মৌর্যবংশের পরে
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের কাছাকাছি বৃহৎ সুসংহত মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটার পরে ভারতবর্ষে এমন কোনও কেন্দ্রীয় রাজশক্তি রইল না যা অত বড় অঞ্চলের উপর ওই রকম আধিপত্য বিস্তার করতে পারত। এই সময়ে শুরু হল বিদেশি আক্রমণ, যার প্রথম সূত্রপাত অবশ্য শ’খানেক বছর আগে গ্রিক আক্রমণে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, মধ্য এশিয়ার সঙ্গে নতুন এক সংযোগ ঘটল। পূর্ব ভারত, মধ্য ভারত ও দাক্ষিণাত্যে মৌর্য প্রভাব সরে যাওয়ার পরে দেখা দিল শুঙ্গ, কাণ্ব ও সাতবাহন রাজারা।
আফগানিস্তানের গ্রিক রাজ্য ব্যাকট্রিয়া থেকে বারেবারে ভারতবর্ষে আক্রমণ চলে। পারস্যে গ্রিক রাজশক্তির প্রতিনিধি সেলিউকাসের শক্তি ক্রমে ক্ষয় হয়। শকরা ব্যাকট্রিয়া ও পাৰ্থীয় রাজ্যে হানা দেয়। শকদের চাপে পড়ে ব্যাকট্রিয়ানরা ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। অশোকের দুর্বল উত্তরাধিকারীদের কোনও আক্রমণ ঠেকাবারই শক্তি ছিল না। ব্যাকট্রিয়ানরা আসে পাটলিপুত্রে; এরা কিন্তু কোনও সুসংহত রাজ্য স্থাপন করতে পারেনি। মিনাণ্ডার— ওই দেশের সাহিত্যে মিলিন্দ– (১৩৫-১৪৫] খ্রি.পূ.) গঙ্গা যমুনার দোয়াবে রাজ্য স্থাপন করেন। বৌদ্ধ পণ্ডিত নাগসেন (মতান্তরে নাগার্জুন) তাঁকে বহু প্রশ্নোত্তরের পরে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন। এগুলি সংকলিত আছে মিলিন্দপঞহ নামক গ্রন্থে। এই ইন্দো-গ্রিক সাম্রাজ্যটি ছোট ও স্বল্পস্থায়ী হলেও এর একটা গুরুত্ব আছে; এই সময়েই প্রথমে টাকশালে রাজার নামে মুদ্রা তৈরি হল; এর আগের মুদ্রা ছিল বাণিজ্যের জন্যে, কোনও রাজবংশের জন্যে নয়। দ্বিতীয়ত, গ্রিক শিল্পের একটি লক্ষণীয় প্রভাব দেখা গেল বিজিত রাজ্যগুলির শিল্পের ওপরে। এই প্রভাবে ভারতবর্ষে যে শিল্প রীতি জন্ম নিল তার নাম ‘গান্ধার শিল্প’, এই রীতির ভাস্কর্যে আমরা বুদ্ধের মূর্তি ও অন্যান্য শিল্পকর্মের নিদর্শন পাই। শুধু মুদ্রা ও শিল্পেই এ প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল না; দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগের ফলে নাটকে সাহিত্যেও কিছু কিছু গ্রিক প্রভাব দেখা গেল।
গ্রিকদের পরে আসে শকরা। এরা যদিও গ্রিকদের তুলনায় ভারতবর্ষের অনেক বেশি অঞ্চল দখল করে তবু এদের রাজশক্তির কোনও একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র ছিল না। একদল রইল আফগানিস্তানে আর একদল এল পঞ্জাবে, এই দ্বিতীয়দের রাজধানী ছিল তক্ষশিলা। মথুরায় যারা পৌঁছল তারা প্রায় দুশো বছর ধরে রাজত্ব করেছিল। চতুর্থ দলটি পশ্চিম ভারতে দীর্ঘকাল রাজত্ব করে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত। পঞ্চম দলটির রাজ্য ছিল উত্তর দাক্ষিণাত্যে। শকদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা খুব বেশি বা খুব সফল প্রতিরোধ করতে পারেনি। শুধু খ্রিস্টপূর্ব ৫৮ সালে উজ্জয়িনীর এক রাজা বিক্রমাদিত্য শকদের তাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন, তাই খ্রিস্টপূর্ব ৫৭] সাল থেকে তাঁর নামেই ‘বিক্রম সংবৎ’ প্রবর্তিত হয় এবং পরের বিজয়ী রাজারা ‘বিক্রমাদিত্য’ নামটি গৌরবের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেন; ফলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মোট চোদ্দটি ‘বিক্রমাদিত্য’ পাওয়া যায়।
শকরা যদিও ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে রাজত্ব করেছিল, তবু পশ্চিম ভারতেই এরা সবচেয়ে বেশি দিন, প্রায় চার দশক ধরে রাজত্ব করে। এখানকার রাজাদের মধ্যে রুদ্রদামা (১৩০-১৫০] খ্রিস্টাব্দ) সবচেয়ে বিখ্যাত। ইনি সিন্ধু গুজরাত, মালব, কাঠিয়াবাড় ও নর্মদা উপত্যকা জুড়ে বিস্তৃত ভূখণ্ডের রাজা ছিলেন। এঁর একটি শিলালিপিতে পড়ি আশপাশের অনুর্বর জমিকে উর্বর করবার জন্যে ইনি মৌর্য আমলের ‘সুদর্শন’ হ্রদটির সংস্কার করেন। রুদ্রাদামা সংস্কৃতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নিজে বিদেশি হলেও এঁর দীর্ঘ শিলালিপিটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত, এটিই এ দেশে প্রথম সংস্কৃত শিলালিপি।
শকদের পরে খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে ইরানের আর এক গোষ্ঠী পহ্লবরা (পার্থীয়) উত্তর পশ্চিম অঞ্চল দখল করে। শক ও পহ্লব দু’ দলই ইরান থেকে আসে এবং ভারতীয় সাহিত্যে মাঝেমাঝেই এদের শক-পহ্লব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পহ্লবদের প্রধান রাজার নাম গন্ডোফার্নেস। শকদের মতো এরাও ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের জনসমাজে নিশ্চিহ্ন ভাবে মিশে যায়।