৮
খালেক হাসিমুখে বলল, স্যার, আগামী পরশু আমার মেয়ের জন্মদিন।
জোয়ার্দার ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বললেন, ও আচ্ছা।
খালেক বলল, স্যার, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আপনি প্রধান অতিথি।
জোয়ার্দার বিস্মিত গলায় বললেন, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকে?
প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি সবই থাকে।
জানতাম না তো।
খালেক বলল, অফিস ছুটি হলে আমি আপনাকে নিয়ে যাব। ঠিক আছে স্যার?
হুঁ।
জোয়ার্দার চাচ্ছেন যেন খালেক তাড়াতাড়ি এই ঘর ছেড়ে যায়। তাঁর টেবিলের নিচে কুফি বসে আছে। এই দৃশ্য তিনি অন্যদের দেখাতে চান না। নানান প্ৰশ্ন করবে। সব মানুষের কৌতূহল এভারেস্টের চূড়ার মতো।
খালেক বলল, স্যার, আপনার এখানে একটু বসি? এক কাপ চা খেয়ে যাই।
জোয়ার্দার আমতা আমতা করে বললেন, একটা জরুরি কাজ করছিলাম।
তা হলে আর বিরক্ত করব না। পরশু দিন ছুটির পর আপনাকে নিয়ে যাব।
খালেক ঘর থেকে বের হতেই জোয়ার্দারের মন সামান্য খারাপ হল। তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন এ কারণেই খারাপ লাগছে। তিনি কোনো জরুরি কাজ করছেন না। প্রমোশন পাবার পর তাঁর কাজ কমে গেছে। এসি ছেড়ে ঘর ঠাণ্ডা করে চুপচাপ বসে থাকাই এখন তাঁর প্রধান কাজ।
বিড়ালটা এক অর্থে তাঁর সময় কাটাতে সাহায্য করছে। কাল দুপুরের পর সে একটা ইঁদুর ধরেছে। বিড়াল ইঁদুর ধরে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে না। অনেকক্ষণ তার সঙ্গে খেলে, তারপর মারে। এই কথা তিনি শুনেছেন, আগে কখনো দেখেন নি। কালই প্রথম দেখলেন। ইঁদুরের বুদ্ধি দেখেও চমৎকৃত হলেন। বিড়ালের হাত থেকে একবার ছাড়া পেয়ে ভালো খেলা দেখাল। দৌড়ে সামনে যাচ্ছে হঠাৎ ১৮০ ডিগ্রি টার্ন নিয়ে উল্টা দৌড় শুরু করছে। বিড়াল বিভ্রান্ত। শেষ পর্যন্ত ইঁদুরটা পার্টিশনের একটা ফাঁক বের করে পালিয়ে গেল। বিড়াল হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল। জোয়ার্দার বিড়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকে বুদ্ধিতে হারিয়ে দিয়েছে। তোর মন খারাপ বুঝতে পারছি। হেরে গেলে সবার মন খারাপ হয়। আমি প্রায়ই বুদ্ধিতে আমার মেয়ের কাছে হেরে যাই। আমারও খানিকটা মন খারাপ হয়। আমার মেয়েকে তুই চিনিস? অনিকা তার নাম।
বিড়ালের মনে হয় কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। সে জোয়ার্দারের টেবিলের নিচে ঢুকে তাঁর চোখের আড়াল হয়ে গেল। জোয়ার্দার অবিশ্যি কথা বন্ধ করলেন না। চালিয়ে যেতে থাকলেন। তিনি বললেন, বেশি বুদ্ধি থাকা কোনো কাজের কথা না। এজন্য বাংলা ভাষায় বাগধারা আছে ‘অতিচালাকের গলায় দড়ি’। আমার শ্যালক রঞ্জুর অসম্ভব বুদ্ধি। অর্থাৎ অতিচালাক। এ কারণেই তার গলায় দড়ি পড়েছে। বিরাট ঝামেলায় আছে। কী ঝামেলা সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না। আমার স্ত্রী তাকে নিষেধ করে দিয়েছে সে যেন বাসায় কখনো না আসে।
এই কুফি একটু বের হ। তোর ছবি তুলব। শায়লা তোর ছবি দেখতে চাচ্ছে। তোর কথা শায়লাকে বলেছি। সে বিশ্বাস করে না। ছবি দেখলে বিশ্বাস করবে।
কুফি আড়াল থেকে বের হল। জোয়ার্দার তার বেশ কিছু ছবি তুললেন। সে আপত্তি করল না। জোয়ার্দার বললেন, বাড়িতে বিরাট ঝামেলা হচ্ছে। অফিসে আমি আরামে আছি।
কুফি বলল, মিঁয়াও।
বাড়ির ঝামেলাটা কী তা জানার কোনো আগ্রহ জোয়ার্দার বোধ করছেন না। সুলতানা তাঁকে জানাতে চাইছে না। কী দরকার জানার চেষ্টা করা?
ঝামেলাটা ঘটায় সুলতানার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কিছু উন্নতি হয়েছে। সুলতানা আগের মতো কথায় কথায় চেঁচিয়ে উঠছে না। এটা অনেক বড় ব্যাপার।
কাজের মেয়ে দুটো এখন বাসায় থাকছে না। অনিকার কাছে শুনেছেন তারা রঞ্জুর কাছে আছে। সুলতানা নতুন বুয়া রেখেছেন। তার নাম সালমা। দেখতে রাক্ষসীর মতো। তবে মেয়েটা কাজের। জোয়ার্দারের কখন কী লাগবে বুঝে গেছে। আগের দু’জন সাজগোজ নিয়েই থাকত। সালমা সাজগোজের কী করবে? রাক্ষসীকে সাজতে হয় না।
কী ভাবছেন?
জোয়ার্দার চমকে উঠলেন। তাঁর টেবিলের পাশে আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম নেবার জন্য একটি বেতের ইজিচেয়ার আছে। সেখানে বরকতউল্লাহ বসে আছেন। বিড়ালটা এখন বসেছে চেয়ারের নিচে। দু’জনই তাকিয়ে আছে জোয়ার্দারের দিকে।
বরকতউল্লাহ বললেন, এসির টেম্পারেচার এত কম রেখেছেন! ঘরটা তো ডিপ ফ্রিজ হয়ে গেছে।
টেম্পারেচর কি বাড়িয়ে দেব?
না, থাক।
জোয়ার্দার বললেন, আপনার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
বরকতউল্লাহ বললেন, কোন ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না?
আপনি কোত্থেকে আসেন? কীভাবে আসেন?
এটা না বোঝার কী আছে?
আপনি যে মারা গেছেন এটা জানেন?
বরকতউল্লাহ বললেন, আপনার সমস্যা কী? উল্টাপাল্টা কথা বলছেন কেন?
জোয়ার্দার লজ্জিত গলায় বললেন, কিছু কি খাবেন? চা বা কফি।
না।
জোয়ার্দার বললেন, আমার ধারণা আমার মাথায় কোনো ঝামেলা হয়েছে।
বরকতউল্লাহ বললেন, হতে পারে। ভালো ডাক্তার দেখান। সাইকিয়াট্রিস্ট।
জোয়ার্দার বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন।
বরকতউল্লাহ বললেন, দেরি করবেন না। প্রথম অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসা করে কন্ট্রোল করা যায়। আমার ছোট বোন নাইমা ব্রেস্ট ক্যানসারে মারা গেল। শুরুতে ধরা পড়লে ব্রেস্ট ক্যানসার কোনো ব্যাপারই না। তিনটা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তার স্বামী কী বিপদেই না পড়েছে।
বরকতউল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা যাই। কাজ করছিলেন, কাজের মধ্যে ডিস্টার্ব করলাম।
বরকতউল্লাহ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। বিড়ালটাও পিছু পিছু গেল। কেউই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল না।