৮
মিসির আলি সাহেব আজ অনেক সুস্থ। গায়ে চাদর জড়িয়ে বিছানায় বসে আছেন। হাতে শিবরাম চক্রবর্তীর বই ‘জন্মদিনের উপহার’। কিছুক্ষণ পড়ছেন, তারপর গা দুলিয়ে হাসছেন। আবার পড়ছেন, আবার হাসছেন।
আশেপাশের রুগীরা ব্যাপারটায় বেশ মজা পাচ্ছে। আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে তারা দেখছে এই বিচিত্র মানুষটাকে।
আমার দিকে চোখ পড়তেই মিসির আলি বললেন, ‘শিবরামের বাঘের গল্পটা পড়েছেন? অসাধারণ! সকাল থেকে এখন পর্যন্ত এগার বার গল্পটা পড়লাম।
‘তাই নাকি?’
‘আমার কী মনে হয় জানেন? হাসপাতালের রুগীদের জন্যে এই জাতীয় বই অষুধপত্রের সঙ্গে দেওয়া দরকার। প্রাণখুলে কয়েক বার হাসতে পারলে যে-কোনো অসুখ অনেকটা কমে যায় বলে আমার ধারণা।‘
‘আপনার তাহলে কমে গেছে?’
‘জ্বি।’
আমি বললাম, ‘আপনার খাতাটা কাল রাতে পড়ে শেষ করেছি। আমার মনে হয়, যে-ছ’টি প্রশ্ন আপনি তুলেছেন, তার উত্তর জানা প্রয়োজন।‘
‘প্রয়োজন তো বটেই।’
‘আমি আপনার সঙ্গে যাব এবং সুধাকান্তবাবুর সঙ্গে কথা বলব।’
মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি জানতাম আপনি এই কথা বলবেন।’
আমি বললাম, ‘কোনো-একটা ভৌতিক গল্প শুনলেই কি আপনি এ-রকম করেন, সব রহস্য উদ্ধারের জন্যে লেগে পড়েন?’
মিসির আলি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
আমি বললাম, ‘আপনি কি আপনার শোনামতো ভৌতিক গল্পের রহস্য ভেদ করতে পেরেছেন?’
‘না, পারি নি। শতকরা বিশ ভাগ ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারি নি। আমার আরেকটা খাতা আছে। ঐ খাতার নাম রহস্য-খাতা। যে-সব সমস্যা আমি সমাধান করতে পারি নি, রহস্য-খাতায় সেইসব লিখে রেখেছি। আপনাকে একদিন পড়তে দেব।’
‘ঠিক আছে। আপনার ‘রহস্য-খাতা’ একদিন পড়ব।’
‘কিংবা আপনি যদি চান তাহলে ঐখানকার একটা গল্প আপনাকে শোনাতেও পারি।’
‘এইখানে বলবেন?’
‘অসুবিধা কী? হাসপাতালে একটা ক্যান্টিন আছে। ক্যান্টিনে বসে চা খেতে-খেতে গল্পটা আপনাকে বলতে পারি। আসলে ব্যাপারটা কি জানেন—আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে। একটা গল্প যদি শুরু করি, তাহলে ভদ্রতার কারণেই আপনি গল্প শেষ না-করা পর্যন্ত বসে থাকবেন। এটাই হচ্ছে আমার লাভ।’
‘আপনার শরীরের এই অবস্থায় আপনি ক্যান্টিনে যেতে পারবেন?’
‘পারব। আমাকে যতটা কাহিল দেখাচ্ছে, ততটা কাহিল কিন্তু না। আসুন যাই।’
.
আমরা ক্যান্টিনে বসলাম।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম হাসপাতাল নোংরা হলেও ক্যান্টিনটা বেশ পরিষ্কার। ভিড় আছে, তবে হৈচৈ নেই। দু’ ধরনের চা পাওয়া যাচ্ছে—এক নম্বরী চা এবং দু’ নম্বরী চা। এক নম্বরী চা এক টাকা করে, দু’ নম্বরীটা তিন টাকা করে। মিসির আলি বললেন, ‘একই চা দু’ ধরনের কাপে দেওয়া হয় বলে দু’ ধরনের দাম। এবং মজার ব্যাপার কী জানেন, সবাই কিন্তু বেশি দামের চা’টা খাচ্ছে। গতকালও চা খেতে এসেছিলাম। এক জনকে বলতে শুনলাম—’এক নম্বরী চা মুখে দেওয়া যায় না। খানিকটা পানি গরম করে এনে দিয়ে দেয়।’
আমি বললাম, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে দুটো চা-ই এক?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চিত। প্রমাণ করে দিতে পারি। করব?’
‘না, প্রমাণ করতে হবে না। আপনার কথা আমি বিশ্বাস করছি। এখন আপনার গল্পটা বলুন।’
‘আপনার কি তাড়া আছে?’
‘না, তাড়া নেই। তবু বেশিক্ষণ হাসপাতালে থাকতে আমার ভালো লাগে না।’
মিসির আলি সঙ্গে-সঙ্গে গল্প শুরু করলেন—
‘রহস্য-খাতায় এই গল্পের নম্বর হচ্ছে একুশ। অর্থাৎ এটা একুশ নম্বর গল্প। এর চেয়ে অনেক ভয়ংকর গল্প আমার স্টকে আছে, তবু এটা বলছি, কারণ এটা বলতে গেলে একটা ফার্স্ট-হ্যাণ্ড স্টোরি। আমার নিজের জীবনে ঘটে নি, তবে যার জীবনে ঘটেছে, সে আমার প্রিয় এক মানুষ। ঘটনাটার সঙ্গে আমার যোগাযোগও প্রত্যক্ষ।…
‘মেয়েটি হচ্ছে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া—আমার মা’র মামাতো বোনের মেয়ে। গ্রামের মেয়ে। হোস্টেলে থেকে ময়মনসিংহ মমিনুন্নেসা কলেজে পড়ত। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে হঠাৎ করে তার বিয়ে হয়ে যায়। খুব বড় ঘরে বিয়ে হয়। ছেলের অর্থ, বিত্ত এবং প্রতিপত্তির কোনো অভাব নেই। পরিবারটিও এ-দেশের নাম-করা পরিবার। নাম বললেই আপনি চিনবেন, তাই নাম বলছি না। শুধু ধরে নিন যে, এই দেশের রাজনীতিতে এই পরিবারটির প্রত্যক্ষ যোগ আছে।’
‘আপনি গল্পটা বলুন। বিত্তবান পরিবারের ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই।’
‘আমার নিজেরও নেই এবং আমার ঐ খালার মেয়েটিরও ছিল না। অত্যন্ত ক্ষমতাবান একটি পরিবারে বিয়ে হবার কারণে তার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। কিছুদিন স্বামীর সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরল। সেই বছর পরীক্ষা দেওয়া হল না। তার পরের বছরও হল না, কারণ সে তখন কনসিভ করেছে।…
‘সমস্যা শুরু হল তখন, যখন মেয়েটি বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে লাগল। প্রতিটি স্বপ্নের মূল বিষয় একটিই—ছোট্ট একটা ছেলে এসে তাকে বলে : মা, তোমাকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোন। আমাকে এরা মেরে ফেলবে। যে-রাতে আমার জন্ম হবে সেই রাতেই ওরা আমাকে মারবে। তুমি আমাকে রক্ষা কর।…
‘বুঝতেই পারছেন, গর্ভবতী একটি মেয়ের কাছে এই জাতীয় স্বপ্ন কতটা ভয়াবহ। মেয়েটি অস্থির হয়ে পড়ল। খেতে পারে না, ঘুমুতে পারে না, এবং প্রায় রোজই এই জাতীয় স্বপ্ন দেখে।
‘আমার সঙ্গে মেয়েটির তখন যোগাযোগ হয়। আমি তাকে নানানভাবে বুঝিয়ে বলি যে এটা কিছুই না। গর্ভবতী মেয়েদের অবচেতন মনে একটা মৃত্যুভয় থেকেই যায়। সেই ভয় নানানভাবে প্রকাশ পায়। তোমার বেলায় এইভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
‘মেয়েটির স্বামী বিষয়টি নিয়ে খুব বিব্রত বোধ করছিল। সে ঠিক করে রেখেছিল যে মেয়েটির মনের শান্তির জন্যে ডেলিভারির ব্যাপারটা এ-দেশে না করে বিদেশের কোনো হাসপাতালে করা হবে।
‘সেটা সম্ভব হল না। আট মাসের শেষে হঠাৎ করে মেয়েটির ব্যথা উঠল। তাড়াহুড়ো করে তাকে নিয়ে যাওয়া হল ঢাকার নামকরা একটা ক্লিনিকে। নৰ্য্যাল ডেলিভারি হল। রাত দুটোয় মেয়েটি একটি পুত্রসন্তান প্রসব করল।‘
মিসির আলি থামলেন। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অনেকের সঙ্গে আমিও ক্লিনিকে অপেক্ষা করছিলাম। মেয়েটি আমার একজন রুগী, কাজেই আমার খানিকটা দায়িত্ব আছে। ক্লিনিকের পরিচালক একজন মহিলা ডাক্তার। তিনি আমাকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘যে-বাচ্চাটির জন্ম হয়েছে তাকে একটু দেখুন।’…
‘আমি দেখলাম।‘
‘একটা গামলার ভেতর বাচ্চাটিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। জেলি ফিস আপনি দেখেছেন কি না জানি না, শিশুটির সমস্ত শরীর জেলি ফিসের মতো স্বচ্ছ, থলথলে, গাঢ় নীল রঙ। শুধু মাথাটা মানুষের। মাথাভর্তি রেশমি চুল। বড়-বড় চোখ। হাত-পা কিছু নেই। অক্টোপাসের মতো নলজাতীয় কিছু জিনিস কিলবিল করছে।
‘আমি খুবই সাহসী মানুষ, কিন্তু এই দৃশ্য দেখে ভয়ে গা কাঁপতে লাগল।‘
‘ডাক্তার সাহেব বললেন, “এই শিশুটিকে আপনি কী করতে বলেন?”…
‘আমি বললাম, ।“আমার বলায় কিছু আসে-যায় না। বাচ্চার বাবা-মা কী বলেন?”
“বাচ্চার মাকে জানান হয় নি। তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। বাচ্চার বাবা চান না বাচ্চা বেঁচে থাকুক।“…
“আমি চুপ করে রইলাম। তিনি বললেন, ‘এ-রকম অ্যাবনর্মাল বাচ্চা এম্নিতেই মারা যাবে। আমাদের মারতে হবে না। প্রকৃতি এত বড় ধরনের অ্যাবনর্মালিটি সহ্য করবে না।“
‘আমি কিছু বললাম না। বাচ্চাটিকে ফুল স্পীড ফ্যানের নিচে রেখে দেওয়া হল। প্রচণ্ড শীতের রাত, বাচ্চাটির মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, এতেই তার মরে যাওয়া উচিত, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার—ভোর পাঁচটায় দেখা গেল, বাচ্চা দিব্যি সুস্থ। বড়-বড় চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, শিস দেওয়ার মতো শব্দ করছে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় সবার সম্মতি নিয়ে বাচ্চাটিকে এক শ’ সিসি ইমাডোজল ইনজেকশন দেওয়া হল। যে-কোনো পূর্ণবয়স্ক লোক এতে মারা যাবে, কিন্তু তার কিছু হল না। শুধু শিস দেওয়ার ব্যাপারটা একটু কমে গেল। ভোর ছ’টায় দেওয়া হল পঞ্চাশ সিসি এট্রোজিন সল্যুশন। বাচ্চাটা মারা গেল ছ’টা বিশে। বাচ্চার মা জানতে পারল না। সে তখনো ঘুমে অচেতন।’
মিসির আলি গল্প শেষ করলেন। আমি বললাম, ‘তারপর?’
‘তারপর আবার কি? গল্প শেষ।‘
‘বাচ্চাটির মা’র কী হল?’
‘বাচ্চার মা’র কী হল তা দিয়ে তো আমাদের প্রয়োজন নেই। রহস্য তো এখানে নয়। রহস্য হচ্ছে বাচ্চার মা যে-স্বপ্নগুলি দেখত সেখানে। সেই রহস্য আমি ভেদ করতে পারি নি। সুধাকান্তবাবুর রহস্যও শেষ পর্যন্ত ভেদ করতে পারব কি না তা জানি না।’
‘আমার তো মনে হয় রহস্য ভেদ করেছেন।‘
‘কাগজপত্রে করেছি। কাগজপত্রে রহস্য ভেদ করা এক জিনিস, বাস্তব অন্য জিনিস। যখন সুধাকান্তবাবুর মুখোমুখি বসব তখন হয়তো দেখব গুছিয়ে-আনা জিনিস সব এলোমেলো হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার কী, জানেন ভাই? প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না, সে নিজে কিন্তু খুব রহস্যময়।‘
‘কবে যাবেন সুধাকান্তবাবুর কাছে?’
‘হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই যাব। আপনি কি যাবেন আমার সঙ্গে?’
আমি বললাম, ‘অবশ্যই।’