রঙ ছোঁড়াছুঁড়ির হাত থেকে বাঁচবার জন্য হোসনে সাহেব অতিরিক্ত ব্যস্ততায় দোতলায় উঠে এসেছেন। তাঁর গায়ে শার্ক-স্কিনের দামী কোট–নষ্ট হলেই গেল। বিয়েটিয়ের সময় মেয়েদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। উঠোনের কাদায় গড়াগড়ি করাতেও তাদের বাঁধবে না।
দোতলায় তিনি আনিসের ঘরটি খুঁজে পেলেন না। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন শেষ প্রান্তে। সেখানে কিশোরী মেয়েদের দলটি সিগারেট টানছে। তারা হোসেন সাহেবকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তিনি নিজেও বিস্মিত, তবু হাসি-হাসি মুখে বললেন, আনিসের ঘরটা এক জন দেখিয়ে দাও তো।
কেউ নড়ল না।
আনিসের ব্যথা এখন একেবারেই নেই। শরীর বেশ হালকা ও বারবারে লাগছে। জমাদার এসেছিল ঘর ঝাঁট দিতে, বেডপ্যান সরিয়ে নিতে, তাকে দিয়ে পানি আনিয়ে আনিস দাড়ি কামাল। মুখ ধোওয়া, চুল ব্রাশ করা আগেই হয়েছে। হালকা গোলাপী একটা সিল্কের শার্ট বের করে পরল। বিয়েবাড়ি উপলক্ষে কত লোকজন আসে, এ সময় কি বাসি কাপড়ে ভূত সেজে শুয়ে থাকা যায়? বেশ লাগছে অনিসের। মাঝে মাঝে এরকম চমৎকার সময় আসে। মনে হয় বেঁচে থাকাটা খুব একটা মন্দ ব্যাপার নয়।
খবরের কাগজ দিয়ে গেছে খানিক আগে। আনিস আধশোওয়া হয়ে বসে আছে। খবরের কাগজ কোলে নিয়ে। খবরের কাগজ কোলে নিয়ে বসে থাকাটাও রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আনকোরা নতুন কাগজ। এখনো ভাঁজ ভাঙা হয় নি। ইচ্ছা! করলেই পড়া শুরু করা যায়। তবে আনিস। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তার পড়া শুরু হয় ভেতরের পাতা থেকে। হারান-বিজ্ঞপ্তি, পড়াইতে চাই, রেকর্ডপ্লেয়ার বিক্রি, পাত্রী চাই–এইগুলিই তার কাছে বড়ো খবর। পড়তে আনিসের দরুণ ভালো লাগে। এ থেকেই কত মজার মজার জিনিস চোখে পড়ে। একবার রাইসুদ্দিন নামের এক ভদ্রলোক বিজ্ঞাপন দিল, আকবর ফিরিয়া আসি, যাহা চাও, তাহাই হইবে। তোমার মা রোজ প্যানপ্যান করেন। রোজ প্যানপ্যান করে শব্দটি আনিসের খুব মনে ধরেছিল এবং সে রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, আকবর তার মায়ের কাছে ফিরেছে। কিনা তাই ভেবে; আরেক বার আরেকটি বিজ্ঞাপন ছাপা হল।–রোকেয়া সুলতানা নামের এক স্কুল-শিক্ষিকার। বর্ণনার ভঙ্গিটি ছিল এই রকম–আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। অবিবাহিতা। নিকট-আত্মীয়স্বজন কেউ বেচে নেই। কোনো সহৃদয় ছেলে আমাকে বিয়ে করলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আমার চেহারা ভালো নয়। শেষ লাইনের আমার চেহারা ভালো নয় বাক্যটি একেবারে বুকে বেঁধে। ভদ্রমহিলাকে একটি চিঠি লিখবার দরুণ ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কী লিখবে ভেবে পায় নি বলে লেখা হয় নি।
আনিস, কী খবর?
আনিস তাকিয়ে দেখল, হোসেন সাহেব হাসিমুখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। এই লোকটিকে আনিস খুব পছন্দ করে। দেখা-সাক্ষাৎ তেমন হয় না, কিন্তু যখনি হয়, আনিসের সময়টা চমৎকার কাটে। হোসেন সাহেব বললেন, বাইরে খুব রঙ খেলা হচ্ছে, তোমার এখানে আশ্রয় নিতে এলাম।
খুব ভালো করেছেন। কখন এসেছেন? এইমাত্র, কেমন আছ বল?
খুব ভালো।
তবে যে শুনলাম খুব পেইন হয়। মাঝে মাঝে পেথিড্রিন দিতে হয়।
তা হয়। কিন্তু এখন ভালো।
হোসেন সাহেব কোটি খুলে হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে দিলেন। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তোমার জন্যে গল্পের বই পাঠিয়েছিলাম, পেয়েছ?
জ্বি, পেয়েছি।
পড়েছ নাকি সব?
কিছু কিছু পড়েছি।
কী-যে রস পাও গল্পের বইয়ে, তোমরাই জোন। তোমার পরী আপার তো বই পেলে আর কথা নেই। এক বার কী–একটা পই পড়ে ফিচফিচ করে এমন কানা-দুপুরে ভাত খেল না, রাতেও না।
কী বই সেটি?
কি জানি কী বই। জিজ্ঞেস করে ওকে। যে-লেখক লিখেছে, সে নিশ্চয়ই লিখবার সময় খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করেছে।
হোসেন সাহেব হাসতে লাগলেন। আনিসও হাসল। হোসেন সাহেব বললেন, এক কাপ চা খেলে হত।
আমার এখানে চায়ের সরঞ্জাম আছে। কাউকে ডেকে আনেন।
ডাকতে হবে না, আমিই পারব।
হোসেন সাহেব নিঃশব্দে উঠে গিয়ে হিটার জ্বালালেন। চা, চিনির পট খুঁজে বের করলেন। দুটি কাপ ধুয়ে টেবিলে এনে রাখলেন। আনিস দেখল, তিনি মৃদু মৃদু। হাসছেন। এই লোকটির বেশ কিছু বিচিত্র অভ্যেস আছে। আপন মনে হাসা, আপন মনে কথা-বলা তার মধ্যে পড়ে। এছাড়াও আরো অদ্ভূত অভ্যেস আছে। যেগুলি পরী জানে। কিন্তু পরী সে-সব নিয়ে কারো সঙ্গে গল্প করতে পারে না। তার স্বামী সম্পর্কে সে খুব সজাগ। কেউ তার কোনো দোষ ধরুক, তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করুক, এসব সহ্য করতে পারে না। বড়োচাচা একবার পরীকে বলেছিলেন, তোর ভদ্রলোকটি এমন মিনমিনে কেন রে? এতেই পরী কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছিল। বড়োচাচা অপ্রস্তুতের একশেষ। আবার এও ঠিক, হোসেন সাহেবের সঙ্গে পরীর বনিবিনা হয় নি। কুমারী অবস্থায় পরী যে-সব কথা ভেবে একা এক লাল হত তার কোনোটিই বাস্তবের সঙ্গে মেলে নি। এ নিয়ে তার গোপন ব্যথা আছে। আনিস তা জানে। সে হঠাৎ বলল, পরী তার বাচ্চা দুটিকে কেমন আদর করে দুলাভাই?
খুব, যাকে বলে এনিমেল লাভ।
আর আপনাকে?
আমাকে ভয় করে। নাও তোমার চা। মিষ্টি লাগবে কিনা বল!
আনিস চায়ে চুমুক দিল। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছে। সকালে নাশতা হয় নি, এখন বেলা হয়েছে বারটা। খিদে জানান দিচ্ছে। হোসেন সাহেব বললেন, এ রকম করছ কেন? ব্যথা শুরু হল নাকি?
না, ও কিছু নয়।
হোসেন সাহেব সিগারেট ধরালেন। আনিস খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনি কি সুখী?
সামটাইমস। একটি মানুষ সারাক্ষণ সুখী থাকতে পারে না। মাঝে মাঝে সুখী হয়। এখন আমি সুখী।
কেন?
কি জানি কেন। হঠাৎ এসব কথা জিজ্ঞেস করছি যে?
দুলাভাই, মাঝে মাঝে আমি এসব নিয়ে ভাবি। কিছু করবার নেই তো, এই জন্য। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আসলে হ্যাপিনেস বলে আলাদা কিছু নেই।
আনিসের কথা শেষ হবার আগেই দারুণ হৈচৈ ও চেঁচামেচি শোনা যেতে লাগল। একটি তীক্ষ্ণ মেয়েলী গলায় কে যেন কেঁদে উঠল। ছাদের উপর থেকে হুঁড়মুড় শব্দ করে একসঙ্গে অনেক লোক নিচে নেমে এল। হোসেন সাহেব আধখাওয়া চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
গোলমালটা যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ থেমে গেল। একটি বিয়েবাড়ির হৈচৈ হঠাৎ থেমে গেলে বুকে ধক করে ধাক্কা লাগে। আনিস নিদারুণ অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছিল।হোসেন সাহেবের ফিরে আসতে দেরি হল না। তিনি আবার তাঁর ঠাণ্ডা। চায়ের কাঁপে চুমুক দিলেন। আনিসের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাসলেন। আনিস বলল, কী হয়েছিল দুলাভাই?
আমার মেয়ে পান্না ড়ুবে গিয়েছিল পুকুরে।
বলেন কী।
সঙ্গে সঙ্গে তুলে ফেলেছে।
পুকুরে গেল কী করে?
মেয়েরা সবাই রঙ খেলে গিয়েছিল গা ধুতে, পান্নাও গিয়েছে।
হোসেন সাহেব আরেকটি সিগারেট ধরালেন। আনিস দেখিল আগুন জ্বালাতে গিয়ে তার হাত কাঁপছে, দেশলাইয়ের কাঠি বারবার নিভে যাচ্ছে। আনিস বলল, আপনি পরীর কাছে যান।
যাই। সিগারেটটা শেষ করে নিই। পরী কী করছে জোন? লীনা-পান্না, তার দু বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মাঝে মাঝে অবিকল গরুর মতো গলায় চিৎকার করে কাঁদছে।
দুলাভাই, আপনি পরীর কাছে যান।
যাই। আনিস, তুমি হ্যাপিনেস সম্পর্কে জানতে চাইছিলে–
পরে বলবেন। এখন পরীর কাছে যান।
হ্যাঁ, তাই যাই।
হোসেন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আনিস দেখল, তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাসলেন।
হৈচৈ শুনে বড়োচাচা নিচে নেমে গিয়েছিলেন।
ততক্ষণে পানাকে পানি থেকে তোলা হয়েছে এবং পান্নার চার পাশে একটি জটলার সৃষ্টি হয়েছে। সব কটি বাচ্চা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। বড়োচাচা কয়েক বার জানতে চেষ্টা করলেন কী হয়েছে। কিন্তু সবাই হৈচৈ করছে, কেউ কিছু বলছে না। তিনি ভিড়ের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখলেন পরী তার দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে। পরীর গা ভেজা, তার মাথায় কচুরিপানার ছোট ছোট পাতা লেগে রয়েছে। বড়োচাচা ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। গলা উঁচিয়ে বললেন, কী হয়েছে রে পরী?
পান্না পানিতে ড়ুবে গিয়েছিল। আভা কোনোমতে তুলেছে। পরী ঘনঘন চোখ মুছতে লাগল।
বড়োচাচা বললেন, তুলেই তো ফেলেছে, তবু কাঁদছিস।
বড়োচাচা হাসতে লাগলেন। পরীর কাণ্ড দেখে বেশ মজা লাগছে তাঁর। তিনি এক বার ভাবলেন জিজ্ঞেস করেন, পরী নিজেই যে ছোটবেলায় পুকুরে ড়ুবে মরতে বসেছিল, সেটি কি তার মনে আছে? কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তাঁকে এখন খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে।