৮. যখন সবাই মিলে রাত্রে ভূতের গল্প শুনেছে
বাসায় যতবার মাছ রান্না করা হয় টিটন খাওয়ার সময় একবার হলেও নাক কুঁচকায়, যতবার সবজি খেতে হয় মিঠুন শুধু নাক কুঁচকায় না এমন ভান করে যে সেটা খেতে গিয়ে তার গলায় সবজি আটকে যাচ্ছে এবং দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু এই গেস্ট হাউজে তারা একবারও নাক কুঁচকালো না, গ্রামের মহিলার রান্না করা মাছের ঝোল এবং মিষ্টিকুমড়া ভাজি সবাই খুব সখ করে খেল।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে বাসার সবার সাথে টেলিফোনে কথা বলে, ঘুমের কাপড় পরে সবাই যখন গভীর রাতে ঘুমাতে গেল তখন আবিষ্কার করল মাত্র নয়টা বাজে। কেমন করে রাত নয়টার সময় নিশুতি রাত হয়ে যায় সেটা কেউ বুঝতে পারল না।
রিতু বলল, মাত্র নয়টা বাজে বিছানায় শুয়ে থেকে লাভ নেই। ঘুম আসবে না। তার থেকে আয়, বারান্দায় বসে গ্রাম দেখি।
সবাই এক কথায় রাজি। তারা হুটোপুটি করে বাইরে গিয়ে বারান্দায় বসল, ভালো করে লক্ষ্য করে নাই বলে দেখতে পেলো না তাদেরকে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ শুট করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল।
বারান্দায় বসতেই প্রথমে তাদের চোখে পড়ল বিশাল একটা চাঁদ। রিতু বলল, দেখ দেখ, কী সুন্দর চাঁদ।
টিটন জিজ্ঞেস করল, কে বলতে পারবে এটা শুক্লপক্ষ না কৃষ্ণ পক্ষ?
মিঠুন জিজ্ঞেস করল, সেটা আবার কী জিনিস?
টিয়া বলল, চাঁদটা যখন বড় হতে থাকে সেটা হচ্ছে শুক্লপক্ষ আর যখন ছোট হতে থাকে সেটা হচ্ছে কৃষ্ণপক্ষ।
মিঠুন বলল, কী আজিব। চাঁদ আবার ছোট বড় হয়!
টিয়া বলল, এর মাঝে আবার আজিব কোনটা? তা ছাড়া শব্দটা মোটেও আজিব না। শব্দটা আজব।
একই কথা।
মোটেও একই কথা না।
রিতু বলল, হয়েছে এখন ঝগড়াঝাটি না। টিটন যেটা জিজ্ঞেস করেছে তার উত্তর দে, এটা কী শুক্লপক্ষ নাকী কৃষ্ণপক্ষ!
টিয়া বলল, পঞ্জিকা দেখে বলতে হবে। এমনি বলা যাবে না।
টিটন বলল, উঁহ পঞ্জিকা লাগে না। চাঁদ দেখলেই বোঝা যায়।
রিতু জিজ্ঞেস করল, কীভাবে?
দেখছ, চাঁদের একটা সাইড গোল, অন্য সাইডটা এবড়ো থেবড়ো?
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ দেখেছি।
গোল অংশটা যখন ডান দিকে তখন সেটা হচ্ছে শুক্লপক্ষ। গোল অংশটা যখন বাম দিকে তখন সেটা কৃষ্ণপক্ষ।
রিতু অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি! কী আশ্চর্য, আমি কখনো জানতাম না।
তিতু বলল, আপু তুমি কেমন করে জানবে? ঢাকায় কখনো চাঁদ উঠে না।
টিয়া বলল, উঠে কিন্তু কেউ দেখে না।
তিতু বলল, হ্যাঁ। কেউ দেখে না।
রিতু বলল, আমরা গ্রামে না আসলে কেউ কোনোদিন জানতাম না চাঁদ এত সুন্দর।
সবাই মাথা নাড়ল। টিয়া বলল, ঐ গাছে জোনাকি পোকাগুলো দেখছ? এক সাথে জ্বলছে এবং নিভছে? কী সুন্দর!
টিটন এটার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু সবাই সৌন্দর্য দেখে এত মুগ্ধ টিটনের মনে হলো, এখন কেউ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনতে চাইবে না, তাই শেষ পর্যন্ত আর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করল না।
তিতু বলল, বাতাসে নারকেল গাছের পাতাগুলো নড়ছে আর কী সুন্দর শব্দ হচ্ছে দেখেছ? শির শির এক রকম শব্দ!
সবাই মাথা নাড়ল, টিয়া বলল, পাখির ডাকগুলো শুনছ? কী রকম অদ্ভূত পাখির ডাক! মনে হয় অন্য দুনিয়া থেকে ডাকছে।
টিটন বলল, বাতাসটা একদম পরিষ্কার। পিওর অক্সিজেন। একবার শ্বাস নিলেই ফুসফুস পরিষ্কার হয়ে যায়।
রিতু বলল, আর দেখেছিস কী সুন্দর একটা বাতাস আসছে। বাতাসের মাঝে কেমন যেন একটা ফুলের গন্ধ।
তিতু বলল, চারিদিক একেবারে নীরব। কোনো শব্দ নাই। গ্রামের সব মানুষ মনে হয় সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যায়।
এরকম সময় মিঠুন বলল, রিতু আপু। একটা ভূতের গল্প বলবে?
রিতু বলল, ভূতের গল্প? এখন?
হ্যাঁ। এখন।
টিয়া বলল, অনেক ভয় করবে।
মিঠুন বলল, ভয় পাওয়ার জন্যই তো ভূতের গল্প। বল না আপু। প্লিজ।
তিতু আর টিটন বলল, হ্যাঁ আপু, বল।
রিতু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, আমি যখন আরো ছোট, তোদের জন্ম হয় নাই কিংবা জন্ম হলেও তারা খুবই ছোট তখন নানি একটা গল্প বলেছিল। সেই গল্পটা বলি?
হ্যাঁ হ্যাঁ বল।
এইটা নানি শুনেছিল তার মামার কাছ থেকে। অনেকদিন আগের কাহিনি তখন রেডিও টেলিভিশন ছিল না, ইলেকট্রিসিটি ছিল না গাড়ি ঘোড়া ছিল না, মানুষেরা একটা গ্রামে থাকত, গ্রামের বাইরে কিছু আছে কিনা সেইটাও গ্রামের মানুষেরা জানত না। এইটা সেই সময়ের গল্প।
মিঠুন উৎসাহ নিয়ে বলল, বল রিতু আপু বল।
গেস্ট হাউজের সিঁড়িতে অন্ধকারে পাঁচজন বসে আছে, চাঁদের আলোতে সবাইকে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে সুনশান নীরবতা, শুধু মাঝে মাঝে রাত ডাকা পাখির শব্দ। হঠাৎ হঠাৎ বহু দূর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। এর মাঝে রিতু নানির কাছ থেকে শোনা গল্পটা বলতে শুরু করল, ঠিক নানি যেভাবে বলেছিল সেভাবে:
আমার ছোট মামা মফিজের বয়স তখন বেশি না। সেই সময় স্কুল কলেজ ছিল না তাই কেউ লেখাপড়া করত না। মফিজ ও লেখাপড়া করে নাই। বাবার জমি ছিল সেখানে চাষবাস করে দিন কেটে যেত। মফিজের খুব মাছ ধরার সখ। যেই সময়ের কথা বলছি তখন কেউ বাজার থেকে মাছ কিনতো না। বাড়িতে পুকুরে মাছ থাকত, খালে মাছ থাকত, নদীতে মাছ থাকত আর সবচেয়ে বেশি মাছ থাকত বিলে। যার মাছ খাওয়ার সখ থাকত তারা খাল বিল নদী কিংবা পুকুর থেকে মাছ ধরে আনতো।
মফিজের একজন বন্ধু ছিল সুলতান। সে মফিজ থেকে এক দুই বছর বড়। মফিজের মতো সুলতানেরও খুব মাছ ধরার সখ। দুই বন্ধু মিলে মাঝে মাঝেই বিলে মাছ ধরতে যেত। সেবার খুব শীত পড়েছে, এই শীতের মাঝে দুই বন্ধু সুলতান আর মফিজ ঠিক করল তারা বিলে মাছ মারতে যাবে। তবে তারা যাবে গোপনে।
গোপনে যাওয়ার একটা কারণ আছে, তারা ঠিক করল তারা মাছ মারবে বাঘামারি বিলে। বাঘামারি বিল বাড়ি থেকে অনেক দূরে, নৌকা করে যেতেই ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। দুইজন জোয়ান মানুষ ঘণ্টাখানেক নৌকায় যাওয়া তাদের জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এই বিলটার দোষ আছে, রাত্রিবেলা অনেক দূর থেকে এই বিলে মানুষের কান্না শোনা যায়। অমাবস্যার সময় বিলের মাঝে হালকা সবুজ রঙের আলো দেখা যায়, আলোগুলো বিলের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। এই বিলে দিনের বেলাতেই মানুষ যেতে ভয় পায়, রাতের বেলা তো প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু সুলতান আর মফিজ দুইজনেরই অনেক সাহস। দুইজন একসাথে থাকলে জীন ভূত কোনোটাই তারা ভয় পায় না। তবে বাড়ির মুরব্বিরা শুনলে তাদের যেতে দিবে না। তাই তারা ঠিক করলো কাউকে না জানিয়ে গোপনে যাবে। মফিজ ঠিক করল, এই রাতে সে বাইরের বাংলা ঘরে ঘুমাবে। মাঝরাতে সুলতান এসে ঘরের দরজায় শব্দ করলেই সে উঠে যাবে। তারপর দুই বন্ধু রওনা দিবে বাঘামারি।
যেভাবে ঠিক করেছিল ঠিক সেভাবে মফিজ বাংলা ঘরের চৌকিটাতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। অনেক শীত পড়েছে। সাথে কুয়াশা। এক কাঁথাতে শীত মানে না। তাই মফিজ মাটির মালসাতে একটু আগুন করে নিয়েছে। আগুনে হাত পা সেঁকে একটু গরম হয়ে সে ঘুমাতে গেছে। কাছেই মালসাটা রেখেছে, তুষের আগুন সেখানে ধিকি ধিকি করে জ্বলছে।
সেই সময় কোনো ঘড়ি ছিল না। রাত দুপর হয়েছে না ভোর রাত হয়েছে পুরোটাই অনুমানের উপর। আকাশে চাঁদ থাকলে চাঁদটা দেখে সময়ের আন্দাজ করা যেত কিন্তু রাতটা অমাবস্যার তাই আকাশে চাঁদ নাই।
ভোর রাতে দরজায় শব্দ হলো, মফিজ বুঝল সুলতান এসে গেছে। মফিজ বিছানা থেকে নেমে বলল সুলতান ভাই, আসছ?
বাইরে থেকে সুলতান একটা অস্পষ্ট শব্দ করল। চাদর মুড়ি দিয়ে থাকলে কথাবার্তা ভালো বোঝা যায় না তাই মফিজ বেশি অবাক হলো না।
মফিজ দরজা খুলে দিল, বাইরে অন্ধকারে সুলতান দাঁড়িয়ে আছে, অনেক শীত, তাই চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ মুখ মাথা সব ঢেকে রেখেছে। অন্ধকারের কারণেই কিনা কে জানে সুলতানকে দেখতে অনেক খাটো লাগছে কিন্তু মফিজ সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না। বলল, সুলতান ভাই, হুঁকোটা ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে যাই। শরীরটা গরম হোক।
সুলতান কিছু বলল না। মফিজ হুঁকো ধরিয়ে গুড়ক গুড়ক করে। কয়েকটা টান দিয়ে শরীরটা গরম করে নিয়ে সেটা সুলতানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও সুলতান ভাই। কয়টা টান দিয়ে নাও।
সুলতান হুঁকোটা দেখে আরো পিছিয়ে গেল হুঁকো খেতে চাইল না। তখন মফিজ খুব অবাক হলো, এই শীতের রাতে একজন হুঁকোয় দুটো টান দিতে চাইবে না সেটা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু যদি কেউ হুঁকো খেতে চায় না তখন তো আর জোর করা যায় না।
মফিজ মাছ মারার সরঞ্জামগুলো নিয়ে নেয়। একটা গোল জাল, একটা কোচ আর মাছ ধরার জন্য পলো। কোচ হচ্ছে বর্শার মতো, তবে বর্শার ফলা থাকে একটা, কোচের ফলা অনেকগুলো।
ঘরের দরজা বন্ধ করে মফিজ বের হয়ে আসে। সুলতান সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করে, মফিজ পিছু পিছু হটে। নিশুতি রাত কুয়াশায় ঢাকা। গ্রামের পথ দিয়ে দুজন হেঁটে যাচ্ছে দুই পাশে গাছ গাছালি, উপরে তারা ঢাকা একটা আকাশ। মফিজ জোরে জোরে হাঁটে কিন্তু সুলতানকে ধরতে পারে না। সে সামনে দিয়ে আরো জোরে হাঁটে, কিছুতেই তাকে ধরা যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে সুলতান যে এত জোরে হাঁটছে তার পায়ের কোনো শব্দ নেই, সে একেবারে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে।
যাই হোক দুজনে হেঁটে খালের ধারে পৌঁছেছে। সেখানে নৌকাটা বাধা আছে। সুলতান নৌকার গলুইয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসল। মফিজ মাছ ধরার সরঞ্জাম নৌকার মাঝখানে রেখে নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে পানির ভিতর নামিয়ে লাফিয়ে নৌকার উঠে বৈঠা বাইতে শুরু করল।
শীতের রাত ছপাৎ ছপাৎ করে বৈঠা বেয়ে মফিজ খাল বেয়ে নৌকা নিয়ে যায়। খাল থেকে নৌকা নদীতে পড়ল, নদী থেকে বাঘমারা বিলে। বিলের ভেতর নৌকা ঢুকিয়ে মফিজ লগি দিয়ে নৌকা নিয়ে যায়। নৌকার গলুইয়ে সুলতান চুপচাপ বসে আছে, সে কোনো কথা বলে না, কোনো শব্দ করে না।
বিলের মাঝখানে নৌকাটা নিয়ে মফিজ মাছ ধরতে শুরু করল। জাল ফেলে সেটা টেনে তুলতে পারে না। জালে এতো মাছ ধরেছে। মাছগুলো নৌকায় পাটাতনে ফেলে সে আবার জাল ফেলল। তারপর আবার। দেখতে দেখতে নৌকা প্রায় মাছে বোঝাই হয়ে যাবার অবস্থা।
এরকম সময় মফিজ কেমন যেন খচমচ শব্দ শুনতে পায়, মনে হতে থাকে মাছগুলো যেন কেউ কচমচ করে খাচ্ছে। নৌকার মাঝে মাছ কে খাবে? মফিজ বেশি গুরুত্ব দিল না সে মাছ মেরেই চলল।
তখন হঠাৎ করে তার মনে হলো আশেপাশে কেমন যেন ফিস ফিস শব্দ, মনে হচ্ছে কেউ ফিস ফিস করে কথা বলছে। সে মাথা ঘুরিয়ে সুলতানের দিকে তাকাল এবং সাথে সাথে তার শরীর হিম হয়ে গেল। সে দেখল চাদর মুড়ি দেওয়া মানুষটি, যাকে সে এতক্ষণ সুলতান ভেবে আসছে। সে মোটেও সুলতান নয়। সে তার লম্বা কালো হাত বাড়িয়ে এক সাথে অনেকগুলো মাছ ধরে মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না কিন্তু সেই প্রাণীটার অনেক বড় একটা মুখ, সেই মুখে মাছগুলো ঢুকিয়ে কচমচ করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।
এতক্ষণ চাদর দিয়ে মুখ মাথা ঢেকে রেখেছিল, এখন চাদর খসে পড়েছে, প্রাণীটার মাথা দেখা যাচ্ছে। এমনিতে অন্ধকার কিন্তু তারার আলোতে আবছা দেখা যায় প্রাণীটার বড় একটা মাথা। চোখগুলো লাল অঙ্গারের মতো জ্বলছে। নাক নেই সেখানে দুটো গর্ত, আর অনেক বড় একটা মুখ। মুখের ভিতর থেকে লকলকে একটা জিব বের হয়ে আসছে সেই জিব টান দিয়ে মাছগুলোকে মুখের ভিতর নিয়ে যাচ্ছে। যখনই মুখ খুলছে একটা পচা গন্ধ বের হয়ে আসছে, পুরো নৌকায় পচা একটা গন্ধ।
মফিজ যত মাছ ধরেছিল প্রাণীটা সব মাছ খেয়ে ফেলে মুখ দিয়ে এক ধরনের শব্দ করছে। মনে হচ্ছে আরো মাছ খেতে চায়। কিন্তু মফিজের তখন আর মাছ ধরার ক্ষমতা নাই। সে বিস্ফারিত চোখে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার সমস্ত শরীর কুল কুল করে ঘামছে। অন্ধকার নির্জন বিল তার মাঝে সে একা।
প্রাণীটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, শরীর থেকে চাদরটা খসে পড়েছে। বড় মাথা, মাথায় কোনো চুল নাই, লম্বা লম্বা হাত, উঁচু কাঁধ। পাগুলো খাটো। প্রাণীটা থপ থপ করে পা ফেলে মফিজের দিকে এগিয়ে আসে। মফিজ বুঝতে পারে মাছ খেয়ে প্রাণীটার খিদে মিটেনি, সে এখন আরো খাবে।
মফিজ তখন হাত বাড়িয়ে কোচটা তুলে নেয়। তারপর সেটা হাতে নিয়ে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে থাকে। জান্তব একটা শব্দ করে প্রাণীটা দুলতে দুলতে এগিয়ে আসতে থাকে, যখন আরেকটু কাছে এসেছে তখন মফিজ কেঁচটা তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণীটাকে সেখানে গেঁথে ফেলল।
প্রাণীটা অমানুষিক একটা চিৎকার করে ছটফট করতে থাকে, কোচ থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু মফিজ সেটাকে ছাড়ল না, কোচের মাথায় ধরে রেখে প্রাণীটাকে নৌকায় পাটাতনে ঠেসে ধরে রাখল।
কতক্ষণ ধস্তাধস্তি করছিল মনে নেই হঠাৎ মনে হলো কা কা করে একটা কাক ডাকছে, মফিজ অবাক হয়ে দেখল কোচের আগায় কোনো ভয়ংকর প্রাণী নেই, একটা বড় দাঁড়কাক সেখানে গেঁথে আছে। কা কা শব্দ করতে করতে কাকটা মরে গেল।
মফিজ অবাক হয়ে কাকটার দিকে তাকিয়ে রইল। ভয়ে আর আতংকে তার শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। এরপর তার আর কিছু মনে নেই।
পরদিন মানুষজন বাঘমারা বিল থেকে মফিজকে উদ্ধার করল। আসল সুলতান মাছ মারার জন্য মফিজের বাড়ি গিয়ে দেখে মফিজ নাই। তখনই তার কিছু একটা সন্দেহ হয়েছে। দিনের আলো হলে লোকজন নিয়ে বাঘমারা বিলে গিয়ে দেখে সত্যিই একটা নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছে। নৌকার পাটাতনে মফিজ অজ্ঞান হয়ে আছে। মুখে ফেনা, সারা শরীর থেকে পিচ্ছিল এক ধরনের তরল বের হচ্ছে। মফিজ তখনো কোচটা ধরে রেখেছে, কেঁচের মাঝে গেঁথে রেখেছে একটা মরা কাক।
মফিজ কিছু দিন পাগলের মতো হয়েছিল। তাবিজ কবজ ঝাড়ফুঁক দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভালো হয়েছে। আর কোনোদিন সে বাঘামারা বিলে মাছ ধরতে যায়নি।
.
রিতু গল্প শেষ করতেই সবাই ভয় পাওয়ার মতো শব্দ করল। কেউ আর উঠতে সাহস পায় না। অনেকক্ষণ পর টিটন বলল, আপু তোমার গল্পের মাঝে কিছু লজিকের সমস্যা আছে। যেমন মনে করো।
টিয়া বাধা দিয়ে বলল, থাকুক। এখন আর এইটা নিয়ে কোনো কথা বলো না প্লিজ।
কাজেই কেউ আর কোনো কথা বলল না। সবাই উঠে একজন আরেকজনকে ধরে জড়াজড়ি করে ভেতরে ঢুকে গেল।
তারা যদি বাইরে তাকাতো, তাহলে দেখতে একজন মানুষ গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে গেস্টহাউজটার দিকে তাকিয়ে আছে।