০৮. শশী মাস্টার

শশী মাস্টার মাছ মারার কনুই জাল নিয়ে বের হয়েছেন। জাল ফেলার কৌশল তার এখনো রপ্ত হয় নি। জালের মুখ গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়ার কথা। তা হচ্ছে না, জাল জড়িয়ে যাচ্ছে। শশী মাস্টারের জেদ চেপে গেছে, তিনি জাল ফেলেই যাচ্ছেন। পুরো কর্মকাণ্ড হচ্ছে শুকনায়, পানিতে না। শশী মাস্টারের কাজ আগ্ৰহ নিয়ে দেখছে সুলেমান। সে মাস্টারকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসে ফেসে গেছে। শুকনায় জাল ফেলার দৃশ্যে সে অভিভূত।

শশী মাস্টার বললেন, তুমি আমাকে কিছু বলতে এসেছ?

সুলেমান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। শশী মাস্টার বললেন, বলে ফেলো। কাজের সময় কেউ হা করে তাকিয়ে থাকলে ভালো লাগে না।

আপনার কাজ শেষ করেন, তারপর বলি। অপেক্ষা করি।

শশী মাস্টার জবাব দিলেন না। জাল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জালের একটা অংশ হাতের কনুইয়ে জড়িয়ে রাখতে হয় বলেই এর নাম কনুই জাল। জাল ছুঁড়ে মারার সময় বিশেষ এক মুহুর্তে কনুই নামিয়ে দিতে হয়। সেই বিশেষ মুহূর্ত বের করা যাচ্ছে না বলেই বিপত্তি।

সুলেমান বলল, আমি দেখায়া দেই?

শশী মাস্টার বললেন, না। কৌশলটা আমি নিজে নিজে বের করব। তুমি কী বলতে এসেছি বলে চলে যাও। হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে না। কোনো উপদেশ বা পরামর্শের জন্যে এসে থাকলে ‘নো’। আমি উপদেশ দেই না, পরামর্শও দেই না।

সুলেমান বলল, উপদেশ পরামর্শ না। আমি একটা আচানক জিনিস দেখছি। সেই বিষয়ে আপনারে বলতে চাই।

আমাকে বলে লাভ কী?

আপনি জ্ঞানী মানুষ। আচানক জিনিস ক্যান দেখলাম। আপনি বলতে পারবেন। আমি একজন মানুষরে শূন্যে ভাসতে দেখছি।

শূন্যে ভাসতে দেখেছি?

জে। মাটি থাইকা দুই তিন হাত উপরে সে ভাসতেছে।

শশী মাস্টার বললেন, গাজটা কম খাবে, তাহলে আর এইসব জিনিস দেখবে না। গাজা মনে হয় অতিরিক্ত খাচ্ছি।

মাস্টার বাবু, আমি গাজা খাই না। অনুমতি দেন পুরা ঘটনাটা বলি। মন দিয়া শোনেন।

শশী মাস্টার অনিচ্ছায় রাজি হলেন। বিরক্তিতে তাঁর ভ্ৰ কুঁচকে গেল। অশিক্ষার কারণে এইসব ঘটছে। ভূত-প্ৰেত, শূন্যে ভাসাভাসি, সবকিছুর মূলে অশিক্ষা। শশী মাস্টার সুলেমানের পাশে এসে বসতে বসতে বললেন, ঘটনা বলো। তবে সংক্ষেপে বলবে। ডালপালা দিয়ে বলবে না। আমি বৃক্ষ পছন্দ করি, ডালপালা পছন্দ করি না।

সুলেমানের ঘটনাটা এরকম— কয়েকদিন আগে সে গিয়েছে হরিচরণের বাড়িতে তার ছেলের সন্ধানে। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। মাগরেবের আজান হয় হয়ে গেছে কিংবা এখনি হবে। ছেলেকে সে খুঁজে পেল না। ফিরে আসছে, হঠাৎ চোখ পড়ল। হরিচরণ বাবুর দিকে। তিনি পুকুরের শ্বেতপাথরের ঘাটে কান্ত হয়ে শুয়ে আছেন। মনে হয়। ঘুমাচ্ছেন। ভর সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে থাকা খুব খারাপ, এইজন্যে সে উনাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার জন্যে ঘাটের কাছে গিয়ে থ’ হয়ে গেল। কারণ হরিচরণ শূন্যের উপরে শুয়ে আছেন। শ্বেতপাথরের ঘাট তাঁর দুই তিন হাত নিচে। এই হলো ঘটনা।

শশী মাস্টার বললেন, তুমি কী করলে? তাঁকে ডেকে তুললে?

