যে তরুণ ভল্লা–জোয়ানটিকে তিনকড়ি ঠেঙাইয়াছিল, সে গত রাত্রিতে গ্রামে অনুপস্থিত ভল্লাদের একজন। রাত্রির অন্ধকারে আলপথে কালো কালো ছায়ামূর্তির মত যাহারা ফিরিয়াছিল–তাহাদের মধ্যে ছিদামও ছিল। ওই ছেলেটা যে উহাদের সঙ্গে জুটিতে পারে—এ ধারণা তিনকড়ির ছিল না। রাম ভল্লা প্রৌঢ় হইয়াছে, এ অঞ্চলে তাহার মত শক্তিশালী লাঠিয়াল, ক্ষিপ্রগামী পুরুষ নাই। একবার সে সন্ধ্যায় শহর হইতে রওনা হইয়া এখানে আসিয়া মধ্যরাত্রে ডাকাতি করিয়াছিল এবং অবশিষ্ট ঘণ্টাচারেক সময়ের মধ্যে গিয়া হাজির হইয়াছিল সদর শহরে। সে জীবনে বারতিনেক জেল খাঁটিয়াছে। তারিণী, বৃন্দাবন, গোবিন্দ, রঙলাল ইহারাও কম যায় না। সকলেই রামের যৌবনের সহচর। এখনও প্রৌঢ়ত্ব সত্ত্বেও তাহারা বাঘ। তাদের সঙ্গে ওই ছোঁড়াটা জুটিয়াছিল জানিয়া তিনকড়ির বিস্ময় ও ক্রোধের আর সীমা ছিল না। হিল্হিলে লম্বা–কচি চেহারার ছেলেটা দু বছর আগেও মনসা ভাসানের দলে বেহুলা সাজিয়া গান গাহিত—
কাক ভাই, বেউলার সম্বাদ লইয়া যাও।
দুই বৎসরের মধ্যে সেই ছেলের এমন পরিবর্তন। বাল্যকালে ছোঁড়ার বাপ মরিয়াছিল, মা তাহাকে বহু কষ্টেই মানুষ করিয়াছে। সে সময় তিনকড়িই ছেড়াকে গাঁইটে গরুর পাল করিয়া দিয়াছিল। গাইটে-পালের কাজটা হইল দশ-বার ঘরের ভাগের রাখালের কাজ। সকলের গরু লইয়া ছোঁড়া মাঠে চরাইয়া আনিত, প্রত্যেক গরু পিছু বেতন পাইত মাসিক দুপয়সা। দশ-বার ঘরে ত্রিশ-চল্লিশটা গরু চরাইয়া মাসে এক টাকা, পাঁচ সিকা নগদ উপার্জন হইত। এ ছাড়া পাইত প্রতিঘরে দৈনিক মুড়ির বদলে একপোয়া চাল; পূজায় প্রতিঘরে একখানা কাপড়। সেই ছিদামের এই পরিণতি দেখিয়া সে ক্ষেপিয়া গিয়াছিল। কিন্তু রাত্রে তিনব ড় ছিদামকে ধরিতে পারে নাই। তিনকড়ির সাড়া পাইবামাত্র সে সেই রাত্রেই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ছুটিয়া। পলাইয়াছিল। …
রাম এবং অন্য সকলের সঙ্গে রাত্রেই তার একচোট বচা হইয়া গিয়াছে। বচসা বলিলে ভুল হইবে। বকিয়াছে সে নিজেই। হাজার ধিক্কার দিয়া বলিয়াছে—ছি! ছিঃ ছি! এত সাজাতেও তোদের চেতন হল না রে? রাম, এই সেদিন তুই খালাস পেয়েছি, বোধহয় গত বছর কার্তিক মাসে,আর এ হল শ্রাবণ মাস; এরই মধ্যে আবার? রামা, কি বলব তোকে ব? ছিঃ ছিঃ ছি!
রাম মাথা চুলকাইয়া হাসিয়া বলিয়াছিল—ওঃ, বড় লেগেছে মোড়ল। বস-বস। ওরে, তেরে, আন্ একটা বোতল বার করে আন।
–না–না-না। তোদের যদি আর আমি মুখ দেখি, তবে আমাকে দিব্যি রইল! … তিনকড়ি সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির দিকে ফিরিয়াছিল।
—মোড়ল, যেয়ো না, শোন। ও মোড়ল!
–না, না।
–না নয়, শোন! মোড়ল, ফিরলে না? বেশ, তা হলে তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ শেষ।
এবার তিনকড়ি না ফিরিয়া পারে নাই। অত্যন্ত রাগের সঙ্গেই ফিরিয়া আসিয়া বলিয়াছিল কি বলছিস শুনি? বলি, বলবি কি? বলবার আছে কি তোর?
রাম বলিয়াছিল—তোমার সর্বস্ব তো জমিদারের সঙ্গে মামলা করে ঘুচাইছ। এখন কার দোরে যাই—কি খাই বল দেখি?
—মরে যা, মরে যা, তোরা মরে যা।
–তার চেয়ে জ্যাল খাটা ভাল। রামের উচ্চকণ্ঠের হাসিতে দুর্যোগের অন্ধকার রাত্রি শিহরিয়া উঠিয়াছিল।
—তাই বলে ডাকাতি করবি!
রাম আবার খানিকটা হাসিয়া বলিয়াছিল—তা না করে আর কি করব বল? গোটা ভল্লাপাড়ায় এক ছটাক ধান নাই কারুর ঘরে। তুমি বরাবর দিয়ে এসেছ এবার তোমার ঘরেও নাই। গোবিন্দের ঘরে তিন দিন হাঁড়ি চাপে নাই। বেন্দার বেটার বউ বাপের বাড়ি পালিয়েছে; বলে গিয়েছেনা খেয়ে ভাতারের ঘর করতে পারব। মাথার উপরে চাষের সময়। তোমরা ধর্মঘট জুড়েছ জমিদারে ধান বাড়ি দেবে না। মহাজনদের কাছে গিয়েছিলাম—তারা বলেছে–জমিদারের খাজনার রসিদ আন, তবে দোব। এখন আমরা করি কি?
তিনকড়ি এবার আর কথার উত্তর দিতে পারে নাই।
রাম হাসিয়াই বলিয়াছিল—কদিন গেলাম এলাম শিবকালীপুর দিয়ে; দেখলামছিরু পালের ঘরে ধান-ধন মড়মড় করছে। আবার কেলে শ্যাখকে পাইক রেখেছে; বেটা গোফে তা দিয়ে লাঠি হাতে বসে আছে। তাই সব আপনার মধ্যে বলাবলি করতে করতে মনে করলাম দিই, ওই বেটার ঘরই মেরে দি। আমাদেরও পেট ভরুক; আর ধর্মঘটেরও একটা খতম করে দি।
—তার পর?–তিনকড়ি এবার ব্যঙ্গপূর্ণ তিরস্কারের সুরে বলিয়াছিল—তার পর?
–তারপর তুমি সবই জান! বেটা ঘা খেলে মামলা-মকৰ্দমা আর করত না; করতে পারত?
–ওরে ওয়ার, তার যা হত তাই হত। তাদের কি হত একবার বল্ দেখি?
–সে তখন দেখা যেত।-রাম বেপরোয়ার হাসি হাসিতে লাগিল।
তিনকড়ি এবার গাল দিয়াছিল—শুয়ার, তোরা সব শুয়ার। একবার অখাদ্য খেলে শুয়ার যেমন জীবনে তার স্বাদ ভুলতে পারে, তোরাও তেমনি শুয়ার, আস্ত শুয়ার।
এবার সকলেই সশব্দে হাসিতে আরম্ভ করিয়াছিল। শুয়ার গাল তিনকড়ির নরম মেজাজের গালাগাল।
রাম বলিয়াছিল—তেরে, তোমাকে বললাম না একটা বোতল আনতে–হল কি শুনি?
না, না, থাক্। … তিনকড়ি বাধা দিয়াছিল।
–থাকবে কেনে?
—তোদর ঘরে এমন করে ধান ফুরিয়েছে, খেতে পাচ্ছি না, আমাকে বলিস্ নাই কেনে? সত্যিই গোবিন্দের বাড়িতে তিন দিন হাঁড়ি চড়ে নাই?
গোবিন্দ ঝুঁকিয়া দেহখানা অগ্রসর করিয়া তিনকড়ির পায়ে হাত দিয়া বলিয়াছিল—এই তোমার পায়ে হাত দিয়ে বলছি।
বৃন্দাবন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছিল—বেটার বউটা পালিয়ে গেল মোড়ল বেটাকে পাঠিয়েছিলাম আনতে, তা বলেছে উপোস করে আধপেটা খেয়ে থাকতে পারব। এমন ভাতারের ঘরে আমার কাজ নাই।
তিনকড়িও এবার প্রচণ্ড একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়াছিল। মনে মনে ধিক্কার দিয়াছিল নিজেকে। একটা পাথরের মোহে সে সব ঘুচাইয়া বসিল! শিব-ঠাকুরকে সে এখন পাথর বলে। যতবার ওই পথ দিয়া যায় আসে শিব-ঠাকুরকে সে আপনার বুড়ো আঙুল দেখাইয়া যায়। পাথর নয় তো কি? জমিদার তাহার সম্পত্তির মূলের টাকাটা আত্মসাৎ করিল-পাথর তাহার কি করিল? আর সে গিয়াছিল পাথরের উপর দেউল তুলিতে—তাহারই জমি বিকাইয়া গেল!
নহিলে আজ তাহার ভাবনা কি ছিল? নিজের পঁচিশ বিঘা জমিতে বিঘা প্রতি চার বিশ হারে একশত বিশ অর্থাৎ আড়াইশো মন ধান প্রতি বৎসর ঘরে উঠিত। তাহার জমি ডাকিলে সাড়া দেয়—এমন জমি। শুষ্ক হাজা ছিল না। তাহারই ধানে তখন গোটা ভল্লাপাড়ার অভাব পূরণ হইত। কুক্ষণে সে দেবোত্তরের টাকা উদ্ধারের জন্য জমিদারের সঙ্গে মামলা জুডিয়াছিল। আর, মামলা এক মজার কল বটে! হারিলে তো ফতুর বটেই—জিতিলেও তাই উলি-মোক্তার মুহুরী-আমলা-পেশকার-পেয়াদামায় আদালতের সামনের বটগাছটা পর্যন্ত সকলেরই এক রবটাকা, টাকা, সিকি, সিকি! … বটগাছটার তলায় একটা পাথরে সিঁদুর মাখাইয়া বসিয়া থাকে এক বামুন মাদুলি বেচে। ওই মাদুলিতে নাকি মামলায় জয় অনিবার্য। যে জেতে সেও মাদুলি নেয়, যে হারে সে-ও মাদুলি ধারণ করে। তিনকড়িও একটি মাদুলি লইয়াছিল। প্রতি মামলার দিন একটা করিয়া পয়সা দিয়া সিঁদুরের ফোঁটাও লইয়াছিল; তবুও হারিয়াছে। হারিয়া সে দুরন্ত ক্ৰোধে বামুনের কাছে গিয়া কৈফিয়ত তলব করিয়াছিল। বামুন তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিয়াছিল—অশুদ্ধ কাপড়ে মাদুলি পরলে কি ফল হয় বাবা? কই, দিব্যি করে বল দেখি-অশুদ্ধ কাপড়ে মাদুলি পর নি তুমি?
তিনকড়ি হলফ করিয়া বলিতে পারে নাই। কিন্তু বামুনের ধাপ্পাবাজি সম্বন্ধে তাহার আর সন্দেহ গেল না।
আজ তাহার ঘরে ধান অতি সামান্য। যাহা আছে তাহাতে তাহার সংসারেই বৎসর অর্থাৎ নূতন-ধান-উঠা পর্যন্ত চলিবে না। তাহার ওপর আবার মাথার উপর বৃদ্ধির মামলা আসিতেছে। এ মামলা না করিয়া উপায় নাই! জমিদার বলিতেছে-উৎপন্ন ফসলের মূল্য বাড়িয়াছে, সুতরাং আইন অনুসারে সে বৃদ্ধি পাইবেই! প্ৰজা বলিতেছে—মূল্য যেমন বাড়িয়াছে, চাষের খরচও তেমনি বাড়িয়াছে; তা ছাড়া অনাবৃষ্টি, বন্যা প্রভৃতির জন্য ফসল নষ্ট হইতেছে পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি, সুতরাং জমিদার বৃদ্ধি তো পাইবেই না, প্রজাই খাজনা কম পাইবে। দুই-ই আছে আইনে।… চুলায় যাক আইন। ভাবিয়া ও গোলকধাঁধার কূল-কিনারা নাই! যাহা হইবার হইবে! সে নড়িয়াচড়িয়া সোজা হইয়া বসিয়া বলিয়াছিলরাম, কাল বিকেলের দিকে। যাস্, এক টিন করে ধান দোব। তারপর যা হয় ব্যবস্থা করব।
রাম বলিয়াছিল—দেব বলছ, দিয়ে। কিন্তু এর পর তুমি নিজে কি করবে?
–তার লেগে এখন থেকে ভেবে কি করবে? যা হয় হবে।
–তবে আমার ধানটা আধাআধি করে গোবিন্দকে বেন্দাকে দিয়ো।
–কেনে, তোর চাই না?
হাসিয়া রাম বলিয়াছিল—আমার এখন চলবে।
–চলবে? তা হলে তুই বুঝি—
-–তোমার দিব্যি। এবার জাল থেকে এসে কখনও কিছু করি নাই। মাইরি বলছি, আগেকার ছিল।
–আগেকার ছিল? আমাকে ন্যাক পেলি রামা? তিন বছর মেয়াদ খেটে বেরিয়েছি আজ আট-নমাস–সেই টাকা এখনও আছে?
–গুরুর দিব্যি। ছেলে-পোঁতা বাঁধের তালগাছতলায় পুঁতে রেখেছিলাম কুড়ি টাকা; বলে গিয়েছিলাম মাগীকে ইশেরাতে যে, যদি খুব অভাব হয় কখনও তবে আষাঢ় মাসে জংশনের কলে যখন দশটার ভো বাজবে, বাঁধের একানে তাল গাছটার মাথা খুঁজে দেখি। নেহাৎ বোকা, তালগাছে উঠে মাথা খুঁজেছে। আষাঢ় মাসে দশটার ভো বাজলে—গাছের মাথার ছায়াটা যেখানে পড়েছিল—ঠিক সেইখানে পুঁতেছিলাম। বুঝতে পারে নাই। আষাঢ় মাসে সেদিন খুঁড়ে দেখলাম ঠিক আছে; আমার এখন চলবে কিছুদিন।
তিনকড়ি এবার খুশি না হইয়া পারে নাই। বলিয়াছিল—তুমি চোরা ভাই একটি বাস্তুঘুঘু!–বলিয়া সে উঠিয়াছিল; আসিবার সময়েও বলিয়াছিল—তুই কাল যাস্—গোবিন্দ, বেন্দা, তেরে–যাস্ কাল বিকেলে। কিন্তু–খবরদার! এসব আর লয়। ভাল হবে না আমার সঙ্গে।
আজ তিনকড়ি কঙ্কণার মাঠে হঠাৎ ছিদামকে পাইয়া গেল। সকালে তিনকড়িকে সে নিজগ্রামের মাঠে চাষ করিতে দেখিয়া মহগ্রাম, শিবকালীপুর, কুসুমপুর পার হইয়া কঙ্কণার দিকে আসিয়াছিল মজুরির সন্ধানে। কঙ্কণা ভদ্ৰলোকপ্রধান গ্রাম। তাহারা কেবল জমির মালিক। অনেক ঘরে হাল, বলদ ও কৃষাণ রাখিয়া চাষ করায়, অনেকে আশপাশের গ্রামের চাষীকে জমি বর্গাভাগে দিয়া থাকে। চাষ করিয়া ধান কাটিয়া চাষী ঘাড়ে করিয়া বহিয়া বাবুদের ঘরে মজুত করে; অর্ধেক ভাগ মালিক পায়, অর্ধেক পায় চাষী। এমনি এক বর্গায়েৎ চাষীর কাছে ছিদাম জন। খাঁটিতেছিল। এমন সময় তিনকড়ি সেখানে আবির্ভূত হইল।
তাহার গরুর পালের মধ্যে একটা অত্যন্ত বদ্ স্বভাবের বনা আছে। সেটা সমস্তদিন বেশ শান্তশিষ্ট থাকে, কিন্তু সন্ধ্যায় গোয়ালে পুরিবার সময় হইবামাত্র লেজ তুলিয়া হঠাৎ ঘোড়ার ছাৰ্তক চালের মত চালে-চার পায়ে লাফ দিয়া ছুটিয়া পলায়। সমস্ত রাত্রি স্বেচ্ছামত বিচরণ করিয়া আবার ভোরবেলা গৃহে ফিরিয়া শিষ্টভাবে শুইয়া পড়ে অথবা দাঁড়াইয়া রোমন্থন করে। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় পলাইয়াও সে, আজ পর্যন্ত ফেরে নাই। এটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক ব্যাপার।
জল-খাবার বেলার সময় সে খবর পাইয়াছে সেটা নাকি কঙ্কণার বাবুদের বাড়িতে বাধা। পড়িয়াছে। ফুলগাছ খাওয়ার জন্য তাহারা গরুটাকে নাকি এমন প্রহার দিয়াছে যে, চার-পাঁচ জায়গায় চামড়া ফাটিয়া রক্ত পড়িয়াছে; তিনকড়ি সঙ্গে সঙ্গে চাষ ছাড়িয়া পাঁচন হাতে কঙ্কণায় চলিয়াছে। হঠাৎ তাহার নজরে পড়িয়া গেল ছিদাম। পলাইবার আর পথ ছিল না। একে বাবুদের উপর রাগে সে গরগর করিতেছিল, তাহার উপর অপরাধী ছিদামকে কাল রাত্রে ডাকিয়া বাড়িতে পায় নাই; কাজেই ছিদাম ভয়ে-ভয়ে কাছে আসিতেই সে তাহার পিঠে হাতের পাঁচন-লাঠিটা বেশ প্রচণ্ড বেগেই ঝাড়িয়া দিল–হারামজাদা!
ছিদাম দুই হাতে তাহার পা দুইটা ধরিল। মুখে যন্ত্ৰণাসূচক এতটুকু শব্দ করিল না বা না বা কোনো প্ৰতিবাদ করি না।
তিনকড়ি আরও এক লাঠি ঝাড়িয়া দিল।–পাজি শুয়ার!
ঠিক এই সময়ে শ্ৰীহরি ঘোষের গাড়ি আসিয়া পৌঁছিল।…
ঘোড়াটাকে খানিকটা দূর সঙ্গে আনিয়া সে সহসা তাঁহার কজিটা চাপিয়া ধরিয়া বলিল–ছাড়িয়ে নে দেখি।
ছিদাম অবাক হইয়া তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
ধমক দিয়া তিনকড়ি বলিল—নে, ছাড়িয়ে নে, দেখি। হারামজাদা, শুয়ার, তুমি যে রামা ভল্লার সঙ্গে রাত্রে বের হতে শিখেছ, কত জোর হয়েছে বেটার দেখি। নে, ছাড়িয়ে নে।
ঘোড়াটার মুখে সপ্রতিভ হাসি ফুটিয়া উঠিল। বলিল—তাই পারি?
—তবে শুয়ারের বাচ্চা?
—কি করব বলেন?…ছিদাম এবার বলিল ঘরে খেতে নাই। গাঁইটে পালের চাল উঠিয়ে দিয়েছে লোকে। তা ছাড়ামা বিয়ের সম্বন্ধ করছে, টাকা লাগবে। বললাম রাম কাকাকে, তা রাম কাকা বললে—কি আর করবি, আমাদের সঙ্গে বেরুতে শেখ।
—হুঁ। তিনকড়ি এবার তাহার হাতখানা ছাড়িয়া দিল।
ওদিক হইতে কে হাঁকিতেছে—হো–ই। হো–ই। ও তিনু-ভা–ই!
–কে? তিনকড়ি ও ছিদাম চাহিয়া দেখিল, রাস্তার মাঝখানের সেই নালাটায় একখানা গাড়ি পড়িয়াছে, শিবপুরের দোকানি বৃন্দাবন দত্ত হাঁকিতেছে। তাহারা দুজনেই দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া গেল। বোঝাই গাড়িখানার চাকা দুইটা কাদায় বসিয়া গিয়াছে। বৃন্দাবন জংশন হইতে মাল লইয়া আসিতেছে। পনের-ষোল মন মাল, গরু দুইটা বুড়া—একটা তো কাদায় বসিয়া পড়িয়াছে। তিনকড়ি বৃন্দাবনের উপর ভয়ানক চটিয়া গেল। বলিলখুব ব্যবসা করতে শিখেছ। যা হোক। বেনেরা যে হাড়কিপ্লিন তা তুমিই দেখালে দত্ত। এই বুড়ো গরু দুটোকে বাদ দিয়ে দুটো ভাল গরু কিনতে পার না? না–টাকা লাগবে?
দত্ত বলিল—কিনব রে কিনব। নে–নে, এখন একবার ধর ভাই ওরে–কি নাম তোর–ওরে বাবা-তুই বরং ওই গরুটার জায়গায় জোয়ালটা ধর। হারামজাদা গরু এমন বজ্জাত কাদায় শুয়েছে দেখ না। বেটার খাওয়া যদি দেখি! নে নে বাবা! ওই ভাই তিনু।
বিরক্তির সঙ্গেই তিনু বলিল—ধৰ্ব ছিদে, ধ! জোয়াল ধরতে পারবি তুই? তুই বরং। চাকাতে হাত দে।
–না, আজ্ঞে আপনি চাকাতে ধরেন।—বলিয়া ছিদাম হাত ভজিয়া সেই হাতের ভাঁজে বোঝাই গাড়ির জোয়াল তুলিয়া বুক দিয়া ঠেলিতে আরম্ভ করিল। তিনকড়ি অবাক হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে ছিদামের চেহারা যেন পাথরের চেহারা হইয়া উঠিল। নিজে সে চাকা ঠেলিতে গিয়া বুঝিল—কি প্রচণ্ড শক্তিতে ছিদাম আকৰ্ষণ করিতেছে। অথচ ঠেলিতেছে খাড়া সোজা হইয়া, পায়ের গোড়ালি হইতে মাথা পর্যন্ত যেন একখানা পাকা বাঁশের খুঁটির মত সোজা। ওপাশে
ঠেলিতেছে—গরু, গাড়োয়ান এবং দত্ত স্বয়ং তবুও এই দিকটাই আগে উঠিল।
দত্ত ট্যাঁক হইতে দুটি পয়সা বাহির করিয়া ছিদামের হাতে দিল, বলিল—একদিন আসি বাড়ি থেকে চারটি মুড়ি নিয়ে যাত্।
তিনকড়ি ছিদামের হাত হইতে পয়সা দুইটা কাড়িয়া লইয়া দত্তের দিকে ছুঁড়িয়া দিল। ছিদামকে বলিল—বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করিস। আর খবরদার, ওই কিপটের দুটো পয়সা নিবি না।
হনহন করিয়া পথ চলিতে চলিতে সে ছিদামের কথাই ভাবিতেছিল, ছোঁড়া যদি পেট পুরিয়া খাইতে পাইত, তবে সত্যই একটা অসুর হইত!
কথায় আছে একা রামে রক্ষা নাই সুগ্রীব দোসর। গরুটাকে প্রহার করা এবং আটকাইয়া রাখার জন্য ঝগড়া করিতে তিনকড়ি একাই একশো ছিল, আবার হঠাৎ পথে রহমও তাহার সঙ্গে
জুটিয়া গেল।
রহম ফিরিতেছিল জংশন হইতে। শ্রাবণের রৌদ্রে এক গা ঘামিয়া-কঁধের চাদরখানা দিয়া বাতাস দিতেছিল আপনার গায়ে। তিনকড়ির একেবারে খাঁটি মাঠের পোশাক; পরনে পাঁচহাতি মোটা সুতার কাপড়, সর্বাঙ্গে কাদা তো ছিলই, তাহার উপর দত্তের গাড়ির চাকা ঠেলিয়া দেহখানা হইয়া উঠিয়াছে পঙ্কপল্লচারী মহিষের মত-হাতে পাঁচন।
রহমই বলিল—ওই, তিনু-ভাই, এমন কর্যা কুথাকে যাবা হে? এক্কারে মাঠ থেকে মালুম হচ্ছে?
তিনকড়ি বলিল যাব কঙ্কণায়। বাবু-বেটাদের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। আমার একটা বাঁকে বেটারা নাকি মেরে খুন করে ফেলাল্ছে।
–খুন করে ফেলাল্ছে!–রহম উত্তেজিত হইয়া উঠিল।
—বাবুদের ফুলের গাছ খেয়েছে। ফুলের মালা পরবে বেটারা! তাই বলি দেখে আসি একবার।
–চল। আমিও যাব তুমার সাথে। চল।
এতক্ষণে তিনকড়ি প্ৰশ্ন করিল—তুমি আজ হাল জুড়লে না?
চাষের সময় চাষী হাল জোড়ে নাই—এ একটা বিস্ময়ের কথা। এখন একটা দিনের দাম কত! একই জমিতে আজিকার পোঁতা ধানের গুচ্ছ আগামীকালের পোঁতা গুচ্ছ হইতে অন্তত বিশ-পঁচিশটা ধান বেশি ফলন দিবে।
রহম বলিল—আর বুলি কেন ভাই। আল্লার দুনিয়া শয়তানে দখল কর্যা নিলে। যে করবে ধরম করমতার মাথাতেই বাঁশ মারণ। চাষের সময় ঘরে ধান ফুরাছে, যা আছে। শাঙনটা চলবে টেনে হেঁচিড়ে। ইহার উপর পরব এসেছে। খরচ আছে। ছেলে-পিলাকে কাপড়পিরানটা দিতে হবে। মেয়েগুলিকে দিতে হবে। কি করি বল! তাই গেছিলাম সন্ধ্যায়।
তিনকড়ি বলিলা, তোমাদের রোজা চলছে বটে। একমাস রোজা, নয়?
–হ্যাঁ তামান্ রমজানের মাস! মাঝে পুন্নিমে যাবে তা বাদে অমাবস্য। অমাবস্যের পর সঁদ দেখা যাবে, রোজা ঠাণ্ডা হবে। ইদল্ফেতর পরব।
তিনকড়ি এ পর্বের কথা জানে, তাই বলিল—এ তো তোমাদের মস্ত বড় পরব।
–হ্যাঁ। ইদলফেতর বড় পরব। খানা-পিনা আছে, গরিব-দুঃখীকে খয়রাত করতে হয়, সাধু-ফকির-মেহমানদের খাওয়াতে হয়। অনেক খরচ ভাই তিনকড়ি। অথচ দেখ কেনে আভদ্রা বর্ষাকালঘরে ধান নাই, হাতে পয়সা নাই।
তিনকড়ি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–ওকথা আর বল কেনে রহম ভাই, চাকলার লোকেরও এক অবস্থা। কারুর ঘরে খাবার নাই। জমিদার ধান দেবে না। বলে, বৃদ্ধি দিলে তবে দেবে। মহাজন বলছে—জমির খাজনার হাল-ফিল রসিদ আন; পাকা খত লেখ।
—আমাদের আবার ইয়ার উপরে পরব।
তিনকড়ি এ কথার কি উত্তর দিবে, সে নীরবেই পথ চলিতে আরম্ভ করিল।
রহম বলিলতুদের পরবগুলো কিন্তুক বেশ ধান-পানের মুখে। দুগ্গা পূজা সেই ঠিক আশ্বিনে হবেই। আমাদের মাসগুলা পিছায়ে পিছায়ে বড় গোল বাধায়।
তিনকড়ি বলিল–হ্যাঁ, তোমাদের মাসগুলা পিছিয়ে পিছিয়ে যায় বটে।
–হ। বড় পেঁচ্ ভাই। এক-এক বছর এমন দুখ হয় তিনকড়ি, কি বুলব? এই দেখ, আমার যা কিছু দেনা তার অর্ধেক পরবের দেনা। মান-ইজ্জৎ আছে; ইদল্ফেতর মহরমই দুটি পরবে দশ টাকা খরচ না করলেমানবে কেনে লোকে?
তিনকড়ি বলিলতা বটে হ্যাঁ! আমাদের দুগ্গাপুজো কালীপুজোতে খরচা না করলে চলে? যে যেমন—তেমনি খরচ করতে তো হবেই।
অভাবের দুঃখের কথা বলিতে বলিতে দুইজনেরই মন কেমন ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছিল। কঙ্কণার বাবুদের বাড়িতে তাহারা যখন গিয়া দাঁড়াইল, তখন সেই ভারাক্রান্ত মনের কারণেই রাম-সুগ্রীবের মত প্রথমেই একটা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাইয়া বসিল না। সামনে যে চাকরটা ছিল তাহাকে বলিল—তোমাদের বাবু কোথা? বল—দেখুড়ের তিনকড়ি মোড়ল এসেছে। ক্রোধোন্মত্ততা না থাকিলেও বেশ গম্ভীরভাবেই কথাটা সে বলিল।
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া আসিলেন—বাড়ির মালিক-তরুণ একটি ভদ্রলোক। তিনি বেশ মিষ্টি কথাতেই বলিলেন—তুমিই তিনকড়ি মোড়ল?
–হ্যাঁ। আমার গরু আপনি মেরে জখম করেছেন কেন? ধরেই বা রেখেছেন কোন্ আইনে?—তিনকড়ি কিছু কিছু করিয়া মনের উত্তাপ সঞ্চয় করিতেছিল।
রহম বলিল—গরুটাকে মেরে জখম করা খুন বার কর্যা দিছ শুনলাম? হিন্দুবেরা তুমি?
ভদ্রলোকটি সবিনয়ে বলিলেনদেখ, আমি দোষ স্বীকার করছি। তবে এইটুকু বিশ্বাস কর–আমার হুকুমে হয় নি ব্যাপারটা। একজন নতুন হিন্দুস্তানি মালী রাগের বশে করে ফেলেছে, আমি তাকে জবাবও দিয়েছি।
তিনকড়ি রহম দুজনেই অবাক হইয়া গেল। কঙ্কণার ভদ্রলোক অমন মোলায়েম ভদ্রভাবে চাষীর সঙ্গে কথা কয়—এ তাহাদের বড় আশ্চর্য মনে হইল।
ভদ্রলোকটি আবার বলিলেনদেখ গরুটি জখম হয়েছিল; যদি আমার ইচ্ছে থাকত ব্যাপারটা স্বীকার না করার, তা হলে গরুটাকে ওই অবস্থাতেই তাড়িয়ে দিতাম বেঁধে রেখে সেবাযত্ন করতাম না।
সত্য সত্যই গরুটির যথাসাধ্য যত্ন লওয়া হইয়াছে। রক্তপাত হইয়াছিল একটা শিঙ ভাঙিয়া। ঔষধ দিয়া কাপড় জড়াইয়া বধিয়া রাখা হইয়াছে আহত স্থানটি; ডাবাটায় তখনও মাড়, ভূষি খইলের অবশেষ রহিয়াছে। দেখিয়া তিনকড়ি এবং রহম দুজনেই খুশি হইল। উহার জন্য আর কোনো কটু কথাও তাহারা বলিতে পারিল না।
ভদ্রলোকটি অনুরোধ করিয়া বলিলেন মুখ-হাত ধুয়ে একটু জল খেয়ে যাও।
তিনকড়ি অনুরোধ ঠেলিতে পারিল না; রহম হাসিয়া বলিল-আমার রোজা।
তিনকড়ি প্রশ্ন করিল—আপনারা তো কলকাতায় থাকেন?
ভদ্রলোক হাসিয়া বলিলেন–হ্যাঁ।
রহম মাথা নাড়িয়া বলিল–হুঁ! অর্থাৎ ব্যবহারটা সেইজন্যেই এমন।
তিনকড়ি বাতাসা চিবাইয়া জল খাইয়া বলিল—কবে এলেন দেশে?
–দিন পাঁচেক হল।
–এখন থাকবেন?
–নাঃ। ধান বেচতে এসেছি, ধান বেচা হয়ে গেলেই চলে যাব।
–ধান বেচবেন? বেচে দেবেন?
–হ্যাঁ—দরটা এই সময়ে উঠেছে, বেচে দেব। আমরা কলকাতায় থাকি। সেখানে চাল কিনে খাই। এখানে মজুত রেখে কি করব? প্রতি বৎসরই আমরা বেচে দিই।
–বেচে দেন? তা—তিনকড়ি কথা শেষ করিতে পারিল না।
রহম বলিলতা আমাদিগে দাদন দেন না কেনে? ধান উঠলে বাড়ি সমেত শোধ দিব।
তিনকড়ি বলিল-আজ্ঞে। শুধু আমরা কেনে—এ চাকলাটা তাহলে খেয়ে বাঁচবে; দু হাত তুলে আপনাকে আশীর্বাদ করবে।
বাবু হাসিয়া বলিলেন না বাবু, ওসব ফেসাদের মধ্যে নেই আমি।
ব্যগ্রতাভরে রহম বলিল—একটি ছটাক ধান আপনার ড়ুববে না।
–না। আমি কারুর উপকার করতে চাই না, সুদেও আমার দরকার নেই।
রহম বলিল—শুনেন, বাবু শুনেন–
তাহার কথা সমাপ্ত হইবার পূর্বেই ভদ্ৰলোক ঘরে ঢুকিয়া গেলেন। বলিয়া গেলেন—না না। এসবের মধ্যে আমি নেই।
তাহারা অবাক হইয়া গিয়াছিল। এ ধারার মানুষের সঙ্গে তাহাদের পরিচয় নাই। এ দেশের সুদখোর মহাজনকে তাহারা বোঝে, অত্যাচারী জমিদারকেও জানে, কিন্তু শহরবাসী এই শ্রেণীর মানুষ তাহাদের কাছে দুর্বোধ্য। সুদও লইবে না, উপকারও করিতে চায় না। ইহাকে তাহারা বলিবে কি? ভাল না মন্দঃ কঙ্কণায় এই শ্রেণীর লোক নেহাত কম নয়, তাহাদের সহিত ইহার পূর্বে এমনভাবে তিনকড়ি-রহমের পরিচয় হয় নাই। ইহারা ধান এমনি করিয়াই বৎসর বৎসর বিক্রয় করিয়া দিয়া যায়।
তিনকড়ি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—ওই ধরনের মানুষ ভালতেও নাই, মন্দতেও নাই।
রহম বুঝিতে পারিল না এই লোকটি সম্বন্ধে কি মন্তব্য করা উচিত। গরু জখম করার অপরাধে মালীকে বরখাস্ত করে, ধনী ভদ্রলোক হইয়া চাষীদের কাছে দোষ স্বীকার করে; অথচ এত ধান থাকিতেও লোককে দিতে চায় না, সুদের প্রলোভন নাই!—এ লোককে কি বুলিবে ভাবিয়া না পাইয়া সে বলিল—মরুক গে! লে আয়, ঘর আয়। আমাদের আবার ইরসাদের বাড়িতে মজলিশ হবে, পা চালিয়ে চল ভাই।
—মজলিশ! সেদিন শুনলাম—দেবু পণ্ডিত এসেছিল, মজলিশ হয়েছিল তোমাদের। আবার মজলিশ? ধর্মঘটের নাকি?
-ইবার মজলিশ–প্যাটের। ধানের ব্যবস্থা চাই তো। দৌলত ছিরুর সঙ্গে ভিতরে ভিতরে ফয়সালা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ধায়া ধরেছে—ধান দিবে না। তাই একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ইদিকে মাথার উপর পরব!
—তবে তুমি সকাল বেলায় গিয়েছিলে কোথা?
–জংশনে। মজলিশের লেগ্যা তো একবেলার বাদে চাষ কামাই হবেই। তাই গিয়েছিলাম জংশনে। মিলওয়ালা কলকাতার বাবু ঘর বানাইছে, তা ভাল তালগাছ খুঁজছে। সেই ধন্ধে গেছিলাম। ওই যিমাঠের মধ্যি হাঁড়া গাছটা। বাবার হাতের গাছ-ওটাই দিব বুললাম।
দূর হইতে আযানের শব্দ আসিতেছিল। রহম ব্যস্ত হইয়া বলিল—তু আয় ভাই, আমি যাই। জুম্মার নামায আজ।
ইরসাদের বাড়িতে মজলিশ বসিয়াছিল। সমগ্র মুসলমান চাষী সম্প্রদায়ই আসিয়া জুটিয়াছে। সকলের মুখেই চিন্তার ছাপ। ঘরে সকলেরই ধান নিঃশেষিত হইয়া আসিয়াছে। আউশ ধান উঠিতে এখনও পুরা দুইটা মাস। দুই মাসের খাদ্য চাই। খাদ্যের সন্ধানে ঘুরিবারও অবকাশ নাই। মাঠে জল থইথই করিতেছে, চাষের সময় বহিয়া যাইতেছে। জলের তলায় সারখাওয়া চষা-মাটি গলিয়া ঘষা-চন্দনের মত হইয়া উঠিয়াছে, গোটা মাঠময় উঠিতেছে সোদা সোদা গন্ধ। বীজ-ধানের চারাগুলি প্রতিদিন এখন আঙুলের এক পর্বের সমান বৃদ্ধি পাইতেছে। এখন কি চাষীর বসিয়া থাকিবার সময়।
তিনকড়িও গরুটাকে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধিয়া মজলিশের অদূরে বসিল। তাহাকে আবার এইভাবে ধানের জন্য ঘুরিতে হইবে। চাষ বন্ধ থাকিবে। শ্রাবণের দশ দিন পার হইয়া গেল। চাষ করিবার সময় অতি অল্পই অবশিষ্ট আছে। শাওনের পুরো, ভাদ্রের বার, এর মধ্যে যত পার। পুরা শ্রাবণ মাসটাই চাষের সেরা সময়-ও-দিকে ভাষ্ট্রের বার দিন পর্যন্ত কোনোরকমে চলে। তাহার পর চাষ করা আর বেগার খাটা সমান। হোড় তিরিশে, ফুলোয় বিশে, ঘোড়া মুখ। তের দিন জান, বুঝে কাট ধান। আশ্বিনের তিরিশে ধানের চারাগুলি বৃদ্ধি একেবারে শেষ হইয়া যাইবে, ভিতরে শস্য-শীর্ষ সম্পূৰ্ণ হইয়া কুড়ি দিনের মধ্যেই সেগুলি বাহির হইয়া পড়িবে। তারপর ধানগুলি পরিপুষ্ট হইতে লাগে তের দিন। ধানগাছগুলির বৃদ্ধি তিরিশে আশ্বিনের মধ্যেই শেষ; এখন এক-একটা দিনের দাম যে লক্ষ টাকা।
বিপদটা এবার তাদের চেয়েও রহম ভাইদের বেশি। ঘরে খাবার নাই, ভরা চাষের সময়, তাহার উপর তাদের পরব লাগিয়াছে। আশ্বিনের প্রথমে সেবার দুর্গাপূজা হয়—সেবার তাহাদের যে নাকাল হয় সে কথা বলিবার নয়। তবু তো তখন কিছু কিছু আউশ উঠিয়া থাকে। তিনকড়ি মনে মনে বলিল হায় ভগবান, এমনি করেই কি পালপার্বণের দিন করতে হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই চাষীশ্রেণীর মানুষগুলি তাহাদের পবিত্র ঈদলফেতর পর্বের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা সত্ত্বেও উৎসাহ বোধ করিতে পারিতেছে না, সকলেই চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছে।
চান্দ্র বৎসর গণনায় ইসলামীয় পর্বগুলি নির্ধারিত হয় বলিয়া—সৌর প্রভাবে আবর্তিত ঋতুচক্রের সঙ্গে পর্বগুলির কোনো সম্বন্ধ নাই! আরব দেশে উদ্ভূত ইসলামীয় ধর্মে চান্দ্রমাস গণনায় কোনো অসুবিধা ছিল না। উত্তপ্ত মরুভূমিতে সৌর সম্বন্ধ বৰ্জন করিয়া সুস্নিগ্ধ চালোকের মধ্যে জীবন শূৰ্তি লাভ করিয়াছে বেশি। মানুষের অর্থনীতিক সঙ্গতির উপর পঙ্গপাল-অধ্যুষিত পাহাড়ে ঘেরা, বালু-কঙ্কর-প্রস্তরপ্রধান মৃত্তিকাময় আরবে কৃষির প্রাধান্য এমনকি প্রভাব, মোটই নাই। সুতরাং অগ্নিবর্ষী সূর্য এবং বৈচিত্র্যহীন ঋতুচক্রের সঙ্গে সম্বন্ধহীন বর্ষ গণনায় কোনো অসুবিধা হয় নাই। প্রখরতম গ্রীষ্মের মধ্যে কয়েকদিনের জন্য অল্প কয়েক পশলা বর্ষণ আর কয়েক দিনের কুয়াশায় শীতের আবির্ভাব জীবনে ঋতু-মাধুর্যের এবং সম্পদের কোনো প্রভাব আনিতে পারে না ইহা স্বাভাবিক। একমাত্র ফল-সম্পদ খেজুর; সে সারা বৎসরই থাকে শুকাইয়া। খাদ্য-ব্যবস্থায় সেখানে শস্যের অপেক্ষা মাংসের স্থান অধিক; আবার খাদ্যোপযোগী পশুর জীবনের সঙ্গেও ঋতুচক্রের কোনো সম্বন্ধ নাই। সেখানে চান্দ্র-গণনায় মাস পিছাইয়া যায়, কিন্তু তাহাতে আর্থিক সঙ্গতির তারতম্য হয় না; সেখানে পর্বগুলি চালোকের স্নিগ্ধ রাশ্মির মধ্যে তারতম্যহীন সমারোহে প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভরিয়া ওঠে। কিন্তু কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষির উপর পূর্ণ নির্ভরশীল মুসলমান চাষী সম্প্রদায় স্থানোপযোগী কাল গণনার অসঙ্গতিতে মহা অসুবিধায় পড়িয়াছে। অগ্রহায়ণ-পৌষ–মাঘ-ফাল্গুনে যখন ঈদলফেতর মহরম হয়, তখন তাহারা যে আনন্দোচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে—সেও খানিকটা আতিশয্যময়। আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্রে নিষ্ঠুর অভাবের মধ্যে চাষের অবসরহীন কর্মব্যস্ততার মধ্যে পর্বগুলি ম্ৰিয়মাণ হইয়া চলিয়া যায়–পৌষমাঘের উচ্ছাসের আতিশয্য তাহারই খানিকটা প্রতিক্রিয়ার ফলও বটে। এবার রমজান মাস পড়িয়াছে শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষে, শেষ হইবে দ্রের শুক্লপক্ষের প্রারম্ভে। এদিকে ভরা চাষের সময়, চাষীর ঘরে পৌষের সঞ্চিত খাদ্য শেষ হইয়া ত সিয়াছে, ওদিকে জমিদারের সঙ্গে খাজনা-বৃদ্ধি লইয়া বিরোধ বাঁধিয়াছে, তাহার উপর ঈদলফেতর পর্ব। পর্বের দিন দান-খয়রাত করিতে হয়, সাধু-সজ্জন-আত্মীয়দিগকে আহারে পরিতৃপ্ত করিতে হয়; ছেলে-মেয়েদের নূতন কাপড়-পোশাক চাই; জরির টুপি, রঙিন জামা, নকশিপাড় কাপড়, বাহারে একখানা রুমাল পাইয়া কচি মুখগুলি হাসিতে ভরিয়া উঠিবে—তবে তো! তবে তো পৰ্ব সার্থক হইবে, জীবন সাৰ্থক হইবে!
মক্তবের মৌলবী ইরসাদ মিয়া ইহাদের নেতা। সে ভাবিতেছিল—এতগুলি লোকের কি। উপায় হইবে? মধ্যে মধ্যে সে কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের কথা ভাবিতেছিল।
কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক! এখানকার কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান-কঙ্কণার লক্ষপতি মুখুয্যেবাবুর বড় ছেলে; সেক্রেটারিও কঙ্কণার অন্য বাবুদের একজন। তাহাদের গ্রামের চামড়ার ব্যবসায়ী ধনী দৌলত হাজী, শিবকালীপুরের শ্ৰীহরি ঘোষ–ইহার মেম্বার।
ইরসাদ তবুও বলিল—দেখি একখানা দরখাস্ত করে।
রহম বলিল—শুন, ইরসাদ বাপ ইদিকে শুন একবার।
রহম একটা কথা তিনকড়িকে বলে নাই। আপনাদের কথা ভাবিয়াই কথাটা বলে নাই। ওপারের জংশনের কলওয়ালা কলিকাতার বাবুটি বলিয়াছেন টাকা আমি দিতে পারি। কিন্তু আমার সঙ্গে পাকা এগ্রিমেন্ট করতে হবে যারা টাকা নেবে, তাদের আমার টাকার পরিমাণের ধান আগে শোধ করতে হবে। আর আমি যখন অসময়ে টাকা দেব, তখন হলফ করে বলতে হবে তোমাদের, যখন যা ধান বেচবে আমাকেই বেচবে।
—দর?
–সি বাপ তুমি না হলে হবে না। পাঁচজনকে নিয়া একদিন চল সাঁঝবেলাতেই যাই।
কিছুক্ষণের মধ্যে কথাটা কানাকানি হইতে আরম্ভ করিল। তিনকড়ি শুনিয়া ফেলিল। সঙ্গে সঙ্গে সেও উঠিল।
ওই সংবাদটা পাইয়াই সে বাড়ি ফিরিল বেশ খুশি মনে। যাক উপায় তাহা হইলে একটা মিলিয়াছে। দাদন মিলিলে আর চাই কি? সোনালানোে জমি, তাহার হাতের চাষ, ভাবনা কি তাহার? ওঃ নিজের সব জমি আজ যদি তাহার থাকিত! পাথরের দায়ে সর্বস্ব গেল। যাক! আবার সে সব গড়িয়া তুলিবে। এবারেই সে কয়েকজন ভদ্রলোকের জমি ভাগে লইয়াছে। কার্তিকে নদী নামিয়া গেলে এবার বাপ-বেটায় মিলিয়া ময়ূরাক্ষীর চরের জায়গাটা বেশ করিয়া কাটিয়া দস্তুরমত জমি করিয়া ফেলিবে। অগ্রিম আলু, কপি, মটরশুটির চাষ করিবে। টাকা একদফা তাহাকে উপাৰ্জন করিতেই হইবে। গৌরকে সে দিয়া যাইবে কি? গৌরের চেয়েও ভাবনা তার স্বর্ণ মায়ের জন্য। সোনার প্রতিমা মেয়ে, স্বৰ্ণময়ী নাম তো সে মিথ্যা দেয় নাই। তাহারই ভাগ্যে মেয়েটা সাত বৎসর বয়সে বিধবা হইয়াছে। উহার একটা উপায় করিতে হইবে। তাহার জন্য কিছু জমি পাকাপাকিভাবে লেখাপড়া করিয়া দেওয়া তাহার সবচেয়ে বড় কাজ।
বাড়িতে ফিরিতেই স্বর্ণ তাহাকে তিরস্কার করিল-বাবা, এ তোমার ভারি অন্যায় কিন্তু। মাঠে হাল-গরু রেখেওই ঠেটি কাপড় পরে তুমি কঙ্কণা চলে গেলে! বেলা গড়িয়ে গেল, খাওয়া নাই দাওয়া নাই–
হা-হা করিয়া হাসিয়া তিনকড়ি বলিল—ওরে বাপরে, বুড়ো মা হলি দেখছি।
–বাবুদের সঙ্গে ঝগড়া করে এলে তো?
–না রে না। লোকটি ইদিকে ভাল। কলকাতায় থাকে তো! মিষ্টি করেই বললে—অন্যায় হয়ে গিয়েছে। গরুটাকে খুব যত্ন করেছে। আমাকে জল খেতে দিলে। তবে টাকা ছাড়া আর কিছু চেনে না। উঃ, ওদের ধান কত স্বপ্ন। সব ধান বেচে দেবে।
স্বর্ণ চুপ করিয়া রহিল; আপনার ধান সে যদি বেচিয়া দেয়, তবে তাহার কি বলিবার আছে? তাহাদের নাইকিন্তু তাহাতে সে বাবুর কি?
স্বর্ণের মা বলিল–ওগো, শিবকালীপুরের দেবু পণ্ডিত এসেছিল।
–দেবু পণ্ডিত?
–হ্যাঁ।
–কেনে? কিছু বলে গিয়েছে?
–আমি তো কথা বলি নাই। সুন্ন কথা বললে। কি বলেছে বল না স্বন্ন।
স্বর্ণ বলিলবলে গিয়েছে, আবার আসবে, সে কথা তোমাকেই বলবে।
মা বলিল—তবে যে অনেকক্ষণ কথা বললি লো? স্ব
র্ণ আবার সলজ্জভাবে হাসিয়া বলিল-আমাকে পড়ার কথা বলছিল।
তিনকড়ি উৎসাহিত হইয়া উঠিল।–পড়ার কথা? তোকে পড়া ধরেছিল নাকি? বলতে পেরেছিলি?
সলজ্জভাবে ঘাড় নাড়িয়া নীরবে স্বর্ণ জানাইল—সব বলিতে পারিয়াছে সে। তারপর বলিল-আমাকে বলছিল ইউ-পি বৃত্তি পরীক্ষা দাও না কেনে তুমি?
—তা দে না কেনে তুই স্বনু!—তিনকড়ির উৎসাহের আর সীমা রহিল না। কক্কণার মেয়ে ইস্কুলে বাবুদের মেয়েরা পড়ে, স্বর্ণও পড়ুক না কেনে! ভাল, দেবু তো আসিবেই বলিয়াছে, তাহার সঙ্গেই সে পরামর্শ করিবে।