মৃগনাভিচূর্ণ রাগোত্তেজনা প্রগাঢ়তর করতে পারে এবং শোনা যায়, ক্ষেত্র বিশেষে রাগমোচন বিলম্বিতও করে থাকে। কিন্তু তারও শেষ আছে। এক সময় ক্লান্ত দুই শরীরের স্বেদে শয্যা যখন সিক্তপ্রায়, তখন মায়াবতীর শরীরে যেন তার সমস্ত বিরহকালের ঘুম এসে নামলো, তারপর আর কিছু সে জানে না।
রাত্রির শেষ যামে যখন জাগলো, তখন দেখে, দ্বার অর্গলমুক্ত এবং বসন্তদাস শয্যায় নেই। বাইরে তখনও ঘোর অন্ধকার। বন্য কুক্কুট সবে দুটি একটি ডাকছে। প্রথমে মনে হলো, শারীরিক প্রয়োজনে হয়তো বসন্তদাসকে বাইরে যেতে হয়েছে। কিন্তু সম্ভাব্য সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরও যখন সে এলো না, তখন মায়াবতীর চিন্তা হতে লাগলো, মানুষটা গেলো কোথায়? জননীকে ডাকবে কিনা এ চিন্তায় যখন সে দ্বিধান্বিতা, তখনই দেখলো, সন্তর্পণে বসন্তদাস কক্ষে প্রবেশ করছে।
কোথায় যাওয়া হয়েছিলো? সে জিজ্ঞাসা করে।
ঐ প্রশ্নে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়াবতাঁকে দেখে বসন্তদাস। তারপর বলে, বাইরে।
স্বামীর ঐ সংক্ষিপ্ত উত্তর মায়াবতাঁকে বিমূঢ় করে দেয়। শুধু উত্তরের সংক্ষিপ্ততাই নয়। দেখে স্বামীর মুখে বিচিত্র গম্ভীর একটি ভাব–যা পূর্বে সে কখনও দেখেনি। দীপে তখনও তৈল ছিলো। সে স্বামীর মুখপানে বারবার দৃষ্টিপাত করছিলো। রাত্রিকালের আলিঙ্গনাবদ্ধ স্বামী রাত্রি বিগত হলেই কেমন করে অচেনা হয়ে যায় সে ভেবে পাচ্ছিলো না। শুধু একটি কথা ঐ মুহূর্তে তার স্মরণ হলো। কথাটি বিবাহ রাত্রে মালিনী আয়ী বলেছিলো। বলেছিলো, দেখিস লো, পুরুষ বড় চঞ্চলমতি হয়–অঞ্চলে বেঁধে রাখিস, যেন পলায়ন না করতে পারে।
স্বামীর একেকদিনের ঐ প্রকার রহস্যময় অন্তর্ধান এবং আবির্ভাব তাকে স্বস্তিবিহীন করে তুললো। একদা যখন রাত্রির প্রথম যামেই বসন্তদাস চলে গেলো এবং সারা রাত্রি ফিরলো না–তখন মায়াবতী ভেঙে একেবারে লুটিয়ে পড়লো। সমস্ত রাত্রি সে কাঁদলো। কিন্তু তখনও সে বাইরে কারও কাছে ব্যাপারটা প্রকাশ করেনি। সারারাতের রোদনে তার মুখে মলিন প্রচ্ছায়া দেখা দিয়েছিলো। জননী উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করলে সে সত্য গোপন করে বললো, শরীর অসুস্থ বোধ হচ্ছে মা, অন্য কিছু নয়। এবং ঐ সময়ই পিতা শুকদেব একদা জানালেন, বৎসে, জামাতাকে বলল সে যেন ভিক্ষু ও যোগীদের সান্নিধ্য পরিহার করে। এমনিতে তো কায়স্থ পল্লীর লোকেরা আমার প্রতি বিরূপ এবং বিদ্বষ্ট। এখন ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সৌহার্দ্যের কথা যদি কেউ সামন্তপতির গোচরে আনে, তাহলে আমাদের সবাইকে বিপদে পড়তে হবে।
মায়াবতী সেদিন শয্যায় দুবাহু দিয়ে স্বামীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে রাখলো। মুহূর্তের জন্য নিদ্রা গেলো না এবং বাহুবন্ধনও শিথিল করলো না। বসন্তদাস নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে সে বাহুবন্ধন আরও দৃঢ় করলো। বললো, আমি তোমাকে যেতে দেবো না। মধ্যরাতে তুমি কোথায় যাও? ভয়ে আমার প্রাণ কাঁপে–পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির কথা তুমি জানো–তবু