সুলেমান বলল, আমি কিছুই করলাম না। দৌড় দিয়া পালায়া আসলাম। হারিকেন জ্বালায়া পরে আরেকবার গেছি। দেখি উনিও লণ্ঠন জ্বলায়ে বই श्रएহুঁ0ठgछ्न्म।

তাকে কি তুমি সন্ধ্যার ঘটনা বললে?

জে না।

বললে না কেন?

সাহসে কুলাইল না।

তুমি মদ, ভাং, গাজা, আফিম— এর কিছু খাও?

একবার তো বলছি- না। আমি মুসলমান। আমাদের ধর্মে এইসব খাওয়া নিষেধ আছে।

কোনোদিন খাও নাই?

একবার আফিং খাইছিলাম। পেটে বেদনা হইছিল। কবিরাজ চাচা বললেন, সরিষার দানা পরিমাণ আফিং দুধে দিয়া তিনদিন খাইতে। আমি দুইদিন খাইছি। দুইদিনেই আরাম হইছে।

হরিচরণ বাবু যে শুয়েছিলেন তাঁর গায়ে কি চাদর ছিল?

জে না।

মাথার নিচে বালিশ ছিল?

জে না।

তুমি যা দেখেছ, তার নাম ধান্ধা।

ধান্ধা কেন দেখাব?

ধান্ধা দেখার জিনিস তাই দেখেছি। দুনিয়ায় অনেকেই ধান্ধা দেখে। মরুভূমিতে দেখে মরীচিকা। চারদিকে ধুধু বালি— এর মধ্যে দেখে টলটলা পানি।

সুলেমান বলল, পানি দেখা আর মানুষ শূন্যে ভাসতে দেখা তো এক না।

শশী মাস্টার বললেন, জিনিস একই। তোমার মাথার কিছু দোষ আছে, এইজন্যে শূন্যে ভাসা মানুষ দেখেছ।

আরো একজন দেখেছে। তার মাথায়ও দোষ?

সেই একজন কে?

সুলেমান চাপা গলায় বলল, সে বিরাট পাপিষ্ঠ। তার নাম মুখে আনাও পাপ। একসময় আমার পরিবার ছিল, এখন নটিবাড়ির নটি। তার জন্যে আমার ইজ্জত গেছে। কাউরে মুখ দেখাইতে পারি না।

শশী মাস্টার অবাক হয়ে বললেন, তার নাম কি জুলেখা?

হুঁ। এই নাম আমার সামনে নিয়েন না। সেই বান্দি প্রথম দেইখা আমারে বলছিল। সেও হরিবাবুরে একই জায়গা দেখেছে। উনি ঘুমের মধ্যে ছিলেন।

শশী মাস্টার বললেন, তোমার স্ত্রীও ধান্ধাই দেখেছে। তোমাকে বলার পর তোমার মন তৈরি ছিল ধান্ধা দেখতে। যথাসময়ে দেখেছি। এই ঘটনা কি তুমি আর কাউকে বলেছ?

মাওলানা সাবরে বলেছি। মাওলানা ইদরিস।

উনি কী বলেছেন?

উনি বলেছেন, দুষ্ট জিনের কাজ।

জিন শুধু শুধু উনাকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখবে কেন?

সেটা আমি ক্যামনে বলব? জিনের সাথে তো আমার আলাপ পরিচয় নাই।

শশী মাস্টার বললেন, তুমি এই ঘটনা নিজের মধ্যে রাখবে। কাউরে বলে বেড়াবে না। বলাবলি করলে বিপদ হবে।

কী বিপদ?

দেশের মানুষ অশিক্ষিত। কুসংস্কারে ড়ুবে আছে। ঘটনা জানাজানি হলে সবাই ভাববে হরিবাবু বিরাট আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাধুপুরুষ। ঝাড়ফুকের জন্যে দলে দলে লোক আসবে। কবচ দরকার, ঝাড়ফুক দরকার।

সুলেমান বলল, উনার কাছে তো আগে থাইকাই অনেকে যায়। ফুঁ নিতে যায়।

শশী মাস্টার অবাক হয়ে বললেন, কই আমি তো জানি না!

আপনে থাকেন আপনের মতো। জানবেন ক্যামনে? মাস্টার বাবু, উঠি? ঘটনা কাউরে বলতে না করছেন, বলব না।

 

মাধাই খাল যেখানে বড়গাঙে পড়েছে সেখানে বিশাল এক পারুল গাছ। ফুলগুলি জবার মতো দেখতে, রঙ নীল মেশানো হালকা শাদা। শীতের সময় গাছতলা ফুলে ফুলে ঢেকে থাকে। হরিচরণ গাছের নিচটা বঁধিয়ে দিয়েছেন। শীতের সময় প্রায়ই তিনি বাধানো গাছতলায় এসে বসেন। পারুলের হালকা সুঘ্ৰাণে তার নেশার মতো হয়। মাঝে মাঝে তিনি খাতাপত্র সঙ্গে নিয়ে যান। লেখালেখি করেন। কী মনে করে যেন একটি গ্রন্থ রচনায় হাত দিয়েছেন। গ্রন্থের নাম—- ‘দেবদেবী অভিধান’। গ্রন্থে দেবদেবীর ঠিকুজি কুলিজি লিখছেন। তাদের কর্মকাণ্ডও লিখছেন।

মাঘ মাসের শেষ।

প্ৰচণ্ড শীত ছিল। আজ হঠাৎ ধাপ করে শীত নেমে গেছে। হরিচরণ পারুল গাছের নিচে আয়োজন করে বসেছেন। একটু দূরে কালু মিয়া হাতি নিয়ে অপেক্ষা করছে। জায়গাটা মোটামুটি জনশূন্য। হরিচরণ লিখছেন—

দেবী লক্ষ্মী

জগত তখনো সৃষ্ট হয় নাই। সনাতন কৃষ্ণের বাম অংশ হইতে এক অপরূপ নারীর সৃষ্টি হইল। তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ এই নারী দ্বাদশ বৰ্ষিয়া বালিকার ন্যায়। মুখমণ্ডল পূৰ্ণচন্দ্ৰ সদৃশ। এই নারীই লক্ষ্মী। তিনি হরিকে স্বামীরূপে কামনা করিলেন। হরি নিজ স্বরূপকে দুই অংশে বিভক্ত করিলেন। এক অংশের নাম চতুৰ্ভুজ নারায়ণ। অপর অংশ দ্বিভূজা কৃষ্ণ। চতুৰ্ভুজ নারায়ণ লক্ষ্মীকে পত্নীরূপে গ্রহণপূর্বক বৈকুণ্ঠে স্থায়ী সংসার গড়িলেন। দেবী লক্ষ্মী স্বৰ্গলক্ষ্মী হিসেবে অবস্থান করেন স্বর্গে, আবার একই সঙ্গে যোগমহিমায় গৃহলক্ষ্মী হিসেবে অবস্থান করেন মানুষের গৃহে গৃহে।

দেবী রাধা

সনাতন কৃষ্ণের ডান অংশ হইতে সৃষ্ট হইলেন অপরূপা রাধা। তিনিও লক্ষ্মীর ন্যায় হরিকে স্বামীরূপে প্রার্থনা করিলেন। হরির যে অংশ দ্বিভূজ কৃষ্ণ সেই অংশ রাধাকে লীলাসঙ্গীনি হিসেবে গ্রহণ করিয়া গোলকবিহারী হইলেন।

হরিচরণের লেখায় বাধা পড়ল। জেলেপাড়ার মুকুন্দ তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। ছেলের প্রচণ্ড জ্বর। মুকুন্দ ভীতগলায় ডাকল, কর্তা!

হরিচরণ বললেন, তোর খবর কিরে মুকুন্দ? আছিস কেমন?

মুকুন্দ বলল, কর্তা আছি ভালা। পুলাটার বেজায় জ্বর। আপনের কাছে নিয়া আসছি।

আমার কাছে কেন? সতীশ কবিরাজের কাছে নিয়া যা।

আপনে কপালে হাত দিলেই জ্বর। কমবে। ডাক্তার-কবিরাজ লাগব না।

হরিচরণ বললেন, আমি কপালে হাত দিলে জ্বর কমবে কেন?

মুকুন্দ বলল, ভগবান আপনেরে এই ক্ষমতা দিছে। কেন দিছে সেইটা উনার বিষয়। পুলাটার কপালে হাত দেন কর্তা। জুরে শ‍ইল পুইড়া যাইতেছে।

হরিচরণ মুকুন্দের জুরতপ্ত পুত্রের মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘসময় একমনে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করলেন। এবং একসময় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন— মুকুন্দের পুত্রের কপালে ঘাম হচ্ছে, জ্বর ছেড়ে দিচ্ছে। এই ঘটনা কেন ঘটছে তার কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে নেই। একটাই ব্যাখ্যা- জগত অতি রহস্যময়।

কর্তা!

বল মুকুন্দ।

পুলার জ্বর নাই। শ‍ইল পানির মতো ঠাণ্ডা।

হুঁ।

আইজ নাও নিয়া হাওরে মাছ ধরতে যাব। পরথম মাছ যেটা পাব সেটা আপনের জন্যে।

আমার জন্যে মাছ আনতে হবে না। আমি মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

আপনে মাছ খান না-খান আপনের জন্যে নিয়া আসব। আপনের নামে মানত করেছি। মাছ একখান যে উঠব।

হরিচরণ লেখায় মন দিলেন। মুকুন্দের খেজুরে আলাপ ভালো লাগছে না। মুকুন্দ যাচ্ছে না। ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। পিতা-পুত্র মুগ্ধ হয়ে হরিচরণকে দেখছে।

হরিচরণ বললেন, বসে আছিস কেন চলে যা। ছেলেটার গায়ে রোদ লাগাচ্ছিাস, আবার জ্বর আসবে।

মুকুন্দ তৃপ্তির গলায় বলল, আসলে আসব। আমরার কবিরাজ এইখানে বসা। কর্তা, আমার পুলা একটা হপন দেখছে। হপন শুনলে আপনে হাসতে হাসতে পেট ফাইট্টা মরবেন।

কী স্বপ্ন?

হাপনে দেখছে হে হাতিতে চইড়া বিয়া করতে যাইতেছে। হা হা হা।

হরিচরণ মাহুত কালুকে ডেকে বললেন, মুকুন্দের ছেলেটাকে হাতিতে করে বাড়িতে দিয়ে আস।

মুকুন্দের মুখ হা হয়ে গেল।

 

আধমান ওজনের দর্শনীয় এক বোয়াল মাছ মুকুন্দ পৌঁছে দিয়েছে। সেই মাছ রান্না হচ্ছে। রান্না করছে। হাতির মাহুত কালু মিয়া। বিশেষ বিশেষ রান্নায় সে পারদশী। বড় বোয়াল রান্না করা জটিল ব্যাপার। সামান্য নাড়াচাড়াতেই পেটি ভেঙে যেতে পারে। পেটি ভাঙা মানেই মাছ নষ্ট।

মাছ খাওয়ার দাওয়াত পেয়েছেন মাওলানা ইদরিস এবং শশী মাস্টার। শশী মাস্টার জানালেন যে, তিনি তাঁর জীবনে এত স্বাদু মাছ কখনো খান নি। বোয়ালের মতো নিম্নশ্রেণীর একটা মাছ যে এত স্বাদু হতে পারে এটা তার কল্পনাতেও কখনো আসে নি। মাওলানা ইদরিস মাছ নিয়ে কিছু বললেন না, তবে খাওয়া শেষে হাত তুলে মোনাজাত করলেন- ‘হে আল্লাহপাক! যে বাড়িতে আমার জন্যে এত সুন্দর খাবার আয়োজন হয়েছে তার বাড়িতে যেন এরচেও অনেক সুন্দর আয়োজন প্রতিদিনই হয়।’ এই মোনাজাত করতে গিয়ে মাওলানার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল।

শশী মাষ্টার বললেন, মাওলানা সাহেব, আপনার সঙ্গে আমার সেইভাবে পরিচয় হয় নাই। তবে সর্বজনের কাছে আপনার সুনাম শুনেছি। আপনি যে প্রার্থনা করলেন সেটা শুনেও ভালো লাগল। এ ধরনের প্রার্থনা আমি কাউকে করতে শুনি না।

মাওলানা ইদরিস বললেন, এই ধরনের দোয়া আমাদের নবি-এ-করিম সাল্লালাহু আলাহেস সালাম করতেন। তাকে দাওয়াত করে নানা আয়োজনে কেউ যখন খাওয়াত তখন তিনি এই দোয়াটা করতেন।

শশী মাস্টার বললেন, দোয়াটা খুব সুন্দর। কিন্তু আপনি এই দোয়া করতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন কেন, একটু জানতে পারি?

মাওলানা বললেন, জানতে পারেন। আজ আমার ঘরে কোনো খাবার ছিল না। মাঝে মাঝে এরকম হয়। টিন খুলে দেখি সামান্য চিড়া আছে। মনটা হলো খারাপ। আমি আল্লাহপাককে বললাম, ইয়া আল্লাহ, তোমার বান্দা কি আজ উপাস থাকবে? আল্লাহপাক সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা করলেন। উনার রহমতের নমুনা দেখালেন। আল্লাহপাকের কাছে শুকুর গোজার করতে গিয়ে চোখে পানি এসেছে।

মাওলানার চোখে আবার পানি এসেছে। তিনি চোেখ মুছলেন। মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকলেন শশী মাস্টার।

রাত ভালোই হয়েছে। হরিচরণের সঙ্গে শশী মাস্টার পুকুরঘাটে বসে আছেন। শীত পড়েছে। চারদিক অন্ধকার করে কুয়াশা পড়েছে। হরিচরণ বললেন, রাত হয়েছে, বাড়িতে যাবে না?

শশী মাস্টার বললেন, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব বলে বসে जाछि।

কিছু তো জিজ্ঞাস করছ না।

অস্বস্তির কারণে জিজ্ঞাস করতে পারছি না।

হরিচরণ বিস্মিত হয়ে বললেন, অস্বস্তি কেন?

শশী মাস্টার বললেন, আপনি কিছু মনে করেন কি-না। এই ভেবে অস্বস্তি। আমি চাই না, আমার কোনো কারণে আপনি মনে কষ্ট পান। আমি আপনাকে অসম্ভব শ্ৰদ্ধা করি।

কী জিজ্ঞাস করতে চাও জিজ্ঞাস কর।

আপনার বিষয়ে যে অনেক গুজব প্রচলিত এটা কি জানেন? আপনি গায়ে হাত দিলে অসুখ সেরে যায়। এই ধরনের গুজব।

জানি।

এর কারণ কী?

হরিচরণ বললেন, কারণ কী আমি জানি না। কারণ নিয়ে মাথাও ঘামাই না। এটাই কি তোমার কথা?

না। মূল কথা না।

বলো, মূলটা শুনি।

শশী মাস্টার ইতস্তত করে বললেন, আপনি মহাপ্ৰাণ ব্যক্তি, এই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। জুলেখা নামের একটি মেয়ে আপনাকে বাবা ডাকত। শুনেছি আপনিও তাকে স্নেহ করতেন।

ঠিকই শুনেছে।

সেই মেয়ে বেশ্যাবাড়িতে স্থান নিয়েছে। আপনার মতো মহাপ্ৰাণ ব্যক্তি কিছুই করলেন না। আপনি ইচ্ছা করলেই মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনতে পারতেন। কেন তা করলেন না এটাই আমার জিজ্ঞাসা। প্রশ্নের জবাব দিতে না চাইলে দিতে হবে না। আমি বুঝে নেব।

হরিচরণ বললেন, প্রশ্নের জবাব দিব। মেয়েটির প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা তৈরি হয়েছিল বলে কিছু করি নাই। তাছাড়া মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনলেও লাভ কিছু হতো না। কে গ্ৰহণ করত এই মেয়েকে। সে পতিতজন। যেখানে সে বাস করছে এর বাইরে তার স্থান নাই। কোনো পুরুষ তাকে পত্নী হিসেবে গ্রহণ করবে না। মেয়েটি অসাধারণ রূপবতী। অনেকেই হয়তো তাকে রক্ষিতা হিসেবে গ্ৰহণ করতে রাজি হবে। তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি কি হবে?

শশী মাস্টার চুপ করে রইল। হরিচরণ হঠাৎ শশী মাস্টারকে চমকে দিয়ে বললেন, তুমি মেয়েটিকে খুব পছন্দ কর, তাই না?

শশী মাস্টার বললেন, আপনি কীভাবে জানেন?

হরিচরণ বললেন, জুলেখার কথা থেকে অনুমান করেছি। তুমি তাকে কলের গান উপহার দিতে চেয়েছ। মোহের কাছে পরাজিত হওয়া ঠিক না। যাও, বাড়িতে যাও। বিশ্রাম কর।

শশী মাস্টার ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন।

হরিচরণ বললেন, পিতামাতার সঙ্গে কি কোনো যোগাযোগ হয়েছে?

শশী মাস্টার না-সূচক মাথা নাড়লেন। হরিচরণ বললেন, যোগাযোগ করা উচিত। তাদের রাগ নিশ্চয়ই এতদিনে পড়ে গেছে। তারা তোমার জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছেন।

শশী মাস্টার কিছু বললেন না। হরিচরণ বললেন, আমি কি তাদের কাছে একটা পত্ৰ দিব?

দিতে পারেন।

পত্র লিখে আমি তোমার হাতে দিব। পত্রটা মন দিয়ে পড়ে তুমি যদি মনে করো পাঠানো যায় তাহলে পাঠাবে।

আচ্ছা।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার মন পীড়িত। আমার কথায় যদি মন পীড়িত হয় তাহলে সেটা আমার জন্যে কক্টের ব্যাপার। আমি তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করি।

শশী মাস্টার বললেন, আমি জানি।

হরিচরণ বললেন, পত্রটা আমি আজ রাতেই লিখে রাখব। পত্ৰলেখার জন্যে রাত্রি অতি উত্তম।

শশী মাস্টার বললেন, আমি যাই।

কালু মিয়াকে সঙ্গে দিয়ে দেই। এতটা পথ একা যাবে!

শশী মাস্টার বললেন, প্রয়োজন নাই।

 

ঘন কুয়াশায় শশী মাস্টার হাঁটছেন। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক ধরে সোজা চলে গেলেন বটকালি মন্দিরের কাছে। কিছুক্ষণ মন্দিরের সামনে দাড়িয়ে বাজারের দিকে রওনা হলেন। শিমুলতলা থেকে রওনা হলেন হরিবাবুর কাঠের পুলের দিকে। কাঠের পুলের সেগুন কাঠের রেলিং যথেষ্ট চওড়া। পা ঝুলিয়ে বসে থাকা যায়। শশী মাস্টার আগেও কয়েকবার এখানে এসে বসেছেন। যখন আশেপাশে কেউ থাকে না তখন পুলের উপর বসে কবিতা আবৃত্তি করা যায়।

শশী মাস্টার পুলের উপর পা ঝুলিয়ে বসলেন। চোখের সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় মাধাই খাল। চাঁদের আলোয় চকচক করছে। শশী মাস্টারের প্রবল ইচ্ছা করছে ঝাপ দিয়ে খালে পড়তে। নিচে বাঁশের খুঁটি পোতা আছে কি-না ভেবে

ঝাঁপ দিতে পারছেন না। শশী মাস্টার কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন—

সূর্য গেল অস্তাচলে, দিগন্ত রেখায়
স্বর্ণ আভা, রাখি–
বাবলার শাখা হতে নমি তারি পায়
কহিল জোনাকি

কে, মাস্টার বাবু না? কী করেন?

প্রশ্ন করেছে ধনু শেখ। তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। শশী মাস্টার বললেন, কিছুই করি না। জেগে বসে আছি।

নিশি রাইতে জাইগা থাকে দুই কিসিমের মানুষ, সাধু আর শয়তান। আপনি কোন কিসিমের?

শশী মাস্টার জবাব দিলেন না। ধনু শেখ আগ্রহ নিয়ে বলল, আমি শয়তান। এই কারণেই নিশি রাইতে আমার চলাফেরা। রঙিলা বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিলাম। পেটে উঠেছে বেদনা- ফিরত যাইতেছি। আমার বাড়িতে কি যাবেন? বিলাতি শরাব ছিল, এক চুমুক দিতেন, শরীর গরম হইত। আপনাদের ধর্মে তো শরাব নিষেধ নাই।

শরাব খাওয়ার ইচ্ছা নাই।

জোয়ান বয়সে এক আধা চুমুক খাবেন না, এইটা কেমন কথা? ধর্মে যখন নিষেধ নাই তখন কত সুবিধা। আমরার ধর্মেনিষেধ, যে কারণে গোপনে খাইতে হয়।

আপনি তো শুনেছি প্ৰকাশ্যেই খান।

ঠিকই শুনেছেন। পুলের উপরে বইসা করতেছিলেন কী?

কবিতা আবৃত্তি করছিলাম। নিজের কবিতা। আমি আবার একজন কবি। শুনবেন কবিতা?

জে না। কবিতা, গানবাজনা শোনার মতো মনের অবস্থা না। শরীর ভালো না। শরীর ভালো থাকলে শুনতাম। আপনি বাদ্যবাজনা পারেন। শুনেছি— একদিন আপনার বাড়িতে গিয়া বাদ্য শুনব। যদি অনুমতি পাই।

অনুমতি দিলাম।

রাগ না করলে একটা উপদেশ দিতাম। শশী মাস্টার বললেন, উপদেশ শুনতে আমার ভালো লাগে না। তারপরেও দিন, রাগ করব না।

ধনু শেখ গলা নামিয়ে বলল, আপনের জোয়ান বয়স। পুলের উপরে খামাখা বইসা আছেন কোন কামে? আমার কথা শোনেন, রঙিলাবাড়িতে যান। কুয়াশা। যা পড়ছে। কেউ আপনেরে দেখবে না। আর দেখলেই কী? আমি যাই, পেটের বেদনাটা বাড়তেছে। বেদনা কম থাকলে আরো কিছুক্ষণ গফ করতাম। আপনার বিষয়ে অনেক কিছু শুনেছি— পরিচয় হয় নাই।

কী শুনেছেন?

আপনে পাগলা মানুষ। পাগলা মানুষ আমার পছন্দ, তবে পাগলা মেয়েমানুষ পছন্দ না। যাই?

ধনু শেখ চলে যাচ্ছে। শশী মাস্টার তাকিয়ে আছেন। ধনু শেখের পেছনে তিনজন যাচ্ছে। এরা মনে হয় পাহারাদার। একজনের হাতে তালিকাঠের বর্শা। এতক্ষণ আড়ালে ছিল। তিনজনের একজন শশী মাস্টারের পরিচিত। অম্বিকা ভট্টাচার্য। বর্তমান নাম সিরাজুল ইসলাম। সে ধনু শেখের অধীনে চাকরি নিয়েছে হয়তো। তার মাথায় কিস্তি টুপি। অন্ধকারে শাদা কিস্তি টুপি জ্বলজ্বল করছে।

 

জুলেখা সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, আসেন গো। মনে হয় আপনেরে ‘জারে ধরছে (শীতে ধরেছে), কাঁপিতেছেন। এমন শীত তো নাই। আসেন আসেন। পানি দিতেছি, হাত-মুখ ধোন।

শশী মাস্টার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ইচ্ছে করছে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। পা স্থানু হয়ে আছে। দরজার গোড়ায় পিতলের দু’টা কুপি জুলছে। জুলেখার হাতে কাশেমপুরি পেটমোটা হারিকেন। এই হারিকেন শাদা কেরোসিনে জ্বালাতে হয়। এর আলো হ্যাজাকবাতির মতো উজ্জ্বল। হারিকেনের আলো পড়েছে জুলেখার মুখে। তাকে ইন্দ্রনীর মতো দেখাচ্ছে। পানের রঙে ঠোঁট লাল। চোখে কাজল। কাজলের কারণেই চোখ হয়েছে বিষন্ন। জুলেখা বলল, আপনি যে আসবেন আমি জানতাম।

শশী মাস্টার বললেন, কীভাবে জানতে?

ঘরে আইস বসেন তারপরে বলি।

ঘরে ঢুকব না জুলেখা।

দোয়ার থাইকা চইলা যাবেন?

হ্যাঁ। ঘোরের মধ্যে চলে এসেছিলাম।

ঘোর কি কাটছে?

শশী মাস্টার জবাব দিলেন না। তার ঘোর কাটে নি, বরং বাড়ছে। জুলেখা বলল, আপনে আমার গান শুনতে চাইছিলেন। আইজ গান শুনবেন? বিচ্ছেদের গান। উকিল মুনসির বিচ্ছেদি।

শশী মাষ্টার দাঁড়িয়ে আছেন। এই শীতেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জুলেখা হাত ধরে তাকে ঘরে ঢুকাল।

কী সুন্দর পরিপাটি ঘর! সামান্য আসবাব। কার্তিকের মূর্তির সামনে পাথরের ফুলদানিতে টকটকে লাল রঙের জবাফুল। ফুল এখনো সতেজ। বিছানায় বকুলফুল ছড়ানো। হালকা মিষ্টি স্বাণ আসছে।

তুমি জানতে যে আমি কোনো একদিন আসব?

হুঁ।

কীভাবে জানতে?

আপনের চোখে লেখা ছিল। আমি চোখের লেখা পড়তে পারি।

এখন আমার চোখে কী লেখা?

এখন কিছু লেখা নাই?

নিশ্চয়ই লেখা আছে। পড় কী লেখা।

জুলেখা বলল, এখন আপনের চোখে লেখা— আমি বাকি জীবন এই মেয়েটার সঙ্গে থাকব। এরে ছাইড়া যাব না। লেখা ঠিকমতো পড়ছি না?

শশী মাস্টার জবাব না দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। তার প্রচণ্ড পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে হচ্ছে বুক শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে।

জুলেখা, জল খাব।

একটু ঠাণ্ডা হন তারপর খান।

শশী মাস্টার বললেন, আমার ভিন্ন একটা পরিচয় আছে। পরিচয়টা তোমাকে দিতে চাচ্ছি।

কেন?

তোমাকে গোপন কিছু বলতে ইচ্ছা করছে। আমার নাম শশী না। আমার নাম কিরণ গোস্বামী। বিপ্লবী কিরণ গোস্বামী। আমি একজন ইংরেজ সাবজজ এবং দু’জন ইংরেজ কনস্টেবল বোমা মেরে মেরেছি। এখন আমি পলাতক। আমার অনুপস্থিতিতে বিচারে আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছে। ইংরেজ পুলিশ আমাকে ধরতে পারলেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে।

জুলেখা বলল, আপনে ঘামতেছেন। একটু বাতাস করি?

করো। জল খাব।

একগ্লাস শরবত বানায়ে দেই? লেবুর শরবত?

দাও।

জুলেখা শরবতের গ্রাস নিয়ে এসে দেখে, শশী মাস্টার বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে। বাচ্চাদের মতো হাত-পা কুণ্ডুলি পাকিয়ে আছে। তৃষ্ণা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া ঠিক না। ঘুমুতে যেতে হয় যাবতীয় তৃষ্ণা মোচনের পর। জুলেখা কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কি এই মানুষটাকে ডেকে তুলবে?

 

হরিচরণ রাত জেগে শশী মাস্টারের বাবাকে একটি চিঠি লিখছেন—

মহাশয়,
সম্মানপ্রদর্শন পূর্বক নিবেদনমিদং। অধীনের নাম হরিচরণ। আপনার আদরের সন্তান শশী আমার আশ্রয়ে আছে। নিরাপদে আছে। সে আপনাদের সান্নিধ্যের জন্যে অতিব ব্যাকুল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়াছি তাহাকে সঙেগ করিয়া আপনার আতিথ্য গ্ৰহণ করিব…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *