০৮. লোকটিকে এই বসার ঘরে ঠিক মানাচ্ছে না

লোকটিকে এই বসার ঘরে ঠিক মানাচ্ছে না। রোগা ধরনের অভাবী টাইপের একজন মানুষ। চোখে মোটা কাচের চশমা। স্যান্ডেল ঘরের বাইরে খুলে রেখে এসেছে। সেই স্যান্ডেলগুলির জরাজীর্ণ অবস্থা। অন্য কেউ হলে ফেলে দিত। এই লোক ফেলতে পারছে না।

এই ঘরে যে লোকটিকে মানাচ্ছে না, তা সে নিজেও বুঝতে পারছে। বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। হাত দু’টি অবসন্ন ভঙ্গিতে কোলের ওপর ফেলে রাখা। গায়ে হলুদ রঙের একটা চাদর। কড়া হলুদ। এই নীল নীল বসার ঘরে হলুদ রঙ বড় চোখে লাগে। লোকটির বয়স পঞ্চাশের মত হবে কিংবা তার চেয়ে কমও হতে পারে। অভাবী লোকদের অল্প বয়সেই চেহারা নষ্ট হয়ে যায়।

অপালা পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি এক বার শুধু তাকিয়েছে। তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিয়েছে। অথচ অপালা এমন একটি মেয়ে, যার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অপালা বলল, আপনি কি বাবার কাছে এসেছেন?

লোকটি হাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু অপালার দিকে তাকাল না। মাথা ঘুরিয়ে জলরঙা ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইল।

বাবা তো দেশে নেই। সপ্তাহখানেক পরে ফিরবেন। আপনি বরং এক সপ্তাহ পরে আসুন।

আচ্ছা।

লোকটি কিন্তু উঠে দাঁড়াল না, বসেই রইল। এবার সে তাকিয়ে আছে জানালার পর্দার দিকে। যেন পৃথিবীর সমস্ত রহস্য ও সৌন্দর্য জানালার ঐ পর্দাটিতে। অপালা বলল, আপনি কি কিছু বলবেন?

তোমার মা আছেন?

অদ্ভুত ব্যাপার তো, এই লোক তাকে তুমি করে বলছে! অপালাকে তুমি করে বলার মত বাচ্চা এখনো নিশ্চয়ই দেখাচ্ছে না। তার বয়স একুশ। একুশ বছরের একটি মেয়েকে শাড়ি পরলে অনেকখানি বড় দেখায়। কিংবা কে জানে, লোকটি হয়ত ভাল করে তাকে লক্ষ্যই করেনি।

আমার মাও দেশের বাইরে। চিকিৎসার জন্যে গিয়েছেন।

লোকটি ঠিক আগের মত ভঙ্গিতে পর্দার দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

আপনার যদি জরুরি কিছু বলার থাকে, আমাকে বলতে পারেন।

লোকটি হলুদ চাদরের ভেতর থেকে একটা কার্ড বের করল। বিড়বিড় করে বলল, আমার বড় মেয়ের বিয়ে ১৭ই পৌষ।

অপালা হাত বাড়িয়ে কার্ডটি নিল।

বাবা এলেই আমি তাকে দিয়ে দেব। তিনি কী আপনাকে চেনেন?

হ্যাঁ। আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন।

অপালা হাসিমুখে বলল, বাবার মন ভাল থাকলে তিনি সাহায্য-টাহায্য করেন। তার কাছে যেতে হয় মুড বুঝে।

লোকটি উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেরোবার সময় হঠাৎ বলে বসল, ছেলেটা ভাল পেয়েছি। ব্যাঙ্কে কাজ করে। অগ্রণী ব্যাঙ্কে।

বাহ, খুব ভাল!

