০৮. রানিগণ

০৮. রানিগণ

মারওয়াড়িদের গাদা বন্দুকের গুলি এড়াতে আকবর ঘোড়ার ঘাড়ের দিকে সামনে ঝুঁকলেন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন লাল পাগড়িপরা মারওয়াড়ি সৈন্যরা তাঁবু থেকে ছুটে পালাচ্ছে। ওরা ধূলিময় প্রান্তরের মাঝে একটি নিচু পাথুরে পাহাড়ের চারপাশে তাঁবু খাটিয়েছিল। তাঁর চতুর্দিকে তার সৈন্যরাও তা দেখতে পাচ্ছে। তিনি পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করেছিলেন, যাতে মোগলরা যখন ওদের উপর হামলা করবে তখন উদীয়মান সূর্য ওদের চোখের সামনে থাকবে। এত তাড়াহুড়া করে কাজ করে ওরা বোকামির পরিচয় দিয়েছে। তাদের ভালোভাবে জানা উচিত ছিল যে, তার বাবা কখনও প্রকাশ্য অবাধ্যতাকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়েন না…উচিত শাস্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র।

 যখন আওরঙ্গজেব যশবন্ত সিং-এর দুই বিধবাকে নবজাত পুত্র সন্তানদেরকে নিয়ে দিল্লি আসতে বললেন, তখন মনে হয়েছিল ওরা তাঁর কথায় রাজি হয়েছেন। রানিরা যাত্রা শুরু করে পানিপথ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। এরপর একজন মারওয়াড়ি সংবাদবাহক আওরঙ্গজেবের কাছে এসে জানাল যে, একজন রানি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তাকে আবার যাত্রা শুরু করার আগে কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে। এর এক সপ্তাহ পর মোগল চর খবর আনলো যে, রাতের অন্ধকারে মারওয়াড়িরা শিবির গুটিয়ে তাদের দেশের দিকে দ্রুত ফিরে যাচ্ছে।

আওরঙ্গজেব সাথে সাথে আকবরকে নির্দেশ দিলেন পাঁচশো অশ্বারোহী সেনার একটি বাহিনী নিয়ে পলাতকদের ধরে আনতে। যথারীতি সৈন্য জড়ো করে যাত্রা শুরু করতে করতে আকবর একটু বেশি সময় নিলেন। মোগল চরেরা খবর পাঠাল পলাতকরা ইতোমধ্যেই মারওয়াড়ের সীমানায় পৌঁছে গেছে। মোগল সেনার অগ্রবর্তী দলটি মারওয়াড়িদের অবস্থানের আট মাইল পূর্বদিকে একটি পাহাড়ের পেছনে লুকিয়ে আকবরের জন্য অপেক্ষা করছিল। এদিকে রানিরা তাদের দলবলসহ একই জায়গায় তিনদিন ধরে তাঁবু খাটিয়ে বসে। রয়েছেন আর কোনো কারণবশত ওদের আর সামনে এগোবার কোনো লক্ষণ : দেখা যাচ্ছে না। যেহেতু ওরা মারওয়াড়ের কাছেই পৌঁছে গেছেন, তাই হয়তো ভেবেছেন যে আওরঙ্গজেবের হাত থেকে নিরাপদ হয়েছেন। কিংবা একজন রানি হয়তো আসলেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আকবর একবার ভেবেছিলেন ওদেরকে একটা সুযোগ দেবেন, যাতে ওরা রানি আর বাচ্চাদেরকে তার হাতে তুলে দেয়–কেননা তার চরেরা তাঁকে খবর দিয়েছিল যে, শিবির রক্ষায় কেবল ষাট থেকে সত্তর জন সৈন্য রয়েছে। তবে তিনি রাজপুত যোদ্ধাদের নীতি ভালোভাবে জানতেন যে, ওরা কখনও তা করবে না। কাজেই অতর্কিতে আক্রমণ করলে তার নিজের ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে…।

তার চারপাশে লাল বালু উড়ছিল আর মারওয়াড়িদের প্রথম তাঁবুটা মাত্র পঞ্চাশ গজ সামনে দেখা যাচ্ছে, কাজেই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করার মতো আর সময় আকবরের হাতে নেই। গাদা বন্দুকের গুলি ছোঁড়ার আওয়াজে বাতাস ভারী হয়ে এসেছে। তার বাম পাশে একজন সেনা কর্মকর্তা ঘোড়ার জিন থেকে উল্টে পড়ে পেছন পেছন আসা সৈন্যদের ঘোড়াগুলোর নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। আরেকজন অশ্বারোহী সৈন্য ঊরুতে গুলির আঘাতে ঘুরে পড়ে গেল। তিনি যে রকম আশা করেছিলেন, মারওয়াড়িরা সংখ্যায় মুষ্টিমেয় হলেও রানিদের জীবন রক্ষায় নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছে। রসদবাহী দুটো গাড়ির মাঝে কয়েকটা পিপা রাখা ছিল, আকবরের ঘোড়া সহজেই পিপাগুলো টপকে গেল। আকবর তরোয়াল বের করে বাগিয়ে ধরলেন, যাতে সামনে কোনো আক্রমণকারী এলে আঘাত করতে পারেন। পেছনে ঘোড়ার খুরের শব্দে বুঝা গেল, দেহরক্ষী দল তার সাথেই রয়েছে। একজন দেহরক্ষী চিৎকার করে উঠলো, জাহাপনা, আপনার বামে তাকান!’ লাগাম টেনে নিয়ে আকবর তার ঘোড়াটি ঘুরাতেই কয়েকটি পাথরের আড়ালে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা একজন মারওয়াড়ি একটা বল্লম ছুঁড়ে মারলো। ঠিক সময়মতো আকবর সামনের দিকে লাফ দিতেই বল্লমটা তার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে একটা গাড়ির গায়ে বিধলো। দেহরক্ষী তার ঘোড়ার পিঠ থেকে একটু নিচু হয়ে তরোয়ালের এক কোপ মারতেই আক্রমণকারী হাত-পা ছুঁড়ে পাথরের উপর পড়ে গেল। তার গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো।

তার চারপাশে তিনি ইস্পাতের সাথে ইস্পাতের ঠোকাঠুকির আওয়াজ শুনতে পেলেন। প্রচণ্ড লড়াই চলছে। চোখের এক কোণ দিয়ে আকবর লক্ষ করলেন একজন মারওয়াড়ি বরকন্দাজ তার গাদা বন্দুকের লম্বা ইস্পাতের নলটি একটি গাড়ির পাশে রেখে একজন মোগল কোরচির দিকে ধীরে সুস্থে তাক করছে। বেচারি মোগল সেনাটি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে টলমলভাবে হাঁটছিল। ঘোড়া ছুটিয়ে সামনে এগিয়ে আকবর ছেলেটিকে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতেই ছেলেটির জীবন রক্ষা হল। তবে একই সাথে বন্দুকধারী গুলি ছুঁড়তেই গুলিটা আকবরের গাল ঘেঁসে উড়ে গেল। জোরে একবার নিশ্বাস নিয়ে আকবর ঘুরে তাকালেন। মারওয়াড়িরা পিছু হটতে শুরু করেছে। বেশির ভাগই শিবিরের মাঝখানে পাহাড়ের চূড়ায় সাদা দুটো তাঁবুর দিকে যাচ্ছিল। এই তাঁবুগুলো অন্যান্য তাঁবুর তুলনায় বেশ বড়। রানিরা নিশ্চয়ই এই তবুগুলোর মধ্যে রয়েছেন….

আকবর আবার ঘোড়া ছুটিয়ে তার লোকদের সাথে তাঁবু দুটোর দিকে ছুটলেন। প্রায় ছয়ফুট দূরে মাটিতে স্তূপকরা কতগুলো ঘোড়ার পিঠে ঝুলানো থলের পেছন থেকে খাটো, মোটা এবং বলশালী একজন মারওয়াড়ি লাফ দিয়ে বের হয়ে এল। লোকটি তার ডান হাত পেছন দিকে নিতেই আকবর একটি ছুরির ধাতব ফলার ঝলকানি লক্ষ করলেন। তবে মারওয়াড়ি লোকটি ছুরিটি ছুঁড়ে মারার আগেই একজন দেহরক্ষীর তরোয়ালের আঘাতে লোকটির চিবুক কেটে ফাঁক হয়ে দাঁত বের হয়ে গেল। সারা মুখ লাল টকটকে রক্তে ভরে গিয়ে লোকটি পেছন দিকে পড়ে গেল। আকবর স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। এই হচ্ছে যুদ্ধের সৌভাগ্য–তাঁর পেছন ফেরারও অবকাশ ছিল না।

এবার প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন মারওয়াড়ি সেনা মোগলদের দিকে অস্ত্র তাক করে তবু দুটো ঘিরে গোল হয়ে অবস্থান নিল। সম্ভবত এরাই কেবল বাকি ছিল। অবশ্য ওদের আর কোনো সুযোগ নেই, সকলেই মারা পড়বে…যদি ওরা যুক্তির কথায় কান না দেয়। আকবর আর হতাহতের সংখ্যা বাড়াতে চাইছিলেন না, তিনি নিজেই গত কয়েক মিনিটে অন্তত তিনবার বেঁচে এসেছেন।

তিনি তার লোকদের ডেকে বললেন, “থামো!’ ঘোড়া থেকে নেমে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। তবে যদি কেউ আক্রমণ করে, সাথে সাথে একদিকে লাফ দিয়ে সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে মারওয়াড়িদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন, “কেন তোমরা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেবে? তোমরা যথেষ্ট সম্মান নিয়ে লড়েছ, তবে দেখতে পাচ্ছ তোমরা সংখ্যায় কত কম। আমি কথা দিচ্ছি। রানিদের কোনো সম্মান হানি হবে না। তাদেরকে আমাদের হতে তুলে দাও, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি তাদেরকে দিল্লির রাজদরবারে নিয়ে যাওয়া হবে আর সেখানে এরা মারওয়াড়ের রাজপরিবারের উপযুক্ত যথাযথ মর্যাদা পাবেন।

তার কথায় সবাই চুপ হল। মনে হচ্ছে রাজপুতরা অস্ত্রগুলো আরো শক্ত করে ধরলো।

আকবর আবার চেষ্টা করলেন, “আমার কথা শোন। শত শত বছর ধরে মোগল আর রাজপুতরা কি পাশাপাশি লড়াই করে নি? আমরা কি ভাই ভাই নই? তোমাদের রক্ত কি আমার নিজের পরিবারে বইছে না? তবে যদি আর প্রতিরোধ করার চেষ্টা কর, তাহলে তোমাদেরকে ধ্বংস করা ছাড়া আমার হাতে আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।’

ঠিক সেই মুহূর্তে একটি তাঁবুর ঝাঁপ খুলে গেল আর একজন মহিলা কমলা রং এর কাপড়ে জড়ানো ছোট একটি শিশুকে কোলে নিয়ে বের হয়ে এলেন। এমব্রয়ডারি করা তার জাফরানি রঙয়ের শাড়ির আঁচলের ঘোমটা তার মুখ ঢেকে এত নিচে নামানো ছিল যে, আকবর তার চেহারা দেখতে পেলেন না, তবে তিনি তার সরু হাতে ভারী সোনার চুড়ি আর বালা দেখতে পেলেন।

দয়া করে…এই লড়াই এখানেই শেষ হোক। অনেক মৃত্যু হয়েছে, আমি চাই না আর কোনো স্ত্রী আর তাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে শোক করুক, যেরকম আমি আমার স্বামী যশবন্ত সিংকে হারিয়ে শোক করছি। রানিদের বাঁচাতে এই বীর সৈনিকরা তাদের জীবন বিসর্জন দিতে চাইছে, কিন্তু আমি তা হতে দিতে চাই না। আমি আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করছি। আপনি যে কথা দিয়েছেন তাতে আমি বিশ্বাস রাখবো। আমি আর আমার পুত্র অজিত সিং আপনার কাছে আত্মসমপর্ণ করছি আর আমার সৈন্যদেরকে বলছি হাতিয়ার নামিয়ে রাখতে। রাজপুত সৈন্যরা একে অন্যের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলো আর একজন বলে উঠলো, কেমন করে আমরা আমাদের ধর্মবিশ্বাস আর ঐতিহ্যের শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করবো?

 মহিলাটি আবার বলে উঠলেন, ‘আমি হাদি, আমার প্রয়াত স্বামীর জ্যেষ্ঠ রানি। আমি যা আদেশ করছি তা তোমরা পালন করবে। কমবয়সী হলেও তার কণ্ঠস্বর দৃঢ় এবং কর্তৃত্বব্যঞ্জক ছিল। আকবর ভাবলেন, এরা সত্যি একটি যোদ্ধা জাতি, কি নারী কি পুরুষ। তাকিয়ে দেখলেন বাচ্চাটি জেগে উঠে কেঁদে উঠতেই সোজা হয়ে দাঁড়ান হালকা-পাতলা গড়নের মহিলাটি বাচ্চাটিকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

ভদ্রে, আমি যে কথা দিয়েছি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’

অন্য সাদা তবুটির ঝাঁপ উঠিয়ে বেগুনি রঙের শাড়ি পরা দ্বিতীয় আরেকজন মহিলা ঘোমটায় মুখ ঢেকে বের হয়ে এলেন। তিনিও হাদির মতো ভারী ভারী গহনা পরে রয়েছেন। আমি আমার বোনের কথা আর আপনার উত্তরও শুনেছি। আর আমিও তার মতো আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে এসেছি। আমি রানি শিল্পা, আমার বাচ্চা তাঁবুর ভেতরে সেবিকার কাছে রয়েছে। তার কণ্ঠস্বর শুনে রানি হাদির চেয়ে একটু বয়স্ক মনে হল। একটু বেঁটে হলেও তার আচরণ একজন রানির মতোই।

আকবর নরম স্বরে বললেন, ‘অনুগ্রহ করে আপনারা তাঁবুতে গিয়ে আরাম করুন। ততক্ষণে আমি আপনাদের সন্তান আর অন্যান্য মহিলাসহ আপনাদের দিল্লি নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় উটের ব্যবস্থা করছি। রানিরা তাঁবুতে ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই আকবর মারওয়াড়িদেরকে নিরস্ত্র করার জন্য তার লোকদের নির্দেশ দিলেন। আর তাঁবুগুলোর ভেতরে আর কেউ লুকিয়ে রয়েছে কি-না তা দেখার জন্য সেখানেও তল্লাশি চালাতে বললেন। তার সৈন্যরা আহত মোগল সেনাদের যত্ন নিতে শুরু করতেই তিনি মারওয়াড়িদেরকেও তাদের আহত সহযোদ্ধাদের সেবা আর মৃতদের দাহ করার সুযোগ দিলেন।

 চিতার আগুন নিভু নিভু হয়ে এসেছে আর সূর্যও পশ্চিমে ডুবতে শুরু করেছে। আকবরও যাত্রা শুরু করার জন্য তৈরি হয়েছেন। নারী আর শিশুদেরকে উটের পিঠের দুইপাশে ঝুলানো বড় বড় ঝুড়িতে বসান হল। আকবরের লোকেরা কাছের গ্রাম থেকে এগুলো কিনে এনেছিল। বাদবাকি নিরস্ত্র মারওয়াড়ি সৈন্যরা নিজেদের ঘোড়ার পিঠে চললো। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের জখমে বড় ধরনের পট্টি লাগান ছিল। মোগল অশ্বারোহী সেনারা পুরো দলটিকে ঘিরে চললো। কোনো মারওয়াড়ি সৈন্য রানিদের উদ্ধার করার জন্য কোনো ধরনের চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করার জন্য ওরা সতর্ক রইল। আকবর বেশ সন্তুষ্ট হয়েছেন। একজন সম্মানীয় মানুষ যে ধরনের কাজ করা উচিত তিনি শুধু তাই করেন নি, তার বাবাও খুশি হবেন দেখে যে, তিনি পলাতকদের পাকড়াও করে দিল্লিতে নিয়ে এসেছেন।

*

তিন সপ্তাহ পর অস্পষ্ট দিগন্তে দিল্লির দেয়াল আর মিনারের চূড়ার আকৃতি দেখা গেল। সফরটি ক্লান্তিকরভাবে ধীর হলেও, উটগুলোর ধীর গতির জন্য ধন্যবাদ দিতে হয়, কেননা এতে মেয়েদের কষ্ট হয়নি। বিষয়টির নিষ্পত্তি করার শুরু থেকেই আকবরের মন প্রফুল্ল ছিল, এখনও তাই রয়েছে। মারওয়াড়ি কোনো যোদ্ধাদল তাদের পিছু নেয়নি। শুধু একবার একটি বিপজ্জনক মুহূর্ত এসেছিল, এক সন্ধ্যায় যখন টহলদাররা টহল দিচ্ছিল, তখন একটি বাঘ চমকে গিয়ে একটি জঙ্গল থেকে বের হয়ে শিবিরে ঢুকে পড়েছিল। আকবর তাবুর চাদোয়ার নিচে বসে মশালের আলোয় কিছু একটা পড়ছিলেন, বাঘটি তার কাছ দিয়ে আবার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সময় তিনি বাঘের ডোরাকাটা তামাটে দেহটি আর লণ্ঠনের মতো জ্বলজ্বলে চোখ দুটো কেবল এক ঝলক দেখতে পেলেন।

 অবশেষে অশ্বারোহী দল আর ভারী ওজন বয়ে নিয়ে আসা উটগুলো ধুঁকতে ধুঁকতে লাহোর ফটকের নিচ দিয়ে দুর্গে ঢুকতেই আকবরের মন খুশিতে ভরে উঠলো। যদিও তিনি আগেই তার সফলতার খবর দিয়ে সংবাদবাহক পাঠিয়েছিলেন, তারপরও নিজে বাবাকে পুরো বিষয়টি বলার জন্য তার মনে বেশ আগ্রহ ছিল। তাকে ছাড়াও সম্রাট তাঁর সকল ছেলেকে প্রায়ই তাদের কাজের সমালোচনা করতেন। এবার আওরঙ্গজেবও তাকে প্রশংসা না করে । পারবেন না। ভেতরের একটি উঠানে পৌঁছার পর আকবর পুরো দলটিকে থামতে বলে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে লাগাম একজন সহিসের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। তারপর একজন কোরচিকে ডেকে বললেন, ‘হেরেম থেকে প্রহরীদের ডেকে এনে এই উটগুলোকে মেয়েমহলে নিয়ে যেতে বল, যাতে মহিলারা লোকের নজরের আড়ালে উট থেকে নামতে পারেন। তারপর তাদেরকে সোজা হেরেমে আমার বোন জেবুন্নিসার কাছে নিয়ে যেতে বল। আমি আগেই তাকে চিঠিতে লিখে জানিয়েছি এদের থাকার জন্য উপযুক্ত কামরার ব্যবস্থা করতে। আর তাদেরকে খুবই সম্মানসহকারে দেখাশুনা করবে। এই মহিলারা মারওয়াড়ের রানি।

রানিদের আরাম-আয়েসের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পর সন্তুষ্ট হয়ে আকবর হাত-মুখ ধুয়ে আর এক গ্লাস পানি খেয়ে বাবার মহলের দিকে রওয়ানা দিলেন। সম্রাট তখন নিচু একটি ডেক্সের সামনে বসে কিছু পড়ছিলেন, কোরচি আকবরের উপস্থিতির খবর দিতেই তিনি মুখ তুলে বললেন, ‘তাহলে তোমার অভিযান সফল হয়েছে?

 ‘হ্যাঁ, বাবা। যদিও মারওয়াড়িদের কাবু করতে আমি যা আশা করেছিলাম তার চেয়ে বেশি সময় লেগেছিল। তবে আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে, তাদের সীমন্তের প্রায় কাছে পৌঁছে ওরা সেখানেই থেমে তাঁবু খাটিয়ে কয়েকদিন অবস্থান করেছিল।

 ‘হ্যাঁ, চিঠিতে সেকথা তুমি জানিয়েছ। তবে বিষয়টি একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এখন আমাকে সবকিছু খুলে বল, বিশেষত ঐ শিবিরটি সম্পর্কে সেখানে কতজন মারওয়াড়ি সৈন্য ছিল, অস্ত্র কি ছিল, ওদেরকে কাবু করতে কত সময় লেগেছিল। কোনোকিছু বাদ দিও না। তুমি তো জান খুঁটিনাটি বিষয়কে আমি খুবই মূল্য দেই।

 যতদূর মনে পড়লো, আকবর সবকিছু খুলে বললো, তারপর তার বাবার অভিনন্দনের জন্য অপেক্ষা করে রইল। কিন্তু আওরঙ্গজেব গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইলেন, তার ভ কুঁচকে রয়েছে। অবশেষে বললেন, কতজন রাজপুত সেনা তুমি বললে শিবিরের প্রতিরক্ষায় ছিল?

‘প্রায় সত্তর জন। এর বেশি নয়।’

 ‘এই বিষয়টি তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হয় নি যে, মারওয়াড়িরা তাদের রানি আর সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারের প্রতিরক্ষার জন্য এত কম সেনা কেন রেখেছিল?

না। সংখ্যায় কম হলেও মারওয়াড়িরা দৈত্যের মতো লড়াই করেছিল…আমার ত্রিশজন লোক নিহত হয়েছিল। আমি সব সময় ভাবতাম একজন রাজপুত অন্য যেকোনো পাঁচজন সৈন্যের সমান।

 হ্যাঁ, তারা আসলেই ভালো যোদ্ধা। তবে অনেক সময় ব্যর্থ গৌরবের কাজকে ভালো কৌশল হিসেবে মনে করে ভুল করে। তবে তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই।’

আকবর সম্রাটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, তবে কোন বিষয়টি নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন বাবা? তার পেটে একটু অস্বস্তিকর অনুভূতি হল। তবে তার প্রশ্নটি এড়িয়ে আওরঙ্গজেব তাকে একটি প্রশ্ন করতেই তার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল।

তুমি বলেছ সীমান্তের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছার পর মারওয়াড়িরা সেখানেই থেমে পড়ে। এ খবরটি তুমি কি ভাবে জানতে পেরেছিল?

 ‘আমার অগ্রবর্তী দলের সদস্যদের কাছ থেকে খবরটি জেনেছি। ওদের একজন আমার কাছে এসে খবর দিল যে ওরা মারওয়াড়িদের খুঁজে পেয়েছে আর বাদবাকিরা আড়ালে লুকিয়ে ওদের প্রতি নজর রাখছে। মূল সেনাদল নিয়ে আমি যখন ওখানে পৌঁছলাম, তার আগে ওরা তিনদিন ধরে মারওয়াড়িদের উপর নজর রাখছিল।’

তারপরও ব্যাপারটি তোমার কাছে একটু অস্বাভাবিক মনে হয় নি? কেন মারওয়াড়িরা অতি দ্রুত ওদের দুর্গে চলে গেল না? ওরা তো জানতোই যে আমি ওদের পেছনে সেনা পাঠাব। তাহলে কেন এমন জায়গায় রয়ে গেল, যেখানে ওরা অরক্ষিত হয়েছিল?

হয়তো কোনো একজন রানি কিংবা বাচ্চাগুলোর মধ্যে কোনো একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল আর তাদের বিশ্রাম নেবার প্রয়োজন ছিল। মরুভূমিতে প্রচণ্ড গরম ছিল আর …’।

আওরঙ্গজেব তাকে বাধা দিয়ে বললেন, মহিলারা এখন কোথায় রয়েছে?

 ‘হেরেমে জেবুন্নিসার তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

 “ঠিক আছে, আমি একবার ওদের সাথে দেখা করতে যাব। এমনি সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ। তুমিও সাথে আসতে পার। আওরঙ্গজেব উঠে দ্রুত কামরা থেকে বের হয়ে গেলেন। আকবর প্রথমে একটু ইতস্তত করলেন, তারপর তিনিও তাঁর বাবাকে অনুসরণ করলেন। তিনি জেবুন্নিসার মহলে পৌঁছে শুনলেন আওরঙ্গজেব তার বোনকে বলছেন, ‘ঐ মহিলাদের এখানে আসতে বল। আমি এখুনি তাদের সাথে দেখা করতে চাই।’

 ‘তারা মনে হয় বেশ ক্লান্ত…এখনও নিজেদেরকে ঠিকমতো ঘরে গুছিয়ে উঠতে পারে নি…’

আওরঙ্গজেব একটু কড়া কণ্ঠে বললেন, যাই হোক। আমি যা বলছি তা কর জেবুন্নিসা।

‘ঠিক আছে আপনি যা বলেন। আমি নিজে গিয়ে ওদেরকে নিয়ে আসছি।

কিছুক্ষণের মধ্যে জেবুন্নিসা দুই রানিকে নিয়ে ফিরে এলেন। এখন দুজনেই মারওয়াড়ের জাতীয় রং উজ্জ্বল হলুদ শাড়ি পরে রয়েছেন–আর দুজনেরই মাথা সোনালি রেশমি কাপড়ের ঘোমটায় কয়েক ভাঁজে ঢাকা রয়েছে।

কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আওরঙ্গজেব বললেন, আপনারা দুজনের ঘোমটা খুলে মুখ দেখান।

আকবর হতাশার অনুভূতি নিয়ে কথা শুনছিলেন। এরা রাজ পরিবারের মহিলা। তিনি কথা দিয়েছিলেন এদের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করা হবে। এখন কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি?

 মহিলা দুজন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আওরঙ্গজেব শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘আমি সম্রাট। আমি আপনাদেরকে আদেশ করছি মুখ দেখাতে আর নয়তো অন্য কাউকে দিয়ে করাবো।’

 রানি শিল্পা প্রথমে সম্রাটের আদেশ পালন করলেন। মেহেদি লাগান হাত দিয়ে ঘোমটা ঠেলে মুখ থেকে সরিয়ে দিলেন, তবে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আওরঙ্গজেব আদেশ করলেন, “আমার দিকে তাকান। ধীরে ধীরে তিনি মুখ তুললেন। আকবরের মনে হল, তার বয়স প্রায় ত্রিশ, দেখতে বেশ সুন্দরী। গোলাকার মুখ আর ভারী ঠোঁট।

এরপর আওরঙ্গজেব রানি হাদির দিকে ফিরে বললেন, এবার আপনি। মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আওরঙ্গজেবের আদেশের জন্য অপেক্ষা না করে তিনি সরাসরি তাঁর দিকে তাকালেন। আকবর কল্পনা করেছিলেন–ডিম্বাকৃতি মুখ আর বড় বড় উজ্জ্বল চোখ নিয়ে তিনি খুবই সুন্দরী। ঠাণ্ডা চোখে আওরঙ্গজেব যেভাবে তাদেরকে নিরীক্ষণ করছিলেন, তাতে মনে হল শিল্পার মতো তিনি তেমন ঘাবড়াননি।

 ‘আপনাদের মধ্যে বড় রানি কে?

 হাদি সাথে সাথে উত্তর দিলেন, ‘আমি।’

 ‘আপনাকে দেখে বেশ কমবয়সী মনে হচ্ছে। যশবন্ত সিং-এর সাথে বিয়ের কত বছর হল?

‘চার বছর।

কিছুকাল আগে আমার সাম্রাজ্যের হয়ে যুদ্ধ করার সময় তার শরীরে বড় ধরনের একটি যখম হয়েছিল। সেটা শরীরের কোন জায়গায় হয়েছিল বলতে পারেন?

এই প্রথম হাদিকে দেখে একটু অনিশ্চিত মনে হল।

যশবন্ত সিং-এর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছেন, কাজেই যথেষ্ট অন্তরঙ্গ নিশ্চয়ই ছিলেন। সেক্ষেত্রে আপনার এটা জানার কথা, তাই না? আমি আবার বলছি, যখমটা কোথায় হয়েছিল?

এক মুহূর্ত পর হাদি বললেন, এটা…এটা বুকে হয়েছিল।’

 আওরঙ্গজেব এবার শিল্পার দিকে ফিরে বললেন, আপনার কি মনে হয়? ইনি কি ঠিক বলেছেন?

ঢোক গিলতে গিলতে শিল্পা হাদির দিকে তাকিয়ে তারপর বললেন, ‘হা…হ্যাঁ …বুকে হয়েছিল। হাদি তখনও এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তার চেহারা শান্ত হলেও আকবর দেখলেন তিনি দ্রুত নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন। আওরঙ্গজেব সামনে হাদির দিকে এগিয়ে সরাসরি তার দিকে তাকালেন। হাদি পিছু হটলেন না, বরং গর্বিতভাবে আওরঙ্গজেবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর আওরঙ্গজেব শিল্পার কাছে গিয়ে তাকেও একইভাবে নিরীক্ষণ করলেন।

 পরিশেষে সম্রাট বললেন, আপনারা আমার ছেলেকে বোকা বানাতে পারলেও এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে বিশ্বাস করাতে পারেন নি।

 ‘এ আপনি কি বলছেন? আমরা মারওয়াড়ের রানি। আপনার ছেলে আমাদের কথা দিয়েছিলেন যে, আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা হবে। অথচ আপনি আমাদের মুখ ঢেকে রাখার অধিকার লঙ্ঘন করেছেন। আর এখন আরো অপমান করছেন।

 ‘চমৎকার অভিনয় করেছেন। তবে আর ভান করে লাভ নেই। আমি যতদূর জানি যশবন্ত সিং-এর একমাত্র যখম হয়েছিল তার উরুতে। আপনারা আসলে কে? মারওয়াড়ের বাজার থেকে মোটা ঘুষ নিয়ে আনা অভিনেত্রী নিশ্চয়ই?

হাদির দুই চোখ জ্বলে উঠলো। তিনি বললেন, “এটি সত্যি আমরা রানি নই। তবে আমরা মারওয়াড়ের উচ্চ অভিজাত ঘরের মহিলা। আমরা যথোপযুক্ত সম্মান পাওয়ার যোগ্য।

 ‘যদি সেরকম ব্যবহার আমার কাছ থেকে আশা করেন, তবে সবকিছু বলুন। আর যদি আমার কথা অমান্য করেন তবে পরিণতি খুবই খারাপ হবে।

 ‘আমরা দুই রানির সহচরী এবং তাদেরকে আমরা ভালোবাসি। যখন আমাদের চরেরা খবর আনলো যে, আপনার ছেলে সৈন্য নিয়ে দ্রুত আমাদের অনুসরণ করছেন আর কয়েকদিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন, তখন আমরা আসল রানিদের বদলে নিজেরা রানি সাজতে রাজি হলাম। যখন আমরা তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন আপনার সৈন্যরা এসে আমাদের ধরে ফেলবে, তখন বাচ্চাসহ আসল রানিরা আমাদের বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে মারওয়াড়ি পার্বত্য এলাকার গভীরে ঘোড়া ছুটিয়ে আপনাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিলেন। আমরা সম্মান নিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। এখন ইচ্ছা করলে আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারেন, তবে বাচ্চাগুলোকে দয়া করে রেহাই দিন। ওরা আমাদের সন্তান আর এত ছোট যে, এই প্রতরাণার ঘটনায় তাদের ভূমিকা নিয়ে আপনি তাদেরকে দোষী করতে পারেন না।

 হাদির কথা বলা শেষ হলে আকবর তার বাবার দিকে তাকালেন। বেশিরভাগ যেরকম হয়, তিনি তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করতে পারলেন না তার মনে কি ভাবনা চলছে। শেষপর্যন্ত আওরঙ্গজেব বললেন, ঠিক আছে। আমি আপনার কথা বিশ্বাস করলাম। জেবুন্নিসা, এই মহিলাদেরকে তাদের কামরায় আটকে রাখ, আর যে পর্যন্ত আমি এদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না নেই ততদিন এদেরকে কড়া পাহারা দিয়ে রাখবে। আকবর তুমি এসো আমার সাথে।

বাবাকে অনুসরণ করে তাঁর মহলের দিকে চলতে চলতে আকবরের আবার মন খারাপ হয়ে গেল। এই মহিলারা তাকে কিরকম বোকা বানিয়েছেন। যদি তিনি সেখানে তাদেরকে প্রশ্ন করতেন, তাহলে হয়তো সত্যিটা আবিষ্কার হত আর তিনি আসল রানি আর তাদের বাচ্চাদের ধরতে পারতেন। বাবার সাথে একা হওয়ার পর তিনি অপেক্ষা করছিলেন, কখন তার সমালোচনা করবেন, তবে অবাক হলেন যখন দেখলেন চিন্তামগ্ন হলেও তাকে দেখে মনে হল না যে রেগেছেন। দুটি পেয়ালায় আনারের রস ঢেলে একটি আকবরের হাতে দিয়ে তাকে বসতে ইশারা করলেন।

তারপর এমন কোমল কণ্ঠে কথা বললেন যে, আকবর বেশ অবাক হলেন, ‘আশা করি এটা তোমার জন্য একটা শিক্ষা হয়ে থাকবে। যদিও তুমি ভেবেছিলে যে, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ, কিন্তু আসলে তা করো নি। কেন? কারণ তুমি তোমার শত্রুর মনের ভেতরে ঢুকতে পারোনি, এটাই হল যুদ্ধের প্রথম নিয়ম। বরং তুমি বোকার মতো বিশ্বাস করছে, যা বিশ্বাস করতে চেয়েছে, যা দেখতে চেয়েছো তাই দেখেছে। আর তাই মারওয়াড়িরা বেশ সহজে তোমার সাথে চালাকি করেছে, যেরকম একজন সেবিকা একজন শিশুর সাথে করে। এক হাতে একটি মিঠাই লুকিয়ে রাখার ভান করে, অথচ ওটা আসলে সব সময় অন্য হাতেই ছিল। তুমি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ। এখন তোমার গভীরভাবে চিন্তা করা শেখার সময় হয়েছে…।

আকবর মনোযোগ দিয়ে তার বাবার উপদেশবাণী শুনে চললেন–একই বয়সে তিনি নিজে কিরকম তার ছেলের বিপরীত আচরণ করতেন, তাঁর নিজের বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতার একের পর এক উদাহরণ দিয়ে তাকে একটি বার্তা দিলেন। ধীরে ধীরে আকবরের মন থেকে তিক্ততা দূর হয়ে স্বস্তি ফিরে এল। তার বাবা ঠিকই বলেছেন–তার আরো সাধারণ জ্ঞান খাটান উচিত ছিল। কিন্তু আওরঙ্গজেবের এভাবে তার সাথে কথা বলার প্রয়োজন ছিল না, যেন তিনি একজন তরুণ কোরচি যে কখনও যুদ্ধ করেনি। সেই সাথে তিনি বুঝতে শুরু করলেন, নারী আর শিশুদের পিছু নেওয়ার অভিযানটি কিরকম তিক্ত মনে হল, যখন নকল রানি হাদি আরো রক্তপাত এড়াতে তার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন তখন তিনি কি খুশি হয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি আশ্বস্ত হওয়ার কারণে চালাকির সম্ভাবনাটি তার চোখে পড়েনি।

..আমার জায়গায় হলে এখন তুমি কি করতে আকবর?

 ‘সেনাবাহিনী পাঠিয়ে আসল রানিদেরকে ধরে দিল্লি নিয়ে আসতাম।

 ‘এটা একটা সহজ উত্তর। তুমি একবারও বিষয়টা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করোনি কিংবা আমি এতক্ষণ কি বলেছি তাও ঠিকমতো শোননি। আমি তোমাকে বলেছি সব সময় জানার চেষ্টা করবে অন্যেরা কি ভাবছে আর এটা নিজের পরিবারে যেমন ঘটে তেমনি শত্রুর বেলায়ও একইভাবে খাটে। আমাকে যতটুকু তুমি জেনেছ, তারপর তোমার নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত আমি কি আদৌ এ ধরনের সোজা কাজ করতে পারি কি-না। আর তোমার ভেবে দেখা উচিত ছিল আর কোনো উপায় আছে কি-না আর এও দেখতে হবে কোনটা তোমার কাছে সবচেয়ে ভালো মনে হতে পারে।

 কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আকবর বললেন, কিন্তু কেন রানিদের পিছু নেবেন না?

‘বিষয়টা নিয়ে একবার ভেবে দ্যাখো! আর বেশি দিন নয়, দুই রানির মধ্যে ঝগড়া লেগে যাবে আর তারা যার যার নিজ সন্তানকে সিংহাসনে বসাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দুই পক্ষ লড়াই করে মারওয়াড়কে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলবে। এসব করে ওরা মারওয়াড়কে আরো দুর্বল করে ফেলবে আর আমাদেরকে প্রতিহত করার ক্ষমতা ধ্বংস করে ফেলবে।

‘তাই যদি হয়, তবে আপনি কেন আমাকে রানিদের গ্রেফতার করে আনতে পাঠালেন?’  ‘দুটি কারণে। প্রথমত, যদি আমি কোনো ব্যবস্থা না নিতাম তাহলে ওরা আমাকে দুর্বল ভাবতো। দ্বিতীয়ত, মোগলদের রক্তপাত করার জন্য আমি মারওয়াড়িদেরকে উস্কে দিতে চেয়েছিলাম। আমি মনে মনে খুশি হয়েছিলাম, যখন রানিরা আমাকে অমান্য করে মারওয়াড়ে ফিরে যেতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এমনকি তাদের পালিয়ে যেতেও প্ররোচিত করেছিলাম তাদের শিবিরে আমার গুপ্তচর পাঠিয়ে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিলাম যে, দিল্লির আসার পর আমি রানিদেরকে কারাগারে বন্দী করে রাখবো আর বাচ্চাগুলোকে হত্যা করবো। আর যতটা আশা করেছিলাম এই ফন্দিটা তার চেয়ে আরো ভালো কাজে লেগে গেল। তোমার কয়েকজন সৈন্য হত্যা করে আর তোমার সাথে প্রতারণা করে মারওয়াড়িরা তাদের দেশে আমার অভিযান চালাবার যথেষ্ট কারণ তৈরি করলো। এই গর্বিত রাজপুতদের দীর্ঘদিন প্রশ্রয় দিয়েছি, পদবী আর সম্মান দিয়েছি যা ওদের প্রাপ্য নয়। এবার তাদেরকে অবনত আর বাধ্য হতে শেখাব আর তাদের রাজ্যকে আমার সাম্রাজ্যের একটি অংশ করে নেবো। আর তুমি, আমার ছেলে হবে এই বিজয়ের ঘটক। তুমি আবার মারওয়াড় ফিরে যাবে, এবার শক্তিশালী একটি মোগল সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে বিজয়ী হয়ে ফিরবে। আকবর কিছু বললেন না। এই প্রথম বড় একটি অভিযানে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব পাওয়ার উল্লাসে মারওয়াড়িদের বিরুদ্ধে তার বাবার চক্রান্ত সম্পর্কে তার মনে যে সংশয় ছিল তা এখনকার মতো মুছে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *