যাদের সঙ্গে তিথির সময় কাটাতে হয় তাদের কারোর চেহারাই তার মনে থাকে না। যেন স্বপ্নদৃশ্য; ঘুম ভাঙলে স্বপ্নদৃশ্যের কাঠামো মনে থাকে, কিন্তু যাদের নিয়ে দৃশ্য তাদের চেহারা মনে থাকে না!
তিথি হ্যান্ড ব্যাগ থেকে কার্ড বের করল; ইংরেজিতে লেখা কার্ড। তিনটা টেলিফোন নম্বর দেয়া। বেশ পয়সাওয়ালা মানুষ নিশ্চয়ই। লোকটির চেহারা মনে পড়ছে না। লম্বা না বেঁটে, রোগা না মোটা কিছুই মনে নেই। তবে নাৰ্ভাস ধরনের মানুষ ছিল এটা খুব মনে আছে। বারবার তার স্ত্রীর কথা বলছিল। স্ত্রীর নাম ফরিদা। বড় মেয়ে আজিমপুর গার্লস স্কুলে সেভেনে পড়ে তাও মনে আছে, কিন্তু লোকটির চেহারা মনে নেই। কার্ডে লেখা মোঃ দবিরউদ্দিন বিএ (অনার্স)। কারখানার ঠিকানা এবং বাসার ঠিকানা দুটোই দেয়া আছে। তিথি ঠিক করল বাসাতেই যাবে। এই সময় ভদ্রলোককে বাসাতেই পাওয়া যাবে। নটা এখনো বাজেনি; এত ভোবে। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কারখানায় চলে যাননি। তাছাড়া বাসায় যাধর অন্য একটা উদ্দেশ্য ও আছে। অদৃশ্য চাপ সৃষ্টি করা। বাসায় গিয়ে তিথি। যদি বলে, আপনি আমাকে একটা চাকরি দেবেন বলেছিলেন, তখন ভদ্রলোক হকচাকিয়ে যাবেন। চেষ্টা করবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে বিদেয করতে। তখন চাকরির প্রসঙ্গে ভদ্রলোক হয়ত বলবেন, আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে ব্যবস্তু! করছি। তুমি কাল আমার অফিসে এসো!
তুমি করে নাও বলতে পারে। হয়ত আপনি করে বলবে। না চেনার ভান ও করতে পারে। তবে এই লোক তা কববে না। এ নাভসি ধরনের ভীতু একজন লোক। নার্ভাস এবং ভীতু মানুষ চট করে মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু বলার সময়; সত্যি কথাই বলে। সে ফে{ ভুল করে সত্যি কথা বলছে তা নিজে শুরুতে বুঝতে পারে না; যখন বুঝতে পারে তখন সে আবে: নাৰ্ভাস হয়ে যায়। তিথি নিজের মনেই খানিকক্ষণ হাসল; কেন জানি তার খুব মজা লাগছে। যদিও মজা লাগার মত কিছু হয়নি।
বাসা খুজে পেতে দেরি হল না। দোতলা একটা বাড়ি। তিনতলার কাজ চলছে। বাড়ির সামনে ইট, সিমেন্ট, রিভ গাদাগাদি করে রাখা। ছসাত জন মিস্ত্রী কাজ করছে। চৌবাচ্চার মত একটা জায়গার চারপাশে গোল হয়ে বসে ইট পরিষ্কার করছে। ব্রাশ দিয়ে ইট ঘষে পানি ঢালছে। সেই ইট মাথায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দোতলার ছাদে। তিথি বলল, এটা কী দাবির সাহেবের বাসা? ভূঁচালো দাড়ির এক মিস্ত্রী বিরক্ত মুখে বলল, জানি না। কার বাস। আফনে জিাগান গিয়া। এই বলে সে নিচু গলায আরো কী যেন বলল। কোন কুৎসিত ইঙ্গিত কিংবা কোনো অশ্লীল রসিকতা। কারণ সঙ্গী সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। দু’জন আড়চোখে তাকোল তিথির দিকে। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক সমস্যা। কুৎসিত ইঙ্গিত রসিকতা সব সময় মেয়েদের নিয়েই করা হয়। পুরুষদের নিয়ে নয়।
তিথি ছুঁচালো দাড়ির মিস্ত্রীটের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, তুমি কী বললে? মিস্ত্রী এই প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিল না। সে আমতা আমতা করতে লাগল। তিথি বলল, তোমার দাড়ি ধরে তোমাকে আমি এই পানির মধ্যে চুবিয়ে ধরব বুঝতে পারছ?
মিস্ত্রীদের কেউ কোনো কথা বলল না। তারা ইট পরিষ্কারের ব্যাপারে এখন অতিরিক্ত মনোযোগী। ওদের একজন লজ্জিত গলায় বলল, কিছু মনে লাইয়েন না আফা। এইডা দবির স্যারের বাসা। ডাইন দিকে যান!
তিথি এগিয়ে যাচ্ছে। দাড়িওয়ালা মিস্ত্রীটি কী বলেছিল কে জানে। তার জানতে ইচ্ছা করছে। অনেক কিছুই আমাদের জানতে ইচ্ছা করে, শেষ পর্যন্ত জানতে পারি না। এটা একদিক দিয়ে ভাল। সবচে সুখী মানুষ তারাই যারা সবচে কম জানে। এটা তিথির বাবা জালালুদ্দিন সাহেবের কথা। জালালুদ্দিন সাহেব এক সময় দার্শনিকের কথাবার্তা বলতেন। এখন বলেন না। তার এখনকার সব কথা নিজের চোখ নিয়ে এবং খাদ্যদ্রব্য নিয়ে। আজও তিথি বেরুবার সময় অনেকক্ষণ বকবক করলেন।
একজন বড় চোখেন ডাক্তারের কাছে আমাকে নিয়ে যা তো মা! বা চোখটায় এখন আর কিছুই দেখতে পাঠ না। আগে কিছুটা দেখতাম, হীরুর পীরের কাছে যাওয়ার পর থেকে এক্কেবারে সাড়ে সৰ্ব্বনাশ; এই দেখ, ডান চোখ বন্ধ কৰে তোব দিকে ত:কাচিহ্ন! তোকে দেখছি না। কিছু না অন্ধকার। ঐ শাল। পারের কাছে কেন যে গোলাম।
ডানটা কী ঠিক আছে?
এখনো আছে আর কিন্তু বেশিদিন থাকবে না। একটা গেলে অন্যটা যায় এটাই নিয়ম। তিথি অন্যমনস্ক স্বাবে বলল তুমি দেখি অনেক নিয়ম-কানুন জান। তার উত্তরে জালালুদ্দিন কিছু বলেননি। অদ্ভুত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন। তিথি বলেছে সামনের সপ্তাহে একজন বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
দেরি হয়ে যাবে তো।
দেরি হলেও কিছু করার নেই। হাত খালি। ডাক্তার বিনা পয়সায় তোমাকে দেখবে না। নগদ একশ টাকা দিতে হবে। জালালুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, আমার কাছে কিছু আছে।
তিথিবি জন্যে এই খবরটা অবাক হবার মত। রান্না হয়নি, খাওয়া-দাওয়া হয়নি এমন দিন ও তাদের গেছে। জালালুদ্দিন শব্দ করেননি; শুকনে মুখে উপোস দিয়েছেন। অথচ তার কাছে টাকা ছিল। তিথি বলল,
কত টাকা আছে?
তিনি জবাব দেননি; চোখ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন; একটা হাত একবার ডান চোখের সামনে ধরছেন, একবার বাঁ চোখের সামনে। তিথি বলল, কত টাকা বল? আমি তো নিয়ে যাচ্ছি না।
আছে কিছু।
সেই কিছুটা কত?
এই ধরা শ পাঁচেক।
এতগুলি টাকা নিয়ে ঘাপটি মেরে ছিলে? তুমি তো বেশ মজার মানুষ বাবা। দাও আমাকে একশ টাকা ধার দাও। ভয় নেই, ফিরিযে দেব। তিনি না-শোনার ভান করলেন। খাট থেকে নেমে হাতড়ে হাতড়ে রওনা হলেন বাথরুমের দিকে। তিথি বাড়ি থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত তিনি বেরুলেন না।
তের–চৌদ্দ বছরের রোগা একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। মেয়েটির চেহারা খুব মায়াকাড়া! ভারি কোমল চোখ! গোলাকার মুখ! যেন কেউ কাটা কম্পাস দিয়ে মুখ একেছে। পাতলা ঠোট। এত পাতলা য়ে মনে হয় তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে রক্ত চলাচল দেখা যাবে।
দবির সাহেবের বাসা?
জি।
উনি আছেন?
জি গোসল করছেন।
কে হন তোমার?
আমার বাবা।
আমি উনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
বসুন। বাবা বের হলে বলব। উনার বের হতে অনেক দেরি হয়।
তোমার নাম কী?
অজন্তা।
বাহ খুব সুন্দর নাম তো।
আমার ভাল নামটা খুব খারাপ।
ভাল নাম কী?
অজন্তা কিছু বলল না। আগ্রহ নিয়ে সে তিথিকে দেখছে। মনে মনে বলছে, এই মেয়েটার গলার স্বর এত মিষ্টি কেন? শুধু শুনতে ইচ্ছা করে। তার একটু মন খারাপও হল। অজন্তার ধারণা তার গলার স্বরটা খুব বাজে। কর্কশ, কানে লাগে। এই জন্যে বাইরের মানুষের সামনে সে কথার্বতা একেবারেই বলে না। তবু এই মহিলাটির সঙ্গে সে অনেক কথা বলে ফেলেছে। এখন মন খারাপ লাগছে। তার ধারণা এই মহিলা মনে মনে বলছেন। অজন্তা মেয়েটা এত সুন্দব কিন্তু তার গলার স্বর এরকম কাকের মত কেন? তিথি বলল,
তোমার আজ স্কুল নেই অজন্তা?
উঁহু।
কিসের ছুটি?
এসএসসি পরীক্ষার ছুটি। আমাদের স্কুলে সিট পড়েছে।
তুমি ক্লাস সেভেনে পড়, তাই না?
অজন্তা অবাক হয়ে বলল, কি করে বুঝলেন? তিথি হাসিমুখে বলল, চেহারা দেখে আমি অনেক কিছু বলতে পারি। এখন দেখ তোমার বাবা বের হয়েছেন কী না।
বের হননি।
কী করে বুঝলে?
বাথরুমের দরজা খুলেই তিনি আমাকে ডাকেন লেবুব শরবত দেবার জন্যে। গোসল শেষ করে তিনি এক গ্লাস লেবুর শরবত খান। ভিটামিন সি আছ শরবতে। বেশি করে ভিটামিন সি খেলে মাথায় চুল ওঠে।
তিথি হেসে ফেলল। অজন্তা সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেল। নিজের ওপর তার খুব রাগ লাগছে। কাকের মত গলায় সে এতক্ষণ ধরে কথা বলেছে। কী লজ্জা! জিভটা কেটে ফেলতে পারলে বেশ হত। ভেতর থেকে ভারী গলা ভেসে এল, অজু, মা অজু। অজন্তা মুখ কালো করে বলল, বাবা আমাদের আদর করে অজু ডাকেন। কী বিশ্ৰী যে লাগে শুনতে। দবির সাহেব খালি গায়ে, কাধে শুধু একটা ভেজা গামছা জড়িয়ে বসার ঘরে ঢুকেই পাথরের মূর্তির মত হয়ে গেলেন। তিথি উঠে দাঁড়াল। তিনি ভাঙা গলায় বললেন বস। বস। তিথি বলল, আপনি কী আমাকে চিনতে পারছেন…
হুঁ।
আমার নাম মনে আছে আপনার?
না, নাম মনে নাই। আমার কোনো মানুষের নাম মনে থাকে না। চেহারা মনে থাকে; একবাধ কাউকে দেখলে সারা জীবন মনে থাকে। তুমি ব্যস, আমি একটা শার্ট গায়ে দিয়ে আসি।
আমি কী আপনাকে কোনো অস্বস্তিতে ফেলেছি।
হুঁ, তা তা তা কিছুটা… কী জন্যে এসেছ?
আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন।
আমি, আমি আসতে বলেছিলাম? বল কী!
একটা কার্ড দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই ঠিকানা পেলাম।
ও আচ্ছা আছচা।
বলেছিলেন। আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দেবেন।
চাকরি? চাকরি আমি কোথায় পাব?
তা তো জানি না; আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন, তাই এসেছি। চলে যেতে বললে চলে যাব।
না না বস। একটু বাস। চা খাও! আমি একটা শার্ট গায়ে দিয়ে আসছি। ঘরে কোনো কাজের লোক নেই। চারজন ছিল। গত সোমবার একসঙ্গে চারজনকে বরখাস্ত করেছি। ছাব্বিশ ইঞ্চি একটা কালার টিভি চুরি হয়েছে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া সেটা সম্ভব না। আমার ধারণা, ওরা ধরাধরি করে টিভিটা চোরের রিকশায় তুলে দিয়ে এসেছে। আই অ্যাম পজিটিভ।
দবির উদ্দিন শার্ট গায়ে দেবার জন্যে দোতলায় চলে গেলেন। তার ঘর তার স্ত্রী ফরিদার ঘরের পাশে। এক সময় তারা দু’জন এক খাটে ঘুমুতেন। এখন তা সম্ভব না। ফরিদার গায়ে একটু হাত রাখলে সে ব্যথায় নীল হয়ে যায়। দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে তার পিঠে দগদগে ঘা হয়েছে। সেখান থেকে কটু গন্ধ আসে। দবির উদ্দিন সেই গান্ধ সহ্য করতে পারে না। সমস্ত শরীর পাক দিয়ে ওঠে। মনে হয় বমি করে ফেলবেন। বহু কষ্টে বমির চাপ সামলাতে হয়। সামলাতে না পারলে খুব খারাপ ব্যাপার হবে। ফরিদা মনের কষ্টেই মরে যাবে।
দবির উদ্দিন ফরিদার ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় থমকে দাঁড়ালেন। সকাল বেলার এই সময়টায় সে আচ্ছান্ন অবস্থার মধ্যে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলে কথা বলে না। তাকায় না পর্যন্ত। কথা বলতে শুরু করে বিকেলের দিকে। আজি অন্য রকম হল। ফরিদা ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলেন এই শোন। দবির উদ্দিন ঘরে ঢুকলেন। দরজার ও-পাশ থেকে বললেন কী?
ঐ মেয়েটা কে?
কোন মেয়েটা?
ফরিদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললে। দবির উদ্দিন ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। ফরিদা বললেন, মেয়েটাকে আমার এখানে একটু আসতে বল। আমি কথা বলব!
তিথি অনেকক্ষণ কিছু দেখতেই পেল না। জানালা ভারী পর্দায় ঢাকা। ঘরের তিনটি দরজার দুটোই বঙ্গ। যেটা খোলা, সেখানেও জানালার মতই ভারী পর্দা। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার আগেই তিথি শুনল কেউ একজন তীক্ষ্ণ গলায় বলছে, ভেতরে এসে দাঁড়াও। পর্দা ধরে দাড়িও না। পর্দার কাঠ আলগা হয়ে আছে, মাথার উপর পড়বে।
তিথি খানিকটা এগুলো। এগুতে ও ভয় লাগছে। কোনো কিছুর সঙ্গে হয়ত ধাক্কা লাগবে।
তোমার বা দিকে চেয়ার আছে, তুমি চেয়ারে বাস।
সে বসল না। দাঁড়িয়ে রইল। চোখে অন্ধকার সয়ে গেছে। ঘর দেখা যাচ্ছে। পুরনো আমলের পালংক দেখা যাচ্ছে। পালংকে শুয়ে থাকা মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। খুব রুগ্ন মানুষকে আমরা কংকাল বলি। এই মহিলাটি তাও নয়। তার কংকাল ও যেন শুকিযে ছোট হয়ে গেছে। হাঁটু পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। মাথার উপর শ্লথগতিতে একটা ফ্যান ঘুরছে। ঘরের ভেতর চাপা এক ধরনের গন্ধ।
বসতে বললাম, বসছ না কেন?
তিথি বসল। তাকিয়ে রইল দেয়ালের দিকে। ফরিদা বললেন, চেয়ারটা ঘুরিয়ে বাস; তোমার মুখ দেখতে পারছি না। তিথি চেয়ার ঘুরিয়ে বসল।
তোমার চেহারা তো বেশ সুন্দর। বেশ্যাদের এত সুন্দর চেহারা থাকে জানতাম না। আমি শুনেছি। ওদের শরীর ভাল থাকে, চেহারা ভাল থাকে না। তিথি তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না।
তোমাকে বেশ্যা বলায় রাগ করলে নাকি? ও আমাকে তোমার বিষয়ে বলেছে। ও আমাকে সব কিছু বলে। কোনো কিছু লুকিয়ে রাখতে পারে না।
আপনি মনে হচ্ছে খুব ভাগ্যবতী।
ঠাট্টা করলে নাকি?
তিথি কিছু বলল না।
ফরিদা বললেন, আমি অবশি। শুনেছি তোমার মত মেয়েরা খুব ঠাট্টাতামাশা করতে পারে।
আমাদের সম্পর্কে এত খবর জানলেন কী ভাবে?
ইচ্ছা করলেই জানা যায়। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে। জেনেছি।
তিথি বলল, আপনার কথা কী শেষ হয়েছে। আমি এখন উঠব?
না বস। আরো খানিকক্ষণ বস। তোমার কাজের ক্ষতি হলেও বাস, আমি পুষিয়ে দেব।
কীভাবে পুষিয়ে দেবেন? ঘণ্টা হিসেবে টাকা দেবেন?
হ্যাঁ দেব। তুমি বস। চা খেয়েছ তুমি? চা দিয়েছে?
না দেয়নি। চা খেলে আপনার কাপ নোংরা হয়ে যাবে না?
হবে। আমার এত শুচিবায়ু নেই। আচ্ছা তুমি বল ও তোমার সঙ্গে কী কী করেছিল?
আপনার স্বামী আমার সঙ্গে কী কী করেছিল তা শুনতে চান?
হুঁ।
উনি আপনাকে কিছু বলেননি?
বলেছে। তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। তুমি বল। আমি তোমাকে টাকা দেব। এটা বলার জন্যে আপনি আমাকে টাকা দেবেন?
হ্যাঁ দেব। ও ভীষণ লাজুক। ওর মত লাজুক একটা মানুষ তোমার মত সুন্দরী একটা মানুষ নিয়ে কী করল তাই জানতে চাই।
আপনিও তো এক সময় সুন্দরী ছিলেন। আপনাকে নিয়ে উনি কী কী করেছিলেন?
আমি আর তুমি এক হলাম?
এক না? আমাদের দুজনের শরীরই তো এক রকম? তাই নয় কী?
তুমি খুবই ফাজিল একটা মেয়ে।
আমার মত মেয়েরা ফাজিলও হয়। এই খবরটা বোধ হয় আপনি জানেন না। অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমরা খুব ফাজলামী করি আবার ছেলেদের সঙ্গে মধুর ব্যবহার। এখান থেকে যাবার সময় আমি করব কী জানেন? আপনার মুখে থুথু দিয়ে যাব। আপনার শরীরের যে অবস্থা আপনি আমার সেই থুথু মুখে মেখে শুয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে পারবেন না।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার ফরিদা এই কথায় রাগ করলেন না, বরং তার মুখের রেখাগুলি কোমল হয়ে গেল। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, তোমার নাম কী?
আমার দশটা নাম আছে। কোনটা আপনাকে বলব?
সত্যি নামটা বল।
সত্যি নাম আমার নেই। আমার সবই নকল নাম।
তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছ। আমি খুবই অসূস্থ একজন মানুষ; আর অল্প কিছু দিন বেঁচে আছি! এরকম একজন মানুষের ওপর রাগ করা ঠিক না।
আপনার মত রোগীরা সহজে মরে না। আপনি দীর্ঘদিন বাঁচবেন। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষের হাড় ভাজা ভাজা করবেন। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ এক’দিন মনে মনে আপনার মৃত্যু কামনা করবে…তবু আপনি মরবেন না।
ফরিদা বললেন, তুমি সত্যি কথাই বলেছ। তুমি আমার আরো কাছে আসি তো তোমাকে ভাল করে দেখি। জানালার একটা পর্দাও সরিয়ে দাও; ঘর বেশি অন্ধকার হয়ে আছে। আজ এত অন্ধকার কেন বল তো? ঝড়বৃষ্টি হবে নাকি? আকাশে কী মেঘ আছে?
তিথি একটি প্রশ্নের জবাবও দিল না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, যাই।
ফরিদা বললেন, থুথু দিয়ে গেলে না?
তিথি তার জবাব না দিয়ে নিচে নেমে গেল। দবির উদ্দিন বারান্দায় মেয়ের মাথার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন। তিথি তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে উঠোনে নামল। দাবিব উদ্দিন শংকিত চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। অজন্তা বাবাকে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটা কে বাবা? দবিব উদ্দিন মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। কিছু একটা বলতে গেলেন, গলা দিয়ে শব্দ বের হল না। গলার মধ্যে আটকে গেল।