অফিসার্স গ্রেড। কোয়ার্টার পেয়েছে।

অপালার বড় মায়া লাগল। সে নিতান্তই অপরিচিত একটি মেয়ে। অথচ এই লোকটি কত আগ্রহ করে তার সৌভাগ্যের কথা বলছে। নিশ্চয়ই মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে কিছু সাহায্যের জন্যে এসেছিল। লোকটি নিচু গলায় বলল, যাই।

অপালা তার পেছন পেছন বারান্দা পর্যন্ত এল। গেটের বাইরে বার-তের বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে। লোকটি গেট খুলে বেরোতেই এসে তার হাত ধরল। এই মেয়েটি নিশ্চয়ই লোকটির সঙ্গে এসেছিল। ভেতরে ঢোকেনি। অপলা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েটি এলেই পারত। বিশাল বাড়ি দেখে হয়তো ভরসা পায়নি। আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করেছে বাইরে। ভারি মিষ্টি চেহারা মেয়েটির! লোকটি কেমন–মেয়েটিকে গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে!

অপা, এই অপা।

অপালা বিরক্ত মুখে তাকাল। দোতলার গেট থেকে নিশানাথককাকুর স্ত্রী তাকে ডাকছেন। অপালা জবাব দিল না। এই মহিলা গত তিন দিন ধরে এ-বাড়িতে আছেন। প্রথম দিন থেকেই অপলাকে আদর করে অপা ডাকছেন। এই আদর তার সহ্য হচ্ছে না। এক বার ভেবেছিল বলবে… আপনি আমাকে অপা ডাকবেন না। বলতে পারেনি। বয়স্ক একজন মহিলাকে মুখের ওপর এমন কঠিন কথা বলা যায় না। তা ছাড়া ভদ্রমহিলা প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন অপালাকে খুশি রাখতে। প্রথম রাতে অপালার ঘরে ঘুমুতে এলেন। অপালা বলল, এই ঘরে আপনার ঘুমানোর দরকার নেই।

কেন, দু’টা খাট তো আছে!

থাকুক। আমার একা একা থাকতে ভাল লাগে।

ও-মা, কেমন কথা! ঘুমুবার আগে খানিক্ষণ গল্পগুজব করলে তোমার ভালই লাগবে মা! আমি খুব মজার মজার গল্প জানি মা।

মজার মজার গল্প আমার শুনতে ভাল লাগে না।

না-শুনেই কী করে বলছি, শুনতে ভাল লাগে না! আচ্ছা, এইটা শোন, তারপর দেখি না-হেসে থাকতে পার কিনা। একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হল কোনটা বেশি দরকার–চেহারা না ব্ৰেইন। মেয়েটি বলল, চেহারা। কারণ চেহারা দেখা যায়, ব্রেইন দেখা যায় না। কী, গল্পটা মজার না?

হ্যাঁ, মজার।

এ-রকম গল্প আমি লক্ষ-লক্ষ জানি।

অপালা অস্থির হয়ে পড়ল। উঠতে-বসতে একটা হাসির গল্প। কখনো বীরবলের, কখনো গোপাল ভাঁড়ের, কখনো-বা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার।

এই ভদ্রমহিলা দোতলার বারান্দা থেকে অপালা-অপালা ডাকছেন, এক্ষুণি তিনি নেমে এসে একটা হাসির গল্প বলবেন, যা শুনে মোটেও হাসি আসবে না। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই ম্যানেজারকাকুর মাথা খারাপ করে দিয়েছেন।

এই যে অপা।

বলুন।

কখন থেকে ডাকছি, কথা বলছি না কেন?

আমি কথা কম বলি, কাকিমা।

এটা ভাল কথা না, মা। কথা বেশি বলবে। হাসবে, খেলবে, গান গাইবে। তুমি দিনরাত এমন গভীর থাক, আমার ভয় লাগে। ঐ লোকটা কে?

কোন লোকটা?

ঐ যে, তুমি এগিয়ে দিলে?

আমি চিনি না। অচেনা মানুষ।

কী সর্বনাশ! তুমি অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলছ কেন?

কথা বলা কি নিষেধ? এইসব আপনি কী বলছেন! হাসির গল্প বলতে চান বলুন, এ রকম অদ্ভুত কথা বলবেন না। আপনিও তো একজন অচেনা মানুষ। আমি কী আপনার সঙ্গে কথা বলছি না?

তুমি শুধু-শুধু আমার ওপর রাগ করছ মা। সব জান না, তাই রাগ করছ। কারখানায় বিরাট গণ্ডগোল। দু’জন শ্রমিক মারা গেছে। সবার ধারণা, মালিকপক্ষ মারিয়েছে। এখন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। ওরা কিছু করেও বসতে পারে। পারে না?

অপালা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে এ-সবের কিছুই জানে না।

আমি যে মা এখানে আছি, এ জন্যেই তো আছি।

আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি!

তোমাকে শুধু-শুধু বলবে কেন? আমিও বলতাম না। তুমি রাগ করছ দেখে বললাম।‘

বাবা এ সব জানেন।

জানেন। বড় সাহেবের সঙ্গে গতকাল কথা হয়েছে। বড় সাহেবের শরীর খারাপ, তাই আসতে পারছে না। শরীর ভাল থাকলে এসে পড়তেন।

শরীর খারাপ? কই, আমি তো এই খবরও জানি না!

তুমি তো মা কোনো খবরই জানো না। কোন দুনিয়ায় তুমি বাস কর বল তো? উদাসীর মতো শুধু ঘুরে বেড়ালে তো হয় না, পৃথিবীর খোঁজখবর রাখতে হয়।

অপালা একটি কথাও বলল না–তাকিয়ে রইল। ভদ্রমহিলা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তোমাকে আরেকটা কথা বলি মা, মন দিয়ে শোন–আমি তোমার মায়ের বয়সী, তোমার মতো মেয়ে আমার ঘরে আছে। আর তুমি এ রকম কর, যেন আমি রাস্তার একটা মেয়ে।

ভদ্রমহিলার চোঁচামেচিতে বাসার অন্য সবাই বের হয়ে এল। কী লজ্জার কথা! আপালার কান বী-বী করতে লাগল। ইচ্ছে করছে ছুটে বেরিয়ে যেতে। পৃথিবীতে বাস করার এত যন্ত্রণা! আজ সারা দিনে এক পাতাও পড়া হবে না। কী যে হবে পরীক্ষায়, কে জানে!

অপালা তার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দুপুরে ভাত খাবার সময় কাজের মেয়েটি ডাকতে এল। অপালা বলল, বিরক্ত করবে না। আমি কিছু খাব না। বিকেলে চা খাওয়ার জন্যেও নামিল না। সন্ধ্যাবেল নিশানাথবাবু এসে দরজায় টোকা দিলেন। সে খুব স্বাভাবিকভাবে দরজা খুলল। সহজ স্বরে বলল, কেমন আছেন ম্যানেজার কাকু।

ভাল আছি মা।

কারখানায় কী-সব ঝামেলা?

ঝামেলা তো আছেই মা। বিষয়-সম্পত্তি মানেই হচ্ছে ঝামেলা। একমাত্র সাধু-সন্ন্যাসীরাই ঝামেলামুক্ত।

দু’জন নাকি মারা গেছে?

হুঁ। নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে মরেছে, দোষ পড়েছে মালিকপক্ষের। তুমি এই নিয়ে কোনো চিন্তা করবে না। আসগর সাহেব চলে এসেছেন, উনি দেখছেন। খুবই কাজের লোক।

আসগর সাহেব কে?

আমাদের চিটাগাং ব্রাঞ্চের জি.এম, উনি একতলায় বসে আছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

আমার সঙ্গে কিসের কথা?

স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বড় রকমের ডিসিশনের ব্যাপার। তুমি একটু নিচে এস মা।

আসগর সাহেব মানুষটি সুপুরুষ। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। গোলগাল ভালমানুষের মত মুখ। কথা থেমে-থেমে বলেন। মনে হয় প্রতিটি শব্দ বলার আগে খানিক্ষণ ভাবেন। অপালা ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন, এবং অপালা না-বসা পর্যন্ত নিজে বসলেন না।

খুবই দুঃখিত যে আপনাকে ডিসটার্ব করতে হচ্ছে। মাই অ্যাপোলজি। এদিকে স্যার অসুস্থ, স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

কী বলবেন, বলুন।

দু লাখ টাকার মত খরচ করেল ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এক লাখ দিতে হবে ইউনিয়নকে। ওদের ঠাণ্ডা করতে হবে। পুলিশকে দিতে হবে বড় এ্যামাউন্ট। তা ছাড়া…

ভদ্রলোকের কথার মাঝখানেই অপালা বলল, এতে কি মালিকপক্ষের দোষই স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে না? সবাই কি তাহলে ভাববেন না, এটা আমরাই করিয়েছি?

আসগর সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমরা যে ধোয়া তুলসীপাতা, তাও কিন্তু না মিস অপালা। ছোট হলেও আমাদের একটা ভূমিকা আছে।

ও-আচ্ছা, আছে তাহলে!

আপনার সেফটির ব্যাপারটাও দেখতে হয়। আপনার নিরাপত্তা হচ্ছে আমাদের টপ প্ৰায়োরিটি।

আমার নিরাপত্তার ব্যাপারটা আসছে কেন?

প্রতিশোধের ব্যাপার। আর কি। ধরুন, একটা হাতবোমা এসে ফেলে দিল, অ্যাসিড ছুঁড়ে মারল…

অপালা চুপ করে রইল। আসগর সাহেব বললেন, আগেও এ রকম ঝামেলা হয়েছে।। টাকা পয়সা দিয়ে মিটমাট করা হয়েছে। অবশ্যি এত বড় স্কেলে ঝামেলা হয়নি। দিস টা…

আপনারা যা ভাল মনে করেছেন, তা করাই ভাল।

আপনাকে একটা অনুরোধ, এক-একা বাইরে যাবেন না। সবচেয়ে ভাল হয়, প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে না বেরুলে।

আমি এমনিতেই ঘর থেকে বের হই না।

ডি.সি সাউথকে আমি অবশ্যি রিকোয়েস্ট করেছি। কয়েক দিনের জন্যে বাড়ির সামনে একটা ফিক্সড সেন্ট্রির ব্যবস্থা করতে। কথায় আছে না, প্ৰিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর? আজ তাহলে উঠি। আপনাকে কষ্ট দিলাম।

 

রাতে অপালা অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল। যেন বিকেল হয়েছে। সূর্য ডুবে যাবার আগের মায়াবী আলো চারদিকে। সে একা-একা বাগানে হাঁটছে। হঠাৎ কে যেন ডাকল—এই…এই। অপালা চমকে তাকাল কেউ তো কোথাও নেই! কে ডাকল! অপালা ভয়-পাওয়া গলায় বলল, কে ডাকছে আমাকে?

আমি। আমি ডাকছি। আপনাকে।

অপালা দেখল, গেটের বাইরে সেই এগার-বার বছরের মেয়েটি দাঁড়িয়ে, যে তার বাবার সঙ্গে ঘরে ঢোকেনি। এক-একা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।

নাম কী তোমার?

মেয়েটি নাম বলল না। খুব হাসতে লাগল।

ঐ দিন তুমি ঘরে ঢোকনি কেন? কেন তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলে?

এই প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিল না মেয়েটি। অপালার বুক কাঁপতে লাগল, কারণ এই মেয়েটিকে তার চেনা-চেনা লাগছে। খুব চেনা–অসম্ভব চেনা। কিন্তু তবুও অচেনা।

এ কেমন স্বপ্ন!! ঘুম ভাঙার পরও অপালার হাত-পা কাঁপছে। পানির পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ। তার খুব ইচ্ছে করছে চেঁচিয়ে কাঁদে।

ঐ মেয়েটিকে সে কেন স্বপ্নে দেখল? মানুষের অবচেতন মনে কত রহস্যই-না খেলা করে। কোনো দিন মানুষ তা জানতে পারে না। অপালার বড় জানতে ইচ্ছে করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *