ঝিলপাড়ে রক্ষিত তশতরিতে বিন কাসিমের দ্বিখণ্ডিত মাথা রেখে আমার কাছে নিয়ে এসো….
হিন্দুস্তানে ইসলামের আগমন ও বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের জন্য সিস্তানের বিজয় ছিল একটি মাইল ফলক। আরব সৈন্যরা সিন্ধু অববাহিকার পলিমাটিতে নিজেদের রক্তে তৈরি করেছিল ইসলামের মহাপথ। সে পথেই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলাম। কিন্তু সে সময়ে এ কাজটি অতোটা সহজ ছিল না, যতোটা সহজে আজ আমরা কথামালায় সেদিনের বিজয় ও মুসলিম সৈন্যদের কীর্তির চিত্র আঁকতে চেষ্টা করছি। পৌত্তলিক হিন্দস্তানের বুকে ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন ও আল্লাহর তকবীর ধ্বনী ছড়িয়ে দিতে অসংখ্য আরব মায়ের বুক খালি করতে হয়েছে, মা হারিয়েছে আদরের ছেলে, বোন হারিয়েছে ভাই আর সোহাগিনী স্ত্রী হারিয়েছে প্রেমময় স্বামী আর কলিজার টুকরো শিশুরা হারিয়েছে প্রাণপ্রিয় পিতা। এক সাগর রক্ত ও অসংখ্য নারী পুরুষ, কন্যা-জায়া, জননী ও এতীম শিশুদের ত্যাগ ও কুরবানীর বদৌলতে পৌত্তলিকতার স্বর্গরাজ্য হিন্দুস্তানের বাতাসে গুঞ্জরিত হয়েছে আযানের ধ্বনি। বিন কাসিমের সহযোদ্ধাদের দেহ সিন্ধু অঞ্চলের কতো জায়গায় দাফন করতে হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। তাদের এই আত্মত্যাগ ভারতের। ধনরত্ন লুটতরাজের জন্য ছিল না, ছিল না সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশা। প্রতিটি বিজিত এলাকায় তারা সাধারণ মানুষকে যে স্বাধীনতা ও শান্তির ছায়া দিতো, জিজিয়া হিসাবে তা ছিল খুবই নগণ্য। মুসলিম সৈন্যদের সদ্ব্যবহার হিন্দুস্তানের পৌত্তলিক শাসকদের হাতে নির্যাতিত নিষ্পেষিত সাধারণ জনতার হৃদয় জয় করেছিল, ফলে মুসলিম বাহিনী যতোই অগ্রসর হচ্ছিল হিন্দুস্তানের মাটিতেই তাদের অনুসারী ও ভক্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তারা দুর্গজয়ের পাশাপাশি গণমানুষের অন্তরও জয় করে নিচ্ছিল।
মমতা দিয়ে জয় হয় অন্তর তরবারী দিয়ে নয়। বিজিত মানুষেরা তাকেই বিজয়ী বীর বলে অভিহিত করে যে তাদের অন্তর জয় করে নিতে পারে।
বিন কাসিমের সৈন্যরা হিন্দুস্তানের সাধারণ মানুষের জন্য ছিল পরমবন্ধু, রেশমের মতোই কোমল কিন্তু রাজা দাহিরের মতো ইসলামের চিহ্নিত শত্রুদের জন্য বিন কাসিমের প্রতিটি সৈনিক ছিল আকাশের বজ্রের মতো আতঙ্ক। মুসলিম ইতিহাসের গর্ব সবচেয়ে অল্প বয়ষের বিজয়ী সেনাপতি বিন কাসিম তখনো বিজিত দুর্গ শহর সিস্তানে অবস্থান করছিলেন। তার গন্তব্য ছিল আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার কিন্তু মুসলিম সৈন্যদের নীতি ছিল, তারা যখন কোন শহর দুর্গ বা অঞ্চল জয় করতো তখন সেই অঞ্চল বা শহরের মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা আগে সুসংহত করতো। তারা এই নীতি অবলম্বন করত যে, শাসন কাজে তারা যাতে বিজিতদের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্য করও ঠিকমতো আদায় করতে পারে এবং বিজিত অঞ্চলের জনগণেরও যাতে কর দিতে কষ্টের মুখোমুখি না হতে হয়। সর্বাগ্রে তারা গণমানুষের আতঙ্ক দূর করে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতো। বলার অপেক্ষা রাখে না যুদ্ধ-বিধ্বস্ত কোন এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি সময় সাপেক্ষ হয়ে থাকে। সিস্তানে শান্তি শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বিন কাসিমকেও কিছু দিন সেখানে অবস্থান করতে হলো।
ইতোমধ্যে তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে সিস্তান বিজয়ের সুসংবাদ দিয়ে পয়গাম পাঠালেন। সেই পয়গামে তার সেনাবাহিনীর অবস্থাসহ সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন। জানালেন, তার সৈন্যদের কতোজন শাহাদাতবরণ করেছে, কতোজন পঙ্গু হয়ে বেকার হয়ে গেছে, আসবাব ও রসদপত্র কি পরিমাণ রয়েছে এবং সামনে কি প্রয়োজন হতে পারে। সেই সাথে শত্রুদের অবস্থাও জানালেন, সামনে কোন্ জায়গায় শত্রুরা কোন্ অবস্থায় আছে এবং কোথায় কি পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় করেছে।
ঐতিহাসিক বালাজুরী লিখেছেন, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বসরায় বসে সিন্ধু এলাকার যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। মাঝে মধ্যে তিনি এমন নির্দেশও পাঠাতেন, যা এখানকার পরিস্থিতি অনুধাবন করে বিন কাসিমের তৈরি পরিকল্পনার বিপরীত হতো। যেমন বিন কাসিম পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এক দিকে অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু হাজ্জাজের পয়গাম এলো উল্টো দিকে যাও, সেখানে শত্রুদের তুমি এমন অবস্থায় পাবে।
ঐতিহাসিকগণ জোর দিয়েই একথা লিখেছেন, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের এসব নির্দেশ শুধু আন্দাজ ও অনুমান নির্ভর ছিল না। শক্তিশালী গোয়েন্দা ব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলেছিলেন। সেই গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তিনি রণাঙ্গনের সার্বিক তাজা সংবাদ জানতে পারতেন। সেই সাথে সরোদ প্রেরণের এমন গতিশীল ব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলেছিলেন যে, ভারতের এই অঞ্চল থেকে সুদূর বসরায় মাত্র সাত দিনে খবর পৌছে যেত এবং সেই বসরা থেকে মাত্র সাতদিনে বিন কাসিম যখন যেখানে অবস্থান করতেন সেখানে সংবাদ চলে আসতে। এ জন্য তিনি সময় মতো সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে যে দিকনির্দেশনা দিতেন তার প্রায় সিংহভাগই বাস্তব সম্মত হতো।
বিন কাসিম তখনো সিস্তান দুর্গে অবস্থান করছিলেন। শহরের শান্তি শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। অগ্রাভিযানের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে ছিল। সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের কাজও সমাপ্ত হয়েছিল। শহরের অধিবাসীদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছিল। ঘরে ঘরে সেখানকার মানুষ পরম শান্তিতে বসবাস করছিল। বিজয়ী মুসলমানরা দুর্গে প্রবেশের পর অধিবাসীদের মধ্যে যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল তার অবসান হয়েছিল। মুসলমান সৈন্যরা শহরের অধিবাসীদের মধ্যে এ ধারণা জন্মাতে সক্ষম হয়েছিল যে, তারা বিজিত বটে কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার তাদের আছে।
বিকেলের সূর্য শেষ আলোক বিকিরণ করে তলিয়ে যাচ্ছিল। দুর্গের ফটক বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ফটক রক্ষীরা। দুর্গের বাইরে ক্ষেত খামারে কর্মরত সকল মানুষ দুর্গের ভিতরে চলে এসেছিল। ফটক রক্ষীরা যখন দুর্গফটক বন্ধ করতে যাবে তখন সেখানে উপস্থিত হলো দু’জন লোক। প্রধান দুর্গফটকের কাছে এসে তারা থামল তাদের সাথে ছিল দুটি উত্নী। একটি উষ্ট্ৰীতে ছিল একজন বয়স্কা মহিলা আর অপর উস্ত্রীর ওপর দু’জন তরুণী। পুরুষ দুজন হেটে এসেছে। মহিলাদের পরিধেয় বস্ত্র ছিল মলিন। পুরুষদের পরিধেয় কাপড় ছিল ময়লা। দেখে মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে এসেছে।
তোমরা কে, কোথেকে এসেছ? দুর্গফটকের ওপর থেকে আগন্তুকদের জিজ্ঞেস করল এক নিরাপত্তারক্ষী। অনেক দূর থেকে এসেছি। আমরা একটু আশ্রয়ের সন্ধান করছি। ওপরের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো আগন্তুক এক পুরুষ।
ঠিক আছে, ভিতরে প্রবেশ না করে, তবে দেউড়ীতে দাড়াও। নির্দেশের সুরে বলল নিরাপত্তারক্ষী। তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকো। ফটক বন্ধ করে দেয়া হবে। আগন্তুক উভয় পুরুষ আরোহীদের নিয়ে দুটি উটসহ দুর্গফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। দুর্গরক্ষী দলের কমান্ডার তাদের আবারো জিজ্ঞেস করল, তারা কোথেকে এসেছে এবং কেন এসেছে? অজ্ঞাতনামা একটি জায়গার নাম বলে আগন্তুক এক পুরুষ বলল, তারা সেখান থেকে এসেছে, সেখানকার সৈন্য ও শাসকরা তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছে, ফলে বাঁচার তাকিদে তারা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের কাছে কোন ধন সম্পদ নেই, বলল বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ আগন্তুক। আমাদের কাছে এমন কোন সম্পদ নেই যা দিয়ে খোশহালে কোথাও জীবন যাপন করবো। আমাদের সাথে আছে যুবতী দুই বোন। দুর্ভাগ্য বশত এরা যুবতী এবং রূপসী। জালেম সৈন্যদের অত্যাচার থেকে এদেরকে বাঁচানোর জন্য আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এরা আমাদের সম্পদ, এরাই আমাদের সম্মানের বস্তু। কোন মুসলিম সৈন্য কি তোমাদের হয়রাণী করেছে? না, সেখানে যদি মুসলিম সৈন্যরা পৌছে যেত তাহলে তো আমাদের আর কোন ভয় থাকতো না।
মুসলমানরা মানুষকে সম্মান করে নারীকে ইজ্জত দেয় একথা শুনেই আমরা এখানে এসেছি। শুনেছি, মুসলমানরা নারীর ইজ্জতকে খুব সম্মান করে, কারো ধন সম্পদে হস্তক্ষেপ করে না। আপনি প্রয়োজনে আমাদের দুর্গ থেকে বের করে দিতে পারেন কিন্তু দয়া করে এই দুই যুবতী ও এদের বয়ষ্কা মাকে আশ্রয় দিন। পথ হারিয়ে আমরা অনেক দিন মরুভূমিতে এবং অচেনাপথে ঘুরে ঘুরে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছি। আর সূর্যের তাপে দিনের বেলায় পুড়েছি। দুঃখ কষ্টের কথা এরা এভাবে পাহারাদারকে শোনালো যে, তাদের কষ্টের বর্ণনা শুনে দুর্গফটকের কমান্ডার ও তার সহকর্মীদের মধ্যে দয়ার উদ্রেক হলো।
দুর্গফটকের কমান্ডার বলল, তোমরা দুর্গের ভিতরের দিকে চলে যাও, গিয়ে জেনে নাও, এখানে কোথায় পান্থশালা আছে। সেখানে গিয়ে থাকো। পান্থশালায় মুসাফিরদের থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্তু আছে। আচ্ছা, তোমাদের ধর্ম কি? জিজ্ঞেস করল কমান্ডার।
আমরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। জবাব দিলো বয়স্ক লোকটি। এখন গিয়ে মুসাফিরখানায় থাকো। দিনের বেলায় এখানকার বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ভিক্ষুর
সাথে সাক্ষাত করো, সেই তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। শহরে বেশ কয়েকটি বাড়ি খালি পড়ে রয়েছে। এগুলো এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। হিন্দুদের ঘর বাড়ি। ওগুলোতে তোমরা নির্বিঘ্নে থাকতে পারবে। আগন্তুকরা মাথা নীচু করে দুর্গরক্ষী কমান্ডারকে কুর্নিশ করে সামনে অগ্রসর হলো।
ঠিক সেই সময়ে দুর্গপ্রাচীরে দাড়িয়ে এক সৈনিক মাগরিবের আযান দিচ্ছিল। আযানের বিস্ময়কর ও মুগ্ধকর আওয়াজে থমকে দাঁড়াল মুসাফির দল। তারা দেখতে পেল আযানের সাথে সাথে বিক্ষিপ্ত সৈন্যরা সারিবেঁধে পাশা পাশি দাঁড়াচ্ছে পার্শ্ববর্তী খোলা জায়গায়। মুসাফির দল মোহনীয় আযানের ধ্বনি শেষে অবাক বিস্ময়ে একটু দূরে সরে গিয়ে দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে গেল সৈন্যরা কি করে? তারা গভীরভাবে লক্ষ্য করল, এতো সৈন্যদের উপস্থিতিতেও আযান শুরু হওয়ার সাথে সাথে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কোথাও কারো মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত শোনা যায় নি। আযানের পরপরই দেখা গেল, সবাই সারিবদ্ধ হয়ে গেছে এবং একজন লোক সামনে দাঁড়িয়ে গেছে আর বাকীরাও তার মতোই একই দিকে মুখ করে তার অনুসরণ করে উঠবস করছে। তৎকালীন সময়ের রীতি অনুযায়ী নামাযে ইমামতি করলেন সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম। বিন কাসিমের তেলাওয়াতের মধ্যে ছিল দারুণ আকর্ষণ। তাঁর তেলাওয়াতে পথিকেরা আরো বেশি বিমুগ্ধ হলো। ঐতিহাসিক মাসুমী লিখেছেন, সেই দিনের মাগরিবের জামাতের নামায যেসব পথিক দেখেছিল তারা এতোটাই বিমোহিত হয়েছিল যে, তারা ভুলে গিয়েছিল ভ্রমণের ক্লান্তি। অভিযাত্রীদের মধ্যে উঠের উষ্ট্রারোহী একটি পরিবারে ছিল একজন বৃদ্ধ একজন বয়স্কা মহিলা ও দুজন তরুণী। এরা এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে তারা সওয়ারী থেকে নেমে পড়েছিল। বয়স্কা মহিলা তরুণীদের উদ্দেশ্যে বিন কাসিমকে লক্ষ্য করে বলছিল, দেখো, কেমন মায়াবী চেহারা। আর দুই তরুণির দৃষ্টি বিন কাসিমের ওপর এভাবে নিবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তারা বিন কাসিমের অস্তিত্বে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল।
নামায শেষে সৈন্যরা নিজেদের তাবুতে ফিরে যাচ্ছিল কিন্তু বিন কাসিম ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কোন কোন সৈনিক পরম শ্রদ্ধা ভরে বিন কাসিমের
সাথে মোসাফাহা করছিল। এভাবে অনেক সৈনিক মাসাফাহা করে ফিরে গেলে এক পর্যায়ে বিন কাসিমের পাশে মাত্র কয়েকজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা গোয়েন্দা প্রধান শা’বাব ছাকাফী আর তার একান্ত গুটি কয়েক নিরাপত্তানরক্ষী তখনো রয়ে গিয়েছিল.
অতি উৎসাহী, সেই পথিক পরিবার সামনে অগ্রসর হলো। অগ্রসর হয়ে তারা এক অমুসলিমের দেখা পায় তার কাছ থেকে জেনে নিলো, সৈন্যরা এতোক্ষণ কি করছিল। অমুসলিম-লোকটি জানালো সৈন্যরা এতোক্ষণ ইবাদত করছিল। তারা এও জেনে নিয়ে ছিল সবার সামনে দাঁড়ানো লোকটি কে? তাদের জানানো হলো, সবার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি এই সৈন্য দলের প্রধান সেনাপতি। হিন্দুস্তানে সেনা প্রধানকে যেমন শাসক ও সেনার হর্তাকর্তা মনে করা হয়, মুসলমানদের মধ্যে সেনা প্রধান শুধু প্রশাসনিক প্রধানই থাকে না, সে প্রার্থনা ও উপাসনার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দান করে: মুসাফির দল এক সৈনিকের কাছে জানতে চাইলো, আমরা কি তোমাদের প্রধান সেনাপতির সাথে সাক্ষাত করতে পারব? আমরা অনেক দূর থেকে তোমাদের বাহিনীর এবং তোমাদের সেনাপতির প্রশংসা শুনে এসেছি। তাহলে সামনে এগিয়ে যাও; সামনে গেলেই তুমি জানতে পারবে তোমাদের পক্ষ্যেতার সাক্ষাত পাওয়া সম্ভব কিনা? বলল সৈনিক।
সাফিররা বিন কাসিমের দিকে অগ্রসর হলো। দুই পুরুষের পিছু পিছু তাদের মা ও দুই বোনও অগ্রসর হচ্ছিল। বিন কাসিম আগন্তুক দলকে তার দিকে আসতে দেখে নিজেই ধীরে ধীরে তাদের প্রতি অগ্রসর হলেন। অভিঞ্জ দুই পুরুষ বিন কাসিমের কাছে এসে হাটু গেড়ে এভাবে নমস্কার করল যে কে সিজদা করছে। দুই তরুণী বিন কাসিমের পাশে গিয়ে পুরুষদের মতোই হাটু গেড়ে বসে তার জামা ধরে চুমু দিলো।
বিন কাসিম দূভাষীকে লক্ষ্য করে বললেন, এরা কি চায় জিজ্ঞেস করো? দূভাষী তাদের আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলে সে কথাই তারা পুনর্ব্যক্ত করল, যা তারা এদিকে আসার সময় প্রহরী সৈন্যকে বলেছিল। তরুণীয় যখন তার নিকাব খুলে দেখালো, তখন সবাই লক্ষ্য করল দুজনই খুব সুন্দরী+উক্তয় তরুণী দুভাষীর দিকে হাত জোড় করে আবেদন করল, তুমি তোমার রাজাকে বলল, তার প্রাসাদে আমাদেরকে সেবিকার চাকরি দিতে, আমরা তার প্রাসাদেই নিরাপদ থাকতে পারব।
যেহেতু বিন কাসিম নিজে এখানে উপস্থিত তাই তার উপস্থিতিতে তার পক্ষ হয়ে আর কারো জবাব দেয়ার সুযোগ ছিল না। তরুণীদ্বয় কি আবেদন করছে, হুবহু দুভাষী আরবীতে বিন কাসিমের কাছে ব্যক্ত করুন।
বিন কাসিম শা’বান ছাকাফীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, রাজত্ব সব দেশেই বিদ্যমান। সাধারণ মানুষ মনে করে এর রাজা বাদশাকে আল্লাহ্ তাআলা রাজা বাদশা করেই দুনিয়াতে প্রেরণ করেছে। আমরা এসব লোককে কি করে বোঝার সারা দুনিয়ার রাজা আল্লাহ তাআলাই। এরা আমাকে তাদের রাজার সাথে তুলনা করছে। রাজা ভাবছে। তিনি দুভাষীর মাধ্যমে তরুণীদের বললেন, আমাদের সমাজে কেউ রাজা বাদশা নেই। কোন প্রজাও নেই। আমরা কোন নারীকে কর্মচারী রাখি না। রনাঙ্গনেই আমাদের জীবন কেটে যায়? তোমরা তোমাদের পুরুষদের সাথে মুসাফিরখানায় চলে যাও। সেখানে তোমরা সসম্মানে থাকতে পারবে, তোমাদের ইজ্জতের ওপর কোন ধরনের আক্রমণ হবে না। তোমাদের সব প্রয়োজনই সেখানে বিনা মূল্যে পূরণ করা হবে।
আমরা আপনার কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না, ‘আমরা আপনার সেবাদাসী হিসাবে থাকার জন্যই এখানে এসেছি।
মুচকী হেসে বিন কাসিম বললেন, আমি তো আর তোমাদের অবতার বা রাজা নই। আমার সেবাদাসী হতে তোমাদের এতোটা আগ্রহ কেন?
আপনি আমাদের দেবতার চেয়েও বেশি। আমাদের ধরে লোকদের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। আমাদের ধর্মগুরু পণ্ডিতরা দেবদূতের আসনে বসেও আমাদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, আমরা আমাদের সম্ভ্রম রক্ষার তাকিলে আপনার কাছে এসেছি। আমরা জানতে পেরেছি মুসলমানদের কাছেই নারীর ইজ্জত সুরক্ষিত থাকে।
বিন কাসিম তরুণীদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন কোন নারী বিশেষ করে তাদের মতো তরুণী রূপসীদের তিনি তাঁর দফতরে চাকরি দিতে পারবেন না। কিন্তু উভয় তরুণী বিন কাসিমের সান্নিধ্যে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতে শুরু করল। তারা বলল, তাদের দৃষ্টিতে বিন কাসিম দেবতাতুল্য, তারা এই দেবতার পূজা করতে চায়। তরুণীদ্বয় কখনো বিন কাসিমের হাতে চুমু দিতো আবার কখনো তার জামার আস্তিন চোখে লাগাতো। তাদের সাথে যে পুরুষ
ছিল, তারাও মিনতি জানাতে লাগল বিন কাসিম যেন এদের আবেদন মঞ্জুর করে তার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ দেন।
গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী অনতি দূরে দাঁড়িয়ে দুই তরুণী, তাদের সফর সঙ্গী বয়স্কা মহিলা এবং পুরুষদের গতিবিধি, আচার আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এক পর্যায়ে বিন কাসিম তাকে ইঙ্গিত করলে তিনি এগিয়ে এলেন। আগন্তুকদের পোশাক পরিচ্ছদ ছিল এলাকার কৃষকদের মতো। গোয়েন্দা প্রধান এগিয়ে এসে দুই তরুণির কাধে হাত রেখে বললেন, আমার সাথে এসো, আমি তোমাদের চাকরি দেবো। তরুণীদ্বয় ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে বিন কাসিমের দিকে তাকালো। বিন কাসিম মুচকি হেসে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন, তোমরা এই লোকের সাথে চলে যেতে পারো। সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকারে চারপাশ ছেয়ে গেল। চতুর্দিকে জ্বলে উঠল প্রদীপ। শাবান ছাকাফী দুই তরুণী ও বৃদ্ধাসহ তাদের সঙ্গী পুরুষদের একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। গোয়েন্দা প্রধান দুই তরুণীকে তার কক্ষে নিয়ে বয়স্কা মহিলা ও পুরুষদের বাইরে বসার নির্দেশ দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তিনি কক্ষে প্রবেশ করতেই আরো প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরটি আলোকময় করে দেয়া হলো। শাবান ছাকাফী তার একান্ত সচিবকেও কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে তরুণী দুজনের মাথার উড়না ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তরুণিরা তাদের রেশমী চুল উদোম করে দিলে গভীরভাবে তাদের চুলের বর্ণ ও পরিপাটি নিরীক্ষণ করে তাদের হাত নিজের হাতে নিয়ে আঙুলের গঠন ও হাতের ত্বক পরখ করলেন। অতঃপর তাদের বাজু থেকে বস্ত্র সরিয়ে তাও পরখ করলেন। পায়ের জুতো খুলে পায়ের গঠন পর্যবেক্ষণ করলেন। তোমরা ঠিকই শুনেছ যে, মুসলমানরা নারীকে সম্মান করে, তরুণীদের উদ্দেশ্যে বললেন, গোয়েন্দা প্রধান। আমরা তোমাদের মতো তরুণীদের ইজ্জতের ওপর হাত দেই না কিন্তু হত্যা করি। অবশ্য সেই হত্যাকাণ্ডটি খুবই মর্মান্তিক হয়ে থাকে। তোমরা যদি সত্য কথা বলো, কোন বিষয় আড়াল না করো এবং চালাকী চাতুরী করে বিভ্রান্তিমূলক জবাব না দাও; তাহলে তোমাদের কোন কষ্ট দেবো না। তোমরা যে ভাবে এসেছে, ঠিক সেভাবেই সসম্মানে তোমাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করব।
একথা শুনে উভয় তরুণী প্রকম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতে লাগল, আমাদের কেন হত্যা করা হবে, আমরা কি অপরাধ করেছি? এরা অপরাধের কারণ জানতে শাবান ছাকাফীর গায়ের সাথে গা মিশিয়ে দিয়ে অনুনয় বিনয় করছিল। ওদের অঙ্গভঙ্গি ছিল খুবই উন্মাদনাপূর্ণ। শা’বান ছাকাফীর মতো অভিজ্ঞ গোয়েন্দার পক্ষে বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না, এদের এই কাকুতি মিনতির মধ্যে কোন ভয় শঙ্কা নেই, বরং আছে সচেতন সতর্ক লক্ষ্যভেদী আক্রমণের প্রয়াস। গোয়েন্দা প্রধান উভয় তরুণির চুল, হাত, পায়ের গঠন দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন এরা পশ্চাদপদ কোন দলিত শ্রেণির হিন্দু পরিবারের মেয়ে নয়। এরা সেনা প্রধানের সাথে যেভাবে কথা বলছিল তাতেও প্রমাণ হয় এরা কোন আনাড়ী অশিক্ষিতা অবলা মেয়ে নয়, বরং খুব পটু ও প্রশিক্ষিত। কোন পশ্চাদপদ দলিত শ্রেণির কৃষাণ কন্যার পক্ষে এভাবে সেনা প্রধানের সাথে জড়তাহীন কথা বলা একেবারেই অসম্ভব।
তাছাড়া এদের হাত পা চেহারা শরীরে বিন্দুমাত্র অভাব দারিদ্র্য দুঃখ যন্ত্রণার ছাপ নেই। ওরা আসলে খুব নির্বোধ, যারা তোমাদেরকে এখানে পাঠিয়েছে, বক্র হাসি দিয়ে বললেন গোয়েন্দা প্রধান। ওরা তোমাদেরকে গরীব কৃষাণ কন্যার বেশে পাঠালেও ভেবে দেখেনি, আসলে তোমাদেরকে কৃষাণ কন্যাদের মতো দেখায় কি না। তোমরাই বলো, কি উদ্দেশ্যে তোমরা এখানে এসেছ? আমাদের সেনাপতিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে এসেছিলে, না গোয়েন্দাগিরি করে আমাদের ভিতরকার অবস্থা জেনে তথ্য পাচার করার জন্যে এসেছো? তরুণীদ্বয় একথার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই শা’বান ছাকাফী এক তরুণীকে কাছে টেনে এক হাতে তাকে নিজের পাজরের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। ভাবটা এমন যেন তিনি তরুণির প্রতি অতিশয় আগ্রহের আতিশয্যে তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছেন। তিনি ডান হাতে তরুণির গালে আলতু করে টোকা দিয়ে গভীরভাবে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেললেন।
পরম সোহাগভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, বলো, আমি ইচ্ছা করলে উভয়কে শাহজাদী বানিয়ে রাখতে পারি। আর আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের হাত পা বেঁধে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে ঘোড়া দৌড়িয়ে তোমাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি। আপনি কে? তরুণী তার শরীরের সাথে আরো লেপ্টে গিয়ে পরম মাদকতা মেশানো কণ্ঠে বলল, আপনিও কি সেনাপতি?
শুধু সেনাপতি নই, এখানকার সব কিছুই আমি। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি, সেটির জবাব দাও? তরুণী গোয়েন্দা প্রধানের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করাতো দূরে থাক, বরং নিজেকে সে আরো মেলে দিলো, আরো গভীরভাবে তার তুলতুলে শরীরটা গোয়েন্দা প্রধানের শরীরের সাথে মিশিয়ে দিয়ে একহাতে শা’বান ছাকাফীর কোমর পেচিয়ে ধরল। গোয়েন্দা প্রধানের এই কাণ্ড দেখে অপর তরুণির ঠোটে ঈষৎ হাসির আভা ফুটে উঠল যা শা’বান ছাকাফীর দৃষ্টিকে আড়াল করতে পারল না। তাতে শা’বান ছাকাফী চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছে গেলেন। এক ঝটকায় তরুণীকে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে অপর কক্ষে বসা দু’পুরুষ সাথীকে ডেকে ভিতরের কক্ষে নিয়ে এলেন। শাবান ছাকাফীর বুঝতে বাকী রইলো না এরা গোয়েন্দা। তিনি পুরুষ সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললেন, এতোটা নির্বোধ হলে কি তোমরা কাজ করতে পারবে? না তোমরা আরবদের বোকা মনে করো? না তোমরা মনে করো যে, আমরা তোমাদের চালচলন, রীতিনীতি, চক্রান্ত ও পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানিনা। জানো, আমি যে কোন মানুষের হাত পা দেখে ওর পূর্ব পুরুষের পেশাও বলে দিতে পারি।
একথা বলে তিনি যুবক লোকটির দু’হাত টেনে নিয়ে ওলট পালট করে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, সেনাবাহিনীতে তুমি কোন পদমর্যাদার অফিসার? তুমি কৃষকের পোক গায়ে জড়িয়ে এসেছ কিন্তু তোমার তিন পুরুষের মধ্যে কেউ কি কখনো কৃষি কাজ করেছে? আপনি আমাদের ভিতর তলব না করলেও আমরা নিজে থেকেই ভিতরে আসার চিন্তা করছিলাম হুজুর! বলল বয়স্ক লোকটি।
আমরা কিছু বললে হয়তো আপনি মনে করবেন, শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আমরা আপনাকে মিথ্যা কথা বলছি। আমরা দু’জন বাইরে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, ভিতরে এসে আপনাকে বলে দেবো, আমরা রাজা কাকসার পাঠানো গোয়েন্দা।
এই দুর্গ থেকে পালিয়ে যাওয়া বিজয়রায় আমাদেরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। বলল অপর লোকটি। এই দুই তরুণী বিজয় রায়ের নিজ খান্দানের মেয়ে।
“বিজয় রায় কি এখান থেকে পালিয়ে সিসিমপুরে চলে গেছে।” জিজ্ঞেস করলেন গোয়েন্দা প্রধান।
জী হা। জবাব দিলো লোকটি। তিনি রাজা কাকসার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তারা উভয়ে মিলে এখন আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিন কাসিমের সৈন্যরা যখন আংটা দিয়ে সিস্তানের দুর্গে প্রবেশ করছিল তখন দুর্গপতি রাজা দাহিরের ভাতিজা বিজয় রায় তার পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বিন কাসিম বিজয় রায়ের পিছু ধাওয়া করার ইচ্ছা করেছিলেন কিন্তু তার গোয়েন্দারা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছিল না বিজয় রায় ঠিক কোন দিকে পালিয়েছে। বিন কাসিম রাজা দাহিরের রাজ্য ও তার প্রশাসন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের মধ্যে এ বিষয়টি জানতে সক্ষম হয়েছিলেন, রাজা দাহিরের সেনাবাহিনীর অধিকাংশ তার ভাতিজা বিজয় রায় ও ছেলে জয়সেনার কমান্ডে তুকমান ও সিস্তানে নিয়োজিত রয়েছে। তাই বিন কাসিম চেষ্টা করছিলেন উভয়কেই পাকড়াও করতে নয়তো নিঃশেষ করে দিতে। কারণ তাতে রাজা দাহিরের সিংহ ভাগ সমরশক্তি নিঃশেষ হয়ে যেত। সিস্তানের পর বিন কাসিমের প্রধান লক্ষ্য ছিল সিসিমপুর দুর্গ। সিসিমপুর ছিল বৌদ্ধ রাজ্যের রাজধানী। ওখানকার রাজা কাকা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। এই রাজ্য দৃশ্যত স্বাধীন হলেও মূলত রাজা দাহিরের করতলগত ছিল। রাজা দাহির রাজা কাকাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছিল, তোমার রাজ্য যদি বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে আমি সৈন্যদল নিয়ে শত্রুদের প্রতিরোধ করব।
বিন কাসিম ও গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর জন্য এই তথ্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গভীর অনুসন্ধান করে বিন কাসিমের অভিজ্ঞ গোয়েন্দারা এই তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল। বিন কাসিম জানতে পেরেছিলেন সিসিমপুর তেমন কোন শক্তিশালী দুর্গ নয়। এছাড়া সিসিমপুরের রাজা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তিনি ধারণা করেছিলেন বৌদ্ধরা যেহেতু অহিংসবাদী ও রক্তপাত বিরোধী তাই নিরূনের বৌদ্ধ শাসকের মতো রাজা কাকাও তার প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে মুসলিম সৈন্যদের স্বাগত জানাবে। কিন্তু ধৃত গোয়েন্দারা তাকে ভিন্ন সংবাদ সরবরাহ করল। অবশ্য এদের পরিবেশিত সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে সংশয় ছিল এরা সঠিক সংবাদ দিচ্ছে কি-না। তা ছাড়া এদের কথাবার্তা এমনও হতে পারে যে, তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে তোমরা সিস্তান গিয়ে এমন আচরণ করবে যাতে তোমাদেরকে তারা শত্ৰু গোয়েন্দা মনে করে পাকড়াও করলে তোমরা জীবন বাঁচানোর জন্য
গোপন সংবাদ বলে দেয়ার ভান করে বলবে যে, বিজয় রায় আর রাজা কাকা মিলিত হয়ে বিন কাসিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমরা জানি, আপনি আমাদের কখনো ছেড়ে দেবেন না। বলল পুরুষ দু’জনের একজন। কারণ আমরা যে অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়েছি, তাতে আমাদের গর্দান আমরাই আপনার তরবারীর নীচে নিক্ষেপ করেছি। আমরা হয়তো আপনাকে বিশ্বাস করাতে পারব না, আমরা যা বলেছি তা কতটুকু সত্য ও বাস্তব।
কথা শুনে মনে হচ্ছে, তোমরা উভয়েই যথেষ্ট জ্ঞানী। বললেন শাবান ছাকাফী। আমি তোমাদের জানিয়ে দিতে চাই, আমি তাদেরই একজন যারা তোমাদের মতো লোকদের ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করে। তোমরা যদি ইচ্ছা করে মিথ্যা কথা বলো, তাহলে আমি দিব্যি তা বলে দিতে পারব তোমরা কোন্ কথাটি মিথ্যা বলেছ। আচ্ছা! তোমরা কি আমাকে বলবে, নিজেদের জীবন বাচানো ছাড়া আর কি কারণ ঘটেছে যে, আমার কাছে তোমরা নিজেদের আসল পরিচয় প্রকাশ করে দিচ্ছ? “আমরা এই প্রথম মুসলমানদের ইবাদত করতে দেখেছি” বললো দু’জনের একজন পুরুষ। আপনাদের আযানের ধ্বনিও আমরা এই প্রথম শুনেছি। আপনাদের নামায পড়াও প্রথম দেখলাম। আমরা হিন্দু। হিন্দুরা নানা জাতি ও বর্ণে গোত্রে বিভক্ত। আমাদের ধর্মকর্মে আপনাদের নামাযের মতো এমন কোন জিনিস নেই। আপনাদের নামায, আযান আমাদের মধ্যে এমন অদৃশ্য প্রভাব সৃষ্টি করেছে যা আমরা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না।
আমি তোমাদের এতো দীর্ঘ দাস্তান শুনতে পারব না। তোমরা সংক্ষেপে আমাকে একথা বলো, এখানে তোমাদের আসার আসল উদ্দেশ্য কি ছিল? আমার প্রশংসা ও আমাদের ধর্মের প্রশংসা করে তোমরা আমার অন্তর গলাতে পারবে না। বললেন শাবান ছাকাফী। আমাদের এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল, এরপর আপনারা কোন দিকে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তা জানা। তাছাড়া আমাদেরকে একথাও বলে দেয়া হয়েছিল, আপনাদের সৈন্য সংখ্যা কত এবং তাদের অবস্থা কি তাও জানা। সেই সাথে আপনাদের রসদপত্র কোন পথে কিভাবে আসে সে বিষয়টিও আমাদের জানতে বলা হয়েছিল। বলল বয়স্ক লোকটি।
এ বিষয় জানার জন্য এই তরুণীদের সাথে আনার কি প্রয়োজন ছিল? জানতে চাইলেন গোয়েন্দা প্রধান। তোমরা দু’জন কি এ কাজ করতে পারতে না?
এসব তথ্য জানার জন্য উর্ধতন কর্তা ব্যক্তিদের সংশ্রবে যাওয়ার প্রয়োজন হতো। বলল ধৃত এক গোয়েন্দা। আমাদের একথাও বলা হয়েছিল, মুসলিম সেনাপতি একজন নওজোয়ান লোক। সে সহজেই নারীর ফাঁদে পা দিতে পারে। নারীর ফাঁদে পা দেয়ার মতো লোকেরা ফেঁসে যেতে বেশি দেরী করে না। কিন্তু আমরা শুরুতেই বুঝতে পেরেছি, আপনাদের সেনাপতির মধ্যে নারীর প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
নারীর প্রতি তাঁর আসক্তি কি করে হবে বলো? বললেন শাবান ছাকাফী। তোমরা কি দেখোনি, তিনি শুধু আমাদের সেনাপতিই নন, আমাদের ইমামও তিনি। সেনাপতি পাপীষ্ঠ হলেও সৈন্যদের মধ্যে এর তেমন প্রভাব পড়ে না, কিন্তু ইমাম বদকার হলে তার প্রভাব মুসল্লীদের মধ্যেও পড়ে…। ওহ্! আমি কি বলছি, তা তোমাদের পক্ষে হয়তো বোঝা মুশকিল। যাক তোমরা তোমাদের কথাই বলো। এর আগেও আমরা তোমাদের রাজা দাহিরের কাছে এদের মতোই তরুণীদেরকে এই পয়গাম দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছি যে, এসব দুশ্চরিত্রা মেয়েদের দিয়ে সে আমাদের আক্রমণ থেকে তার রাজত্ব ও রাজ্য রক্ষা করতে পারবে না। আর এখন তার ভাতিজা নিজ খান্দানের মেয়েদেরকেই এ কাজে পাঠাল।
আমরা আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব না’ বলল এক গোয়েন্দা। কিন্তু আমরা চাই রাজা কাকা ও বিজয় রায়ের কাছে আমাদের পক্ষ থেকে একটা পয়গাম দিতে। আমরা তাদের জানাতে চাই, তোমরা এই বাহিনীর বিরুদ্ধে কখনো সফল হবে না। যাদের ইবাদত ঐক্য ও মমতার শিক্ষা দেয়, যারা এক ইমামের পিছনে পূর্ণ আনুগত্য নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আবার সোজা হয় আবার মাথা অবনত করে।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, হিন্দুদের এই গোয়েন্দারা বিন কাসিমের নামায, ইমামতি ও আযান শুনে ও প্রত্যক্ষ করে এতোটাই প্রভাবিত হয়ে ছিল যে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ফিরে গিয়ে রাজা কাকা ও বিজয় রায়কে বলবে, তারা মুসলমানদের সাফল্য ও বিজয়ের রহস্য জেনে এসেছে। আর এই রহস্য হলো, তাদের এক ইমামের পিছনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইবাদত করা এক ইমামের
পিছনে ভেদাভেদহীনভাবে একই সারিতে দাঁড়িয়ে পূর্ণ আনুগত্যের সাথে নামায পড়া। তারা মুসলমানদের বিজয়ের দ্বিতীয় যে কারণটি অনুধাবন করেছিল, তা হলো, মুসলিম সেনাপতি একজন তরুণ হওয়ার পরও সুন্দরী তরুণীদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম ছিল, বিন্দুমাত্র তাঁর মধ্যে নারীর প্রতি আসক্তি ছিল না। গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফী ধৃত শক্ত গোয়েন্দাদেরকে সৈন্যদের প্রহরায় রেখে বিন কাসিমের শরনাপন্ন হয়ে বললেন, আপনার কাছে চাকরি ও আশ্রয় প্রার্থী দলটি শত্রু পক্ষের গোয়েন্দা দল। ধৃত গোয়েন্দা দলের কাছ থেকে তিনি যে তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন, এ সম্পর্কেও বিন কাসিমকে তিনি অবহিত করলেন। দুর্গের দ্বার রক্ষীর কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা নিশ্চিত হলেন, সে দিন সন্ধ্যায়ই এই লোকগুলো দুর্গে প্রবেশ করে, এরা এই দুর্গের বাসিন্দা নয়। এদেরকে এখানে আর দেখা যায়নি।
বিন কাসিম কিছুক্ষণ চিন্তা করে ওদেরকে দুর্গ থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সম্ভবত বিন কাসিমের জীবনে এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমি ঘটনা। চিহ্নিত শত্রুদের তিনি কখনো ক্ষমা করতেন না। শত্রুদের জন্য তিনি ছিলেন সাক্ষাত যমদূত।
‘আমাদের সিপাহসালার তোমাদেরকে বিনা বিচারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন বিন কাসিমের কাছ থেকে তার দফতরে ফিরে এসে ধৃত গোয়েন্দাদের উদ্দেশ্যে বললেন শাবান ছাকাফী। ফিরে গিয়ে বিজয় রায় ও রাজা কাকাকে বলবে, খুব শিগগিরই তাদের সাথে আমাদের সাক্ষাত হবে ইনশাআল্লাহ। তীরন্দাজদের বিষাক্ত তীর আর মিনজানিকের পাথর দিয়ে আমরা তাদের শুভেচ্ছা জানাবো। সেই রাতেই ধৃত শত্রু গোয়েন্দা দলটিকে বিনা বিচারে দুর্গ থেকে বের করে দেয়া হলো।
বিজয় রায় সিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে সিসিমে রাজা কাকসার আশ্রয় গ্রহণ করে। সে রাজা কাকাকে বলে, প্লাবনের মতো মুসলিম সৈন্যরা অগ্রসর হচ্ছে। আপনি প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করুন।
‘তোমরা তো জানো, আমরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী, আমরা স্নেহ-মমতার পূজারী, কারো রক্ত ঝরানো আমাদের ধর্মের চেতনা বিরোধী। ‘মুসলমানরা স্বধর্মের লোক ছাড়া সব মানুষের প্রতিই সহিংস।’ বলল বিজয় রায়। যে কোন মানুষের রক্ত ঝরাতে এরা দ্বিধা করে না। তুমি এরপর
কি বলবে তা আমি জানি রাজা কাকাকে বলল বিজয় রায়। তোমার আর কোন কথা শুনতে চাই না। বৌদ্ধ কাপুরুষদের জন্য আজ গোটা হিন্দুস্তান বেদখল হতে চলছে। নিরূনের মতো মজবুত দুর্গও সুন্দরী বিনা বাধায় মুসলমানদের হাতে তুলে দিয়েছে। মৌজ অঞ্চলের বৌদ্ধরা আমাদের সাথে বেঈমানী করার কারণে মুসলমানরা সিস্তান কব্জা করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তুমিও ধর্মের বাহানা দিয়ে ওদের পথই অনুসরণ করছ। কোন ধরনের প্রতিরোধ না করে স্বেচ্ছায় অস্ত্র সমর্পণ করেছ সেসব মুসলমানরা তোমাদের কন্যা জায়াদের নিয়ে আমোদ স্ফুর্তি করছে। নানা, ওরা এমন করে না বিজয় রায়। বলল রাজা কাকা। আমি খোজ নিয়েছি। ওদের ব্যাপারে তোমাদের এই অভিযোগ ঠিক নয়। মুসলমানরা যদি নাও করে, তবে আমরাই তোমাদের কন্যা জায়াদের নিয়ে স্ফুর্তি করব। হুমকির সুরে বলল বিজয় রায়। তোমরা কি ভুলে গেছ, রাজা দাহিরের অনুগ্রহে রাজত্ব করছ তোমরা। তুমিও যদি আমাদের সাথে বেঈমানী করো, তাহলে তোমার খান্দানের কোন একটা শিশুকেও জ্যান্ত রাখা হবে না। তোমরা আমার সহযোগিতা করো, আমাকে সিস্তানের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ দাও। তুমি কি জানো না, রাজা দাহির আমার ওপর কতটা নির্ভর করে।
সে কথা তো জানি, কিন্তু বলল, এই অবস্থায় আমি কি করতে পারি? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল রাজা কাকা। তোমার ইচ্ছা পরিবর্তন করতে হবে। বলল বিজয় রায়। চুন্না বংশের লোকেরা তোমার প্রজা। এরা খুবই দুর্ধর্ষ ও লড়াকু। ওই বংশের যুবকদের দিয়ে একটি বাহিনী গঠন করে আমার সাহায্যের জন্যে বলল।
বদলে গেল রাজা কাকা। সে বিজয় রায়ের কথায় প্রভাবিত হয়ে গেল। সে বিজয় রায়ের সাথে বিন কাসিমের অগ্রাভিযান ও সামরিক চাল সম্পর্কে আলাপ চারিতায় মগ্ন হয়ে গেল। এক পর্যায়ে তারা বিন কাসিমকে পরাজিত করার পরিকল্পনা করতে শুরু করল।
মুহাম্মদ কাসিম এদিকে অগ্রসর হবে এটা কিভাবে জানা যাবে? জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল বিজয় রায়। মুসলিম বাহিনী এদিকেই আসবে এমনটি মনে করে আমি দুর্গবন্দি হয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত নই। আমি ময়দানে ওদের মোকাবেলা করবো, উন্মুক্ত ময়দানেই সিস্তানে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাই। রাজা দাহির অবশ্য নির্দেশ দিয়েছেন দুর্গবন্দি হয়ে লড়াই করতে। এর ফলে আমরা একটির পর একটি দুর্গ মুসলমানদের দখলে দিতে বাধ্য হচ্ছি। সিস্তানের
পরাজয় আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আমি বুঝতে পারছি না সিস্তান থেকে কিভাবে মুসলমানদের বিতাড়িত করব। আমরা খবর নেয়ার জন্যে গোয়েন্দা পাঠাব, প্রস্তাবের সুরে বলল রাজা কাকা। আমার কাছে এমন কোন মেয়ে নেই, যাকে গোয়েন্দা কাজে পাঠানো যায়। এ কাজের জন্য দুইজন সুন্দরী তরুণী দরকার।
সুন্দরী তরুণির প্রয়োজন হলে আমার কাছে বলো। আমার নিজের খান্দানের মধ্যে সুন্দর সুন্দর শিক্ষিত চতুর তরুণী আছে। রাজা কাকসার সাথে পরিকল্পনার পর বিজয় রায় তার নিজ খান্দানের মহিলা ও তরুণীদের ডেকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলে দুই সুন্দরী তরুণী স্বেচ্ছায় গোয়েন্দা অভিযানে বের হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল। কাকা এই তরুণীদেরকে তাদের কর্ম পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিল। কাকা বুঝতে পারেনি সে যে কাজের জন্য এই তরুণীদের পাঠাচ্ছে বাস্তবে এ কাজটি তার ধারণা মতো অতোটা সহজ সাধ্য নয়। কাকা মনে করেছিল হিন্দুস্তানের রাজা মহারাজারা যেমন সুন্দরী তরুণী দেখলেই তাকে রাজমহলের অলংকারে পরিণত করে মুসলিম সেনাপতিরাও এমন সুন্দরী রূপসীদের দেখে নিজেদের দীনধর্ম কর্তব্য ভুলে যাবে।
তরুণিরা তাদের ভিতর থেকে সকল গোপন রহস্য উদঘাটন করে সাবাড় করে দেবে। রাজা কাকা তার দেখা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিন কাসিম সম্পর্কে চিন্তা করেছিল। সে জানতো মহা ভারতের মন্দিরগুলোতে পুরোহিত মণি ঋষিরা পর্যন্ত যৌন লিলা চরিতার্থ করতে নারী পুরুষকে একই সাথে রাখে। এবং তাদের ব্যভিচার কর্মকে ধর্মের আচরণে ঢেকে রাখে। কাকা আরো ভেবেছিল দূর দেশে দীর্ঘ দিন নারী সম্ভোগ থেকে দূরে থাকা মুসলিম সেনাপতিরা সুন্দরী ললনাদের কাছে পেয়ে নিজেদের ক্ষুধা দমিয়ে রাখতে পারবে না। অবশ্য মানবিক চাহিদাও এটাই প্রত্যাশা করে। মহা ভারতের ইতিহাসও তাই বলে যে, বিজয়ী রাজা মহারাজারা বিজিত রাজ্য দখল করে সেখানকার প্রজাদের কাছে প্রথম যে উপঢৌকন প্রত্যাশা করে তা হলো সেখানকার সুন্দরী ললনা।
হিন্দু রাজা মহারাজারা বিজিত রাজ্যে প্রবেশ করে প্রথমেই সেখানকার নারীদের ওপর আগ্রাসন চালাত। বাহ্যিক দৃষ্টিতে সে সময়ের পারিপার্শিকতায় রাজা কাকা যা ভেবেছিল তা যথার্থই ছিল কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে, বিন কাসিম পার্থিব স্বার্থের মোহে ভারত অভিযানে বের। হননি, তিনি এ উদ্দেশেও যুদ্ধের নেতৃত্ব দেননি, জয়ী হলে লোকে তাকে বিজয়ী বীর বলবে এবং বিজিত রাজ্যের সাধারণ লোকজন তার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়বে।
গোয়েন্দা কাজে যে বয়স্কা মহিলাকে কাকা পাঠিয়েছিল, সে ছিল বিজয় রায়ের খান্দানের একজন পুরনো ভৃত্য। এই মহিলা ছিল চালাক ও ধূর্ত। সে বিজয় রায়ের খান্দানের লোকজনকেও চাতুরীপনার আঙুলের ইরাশায় নাচাতো। যে দু’জন পুরুষকে তাদের সাথে পাঠানো হয়েছিল এরা ছিল বিজয় রায়ের সৈন্যদলের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এরা অসি চালনা, বর্শা নিক্ষেপ ও অশ্বারোহনে খুব পারদর্শী ছিল। এরা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান ছিল কিন্তু গোয়েন্দাদের মধ্যে যে দূরদর্শিতা থাকে তা ওদের মধ্যে ছিল না। কারণ গোয়েন্দাদের মধ্যে কোন রাগ অনুরাগের বশবর্তী হওয়ার সুযোগ নেই। আবেগকে গোয়েন্দা কর্মে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এরা মুসলমানদের সারিবেধে নামায পড়তে দেখেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে বিনা জিজ্ঞাসাবাদেই নিজেদের পরিচয় ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেয়।
হঠাৎ একদিন রাজা কাকা ও বিজয় রায়ের পাঠানো গোয়েন্দা দল ফিরে এলো। বিজয় রায় ও কাকা সহাস্যে তাদের ফিরে আসায় স্বাগত জানালো। তারা উভয়েই কিছুটা বিস্ময়মাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, মেয়েদের তোমরা ফিরিয়ে এনেছ কেন? অতঃপর গোয়েন্দা দল তাদের পুরো কাহিনী রাজা কাকা ও বিজয় রায়কে শোনালে তাদের চোখ কপালে উঠল। উভয়েই গোয়েন্দা দলের দুই সেনা কর্মকর্তাকে গালমন্দ করতে শুরু করল। ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে বিজয় রায় বলল, তোমাদের এই ব্যর্থতার জন্য উভয়কে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়াই হবে উচিত বিচার।
‘ওদেরকে হাত পা বেধে দুর্গম মরুভূমিতে ফেলে আসা উচিত’ বলল রাজা কাকা। মরুভূমিতে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যু বরণ করলেও ওদের যথার্থ বিচার হবে না। আমরা ওদের কিসের জন্য পাঠালাম আর ওরা করে এলো কি?
‘আমরা আপনাদের জন্য বহুত দামী সংবাদ এনেছি মহারাজ’ বলল দু’জনের একজন। সবচেয়ে দামী রহস্যজনক সংবাদ হলো আপনাদের পক্ষে কোনভাবেই ওদেরকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। আমরা তাদেরকে যেভাবে ইবাদত করতে দেখেছি তাতে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, ওদের ঐক্য ও আনুগত্যে কখনো বিচ্যুতি ঘটবে না, তারা এক কমান্ডে জীবন দিতেও প্রস্তুত। আমরা দেখে এসেছি, ওখানকার অমুসলিম অধিবাসীরা খুবই শান্তিতে বসবাস করছে।
এরা মুসলমানদের নামায দেখে যেভাবে প্রভাবিত হয়েছিল তা ব্যক্ত করল উভয় তরুণির মধ্যে তখন বিরাজ করছে আতঙ্ক। তারা নীরবে নতশিরে দণ্ডায়মান। তাদের ওপর শাসকদের কোন শাস্তি নেমে আসতে পারে এ নিয়ে তাদের কোন উদ্বেগ ছিল না। তারা হতাশ ও আফসোস করছিল, ধরা পড়ে যাওয়ার কারণে কাল বিলম্ব না করে তাদেরকে মুসলমানরা সিস্তান থেকে বের করে দিয়েছিল বলে। তারাও মুসলমানদের প্রতি এতোটাই প্রভাবিত ও মুগ্ধ হয়েছিল যতোটা প্রীত ও মুদ্ধ হয়েছিল তাদের সহযাত্রী দুই পুরুষ কর্মকর্তা। আপনারা যদি তাদেরকে পরাজিত করতে চান, তাহলে আপনাদেরকেও সেনাবাহিনীর মধ্যে তাদের মতো আনুগত্য, সৎ চরিত্র এবং ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। বলল অপর কর্মকর্তা। অথবা এমনই কোন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আমাদের দু’জনকে এমন কোন কঠিন দায়িত্ব দিন যা আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমরা জীবন দিয়ে সেই কাজ করে দেখাবো। সেই দু’সেনা কর্মকর্তাকে পুনরায় কোন ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছিল কিনা এ ব্যাপারে ইতিহাস নীরব কিন্তু একথা ঠিক তাদের বলার পর বিজয় রায় ও রাজা কাকা বিন কাসিমকে পরাজিত করার জন্য নতুন এক কৌশলের চিন্তা করল।
এদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিস্তান থেকে রওয়ানা হলেন। সিসিমের দিকেই ছিল তাঁর অগ্রাভিযান। তিনি সৈন্যদেরকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁর গোয়েন্দারা খবর দিলো, পথিমধ্যে কয়েকটি হোট ছোট দুর্গ রয়েছে এগুলো দখলে নিতে হবে। গাইড তাদের সাথে থেকে পথ নির্দেশনা দিচ্ছিল।
সিস্তান আর সিসিমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল সিন্ধু নদী। বিন কাসিম আগেই নদী পার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নৌকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। গোটা বাহিনীকে অল্প সময়ের মধ্যে নদী পার করা সম্ভব ছিল কিন্তু সামরিক সাজ সরঞ্জাম ও রসদপত্র পার করাটা ছিল সময় সাপেক্ষ। কিন্তু বিশাল সামরিকবহর ও বিরাট বিরাট মিনজানিক ও উট ঘোড়র বিপুল সমাহার পার করাটা সহজ সাধ্য ছিল না। তবুও বিন কাসিম নির্দেশ দেন যতো কম সময়ে সম্ভব সব কিছু নিয়ে নদী পেরিয়ে যেতে হবে। বিশাল সৈন্যবহর সাজ সরঞ্জাম নিয়ে নদী পাড়ি দেয়াটা ছিল সে সময়কার একটি মহাকর্মযজ্ঞ। একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, রাজা দাহির সিন্ধু নদীর একটি জায়গায় নৌকা দিয়ে পুল বানিয়েছিল কিন্তু বিন কাসিমের
অগ্রাভিযান দেখে সে পুল রাজা দাহির ভেঙে ফেলে। এ পুল তৈরির ব্যাপারটি কতটুকু বাস্তব সে সম্পর্কে বিশদ জানা যায়নি। রাজা কাকা ও বিজয় রায় ভেবেছিল মুহাম্মদ বিন কাসিম যদি সিস্তান থেকে সিসিমের দিকে অগ্রসর হন, তাহলে রাস্তার মধ্যে তারা যখন যাত্রা বিরতি করবে তখন তারা রাতের অন্ধকারে গুপ্ত হামলা চালাবে। কাকা ধর্মীয় দিক থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও জাতিগতভাবে ছিল চেন্নাই বংশোদ্ভূত। তিনি সে দিনই নির্দেশ দিলেন, চিন্নাই জনগোষ্ঠী থেকে বাছাই করে এক হাজার সাহসী অশ্বারোহী ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী যুবককে আমার সামনে তিন দিনের মধ্যে হাজির করো। ঠিক তিন দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীর লোকেরা বাছাইকৃত এক হাজার যুবককে এনে রাজা কাকসার সামনে উপস্থিত করলো। তাদের সবাইকে সিসিম দুর্গে এনে সারিবদ্ধ করা হলো। রাজা কাকা জড়ো করা যুবকদেরকে বিজয় রায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, তুমি এদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুপ্ত হামলার জন্য তৈরি করে নাও। তুমি ওদের যতো তাড়াতাড়ি পারো ট্রেনিং দিয়ে তোমার মতো করে প্রস্তুত করো। সে দিন থেকেই এক হাজার চেন্নাই যুবককে ট্রেনিং দেয়া শুরু হলো। বিজয় রায় নিজে যুবকদের দুর্গের বাইরে নিয়ে কল্পিত মুসলিম শিবির তৈরি করে কিভাবে হামলা করতে হবে সে নির্দেশনা দিতো। বিন কাসিম নদী পার হওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ রশি তৈরি করিয়েছিলেন। রশির একমাথা এপাড়ের তীরবর্তী বৃক্ষরাজির সাথে বেধে দিয়ে নৌকা করে অপর মাথা ও পাড়ে নিয়ে গাছের সাথে বেধে দেয়া হলো। সাধারণ সৈনিকরা সেই রশি বেয়ে দ্রুত নদী পার হয়ে যাচ্ছিল। আর ভারী রশদপত্র নৌকায় বোঝাই করে অপর পাড়ে উঠানো হচ্ছিল। বিন কাসিম অশ্বারোহন করে গোটা এলাকা জুড়ে প্রদক্ষিণ করছিলেন আর সৈন্যদের দ্রুত কাজ করার জন্য বলছিলেন, ভাইয়েরা! তাড়াতাড়ি করো সময় বয়ে যাচ্ছে।’ বিন কাসিম সৈন্যদের বললেন, বন্ধুরা একটু ওপর দিকে তাকিয়ে দেখো, সূর্য হেলে পড়ছে, সময় দ্রুত তোমাদের আগে চলে যাচ্ছে, সময়কে তোমাদের পিছনে ফেলতে হবে। তরুণ সেনাপতির উদ্বিগ্ন তাড়া আর তার আবেগ ও উচ্ছাস দেখে অশ্বারোহী ইউনিট তাদের ঘোড়া গুলোকে নৌকা দিয়ে পার করার অপেক্ষা না করে সবাই নিজ নিজ ঘোড়া নদীতে নামিয়ে দিল। এভাবে অতি অল্প
সময়ের মধ্যে গোটা বাহিনী সব কিছু নিয়ে সিন্ধু নদী পেরিয়ে নদীর ওপারে চলে গেল।
সিস্তান থেকে সিসিম যাওয়ার পথে বিন কাসিম কয়টি জায়গায় এবং কোন কোন জায়গায় যাত্রা বিরতি করেছিলেন ইতিহাস তা উল্লেখ করেনি। শুধু এতটুকু জানা যায়, পথিমধ্যে তিনটি শত্রু দুর্গ ছিল সেগুলো তিনি অবরোধ করে দখলে নিয়েছিলেন এবং প্রতিটি দুর্গ দখল করতে আট দিন সময় লেগেছিল। এভাবে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সিস্তান থেকে সিসিম পর্যন্ত পৌছতে তার তিন মাস লেগে গিয়েছিল।
অবশেষে এক দিন বিন কাসিমের সেনাবাহিনী সিসিম থেকে অনতি দূরে বন্ধা নামক স্থানে পৌছে গেল। সেটিই ছিল সিসিমের আগে শেষ যাত্রা বিরতি। অন্যান্য যাত্রাবিরতির চেয়ে এখানে কিছুদিন বেশি থাকার সিদ্ধান্ত নেন বিন কাসিম। কারণ দীর্ঘ পথ এক নাগাড়ে অতিক্রম করা এবং পথিমধ্যে কয়েকটি জায়গায় যুদ্ধ করে সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কাজেই সিসিম অবরোধ করার আগে সেনাবাহিনীর কিছুটা বিশ্রাম ও প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল।
এদিকে সিসিম দুর্গে অবস্থানকারী বিজয় রায় ও রাজা কাকসার কাছে বিদ্যুৎগতিতে খবর পৌছে গেল যে, বন্ধা নামক স্থানে মুসলিম বাহিনী এসে গেছে এবং সেখানে তাঁবু গেড়েছে। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে বিজয় রায় চেন্নাই জনগোষ্ঠীর সেই এক হাজার যুবককে ডেকে পাঠালো। তাদের একত্রিত করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ করতে শুরু করল। বিজয় রায় চেন্নাই যুবকদের বলল, মুসলমানরা হিংস্র এরা দেশ দখল করে লুটপাট করে এবং যুবতী তরুণীদের ধরে নিয়ে যায় আর মানুষের ধন সম্পদ ঘর বাড়ি সব তছনছ করে দেয়। বিজয় রায় চেন্নাই যুবকদের বলল, সাধারণ মানুষ এবং দেশের নারীদের সম্ভ্রম ও ধন সম্পদ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা যদি সেই দায়িত্ব পালন না করি তাহলে সবার সাথে আমাদেরকেও মুসলিম বাহিনীর গোলামী করে অবমানোকর জীবনের মুখোমুখি হতে হবে। বস্তুত যে কোন অমুসলিম স্বজাতির মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যে ধরনের অসত্য ও কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করে বিজয় রায়ও চেন্নাই যুবকদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দেয়ার জন্য এসবের সবকিছুই প্রয়োগ করল।
এদিকে বন্ধা এলাকায় বসবাসকারী একটি অমুসলিম যাযাবর গোত্র মুসলিম সৈন্যদের আগমন দেখে তাদের ওপর রাতের অন্ধকারে গুপ্ত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলো। এদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা আক্রমণের আগে রাজা কাকাকে ব্যাপারটি অবহিত ও অনুমতির জন্য সিসিম দুর্গে একটি প্রতিনিধি দল পাঠালো। নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিকদের মতে, এই গোত্র ছিল জাট। জাট গোত্র ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতি খুবই অনুরাগী। এরা বিজয় রায় ও কাকসার অপপ্রচারে জানতে পারে, মুসলমান সৈন্যরা অমুসলিম এলাকা দখল করে সেখানে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় লুটপাট করে সব কিছু তছনছ করে দেয় এবং অধিবাসীদের জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। এই অপপ্রচারের কারণে নিজেদের জাতিধর্ম রক্ষায় জাট সম্প্রদায় দৃঢ় শপথ নিল এবং রাতের অন্ধকারে গেরিলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজার কাছে গেল। জাট গোত্রের প্রতিনিধিরা সিসিম দুর্গে গিয়ে রাজা কাকাকে তাদের উদ্দেশ্যের কথা জানালে সব চেয়ে বেশি খুশী হলো বিজয় রায়। বিজয় রায় মন্দিরের পুরোহিতদের ডেকে তাদেরকে বলল, শত্রু আক্রমণের জন্যে কোন্ সময়টা শুভ হবে তা যেন তারা বলে দেন। সেই সাথে বিজয় রায় পণ্ডিতদের কাছে জানতে চাইলো সাফল্যের জন্য কি কোন ধরনের বলিদানের প্রয়োজন হবে কি-না তাও জানাতে। পণ্ডিতরা বিজয় রায়ের নির্দেশ পালনে মন্দিরে চলে গেল এবং আক্রমণের শুভক্ষণ বের করার জন্য তপস্যা শুরু করে দিলো। জাট প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বিজয় রায় বলল, তোমরা যদি তাবুতেই মুসলিম বাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে পারো তাহলে আমরা তোমাদের রাজকীয় পুরস্কারে ভূষিত করব। তোমাদের কেউ যদি মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে জীবিত পাকড়াও করে আনতে পারো, তাকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করা হবে, রাজ দরবারে তাকে মর্যাদার আসন দেয়া হবে এবং মুসলিম সেনাপতির মাথার ওজন সমান সোনা উপঢৌকন দেয়া হবে। এই অঞ্চলের যে কোন তরুণীকে সে পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে দেয়া হবে। আর কেউ যদি বিন কাসিমের দ্বিখণ্ডিত মাথা আনতে পারে তাহলে তাকে মাথার দ্বিগুণ সোনা দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে এবং দেশের সেরা সুন্দরী নারীর সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। তোমরাই মোকাবেলা করবে না, এক হাজার ট্রেনিংপ্রাপ্ত চেন্নাই যুবক তোমাদের সঙ্গে থাকবে, বিজয় রায়ের কথার সাথে যোগ করল রাজা কাকা। তোমরা উভয় সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে আক্রমণ করবে।
মহারাজের জয় হোক ধ্বনি তুলল এক জাট প্রতিনিধি। আমরা কোন পুরস্কারের আশায় যুদ্ধ করতে উৎসাহী হইনি। আমরা ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছি এ জন্য যে, মহারাজা দাহিরের বাহিনী মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযান রুখতে পারেনি। আজ আমরা মুসলমানদের অগ্রাভিযানের ক্ষমতা নিঃশেষ করে দেবো। এরা আমাদের তরবারীর আঘাতে মরতে এসেছে। মহারাজ আমরা পুরস্কার চাই না, আমাদের কর্তব্য পালনে আপনার আশির্বাদ চাই।
পণ্ডিত মহারাজ শুভক্ষণ বলে দেবেন। যে রাতে তোমরা আক্রমণ করবে সে রাতে পণ্ডিতজী মন্দিরে ভজনা করবেন, যাতে তোমরা বিজয় লাভ করতে পারো। বলল বিজয় সেনরায়।
পরদিন সকালে মন্দিরের পুরোহিত এসে দু’দিন পরের রাতে আক্রমণের শুভক্ষণ বলে মত প্রকাশ করল। একথাও বলল যে, আক্রমণের সময় হবে অর্ধরাতের পর।
কোন বলিদান করতে হবে কি? জিজ্ঞেস করল বিজয় রায়।
“এক কুমারী। এক কুমারী বলিদান করতে হবে। আক্রমণে যাওয়ার আগে আক্রমণকারীদের পথে এক কুমারীর তাজা রক্ত ছিটিয়ে দিতে হবে; আর কুমারীর মাথা মানচার ঝিলে ডুবিয়ে রাখতে হবে, হামলাকারীরা আক্রমণে যাওয়ার আগে সেই ঝিল থেকে এক চুমু পানি পান করে যাবে।” বলল পণ্ডিত।
দিন শেষেই এলো শুভ রাত। রাতের আগেই আটশ জাট পুরুষ তরবারী, বর্শা, তীর, ধনুক নিয়ে সিসিম দুর্গে এসে জড়ো হলো। এদিকে চেন্নাই গোত্রের এক হাজার প্রশিক্ষিত যুবক তাদের সাথে যোগ দিলো। চেন্নাই যুবকদের সবাই ছিল অশ্বারোহী। জাটদের কেউ ছিল অশ্বারোহী আবার কেউ পদাতিক। জাট ও চেন্নাই গোত্রের আঠারোশ যোদ্ধাকে বিজয় রায় শেষ দিক নির্দেশনা দিচ্ছিল। বিজয় রায় যোদ্ধাদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ উস্কাতে শুরু করল। এ দিকে মন্দিরের পুরোহিত এক কুমারীর মাথা একটি বড় ধরনের তশতরিতে নিয়ে আরো কয়েকজন পণ্ডিতের সমবিহারে দুর্গে আগমন করল। বলিকৃত কুমারীর প্রবাহিত রক্ত একটি পাত্রে জমা করাছিল। আর পুরোহিতরা ভজন গাইতে ছিল এবং থেমে থেমে মন্দিরের ঘণ্টা বাজাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর এক পণ্ডিত বড় ধরনের তশতরিতে বলি দেয়া কুমারীর ছিন্নমস্তক নিয়ে গুপ্ত হামলাকারীদের সমাবেশে হাজির হলো। এদিকে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। চার পাশে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে অসংখ্য মশাল। যে পণ্ডিত কুমারীর ছিন্ন মস্তক নিয়ে এসেছিল তার দুপাশে দুজন দীর্ঘদেহী লোক মশাল উঁচিয়ে রেখেছিল, যাতে দূর থেকেও মশালের আলোয় ছিন্ন মস্তক সবাই দেখতে পারে। তার পিছনে ভজন গাইতেছিল চারজন পণ্ডিত। বিজয় রায় তশতরি নিয়ে আসতে দেখে পণ্ডিতের দিকে এগিয়ে তার কাছ থেকে তশতরি নিজ হাতে নিয়ে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে গুপ্ত হামলাকারীদের ছিন্নমস্তক দেখিয়ে বলল, এই কুমারীর ছিন্ন মস্তক ঝিলে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর এই তশতরি ঝিলের পাড়ে রেখে দেয়া হবে। তোমরা সবাই এই ঝিল থেকে এক ঢোক করে পানি পান করে যাবে। এরপর তোমরা যখন মুসলিম বাহিনীকে হত্যা করে কিংবা অধিকাংশ সৈন্যকে নিঃশেষ করে দিয়ে আসবে এবং যার হাতে মুসলিম সেনাপতি বিন কাসিমের ছিন্ন মস্তক থাকবে সেটি এনে এই তশতরিতে রেখে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে…। তোমাদের মনে রাখতে হবে, তোমাদের সাফল্যের জন্য এই কুমারী নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে। এই কুমারীর রক্ত তোমাদের গমন পথে ছিটিয়ে দেয়া হবে।
কুমারীর মস্তক বিচ্ছিন্নকারী পণ্ডিত এবার বিজয় রায়ের কাছ থেকে তশতরি নিয়ে দুর্গফটকের দিকে অগ্রসর হলো। তার পিছু পিছু আরো ক’জন পণ্ডিত ভজন গেয়ে গেয়ে এগুচ্ছিল। মন্দির থেকে ঘণ্টা ধ্বনি বাজছিল। দুর্গফটকের কাছেই ছিল ঝিলের অবস্থান। পণ্ডিত ঝিলের তীরে দাঁড়িয়ে কাটা মস্তকটি ঝিলের পানিতে ছুড়ে মারল। ছুড়ে মারা মাথাটি ঝিলের পানিতে আঁছড়ে পড়ার শব্দ চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল।
সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ায় দুর্গের প্রধান ফটক খুলে গেল। ফটক দিয়ে বেরুতে শুরু করল শত শত অশ্বারোহী ও পদাতিক লড়াকু। অশ্বারোহী ও পদাতিক হামলাকারীরাও পায়দল ঝিলে নেমে সবাই চিল্প দিয়ে এক ঢোক করে পানি পান করে এগিয়ে চলল। তাদেরকে বিদায় জানানোর জন্য বিজয় রায় ও রাজা কাকাও এসে একটি উচু স্থানে দাড়িয়ে হামলাকারীদের হাত নেড়ে বিদায় জানাল।
সেই যুগের মানদণ্ডে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও অমুসলিমদের মোকাবেলায় সে নিজেকে মুসলিম ঐতিহ্যের ধারকবাহক মনে করত। তিনি যতবার বিন কাসিমকে পয়গাম লিখতেন, সামরিক দিক নির্দেশনার পাশা পাশি লিখতেন, সব সময় তোমাদের সাফল্যের জন্য আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করবে। প্রত্যেক অভিযানের গমন পথে যদি কোথাও যাত্রা বিরতি করতে হয় তাহলে রাতের বেলায় সৈন্যদের সতর্ক রাখবে, জাগ্রত থাকতে বলবে। রাতে সৈন্যদের সতর্ক ও সচেতন রাখার ভালো ব্যবস্থা হলো, সৈন্যদের মধ্যে যারা কুরআন শরীফ পড়তে পারে তারা রাতের বেলায় তেলাওয়াত করবে এবং যারা কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে পারে না, তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দেবে। সবার উচিত বেশি বেশি নফল নামায পড়া এবং নামাযের পর আল্লাহ তাআলার কাছে সাফল্যের জন্য দোয়া করা। সেই সাথে লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বেশি বেশি পাঠ করবে।
সেই রাতের সিসিম থেকে কিছুটা দূরবর্তী যাত্রা বিরতির পর তাঁবু ফেলে বিন কাসিমের সৈন্যদের অধিকাংশই তেলাওয়াত করছিল, আর যারা কুরআন শরীফ পড়তে জানত না, তাদেরকে অন্যান্যরা কুরআন পড়া শেখাচ্ছিল। কেউ কেউ নফল নামাযে লিপ্ত ছিল। তাবুর ফাকে ফাকে জ্বলছিল মশাল। সকাল বেলায় সৈন্যদের সিসিমের দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। তারা আশা করছিল দুপুর নাগাদ তারা সিসিম দুর্গ অবরোধ সম্পন্ন করতে পারবে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন রাতের বেলায় কুরআন তেলাওয়াত, শিক্ষা ও ইবাদতের পাশা পাশি তারা যেন জরুরি বিশ্রাম করে কিন্তু সে রাতে কোন সৈনিকই বিশ্রাম ও আরামের জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দেয়নি। সকল সৈন্যই কুরআন পাঠ ও নামাযে রাত কাটিয়েছে। সেনাবাহিনীর কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা ও সৈনিকের স্ত্রী সন্তান তাদের সাথেই শিবিরে অবস্থান করছিল। তখনকার সময়ে প্রতিটি যুদ্ধেই কিছু সংখ্যক লোককে স্ত্রী সন্তান যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো। বিন কাসিমের সৈন্যদলেও কিছু সংখ্যক সৈন্য পরিবার পরিজন নিয়ে এসেছিল। সৈন্যদের সাথে আসা মহিলারা আহত সৈন্যদের সেবা শুশ্রুষা করত। সেই রাতেও রাত জেগে মহিলারা আহত সৈন্যদের দেখা শোনা করছিল।
আর এদিকে আঠারো’শ হিন্দু যোদ্ধা বিজয় রায়ের নির্দেশে রাতের অন্ধকারে গুপ্ত হামলা চালানোর জন্যে এগিয়ে আসছিল। সে দিন মুসলমানরা কোন মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। মুসলিম শিবিরের পাহারাদার ও
শিবিরের বাইরে টহলদল ছাড়া আর কোন সৈনিকের যুদ্ধ প্রস্তুতি ছিল না। রাতের অন্ধকারে শত্রু পক্ষের অজ্ঞাতে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে শত্রুদের পর্যস্ত করা ছিল মুসলমান সেনাদের ঐতিহ্য। কিন্তু আজ বিজয় রায় ও রাজা কাকসার তৈরি বাহিনী মুসলমানদের ওপর ঝটিকা আক্রমণের জন্যে অগ্রসর হচ্ছিল। অথচ এদিকে সেইরাতে ঝটিকা আক্রমণ হতে পারে এমনটি ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি মুসলিম শিবির। ফলে তারা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত, অসতর্ক। মুসলিম শিবিরে নারী শিশুদের অবস্থানের কারণে হিন্দু সেনাদের রাতের আক্রমণ আরো বেশি বিপর্যয়কর হয়ে ওঠতে পারত। পৌত্তলিক হিন্দু সৈন্যরা এক কুমারীকে বলি দিয়ে সেই কুমারীর রক্ত মাড়িয়ে অভিযানে বের হয়েছিল, তাদের সাফল্যের জন্য মন্দিরে চলছিল ভজন ও পূজা-অর্চনা। রাত ব্যাপী মন্দিরগুলোতে পুরোহিত পণ্ডিতেরা জড় মূর্তিগুলোর সামনে বসে সাফল্যের জন্য কাকুতি মিনতি করছিল।
আর এদিকে বিন কাসিমের সৈন্যরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য প্রাপ্তির জন্য ইবাদতে লিপ্ত ছিল। সেই রাতের ঝটিকা আক্রমণ সফল হলে বিন কাসিমের বাহিনীর অগ্রাভিযান শুধু সেখানেই রুদ্ধ হতো না, আরব সাগরের অথৈ পানিতে তাদের চিহ্নও হারিয়ে যেত।
সিসিম দুর্গ থেকে এক দুপুরের পথ দূরে বিন কাসিমের বাহিনী শিবির স্থাপন করেছিল। জায়গাটি ছিল তুলনামূলকভাবে নীচু। সেই সাথে এলাকাটি ছিল অসমতল। জায়গায় জায়গায় টিলা ঝোপ ঝাড় ও গাছ গাছালীতে আকীর্ণ। একটা জায়গায় এতোটা পানি হয়েছিল যেন বিশাল একটা পুকুর। বিন কাসিম সিসিমের যাতায়াত পথ থেকে অনেকটা দূরের এই স্থানে এসে শিবির স্থাপন করেন।
বিন কাসিমের অসাধারণ প্রজ্ঞার এটি একটি উদাহরণ ছিল যে, তিনি কখনো পরিচিত পথে অভিযান পরিচালনা করতেন না। সেই দিনের শিবিরটি তিনি এমন এক জায়গায় স্থাপন করেছিলেন, বিশাল আসবাবপত্র ও সাজ সরঞ্জামসহ গোটা বাহিনীকে সেই নীচু জায়গাটি আড়াল করে ফেলেছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে একথাও বলা যায় যে, রাজা কাকা ও বিজয় রায় মুসলিম বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েই ঝটিকা বাহিনীকে আক্রমণের জন্য পাঠিয়ে ছিল।
বিন কাসিমের রাতের শিবির ছিল কুরআন তেলাওয়াতে মুখরিত। মাঝে মধ্যে আহত সৈনিকদের উহ্ আহ্ তেলাওয়াতের গুঞ্জরনে তলিয়ে যেত। যখনই কোন আহত সৈনিক যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠত সেবারত মহিলারা দৌড়ে সেই সৈনিকের কাছে ছুটে যেত।
রাত বাড়ার সাথে সাথে এমন আশঙ্কা ছিল যে রাতের তেলাওয়াতের গুঞ্জরণ ও আহত সৈন্যদের যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠার সাথে হিন্দু আগ্রাসীদের আক্রমণের আর্তনাদ মিশে একাকসার হয়ে যাবে কিন্তু রাত গভীর হতে হতে এক সময় তেলাওয়াতের গুঞ্জরণ স্তিমিতি হয়ে নেমে এলো নিস্তব্ধতা। আর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে উচ্চ আওয়াজে ধ্বনিত হলো ফজরের আযান “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার”। আযানের মধুর ধ্বনি ইথারে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেল পৌত্তলিক ভারতের সিসিমের বাতাসে। ছড়িয়ে পড়ল বহু দূর পর্যন্ত।
মুসলিম শিবিরে ফজরের নামাযের জন্য সকল সৈন্যরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল। গোটা শিবিরে পিনপতন নীরবতা। সেনাপতি বিন কাসিমের কুরআন তেলাওয়াতের মধুর ধ্বনি যেন নির্জন এই এলাকার বৃক্ষ তরুলতাকেও এক অপার্থিব মুগ্ধতার আবেশে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। এদিকে সেনাবাহিনীর ঘোড়া ও ভারবাহী উটগুলো তখন খাবারের জন্যে হ্রেষাব করছে। সিসিমের প্রধান মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি তখনো অবিরাম বেজেই চলছে। ভোর হতেই বিজয় রায় ও রাজা কাকা দুর্গপ্রাচীরের ওপরে এসে দাঁড়াল। উভয়েই ঝটিকা আক্রমণকারীদের আগমন প্রত্যাশায় পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভোরের পূর্বাকাশ আলোকিত করে উঁকি দিলো দিবাকর। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল সকালের মিষ্টি রোদ। মরুভূমির সূর্যোদয়ের দৃশ্য খুবই মনোরম হয়ে থাকে কিন্তু সে দিনের সূর্যোদয় রাজা কাকা ও বিজয় রায়ের জন্য ছিল খুবই মলিন অসুন্দর। কারণ তারা ভোরের সূর্যালোক দেখা নয় অপেক্ষা করছিল বিজয়বার্তা নিয়ে অভিযানকারীদের ফিরে আসার দৃশ্য দেখার জন্যে।
সকালের সূর্য ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করল, বাড়তে থাকল উষ্ণতা। মুগ্ধতার পরিবর্তে বিজয় রায়ের মধ্যে দেখা দিলো উদ্বেগ অস্থিরতা। অপেক্ষার পালা দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিজয় রায়কে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে তুলল। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিজয় রায় বলল, কি ব্যাপার, ওরা কি সবাই মারা পড়ছে না কি? এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
আমি বলতে পারি কি হয়েছে? বলল কাকা। ওরা মুসলিমদের ধ্বংস করে ওদের ধন সম্পদ কব্জা করায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। আর তাদের নারীদের নিয়ে টানা হেঁচড়া করছে। এসে যাবে, হয়তো আসছে।
“আচ্ছা, তোমার কথাই যেন সত্যি হয়, দেখো কি করে আসে। আমার কাছে তো আলামত ভালো মনে হচ্ছে না।” বলল বিজয় রায়। এমন সময় পূর্ব দিকে ধূলিবালির আরবণ দেখা গেল। দেখতে দেখতে ধূলিময় অন্ধকার আরো ঘনিভূত হয়ে আকাশ ঢেকে ফেলল। কিছুক্ষণ পর ধূলিস্তর ভেদ করে নজরে পড়ল অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যদের আগমন। বিজয় রায় ও কাকা ঝটিকা বাহিনীর আগমন দেখে দুর্গপ্রাচীর থেকে দৌড়ে নীচে নেমে এলো। প্রধান ফটকেই তাদের ঘোড়া অপেক্ষমান ছিল, উভয়েই এক লাফে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ঝটিকা বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্যে ঘোড়া দৌড়াল।
তারা উভয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া হাকিয়ে ঝটিকা বাহিনীর সামনে গিয়ে থামল। তাদের প্রত্যাশানুযায়ী সেনারা বিজয়ের কোন জয় ধ্বনী করল না। ঝটিকা বাহিনীর কমান্ডারের চেহারা ছিল হতাশায় বিমর্ষ। আমি কোন ব্যর্থতার দাস্তান শুনবো না, ক্ষোভে কম্পমান কণ্ঠে বলল বিজয় রায়।
বিজয় রায়ের গর্জনে কমান্ডার দয়ার্দ্র দৃষ্টিতে তাকালো। মুখ ফুটে কিছু বলল না। বিজয় রায়ের আগমনে ঝটিকা বাহিনী পদাতিক ও অশ্বারোহী সবাই থেমে গেল। বিজয় রায় ঘোড়ার বাগ ধরে এক চক্কর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে সবার চেহারা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে নিলো, তাদের মধ্যে কাউকেই আহত হওয়ার মতো কোন চিহ্ন দেখা গেল না। চার পাশে চক্কর দিয়ে বিজয় রায় ফিরে এলো কমান্ডারের সামনে। কমান্ডারের সামনে এসে তার তরবারীর হাত ধরে এক টানে তরবারী কোষমুক্ত করল। রোদের আলোতে ঝলসে উঠল তরবারী। গভীরভাবে তরবারীটা একবার দেখে নিলো বিজয় রায়।
তরবারী তো তেমনই রয়ে গেছে যেমনটি নিয়ে গিয়ে ছিলে। তরবারী কোষমুক্তই করোনি? কি হয়েছে কথা বলছ না কেন? গর্জে উঠল বিজয় রায়।
মহারাজের জয় হোক’ বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলল কমান্ডার। আমরা মুসলিম শিবির পর্যন্ত পৌঁছতেই পারিনি।
কেন পৌছতে পারলে না? কোথায় গিয়ে মরে ছিলে তোমরা? না। কাপুরুষের মতো ভয়ে সেখানে যেতেই সাহস পাওনি?
মহারাজ আমাদের পথ প্রদর্শক হিসাবে যে দু’জন আমাদের সাথে পাঠিয়েছিলেন তারা আমাদেরকে মুসলিম শিবিরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে গেল যেখানে কোন কিছুই ছিল না। আমরা যখন ওদের জিজ্ঞেস করলাম, মুসলিম শিবির কোথায়? তখন তারা বলল দুঃখিত, আমাদের ভুল হয়ে গেছে আমরা পথ হারিয়ে অনেক দূরে এসে গেছি। এরপর ওরা আমাদেরকে নিয়ে অচেনা পথে ঘুরতে লাগল এভাবেই শেষ হয়ে গেল রাত আমরা আর মুসলিম শিবির পর্যন্ত পৌছতে পারলাম না। যখন ভোর হয়ে পূর্বাকাশে সূর্য উঁকি দিলো, তখন আর আমাদের ফিরে আসা ছাড়া গত্যন্তর রইলো না। কারণ দিনের বেলায় এতো বড় বাহিনীর মুখোমুখি হলে আমাদের অবস্থা কি হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কমান্ডারের তরবারীর বাট ছিল বিজয় রায়ের হাতে। রাগে ক্ষোভে আগ্নেয়গিরি মতো ফুসছিল সে। হঠাৎ ঝকমকে তরবারীটা প্রচণ্ড শক্তিতে ঘুরালো বিজয় রায়। কমান্ডারের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে গিয়ে পড়ল, আর শরীরটা গড়িয়ে পড়ল ঘোড়ার পিঠ থেকে। রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ল জমিন। হতভাগাটার মাথাটা ঝিলে ফেলে দাও। ওই শয়তান দুটা কোথায় যাদেরকে পথ দেখানোর জন্য তোমাদের সাথে দিয়েছিলাম? সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল বিজয় রায়।
আঠারো শত সৈন্যের মধ্যে তন্নতন্ন করে সবাইকে যাচাই করা হলো কিন্তু গাইড দু’জনকে এদের মধ্যে পাওয়া গেল না। কিন্তু এই সময়ে এরা এখান থেকেও পালিয়ে গেলে কেউ না কেউ দেখতো। অবশেষে ঝটিকা দলের ডেপুটি কমান্ডার জানালো, আমরা ফেরার পথে আর ওদের পাইনি, ওরা আমাদের ফিরে আসার সময় সবার অগোচরে পালিয়ে গেছে। কমান্ডারের বিচ্ছিন্ন দেহ থেকে ছিন্ন মাথা এক সিপাহী ঝিলের মধ্যে নিক্ষেপ করল। আর ঝিলের পাড়ে রাখা তশতরি খালিই পড়ে রইলো। সেটায় আর বিন কাসিমের মাথা রাখা সম্ভব হলো না।
সেই দুই গাইডকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বিজয় রায় ঘোষণা করল, ওদেরকে যেখানেই পাবে ওদের মাথা কেটে ঝিলে ফেলে দেবে আর ওদের দেহ পোড়ানোর বদলে জঙ্গলে ফেলে রাখবে।
আসলে ওদের দুজনের দেখা পাওয়ার সম্ভব ছিল না। তারা তখন সিসিম দুর্গের পরিবর্তে মুসলিম শিবিরে গিয়ে হাজির হয়েছে। তারা বিজয় রায়ের ক্ষোভের মুখে পড়ার পরিবর্তে মুসলিম শিবিরে পরম যত্নে আরাম করছিল।
এরা দুজন ছিল সেই দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা যাদেরকে দু’জন তরুণী ও একজন বয়স্কা মহিলা সঙ্গে করে বিন কাসিমের সিস্তান দুর্গে পাঠিয়েছিল বিজয় রায় ও কাকা গোয়েন্দা কাজের জন্য। তারা আশ্রয় প্রার্থী হিসাবে দুর্গে প্রবেশ করেছিল বটে কিন্তু গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী তাদের পাকড়াও করে তাদের দূরভিসন্ধি বের করে ফেলেছিলেন। গোয়েন্দা প্রধানের জেরার মুখে এরা স্বীকার করেছিল তারা যে গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য কৃষকের বেশে নাটক সাজিয়ে দুর্গে এসেছে। কিন্তু গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগ সত্ত্বেও সেনাপ্রধান বিন কাসিম তাদেরকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সেই রাতের শেষে ফজরের নামাযান্তে বিন কাসিম তার তাবুতে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন টহলরত সৈন্যরা এ দুই হিন্দু সৈন্যকে পাকড়াও করে নিয়ে এলো। তারা ধৃতদেরকে নিয়ে গেল গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীর কাছে। তারা জানালো, এরা আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চায়। প্রহরী সৈন্যরা আগেই তাদের তরবারী ও বর্শা ছিনিয়ে নিয়েছিল। শা’বান ছাকাফী তাদের দেখেই চিনে ফেললেন।
আবার এসেছ তোমরা? এখন আবার কোন মেয়েদের এনেছো? এখন আর তোমাদের জ্যান্ত ছেড়ে দেয়া হবে না। আগের বেলায় আমাদের প্রধান সেনাপতি দয়া পরবশ হয়ে তোমাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু এবার তেমনটি করতে দেয়া হবে না।
আমরা সেই উপকারের বদলা দিয়েছি। বলল ধৃতদের একজন। সেই সাথে আমরা এখন মরতে আসিনি, জেনে বুঝে জীবিত থাকার জন্য এবং আমৃত্যু আপনাদের সাথে থাকার জন্যই এসেছি।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসাবে শত্রু গোয়েন্দাদের কথায় নির্ভর করতে পারছিলেন না শা’বান ছাকাফী। কিন্তু এদের দাবী ও প্রস্তাবও উড়িয়ে দেয়ার মতো ছিল না। তারা জানালো, ফিরে গিয়ে তারা বিজয় রায় ও রাজা কাকাকে বলেছিল মুসলমানদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। তারা ফিরে গিয়ে শাসকদের যা বলেছিল এর সবই জানালো শাবান ছাকাফীকে। তাদের একজন বলল, এক পর্যায়ে আমরা বিজয় রায়কে বললাম, আমাদেরকে এমন কোন কাজের দায়িত্ব
দিন যাতে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। আমরা সেটি করে দেখিয়ে দেবো কিন্তু মুসলিম শিবিরে গিয়ে গোয়েন্দা গিরি করতে পারব না। কারণ আমরা সৈনিক, যুদ্ধ ময়দানে বীরত্ব দেখানোর কাজেই আমরা পারদর্শি। আমাদের ব্যর্থতার জন্য বিজয় রায় উভয়কে হত্যা করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু কথায় কথায় তার সিদ্ধান্ত বদলে গেল, রাতের অন্ধকারে মুসলিম শিবিরে চোরাগুপ্তা হামলার সিদ্ধান্ত নিলো সে। অবশ্য আমরাই তাকে অন্য কোন ভাবে মুসলিমদের মোকাবেলা করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। চোরা গুপ্তা আক্রমণ ছাড়া বিকল্প কোন কার্যকরপন্থা ছিল না।
আমরা বললাম, তাহলে আমরা মুসলিম সৈন্যদের খোঁজ রাখি। যেখানে তারা সর্বশেষ শিবির স্থাপন করে সেখানে রাতের অন্ধকারে আমাদের সৈন্যদের আমরা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে এবং ঘুমন্ত মুসলিমদের শেষ করে দেবো। তারা শা’বান ছাকাফীকে জানালো, এরপর আমরা বেশ বদল করে মুসলিম বাহিনীর আগমনের খোঁজ খবর নিতে বেরিয়ে পড়লাম, সেই সাথে বিজয় রায়ের বাহিনীকে ব্যর্থ করার পরিকল্পনা তৈরি করলাম। অবশেষে মুসলিম বাহিনীর সর্বশেষ শিবির দেখে সিসিমে ফিরে গেলাম। আমরা আপনাদের প্রধান সেনাপতির দূরদর্শীতার প্রশংসা না করে পারছি না। বলল অপর ব্যক্তি। আপনাদের সেনাপতি এমন রাস্তা দিয়ে সৈন্যদের নিয়ে এসেছেন যে পথে কোন জন মানুষের যাতায়াত নেই। দুর্গম ও অসমতল পথে আপনারা অগ্রসর হয়ে এমন এক জায়গায় শিবির স্থাপন করেছেন যে, কেউ চিন্তাও করতে পারেনি, এখানে এতো বিশাল একটা বাহিনী শিবির স্থাপন করতে পারে।
আমরা কাকতালীয়ভাবেই আপনাদের আগমন ও শিবির দেখে ফেলেছিলাম। নয়তো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আমাদের এই দিকে আসার কথা ছিল
আমরা ফিরে গিয়ে বিজয় রায়কে আপনাদের শিবির স্থাপনের কথা জানালাম। সেই সাথে আমরা এও প্রস্তাব করলাম, ঝটিকা হামলাকারী দলের মধ্যে আমাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করুন এবং ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের হাতে ছেড়ে দিন।
আমাদের উৎসাহ দেখে বিজয় রায় ঝটিকা বাহিনীকে রাতের বেলায় পথ দেখিয়ে মুসলিম শিবিরে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদের ওপর ন্যস্ত করল। আমরা ইচ্ছা করলে বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত আঠারশ গেরিলা সৈন্যকে সোজা আপনাদের শিবিরে নিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু আমরা আপনাদের
সেনাপতির দয়া ও আপনাদের ইবাদত দেথে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, শত্রু সৈন্যকে পাকড়াও করে জীবন্ত মুক্ত করে দেয়ার প্রতিদান দেবই বলে স্থির করলাম।
এ জন্য রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গেরিলা অভিযানে আসা সৈন্যদেরকে আমরা ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়ে দিকভ্রান্ত করে শিবির থেকে অনেক দূরে ঘুরাতে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে ওদের জানালাম, আমরা তো রাস্তা ভুলে অনেকটা সরে এসেছি। ফের ঠিক রাস্তায় আসার কথা বলে আবারো ওদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাত পার করে দিলাম। অবশেষে যখন পূর্বাকাশে আলো দেখা গেল, তখন তাদেরকে ফিরে আসার পথ দেখিয়ে বললাম, এখন তো রাত শেষ। আমাদের ফিরে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। দিনের আলোয় মুসলিম বাহিনী আমাদের দেখতে পেলে একজনকেও জীবন নিয়ে ফিরে যেতে দেবে না। একথা শুনে সবাই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আর ফেরার পথে হঠাৎ আমরা দু’জন দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সবার অলক্ষ্যে এদিকে রওয়ানা হলাম। আপনারা ভোরের ইবাদত শেষ করেছেন, আমরাও এখানে এসে পৌছেছি। আপনিই এখন আমাদের ভাগ্য নিয়ন্তা। ইচ্ছে করলে আপনি আমাদের হত্যা করতে পারেন কিন্তু আমরা ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছি তোমরা কি তোমাদের ধর্মের প্রতি এতোটাই ঘৃণা পোষণ করো? বললেন গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী।
আগে ঘৃণ করতাম না কিন্তু আপনাদের ইবাদত বন্দেগী আমাদের এতোটাই আকৃষ্ট করল যে, আমাদের ধর্মের প্রতি আমরা বীশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি। তাছাড়া নিজ ধর্মের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির আরেকটি কারণ হলো, গেরিলা বাহিনীর সাফল্যের জন্য সিসিম মন্দিরে একটি কুমারী বলি দান করে তার ছিন্ন মস্তক ঝিলে নিক্ষেপ করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী গোয়েন্দা দুজন শা’বান ছাকাফীর কাছে জানতে চাইলে আপনারাও কি এ ধরনের সাফল্যের জন্য নরবলী দিয়ে থাকেন? নরবলী দিয়েই তো আমরা এ পর্যন্ত এসেছি’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান। কিন্তু তোমাদের মতো আমরা কুমারী বলি দান করি না। আমরা বরং এ ধরনের কুমারী সে যে ধর্মেরই হোক তাদের সুভ্রম রক্ষার জন্য আমাদের জীবন কুরবানী করে দেই। অত্যাচার ও জুলুমের ভয়ানক অবস্থা দেখুন, বলল অপর গোয়েন্দা। গেরিলা বাহিনীর বিজয়ের জন্য যে কুমারীকে বলিদান করা হয়েছে, তার রক্ত
গেরিলা বাহিনীর গমন পথে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা জানতাম হিন্দু ধর্মে নরবলী দেয়ার রীতি আছে কিন্তু এর আগে নরবলী দানের ঘটনা আমরা কখনো প্রত্যক্ষ করিনি। আহা! সেই কুমারী মেয়েটির মা-বাবা আর ছোট দুটি ভাইকে মাটিতে পড়ে কান্নায় গড়াগড়ি করতে দেখেছি…। কি নির্মম হত্যা কাণ্ড। তাহলে আপনাদের ধর্মে এ ধরনের কাণ্ড ঘটে না? না, আমাদের ধর্মে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। আমরা আমাদের নবীর দেখানো পথে চলি। আমাদের পথে যদি কোন অহংকারী শাসক সামরিক শক্তির অহমিকায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমরা সেই ভ্রষ্টচারী অহংকারীর রক্ত প্রবাহিত করতে কুণ্ঠাবোধ করি না। বললেন শা’বান ছাকাফী।
গোয়েন্দা প্রধান পুনর্বার মুসলিম শিবিরে আসা সেই দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে বিন কাসিমের কাছে হাজির হলেন। তিনি তাকে সবিস্তারে ওদের বলা কাহিনী জানালেন। বললেন, গতরাতে আমাদের ওপর ভয়াবহ এক কেয়ামত ধেয়ে আসছিল, এরা দু’জন সেটিকে রুখে দেয়ার দাবী করছে।
এটা আল্লাহ তাআলার অপার মেহেরবানী, বললেন বিন কাসিম। চাচা হাজ্জাজ যে আমাদেরকে বারবার আল্লাহর দরবারে দোয়া করা, আল্লাহর মদদ কামনা করা এবং রাতের বেলায় ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকার কথা জোর দিয়ে বলছিলেন, এই বলা অর্থহীন নয়। রাতের বেলায় যেখানে সমগ্র বাহিনী ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত আল্লাহর সাহায্যের আশায় ক্রন্দরত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে সেখানে নরবলী দানকারী খোদাদ্রোহী আগ্রাসী বাহিনী এসে অন্ধ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
তিনি ধৃত গোয়েন্দাদের জিজ্ঞেস করলেন, সিসিমের রাজা কাকা আর কি কি পরিকল্পনা এঁটেছে?
আসলে সে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না, বলল এক গোয়েন্দা। বিজয় রায়ের প্ররোচনায় সে যুদ্ধ করতে রাজী হয়ে যায়। আপনি যদি আমাদের কথা বিশ্বাস করেন, তাহলে কাকসার কাছে দূত পাঠিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব করতে পারেন। ‘বিজয় রায় সমঝোতা করতে রাজি হবে না,’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান।
সে না মানলেও কিছু যায় আসে না। কারণ এখন আর তার হাতে কোন সৈন্য নেই। সে তো এই দুর্গে আশ্রয় প্রার্থী। বলল অপর গোয়েন্দা।
ওদের সাথে সামরিক কলা কৌশল নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না বিন কাসিম। কারণ সামরিক কলা কৌশল নিয়ে ওদের সাথে আলোচনা করা তিনি যৌক্তিক মনে করেননি। গোয়েন্দা প্রধানকে ইঙ্গিতে কাছে ডেকে বিন কাসিম বললেন, এদের সম্মানের সাথে থাকা খাওয়া এবং ভালো কাপড় চোপড় পরিধানের ব্যবস্থা করে দিন।
মহামান্য সেনাপতি আমাদেরকে আপনার ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ দিন। এর চেয়ে আমাদের জন্যে আর সম্মানের জিনিস কি হতে পারে। বললো এক গোয়েন্দা। আপনি অনুমতি দিলে আমরা মুসলমান হিসাবে আপনার সেনাদলে যোগদান করতে আগ্রহী। অতঃপর উভয়েই কালেমা পড়ে বিন কাসিমের হাতে হাত রেখে ইসলামে দীক্ষা নিলো। বিন কাসিম এদেরকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
রাতেই বিন কাসিম সৈন্যদেরকে সকাল বেলায় অগ্রাভিযানের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। ফলে সকাল বেলায় অভিযান শুরু করার জন্যে সবাই প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এদিকে যে সিসিমের অবস্থা ভিন্ন এ সম্পর্কে মোটেও কোন তথ্য জানা ছিল না বিন কাসিমের। নওমুসলিম গোয়েন্দার কাছ থেকে শুনে সকাল বেলা চারজন নিরাপত্তারক্ষীসহ গোয়েন্দা ও দূতিয়ালীতে পারদর্শী খুবই মেধাবী ও উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন বাকপটু যোদ্ধা নাবাহ বিন হানযালাকে অগ্রবর্তী দূত হিসাবে সিসিম দুর্গের রাজা কাকসার কাছে পয়গাম দিয়ে পাঠালেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেদিলেন, সিসিমের রাজা কাকাকে বলবে, সে যেন বিনা রক্তপাতে দুর্গ আমাদের হাতে তুলে দেয় এবং আমাদের আনুগত্য স্বীকার করে। তাহলে স্বপদে তাকে বহাল রাখা হবে এবং তার ও দুর্গের সকল অধিবাসীর জীবন ও সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব থাকবে আমাদের ওপর। বিন কাসিমের পয়গাম ও দিক নির্দেশনা নিয়ে দূত নাবাহ বিন হানযালা সৈন্যদের আগে দ্রুতগতিতে রওয়ানা হলেন।
এদিকে সিসিম দুর্গে বিজয় রায় ও রাজা কাকসার মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিলো। ঝটিকা বাহিনীর পরাজয় আমার কাছে মনে হচ্ছে অশুভ সংকেত, বিজয় রায়ের উদ্দেশ্যে বলল রাজা কাকা। এতে পরিষ্কার বোঝ
যাচ্ছে, আমরা যদি মুসলিম সৈন্যদের অবরোধ ভাঙতে চেষ্টা করি তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। ‘কাপুরুষ হয়ো না কাকা বলল বিজয় রায়। অবরোধ তো এখনো হয়নি। আমি দাহিরের কাছে পয়গাম পাঠিয়ে আরো সৈন্য নিয়ে আসবো। তোমার কাছেও তো সৈন্য রয়েছে। তাছাড়া আমার প্রশিক্ষিণপ্রাপ্ত আঠারশ সৈন্য তো রয়েই গেছে। এদেরকে আমরা আগেই দুর্গের বাইরে পাঠিয়ে দেবো। মুসলমানরা অবরোধ করলে এরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবে।
বিজয় রায়! রাজা দাহিরের ভাতিজা হওয়া ছাড়া তোমার আর কি গুণ আছে, বলো? সিস্তানে তোমার সৈন্যের অভাব ছিল? তুমি যদি এতোই যুদ্ধ পারদর্শী হতে তাহলে সেখান থেকে পালিয়ে আসলে কেন? বলল কাকা। আমি যা বলছি, তা বোঝার চেষ্টা করো। আমি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। বৌদ্ধ ধর্মে এ ধরনের খুনোখুনির অনুমতি নেই। কোন মানুষের জীবনহরণ করাকে আমার ধর্ম মোটেও অনুমোদন দেয় না। অথচ তোমরা আমার সামনে একটি অবলা কিশোরীকে হত্যা করে তার মস্তক ঝিলে ফেলে দিয়েছ। তাতে কি লাভ হয়েছে….? হতাশা আর ব্যর্থতা ছাড়া কি পেয়েছে….? এই নিরপরাধ কুমারীর প্রেতাত্মা এখন আমাদের ওপর গযব হয়ে দেখা দেবে। তোমাদের কৃত অপরাধের কারণে আমার জনগণের ওপর গযব ধেয়ে আসছে। আমি অপরাধের কাফফারা আদায় করবো। আমার চোখের সামনে আর একটি মানুষেরও রক্ত প্রবাহিত হতে আমি দেবো না।
“তার মানে কি তুমি আমাকে মুসলিম সৈন্যদের হাতে তুলে দিতে চাও?” উক্তষ্ঠিত সুরে বলল বিজয় রায়। আসলে এটাই করা উচিত হতো। যে তশতরিতে কুমারীর মাথা রেখে সেটিতে বিন কাসিমের ছিন্ন মাথা দেখতে চেয়েছিলে তুমি, সেটিতে তোমার ছিন্ন মস্তক রাখাই ছিল উচিত কাজ। কিন্তু আমি তোমার সাথে গাদ্দারী করব না।
একটাই উপায়, তুমি আমার এই দুর্গ থেকে বেরিয়ে যাও।” কাকসার হুমকিতে ভড়কে গেল বিজয় রায়। একান্ত অনুগত কয়েকজন নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়া এখানে তার কোন সৈন্য সামন্ত নেই। রাজা কাকসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সে মুসলমানদের মোকাবেলা করা তো দূরে থাক নিজের অস্তিত্বই টেকাতে পারবে না। চরম অহংকারী ও তেজস্বী বিজয় রায় নিজের অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল। সে বুঝতে পারল, ঝটিকা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে কাকা যতোটুকু মোকাবেলার জন্য
প্ররোচিত হয়েছিল ততটুকুই এখন মোকাবেলা না করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় তার দুর্গে অবস্থান করা হবে আত্মঘাতি। ফলে কাকসার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে একান্ত ক’জন অনুচর ও পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্গ ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়ে পড়ল সে। বিজয় রায়কে বিদায় করে রাজা কাকা দুর্গপ্রাচীরে উঠে বিন কাসিমের সৈন্যদের সম্ভাব্য আগমন পথের দিকে দৃষ্টি মেললো। অনেক দূরে নজরে পড়লো ধূলি ঝড়ের মতো। হয়তো বা এটাই হবে মুসলিম বাহিনীর আগমনী বার্তা। সে দুর্গপ্রাচীরের ওপর পায়চারী করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর অনেক দূরে পাঁচজন অশ্বারোহীকে দুর্গের দিকে আগোয়ান দেখতে পেল। বিষয়টা অনুমানের জন্যে দুর্গপ্রাচীরেই পায়চারী করতে লাগল রাজা কাকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই অশ্বারোহী পাঁচজন এসে দুর্গফটকের কাছে থামল। রাজা দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে দেখলো তাদের পোশাক পরিচ্ছদ সম্পূর্ণ অপরিচিত। কাকসার বুঝতে অসুবিধা হলো না এরাই আরব সৈন্য। দুর্গরক্ষী কমান্ডার আগন্তুকদের কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে রাজা কাকা জিজ্ঞেস করল, এরা কে? কোথেকে এসেছে? নাবাহ বিন হানযালার এক সহযোদ্ধা এখানকার ভাষা জানতো, সে তাকে বুঝিয়ে দিলো, দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে এরা কি জিজ্ঞেস করছে?
আমি আরব সেনা প্রধান মুহাম্মদ বিন কাসিমের পক্ষ থেকে মৈত্রীর পয়গাম নিয়ে এসেছি। মানুষের হাতে মানুষের রক্ত প্রবাহিত হওয়াকে আপনিও হয়তো পছন্দ করবেন না। এর আগে একটি নিরপরাধ তরুণীকে হত্যা করে আপনাদের কি লাভ হয়েছে?
রাজা কাকা তো আগে থেকেই সমঝোতা ও মৈত্রীর জন্য উদগ্রীব ছিল। সে ভাবছিল কি করে কার মাধ্যমে বিন কাসিমের কাছে প্রস্তাব পাঠাবে। তা ছাড়া বিন কাসিম মৈত্রী প্রস্তাব গ্রহণ করেন কি না, করলে কি কি শর্তারোপ করতে পারেন, ইত্যাকার নানা শঙ্কা ও সম্ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে কাকা দৌড়ে দুর্গপ্রাচীর থেকে নিচে নেমে ফটক খুলিয়ে বাইরে এলো এবং হাসি মুখেই নাবাহ বিন হানজালাকে স্বাগত জানালো। কাকা বলল
“আমি যদি আপনাদের সৈন্যদের জন্য দুর্গফটক খুলে দেই তাহলে আমাদের সাথে আপনাদের সম্পর্কের পর্যায়টি কেমন হবে?” কি হবে আপনাদের শর্তাদি? বিন কাসিম তাকে যেসব শর্তাবলির কথা বলে
দিয়েছিলেন, নাবাহা কাকসার কাছে ব্যক্ত করলেন। কাকা তো শর্তাদির কথা শুনে হতবাক। সে বিনা বাক্য ব্যয়ে সব শর্ত মেনে নিলো। কাকা বিশ্বাসই করতে পারছিল না, কোন বিজয়ী শক্তি এ ধরনের নমনীয় শর্তাদি আরোপ করতে পারে। আমাদের সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাতের জন্য আপনি কি আমার সাথে যেতে রাজী হবেন? কাকসার মনোভাব জানতে চাইলেন নাবাহ। তিনি আরো বললেন, ওহ! আমি একটি শর্তের কথা এখনো আপনাকে বলিনি, পরিবার পরিজনসহ বিজয় রায়কে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে, এ ব্যাপারে অন্যথা করা চলবে না।
বন্ধু, আপনার পৌছতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বিজয় রায় আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমাকে প্ররোচিত করছিল। কিন্তু আমি তার কথায় সম্মত হচ্ছিলাম না। যুদ্ধ না করার ব্যাপারে আমার অনড় অবস্থান দেখে আপনাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে সে দুর্গ ছেড়ে চলে গেছে…। আচ্ছা, আমি আপনার সাথে সম্মানিত সেনাপতির সাথে সাক্ষাতের জন্য যেতে প্রস্তুত। চলুন।
কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকটি উট বোঝাই করে মূল্যবান উপঢৌকন ও উপহার সামগ্রী নিয়ে রাজা কাকা বিন কাসিমের সাথে সাক্ষাতের জন্য রওয়ানা হলো।
এদিকে বিন কাসিম তার সেনাবাহিনী নিয়ে দুর্গের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পথিমধ্যেই তার সাথে রাজা কাকসার সাক্ষাত হলো। কাকা বিন কাসিমের আনুগত্য স্বীকার করে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিলো। বিন কাসিম তাকে আশ্বস্ত করলেন, আপনি প্রতিশ্রুতি পালন করলে শুধু আপনি ও আপনার পরিবার পরিজন নয়, আপনার সকল প্রজাদের জীবন সম্পদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে আমাদের কর্তব্য। কিছুক্ষণ পর বিন কাসিম রাজা কাকসার সাথে সিসিম দুর্গে প্রবেশ করলেন।
দুর্গে প্রবেশ করে কাকসার কাছে বিন কাসিম জানতে চাইলেন, এ অঞ্চলে যদি কাউকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয় তবে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়? এখানে কুরসীকে সবচেয়ে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হয়। বলল রাজা কাকা। যাকে সম্মানিত করা হয় তাকে কুরসীতে বসিয়ে তার মাথায় একটি রেশমী কাপড় দেয়া হয়।
বিন কাসিম একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেখানে তার পাশে রাজা কাকাকে একটি কুরসীতে বসিয়ে তার মাথায় একটি মূল্যবান রেশমী কাপড় পেঁচিয়ে দিলেন। বিজয়ী শক্তির বশ্যতা ও আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার পরও বিজিত রাজাকে অপমানিত না করে তাকে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদায় অভিষিক্ত করার ঘটনায় দুর্গের অধিবাসীরা মুসলমানদের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করল এবং মুসলমানদেরকে শত্রু সৈন্যের বদলে মঙ্গলকামী ভাবতে লাগল।
সিসিম দুর্গ জয়ের ব্যাপারে ইতিহাসে দু’ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। একজন লিখেছেন, রাজা কাকসার বিজয় রায়ের সাথে বিরোধের পর বিজয় রায়কে দুর্গে রেখেই মৈত্রী প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বিন কাসিমের সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে চলে গিয়েছিল। পথিমধ্যে সে বিন কাসিমের সাথে মিলিত হয়ে পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করে নেয় এবং তার সৈন্যদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। এরপর বিন কাসিম এসে দুর্গ অবরোধ করেন। বিজয় রায়ের সাথে দুদিন মোকাবেলা হয় এক পর্যায়ে বিজয় রায় নিহত হয় আর বিজয়ীবেশে বিন কাসিম দুর্গে প্রবেশ করেন। অপর এক ঐতিহাসিক লিখেছেন, বিজয় রায় সিসিম দুর্গ থেকে দলবল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা পশ্চাদ্ধাবন করে তাকে হত্যা করেছিল। মোদ্দা কথা হলো, বিন কাসিমের সিসিম দুর্গ অভিযানকালে বিজয় রায় নিহত হয়েছিল।
অপর একটি বর্ণনা এমনও রয়েছে যে, রাজা কাকা সংঘর্ষ পরিহার করে স্বেচ্ছায় বিন কাসিমের আনুগত্য মেনে নিয়েছিল কিন্তু আশেপাশের কিছু লোক আনুগত্য মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তারা কাকসার বিরুদ্ধে গিয়ে বিন কাসিমের প্রতিরোধে উদ্যত হয়। এসব বিদ্রোহের উস্কানীদাতা ছিল সিসিম দুর্গ থেকে পালিয়ে যাওয়া বিজয় রায়। রাজা কাকা তার নিজস্ব লোক পাঠিয়ে বিদ্রোহকারীদের বোঝাতে চেষ্টা করল কিন্তু বিদ্রোহীরা সমঝোতা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শক্তি সঞ্চয় ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম জোরদার করতে লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত রাজা কাকা বিন কাসিমকে বলতে বাধ্য হলো, আপনি বিদ্রোহ দমনে যা ভালো মনে করেন করুন, তাতে আমার কোনই আপত্তি থাকবে না। বিন কাসিম ডেপুটি সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন কায়সকে কিছু সৈন্য দিয়ে নির্দেশ দিলেন, তুমি বিদ্রোহীদের ঘর বাড়ি ভেঙে দেবে এবং তাদের ধরে ধরে হত্যা করবে এবং তাদের দমনে যা জরুরি মনে করো তাই করবে।
এদিকে বিদ্রোহীরা তখন স্বীয় জাতির লোকজনের ঘরবাড়িতেও লুটতরাজ শুরু করে এবং মুসলিম বাহিনীর বিচ্ছিন্ন সেনা চৌকিগুলোতে গেরিলা আক্রমণ শুরু করে।
আব্দুল্লাহ বিন কায়স বিন কাসিমের নির্দেশ মতো বিদ্রোহীদের দমনে ওদের বাড়ি ঘরে আক্রমণ চালালেন। কোন কোন জায়গায় বিদ্রোহীদের সাথে প্রচণ্ড লড়াই হলো। এ ধরনের একটি তীব্র লড়াইয়ের পর বিদ্রোহীরা যখন বিপুল পরিমাণ সহযোদ্ধার লাশ ফেলে পালাতে বাধ্য হলো, তখন আটককৃতদের মধ্যে কয়েকজন বলল, আজকের লড়াইয়ে বিজয় রায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল, মনে হয় সে এবং অনুগত কয়েকজন কমান্ডারও নিহত হয়েছে। পরে মৃতদেহ তল্লাশী করে বিজয় রায়ের মরদেহ পাওয়া গেল। বিজয় রায়ের মত্য এবং আব্দুল্লাহ বিন কায়সের দুর্দান্ত দমন অভিযানে বিদ্রোহীরা রণে ভঙ্গ দিলো এবং সম্পূর্ণ বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রনে এসে গেল।
বিদ্রোহীদের বিভিন্ন আস্তানা থেকে মূল্যবান আসবাবপত্র ও ধনদৌলত, গণীমত হিসাবে মুসলিম সেনাদের হস্তগত হলো। বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ রৌপ্য কাপড় এবং আহার সামগ্রী পাওয়া গেল। গ্রেফতারকৃতরা জানালো, বিদ্রোহীদের উজ্জীবিত রাখার জন্যে অল্প সময়ের মধ্যে বিত্তশালীদের কাছ থেকে বিজয় রায় বিপুল সম্পদ কুক্ষিগত করেছিল। সময় মতো বিন কাসিম যদি বিদ্রোহ দমনে কঠোর পদক্ষেপ না নিতেন, তাহলে বিদ্রোহীরা বিন কাসিমের জন্য ভয়ানক দুর্ভাবনার কারণ হয়ে উঠত। অতঃপর বিভিন্ন বিদ্রোহী গোত্রের গোত্রপতিরা বিন কাসিমের দরবারে সাধারণ ক্ষমার আবেদন করল। প্রত্যেক গোত্রপতিদের বাৎসরিক এক হাজার দিরহাম জিজিয়া দেয়ার শর্তে বিন কাসিম তাদের ক্ষমা করলেন। গোত্রপতিরাও এই শর্ত মেনে নিয়ে আনুগত্যের অঙ্গীকার করল। অনেক গোত্রপতি তো বিশ্বাসই করতে পারছিল না এমন পরাক্রমশালী বিজয়ী বাহিনীর সেনাপতি এতোটা নমনীয় শর্তে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে পারেন।
এদিকে বিদ্রোহীদের থেকে প্রাপ্ত গণীমতের সম্পদ থেকে বায়তুলমাল তথা সরকারের প্রাপ্য অংশ আলাদা করে বসরায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে মুহাম্মদ বিন কাসিম হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে সিসিম দুর্গ বিজয় এবং বিদ্রোহ দমনের ঘটনা বিস্তারিত লিখলেন। সিসিম দুর্গে তিনি দুজন শাসক নিযুক্ত করলেন, প্রধান শাসকের দায়িত্ব পেলেন বিদ্রোহ দমনকারী ডিপুটি সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন কায়স আর তার সহকারী হলেন হুমাইদ বিন বিদায়।
পরবর্তী অভিযানের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা করছিলেন বিন কাসিম। এরই মধ্যে বসরা থেকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পয়গাম এলো। পয়গামের শুরুতে বোধী অঞ্চলের বিদ্রোহ দমনের প্রশংসা করা হয়েছে। অতঃপর হাজ্জাজ পয়গামে নির্দেশ দিলেন, অগ্রাভিযান মূলতবি করে এখন পুনরায় নিরূন দুর্গে প্রত্যাবর্তন করো। সৈন্যদের কয়েক দিন বিশ্রাম দাও, আর এর মধ্যে জনবল ঘাটতি পূরণ করে নাও। প্রয়োজনীয় সামরিক আসবাবপত্রের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে দাহিরের উদ্দেশ্যে অভিযানে নামো।
খোলা ময়দানে নেমে আসতে ওকে প্ররোচিত করো। ওর বাহিনীকে এভাবে নাকানী চোবানী খাওয়াবে যে, শেষ পর্যন্ত দাহির তোমার পায়ের তলায় এসে পড়ে। রাজা দাহিরকে পরাস্ত করার পর তোমাদের জন্যে গোটা হিন্দুস্তানের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এরপর তোমাদের মোকাবেলায় আর কেউ টিকেত পারবে না। তবে সব সময় নফল নামায ও আল্লাহর মদদের জন্য দোয়া করতে ক্রটি করবে না। ইবাদত, তেলাওয়াত ও দোয়ার কার্যকারিতা তো ইতোমধ্যেই তোমরা উপলব্ধি করছ। তাই বেশি বেশি আল্লাহর সাহায্য কামনা করবে। আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের মদদ করবেন ইনশাআল্লাহ।
হাজ্জাজের পয়গাম পাওয়ার পর কাল, বিলম্ব না করে সিসিম দুর্গের দায়িত্ব দুই প্রশাসককে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি সৈন্যদের নিরূন প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দিলেন। সিসিম দুর্গের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কিছু সংখ্যক সৈন্য সেখানে রেখে বাকীদের সাথে নিলেন। পথিমধ্যে সিস্তান দুর্গে যাত্রা বিরতি করলেন বিন কাসিম। বিন কাসিম সিস্তান দুর্গ থেকে রওয়ানা হবেন ঠিক এই মুহূর্তে চেন্নাই গোত্রের কিছু লোক তার সাথে সাক্ষাত করতে এলো। তারা বিন কাসিমকে জানালো, রাজা কাকা ও বিজয় রায়ের পাঠানো দুই গোয়েন্দা যারা এখন ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেছে, তারা স্বগোত্রের সরদারদের গিয়ে বলেছে, মুসলমানরা আসলে কেমন, ইসলাম কি এবং ইসলাম গ্রহণ করলে দুনিয়া ও পরকালে কি কি পুরস্কার ও শান্তি লাভ করা যাবে। এরা দু’জন যেখানেই যেত, মুসলিম সৈন্যদের পরোপকার, তাদের সৎ চরিত্র, জনকল্যাণ ও মানব হিতৈষীর কথা প্রচার করত।
অবশ্য চেন্নাই গোত্রের লোকেরাও দেখতে পেয়েছিল, বিজিত এলাকায় মুসলমানরা সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার জুলুম তো দূরে থাক তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করে দিতে
কুণ্ঠাবোধ করে না। তারা স্বগোত্রের দুই নও মুসলিমের মুখে মুসলিম সেনাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা ও সৎ চরিত্রের কথা শুনে বহুলোক সদল বলে সিস্তান দুর্গে এসে বিন কাসিমের কাছে তাদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দেয়ার আবেদন জানালো।
চেন্নাই গোত্রের লোকেরা বিন কাসিমের জন্য বহু মূল্যবান উপঢৌকনও নিয়ে এলো। বিন কাসিম তাদেরকে ইসলামে দীক্ষা দিলেন। সবাই কালেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেল। তখন প্রায় দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। সৈন্যরা খাবার আয়োজন করল। বিন কাসিম সবাইকে খাবারে আহবান জানালেন।
আহার শেষে বিন কাসিম চেন্নাই গোত্রের লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, এই গোত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে অবারিত রিযিকের দ্বারা স্নাত হবে। তারা যেখানেই থাকুক রিযিকের ঘাটতির সম্মুখীন হবে না। এরা আরযুক। তখন থেকেই দেখা যায় চেন্নাই গোত্রের লোকেরা সত্যিকার অর্থেই রিযিকের অভাব বোধ করে না।
অতঃপর বিন কাসিম নিরূনের পথে রওয়ানা হলেন।