চাপাবে
বললাম—তা হোক, আমার কোনও তাড়া নেই।
—আমাদের কিন্তু দেবীপুরাণ মতে পূজো, এই কদিন নিরামিষ খাওয়া চলছে, সেই বোধনের দিন থেকে। একেবারে দশমীর দিন বিসর্জন সেরে এসে রাত্তিরে লুচি-মাংস খাওয়া হবে সকলে মিলে। আপনার হয়ত কষ্ট হবে
—কিছু অসুবিধে হবে না। ভালমন্দ জিনিস খেতে খুব ভালবাসি ঠিকই, আবার নুনভাত খেতেও ভালই লাগে। স্বাদ জিনিসটা জিভে নয় মুখুজ্যেমশাই, হৃদয়ে।
দু-একজন করে গ্রামের বৃদ্ধ প্রতিবেশী বৈঠকখানায় এসে বসতে শুরু করলেন। সাধারণ মানুষেরা প্রসাদ খেয়ে সামিয়ানার নিচেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্পগুজব করতে লাগল। সবাই দুপুরে খেয়ে বাড়ি যাবে, সন্ধেবেলা এসে আরতি দেখবে, এবং আবার রাত্তিরের খাওয়া সেরে ফিরবে। সমস্ত গ্রামটায় উৎসবের আবহাওয়া এবং সেটা মুখুজ্যেবাড়িকে কেন্দ্র করে।
দেবদর্শনের বাড়ির একটা সুন্দর প্রথা দেখলাম। যেমন, দুপুর আর রাত্তিরের সামুদায়িক ভোজ। সবাই মিলে সামিয়ানার নিচে সারি দিয়ে বসে একই খাবার খাওয়া হচ্ছে। জমিদার বলে দেবদর্শন আলাদা বসেন নি, বা তাকে আলাদা করে বিশেষ কোনও খাবারও দেওয়া হচ্ছে না। রান্না হয়েছে মোটা লালরঙের আউশ চালের ভাত। কী মিষ্টি তার স্বাদ! সঙ্গে কলাইয়ের ডাল, কাঁচকলা ভাজা, আলু-বেগুন-কুমড়ো-ঝিড়ে-আঁটাশাকগুড়িকচু দিয়ে অনবদ্য একটা ঘাট, আমড়ার চাটনি আর পাতলা পায়েস। কোনও জমিদারবাড়ির পক্ষে নিতান্তই সামান্য আয়োজন, কিন্তু সমবেত মানুষজন সোনা হেন মুখ করে আনন্দের সঙ্গে তাই খাচ্ছে। প্রথম কারণ, জমিদারবাবুর প্রতি ভালবাসা। দ্বিতীয় কারণ, একসঙ্গে বসে খাওয়ার আনন্দ। দুটো কারণই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
খেতে খেতে দেবদর্শন বললেন-রাত্তিরে হবে লুচি, আলু-কুমড়োর তরকারি আর পায়েস। পায়েসটা একটু জোলো লাগছে, না? কী আর করা যাবে বলুন, এতগুলো মানুষের জন্য আয়োজন। আমাদেরও তো সে দিন আর নেই। তবে হ্যাঁ, আগামীকাল দুপুরে আপনাকে একটা জিনিস খাওয়াব। সামান্য জিনিস, তবে খেতে ভারি ভাল
বললাম-কী জিনিস?
—আমরুল পাতা, রাঙাআলু আর আম-আদা দিয়ে তৈরি চাটনি। আমাদের এই অঞ্চল ছাড়া জিনিসটার চল দেখিনি বিশেষ কোথাও–
সরল মানুষ দেবদর্শন, আনন্দে পূর্ণ মনের মানুষ। এই নিয়ে মাত্র দুবার ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ, তবু যেন একটা আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করলাম। সকলের সঙ্গে আনন্দ করে পূজোর বাকি দুটো দিন কেটে গেল। দশমীর দিন দুপুরের পর থেকে বৌঝির দল ভিড় করে ঠাকুরবরণ করতে শুরু করল। দু-থাক তক্তা দিয়ে প্রতিমার সামনে উঁচু মঞ্চের মত করে দেওয়া হয়েছে, তার ওপরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা ঠাকুরের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে, মুখে চুইয়ে দিচ্ছে সন্দেশ। নিজেদের মধ্যে এ-ওর কপালে সিঁদুর লেপে দিচ্ছে, শাঁখা আর নোয়ায় মাখিয়ে দিচ্ছে। এই লোকাচারের নাম সিঁদুর খেলা। আমাদের সমাজে মেয়েদের সমস্ত উৎসব-আনন্দই প্রায় পর্দার আড়ালে পালিত হয়। এই একটা দিন তারা অসঙ্কোচে বেরিয়ে আসে বাইরে। দেখতে ভারি ভাল লাগে তাদের স্বতোৎসারিত। আনন্দের প্রকাশ। বুঝতে পারা যায় আড়ালে থাকা এই বিপুল নারীশক্তির বলেই ঠিকঠাক চলছে সমাজটা।
সারা গাঁয়ের লোক মিছিল করে প্রতিমা নিয়ে বেরুল বিকেলবেলায়। তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে। ছায়া গাঢ় হচ্ছে আম-জামবাগানের ফাঁকে ফাঁকে। বাতাসে হিমের ছোঁয়া, কার্তিক মাসের প্রথম দিকের স্নিগ্ধ হিম। হেমন্তকাল আসতে আর দেরি নেই।
বাঁশের ওপর পাশাপাশি তক্তা সাজিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার ওপর ঠাকুর রেখে কাঁধে নিয়েছে বাহকেরা। হাতে তাদের মশাল, সন্ধে আর একটু গাঢ় হলেই জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। নাচতে নাচতে আর দেবীর নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে পুরো দলটা এসে দাঁড়াল নদীর ঘাটে। সেখানে ভাসানের জন্য পাশাপাশি দু-খানা নৌকো বেঁধে চওড়া বেদীর মত করা হয়েছে। ঠাকুরসুদ্ধ তক্তা রাখা হল সেই নৌকোর ওপরে, সঙ্গে উঠল দশ-বারোজন বলিষ্ঠ লোক আর ছ-জন ঢাকি। ঘাট থেকে ছেড়ে ধীরগতিতে নৌকো মাঝনদীতে গিয়ে দাঁড়াল। তখন অন্ধকার নেমেছে ঘোর হয়ে, নৌকোর ওপর জ্বলে উঠেছে মশাল। হঠাৎ সবগুলো ঢাক বেজে উঠল দ্রুততালে, নদীর পারে আর নৌকোর ওপরে লোজন চিৎকার করে উঠল—আবার এসো মা, অাবার এসো! আস্তে আস্তে দু-দিকে সরে গেল দুই নৌকো, প্রতিমাবাহকেরা মাঝখানের বাঁধনের দড়ি কেটে দিয়েছে। সোজাসুজি দাঁড়ানো অবস্থায় জলে ডুবে গেল দেবীপ্রতিমা। পাগলের মত বাজছে ঢাক, পাগলের মত চেঁচাচ্ছে মানুষ। ধকধক করে জ্বলছে মশাল। বিসর্জন হয়ে গেল।
পুরো দলটা আবার ফিরে এল মুখুজ্যেবাড়ির পূজোপ্রাঙ্গণে। মূর্তিহীন বেদীতে মিটমিট করে একটা প্রদীপ জ্বলছে। অতগুলো মানুষ ফিরে এল, কিন্তু পরিবেশে কীসের যেন একটা হাহাকার। কী একটা খুব আনন্দের জিনিস যেন এই একটু আগেও ছিল, এখন আর নেই। ঢাক থেমে গিয়েছে, পুরোহিত সুধীর ভট্টাচার্য ঘটে আম্রপল্লব ডুবিয়ে সবার মাথায় শান্তিজল ছিটিয়ে দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। দেবদর্শনের কাছে শুনেছি এই সুধীর ভট্টাচার্যেরই পূর্বপুরুষ হচ্ছেন দীনদয়াল ভট্টাচার্য, মুখুজ্যেবাড়ির তৎকালীন পুরোহিত, যিনি গড়ের তোপ সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
বারবাড়ির উঠোনে পরপর পাঁচখানা উনুনে রান্না চেপেছে। লোহার চাদর দিয়ে তৈরি বিশাল কড়াইতে মাংস কষা হচ্ছে। দেবদর্শনের কাছে শুনলাম চারমণ মাংস রান্না হচ্ছে, আর দেড়মণ ময়দার লুচি। নিবারণ ময়রাকে বায়না দেওয়া হয়েছিল, সে দু-মণ কড়াপাকের ছানার গজা বানিয়ে দিয়েছে। যারা বিসর্জনের মিছিলে গিয়েছিল তারা আর ফিরে যায়নি, সামিয়ানার নিচে বসে গল্পগুজব করছে। এখন একটু একটু করে আরও মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া মিটলে মাঝরাত থেকে কবিগান হবে। নবদ্বীপ থেকে রাম গোস্বামীর দল এসে পৌঁচেছে বিকেল নাগাদ, এখন তারা এক কোণে গোল হয়ে বসে তামাক খেতে খেতে বিশ্রাম করছে। পাশে তাদের যন্ত্রপাতি রাখা আছে। উৎসাহী মানুষেরা তাদের কাছে ঘুরঘুর করছে আলাপ জমানোর জন্য, কিন্তু তারা খুবই গম্ভীর লোক, বাজে আলাপ করে নিজেদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে রাজি নয়। চোখ বুজে ঝিমোনোর ভান করছে।
আর একটা পাসিং শো ধরিয়ে তারানাথ বলল—আমার গল্প একটু ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে, না? তবু মন দিয়ে শোনো, এসব দিনকাল চলে যাচ্ছে, তোমরা আর দেখতে পাবে না। শুনে রাখো, পরে ছেলেপুলেদের গল্প বলতে পারবে। বাংলার উৎসব ক্রমেই চেহারা বদল করছে। তাছাড়া আড্ডার তো এই নিয়ম, ধরাবাঁধা পথে গল্প। এগোয় না। আচ্ছা তোমরা একটু বোসো, আমি ভেতরবাড়ি থেকে আর একবার চায়ের কথা বলে আসি–
এখান থেকে হাঁক দিয়েই চায়ের ফরমাশ করে দেওয়া যায়, তারানাথ সচরাচর তাই করে থাকে। কিন্তু সে বিচক্ষণ মানুষ, আমরা তার সামনে ধূমপান করি না, তাই সে মাঝে মাঝে এটা-ওটা অছিলা করে উঠে যায়। আমরাও বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়ে আসি। তারানাথ উঠে ভেতরে যেতে কিশোরী বলল—চল হে, চটপট একটু ধোঁয়া টেনে আসি–
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা সিগারেট ধরালাম। মট লেনের একটু ভেতরদিকে তারানাথের বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে খুব দূরে নয়, কিন্তু রাস্তার কোলাহল এপর্যন্ত এসে পোঁছয় না। প্রাচীন কলকাতার একটা শান্ত, স্নিগ্ধ কোণে তারানাথ থাকে। পলস্তারা খসে যাচ্ছে, নোনা-ধরা দেওয়াল, সদর দরজার কাঠ জীর্ণ হয়ে ফাঁক দেখা দিয়েছে। তবু তারানাথের গল্পের মত পুরনো দিনের চাদর মুড়ি দিয়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে। আধুনিক যুগ একে না ছুঁয়ে পাশ দিয়ে এড়িয়ে চলে গিয়েছে।
কিশোরী বলল—চার-পাঁচ বছর আগেও তারানাথ চক্কোত্তিকে আমরা চিনতাম না। মনে আছে, আমিই তোমাকে প্রথম নিয়ে আসি? তুমি তো বুজরুক ভেবে প্রথমে আসতেই রাজি হওনি। আর আজ? হপ্তায় অন্তত একটা দিন না এলে মন ছটফট করে।
—ঠিক বলেছ।
–আসলে কী জানো, লোকটা গল্প বলে দারুণ সুন্দর। গল্পটা সত্যি না মিথ্যে, সে প্রশ্ন মনেই আসে না। ও একটা সম্মোহনের মত ব্যাপার–
সিগারেট শেষ করে দুজনে ভেতরে এসে বসলাম। একটু পরেই তারানাথও ফিরে এল। গলাখাঁকারি দিয়ে বলল—ঠাণ্ডা মত লেগেছে, আদা দিয়ে চা করতে বললাম। সেদিন ছেলেটার একটু সর্দিজ্বর মত হয়েছিল, গলির মোড়ের ভূপেন ডাক্তার এসে জেফরল নামে কাশির সিরাপ দিয়ে গেল। অবশ্য আমার কাছ থেকে ভিজিট বা ওষুধের দাম নেয় না, ওর ছেলের কোষ্ঠী আমি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওইসব রঙচঙে ডাক্তারি জল খাওয়ার চাইতে খুচখাচ অসুখে দেশী টোটকায় কাজ হয় অনেক বেশি। সর্দিকাশি হলে আমি আদা দিয়ে চা খাই, বড়জোর মুখে দু-একদানা কাবাবচিনি রাখি। তাতেই দিব্যি সেরে যায়। কাবাবচিনি চেন তো? ওই যে, ছোট্ট ল্যাজওয়ালা গোলমরিচের মত দেখতে–
চা এসে গেল। সুরুৎ করে চুমুক দিয়ে তারানাথ বলল—আঃ! আদা-চায়ের কি তুলনা আছে? হ্যাঁ, গল্পটা যেন কোন পর্যন্ত বলেছিলাম?
কিশোরী বলল—মুখুজ্যেবাড়িতে চার মণ মাংস রান্না হচ্ছে—
-হ্যাঁ। তারপর রাত সাড়ে-দশটা নাগাদ সামিয়ানার নিচে সারি সারি পাত পড়ে। গেল। যজ্ঞিবাড়িতে পরিবেশন করবার জন্য পাড়াগাঁয়ে একদল দক্ষ লোক থাকে। এখানেও তেমন কিছু লোক কোমরে লাল গামছা বেঁধে কাজে নেমে পড়েছে। বড় কড়াইতে কলকল করছে ঘি, উঁচলো-মুখ বাঁখারির আগায় গেঁথে ভোলা হচ্ছে লুচির গোছা। গরম ঘি আর সদ্য ভাজা লুচির গন্ধে সমস্ত জায়গাটা আমোদ করেছে। এক একজন লোক যে পরিমাণ লুচি খাচ্ছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। দেড়মণ ময়দায় শেষপর্যন্ত কুলোবে কিনা কে জানে। এখনকার তুলনায় সে ছিল অনেক সস্তাগণ্ডার বাজার, গাওয়া ঘি-তে লুচি ভেজে খাওয়াটা কোনও আহামরি ব্যাপার ছিল না। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের সের তখন দশ আনা কী বারো আনা, ভাবতে পারো? তবু একথা সত্যি যে, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ছিল গরীব। যতই সস্তা হোক, গাওয়া ঘিয়ে ভেজে লুচি খাওয়া তাদের কাছে স্বপ্ন ছিল। এসব দামী খাওয়া-দাওয়া একটু উচ্চবিত্ত পরিবারের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকত। পালেপার্বণে জমিদারবাড়িতে নেমন্তন্ন পেলে এরা কোমরের কষি ঢিলে করে খেতে বসে। খাওয়ার পর্ব চুকতে ঢুকতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা হল। একটা থেকে আরম্ভ হল কবিগানের আসর। সামনের সারিতে একটু কোণের দিকে আমাকে নিজের পাশে বসালেন দেবদর্শন। বললেন—ঠাকুরমশাই, কালকের দিনটাও থেকে যাবেন কিন্তু–
বললাম—শুধু কাল নয়, আমি আরও তিনদিন থাকব, লক্ষ্মীপূজো দেখে তারপর ফিরব–
কী একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও করলেন না দেবদর্শন। বললেন—খুব ভাল কথা, বেশ তো, বাঃ!