বসন্তদাস যুবতী পত্নীর শরীরে সস্নেহ হাত বুলায়। বলে, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। মায়াবতী, আমি কোনো পাপকর্মে লিপ্ত নই–তোমার পিতা আর মাতুলকে বলল, আমি যা করছি, সকলের মঙ্গলের জন্যই করছি।
কী কাজ করো তুমি? মায়াবতী জানতে চায়।
সে কথা এখন নয়, সময় হলে তোমাকে বলবো।
মায়াবতী মরমে মরে যায়। তার দেহসৌষ্ঠব, তার সৌন্দর্য, তার যৌবন–কোনো কিছুই স্বামীকে ধরে রাখতে পারছে না। তার দুচোখে এক অচেনা রহস্য। যখন বাইরে দৃষ্টিপাত করে, তখন মনে হয়, যেন দিগন্ত অতিক্রম করে যাচ্ছে তার দৃষ্টি। যখন ভ্রূকুঞ্চিত করে, তখন মনে হয় না যে ঐ জ্বরেখা আর কখনও সরল হবে।
সে সখী লীলাবতীকে জানায় ব্যাপারটা। বলে, সখী, আমার বড় ভয় করে।
লীলাবতী হাসে। বলে, ভয়ের কিছু নেই, তোর পুরুষ বোধ হয় কোনো কারণে চিন্তাগ্রস্ত–তুই জেনে নে, কী চিন্তা করে ও।
মায়াবতী ঐ রাত্রে স্বামীকে বিশেষ অস্থির দেখলো। বারে বারে সে বাইরে যাচ্ছে। স্বামীর ঐভাব দেখে এক সময় সে স্বামীর দুই পা জড়িয়ে ধরে। বলে, তোমাকে বলতে হবে, তুমি কেন চঞ্চল হয়েছে, কেন তুমি চিন্তাগ্রস্ত আর অস্থির?
বসন্তদাসের বিরক্তি লাগে প্রথমে। তারপর, পদযুগলে স্ত্রীর কোমল বক্ষস্পর্শ, অশ্রুসজল নয়ন এবং বাহু দুটির সজোর আকর্ষণ তাকে কিঞ্চিৎ বিহ্বল করে দেয়। স্ত্রীকে সে দুহাতে তুলে এনে শয্যায় বসায়। তারপর তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বলে, মায়া, তুমি আমার গোপন কথা জানতে চাও–কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমার গোপন কোনো কথা নেই। পিপ্পলী হাটে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা করি। আমি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বাধা দেবার চেষ্টা করছি। কীভাবে, সে প্রশ্ন করো না। শুধু আমাকে তুমি বিশ্বাস করো। সম্মুখের কাল বড় ভয়াবহ। আসন্ন ঐ দুর্যোগের কালে অবিশ্বাস ও সন্দেহের অনুপ্রবেশ ঘটলেই আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। বিশ্বাস আর ভালবাসায় আমাদের সংহত এবং দৃঢ় হতে হবে।
মায়াবতীর দেহ শিথিল হয়ে আসে। সে বসন্তদাসের কথা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে। বক্ষের ভেতরে ভয় থর থর করতেই থাকে। তারপর স্বামীর মুখের ঐ দুটি কথা তার মনে মুদ্রিত হয়ে যায়। বিশ্বাস এবং ভালবাসা! আহা কী সুন্দর কথা! মায়াবতীর চিন্তা ক্রমে সহজ হয়ে আসে। বিশ্বাস করি বলেই তো ভালবাসি–আর যদি ভালবাসতে পারলাম, তাহলেই তো আর কোনো ভয় নেই আমার, আমি তখন মুক্ত, নিঃসংকোচ এবং দায়হীন।
বসন্তদাস জানে যে তার আচরণ অনেকের কাছেই বিসদৃশ ঠেকছে। মায়াবতীর মাতুল দীনদাস বুদ্ধিমান লোক। তিনি প্রায় ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন কয়েকদিন। গ্রামের অন্যান্য লোকেদের কৌতূহলের ব্যাপারটাও তার অগোচর নয়। পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি যেভাবে ত্রাস, এবং আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, তাতে বৌদ্ধ ভিক্ষু দর্শন মাত্র যে তারা অস্থির হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য কি! সে জানে, ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সংস্রব কেউই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। কিন্তু তার নিজেরও উপায় নেই।
মিত্রানন্দের লোক বারবার আসছে। প্রত্যেকবারেই তাদের ঐ এক কথা। আর সহ্য হয় না, তোমরা গ্রামবাসীদের জানিয়ে দাও, আমরা যবন জাতিকে ডেকে আনতে চাই। প্রতিবার ওরা আসছে প্রস্তাব নিয়ে, আর প্রতিবারই বসন্তদাস তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। বলছে, এখনও সময় হয়নি, মিত্রানন্দকে বলো, সময় হলে আমিই সংবাদ দেবো।
মিত্রানন্দের লোকেদের সঙ্গে তাকে দীর্ঘ আলাপে বসতে হচ্ছে। বোঝাতে হচ্ছে, যবন জাতি বহিরাগত–তারা এলে তুমি আমি কেউ থাকবো না। আর জেনো, তারা শুধু রাজ্য জয়ই করছে না–ধর্মকে পর্যন্ত জয় করে নিচ্ছে। এ বড় চিন্তার কথা–এমতাবস্থায় আমাদের চিন্তা করা উচিত, আমরা কী করবো। এক সন্ত্রাসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য যদি আমরা আরেক সন্ত্রাসের মধ্যে নিপতিত হই, তাহলে সেটা কোনো কাজের কথা নয়।
বসন্তদাসের কথায় ভিক্ষুরা নীরব থাকে। শুধু অপলক চক্ষুর স্থির দৃষ্টি মেলে রাখে বসন্তদাসের মুখের উপর। বসন্ত অনুমান করে তার যুক্তি শ্রোতারা গ্রহণ করছে না–কিন্তু তবু সে হতোদ্যম হয় না। যতোদিন পারে, ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যসিদ্ধি বিলম্বিত করতেই হবে। এ বিষয়ে সে আশাবাদী। কারণ মিত্ৰানন্দ তার সুহৃদ বন্ধু এবং সে বসন্তকে বিশ্বাস করে।
প্রতিদিন অপরাহ্নে সে নদীতটে ভ্রমণ করে। কখন যে ভিক্ষুরা আসবে তার স্থিরতা নেই। তাই তাকে নদীতটে আসতে হয়। তার চপল স্বভাব এখনও আছে। বালক ও কিশোরদের সঙ্গে সে একেকদিন ক্রীড়ায় মত্ত হয়। দণ্ডগুলি ক্রীড়ায় তার পারদর্শিতার কথা ইতোমধ্যে গ্রামের কিশোর ও বালকদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে গেছে। সুতরাং সে নদীতটে এলে বালকদের মধ্যে উল্লাস দেখা যায়।
আজ সে নদীতটে এসে দেখলো বালকেরা বিমর্ষ মুখে বসে আছে। কি সংবাদ? সে সন্ধান নিয়ে জানলো যে দ্বিপ্রহরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনাটি সামান্য, কিন্তু মানুষের অনুদারতা এবং ক্রোধ সামান্য ঘটনাকেই প্রকাণ্ড করে তুলতে পারে।
ঘটনাটি হাস্যকরও কিঞ্চিৎ। দ্বিপ্রহরে অভিরাম উপাধ্যায় স্নানে এসেছিলেন। তাঁর অবয়ব শীর্ণাকার, এবং মস্তকে একটি সুন্দর ইলুপ্তি বিরাজমান। তাঁর তৈলসিক্ত ইলুপ্তিটি কখনও কখনও দর্পণের কাজ করে। তিনি যখন নদীজলে নেমে প্রথম ডুবটি দিয়ে সূর্যস্তব আরম্ভ করেছেন, শ্লোকের প্রথম চরণটি উচ্চারিত হয়েছে–কি–হয়নি–ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং পর্যন্ত বলেছেন মাত্র, ঐ মুহূর্তে বালকদের দণ্ডপ্রহৃত গুলিটি তীরবেগে ছুটে এসে তাঁর। মস্তকের ইন্দ্রলুপ্তিটিতে আঘাত করে। আঘাতটি তীব্র হওয়ায় ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং রক্তপাত হয়। উপাধ্যায় মহাশয় কুপিত হন, উপবীত হস্তে ধারণ করে বালকটি এবং তার চতুর্দশ। পুরুষকে অভিসম্পাত করেন। তাতেও তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয় না, বালকটিকে তিনি ধরে নিয়ে যান নিজ গৃহে। সেখানে তাকে যথেচ্ছ প্রহার করা হয়। ঘটনার সেখানেই সমাপ্তি হয়নি, শোনা যাচ্ছে, বালকটির পিতাকে ব্রাহ্মণরক্তপাতের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
বসন্তদাস মলিনমুখ বালকদের কোনোরূপ সান্ত্বনা দিতে পারে না। কারণ বিষয়টি অতিশয় স্পর্শকাতর। সে বহিরাগত, তার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ঘটলেই ব্যাপারটি ভিন্ন আকার ধারণ করবে। সে বালকদের সঙ্গ ত্যাগ করে ভাসমান নৌকাগুলির দিকে অগ্রসর হলো।
বসন্তদাস বলিষ্ঠ, তায় যুবাপুরুষ। পুনর্ভবা তীরের উচ্চ ভূমিতে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার উন্নতদেহের প্রতিচ্ছায়া নদীবক্ষে এসে পড়েছিলো। পুনর্ভবার স্রোতে জল এখন গৈরিক বর্ণ। উত্তরদেশে সম্ভবত কোথাও বৃষ্টি হয়ে থাকবে–তাই জলের ঐ রূপ। ঐ গৈরিকবর্ণের জল এখন কিছুদিন ক্রমান্বয়ে আসতেই থাকবে।
নদীতীরে একত্রে একটি ক্ষুদ্র নৌবীথি ভাসমান। নৌকাগুলিতে নানান পণ্যসম্ভার। সম্ভবত এরা এখানে রাত্রিযাপন করবে। রাত্রিকালে দস্যুর ভয়, তাই এই ব্যবস্থা। বসন্তদাসের হাসি পায়, মানুষ বড়ই সহজ সরল। পথে দস্যু যা হস্তগত করে সে আর কতটুকু! পক্ষান্তরে যুগ যুগ ধরে নিজ নিজ গৃহেই অপহৃত হয়ে চলেছে তারা। গ্রামপতি নেয়, রাজপুরুষেরা নেয়, ব্রাহ্মণেরা নেয়, কায়স্থেরা নেয়–কে তাদের শ্রমলব্ধ উপার্জনের অংশ নেয় না? আশ্চর্যের বিষয়, এই চিন্তাটুকু মানুষ করতে চায় না।
সে ঐ সময় শুনলো, নৌকার এক বণিক ডাকছে, মহাশয় কি এই গ্রামবাসী?
কেন? কি প্রয়োজন? বসন্তদাস ঘুরে দাঁড়ায়।
না, জানতে চাইছিলাম। বণিকটি ইতস্তত করে বলে, এই নদীতীর নিরাপদ তো? দস্যুবৃত্তি হয় না তো?
বসন্তদাস হাসে। বলে, আপনি বড় কৌতুকের কথা বললেন, আমি এই গ্রামবাসী আর আমাকেই জিজ্ঞাসা করছেন, আমি দস্যুবৃত্তি করি কি না?
না না, আমি তা বলিনি, লোকটি অতিশয় বিব্রত বোধ করে। আপনারা এখানে নির্ভয়, বসন্তদাস তাদের আশ্বাস দেয়। বলে, এ গ্রামে কোনো দস্যু নেই–তবে আপনারা কি অধিক দূর যাবেন?
না মহাশয়, আমরা নবগ্রাম হাটে যাবো। পথিমধ্যে শুনলাম ওদিকে নাকি রাজার সৈন্যদের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে–কি ঘটনা, এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কি কোনো সংবাদ জানেন?
নিকটবর্তী নবগ্রামেও কি কোনো ঘটনা ঘটেছে? বসন্তদাস স্মরণ করার চেষ্টা করে।, এমন কোনো ঘটনার কথা সে শোনেনি। তার একবার মনে হলো, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি বর্ণনা করে। কিন্তু পরক্ষণে চিন্তা করে, কি প্রয়োজন অহেতুক নিরীহ লোককে চিন্তাগ্রস্ত করে? সে বলে, আপনারা নির্ভয়ে থাকুন এখানে সকলই নিরাপদ।
নিরাপদ হলেই ভালো, আমরা ক্ষুদ্র ব্যক্তি, সামান্য কিছু উপার্জন করতে পারলেই গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যেতে চাই–আপনি আমাদের নিশ্চিন্ত করলেন, আপনাকে ধন্যবাদ।
লোকটি হয় ভয়াতুর নতুবা বাঁচাল। হয় ভয়, নয় তোষণ। এছাড়া কি মানুষের স্বাভাবিক আচরণ হতে পারে না? বসন্তদাস বিরক্ত হয় লোকটির অতিমাত্রায় শিষ্ট আচরণ দেখে। তার মনে হয়, এ তো দাসের আচরণ? কতোকাল মানুষ কেবলি দাসত্ব করে যাবে? মনুষ্যজন্মের অর্থই কি দাসত্ব? ভয় আর সন্ত্রাস কি চিরকাল মানুষকে দাস করে রাখবে? এরা কি বারেকের জন্যেও সংঘবদ্ধ হতে পারে না? বোঝে না কি যে সংঘবদ্ধ বাহুবল কি বিপুল ও প্রচণ্ড শক্তি ধারণ করতে পারে?
বারবার প্রশ্নটি তার মনে আলোড়িত হতে থাকে।
সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। দূরে বেণুধ্বনি শোনা যায়। বসন্তদাসের নিজ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ হয়। পূর্বদেশের গ্রামগুলিতে সে ভ্রমণ করেছে বন্ধু মিত্রানন্দের সঙ্গে, প্রাচীন পুন্ড্রনগরীতেও সে গিয়েছিলো–সর্বত্রই তার এক অভিজ্ঞতা। রাজশক্তি প্রজাপীড়ন ছাড়া অন্য কাজে কোথাও ব্যবহৃত হয় না। এই রাজশক্তি যে প্রকৃতপক্ষে দুর্বল, এ সত্য কেউ স্বীকার করে না। তারা শুধু মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের হস্তীবাহিনী, অশ্ববাহিনী এবং পদাতিকের সংখ্যাটি দেখতে পায়, আর কিছু দেখতে পায় না।
ঐ সময় সে একটি বালককে দ্রুত ছুটে আসতে দেখলো। বালকটি দ্রুত নিকটে এসে জানালো, আপনি এখানে? ওদিকে আপনার সন্ধান করা হচ্ছে।
কেন? বসন্তদাস অবাক হয়।
সামন্ত হরিসেনের গৃহ থেকে দুজন প্রহরী এসেছে–তারা আপনাকে সামন্ত গৃহে নিয়ে যেতে চায়।
বসন্তদাস চমকিত হলো। কিন্তু বালকটিকে সে বুঝতে দিলো না। বললো, তুমি গৃহে যাও, আমার সঙ্গে যে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে এ কথাটি প্রকাশ করো না।
অতঃপর বসন্তদাস? নিজেকে প্রশ্ন করে সে। ঘনায়মান অন্ধকার, নদীর ছলোচ্ছল স্রোতধারা এবং নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে সে কয়েকবার এবং নিজেকে বলে, এইবার তাহলে তোমাকে জীবনের সম্মুখীন হতে হচ্ছে–তুমি না সংঘর্ষ চাইতে না?
তুমি না হিংসা প্রতিহিংসা উভয়ের নিবৃত্তি চেয়েছিলে? বলেছিলে, যবন জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো অনুচিত–এখন তুমি কী করবে?
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো। বসন্তদাস স্থির করলো, আপাতত সে পুনর্ভবার পরপারে আশ্রয় নেবে। না, হরিসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো বাসনা তার নেই। ঐ সময় আকাশের নক্ষত্রমালায় সে প্রিয়তমা পত্নী মায়াবতীর মুখখানি দেখতে চাইলো, কিন্তু দেখলো, শুধু মায়াবতী নয়–আরও একটি মানবীর মুখ সে দেখতে পাচ্ছে। সে বুঝলো, বালগ্রামের মন্দিরদাসী কৃষ্ণাকে বিস্মৃত হওয়া অতো সহজ নয়।