মুসলমান-যুগে ভারতের ঐতিহাসিকগণ
প্রথম
ছয় শত বৎসর ধরিয়া মুসলমানগণ ভারতে রাজত্ব করেন, এবং তাহার পরও কিছুদিন শাসনকার্য্যে মুসলমান-যুগের সরকারী ভাষা ও পদ্ধতি চলিতে থাকে। এই সুদীর্ঘ কালে মুসলমান রাজা ও সমাজ হইতে ভারতবর্ষ কতকগুলি দান পাইয়াছে যাহা আমাদের জাতীয় জীবনে নিজ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, এবং এখনও শেষ হয় নাই। বর্তমান ভারতীয় সভ্যতা একটি মিশ্র পদার্থ, ইহার ক্রমবিকাশে মুসলমান-যুগের কৃতিত্ব কম আদরের নহে, কারণ ঐ ছয় শত বৎসরের শাসনের ফল ভারতবাসীদের দেহের, মনের অংশ হইয়া পড়িয়াছে। অনেক দিক দিয়া আমরা মুসলমান-যুগের আনীত পরিবর্তনগুলি ভোগ করিতেছি; কিন্তু আজ তাহার একটি মাত্র আলোচনা করিব।
আমার মনে হয়, মুসলমান জগৎ ভারতকে যে দানগুলি দিয়াছে তাহার মধ্যে ইতিহাস-সাহিত্য একটি প্রধান। এটি ভারতের পক্ষে অপূর্ব্ব। আমরা দম্ভ করিয়া বলি, হিন্দুযুগে কি ইতিহাস ছিল না? আমাদের পুরাণই ইতিহাস, রামায়ণ মহাভারতও ইতিহাস, হর্ষচরিত, বিক্রমাঙ্কচরিত, রামচরিত এই ত ইতিহাস। এই যুক্তির উত্তর আমাদের একজন বিখ্যাত লেখক রহস্যের আকারে কিন্তু সত্যসত্যই দিয়া গিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, “হনুমানের লেজ দু-হাজার ফুট লম্বা যে গ্রন্থে লেখা তাহা পুরাণ, আর যদি ঐ লেজটা ঘৰ্ষণ কৰ্ত্তন করিয়া তিন ফুটে নামান যায় তবে তাহা ইতিহাস হইবে।” অর্থাৎ ইতিহাস সত্য প্রকৃত জগতের ছবি, ইহা প্রকৃতির সত্য অতিক্রম করিতে পারে না। এজন্য পুরাণকে ইতিহাস বলা যাইতে পারে না, কোন ব্যক্তিকে ধরিয়া রচিত কাব্যকেও এই নাম দেওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত: ইতিহাস সময় ও ব্যক্তিগণের ঠিক পরে পরে সাজান একটি অস্থিকঙ্কাল অবলম্বন করিয়া রচিত হইবে, শুধু ভাবের উচ্ছ্বাস বা কথার রঙ্গীন কুয়াশা দিয়া এই শ্রেণীর সাহিত্য গঠিত হইতে পারে না।
হিন্দুযুগে এরূপ ইতিহাস রচিত হয় নাই, যদি হইয়া থাকে তবে তাহা সম্পূর্ণ লোপ পাইয়াছে। চীন-পরিব্রাজক ইয়াং চুয়াং (৬৩০খ্রি.) বলেন যে ভারতবর্ষের “মধ্যদেশে” প্রত্যেক প্রদেশের ঘটনার কাহিনী সদ্য লিখিবার পদ্ধতি ছিল, এবং এই বিবরণগুলিকে “নীলপীট” নাম দেওয়া হইত। কিন্তু এরূপ রচনার এক পৃষ্ঠাও রক্ষা পায় নাই এবং সংস্কৃত সাহিত্যে ইহার উল্লেখ নাই।
সুতরাং, মুসলমান-বিজেতাগণ যখন ইন্দ্রপ্রস্থে সাম্রাজ্য স্থাপন করিলেন, তখন তাঁহাদের সভাসদ কর্তৃক রচিত কাহিনীই প্রথমে ভারতে ইতিহাস-পদবাচ্য হইল, সাহিত্যে একটা নূতন ধারা আনিয়া দিল। পরে হিন্দুরা পারসিক ও অন্যান্য ভাষায় ইতিহাস লিখিতে লাগিলেন বটে, কিন্তু তাহা মুসলমান-লিখিত ইতিহাস অপেক্ষা অনেক অংশে নিরেশ হইল। মুসলমান-লেখকদের কয়েকটি মহা সুবিধা ছিল, যেমন- (১) এক সন ও তারিখ– হিন্দুদের অসংখ্য সন ও মাস-গণন পদ্ধতির মত নহে। (২) এক সাহিত্যিক ভাষা পারসিক। (৩) একই সাহিত্যিক আদর্শ। (৪) জাতিভেদ না থাকায় অনেক স্থলে মুসলমান অসিধারীরা কলম চালাইতেও দক্ষ ছিলেন- সাহিব-ই-সয়ে কম্; ইহার ফলে তাঁহাদের দৃষ্ট ঘটনার বর্ণনা অতিশয় সত্য ও উজ্জ্বল আকারে লিখিত হইত। এই সুবিধাগুলি হিন্দুদের ছিল না। তদ্ভিন্ন নানা দেশের নানা জাতি ইসলামের প্রভাবে ভারতে মিলিত হইয়া, অতি শীঘ্র প্রাদেশিক বা জাতিগত বৈষম্য ভুলিয়া গিয়া এক মিশ্রিত সাধারণ সমাজ গঠন করিয়া ফেলিত, এইরূপ লোকদের মধ্যে সাহিত্যের ছাঁচটা একই উচ্চ আদর্শ অনুসরণ করিত, এবং ইতিহাসগুলিও এলোমেলো হইতে পারিত না ৷
অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত হিন্দু ও মুসলমানের ইতিহাস পাশাপাশি রাখিয়া দেখিয়া আমার বিশ্বাস হইয়াছে যে হিন্দুরা ইহজগৎ অপেক্ষা পরলোকের কথাই বেশী ভাবে, তাহারা এইসব নশ্বর রাজরাষ্ট্র সন্ধিবিগ্রহ প্রভৃতি পার্থিব জিনিষ মনোযোগ করিয়া দেখিয়া লিখিয়া তাহা হইতে স্থায়ী সাহিত্য রচনা করিতে স্বভাবতঃই অনিচ্ছুক, অপারগ, এক্ষেত্রে তাহারা মুসলমানদের তুলনায় অনেক নীচে। একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি– সুবিখ্যাত নজীব্-উদ্দৌলার পারসিক জীবনী সৈয়দ নুরুদ্দীন হোসেন লেখেন, আর তাঁহারই সমসাময়িক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী জাঠরাজা সূরজমলের জীবনী সুজনচরিত্র নামে হিন্দী ভাষায় মিশ্রণ নামক এক হিন্দু রচনা করেন। দুই জনই শিক্ষিত পদস্থ লেখক, কিন্তু তাঁহাদের গ্রন্থ দুখানির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। এমন কি হিন্দু মুশী বিহারীলাল কর্তৃক পারসিক ভাষায় রচিত নজীব্-উদ্দৌলার জীবনী, নুরুদ্দীনের গ্রন্থের তুলনায় চাঁদের পাশে জোনাকির মত নিষ্প্রভ দেখা যায়।
ভারত-বিজয়ী মুসলমান রাজারা ভারতের বাহিরের মুসলমান জগৎ হইতে ইতিহাস রচনার আদর্শ সঙ্গে করিয়া আনেন, আর যুগে যুগে ইসলামীয় সভ্যতার কেন্দ্র খোরাসান, বাগদাদ, মিসর ও কর্ডোভা হইতে মুসলিম পণ্ডিতগণ ভারতে আসিয়া এই সাহিত্যকে নূতন রসে সতেজ করিয়া তুলিতেন। আমাদের এই সব রাজাদের নিজ নিজ ইতিহাস- অন্ততঃ পূৰ্ব্বজগণের কাহিনী রচনা করাইবার একটি স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল; অথবা তাঁহাদের সভায় প্রতিপালিত পণ্ডিতগণ নিজ নাম অমর করিবার জন্য উৎকৃষ্ট পারসিক ভাষায় সেই যুগের ইতিহাস লিখিতেন। এইরূপে মহমুদ গজনবী হইতে দ্বিতীয় শাহ্ আলম পর্যন্ত আট শত বৎসর ধরিয়া ভারতের কোন-না-কোন অংশ লইয়া পারসিক ইতিহাস রচিত হওয়ায় এক মহাসমুদ্রের মত প্রকাণ্ড সাহিত্য সৃষ্টি হইয়াছে। আমাদের মহা সৌভাগ্যের বিষয় যে, ইহার অতি অল্প অংশই লোপ পাইয়াছে।
আরও সৌভাগ্যের বিষয়, এই মহাসমুদ্রে আমরা একজন প্রবলপ্রতাপান্বিত কর্ণধার পাইয়াছি। তিনি লর্ড ডালহৌসীর ফরেন সেক্রেটারী স্যর হেনরী মায়ার্স এলিয়ট। তাঁহার আরব্ধ ও অধ্যাপক ডাউসন কর্তৃক সম্পূর্ণ-কৃত আট বালুম History of India as told by its own Historians এইসব মুসলমান ঐতিহাসিকগণের জীবনী, গ্রন্থপরিচয়, সমালোচনা এবং অনেক স্থলে আংশিক অনুবাদ দিয়া এই ক্ষেত্রের বিস্তৃতি ও মূল্য বুঝিবার, এই ক্ষেত্রের নিজ নিজ নির্ব্বাচিত কোণ-টুকুতে গবেষণা করিবার পথ অতি সুগম করিয়া দিয়াছেন। এলিয়টের আরও মহান কীর্ত্তি এই সব পারসিক ইতিহাসের হস্তলিখিত পুঁথি সংগ্রহ। ডালহৌসী অতি জবরদস্ত বড়লাট ছিলেন, আজ এই রাজার রাজ্য জপ্ত করেন, কাল উহাকে কিছু জমি দেন, অথবা তৃতীয় এক রাজার সর্ব্বস্ব নীলামে চড়ান (যেমন নাগপুরকর ভোঁসলাদের)। সমস্ত ভারতের রাজন্যবর্গ তাঁহার প্রভাবে কম্পমান। এহেন লাটের ফরেন সেক্রেটারী ছিলেন- রাজার উপর রাজা, নবাব মহারাজ-শ্রেণীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এই সাহেবের সখ ছিল পুরাতন পুঁথি সংগ্রহ করা, অর্থাৎ ভারতীয় ইতিহাস বা ঐতিহাসিক জীবনী লইয়া লেখা ফার্সী গ্রন্থ পাইলে তিনি বড়ই সন্তুষ্ট হইতেন, ঐ বিষয়েই অনুসন্ধান আলোচনা করিতে ভালবাসিতেন। সুতরাং অতি দুষ্প্রাপ্য, অথবা সে পর্যন্ত জগতে অজ্ঞাত কোন ফার্সী ঐতিহাসিক পুঁথি তাঁহাকে উপহার দিলে তাঁহার দরবারে অতি সহজে প্রবেশ করা যাইত, এমন কি তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিয়া ছোটখাট রাজ্যও রক্ষা করা যাইত, অথবা কোন নবাবের পেন্সন বাড়ান যাইত। এইরূপে দিল্লীর বাদশাহী প্রাসাদে রক্ষিত অথবা প্রাচীন ওমরাদের জন্য সুন্দর অক্ষরে লিখিত মহামূল্যবান্ ফার্সী পুঁথি তাঁহাদের বর্তমান হতভাগ্য বংশধরেরা এলিয়টের নিকট ভেট দিতেন। ইহার মধ্যে এমন এমন গ্রন্থও আছে জগতে যাহার আর কোন নকল নাই। ভারতের মুসলমান-যুগের সমস্ত ফার্সী ইতিহাস সংগ্রহ এবং অনুবাদ করা এলিয়টের জীবনের ব্রত ছিল; এ কাজ তিনি আরম্ভ করিয়াছিলেন মাত্র, কারণ পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িল, তিনি বিলাত যাইবার পথে মারা গেলেন (১৮৫৩)। তখন এক ভল্যুম মাত্র প্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহার আরব্ধ এই ঐতিহাসিক মহাকোষ তাঁহার মৃত্যুর অনেক বৎসর পরে ভারত-সচিবের খরচে অধ্যাপক ডাউসন্ শেষ করেন (১৮৭৭ খ্রি., আট বালুমে, এবং পরিশিষ্ট লইয়া নয় বালুমে)।
আমাদের আরও একটি সৌভাগ্যের বিষয়, এলিয়ট এইসব ঐতিহাসিক পুঁথি কুড়াইয়া একত্র করিয়া বিলাতে পাঠান সিপাহী-বিদ্রোহের পাঁচ-ছয় বৎসর আগে। তাহাতেই এগুলি রক্ষা পাইয়াছে, আমরা এখন এগুলি দেখিতে পাইতেছি। নচেৎ, যদি এগুলি দেশী মালিকদের বাড়ীতে থাকিত, তবে ঐ উত্তর-ভারতব্যাপী মহাবিপ্লবে একেবারে ধ্বংস হইয়া যাইত। সিপাহী-বিদ্রোহের ফলে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশময় (অর্থাৎ এলাহাবাদ-আগ্রায়) অশান্তি ও দাঙ্গা চলিতে থাকে, অর্দ্ধেক জেলার সরকারী কাগজপত্ৰ পুড়াইয়া ফেলা হয়; দিল্লী লক্ষ্ণৌর উপরে তোপ চালান এবং জয় করিবার পর লুঠ করা হয়; অনেক নবাবের ও রাজার রাজবাড়ী নষ্ট এবং তাহাদের রাজ্য জপ্ত হইয়া যায়। এইসব স্থানের পুঁথি লোপ পাইয়াছে। ইহার চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে ঠিক এই মত একটি অরাজকতার ফলে এলফিনষ্টোন্ কর্তৃক সংগৃহীত অসংখ্য দুৰ্ল্লভ ফার্সী ঐতিহাসিক পুঁথি, মারাঠা সৈন্যদের দ্বারা তাঁহার পুণা রেসিডেন্সী-ভবন আক্রমণের সময় ধ্বংস হয় (১৮১৭ খ্রি.)। সুতরাং যে এলিয়ট-সংগ্রহ এখন ব্রিটিশ মিউজিয়মে এক পৃথক কক্ষে রক্ষা পাইতেছে তাহা জগতে অমূল্য, কারণ অনেক স্থলে অদ্বিতীয়।
ফার্সী ভারত-ইতিহাস-মালার অনুবাদ সুদীর্ঘ আট ভল্যুমে প্রকাশ করিয়া এলিয়ট্-ডাউসন্ কত বড় উপকার করিয়াছেন তাহা বুঝা যায় যদি আমরা ১৮৭৭ সালের আগে ও পরে লিখিত মুসলমান-ভারতের ইতিহাস দুখানি লইয়া তুলনা করিয়া দেখি। ঐ আট ভল্যুমের একটি সুফল ষ্টালি লেন্-পু-রচিত মধ্যযুগীয় ভারত। ইহাতে চারিশত পৃষ্ঠায় মুসলমান ভারত-ইতিহাস-রূপ মহানাটকের অঙ্কের পর অঙ্ক দৃশ্যপটের মত পাঠকের সম্মুখে খুলিয়া দিয়াছে; ইহার সমস্ত উপাদান এলিয়ট হইতে লওয়া। সব বর্ণনা নিখুঁত সভ্য, সাক্ষীদ্বারা প্রমাণিত, অথচ বইখানি জীবন্ত মানুষে ভরা, আমরা সব বড় বড় ঐতিহাসিক পুরুষদের চরিত্র অতি স্পষ্টরূপে দেখিতে পাইতেছি; পাঠক যাহা পড়িবেন তাহা মনে বহুদিন স্মরণ থাকিবে। ফলত: মেকলে যেমন ইতিহাসকে সরস ও জীবন্ত করিয়া দিতেন, লেন্-পুলও তাহাই করিয়াছেন, এবং এলিয়টের গ্রন্থে অসংখ্য সমসাময়িক বিস্তৃত বিবরণ ও উক্তি পাইয়াছিলেন বলিয়াই এরূপ করিতে পারিয়াছেন। তাঁহার পর অনেকেই অংশতঃ বা ব্যাপকভাবে গবেষণা করিবার সুবিধা এই আট ভলুম হইতেই পাইয়াছেন।
কিন্তু এলিয়ট্ আমাদের প্রথম পথ-প্রদর্শক এবং নমুনা-দেখাইবার ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন আর নমুনায় চলে না, আমরা প্রতি মূলগ্রন্থের অবিকল সম্পূর্ণ অনুবাদ চাই, এবং তাঁহার পর অনেক নূতন গ্রন্থও আবিষ্কৃত হইয়াছে।
১৫৫৬ সালে আকবর দিল্লীর সিংহাসনে বসিলেন, এবং ভারতে স্থায়ী মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপিত হইল। তাঁহার রাজ্যকাল হইতে যে যুগ আরম্ভ হইল তাহার এবং মুঘলদের পূর্ব্বেকার যুগের ভারতের ফার্সী ইতিহাসগুলির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ– শুধু সংখ্যাতে নহে, গুণেও। ইতিহাসের ক্ষেত্রে মুঘল-যুগের প্রধান কীর্তি সরকারী ইতিহাস; অসংখ্য ছোট-ছোট ঘটনা, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তারিখ ও স্থানের লোকের নাম দিয়া, মাস ও বৎসর অনুসারে সাজাইয়া প্রত্যেক সম্রাটের রাজ্যকালের সুদীর্ঘ ইতিহাস লেখা হইয়াছে, এবং সেগুলির সেই সেই বাদশাহের নাম-অনুসারে নাম দেওয়া হইয়াছে, যেমন- আকবর-নামা অর্থাৎ আকবরের গ্রন্থ (ফার্সীতে নামা; শব্দের অর্থ গ্রন্থ, ইহা ‘নাম’ শব্দ হইতে ভিন্ন), পাদিশাহ-নামা (অর্থাৎ শাহজাহানের), আলমগীর-নামা ইত্যাদি। দ্বিতীয়তঃ এগুলির উপাদান ইতিহাসের আদি ও অবিকৃত সমসাময়িক মশলা, অর্থাৎ নানা স্থান হইতে কর্ম্মচারীগণ বাদশাহ ও মন্ত্রীদের যেসব পত্র, ডায়েরী, যুদ্ধের এবং শত্রুর দূতের সহিত আলোচনার রিপোর্ট, সন্ধির খসড়া, হিসাবের কাগজ প্রভৃতি লিখিয়া পাঠাইতেন তাহা বাদশাহী রেকর্ড অফিসে (“বস্তা-খানায়”) জমা থাকিত; তাহা দেখিয়া এই শ্রেণীর বইগুলি রচিত।
মুঘল বাদশাহদের আগে এই শ্রেণীর ইতিহাস একখানিও ভারতে রচিত হয় নাই। তাহার প্রথম কারণ, সেসময় সভ্যতা তত অগ্রসর হয় নাই, আর দেশে শান্তিও কম ছিল। কোন রাজবংশই তখন দিল্লীতে তিন পুরুষের বেশী সিংহাসন রাখিতে পারেন নাই। আর এই সব রাজারা প্রায় যাযাবর ছিলেন; সৈন্যসামন্ত লইয়া আজ এখানে, কাল ওখানে তাঁবু খাটাইয়া মাস ও বৎসর কাটাইতেন; এক নিৰ্দ্দিষ্ট রাজধানীতে স্থির হইয়া বসিয়া সভা করিতে পারিতেন অতি কম দিনই। যাঁহাদের অর্দ্ধেক জীবনের অধিক কাল বিদ্রোহদমনে বা রাজ্যবিস্তারে কাটাইতে হইত, তাঁহারা সাহিত্য ইতিহাস সৃষ্টি করাইবার অবসর পাইতেন না। পুঁথি দলিল প্রভৃতি সংগ্রহ করিবার পক্ষেও নানা বাধা ছিল। যদি-বা কিছু সংগৃহীত হইত তাহাও অশান্তি এবং ঘন ঘন স্থান-পরিবর্তনে শীঘ্রই নষ্ট হইত, অথবা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িত।
কিন্তু ঠিক মুঘল-যুগের “নামা”-গুলির মত বড় না হইলেও, কয়েকখানি মূল্যবান ইতিহাস আমরা তাহার পূর্ব্বের যুগে পাই। এগুলি একটানা ইতিহাস, অনেক সময়ে বাবা আদম্ হইতে আরম্ভ! কেবলমাত্র রাজার সমস্ত রাজত্বকাল বা কয়েক বৎসর লইয়া লিখিত নহে।
আরবী ভাষায় লিখিত গজনীর সুলতান মামুদের ইতিহাস কিতাব-ই-ইয়ামিনি বড় কম সংবাদ প্রদান করে, ইহার ইংরাজী অনুবাদ (ফার্সী অনুবাদের অনুবাদ) বিশুদ্ধ নহে। ঐ রাজবংশের বৈহাকী নামক একজন কর্ম্মচারী একখানি সুদীর্ঘ ইতিহাস রাখিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার গ্রন্থের মামুদ-পুত্র মাসুদের কাহিনী- এই অংশটুকু মাত্র রক্ষা পাইয়াছে, যে-খণ্ডে মামুদের কার্য্যকলাপ বর্ণিত ছিল তাহা লোপ পাইয়াছে, কোথাও মিলে না। সুতরাং, ঐ রাজার ভারতে কীর্তির জন্য এখন শিলালিপি প্রধান সম্বল।
তাহার পর ঘোরী-বংশ। ইহাদের জন্য তাজ-উল্-মাসির নামক গ্রন্থ আছে, কিন্তু ইহা নামত: ইতিহাস হইলেও কবিতা ও অলঙ্কারের ভারে ইতিহাস প্রায় দমবন্ধ হইয়া মারা গিয়াছে। তবকাৎ-ই-নাসিরী (১২৬০ খ্রিস্টাব্দে) আমাদের ভারতীয় মুসলমানযুগীন প্রথম ইতিহাস বলিলে অত্যুক্তি হয় না। রাভ্যার্টি সাহেব এখানির সম্পূর্ণ ও বিশুদ্ধ ইংরাজী অনুবাদ করিয়াছেন (যদিও তাঁহার অনেক টীকা অতিপাণ্ডিত্য-দোষে দূষিত এবং ভুল)। খিলজী-বংশের জন্য আছে জিয়া বাণী-রচিত তারিখ-ই-ফিরোজশাহী অতি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ (যদিও গ্রন্থকারের পক্ষপাতদোষ পরলোকগত অধ্যাপক গার্ডনার ব্রাউন প্রথমে দেখাইয়া দেন); এখানিতে প্রথম দুই তুঘলুক সুলতান, এবং ফিরোজ শাহর ১-৬ বৎসরের বিবরণও আছে। শেষোক্ত সুলতানের সম্পূর্ণ ইতিহাস শমস্-ই-আফিফ্ রচিত তারিখ-ই-ফিরোজশাহী (এলিয়ট্ এই দুই গ্রন্থের দীর্ঘ অনুবাদ দিয়াছেন এবং প্রথমখানির অপর এক অনুবাদ J.A.S.B. তে অতি পূৰ্ব্বে ১৮৬৩-৬৪তে ছাপা হয়।) আফঘান অর্থাৎ লোদী এবং সূর-বংশের ইতিহাস তেমন ভাল নাই। এইসব ইতিহাস ভিন্ন আমির খসরুর কাব্য ও গদ্য রচনাগুলি, মহরূর চিঠিপত্র, ইবন্-বতুতার ভ্রমণকাহিনী প্রভৃতি গ্রন্থ ঐ যুগের অনেক খবর দেয় এবং কোন ঐতিহাসিক এগুলিকে উপেক্ষা করিতে পারেন না।*
[সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৪৫ বর্ষ, সংখ্যা ১, ১৩৪৫।]
* বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদে প্রদত্ত ‘অধরচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বক্তৃতামালা’র প্রথম বক্তৃতা।