কবিগান হয় দুই বিরোধী পক্ষ নিয়ে। দুই পক্ষের তুমুল লড়াইতে আসর জমে ওঠে। রাম গোস্বামীর ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তারা নিজেদের মধ্যেই দুটো দল করে নেয়। তারপর চলতে থাকে চাপান-উতোর। প্রথমে মনে হয় নিজেদের ভেতরে সাঁটে গাইছে, এ কি আর তেমন জমবে? কিন্তু কিছুদূর এগুনোর পর দু-পক্ষের হুঙ্কার আর তেড়ে ওঠা দেখে বোঝা যায় ভেতরে আপোস থাকুক আর নাই থাকুক, আসর এবং গান জিনিসটা তারা ভালই বোঝে। তখনকার দিনে গ্রামাঞ্চলে হাততালি দেবার রেওয়াজ ছিল না, তার বদলে মানুষ হরিধ্বনি দিত। এখন ঘন ঘন ‘হরি হরি’ শুনে বুঝলাম আসর জমে গিয়েছে।
কিশোরী জিজ্ঞাসা করল—আচ্ছা, সে সময়ে আসরে আলো করত কী দিয়ে? বিদ্যুতের তো প্রশ্নই ওঠে না, হ্যাজাক বা ডে-লাইটও বোধহয় আসেনি। অন্ধকারে নিশ্চয়। গান হত না—
তারানাথ বলল—ভাল প্রশ্ন করেছ। আলোর বিষয়টা সমস্যা ছিল ঠিকই, তবে ব্যবস্থা যা হত তা মন্দ নয়। মুখুজ্যেবাড়িতেই দেখেছি, সামিয়ানার নিচে বড় ঝাড়লণ্ঠন গোটাকতক ঝুলিয়ে দেওয়া হত। পঞ্চাশ, একশো বা দুশো কাচের পাত্রের মধ্যে বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হত। এমন দু-খানা ঝাড়ে যেখানে অভিনয় বা গানবাজনা হচ্ছে সেই মঞ্চ যথেষ্ট আলোকিত হত। দর্শকদের বসবার জায়গার মাথার ওপরে বড় বড় কাচের ফানুস টাঙানো থাকত, তার ভেতরে জ্বলত তেলের বাতি। পরবর্তীকালে মোমবাতি বাজারে আসায় এবং ক্রমে সুলভ হওয়ায় মোমবাতিও জ্বলত। তোমরা ভাবছ এতে আর এমন কী আলো হত, আসরের কাজ চলত কী করে? ব্যাপার কী জানো, আজকাল ইলেকট্রিক আলো দেখে দেখে তোমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ, তুলনামূলকভাবে সেকালের এইসব আলোর আয়োজন তোমাদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হবে। কিন্তু তখন গ্রামের মানুষ রাত্তিরে ঘরের কাজ করত রেড়ির তেলের প্রদীপে, তাও বেশি তেল খরচ করার সামর্থ্য কারোরই ছিল না। সন্ধের পর খাওয়া সেরে সবাই শুয়ে পড়ত। সাড়ে-আটটায় গভীর রাত। উৎসবে অনুষ্ঠানে ধনীর বাড়ি নেমন্তন্ন পেয়ে সেখানে গিয়ে এই আলোর বাহার দেখেই তারা মুগ্ধ হয়ে যেত—যা তোমাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হচ্ছে। আমার বাবার কাছে শুনেছি, তার ছোটবেলায় প্রথম কেরাসিন তেলের বাতির ঔজ্জ্বল্য দেখে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এ তো তবু ভাল, বলা যেতে পারে রীতিমত আধুনিক যুগ। আজ থেকে আশি-পঁচাশি বছর আগে কি হত জানো? আসরের চারদিকে কলাগাছের। মাথা কেটে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হত, তার ওপরে বসানো থাকত মাটির সরা। যাত্রা বা পালাগান আরম্ভ হলে সেই সরায় ধুনোর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হত। ধুনোর আগুন বড় সাঙ্ঘাতিক, রাত্তিরে পথ হাঁটার জন্য ধুনোর মশালও তৈরি করার রেওয়াজ ছিল। ওই সরাগুলোতে আগুন জ্বলে উঠত দাউ দাউ করে, আলোয় আলো হয়ে যেত চারদিক। কয়েকজন তোক বগলিতে ধুনো নিয়ে আলোর তদারক করে বেড়াত। কোথাও আগুন কমে এলে বগলি থেকে মুঠো করে ধুনো তুলে সরায় ছুঁড়ে দিত, আবার আগুন জ্বলে উঠত আগের তেজে।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলেছে তারানাথ, এবার দম নেবার জন্য থেমে সিগারেট ধরাল। মৌজ করে কয়েকটা লম্বা টান দিয়ে বলল—তোমরা আলোর কথা তুললে, কিন্তু অত বড় আসরে দর্শক-শ্রোতারা গায়ক বা অভিনেতার গলা শুনতে পেত কী করে সে কথা জিজ্ঞাসা করলে না। আজকাল দেখছি বাজারে লাউডস্পীকার বলে যন্ত্র উঠেছে, সে যন্ত্রের সামনে মুখ রেখে কথা বললে চোঙের মধ্যে দিয়ে বিকট আওয়াজ বেরোয়। সে যুগে স্বপ্নেও এমন কাণ্ডের কথা কেউ ভাবেনি। তখন কী করত মানুষ?
বললাম-এটা তো সত্যিই তেমন করে ভাবিনি। কী করত তারা?
তারানাথ হেসে বলল—তোমরা ভাবছ তারানাথ চক্কোত্তি আবার একখানা অসম্ভব। কিছু কলাকৌশলের কথা বলবে, শুনে সবার তাক লেগে যাবে। না হে, তেমন কোনও উপায় ছিল না সেকালে। কবিয়াল বা যাত্রার অভিনেতার গলার জোরে দর্শকদের সংলাপ শোনাতে হত। আমি তেমন কয়েকজনকে দেখেছি। বাপরে, কী তাদের চেহারা, কী তাদের সাগরের গর্জনের মত গলার আওয়াজ! নৃপেন সেন্নাম ছিল আমাদের ছোটবেলার নামকরা অভিনেতা। সে যখন রাবণের ভূমিকায় নেমে হুঙ্কার ছাড়ত, আসরে বসে থাকা মায়েদের কোলে ঘুমন্ত বাচ্চারা জেগে উঠে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিত। বুকের কাপড় সরিয়ে মায়েরা ছেলের মুখে ইয়ে গুঁজে দিয়ে তবে তাদের শান্ত করত। শুনেছি আসরে বাচ্চারা বেশি কাঁদলে বিরক্ত শ্রোতারা তাদের কান্না থামাবার সহজ উপায়টা একযোগে চিৎকার করে মায়েদের বাতলেও দিত।
প্রায় শেষরাত্তিরে আলো ফোটবার কিছু আগে আসর ভাঙলো। দেবদর্শন আর আমি পূজোমণ্ডপ থেকে হেঁটে আসছি কাছারিবাড়ির দিকে, মাঝখানে জমিটুকু ঘন অন্ধকার, হঠাৎ দেউড়ির ওপারে দেবদর্শনের ভদ্রাসনের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম। এ সমস্ত বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে একটা মৃদু শান্ত নীল আলোর আভা।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লক্ষণ, প্রতিলক্ষণ, দৈব, কূটপ্রসার—এসব নিদর্শন বিচার করেই আমাদের চলতে হয়। নীল আলোটা দেখে বুঝলাম এই বাড়িকে ভগবান আশীর্বাদ করেছেন। এখানে কিছুদিনের ভেতর খুব ভাল কিছু একটা ঘটবে।