কোন বিলাতী সমালোচক প্রণীত
আমি রামায়ণ গ্রন্থখানি আদ্যন্ত পাঠ করিয়া অতিশয় বিস্মিত হইয়াছি। অনেক সময়ে রচনা প্রায় নিম্ন শ্রেণীর ইউরোপীয় কবিদিগের তুল্য। হিন্দু কবির পক্ষে ইহা সামান্য গৌরবের বিষয় নহে। গ্রন্থকার যে আর কিছুদিন যত্ন করিলে একজন সুকবি হইতেন, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই।
এই কাব্যগ্রন্থখানির স্থূল তাৎপর্য্য, বানরদিগের মাহাত্ম্যবর্ণন। বানরেরা বোধ হয়, আধুনিক Bonerwal নামা হিমাচল প্রদেশবাসী অনার্য্য জাতিগণের পূর্ব্বপুরুষ। অনার্য্য বানরগণকর্ত্তৃক লঙ্কাজয় ও রাক্ষসদিগের সবংশে নিধন, ইহার বর্ণনীয় বিষয়। তখন আর্য্যেরা অসভ্য ও অনার্য্যেরা সভ্য ছিল।
রামায়ণে কিছু কিছু নীতিগর্ভ কথা আছে। বুদ্ধিহীনতার যে কত দোষ, তাহা কবি বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন, এক নির্ব্বোধ প্রাচীন রাজার চারিটি ভার্য্যা ছিল। বহুবিবাহের বিষময় ফল সহজেই উৎপন্ন হইল। বুদ্ধিমতী কৈকেয়ী স্বীয় পুত্রের উন্নতির জন্য, অসভ্য বৃদ্ধকে ভুলাইয়া ছলক্রমে সপত্নীগর্ভজাত রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বনবাসে প্রেরণ করিল। জ্যেষ্ঠ পুত্রও ভারতবর্ষীয়দিগের স্বভাবসিদ্ধ আলস্যবশতঃ আপন স্বত্বাধিকার বজায় রাখিবার কোন যত্ন না করিয়া বুড়া বাপের কথায় বনে গেল। ইহার সহিত মহাতেজস্বী তুর্কবংশীয় ঔরঙ্গজেবের তুলনা কর; মুসলমান কেন এতকাল হিন্দুর উপর প্রভুত্ব করিয়াছে বুঝিতে পারিবে। রাম গমনকালে আপনার যুবতী ভার্য্যাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেল। তাহাতে যাহা ঘটিবার ঘটিল।
ভারতবর্ষীয় স্ত্রীলোক যে, স্বভাবতই অসতী, এই সীতার ব্যবহারই তাহার উত্তম প্রমাণ। সীতা যেমন গৃহের বাহির হইল, অমনই অন্য পুরুষ ভজনা করিল। রামকে ত্যাগ করিয়া রাবণের সঙ্গে লঙ্কায় রাজ্যভোগ করিতে গেল। নির্ব্বোধ রাম পথে পথে কাঁদিয়া বেড়াইতে লাগিল। হিন্দুরা এই জন্যই স্ত্রীলোকদিগকে গৃহের বাহির করে না।
হিন্দুস্বভাবের জঘন্যতার লক্ষ্মণ আর একটি উদাহরণ। তাহার চরিত্র এরূপে চিত্রিত হইয়াছে যে তদ্দ্বারা লক্ষ্মণকে কর্ম্মক্ষম বোধ হয়। অন্যজাতীয় হইলে সে একজন বড় লোক হইতে পারিত, কিন্তু তাহার এক দিনের জন্যও সে দিকে মন যায় নাই। সে কেবল রামের পিছু পিছু বেড়াইল, আপনার উন্নতির কোন চেষ্টা করিল না। ইহা কেবল ভারতবর্ষীয়দিগের স্বভাবসিদ্ধ নিশ্চেষ্টতার ফল।
আর একটি অসভ্য মূর্খ ভরত। আপন হাতে রাজ্য পাইয়া ভাইকে ফিরাইয়া দিল। ফলতঃ রামায়ণ অকর্ম্মা লোকের ইতিহাসেই পূর্ণ। ইহা গ্রন্থকারের একটি উদ্দেশ্য। রাম পত্নীকে হারাইলে অনার্য্য (বানর) জাতি তাহার কাতরতা দেখিয়া দয়া করিয়া রাবণকে সবংশে মারিয়া সীতা কাড়িয়া আনিয়া রামকে দিল, কিন্তু বর্ব্বর জাতির নৃশংসতা কোথায় যাইবে? রাম স্ত্রীর উপর রাগ করিয়া তাহাকে একদিন পুড়াইয়া মারিতে গেল। দৈবে সে দিন সেটার রক্ষা হইল। পরে তাহাকে দেশে আনিয়া দুই চারি দিন মাত্র সুখে ছিল। পরে বর্ব্বরজাতির স্বভাবসুলভ ক্রোধবশতঃ পরের কথা শুনিয়া স্ত্রীটাকে তাড়াইয়া দিল। কয়েক বৎসর পরে সীতা খাইতে না পাইয়া রামের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। রাম তাহাকে দেখিয়া রাগ করিয়া মাটিতে পুঁতিয়া ফেলিল। অসভ্য জাতির মধ্যে এইরূপই ঘটে। রামায়ণে স্থূল তাৎপর্য্য এই।
ইহার প্রণেতা কে, তাহা সহজে স্থির করা যায় না। কিম্বদন্তী আছে যে, ইহা বাল্মীকি প্রণীত। বাল্মীকি নামে কোন গ্রন্থকার ছিল কি না, তদ্বিষয়ে সংশয়। বল্মীকি হইতে বাল্মীকি শব্দের উৎপত্তি দেখা যাইতেছে, অতএব আমার বিবেচনায় কোন বল্মীকমধ্যে এই গ্রন্থখানি পাওয়া গিয়াছিল। ইহাতে কি সিদ্ধান্ত স্থির করা যায় দেখা যাউক।
রামায়ণ নামে একখানি বাঙ্গালা গ্রন্থ আমি দেখিয়াছি। ইহা কৃত্তিবাস প্রণীত। উভয় গ্রন্থে অনেক সাদৃশ্য আছে। অতএব ইহাও অসম্ভব নহে যে, বাল্মীকি রামায়ণ কৃত্তিবাসের গ্রন্থ হইতে সঙ্কলিত। বাল্মীকি রামায়ণ কৃত্তিবাস হইতে সঙ্কলিত, কি কৃত্তিবাস বাল্মীকি রামায়ণ হইতে সঙ্কলন করিয়াছেন, তাহা মীমাংসা করা সহজ নহে; ইহা স্বীকার করি। কিন্তু রামায়ণ নামটিই এ বিষয়ের এক প্রমাণ। “রামায়ণ” শব্দের সংস্কৃতে কোন অর্থ হয় না, কিন্তু বাঙ্গালায় সদর্থ হয়। বোধ হয়, “রামায়ণ” শব্দটি “রামা যবন” শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। কেবল “ব”কার লুপ্ত হইয়াছে। রামা যবন বা রামা মুসলমান নামক কোন ব্যক্তির চরিত্র অবলম্বন করিয়া কৃত্তিবাস প্রথম ইহার রচনা করিয়া থাকিবেন। পরে কেহ সংস্কৃতে অনুবাদ করিয়া বল্মীকমধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। পরে গ্রন্থ বল্মীকমধ্যে প্রাপ্ত হওয়ায় বাল্মীকি নামে খ্যাত হইয়াছে।
রামায়ণ গ্রন্থখানির আমরা কিছু প্রশংসা করিয়াছি, কিন্তু বিশেষ প্রশংসা করিতে পারি না। উহাতে অনেক গুরুতর দোষ আছে। আদ্যোপান্ত অশ্লীলতাঘটিত। সীতার বিবাহ, রাবণকর্ত্তৃক সীতাহরণ, এ সকল অশ্লীলতাঘটিত না ত কি? রামায়ণে করুণরসের অতি বিরল প্রচার। বানরকর্ত্তৃক সমুদ্রবন্ধন, কেবল এইটিই রামায়ণের মধ্যে করুণরসাশ্রিত বিষয়। লক্ষ্মণভোজনে কিঞ্চিৎ বীররস আছে। বশিষ্ঠাদি ঋষিদিগের কিছু হাস্যরস আছে। ঋষিগণ বড় রসিক পুরুষ ছিলেন। ধর্ম্মের কথা লইয়া অনেক হাস্য পরিহাস করিতেন।
রামায়ণের ভাষা যদিও প্রাঞ্জল এবং বিশদ বটে, তথাপি অত্যন্ত অশুদ্ধ বলিতে হইবে। রামায়ণের একটি কাণ্ডে যোদ্ধাদিগের কোন কথা না থাকায় তাহার নাম হইয়াছে “অযোদ্ধাকাণ্ড”। গ্রন্থকার তাহা “অযোদ্ধাকাণ্ড” না লিখিয়া ‘অযোধ্যাকাণ্ড’ লিখিয়াছেন। প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে এরূপ অশুদ্ধ সংস্কৃত প্রায় দেখা যায়। আধুনিক ইউরোপীয় পণ্ডিতেরাই বিশুদ্ধ সংস্কৃতে অধিকারী।