০৮. মাসুম মুখ লম্বা করে বসে আছে

মাসুম মুখ লম্বা করে বসে আছে। আমাকে দেখে উঠে এল না। যেভাবে বসেছিল সেভাবেই বসে রইল। তার সামনে চায়ের কাপ। চায়ে চুমুক দেয় নি। ভরা কাপে দুতিনটা সিগারেটের টুকরো ভাসছে। আমি তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, তুই তো বিখ্যাত হয়ে গেলি! ফ্রন্ট পেইজে ছবি চলে এসেছে।

মাসুম ফিক করে হেসে ফেলল। যেন আমার কথায় মজা পেয়ে গেছে। সে হাসিমুখেই বলল, পাকেচক্রে আটকে পড়ে গেলামরে দোস্ত। ভিক্টোরিয়া পার্কে ব্যাপারটা ঘটল। আমি দরদাম কী করে হয় ঐটা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। দুই ধরনের মেয়ে আছে। এক ধরনের মেয়েদের হচ্ছে ফিক্সড় প্রাইস, অন্য আরেক ধরন আছে মাছের দামের মতো। দরাদরি হতে থাকে। আমি হাঁ করে দেখছি। ফট করে এসে পড়ল পুলিশ। কুড়িটা টাকা পকেটে থাকলে পুলিশের হাতে দিয়ে চলে আসতে পারতাম, কিন্তু এমনই কপাল, পকেটে পয়সা ছিল না।

আমি বললাম, পুলিশ কি তোকে ধোলাই দিল নাকি?

তেমন না। অল্পস্বল্প। পেটে একটা মাইন্ড ঘুসি। মুখেও দুএকটা মারলস ধরনের।

ঠোঁট তো মনে হচ্ছে ফাটিয়ে দিয়েছে। হাসতে এখন বোধহয় অসুবিধা হয়। হয় না?

তুই শালা রসিক আছিস। চা খাবি?

না।

এরা আফিং দিয়ে চা বানায়—খেয়ে দেখ এক কাপ। নেশা লেগে যাবে।

আফিং দিয়ে চা বানায় মানে?

কী-একটা যেন দেয়, খালি খেতে ইচ্ছা করে। আমি একবার পরপর আট কাপ চা খেয়েছি। তারপর দেখি মাথা ঘুরছে।

আবার মিথ্যা কথা বলছিস?

মিথ্যা বলব কেন?

তোর সামনেই তো এক কাপ চা পড়ে আছে। মুখেই তুলিস নি বলে মনে হচ্ছে।

মনটা ভালো নেই দোস্ত। মলিনার জন্যে খারাপ লাগছে। খুবই খারাপ লাগছে।

মলিনা কে?

ধরা পড়েছে আমাদের সাথে। বড় ভালো মেয়ে। কী রকম ঠাণ্ডা চেহারা। চোখগুলির উপর ছায়া পড়ে আছে, এরকম মনে হয়। আর গলার স্বর কী যে অদ্ভুত। শুধু শুনতে ইচ্ছে করে। অল্প কিছুক্ষণ ওর কথা শুনলে নেশা ধরে যায়, মনে হয় খালি কথাই শুনি।

তুই তো দূরে দাঁড়িয়ে দরদাম করা দেখছিলি। এত কথা শুনলি কখন?

হাজতে কথা হয়েছে।

হাজতে তো যতদূর জানি ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা-আলাদা রাখে।

মাসুম চুপ করে রইল। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

উঠি রে মাসুম। বাসায় যা, তোর মামা মনে হচ্ছে পেরেশান। বাসায় গিয়ে ভাতটাত খা।

মাসুম আমার সঙ্গে-সঙ্গে এল। নিচু গলায় বলল, এই কদিন আর কোথাও বেরুবটেরুব না। ভাইভার ডেট দিলে জানাবি। শিগগির দেবে নাকি?

দিয়ে দিয়েছে।

দিয়ে দিয়েছে মানে?

দিয়ে দিয়েছে মানে দিয়ে দিয়েছে। সাত, আট, নয়।

সে কী? তাহলে তো আন্দোলন করতে হয়।

কি আন্দোলন?

পরীক্ষা পেছানোর অন্দোলন। পাশ করে করবটা কী? বেকার হবার চেয়ে ছাত্র থাকা ভালো না? কত রকম ফেসিলিটি।

কি ফেসিলিটি?

মাসুম জবাব দিল না। বাস-স্ট্যান্ডে দুজন খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মোটামুটি ফাঁকা বাস একটা দাঁড়িয়েছিল। সেটায় উঠলাম না। কেন উঠলাম না কে জানে। পরের বাসটায় হয়তো গাদাগাদি ভিড় থাকবে। ঠেলাঠেলি করে তাতেই উঠব। আমরা সবাই কেমন অন্যরকম হয়ে গেছি। শুধু উল্টো কাজ করতে ইচ্ছা করে।

একটা মিছিল যাচ্ছে। নির্জীব ধরনের মিছিল। কোনোরকম উৎসাহ-উত্তেজনা নেই। কার চামড়া যেন তুলে নিতে চাচ্ছে, কিন্তু এমনভাবে বলছে যেন চামড়া তুলে নেয়াটা একটা আরামদায়ক ব্যাপার। মিছিলের পেছনে-পেছনে একটা পুলিশের গাড়ি। গাড়ির জানালায় মোটাসোটা একজন পুলিশ অফিসারের মুখ। ভদ্রলোককে খুবই ক্লান্ত মনে হচ্ছে। হাই তুলছেন।

মাসুম।

বল।

এশার সঙ্গে কি তোর ইদানীং দেখা হয়েছে?

পরশু হয়েছে।

ওর খবর কি বল তো?

খবর কিছু জানি না। সিরাজের সঙ্গে খুব খাতির জমিয়েছে।

সিরাজটা কে?

মালদার পার্টি, এশার একটা কবিতার বই বের করে দিয়েছে।

তাই নাকি?

হুঁ। আমার কাছে এক কপি বেচতে নিয়ে এসেছিল। পুশিং সেল। আমি বললাম–মাগনা দিলেও আমি এই বই নেব না।

সত্যি বই বের করেছে?

হুঁ।

আমার তো মনে হয় তুই আবার মিথ্যা কথা বলছিস।

মাঝে-মাঝে সত্যি কথাও বলি।

বইটার নাম কি?

নাম জানি না। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

মাসুম আগ্রহ নিয়ে মিছিলের দিকে তাকাচ্ছে। মিছিল দেখলেই সে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। এখনো করছে সম্ভবত। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ঢুকে পড়বে।

মাসুম পিচ করে এক দল থুথু ফেলে বলল, মাদি মার্কা একটা মিছিল বের করেছে। নেতাটাকে দেখছিস? পান খাচ্ছে, আঙুলে আবার চুন। এই শালা মিছিল করবে। কি? কিছু একটা করা দরকার বীরু।

কী করবি?

পুলিশের জীপে দুটা ইটের চাক্কা মারলেই খেল জমে যাবে। আয় না!

পাগল।

দেশটা কেমন ঝিম মেরে গেছে। উত্তেজনা নেই। ফায়ার নেই। ঐ শালা নেতার দিকে তাকিয়ে দে হারামজাদা এখন সিগারেট ধরাচ্ছে—দাঁড়া খেল জমিয়ে দিই। ভেলকি লাগিয়ে দেব। পটকা-ফটকা থাকলে ভালো হত।

আমি উদ্বিগ্ন গলায় বললাম, আমি বাসে উঠে বিদায় হয়ে নিই, তারপর যা ইচ্ছা করিস।

তাড়াতাড়ি চলে যা। হেভি গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে দেব।

আমি দ্রুত বাসে উঠে পড়লাম। মাসুম চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে কাণ্ড কিছু একটা করবে। আমার বাস চলে না-যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে কি না কে জানে। আমি বাসের জানালা গলে হাত নাড়লাম। মাসুম দেখল কি না বুঝলাম না, মুখ শক্ত করে আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। বাস ছেড়ে দিল। দেখতে দেখতে ঝড়ের গতি। প্রতিটি বাস এবং ট্রাকের ড্রাইভাররা সম্ভবত নিয়তিবাদী। যা হবার হবে এই রকম একটা ভাব করে এক্সিলেটার চাপতে থাকে। সামনে বড় রকমের জটলা থাকলে হয়তোবা চোখ বন্ধ করে ফেলে। মতি মিয়া নামের একজন ট্র্যাক ড্রাইভারের সঙ্গে আমার খানিকটা আলাপ আছে। তার কাছে শুনেছি, ঢাকা শহর নাকি একজন কামেল আদমির কন্ট্রোলে আছে। সেই কামেল আদমির হুকুম ছাড়া কিছু হবার উপায় নেই। কাজেই সাবধান হয়ে ট্রাক চালালে যে-কথা, অসাবধান হয়ে চালালেও সেই একই কথা। আকসিডেন্ট হবার হলে হবেই।

সেই কামেল আদমির ঠিকানাও মতি মিয়া জানে। একদিন আমাকে নিয়ে যাবে, এরকম কথা আছে। ভেবে রেখেছি যাব। দেখে আসব। পৃথিবীতে দেখার জিনিসের শেষ নেই। অনেক কিছুই তো দেখলাম, একজন কামেল আদমিও দেখে আসি। মনে-মনে ভদ্রলোকের একটা চেহারাও কল্পনা করে রেখেছি। তিন মণের মধ্যে ওজন (এখন পর্যন্ত কোনো রোগা পীর আমার চোখে পড়ে নি। ঐশ্বরিক ব্যাপার-স্যাপার এবং শরীরের মেদ—এই দুয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে বলে আমার ধারণা)। ভদ্রলোকের গা থেকে নিশ্চয়ই ভুরভুর করে আতরের গন্ধ বেরুচ্ছে। চোখে সুৰ্মা দেওয়ায় চোখ দুটি দেখাবে কোমল। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরও হবে মোলায়েম যাকে বলে সিকি ভয়েস। এঁদের সব কিছুই মোলায়েম থাকে। গলার স্বর মোলায়েম, কথাবার্তা মোলায়েম, শরীর মোলায়েম—শুধু অন্তরটি কঠিন। একাত্তুরে তাই দেখা গেছে।

বাস বড় রকমের একটা ঝাঁকুনি খেয়ে হঠাৎ চলতে শুরু করল, আর ঠিক তখন এশাকে দেখলাম। রাস্তা পার হচ্ছে। তার রাস্তা পার হবার টেকনিকটি চমৎকার। ডান-বাম কোনো দিকেই তাকাবে না। মাথা নিচু করে ছোট-ঘোট পা ফেলবে। ভাব দেখে মনে হবে সে অন্ধ এবং বধির। গাড়ির হর্ন, রিকশার টুনটুন কিছুই তাকে স্পর্শ করবে না। একদিন রাগ করে বলেছিলাম, কী সব ছেলেমানুষী করা কোনো অসাবধান ড্রাইভার যদি তোমার উপর গাড়ি তুলে দেয়, তখন?

তুলবে না।

তুলবে না। এ রকম মনে করার কারণ কি?

কারণ হচ্ছে, ওরা যখন দেখবে খুবই অসাবধান একটি মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, তখনি সাবধান হয়ে যাবে।

ওরা নাও তো দেখতে পারে।

উঁহু দেখবেই। কারণ আমি একজন রূপবতী মেয়ে। রূপবতী একটি মেয়েকে দেখবে না, তা কি হয়! আর যদি গাড়ি তুলেই দেয়, রাস্তায় মরে পড়ে থাকব। বিখ্যাত একজন কবি রাস্তায় মরে পড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে একটা মিল পাওয়া যাবে।

বিখ্যাত কবিটা কে?

জীবনানন্দ দাশ।

আমি অবলীলায় বললাম, সে আবার কে? এশা আহত গলায় বলল, ঠাট্টা করছ?

না, ঠাট্টা করব কেন? নাম শুনি নি।

সত্যি নাম শোন নি?

উঁহু।

একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে তুমি এসব কী বলছ?

আমি শিক্ষিত—এই কথাটা তোমাকে বলল কে?

এশা ফোঁস করে বলল, আমার হাত ছাড়।

আমি হাসিমুখে বললাম, আমি তোমার হতে ধরে নেই। হাত ছাড়ার কথা উঠছে। কেন? এশা একটু যেন লজ্জা পেল। আর আমার মনটা হল খারাপ। এশা যেভাবে বলল, আমার হাত ছাড়—তা থেকে মনে হয় অনেকেই নিশ্চয়ই এশার মন খারাপ করে দেবার মতো কিছু কথাবার্তা তার হাত ধরে রেখেই বলে। তখন এশা বলে, আমার হাত ছাড়। বলতে-বলতে এটা তার অভ্যেস হয়ে গেছে।

যে-কেউ এশার হাত ধরতে পারে। এশা তাতে কিছুই মনে করে না।

জীবনানন্দ দাশের নাম আমি কেন শুনব না? আমাদের কাজই হচ্ছে বিখ্যাত লোকদের নাম শোনা। প্রতিভাবান ব্যক্তিদের প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হওয়া। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবা, আহা রে—আমি কেন এরকম হতে পারলাম না! ঈশ্বরের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোেগ যদি কখনো হয়, তাহলে অবশ্যই তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হবে জনাব, আপনি অল্প কিছু মানুষকে প্রতিভা দিয়ে পাঠালেন আর আমাদের বানালেন ভেজিটেবল। এই কাজটি উচিত হল? সাম্যবাদী স্পিরিট আপনার মধ্যে কেন এল না বলুন তো?

এশাকে অবাক করে দেবার জন্যে জীবনানন্দের দুটা কবিতা মুখস্থ করে ফেললাম। তেমন কোন সুযোগ পেলে আবৃত্তি করা যাবে। তিন মাসের মধ্যে কোনো সুযোগ পাওয়া গেল না! এশার সঙ্গে বেশ কয়েক বার দেখা হল। দুবার গুলিস্তানের মোড়ে, এক বার এলিফেন্ট রোডে, বেশ কয়েক বার মধুর ক্যান্টিনে। এইসব জায়গায় নিশ্চয় বলা যায় না

ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘশাদা শাদা যেন কড়ি শঙ্খের পাহাড়
নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে–কোন এক শঙ্খবালিকার
ধূসর রূপের কথা মনে হবে……..

অবশ্যি একবার কবিতা শোনাবার সুযোগ তৈরি হল। এশার সঙ্গে রিকশা করে যাচ্ছি। মেঘলা দুপুর। মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা। রিকশাওয়ালাও বুড়ো—আমাদের কথাবার্তা কিছু শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। এশার মন খুব তরল অবস্থায় আছে বলেও মনে হল। আমি কবিতাটা মনে-মনে এক বার আবৃত্তি করে নিলাম, যাতে ঠিক সময়ে আটকে না যায়

ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে…………।

দ্বিতীয় লাইনে গণ্ডগোল হয়ে গেল। শিয়রে কী, তাই ভুলে গেলাম। বৈশাখ মাস, নাকি ভাদ্র মাস? মনে হচ্ছে শিয়রে খুব সম্ভবত আষাঢ় মাস। কারণ এই মাসটা নিয়েই কবিদের মাতামাতি বেশি।

এশাকে কবিতা শোনানো হল না। ভালোই হল-হয়তো সে হেসে ফেলত। তার পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। মুনিরুজ্জামান নামের এক ছোকরা অধ্যাপক একবার এশাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। গদগদ গলায় বলেছিল, এশা, আমি তোমাকে ভালবাসি।

এশা তৎক্ষণাৎ বলেছে, আমিও আপনাকে ভালবাসি। কাজেই শোধবোধ হয়ে গেল। এখন আর ঐ নিয়ে কথা বলবেন না।

মুনিরুজ্জামান পরবর্তী সময়ে এশাকে নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা রটিয়েছিল। এশা তাতে খুব মজা পেয়েছে।

এত কাছ দিয়ে এশা চলে গেল, অথচ তাকে ডাকা গেল না। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। সারাদিন তাকে খুঁজছি, এখন দেখা পেলাম অথচ ডাকতে ইচ্ছা হল না। আমরা বড় অদ্ভুত প্রাণী।

বাসায় ফিরলাম পাঁচটায়।

ধীরেন কাকু বারান্দায় মুখ শুকনো করে বসে আছেন। বারান্দায় ডাক্তার বসে থাকা মানেই কিছু-একটা ঝামেলা হয়েছে। মার সেই ব্যথা কিংবা বাবার কাশি। তবে গুরুতর কিছু নয়। সেরকম হলে ডাক্তার বারান্দায় বসে চুকচুক করে চা খেত না। ধীরেন কাকু বললেন বীরু, কোথায় ছিলে সারাদিন?

একটা ইনটারভ্যু ছিল কাকা।

তোমার বাবাও তাই বলছিলেন, এদিকে তো যমে-মানুষে টানাটানি হচ্ছিল। তোমার বাবার কথা বলছি। হঠাৎ কাশি–সেই কাশির সঙ্গে হলুদ রঙের ডিসচার্জ কিছু ব্লডও আছে।

বলেন কী?

এখন একটু ভালো, ঘুমুচ্ছেন। শোন বীরু, আমার তো মনে হয় তাঁকে হাসপাতালে ট্রান্সফার করা দরকার। তোমার চেনাজানা কেউ আছে?

জ্বি-না।

ধরাধরি ছাড়া তো কিছু হবে না। হাসপাতালের গিয়ে একটু খোঁজ নিয়ে দেখ। অনেক সময় টাকাপয়সা দিয়েও কাজ হয়। যাও, ভেতরে যাও। আমি আছি কিছুক্ষণ। ঘুম ভাঙুক। ভয়ের কিছু নেই।

আমি পা টিপে-টিপে ভেতরে ঢুকলাম। আমি ভেবেছিলাম মা এবং পারুল দু জনেই আমাকে দেখামাত্র মুখ কঠিন করে ফেলবে। এমন একটা ভঙ্গি করবে, যেন মহা পাষণ্ড এইমাত্র বাড়ি ফিরছে—যার বাবা মারা যাচ্ছে, অথচ এ নিয়ে যার কোনো মাথা ব্যথা নেই, বুকে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাস্তবে তা হল না। মা আমাকে দেখে অসম্ভব খুশি হয়ে গেলেন। আনন্দে তাঁর মুখ ঝলমল করতে লাগল। এই আনন্দ ভরসা ফিরে পাওয়ার আনন্দ। আমাকে হাত ধরে রান্নাঘরে টেনে নিয়ে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন, এখন ভালো। খুব ভালো। ঘুমাচ্ছে।

শুরু হল কখন?

তুই যাওয়ার পরপরই। পানি খেতে চাইলেন, পানি দিলাম। পানি খাওয়া শেষ করেই কাশি। প্রথমে অল্প, তারপর চোখটোখ উল্টে যাবার মতো অবস্থা।

বল কী।

যা ভয় পেয়েছিলাম না বীরু।

ভয়ের কী আছে? মানুষের অসুখ হয় না? অসুখ হয়, চিকিৎসা করলে সুস্থ হয়। তুই যা, তোর বাবাকে দেখে আয়। শব্দ করি না, উঠে পড়বে।

আমি পা টিপে-টিপে বাবার ঘরে ঢুকলাম। গা কেমন যেন শিরশির করছে। খুব জ্বর আসবার আগে যেমন হয়, তেমন। গলা বুক শুকিয়ে কাঠ।

বাবাকে পরিষ্কার দেখা গেল না। ঘর অন্ধকার। বাবার উপর একটা মশারি ফেলে দেওয়া। মাছির উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্যে এই ব্যবস্থা। দিনের বেলা ঘুমালেও বাবা মশারি ফেলে দেন। পারুল, হাতপাখা নিয়ে মশারির ভেতর বসে আছে। ক্ৰমাগত হাওয়া করছে। কতক্ষণ ধরে করছে কে জানে। এ-ঘরে একটা সিলিং-ফ্যান আছে। কয়েল পুড়ে যাওয়ায় ফ্যান ঘুরছে না। সামান্য কটা টাকা হলেই কয়েল ঠিক করা যায়। টাকাটার ব্যবস্থা বাবা সম্ভবত করে উঠতে পারছেন না। আমি পা টিপে-টিপে রান্নাঘরে চলে এলাম।

মা রান্না চাপিয়েছেন। হাঁড়িতে ভাত ফুটছে। তিনি অতি দ্রুত বেগুন কুটছেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, আজ দুপুরে কারো খাওয়া হয় নি, বুঝলি। কী যে ঝামেলা গিয়েছে। মুনিরের মাকে দিয়ে একটা মুরগীর বাচ্চা আনিয়ে ছদকা দিলাম। জানের বদলে জান।

ভালো করেছ।

ডাক্তারবাবু যা করেছেন বলার না! তুই এটা খুব খেয়াল রাখবি বীরু। উনার কোনো বিপদ হলে জান দিয়ে পড়বি।

মা চোখ মুছলেন। লোকটা যা করেছে—কেউ কারো জন্যে এরকম করে না।

খারাপ ডাক্তাররা মানুষ হিসেবে ভাল হয় মা।

ছিঃ, এটা কী রকম কথা! খারাপ ডাক্তার হবে কী জন্যে?

এমনি বলছি। ঠাট্টা করছি।

এরকম ঠাট্টা আর কবি না বীরু।

আর করব না।

ডাক্তারবাবুকে এখন বল চলে যেতে। কতক্ষণ বেচারা বসে থাকবে। তার বাবার ঘুম ভাঙলে খবর দিয়ে নিয়ে আসবি।

ধীরেন কাকু ঝিমুচ্ছিলেন। আমার কথা শুনে বাসায় চলে যেতে রাজি হলেন। শুকনো গলায় বললেন, হাসপাতালের ব্যবস্থাটা কর। আমি অবস্থা ভালো দেখছি না। হার্টের বিট রেগুলার না, ইরেগুলার। মাঝে-মাঝে কেমন যেন থেমে-থেমে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা পর্যন্ত বাবা ঘুমুলেন। এই সময়টার মধ্যে আমি মার কাছে অন্য একটা খবর পেলাম।

তোর কাছে একটা মেয়ে এসেছিল রোগা-পাতলা, খুবই মিষ্টি চেহারা।

কখন এসেছিল?

তোর বাবাকে নিয়ে যখন যমে-মানুষে টানাটানি হচ্ছে তখন। কোনো কথাই বলতে পারি নি। কথা আর কি বলব বল, আমার নিজের কি তখন হুশ-জ্ঞান আছে? বাড়িওয়ালার বৌ এসেছিল, সে বলছে-আপা মাথা উত্তর-দক্ষিণ করে দিন।

মাথা উত্তর-দক্ষিণ করে দিতে হবে কেন?

মরবার সময় তাই করার নিয়ম।

এই অবস্থা হয়েছিল নাকি?

হয়েছিল।

সন্ধ্যা মিলাবার আগেই মা এবং পারুল ভাত নিয়ে বসে গেল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা অসম্ভব ক্ষুধার্ত। আমি বাবার ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালাম, বাবা জেগে উঠে বললেন, কে?

বাবা, আমি। আমি বীরু।

বাতি নিভিয়ে দে।

বাতি নিভিয়ে খাটের কাছে এগুতে গিয়ে কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেলাম। ঝনঝন শব্দে কী যেন নিচে পড়ল।

বাবা ভারি গলায় বললেন, কে, বীরু?

হুঁ।

ইন্টারভ্যু কেমন হয়েছে রে?

ভালো।

কী রকম ভালো?

বেশ ভালো। মনে হচ্ছে লেগে যাবে।

পেরেছিলি সব?

হ্যাঁ। দু একটা মিস হয়েছে।

আশ্চৰ্য মিথ্যা কথা বলতে আমার মোটেও আটকাচ্ছে না। অবলীলায় মিথ্যা বলছি। মনে হচ্ছে মাসুমের চেয়েও ভালো বলছি। মিথ্যাটাকে আমার নিজের কাছেই সত্যি বলে মনে হচ্ছে।

কোনটা পারিস নি?

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর তারিখ জিজ্ঞেস করল, ঐটা পারি নি।

২২শে শ্রাবণ। পারিস নি কেন? মনে ছিল না বাবা।

খুব অন্যায়। গ্রেটম্যানদের মৃত্যুর তারিখ জন্মের তারিখ সব মুখস্থ থাকা দরকার।

অন্য সব পেরেছি। ইন্টার ববার্ডের চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন মফস্বলে পোস্টিং দিলে আপনার আপত্তি আছে?

তুই কী বললি?

বললাম–না।

খুব ভালো করেছি। পোস্টিং একবার হলে ট্রান্সফার করা কঠিন না।

তা ঠিক।

বাবা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোর আজকের ইন্টারন্যু ভালো হবে জানতাম। সব খারাপ জিনিসের সাথে একটা ভাল জিনিস থাকে। অসুখটা যখন খুব বেড়ে গেল, তখনি বুঝলাম তোর ইন্টার ভালো হচ্ছে।

বাবা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি পা টিপে-টিপে আমার নিজের ঘরে চলে এলাম। পারুল কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে ঢুকল। সে খুব ভয় পেয়েছে। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে। সে টেবিলে চা নামিয়ে রেখে বলল, ভাইয়া ঐ মেয়েটা বলে গেছে আজ সন্ধ্যাবেলা নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানগুলোর সামনে তুমি যেন যাও। খুব নাকি দরকার।

কী দরকার কিছু বলে নি?

না। কিন্তু ভাইয়া, তুমি ঘরে ছেড়ে যাবে না। বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। তুমি আগে দেখ নি, তাই কিছু বুঝতে পারছ না। বুঝলে?

হ্যাঁ, বুঝলাম।

মেয়েটা কে?

আমাদের সঙ্গে পড়ে।

মেয়েটার সঙ্গে কোনো কথাই বলতে পারি নি। তাকে আরেক দিন আসতে বলবে?

আমি হ্যাঁ-না কিছু না-বলে শার্ট গায়ে দিলাম। পারুল তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কোথায় যাচ্ছ?

ধীরেন কাকু বলেছেন হাসপাতালে একটু খোঁজ নিতে, সিট পাওয়া যায় কি না।

পারুল আমার কথা বিশ্বাস করল না। তার চোখ দিয়ে ঘৃণা ফুটে বেরুচ্ছে। আমার ইচ্ছা করছে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিতে। কারণ আমি সত্যি-সত্যি হাসপাতালেই যাচ্ছি। যাবার আগে দু এক মিনিটের জন্যে নিউমার্কেটে হয়তো থামব। সেটা বিরাট কোনো অন্যায় নিশ্চয়ই হবে না।

 

টুকু লম্বা-লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে।

যখন কারো সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছ করে না তখনই টুকুর সঙ্গে দেখা হয়। তার হাত থেকে সহজ নিস্কৃতি বলে কোন কথা নেই। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে কথা বলবে। চলে যেতে চাইলে হাত চেপে ধরবে। পেছনে পেছনে আসবে।

টুকু সরু গলায় ডাকল, দোস্ত। আমি না শোনার ভান করলাম।

দোস্ত একটা কথা শুনে যা।

আমার কাছে টাকা-পয়সা নেইরে টুকু। দোস্ত-দোস্ত বললে কোন লাভ হবে না।

টাকাপয়সার দরকার নেই। আল্লাহর কসম। বিশ্বাস কর আমার পকেটভর্তি টাকা। দরকার হলে তুই কিছু নে সত্যি বলছি নে।

টুকু একগাদা এক শ টাকার নোট বের করল। চকচকে নোট। আমি হকচকিয়ে গেলাম।

দোস্ত তুই নে। কত লাগবে বল?

লাগবে না কিছু।

লাগবে লাগবে। চাচাজানের কথা শুনেছি। পানির মতো টাকা খরচ হবে। ডাক্তার ফাক্তার কত হাঙ্গামা। তার উপর ধর-আল্লাহু না করুক সত্যি-সত্যি যদি কিছু হয় তখন তো…..

আমি বহু কষ্টে নিজেকে সামলালাম। টুকুর উপর রাগ করা অর্থহীন। কেন রাগ করছি তা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। আমি কঠিন স্বরে বললাম, পথ ছাড় টুকু, কাজ আছে।

এক মিনিট দোস্ত। জাস্ট ওয়ান মিনিট। একটা খুবই জরুরি কথা। তোর পায়ে ধরছি দোস্ত, শুনে যা।

টুকু সত্যি-সত্যি নিচু হয়ে আমার পা চেপে ধরল।

বল কী বলবি।

টাকা কীভাবে পেয়েছি সেটা বলব।

বলার দরকার নেই। বুঝতে পারছি।

তুই যা ভাবছি, তা না দোস্ত। আপঅন গড। মজুমদার সাহেব আমাকে টাকাটা দিয়েছেন। সন্ধ্যাবেলা ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর একটা খামের মধ্যে করে দিয়ে দিলেন। তিন হাজার এক শ টাকা।

কেন দিল?

সেটা বলে নি। বলেছে—টুকু, আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে। আমি বললাম–দেব। তখন মজুমদার সাহেব খামটা দিলেন।

কাজটা কি?

সেটা তো দোস্ত বলে নি। পরে বলবে। অ্যাডভান্স পেমেন্ট। রাত আটটার সময়। যেতে বলেছে।

ভালোই তো, যা।

কিন্তু দোস্ত মনটা খারাপ। কী কাজ কে জানে!

মানুষ-মারা কাজ। কাউকে মেরে ফেলতে বলবে।

টুকু হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, পথ ছাড়। কাজ আছে। টাকাটা কি ফিরিয়ে দেব দোস্ত?

তোর ইচ্ছা।

ফেরত দেব কীভাবে? হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। একটা গরম শাল কিনলাম।

ভালোই করেছিস, অস্ত্রপাতি লুকিয়ে রাখার জন্যে শাল হচ্ছে চমৎকার জিনিস।

টুকু ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। নিচু গলায় বলল, তুই কিছু টাকা রেখে দে দোস্ত। তোর কাছ থেকে এক টাকা দুটাকা করে মেলা নিয়েছি।

আমার লাগবে না। যাই রে টুকু।

টুকু আমার সঙ্গে-সঙ্গে আসতে লাগল। সে আসবেই। রিকশায় না-ওঠা পর্যন্ত সে আসবে। রিকশায় ওঠার পরও সে অনেকক্ষণ রিকশা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।

দোস্ত একটা বুদ্ধি দে। কী করব যাব মজুমদারের কাছে?

টাকা নিয়েছি, যাবি না মানে? না গেলে মজুমদার তোকে ছাড়বে?

যদি সত্যি-সত্যি মানুষ মারার কথা বলে, তখন কী করব?

একটা লম্বা ছুরি সাথে করে নিয়ে যা। তোর নতুন শালের আড়ালে লুকিয়ে রাখবি। মানুষ মারার কথা বললে ছুরিটা বের করে ওর ভুড়ির মধ্যে বসিয়ে দিবি।

ঠাট্টা করছিস কেন রে দোস্ত? একটা সিরিয়াস প্রবলেম।

ঠাট্টা করছি তোকে বলল কে? ওকে মারতে পারলে তোর আগের সব পাপ কাটা যাবে।

টুকু ফ্যাকাসেভাবে হাসতে লাগল। তার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। থরথর করে ঠোঁট কাপছে। একটা হাত প্যান্টের পকেটে। এক শ টাকার চকচকে নোটগুলি সে নিশ্চয়ই এই হাতে ধরে আছে। নতুন নোটের স্পর্শের মতো আরামদায়ক আর কিছুই নেই। আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, চলি রে টুকু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *