॥ ৮ ॥
বার দশেক ঝাঁকুনিতে লালমোহনবাবুর জ্ঞান ফিরে না এলে সত্যিই মুশকিল হত। কারণ এরকম অবস্থায় এর আগে আমি কখনও পড়িনি। ভদ্রলোক গায়ের ধুলোমাটি ঝেড়ে বললেন সাহিত্যিকদের নাকি সহজে অজ্ঞান হবার একটা টেনডেনসি আছে, বিশেষত ভয় পেলে, কারণ তাদের কল্পনাশক্তি সাধারণ লোকের চেয়ে অনেক বেশি ধারালো। ‘তোমার দাদা যে কুসংস্কারের কথাটা বললেন সেটা একদম বাজে। আমার মধ্যে ও সব ইয়ে একদম নেই।’
আমরা অবিশ্যি আর এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে সোজা চলে গিয়েছিলাম ফেলুদার কাছে। ওর কাজও শেষ হয়ে গিয়েছিল; না হলেও ও যে এমন খবর শুনে সব কাজ ফেলে গোরস্থানে চলে আসবে সেটা জানতাম। গডউইনের সমাধি দেখে, মাটির ভিতর থেকে উঁকি মারা প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো মড়ার খুলি দেখে আর চারিদিকটা ভাল করে সার্চ করে সমাধি থেকে হাত দশেক দূরে পড়ে থাকা একটা কোদাল ছাড়া আর কিছু পেল না ফেলুদা।
এবারে অবিশ্যি দারোয়ানের সঙ্গে দেখা হল। সে বলল তার ভাতিজার পানের দোকান আছে কাছেই লোয়ার সার্কুলার রোডের মোড়ে, সেখানে একটা জরুরি কথা বলতে গিয়েছিল। সে কবর খোঁড়ার ঘটনা কিছুই জানে না। তার বিশ্বাস ঘটনাটা আগের রাত্রে ঘটেছে, আর যারা করেছে তারা পাঁচিল টপকে এসেছে। ফেলুদা দারোয়ানের সাহায্যে মিনিট পনেরোর মধ্যে মাটি আর গাছের পাতা দিয়ে গর্তটা মোটামুটি বুজিয়ে দিল। যাবার সময় দারোয়ানকে বলে গেল ঘটনাটা সে যেন কাউকে না বলে।
গোরস্থান থেকে আমরা সোজা চলে গেলাম রিপন লেনে।
চোদ্দো বাই একের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আমাদের একটু বাধা পড়ল। একজন নামছেন সিঁড়ি দিয়ে, তার হাতে একটা লম্বা চামড়ার কেস। গিটারের কেস। বছর পঁচিশেক বয়সের একজন যুবক। এ ধরনের চেহারা যে-কোনও সময়ে, বিশেষ করে সন্ধের দিকে, পার্ক স্ট্রিটে গেলেই দেখা যায়, কাজেই বর্ণনা দেবার দরকার নেই। ক্রিস গডউইন এই যে বেরোল, ফিরবে বোধহয় সেই রাত্রে, ব্লু ফক্সের বাজনা সেরে।
দোতলা আজ আর কালকের মতো নিস্তব্ধ নয়; বৈঠকখানায় গলাবাজি চলেছে। একটা গলা আমাদের চেনা; অন্যটা মনে হয় তিন তলার সাহেবের। প্রথম গলা বিশ্রী ভাষায় ধমকাচ্ছে, আর দ্বিতীয় গলা ইনিয়ে-বিনিয়ে দোষ অস্বীকার করছে। ‘কাসকেট’ কথাটা বার বার ব্যবহার করছেন দুজনেই।
ফেলুদা বারান্দায় গিয়ে বৈঠকখানার দরজায় টোকা মারল। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের মতো শোনা গেল ‘কৌন হ্যায়’। আমরা তিনজনেই চৌকাঠ পেরোলাম। অচেনা ভদ্রলোকটির গায়ের রং হলদে, সর্বাঙ্গে মেচেতা, মাথায় টাক, দুটো দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো, বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি। ভদ্রলোক আমাদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন, ফেলুদা তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে হাতের বাক্সটা মোড়ক খুলে সোফায় বসা মিঃ গডউইনের দিকে এগিয়ে দিল।
‘এটা কাল নিয়ে যাবার লোভ সামলাতে পারিনি। আমার রিসার্চে প্রচুর সাহায্য করবে।’
গডউইন বাক্সটা পেয়ে এক মুহূর্ত হতভম্ব থেকে তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
‘সো ইউ ফুলড দেম, ইউ ফুলড দেম! দোজ ফুলস!—ধূর্ত, ঠগ, জোচ্চোর।’—এবার শুধু রাগ আর বিদ্রূপ, আর তার সবটা গিয়ে পড়েছে অন্য ভদ্রলোকটির উপর।—‘টম গডউইনের প্রেতাত্মা নিয়ে গেছে তার বাক্স? ইনি কি টম গডউইনের প্রেতাত্মা?—দিস জেনটলম্যান? কী মনে হয় তোমার?—এই যে, ইনিই হচ্ছেন মিস্টার অ্যারাকিস, আমার তিনতলার প্রতিবেশী, যার টেবিলের ছটফটানি আমার প্রত্যেক বিষ্যুদবারের সন্ধেগুলোকে মাটি করে দেয়!’
মিস্টার অ্যারাকিস বোকার মতো বাক্সটার দিকে চেয়ে ছিলেন; এবারে তাঁর দৃষ্টি গেল ফেলুদার দিকে। তারপর আবার বোকার মতো দৃষ্টি ঘুরিয়ে দরজার দিকে এগোতে গিয়েই তাঁকে থেমে যেতে হল। ফেলুদা তার নাম ধরে ডেকেছে।
‘মিস্টার অ্যারাকিস!’
ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চাইলেন। ফেলুদা ধীরকণ্ঠে বলল, ‘এই বাক্সর একটা জিনিস বোধহয় আপনার কাছে রয়ে গেছে।’
‘সার্টেনলি নট!’ অ্যারাকিস গর্জিয়ে উঠলেন। ‘আর সেটা আপনিই বা বুঝছেন কী করে? মার্কাস, তুমি বাক্স খুলে দেখে নাও তো কোনও জিনিস কম পড়ছে কি না।’
এতক্ষণে জানলাম মিঃ গডউইনের প্রথম নাম, আর সেই সঙ্গে আর্কিস-মার্কিস রহস্যের সমাধান হল।
মার্কাস গডউইন বাক্স খুলে তার ভিতর হাতড়ে দেখে একটু কিন্তু-কিন্তু ভাব করে বললেন, ‘কই মিঃ মিটার, এতে ত সব জিনিসই আছে বলে মনে হচ্ছে।’
‘ওই নস্যির কৌটোটা একবার বার করবেন কি?—যেটার বর্ণনা শার্লট গডউইন তার ডায়রিতে দিয়েছেন এবং বলেছেন ওর গায়ে পান্না চুনি এবং নীলা বসানো ছিল?’
মিঃ গডউইন কৌটো বার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।
ফেলুদা বলল, ‘বুঝতে পারছেন কি যে, ওটা একটা সস্তা নতুন কৌটো, যাতে কালো রং মাখিয়ে পুরনো করার চেষ্টা করেছিলেন মিঃ অ্যারাকিস?’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওপর থেকে আসল নস্যির কৌটো এনে দিলেন মিস্টার অ্যারাকিস, আর মিঃ গডউইন তাকে দিয়ে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বলিয়ে নিলেন যে, সামনের বিষ্যুদবার যদি আবার খটখটানি শোনেন তা হলেই পুলিশে খবর দেবেন। কালো মুখ করে চোর অ্যারাকিস চোরের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
‘থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার মিটার,’ হাঁপ ছেড়ে বললেন মার্কাস গডউইন।
‘শার্লট গডউইনের ডায়রি যে কত মূল্যবান জিনিস সেটা আপনি জানেন?’ প্রশ্ন ফেলুদার।
‘না। শার্লট গডউইনের ডায়রি ওই বাক্সে রয়েছে তা আমি জানতাম না,’ বললেন মার্কাস গডউইন। ‘তবে একটা কথা আমি আপনাকে বলছি মিঃ মিটার— আমার পূর্বপুরুষদের নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। সত্যি বলতে কী আমার কোনও বিষয়েই কোনও কৌতূহল নেই। এখন শুধু মরার দিনটির জন্য অপেক্ষা। ওই বেড়াল ছাড়া আর আমার আপন বলতে কেউ নেই। সন্ধেবেলা একজনের বাড়িতে গিয়ে পোকার খেলতাম, এখন গাউটের জন্য তাও পারি না।’
‘তা হলে প্রশ্নগুলো করে বোধহয় লাভ নেই।’
‘কী প্রশ্ন?’
‘আপনার ঠাকুরদাদার বাবার নাম ছিল ডেভিড, যার সমাধি রয়েছে সার্কুলার রোড গোরস্থানে।’
‘ইয়েস।’
‘ডেভিডের আর কোনও ভাই বা বোন ছিল কি?’
‘মনে নেই। আমার এক পূর্বপুরুষ আত্মহত্যা করেছিলেন। সে ডেভিডের ভাই কি না মনে নেই।’
‘ডেভিডের ছেলে, অর্থাৎ আপনার ঠাকুরদাদার নাম ছিল অ্যান্ড্রু?’
‘ইয়েস। হি ওয়াজ ইন দি আর্মি।’
‘শার্লট গডউইন তার এক ভাইঝি বা বোনঝির কথা লিখেছেন। হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, তিনি আপনার ঠাকুরদার আপন বোন কিংবা—’
‘আমার ঠাকুরদাদার কোনও ভাই-বোন ছিল না।’
‘তা হলে কাজিন।’
‘তাদের সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে পারব না, মিঃ মিটার। আমার স্মরণশক্তি অনেকদিন থেকেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। তা ছাড়া আমাদের পরিবার তোমাদের মতো কাছাকাছি থাকে না। তারা সব ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে। এ তো আর তোমাদের বাঙালিদের একান্নবর্তী পরিবার নয়।’
* * *
সোসাইটি সিনেমার সামনে নিজামেতে বসে মাটন-রোল খেতে খেতে ফেলুদা লালমোহনবাবুকে একটা প্রশ্ন করল।
‘নরেন বিশ্বাস লোকটাকে আপনার কেমন মনে হয়?’
লালমোহনবাবু চিবোনো শেষ করে ঢোক গিলে বললেন, ‘ভালই তো। চোখের মধ্যে বেশ একটা ইয়ে ভাব আছে।’
‘আমারও তাই মনে হয়েছিল।’
‘এখন আর হচ্ছে না?’
‘অবিশ্যি একটা দোষেই একটা মানুষের গোটা চরিত্র নষ্ট করে দেয় না। কিন্তু এটা বলতেই হয় যে, ভদ্রলোক একটা মারাত্মক অন্যায় করে ফেলেছেন।’
আমরা দুজনেই খাওয়া থামালাম।
‘আজ প্রমাণ পেলাম যে, ওর মানিব্যাগের কাটিং দুটো ন্যাশনাল লাইব্রেরির রিডিং রুমে সযত্নে রক্ষিত দেড়শো দুশো বছরের পুরনো খবরের কাগজ থেকে ব্লেড দিয়ে কেটে নেওয়া। আমার মতে, এ অপরাধের জন্য মানুষের জেল হওয়া উচিত।’
আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম নরেনবাবু রিডিং রুমে বসে দম বন্ধ করে গোপনে কর্মচারীদের দৃষ্টি এড়িয়ে এই দুষ্কর্মটি করছেন, কিন্তু পারলাম না। সত্যি, মানুষকে দেখে চেনার উপায় নেই।
‘এটা একটা রোগ বলতে পারেন,’ ফেলুদা বলে চলল, ‘আর এ ধরনের অন্যায় কাজ ধরা না-পড়ে সাক্সেসফুলি করতে পারলে মানুষ একটা উৎকট আনন্দও পায়, নিজেকে আর পাঁচ জনের চেয়ে বেশি চতুর মনে করে একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করে। ভেরি স্যাড।’
মাটন রোলের পর লস্যির অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা বিলটাও আনতে বলে দিল। ঘড়িতে বলছে আড়াইটা। আরও তিন ঘণ্টা সময় কাটিয়ে তারপর যেতে হবে ঘড়ি-পাগল মিস্টার চৌধুরীর বাড়িতে। আমি জানি পেরিগ্যাল রিপিটারের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ফেলুদার সোয়াস্তি নেই।
‘আচ্ছা মশাই, হাড়গিলেও কি এইভাবে খাবারের প্রত্যাশায় জানালার উপর বসে হাঁক পাড়ত নাকি?’
আমাদের পাশেই রাস্তার দিকে একটা জানালা, তার উপর একটা কাক বসে বেশ কিছুক্ষণ থেকে কা-কা করছে। সেইটের দিকে তাকিয়েই লালমোহনবাবু প্রশ্নটা করেছেন।
‘সম্ভবত না’, বলল ফেলুদা, ‘তবে বাড়ির আলসে বা ছাতের পাঁচিলে যে বসত তার অনেক প্রমাণ পুরনো ছবিতে আছে।’
‘আশ্চর্য, পাখিটার চেহারা যে কী রকম তাই জানি না।’
‘জানার একটা উপায় হচ্ছে চিড়িয়াখানায় যাওয়া। আর না হয় চলুন কর্পোরেশন স্ট্রিট দিয়ে বেরোব। মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং-এর সামনেই কর্পোরেশনের সিম্বলে হাড়গিলের চেহারা দেখিয়ে দেব।’
‘আপনি এখনও কর্পোরেশন স্ট্রিট বলছেন?’ হেসে বললেন জটায়ু।
‘থুড়ি, সুরেন ব্যানার্জি—’
ফেলুদা থেমে গেল। চোখের চাহনি চেঞ্জ। পকেট থেকে খাতা বার করে কী জানি দেখল। তারপরেই ছটফটে ভাব, কারণ বিল দিতে দেরি করছে। ফেলুদা বেয়ারা বলে হাঁক দিল—যেটা সচরাচর করে না। বিল দিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভার হরিপদকে নির্দেশ দিয়ে দিল। গাড়ি সুরেন ব্যানার্জি রোডে গিয়ে পড়ল। ফেলুদা বাড়ির নম্বর দেখছে, যদিও সব বাড়িতে নম্বর নেই—কলকাতার এই আরেকটা কেলেঙ্কারি। ‘আরেকটু এগিয়ে যাব ভাই।…তোপ্সে, ১৪১ দেখলেই বলবি।’
মনে পড়ে গেল—১৪১ SNB। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে।
‘ওই যে একশো একচল্লিশ!’
গাড়ি থামল। বাড়ির গায়ে লেখা Bourne & Shepherd-BS! পাওয়া গেছে। মিলে গেছে।
ফেলুদার সঙ্গে আমরা দুজনও ভিতরে ঢুকলাম। লিফ্ট দিয়ে উঠতে হবে।
দোতলায় লিফ্ট থেকে বেরিয়েই একটা সোফা-বেঞ্চি পাতা ঘর। একজন কর্মচারী আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ফেলুদার ইতস্তত ভাব, কারণ যে প্রশ্নটা করতে হল সেটায় একটা বেকুবি গন্ধ থাকতে বাধ্য।
‘ইয়ে—ভিক্টোরিয়ার কোনও ছবি আছে আপনাদের এখানে?’
‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল?’
‘না। কুইন ভিক্টোরিয়া।’
‘আজ্ঞে না। আমাদের এখানে শুধু যারা ভারতবর্ষে এসেছেন তাদের ছবি পাবেন। এডওয়ার্ড দ্য সেভেন্থ পাবেন—যখন প্রিন্স অফ ওয়েল্স ছিলেন—জর্জ দ্য ফিফ্থ, দিল্লির দরবার…’
‘এসব এখনও পাওয়া যায়?’
‘প্রিন্ট তৈরি থাকে না। নেগেটিভ আছে; অর্ডার দিলে করে দিই। ১৮৫৪ থেকে সব নেগেটিভ রাখা আছে।’
‘বলেন কী! আঠারোশো চুয়ান্ন?’
‘বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ড হল পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম ফোটোর দোকান।’
‘তার মানে তো হাজার হাজার নেগেটিভ থাকবে আপনাদের এখানে!’
‘আসুন না, দেখিয়ে দিচ্ছি। ওই যে দেখুন দেয়ালে ঝুলছে—১৮৮০-তে মনুমেন্টের উপর থেকে তোলা ছবি।’
এতক্ষণ দেখিনি, এবার বলতে চোখ গেল। এক হাত বাই পাঁচ হাত সাইজের ছবি। মনুমেন্টের উপর থেকে প্রায় একশো বছর আগের কলকাতা শহর। ড্যালহৌসি-এসপ্ল্যানেড থেকে শুরু করে উত্তরে যতদূর দেখা যায়। গির্জাগুলির মাথা অন্য সব বাড়িকে ছাপিয়ে উঠেছে। ত্রিসীমানায় একটাও হাইরাইজ নেই। দেখলেই বোঝা যায় শান্ত শহর।
নেগেটিভের ঘর দেখে চোখ টেরিয়ে গেল। ঘরের চার দেয়ালের মেঝে থেকে সিলিং অবধি শেলফ উঠে গেছে, আর প্রত্যেকটি শেলফ ব্রাউন রঙের চ্যাপটা চ্যাপটা বাক্সে ঠাসা। প্রত্যেক বাক্সের গায়ে লেখা রয়েছে তাতে কোন সালের কী ধরনের ছবি রয়েছে।
ফেলুদা শেলফগুলোর সামনে ঘুরে ঘুরে লেখাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ খুব মন দিয়ে দেখে হাতের রিস্টওয়াচটার দিকে একবার চেয়ে আমাদের দিকে ফিরে বলল, ‘তোরা ঘণ্টাখানেক ঘুরে আয়; আমার একটু কাজ আছে এখানে।’
লিফ্টে উঠে লালমোহনবাবু বললেন, ‘তোমার দাদার হুকুম শিরোধার্য। ওই একটা লোককে না বলা যায় না। কী পার্সোনালিটি! চলো একটিবার ফ্র্যাঙ্ক রস্-এ।’
গাড়িটা সুরেন ব্যানার্জি রোডেই রেখে আমরা চৌরঙ্গি দিয়ে গ্র্যান্ড হোটেলের দিকে হাঁটতে লাগলাম। লালমোহনবাবু কী ওষুধ কিনবেন জানি না, জানার দরকারও নেই। উদ্দেশ্য কেবল সময় কাটানো।
ভিড়ের মধ্যে কলিশন বাঁচিয়ে কিছুদূর এগোনোর পর ভদ্রলোক বললেন, ‘কিছু বুঝতে পারছ ভাই তপেশ—তোমার দাদার মতিগতি?’
বলতে বাধ্য হলাম যে কিছুই বুঝছি না, তবে এটুকু আন্দাজ করতে পারছি যে, ফেলুদা ছাড়াও আরেকজন কেউ শার্লট গডউইনের ডায়রি পড়েছে, আর সেই পড়ার সঙ্গে টমাস গডউইনের কবর খোঁড়ার একটা সম্পর্ক রয়েছে।
‘দুশো বছর মাটির নীচে থাকার পরও যে দেহ কঙ্কাল অবস্থায় থাকে সেটা তুমি জানতে?’ জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন।
এ ব্যাপারে জোব চার্নকের মৃতদেহ নিয়ে একটা ঘটনা ফেলুদা আমাকে বলেছিল: সেটা লালমোহনবাবুকে বললাম। চার্নক মারা যাবার দুশো বছর পরে সেন্ট জন্স গির্জার একজন পাদ্রির মনে হঠাৎ সন্দেহ ঢেকে চার্নকের সমাধিটা সত্যিই সমাধি তো, নাকি এমনিই একটা স্তম্ভ খাড়া করা হয়েছে। সন্দেহটা এমনিই পেয়ে বসে যে, পাদ্রি শেষে লোক দিয়ে মাটি খোঁড়ালেন। চার ফুট নীচে পর্যন্ত কিছু পাওয়া গেল না, কিন্তু আর দু ফুট খুঁড়তেই একটা কঙ্কালের হাত বেড়িয়ে পড়ল। পাদ্রি মানে মানে গর্ত বুজিয়ে দিলেন।
ফ্র্যাঙ্ক রসে গিয়ে লালমোহনবাবু যখন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন ‘ওয়ান ফরহ্যানস ফর দি গামস ফ্যামিলি সাইজ’, ঠিক তখনই লক্ষ করলাম দোকানে একজন চেনা লোক ঢুকছেন। তিনি অবশ্যি আমাদের দেখামাত্র চেনেননি; বার দু-তিন আমাদের দিকে তাকিয়ে তারপর মুখে হাসিটা এল। নরেনবাবুর ভাই গিরীনবাবু। হাতে একটা বড় বাক্স, তাতে লেখা হংকং ড্রাই ক্লিনারস। বললেন, ‘দাদার জন্য ওষুধ নিতে এসেছি।’
‘কেমন আছেন নরেনবাবু?’ জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
‘দাদা বেটার। ভাল কথা—আপনাদের সঙ্গে সেদিন যিনি ছিলেন তিনিই নাকি গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্তির? দাদা দিলেন খবরটা। ভদ্রলোকের নাম শুনেছি আগে। ভাবছিলাম—’
গিরীনবাবু ভুরু কুঁচকে একটু যেন অন্যমনস্ক হলেন। তারপর বললেন, ‘ওঁকে বাড়িতে পাওয়া যায় কখন?’
‘সেটা ঠিক বলা মুশকিল,’ আমি বললাম, ‘তবে ডিরেক্টরিতে নম্বর পাবেন। আপনি আসতে চাইলে আগে ফোন করে নিতে পারেন।’
‘হুঁ…ওঁর সঙ্গে একটু…ঠিক আছে, আমি টেলিফোন করে নেব। বলবেন প্রদোষবাবুকে, দরকার পড়লে যাব—হেঃ হেঃ…’
আমরাও হেঁ হেঁ করতে করতে ভদ্রলোকের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
নিউ মার্কেটে একটা চক্কর মেরে মতিশীল স্ট্রিট দিয়ে সুরেন ব্যানার্জিতে পড়লাম। বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ডের সামনে এসে দেখি ফেলুদা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাজ নাকি যা আন্দাজ করা গিয়েছিল তার একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে। গিরীনবাবুর সঙ্গে দেখা হবার খবরটা ফেলুদাকে দিলাম। ‘বটে?’ বলল ফেলুদা, ‘কী বললেন ভদ্রলোক?’ আমি জানি ফেলুদাকে ভাসাভাসাভাবে কিছু বললে চলবে না, তাই যা কথা হল সব ডিটেলে বললাম। এমনকী ভদ্রলোকের হাতে লন্ড্রির বাক্সটার কথাও বললাম। ফেলুদা চুপ করে শুনে গেল। ‘কাজ কেমন হল?’ লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
‘ফার্স্ট ক্লাস,’ বলল ফেলুদা, ‘একেবারে রত্নখনি। আর ওখান থেকে ফোন করে জেনে নিয়েছি মিঃ চৌধুরী বাড়ি ফিরেছেন। পাকা অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেছে। মখমলের মতো মোলায়েম গলায় কথা বলেন ভদ্রলোক।’