০৮. মাদ্রী
০১.
কাব্যের দৃষ্টিতে যে চরিত্র তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয়, জীবনের বাস্তবতায় সেই চরিত্রই অনেক মূল্যবান হয়ে ওঠে। মহাভারত যেহেতু আমার কাছে কল্পকাহিনি নয় এবং আমার কাছে যেহেতু এটি এক সচল এবং সজীব সমাজের প্রতিফলন, তাই আমার কাছে মহাভারতীয় প্রত্যেকটি চরিত্রে জীবনের তথ্য এবং তত্ত্বটুকুই বড়, কাব্যকল্পনা নয়। মহাভারতকে যারা কবিকল্পিত কাব্য হিসেবে দেখেন, তাঁরা অনেকেই আমাকে বলেছেন– আচ্ছা। এই মাদ্রীর কী প্রয়োজন ছিল পাণ্ডুর জীবনে! পাণ্ডু নিজেও বাঁচলেন না, মাদ্রীকেও প্রায় তিনিই বাঁচতে দিলেন না। বড় সংক্ষিপ্ত মাদ্রীর জীবনও। দুটি ছেলে নকুল-সহদেব– তারাও মহাকাব্যের বিভিন্ন পরিণতির মধ্যে এমন কোনও গভীর স্বাক্ষর রাখেন না, যাতে মাদ্রীকে পুত্ৰ-পরিচয়েও এক বীর-জননী বলে চিহ্নিত করা যায়। তা হলে কেন এই মাদ্রী?
দেখুন, মহাভারত যদি মাত্র মহাকাব্যের কল্প হত, তা হলে বলতাম– যত ক্ষুদ্রই হোক মাদ্রী-চরিত্রের পরিধি এবং তাৎপর্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় ঠিকই, তবু মাদ্রীকে ছাড়া এই মহাকাব্য অসম্পূর্ণ থেকে যেত। এ-চরিত্রের পার্শ্ব-সহায়তা এমনই যে, তিনি ছাড়া মহাকাব্যের মুখ্য চরিত্রগুলিও বিপন্ন হয়ে পড়ে। তিনি না থাকলে পাণ্ডু বেঁচে থাকতেন, পা বেঁচে থাকলে হস্তিনার সিংহাসন নিয়ে রাজনৈতিক খেলাটিও একেবারে অন্যরকম হত। আর কাব্যকল্প ছেড়ে দিয়ে যদি জীবনের পরিসরে নেমে আসি অর্থাৎ যদি সেই সচল মহাকাব্যিক সমাজের এক বাস্তব চরিত্র যদি হয় মাদ্রীর জীবন- অন্তত আমি তাই বিশ্বাস করি, তা হলে বলব– মাদ্রী সেই সমাজটাকেই চিনিয়ে দেন; চিনিয়ে দেন সেই সমাজের কামনা, ক্ষুধা, বাৎসল্য এবং সমর্পণের দিকগুলি।
শুধু মহাভারত কেন, তার দোসর পুরাণগুলির মধ্যেও আমরা কুন্তীর কথা অনেক পাব। পাণ্ডুর প্রথমা পত্নীর বাল্য-জীবন, দত্তক কন্যা হিসেবে কুন্তিভোজ রাজার কাছে তাঁর আগমন, তার কন্যা-গর্ভ, কানীন পুত্র– কত সব বৈচিত্র্য দিয়ে মোড়া তাঁর প্রাক-বিবাহ পর্ব। সেই তুলনায় মাদ্রীর কথা আমরা প্রায় কিছুই জানি না। পাণ্ডু যখন কুন্তীকে স্বয়ংবরে লাভ করে জিতে আনলেন, তখন এইটুকু মাত্র খবর পেয়েছি যে, পাণ্ডু কে নিয়ে এসে আপন ভবনে প্রবেশ করলেন। বাস্ এইটুকুই, তার পরেই আবার তার পুনর্বিবাহের মাদল বাদ্য শুনতে পাচ্ছি। মহাকাব্যের মধ্যে যে আড়ম্বর থাকে তাতে বিবাহোত্তর সময়ে প্রথমা বধূটির সঙ্গে হস্তিনার রাজার বৈবাহিক সুখের কিছু বর্ণনা প্রত্যাশিত ছিল। অথচ তা এখানে নেই। কুন্তীর বিবাহের পরেই দেখছি– মহামতি ভীষ্ম পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য মতি স্থির করেছেন– বিবাহস্যাপরস্য অর্থে চকার মতিমান মতি। সন্দেহ হয় ভীষ্ম কি সংগোপনে জানতেন যে, পাণ্ডু সন্তান উৎপাদনে অপারগ। অথবা ভীষ্ম না জানলেও পাণ্ডু নিজে কি নিজের কথা জানতেন, যে কারণে প্রথমা বধূ কুন্তীর কাছে নিজের এই অসহায় অক্ষমতা চাপা দেবার জন্যই পাণ্ডু খুব তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় বিবাহের কথা ভেবেছিলেন। এ কথাও ভাবার কোনও কারণ নেই যে, পাণ্ডুর অভিমত-সারস্য ছাড়াই ভীষ্ম নিজে থেকেই তার দ্বিতীয় বিবাহের উদ্যোগ নিয়েছেন।
ভীষ্মের কাছে পূর্বাহ্নেই সংবাদ ছিল যে, মদ্রদেশে একটি রাজকন্যা আছে। মদ্ৰাধিপতি কন্যার পিতা বোধহয় বেঁচে নেই, কিন্তু তাতে বিবাহের কোনও সমস্যা নেই, কেননা সেই পরমা সুন্দরী কন্যার বিবাহের উপযুক্ত বয়স হয়েছে এবং তার ভাই এই বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। ভাল একটা দিন দেখে শান্তনব ভীষ্ম মদ্রদেশে রওনা দিলেন। তার সঙ্গে চললেন বৃদ্ধ কয়েক জন অমাত্য, কয়েক জন ঋষি ব্রাহ্মণ, এবং সৈন্য-সামন্তের একটা সমর্থ বাহিনী– বলেন চতুরঙ্গেণ যযৌ মদ্রপতেঃ পুরম– অর্থাৎ গজ-বাজী-রথ-পদাতিকের একটা সম্পূর্ণ বাহিনী চলল ভীষ্মের সঙ্গে। তার পূর্বের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। কুমার বিচিত্রবীর্যের বিবাহের সময় তাকে স্বয়ংবর-ক্ষেত্র থেকেই প্রায় যুদ্ধ আরম্ভ করতে হয়েছিল, তিনি এক্কেবারে একা পড়ে গিয়েছিলেন তখন। সেবারে ভাইয়ের জন্য মেয়ে আনতে গিয়েছিলেন, এবারে ভাইপোর জন্য, বয়সটা একটু বেড়েছে, বেড়েছে অভিজ্ঞতা। তাই মন্ত্রী-পুরোহিত এবং সৈন্য সব সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন ভীষ্ম।
হস্তিনাপুর থেকে মদ্রদেশ খুব কাছেও নয় আবার খুব দূরেও নয়। যাঁরা মদ্রদেশ বলতে আধুনিক ‘ম্যাড্রাস’ বোঝেন, তাঁরা এক্কেবারে ভ্রান্ত। ভারতীয় সংস্কৃতিতে মদ্রদেশের একটা বড় ভূমিকা আছে এবং মনে রাখতে হবে– বৈদিক ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে মদ্রদেশ এবং মদ্রজাতির উল্লেখ আছে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ এ-বিষয়ে প্রমাণ দেবে। জায়গাটা এতটাই প্রাচীন বর্ধিষ্ণু অঞ্চল যে, সেই অতি-প্রাচীন যুগেই মদ্রদেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল– একটার নাম উত্তর মদ্র অন্যটা দক্ষিণ-মদ্র। উত্তর-মদ্রেরা হিমালয়ের ওপার জুড়ে অর্থাৎ কাশ্মীর দেশেরও উত্তর দিকে থাকতেন আর দক্ষিণ-মদ্রেরা আধুনিক পঞ্জাবের পাশে শিয়ালকোট বলে যে জায়গাটা আছে, সেই অঞ্চল জুড়ে বসবাস করতেন। মহামতি ভীষ্ম উত্তর না দক্ষিণ মদ্রে গেলেন– সে-কথা মহাভারতের কবি স্পষ্ট করে বলেননি, তবে মদ্রদেশের অধিবাসীদের বর্ণনা পরেও যা মহাভারতে পেয়েছি, তাতে দক্ষিণ মদ্রকেই বুঝি মদ্রদেশ বলা হয়েছে এবং মহাভারতের কালে এই দেশের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতেও অবক্ষয় ঘটেছে, যে-কারণে মাদ্র জনসাধারণকে ‘বাহিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সে যাই হোক, পঞ্জাব-কাশ্মীরের মেয়েদের সৌন্দর্যের খ্যাতি যে কতটা, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, অতএব মদ্রদেশের সেই অসাধারণ সুন্দরী যাতে হস্তিনাধিপতি পাণ্ডুর পাণিগৃহীতী হন, সেই আশা নিয়েই ভীষ্ম তার মন্ত্রী-অমাত্য, পারিষদ নিয়ে উপস্থিত হলেন মদ্রদেশে। তৎকালীন ভারতবর্ষে ভীষ্মের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাঁর আগমনের মধ্যে যেহেতু যুদ্ধের আস্ফালন ছিল না, অতএব মদ্ররাজ ভীষ্মের নাম শুনেই– তমাগতমভিতঃ– বহু দূর এগিয়ে এসে ভীষ্মকে প্রত্যুদগমন করে নিয়ে প্রবেশ করালেন রাজসভায় প্রত্যুগম্যাচয়িত্ব চ পুরং বেশয়পঃ। সেকালের দিনে অতিথি-সুজনকে অভিবাদন-অভ্যর্থনা করার নানান ভাবনা ছিল। একেবারে সামান্যভাবে অভ্যর্থনা জানালেও অতিথিকে পা-ধোয়ার জলটুকু, বসার আসনটুকু দিতেই হত। আবার সামান্য আড়ম্বর যুক্ত হলেই পা-ধোয়ার জল, আসন, ফল-মূলের অর্ঘ্য এবং বিশেষত মধুপর্ক দেবার বিধান ছিল। মধুপর্ক হল দই, দুধ, ঘি, জল, চিনি (মিছরি) এবং এক বিশেষ ধরনের পিঙ্গলবর্ণ মধুর মিশ্রণ। দুধটা অনেক সময় মধুপর্ক থেকে বাদ যায়, তবে এই মধুপর্কের মিশ্রণকে অতিথি। সৎকারে গৃহস্থের সৌভাগ্যদায়ী বলে মনে করা হত। মদ্ররাজ ভীষ্মকে পাদ্য-অর্ঘ্য-আসন মধুপর্ক দান করে মদ্রদেশে তার আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন– মধুপর্কঞ্চ মদ্রেশঃ পপ্রচ্ছাগমনেহর্থিতাম।
আগেই বলেছিলাম–মদ্ৰাধিপতি বলে এতদিন যিনি ছিলেন, তিনি বোধহয় তখন সদ্যই মারা গেছেন এবং তাঁর পুত্র শল্য তখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে মদ্রেশ বলতে যেন কিছু দ্বিধা ছিল। কেননা মদ্ররাজ, মদ্রেশ বলে প্রথম পরিচয়-জ্ঞাপনের সময় একবারও যেখানে শুল্যের নাম উচ্চারিত হল না, সেখানে ভীষ্ম কিন্তু প্রথম কথা বলছেন শল্যের সঙ্গেই। তাতেই বুঝি, শল্যই এখন রাজা। ভীষ্ম বললেন- তোমার রাজ্যে আমার ভাইপো হস্তিনাধিপতি পাণ্ডুর জন্য মেয়ে দেখতে এসেছি হে– আগতং মাং বিজানীহি কন্যার্থিনমরিন্দম। শুনেছি, তোমার বোনটি নাকি বড় লক্ষ্মীমতী মেয়ে, যেমন তার রূপ তেমনই তার গুণ। আমি তোমার বোনটিকে আমার ভাইপো পাণ্ডুর জন্য বরণ করে নিয়ে যেতে এসেছি। ভীষ্ম আরও একটু আগ্রহ দেখিয়ে শল্যকে বললেন- এই যে বৈবাহিক সম্বন্ধ ঘটছে, তাতে তোমরাও যেমন আমাদের পালটি ঘর, তেমনই আমরাও তোমাদের উপযুক্ত ঘরানার লোক। অতএব সেই সমতার সম্বন্ধ মনে রেখে তুমি আমার এই বৈবাহিক প্রস্তাব সমর্থন করে আমাদের যথাযথ আদর-সৎকার করবে আশা করি– যুক্তরূপো হি সম্বন্ধে ত্বং নো রাজন বয়ং তব।
ভীষ্মের এই আকস্মিক বদান্য শব্দচারিতায় মদ্ররাজ শল্য অত্যন্ত খুশি হলেন। হস্তিনার প্রসিদ্ধ ভরতবংশের জাতকের সঙ্গে তার ভগিনীর বিয়ে হবে। শল্য অভিভূত হয়ে বললেন– আপনার বংশে আমার ভগিনীর বিয়ে হবে, আপনি নিজে এসেছেন যাচক হয়ে, এর থেকে শ্রেয়তর কী হতে পারে আমার কাছে– ন হি মেহন্যো বরক্বত্তো শ্রেয়ানিতি মতির্মম। তবে হ্যাঁ, এই বিয়ের ব্যাপারে আমার কিছু কথা আছে এবং সে কথা বলতে আমার কিছু সংকোচও আছে। আসলে, আমার মহান পূর্ব-পুরুষেরা আমাদের বৈবাহিক সম্বন্ধে একটা নিয়ম চালু করেছেন– পূর্বৈঃ প্রবর্তিতং কিঞ্চিৎ কুলেহস্মিন্ নৃপসত্তমৈঃ যে নিয়ম ভাল হোক বা মন্দ হোক, ভদ্র হোক বা ভদ্রেতর, কিন্তু পূর্ব-পুরুষের সেই নিয়মটি আমি অতিক্রম করতে চাই না বা অতিক্রম করাটা পছন্দ করি না- সাধু বা যদি বাইসাধু তন্নাতিক্রান্তুমুৎসহে।
‘ভাল হোক বা মন্দ, ভদ্র হোক বা ভদ্রেতর’–এই কথাটার মধ্যেই শুল্যের একটা লৌকিক সংশয় আছে। বৈবাহিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষেরই বিভিন্ন প্রদেশে, বিভিন্ন জাতি-বর্ণের মধ্যে ততোধিক বিভিন্ন কৌলিক এবং লৌকিক প্রথা চালু আছে এবং দেখা যাচ্ছে তা প্রাচীন কালেও ছিল। আমি এমনও দেখেছি– কন্যাপক্ষের বাড়িতে একরকম কৌলিক নিয়ম এবং বরপক্ষের বাড়িতে আর এক রকমের কুপ্রথা এবং দুই পক্ষই একে অন্যের কুপ্রথা নিয়ে হাসাহাসি করছে এবং সে হাসাহাসি ঝগড়াঝাটিতে পরিণত হয়েছে এমনও দেখেছি। আবার এমনটাও হয়– বরপক্ষের পৌরুষেয়তা এবং বর্বরতায় কন্যাপক্ষ নিজেদের কৌলিক নিয়ম ভঙ্গ করতে বাধ্য হয়। এঁরা কেউই বোঝেন না যে, পূর্বপুরুষের কোনও পুরাতন বৃদ্ধ অনেক আদরে এবং মমতায় যে কৌলিক প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন, তার মধ্যে তার কোনও আশা, যন্ত্রণা বা আশীর্বাদ লুকোনো থাকে। সে প্রথা নিয়ে অধস্তনের কোনও পক্ষেরই হাস্য-ব্যঙ্গের অবসর নেই, সে প্রথা পারলে পরে মানো, না পারলে মেনো না, কিন্তু হাসাহাসি কোরো না। শল্য সেই কথাটাই জোর দিয়ে বলেছেন– আমাদের এই কৌলিক নিয়ম আছে– সে আপনার কাছে ভাল লাগুক বা মন্দ লাগুক, আমাকে তা মানতে হবে, আমি তা অতিক্রম করব না– তন্নাতিক্রান্তুমুৎসহে– আপনি না মানলে এ-বিয়ে হবে না।
শল্য বুঝেছিলেন– তাদের কৌলিক প্রথা উত্তর ভারতের খাঁটি আর্যকৌলিকতায় কিছু উপহাস সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু ভীষ্ম নিজে যেচে এসেছেন তার ভগিনীকে কুলবধূরূপে বরণ করতে, তাই শল্যের জোরও এখানে বেশি। তাই জোর জাহির করেই শল্য বললেন আমাদের যে কৌলিক নিয়ম আছে, তা আপনারও জানা, ঠিক সেই জন্যই আমার পক্ষে এটা মুখ দিয়ে বলতে খারাপ লাগছে যে, এ বাবদে আপনাকে কিছু পণ দিতে হবে। শল্য খুব সংকোচ নিয়ে বললেন– কী করব, আমাদের কৌলিক নিয়ম এবং তা কৌলিক বলেই আমাদের কাছে তা প্রমাণ হিসেবে মান্যকুলধর্মঃ স নো বীর প্রমাণং পরমঞ্চ তৎ। কিন্তু আমাদের কুলধর্ম ততটা সার্বিক নয় বলেই আপনার কাছে তা গ্রাহ্য নাও হতে পারে; আর ঠিক সেই জন্যই আপনাকে তা স্পষ্ট করে বলতে আমার সংকোচ হচ্ছে– তেন ত্বা ন ব্রবীমেতদসন্দিগ্ধং বচোহরিহ।
ভীষ্ম একেবারে পাকা বৈবাহিকের মতো করে বললেন– কুলধর্ম আমাদের কাছে পরম ধর্ম– সে-কথা ভগবান ব্রহ্মাই তো বলে দিয়েছেন কোন কালে। এখানে তোমার কোনও দোষ নেই হে! পূর্বপুরুষেরা একটা নিয়ম করেছেন, সেটা তো তোমায় মানতেই হবে, আর তোমাদের এই নিয়ম আমার জানাই আছে– না কশ্চন দোষোহস্তি পূর্বৈবিধিরয়ং কৃতঃ। মদ্রেশ শল্য তার কথার মাঝখানে সামান্যই একটু হিন্ট দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আপনাকে পণ হিসেবে কিছু দিতে হবে, একথা আপনাকে বলি কী করে– ন চ যুক্তস্তদা বক্তৃং ভবান দেহীতি সত্তম। কিন্তু ওইটুকুতেই ভীষ্ম বুঝে গিয়েছেন যে, মদ্রদেশের কৌলিক নিয়মে কন্যাপণ চালু আছে। হয়তো এক প্রতিক্রিয় কারণে মদ্রদেশে এই নিয়মের সৃষ্টি হয়েছিল। উত্তর ভারতের আর্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে বিবাহ-প্রথা চালু ছিল, তাতে বরপণের রেওয়াজ অল্প-বিস্তর চালু থাকলেও কন্যাশুল্ক বা কন্যাপণের ব্যবহার চালু ছিল না। কন্যাপণকে তারা কন্যা-বিক্রয়ের তুল্য বলে মনে করতেন এবং আর্যদের স্বীকৃত অষ্টবিধ বিবাহের মধ্যে অতিঘৃণ্য আসুর-বিবাহে এই ধরনের কন্যা-শুল্ক গ্রহণের রেওয়াজ ছিল এবং নামতই প্রমাণিত যে আসুর বিবাহে ভদ্রসুজনের কোনও সম্মতি ছিল না।
অন্যদিকে মহাভারতেই যা প্রমাণিত, সেটা হল– মহাভারতের যুগে মদ্রদেশের সংস্কৃতিতে কিছু অবক্ষয় এসেছে। শল্যের সারথ্যকালে কর্ণ যেভাবে তার দেশজ সংস্কৃতি সম্বন্ধে উদ্গার প্রকাশ করেছেন, তাতে মদ্রদেশীয় ‘বাহিক’দের মধ্যে আর্যেতর সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পণ্ডিত গবেষকেরাও মনে করেন যে তৎকালীন ইরান বা ব্যাকট্রিয়া থেকে মদ্রদেশের মূল অধিবাসীরা এসেছিলেন এবং মহাভারতে মদ্রদের মূল-পুরুষ মহাভারতীয় ব্যুষিতাশ্বকেও পণ্ডিতেরা পারস্য সম্রাট দারায়ুসের পিতার নাম-স্বরূপে বিশ্লেষণ করে ভাষাতাত্ত্বিক সাম্য খুঁজে পেয়েছেন। আমরা এতদূর যাচ্ছি না, তবে গবেষণার প্রশ্রয় মেনে চললে মদ্রদেশে সংকরজাতীয় শূদ্রসমান রাজাদের রাজত্ব চলছিল, এইটুকু মেনে নেওয়া যেতে পারে। শল্য যে পূর্বপুরুষকৃত বৈবাহিক নিয়মের কথা বলেছেন, সেটাও ঠিক আর্যবিধিসম্মত না হওয়ায় মদ্রদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতবর্ষীয় আর্যবিধির কৌলিক পার্থক্য মহাভারতের যুগেই স্পষ্ট।
তবে হ্যাঁ, আমাদের মহামতি ভীষ্ম তেমন ভয়ংকর রক্ষণশীল মানুষ নন এবং সেই সংরক্ষণশীলতা মহাভারতের প্রথম কল্পে ছিলও না। বিশেষত তিনি পাণ্ডুর জন্য কন্যারত্ন গ্রহণ করতে এসেছেন, অতএব তিনি কাল-বিলম্ব না করে বহুতর স্বর্ণালংকার, বিচিত্র রত্নরাশি– মণি-মুক্তা-প্রবাল এবং কিছু কঁচা সোনাও কন্যাশুল্ক হিসেবে শল্যের হাতে দিলেন। দিলেন বেশ কিছু হাতি-ঘোড়া-রথও এবং অবশ্য কন্যার ব্যবহার্য বস্ত্রালংকার– বাসাংস্যাভরণানি চ… শাতকুম্ভং কৃতাকৃতম। শল্য সানন্দে সেগুলি ভীষ্মের হাত থেকে নিয়ে সেইগুলি দিয়েই সাজিয়ে দিলেন ভগিনীকে দদৌ তাং সমলংকৃত্য স্বসারং কৌরবর্ষভে এবং সানন্দে তুলে দিলেন শ্বশুরোপম ভীষ্মের অধিকারে। ভীষ্ম মদ্ৰাধিপতির ভগিনীকে নিয়ে অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে আজগাম পুরং ধীমান প্রহৃষ্টো গজসাহূয়।
হস্তিনায় ফিরে আসার পর এক শুভ দিন নির্ধারিত হল যেদিন মদ্রদেশিনী রূপবতীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিবাহ হয়ে গেল শাস্ত্রবিধি মেনে। জগ্রাহ বিধিবৎ পাণিং মাদ্রা পাণ্ডুর্নরাধিপ। মহাভারতে এই বিবাহের কোনও মহাকাব্যিক আড়ম্বর বর্ণিত হয়নি। এমনকী বিবাহকাল পর্যন্ত আমরা এই নববধূর নাম পর্যন্ত জানি না। কত দূর দেশ থেকে আহৃতা এই রূপবতী রমণীর নামের মধ্যে তার দেশ-নামটুকুই বড় হয়ে রইল, তিনি মাদ্রী, মদ্রবতী। কুন্তীর মতো মাদ্রীর জন্যও এক নতুন ভবন তৈরি হল– স্থাপয়ামাস তাং ভাৰ্যাং শুভে বেশ্মনি ভাবিনীম। মহারাজ পাণ্ডু কুন্তী এবং মাদ্রীর সঙ্গে সুখে সংসার করতে লাগলেন। এখনও মাদ্রীর কোনও পৃথক বৈশিষ্ট্য নেই, প্রথমা বধূ কুন্তীর তুলনায় অবশ্যই মাদ্রীর মর্যাদা কিছু ন্যূন বটে, কিন্তু সতীন-কাটার সবচেয়ে তীক্ষ্ণ কাটাটুকু বিঁধে রইল– কুন্তীর বুকে– পঞ্জাব-কাশ্মীর অঞ্চলের মেয়ে মাদ্রী অতিশয় রূপবতী, অন্তত কুন্তীর চেয়ে বোধহয় অধিক বটেই।
মহাভারতের কবি আপাতত কোনও পার্থক্য করেননি। বলেছেন– দুই স্ত্রীর সঙ্গেই তিনি সুখে বিচরণ করতে লাগলেন। কুন্তী এবং মাদ্রী– দু’জনের সঙ্গেই যখন তার ইচ্ছে, যখন তার ভাল লাগে, তখনই পাণ্ডু বিচরণ করেন– স তাভ্যাং ব্যচরৎ সার্ধং… যথাকামং যথাসুখম। কিন্তু মহারাজ পাণ্ডুর পক্ষে এই বিচরণই সার ছিল। কুন্তী বা মাদ্রী কারও কাছেই তিনি সম্পূর্ণ ধরা দিলেন না। হয়তো বা সমস্যা এড়ানোর জন্যই তিনি দিগবিজয় করার জন্য চলে গেলেন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। দুই যৌবনবতী স্ত্রী অন্তঃপুরেই পড়ে রইলেন পাণ্ডুর অপেক্ষায়। মৃগয়া থেকে ফিরে আসার পর অবশ্য অদ্ভুত সুযোগ এল দুই স্ত্রীর জীবনে। যে কোনও কারণেই হোক– হয়তো সে কারণ প্রধানত হস্তিনাপুরের রাজঘরের ব্যাপার– কিন্তু সে যাই হোক, পাণ্ডু তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন বনে। রাজবাড়ির কায়দা কেতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কৃত্রিমতা-আড়ষ্টতা তাঁর যেহেতু পিছনে তাড়া করে না, অতএব কখনও পর্বতের সবুজ উপত্যকায়, আবার কখনও মহাশাল-বৃক্ষের অরণ্য-ছায়ায় পা দুই স্ত্রীকে নিয়ে মহাসুখে দিন কাটাতে লাগলেন। বলেছি তো– মহাভারতের কবি হস্তিনাধিপতির মানসিক সমতার হানি ঘটাননি এখনও। পাণ্ডুর এই উত্তাল বনবিহারের মধ্যেও তার উপমা হল– পাণ্ডুকে দেখাচ্ছিল যে দুই হস্তিনীর মাঝখানে ইন্দ্রের গজরাজ ঐরাবতের মতো করেণোরিব মধ্যস্থঃ শ্রীমান্ পৌরন্দরা গজঃ।
পাণ্ডুর ব্যক্তিগত সমস্যাটি এখনও মহাভারতের কবি ব্যক্ত করেননি। হয়তো এই সমস্যা প্রধান হয়ে উঠল যখন গান্ধারীর গর্ভধারণের সংবাদ বনবাসী পাণ্ডুর কানে এল। আমরা তো জানি গান্ধারী পূর্বে গর্ভ ধারণ করলেও তার পুত্রোৎপত্তিতে সময় লেগেছে বেশি। অথচ এদিকে পাণ্ডুর অবস্থা দেখুন, তার সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতাই নেই। মহাভারত ঠিক এই অবস্থায় মৃগরূপধারী কিমিন্দম অথবা কিম মুনির কথা বলেছে। অর্থাৎ সেই ক্রীড়ারত মৃগমিথুনের মিলন-মুহূর্তে এতটুকু বিবেচনা না করে পাণ্ডু একজনকে মারলেন এবং কিমিন্দম মুনির অভিশাপ চলে এল পাণ্ডুর ওপর। অভিশাপ– প্রিয়তমা রমণীর শারীর সংসর্গ ঘটলে তোমারও মৃত্যু ঘটবে– ত্বমপ্যস্যামবস্থায়াং প্রেতলোকং গমিষ্যসি। আমরা এর আগেও অন্যত্র বলেছি মহাভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে পাণ্ডুকে এক অন্যতর মর্যাদা দিয়েছেন মহাভারতের কবি। তাঁর সন্তান-প্রজননের অক্ষমতাকে মহাকাব্যিক আড়ম্বরে মৃগরূপী মুনির অভিশাপের ব্যঞ্জনায় ব্যক্ত করেছেন।
মৃগমুনির শাপেই হোক অথবা নিজে উপলব্ধি করেই হোক, দু-দুটি বিবাহিত স্ত্রীর কাছে নিজের প্রজনন ক্ষমতার অসহায়তা জানানো অত সহজ কথা নয়। পাণ্ডু প্রথমে যে ব্যবহারগুলি করেছিলেন সেগুলি তার অসহায়তাই প্রমাণ করে। কুন্তী এবং মাদ্রী– দুই স্ত্রীকেই পাণ্ডু বলেছিলেন যে, তিনি আর সংসার ধর্ম প্রতিপালন করতে চান না, কঠোর বৈরাগ্য অবলম্বন করে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে চান। এই অবস্থায় কুন্তী এবং মাদ্রী সমস্বরে করুণভাবে বলেছিলেন– আমরা তোমার ধর্মপত্নী। আমাদের ত্যাগ করে যাবার দরকার কী, তপস্যা করতে হয় আমাদের সঙ্গে নিয়েই তুমি বানপ্রস্থ অবলম্বন করো– আবাভ্যাং ধর্মপত্নীভ্যাং সহ তপ্তং তপো মহৎ। তুমি যদি ইন্দ্রিয় দমন করে বৈরাগ্য-তপস্যায় মন দিতে চাও, তবে আমরাও তাই করব, আমরাও ইন্দ্রিয় দমন করে তোমারই সঙ্গে তপস্যা করব ত্যক্ত-কামসুখে হ্যাঁবাং তন্সাবো বিপুলং তপঃ।
.
০২
কুন্তী এবং মাদ্রী– দুই স্ত্রীরই আন্তরিকতা মেনে নিতে বাধ্য হলেন পাণ্ডু। তিনি দুই স্ত্রীকে নিয়েই কঠোর বৈরাগ্য অবলম্বন করে তপশ্চরণ করতে লাগলেন। এতেও তিনি ভালই ছিলেন, দিন এভাবে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মনের মধ্যে একটা গভীর দুঃখ তার রয়েই গেছে। দু-দুটি সুন্দরী স্ত্রী, অথচ কারও গর্ভে সন্তান দেবার ক্ষমতা তার নেই। এরই মধ্যে পাণ্ডুর তৎকালীন আবাসস্থল শতশৃঙ্গ পর্বতে সাধনসিদ্ধ মুনিঋষিদের সঙ্গে তার দেখা হল। পুত্রহীনতার জন্য যত দুঃখ ছিল, সেই দুঃখিত মনোভাব মুনি-ঋষিদের কাছে প্রকট করলে, তারা বললেন, আমরা দিব্য চক্ষে দেখতে পাচ্ছি আপনার পুত্র আছে। অতএব আমরা যা দেখছি, তা আপনি ফলে পরিণত করার জন্য যত্ন নিন– তস্মিন্ দৃষ্টে ফলে রাজন প্রযত্নং। কতুমহসি।
এই কথাটার মধ্যেই সেই সমাজ-সচল ইঙ্গিত ছিল– অর্থাৎ তুমি যখন প্রজননক্ষম নও, তুমি অন্যভাবে পুত্রলাভের চিন্তা করো, সমাজের মধ্যেই সে উপায় চিহ্নিত এবং স্বীকৃত, শুধু তুমি সেই উপায় গ্রহণ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হও। পাণ্ডু সে ইঙ্গিত বুঝলেন। আগেও যে তিনি এই সমাজ-সচল প্রথার কথা জানতেন না, তা নয়। কিন্তু নিজের পৌরুষহীনতা নিজের স্ত্রীর কাছে অসহায়ভাবে বলে, তাদেরই আবার অন্যবিধ উপায়ে পুত্রলাভে নিযুক্ত করা– এটা বড় কঠিন ছিল। কিন্তু পাণ্ডু এখন নিরুপায়, এই প্রথম তিনি তার প্রথমা পত্নী কুন্তীকে ডেকে তার অসহায়তার কথা পরিষ্কার জানালেন নির্জনে– সোহব্রবীদ বিজনে কুন্তীং ধর্মপত্নীং যশস্বিনীম।
‘বিজনে’ বললেন কুন্তীকে, অর্থাৎ মাদ্রী সেখানে নেই। এতক্ষণ পর্যন্ত মহাভারতের কবি মহাকাব্যিক সৌজন্যে কুন্তী এবং মাদ্রীর সমতা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। পাণ্ডুর কথার উত্তরে উভয় স্ত্রী সমস্বরে একই শব্দ উচ্চারণ করেছেন– এটা প্রায় অসম্ভব হলেও আমরা মেনে নিয়েছি। মেনে নিয়েছি সেই সব আচরণ, বিচরণ যেখানে কবি লিখেছেন– উভয় স্ত্রীর সঙ্গেই; অথবা নামত, কুন্তী এবং মাদ্রীর সঙ্গে সুখে বিচরণ করতে লাগলেন। আমরা কি আমাদের শঙ্কিল মনে এতটুকু বিচার করব না যে, কুন্তী যেখানে ভালবেসে স্বয়ংবরা হয়ে পাণ্ডুর গলায় বরমাল্য দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি দেখলেন তার বিবাহের বরমাল্য শুষ্ক হতে-না-হতেই পাণ্ডু দ্বিতীয় বিবাহ করলেন মাদ্রীকে। এই অবস্থায় কুন্তীর মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকবে তার আঁচ মাদ্রীর মনেও লাগার কথা। তবে কি মহাকাব্যের বড় ঘরে প্রতিক্রিয়াগুলি কখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, ফলত কুন্তীও যেমন মাদ্রীকে সস্নেহে মেনে নিয়েছিলেন, তেমনই মাদ্ৰীও থাকতেন কুন্তীর ছত্রছায়ায়।
কুন্তী এবং মাদ্রীর ব্যক্তিগত বেড়ে ওঠা বাল্য-কৈশোর-যৌবনসন্ধির সূত্রগুলি বিচার করলে দেখা যাবে কুন্তীর জীবনে সংগ্রাম অনেক বেশি, সে তুলনায় পিতৃহীনা মাদ্রী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্নেহচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা অতিলালিতা যুবতী। বাল্যে যখন খেলার বয়সে অথচ রীতিমতো বুঝমান অবস্থায় কুমারী পৃথাকে রাজা কুন্তিভোজের কাছে দত্তক দিলেন আর্যক শূর, সেই সময় থেকে পালক পিতার বাড়ির জটিল জীবনে দুর্বাসার আগমন, সূর্যের ঔরসে কানীন পুত্র লাভ, তাকে বিসর্জন দেওয়া এবং অবশেষে পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ– এইসব কিছু কুন্তীকে যে ব্যক্তিত্ব দিয়েছিল, মাদ্রীর মধ্যে সেই ব্যক্তিত্বের উদ্ভবই ঘটেনি। ফলে পঞ্জাব-কাশ্মীরের জাতিকা যতই রূপবতী হোন, কুন্তীর ওপরে নির্ভর করে তার সদানুগামিনী হয়ে তার স্নেহব্যক্তি ভোগ করা ছাড়া মাদ্রী আর কিছু ভাবেননি। অর্থাৎ সেখানেও তিনি লালিতা ছিলেন।
আজ যখন পাণ্ডুর জীবনে অন্য উপায়ে পুত্রলাভের সমস্যা এল, তখন তাই ব্যক্তিত্বময়ী প্রথমা বধূ কুন্তীরই ডাক পড়ল। পাণ্ডু তার প্রজনন ক্ষমতার অসহায়তা প্রথম প্রকাশও করলেন কুন্তীর কাছে এবং তাও নির্জনে অর্থাৎ সেখানে মাদ্রী উপস্থিত নেই। অন্য উপায়ে নিয়োগ প্রথায় পুত্র উৎপাদন করার জন্য কুন্তীর কাছেই প্রথম প্রস্তাব করলেন পাণ্ডু। হয়তো নিরুপায় হয়েই, কেননা সেকালের শাস্ত্রীয় নিয়মে প্রথমা বধূই হলেন ধর্মপত্নী। মাদ্ৰীও সেকালের নিয়মে বিবাহিতা ধর্মপত্নী বটে, কিন্তু জ্যেষ্ঠ বধূ বর্তমানে কনিষ্ঠার শাস্ত্রীয় মূল্য থাকে না, অতএব পাণ্ডুর এই বিশাল সমস্যা-পর্বে মাদ্রীর কোনও ভূমিকা রইল না। আমরা এমন বিশ্বাস অবশ্যই করি না যে, মাদ্রী বড় অনাদরে, অবহেলায় রইলেন, বরঞ্চ বলব– সমস্যা সমাধান করার ব্যক্তিত্ব নিয়ে তিনি জন্মাননি, আর সমস্যা মেটানোর জটিল প্রয়োজনে মাদ্রীকে পাণ্ডু ব্যবহারও করেননি।
প্রজননে-অক্ষম পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও থাকে, পাণ্ডুরও সে সমস্যা ছিল এবং কুন্তী সে ব্যাপারে যতটা অবহিত ছিলেন, বা স্বামীর মন নিয়ে তিনি যতটা ভেবেছেন, মাদ্রী তা ভাবেননি বা ভাবা উচিত কিনা তাও ভাবেননি। পাণ্ডু যখন প্রথম কুন্তীকে নিয়োগপ্রথায় সন্তান উৎপাদন করতে বললেন, সে অবস্থায় কুন্তী পাণ্ডুর মানসিক ক্ষতে বহুতর প্রলেপ দেবার চেষ্টা করেছেন, তার ওপরে চরম নির্ভরতা দেখিয়েছেন, কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও পাণ্ডুকে শেষ সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছে। কুন্তী যখন তাঁর পুত্র-জন্মের স্বাধীন উপায় হিসেবে দুর্বাসার দেবসঙ্গম মন্ত্রের রহস্যটুকু উদ্ঘাটিত করলেন, তখন পাণ্ডু সানন্দে কুন্তীকে অনুমতি দিয়েছেন পুত্র লাভের প্রযত্ন গ্রহণ করতে। পাণ্ডু যেমন যেমন বলেছেন, যে দেবতার আহ্বান করতে বলেছেন কুন্তীকে, তিনি সেই সেই দেবতাকে সম্বোধন করেই পুত্রলাভে ব্রতী হয়েছেন। তিন তিনটি পুত্রও সেইভাবে জন্মাল– যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন।
কুন্তীর গর্ভে তিন-তিনটি দেবোপম পুত্রলাভের পর আহ্লাদ, আশীর্বাদ আর শুভকামনায় পাণ্ডু বেশ কিছুদিন আবিষ্ট হয়ে রইলেন। ওদিকে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে গান্ধারীর এক শত পুত্র হয়েছে। শুধু মাদ্রী, তিনিই রইলেন পুত্রহীনা। পুত্র উৎপাদনের অক্ষমতা সত্ত্বেও কুন্তীর গর্ভজাত পুত্রেরা যেহেতু তৎকালীন সামাজিক নিয়মে পাণ্ডুর পুত্র বলেই পরিচিত হলেন, অতএব পাণ্ডুর আনন্দও ছিল অকৃত্রিম। এর পরেও তিনি কুন্তীর কাছে আরও একটি পুত্রলাভের জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু নিয়োগের মাধ্যমে কুন্তী আর কোনও সন্তান গর্ভে ধারণ করতে চাননি।
ঠিক এইখানেই মাদ্রীর প্রবেশ। মাদ্রী পাণ্ডুর অন্তর্গত হৃদয়টুকু বোঝেন, তিনি বুঝে নিয়েছেন তার স্বামীর পুত্রাকাঙ্ক্ষা এখনও মেটেনি। কিন্তু এমনও তো নয় যে, মাদ্রী কুন্তীর মতোই দুর্বাসার পুত্র-মন্ত্র লাভ করেছেন অতএব তিনিও তার জ্যেষ্ঠা সপত্নীকে হারিয়ে দিয়ে গর্বে নেচে বেড়াতে পারেন। অতএব পুত্র লাভ করতে হলে কুন্তীর ওপরেই নির্ভর করতে হবে। কিন্তু কোন সপত্নী, সে যতই ভাল এবং সুশীলা হোক, যার নিজের শরীরে এবং মনে সন্তান ধারণের কোনও অক্ষমতা এবং ব্যাধি নেই, সে কোনও আহ্লাদে অন্যতরা সপত্নীর কাছে নিচু হয়ে পুত্রলাভের মন্ত্র শিখতে চাইবে। অতএব মাদ্রী জ্যেষ্ঠা কুন্তীর কাছে এতটুকুও নত না হয়ে মনে মনে ঠিক করলেন– কাজটা স্বামী পাণ্ডুকে দিয়েই করাতে হবে, কেননা অক্ষমতা তো তারই, দায় তো তাঁরই।
আমরা এমন কথা বলছি না যে, কুন্তীর ওপরে মাদ্রী খুব বিদ্বিষ্টা ছিলেন অথবা কুন্তীকে তিনি সপত্নী হিসেবে খুব দুষ্ট চোখে দেখতেন। আসলে একদিকে তিনি তো জিতেই ছিলেন। কুন্তীকে বিবাহ করার পরেও যখন মাদ্রীকে পাণ্ডু বিবাহ করেছেন, সেই দিনই তিনি একভাবে জিতে আছেন, কিন্তু তাঁর হার হয়েছে মাতৃত্বের পরতন্ত্রতায় এবং সেইখানে এক রমণী কী করে সপত্নীর কাছে মাথা নত করে। মাদ্রী তাই কুন্তীকে কিছু বললেন না, এতটুকুও আনত হলেন না তার কাছে। তিনি উপায় খুঁজলেন নিজের স্ত্রীজনোচিত মর্যাদায়। একদিন যখন। কুন্তী কোথাও কাছাকাছি নেই তখন নির্জনে পাণ্ডুর সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন মাদ্রী- মদ্ররাজসুতা পাণ্ডুং রহো বচনমব্রবীৎ।
মাদ্রী বললেন– মৃগ-মুনির অভিশাপে তোমার পুত্র উৎপাদনের শক্তি নেই, তাতে আমি তেমন দুঃখ পাইনি। এমনকী আমি রাজকন্যা হওয়া সত্ত্বেও এবং তোমার স্ত্রী হিসেবে গর্ভধারণ করার সমস্ত উপযুক্ততা থাকা সত্ত্বেও আমি যে এমন নিকৃষ্ট অমর্যাদাকর অবস্থায় আছি, তাতেও আমি দুঃখ পাই না। দুঃখ পাই না, কেন না এটা ভাগ্য, এটা নিয়তি। আবার ওদিকে কুরুবাড়ির বড় বউ গান্ধারী শত পুত্রের জননী হয়েছেন, তাতেও আমার দুঃখ নেই। কেননা তিনি ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী, হাজার হলেও বাড়িটাও তো অন্য, অন্য এক গার্হস্থ্য। কিন্তু এটা তো মানতেই হবে যে তোমার স্ত্রীত্বের মর্যাদায় কুন্তী এবং আমি দু’জনেই সমান। সেখানে তার পুত্র আছে অথচ আমার পুত্র নেই– এ দুঃখ আমি সইতে পারছি না– ইন্তু মে মহদুঃখং তুল্যতায়ামপুত্রতা।
মাদ্রী এই সূত্রটুকু জানাতে ভুললেন না যে কুন্তীর গর্ভে পাণ্ডুর ঔরসে কোনও পুত্র হয়নি, পুত্র হয়েছে অন্য উপায়ে, নিয়োগ-প্রথায়। কিন্তু এই কথাটা সোজাসুজি পাণ্ডুকে বললে তার মনে আঘাত লাগবে বলে মাদ্রী সামান্য এক শব্দী ব্যঞ্জনা ব্যবহার করে বললেন– ভাগ্য, ভাগ্যি মানছি, কুন্তীর গর্ভে তোমার পরিচয়েই আমার স্বামীর পুত্রলাভ হয়েছে– দিষ্টা ত্বিদানীং ভর্তুর্মে কুন্ত্যামপ্যস্তি সন্ততিঃ। এখানে ‘দিষ্টা’–ভাগ্যি মানি, আমার স্বামীর’– ভর্তুর্মে এবং অতি নৈর্ব্যক্তিকভাবে– পুত্র আছে– অস্তি সন্ততিঃ– এই কথাগুলি নিজের স্বামীর ওপর মাদ্রীর অধিকার বোধ যেমন স্থাপিত করে, তেমনই এক মুহূর্তের জন্য তার জ্যেষ্ঠা সপত্নীকে যেন অকিঞ্চিৎকর করে তোলে। অর্থাৎ কুন্তী এই পুত্র পেয়েছে অন্য উপায়ে, এখানে তার অন্য কোনও কৃতিত্ব নেই। যদি বা সে কৃতিত্ব থাকেও তবে তা মাদ্রীও দাবি করতে পারেন। মাদ্রী স্বামীকে বললেন– কুন্তীকে বলো– আমাকেও কিছু অনুগ্রহ করতে, তা হলে তোমার প্রতিও সেটা অনুগ্রহ করা হবে– কুর্যাদনুগ্রহে মে স্যাত্তব চাপি হিতং ভবেৎ।
আমার ভাল করা মানে তোমারও ভাল করা– তব চাপি হিতং ভবেৎ–এই কথা বলে মাদ্রী বোঝাতে চাইলেন- এ ব্যাপারে পাণ্ডুরই দায় আছে। কেননা নিয়োগ প্রথায় পুত্র লাভের কথা তিনি কুন্তীকেই প্রথম বলেছেন। দৈবাৎ কুন্তী দুর্বাসার দেবসঙ্গম মন্ত্র জানতেন, নইলে শুধুই নিয়োগের প্রশ্ন উঠলে মাদ্রীরই বা অসুবিধে কোথায়। কিন্তু কুন্তীর দেবসঙ্গম মন্ত্র যেহেতু সাধারণ নিয়োগের চেয়েও মহত্তর এবং শুভঙ্কর, অপিচ সেটা পাণ্ডুর পূর্বসম্মত এবং পছন্দসই বটে, তাই কুন্তীর মন্ত্রটাই মাদ্রী গ্রহণ করতে চাইলেন, স্ত্রীত্বের সমান মর্যাদাও। কিন্তু স্ত্রী হলেও মাদ্রী কুন্তীর সপত্নী বটে, অন্য সপত্নীর কাছে তিনি মর্যাদা নষ্ট করবেন কেন। তিনি তাই পাণ্ডুকেই বললেন– আমি সপত্নী হয়ে কীভাবে কুন্তীর কাছে এই অনুরোধ জানাব, আমার এ বিষয়ে সংকোচ আছে– সংস্তম্ভো মে সপত্নীত্ব বক্তৃং কুন্তিসুতাং প্রতি। যদি সত্যি তুমি আমার মন বুঝে থাকো এবং সত্যিই আমার সঙ্গে সহমত হও তবে প্রসন্ন মনে কুন্তীকে তুমিই বলবে, এবং যাতে সে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়, সে ব্যবস্থাও করবে– যদি তু ত্বং প্রসন্নো মে স্বয়মেনাং প্রচোদ্দয়।
পাণ্ডু বললেন– ক’দিন ধরে আমারও মনে এই কথাটা ঘুরছে ফিরছে বটে, কিন্তু তোমায় বলতে পারছি না–মমাপ্যেষ সদা মাদ্রি হৃদ্যর্থঃ পরিবর্ততে– বলতে পারছি না, কারণ তুমি কী ভাববে বা না ভাববে এ ব্যাপারে আমার দ্বিধা ছিল। মানে কুন্তীর দেওয়া মন্ত্র তুমি নেবে কিনা। এখন তুমি যখন এ বিষয়ে মন করেছ, তা হলে অবশ্যই আমি চেষ্টা করব- প্রতিষ্যাম্যতঃ– এবং আমি তেমন করে অনুরোধ করলে কুন্তী সেটা ফেলবে না বলেই আমার মনে হয়– মনে ধ্রুবং ময়োক্তা সা বচনং প্রতিপৎস্যতে।
সুন্দরী মাদ্রীর সংকোচ-দিগ্ধ উদাসী মনের কথা অনুভব করে তার দুঃখে সমদুঃখী পাণ্ডু কুন্তীর কাছে একদিন বসলেন নির্জনে। বললেন- কল্যাণী! আরও একটি কল্যাণ তোমায় করতে হবে। আমার বংশ বিস্তারের জন্যই শুধু নয়, আমার সন্তোষের জন্য আরও একটু মঙ্গল বিধান করতে হবে তোমাকে– মৎপ্রিয়ার্থং চ কল্যাণি কুরু কল্যাণমুত্তমম্। পাণ্ডু জানেন– কুন্তী অবধারিতভাবে প্রশ্ন করবেন– তোমার বংশবিস্তার তো আমি করেছি এবং তাতেই তোমার সাংস্কারিক পিণ্ডললাপের ভাবনা দূর হয়ে যাবার কথা। শুধু তাই নয়, তোমার সন্তোষের কথা ভেবেই তো পর পর তিন বার আমি অপরিচিত দেবতার সঙ্গে সঙ্গত হয়েছি। পুনরায় চতুর্থ সন্তানের জন্য নিযুক্ত হবার প্রস্তাব তিনি নিজেই প্রত্যাখ্যান করেছেন আগে। তা হলে আবার সেই প্রশ্ন কেন।
পাণ্ডু জানেন, এই প্রশ্ন উঠবে। তাই আগে থেকেই তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, ঠিক বংশপরম্পরা রক্ষা বা তার নিজের সন্তোষ নয়, কিছু কিছু কাজ করতে হয় যশের জন্য সম্মানের জন্য। আমরা আগে যেমন দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক তিনি রাস্তার মাঝে পরিচিত জনের সামনে দাঁড়িয়ে ইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণির বয়স্ক শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন, কেননা এককালে তিনি তাঁর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন। এতে কী হয়, প্রণতেরই ব্যবহারিক মর্যাদা বাড়ে। পাণ্ডু ঠিক সেইভাবেই বললেন কুন্তীকে। বললেন– দেখো, যে যজ্ঞ তপস্যা করে ইন্দ্র স্বর্গরাজ্যের আধিপত্য লাভ করলেন, সেই চরম লাভের পরেও কিন্তু ইন্দ্র যজ্ঞ করেছেন এবং তা করেছেন যশের জন্য। মন্ত্রজ্ঞ ঋষি-ব্রাহ্মণেরা দুষ্কর তপস্যার অনুষ্ঠান করে সিদ্ধিলাভ করায়ত্ত করেও পুনরায় গুরুসেবা করেন যশলাভের জন্য গুরূনভপগচ্ছন্তি যশসোহর্যায় ভাবিনি। পাণ্ডু বোঝাতে চাইছেন– একটা বাড়তি কাজ তোমাকে করতে হবে মাদ্রীর জন্য। বললেন– তুমিই পারো মাদ্রীর কোলে একটি সন্তান দিতে। উত্তম বস্তু তো ভাগ করে নিতে হয়। তোমার পুত্রলাভের মন্ত্র মাদ্রীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে তাকেও যদি পুত্রলাভে সাহায্য করো, তবে তার দুঃখসাগরের তরীখানি হবে তুমিই। তুমিই তাকে বাঁচাতে পারো– সা ত্বং মাদ্রীং প্লবেনৈব তারয়ৈনামন্দিতে।
পাণ্ডুর আগ্রহাতিশয্য কুন্তী বুঝতে পারলেন, সহানুভূতিতে এটাও অনুভব করলেন যে, মাদ্রী তো সত্যিই বঞ্চিত, তাঁর স্বামীর কারণেই বঞ্চিত এবং সেখানে একজন স্ত্রী হিসেবে মাদ্রীর কোনও দোষই নেই। অতএব কুন্তী পাণ্ডুর প্রস্তাব সমর্থন করলেন অদ্ভুত এক আবরণে। তিনি বললেন- তুমি তো এত কালের আইন মেনেই একটা ন্যায়সঙ্গত কথা বলেছ– ধর্মং বৈ ধর্মশাস্ত্রোক্তং যথা বদসি তত্তথা। ঠিক আছে, এই অনুগ্রহটুকু আমি তাকে করব। পূর্বসংকেতমতো মাদ্রীর সঙ্গে দেখা হল কুন্তীর। কুন্তী তাঁকে দুর্বাসার দেব সঙ্গমনী মন্ত্র দিয়ে বললেন– মাদ্রী। তুমি একবার, মাত্র একবার কোনও দেবতাকে এই মন্ত্রে আহ্বান করবে– সকৃচ্চিন্তয় দৈবতম– আর তাতেই তুমি সেই দেবতার অনুরূপ পুত্র লাভ করবে।
‘অনুরূপ পুত্র’–তস্মাত্তে ভবিতাপত্যম্ অনুরূপমসংশয়ম– মাদ্রী অনেক চিন্তা করলেন কুন্তীর এই কথাটা। একবারের তরে সুযোগ পেয়েছেন, তো সে সুযোগটা তিনি কীভাবে ব্যবহার করবেন, এটা অবশ্যই মাদ্রীর ভাবনার বিষয় ছিল এবং এই ভাবনার মধ্যে দিয়েই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও কিছু বোঝা যায়। একবারের জন্য যে সুযোগ আসে, তাকে পূর্ণ সদব্যবহার করার জন্য যে দুটির দিকে তার নজর থাকতে পারত– সে দুটিকে আধুনিক ভাষায় বলা যায় কোয়ালিটি এবং কোয়ানটিটি। তিনি যদি বুদ্ধিমতী হতেন, তিনি অভিজাত গৃহের অতি লালিতা সুন্দরী কন্যাটি না হয়ে যদি কুন্তীর মতো আশৈশব জীবনযুদ্ধ করা অভিজ্ঞা রমণীটি হতেন, তা হলে তিনি এমন এক দেবতার আশীর্বাদ মিলন প্রার্থনা করতেন, যিনি ধর্ম, বায়ু বা ইন্দ্রের চেয়েও অধিক প্রভাবশালী। কিন্তু মাদ্রী তেমন চাননি। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল– কুন্তীর ক্ষেত্রে দেখেছি, প্রত্যেক পুত্র জন্মের আগে পাণ্ডুর সঙ্গে তার আলোচনা হচ্ছে এবং প্রত্যেকবার পাণ্ডুই নির্দেশ দিচ্ছেন কুন্তীকে– তুমি ধর্মজ্যেষ্ঠ পুত্র কামনা করো, তুমি বলজ্যেষ্ঠ পুত্র কামনা করো অথবা দেবরাজোপম অধিগুণসম্পন্ন পুত্র কামনা করো। কিন্তু মাদ্রী কুন্তীর কাছ থেকে মন্ত্র পেলেন স্বামীর ওপর ব্যক্তিগত প্রভাব বিস্তার করে কিন্তু তারপরেই তিনি স্বাধীনা। একবারও তিনি স্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন না– আমার গর্ভে তুমি কেমনতর পুত্র চাও। মন্ত্র লাভ করা মাত্রই তিনি সুযোগ সদ্ব্যবহারে মন দিয়েছেন।
আমি অবাক হই– ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্রের পরে মাদ্রী কেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের তেজ আধান করলেন না আপন গর্ভে। নাকি এঁরা মন্ত্রের এক্তিয়ার ভুক্ত ছিলেন না? তা হলে ইন্দ্র কিংবা বায়ুই বা নয় কেন দ্বিতীয়বার? অসুবিধে তো ছিল না। মাদ্রী তার সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন গাণিতিক সংজ্ঞায়। তিনি এক সুযোগে দুটি পুত্র চাইলেন। কেননা দেবতাদের মধ্যে যুগল দেবতা আছেন খুব কম, তবু পাণ্ডুকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রখ্যাত মিত্রাবরুণের সন্ধান পেতেন। কিন্তু না, মাদ্রী স্বাধীনভাবে স্মরণ করলেন দৈববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে– ততো মাদ্রী বিচার্যেবং জগাম মনসাশ্বিনৌ। অশ্বিনীকুমারদ্বয় মাদ্রীর গর্ভে যমজ সন্তানের বীজ আধান করলেন, নির্দিষ্ট সময়ে মাদ্রীর দুটি পুত্র হল। তারা কুন্তীর তিন ছেলের চেয়েও অনেক সুন্দর দেখতে। হয়তো বালক-বয়সের এই সৌন্দৰ্য কুন্তীকেও একটু ঈর্ষান্বিত করেছিল, কেননা তখনও ভীমার্জুনের শৌর্য-বীর্য প্রকটভাবে বোঝা যায়নি, আর শিশুরা তো আপন সৌন্দর্য্যেই মায়ের মন ভোলায় আরও বেশি।
মাদ্রীর দুই পুত্রের নামকরণ করলেন শতশৃঙ্গবাসী ব্রাহ্মণেরা– প্রথম জনের নাম নকুল, দ্বিতীয় সহদেব। পাঁচ পুত্র পেয়ে পাণ্ডু আনন্দে একেবারে ডগমগ হয়ে আছেন– মুদং পরমিকাং লেভে ননন্দ চ নরাধিপ। বালকেরা শতশৃঙ্গবাসী মুনি এবং মুনিপত্নীদেরও মায়া কেড়ে নিয়েছে। বোঝা যায় যে, পাণ্ডুর জীবনে বেশ একটা স্থিতাবস্থা এসেছে। কিন্তু এরই মধ্যে কোথায় কী হল, মহাভারতের কবির কোনও মহাকাব্যিক প্রস্তুতি দেখলাম না– নতুন কোনও প্রসঙ্গে যাবার আগে। হঠাৎই দেখলাম পাণ্ডু একদিন কুন্তীর কাছে মাদ্রীর পুত্রের জন্য আবারও ওকালতি করছেন– কুন্তীমথ পুনঃ পার্মার্থে সমচোদ্দয়ৎ। কেন যেন মনে হয়, পাণ্ডু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কুন্তীকে এ কথা বলছেন না। কিন্তু মাদ্ৰীও এতটাই আত্মসচেতন যে, তিনি নিজের মুখে কুন্তীর কাছে যাচনা করে জ্যেষ্ঠা সপত্নীর কাছে ছোট হবেন না। অতএব পাণ্ডু কুন্তীর সহায়তা চাইছেন মাত্রীর পুত্রের জন্য।
প্রথম যখন মাদ্রীর মনোদুঃখের কথা কুন্তীর কাছে বলেছিলেন পাণ্ডু, তখনও হয়তো কুন্তীর মনে কিছু মায়া তৈরি হয়েছিল কনিষ্ঠা সপত্নীর জন্য। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন– মাদ্রী যুগল-দেবতার আহ্বানে একবারে দু’দুটি পুত্রের জননী হয়েছেন তখন এই বুদ্ধিমত্তা তার কাছে ছল-চাতুরী কপটতার শামিল হয়ে উঠেছে। তিনি বুঝেছেন যে, মাদ্রীর মনে তাকে অতিক্রম করার ভাবনা এসেছে। পুনরায় মন্ত্রদানে স্বীকৃত হলে, মাদ্রী হয়তো আবারও যুগল দেবতার আহ্বান জানাবেন। তাতে তার পুত্রসংখ্যা হবে চার অর্থাৎ তিনি কুন্তীকে পুত্রের গুণমানে না হারিয়ে দিতে পারলেও সংখ্যায় হারিয়ে দেবেন। যদি বা কুন্তী তাকে এই প্রয়াসে বারণও করেন, তবে মাদ্রী তিন পুত্রের জননী হয়ে কুন্তীর সমান সৌভাগ্যবতী হবেন। কুন্তীকে কোনওভাবে অতিক্রম করা বা তার সমান হতে চাওয়ার একটা বুদ্ধি যে মাদ্রীর মনে কাজ করছে– এটাই কুন্তীর ধারণা ছিল নিশ্চয়ই।
মাদ্রীর ওই চাতুরীটুকু কুন্তী মেনে নিতে পারেননি আগেই, অতএব আবারও যখন পাণ্ডু মাদ্রীর হয়ে কথা বলতে গেলেন, নির্জনে– রহস্যুক্তা সতী তদা– তখন একেবারে জ্বলে উঠলেন কুন্তী। বললেন আমার সঙ্গে তো সে আগেই প্রবঞ্চনা করেছে। আমি তাকে বলেছিলাম– তুমি একবার মাত্র কোনও দেবতার আহ্বান করে পুত্র লাভ করে। কিন্তু সেই একবারের অঙ্কটা ঠিক রেখে যুগল দেবতার আহ্বান করে সে আমাকে সম্পূর্ণ প্রতারণা করল– উক্তা সকৃদ দ্বন্দ্বমেষা লেভে তেনাস্মি বঞ্চিতা। কুন্তী তার সরলতা চেপে রাখেননি। মাদ্রী যে আবারও অশ্বিনীকুমারদ্বয় বা মিত্রাবরুণের মতো দ্বন্দ্ব-দেবতার আহ্বান করে কুন্তীকে প্রতারিত করবেন– সে কথা চেপে রাখেননি কুন্তী। তিনি বলেছেন– খারাপ মেয়েছেলেরা এই রকমই করে থাকে, মাদ্রী আমাকে এইভাবেই প্রতারিত করবে আবার বিভেম্যস্যা হ্যভিভবাৎ কুস্ত্ৰীণাং গতিরীদৃশী।
আসলে মাদ্রী যে তাকে এমন চতুর বুদ্ধিতে ঠকিয়ে দেবেন, এ কথা কুন্তী স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। এমনিতে হৃদয়ের গভীরে একটা অসূয়া অবশ্যই কাজ করে সপত্নীর ভাবনায়। কুন্তীকে বিবাহ করার পরেও যেদিন মাদ্রীকে নববধূ হিসেবে বরণ করেছেন পাণ্ডু, সেখানেই তো এই অসূয়ার বীজ উপ্ত হয়ে গেছে। সেকালের সামাজিক ভব্যতায় সপত্নীজনের প্রতি যতটুকু সখীবৃত্তি করা যায় ততটুকু যথাসাধ্য দেখালেও মাদ্রীর প্রতি রাজার কিছু রূপমোহ প্রকট ছিল বলেই মনে হয় এবং এই সামান্য পক্ষপাতও কুন্তীর হৃদয়ে এতটাই ক্ষত সৃষ্টি করেছিল যে, প্রথম সুযোগেই তিনি কনিষ্ঠা সপত্নীকে ধূর্ত এবং খারাপ মেয়েছেলে– কুস্ত্ৰীণাং গতিরীদৃশী– বলতে দ্বিধা বোধ করেননি। কুন্তী বলেছেন– আমি তো নিতান্তই বোকা। আমি তো একবারও ওর এমন চালাকির কথা মনে মনেও ভাবতে পারিনি যে, যুগল দেবতার আহ্বানে যমজ পুত্র হবে– নাজ্ঞাসিষমহং মূঢ়া দ্বন্দ্বাহ্বানে ফলদ্বয়ম। অতএব মহারাজ! তুমি আর আমাকে এই বিষয়ে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করবে না আর এই অনুরোধ না করাটাই আমি বরদান বলে মনে করব– তস্মান্নাহং নিযোক্তব্যা ত্বয়ৈযোহস্তু বরো মম।
কুন্তীর এই কঠিন-শীতল ভাষণ শুনে পাণ্ডু আর মাদ্রীর কথা তোলেননি। পাঁচ পুত্র সহ কুন্তী-মাদ্রী-পাণ্ডুর অরণ-জীবন আনন্দেই কাটতে লাগল। এরই মধ্যে সবকিছু উথাল পাতাল করে দিয়ে বসন্তের সমাগম ঘটল শতশৃঙ্গ পর্বতে পাণ্ডুর অরণ্য আবাসে। চৈত্র এবং বৈশাখের মাঝামাঝি সময়, সমস্ত বন-পর্বতে শিহরণ জেগে উঠেছে। মহাভারতের কবি লিখেছেন- এ হল এক মোহন সময়, সমস্ত প্রাণী এই সময় পাগল হয়ে ওঠে– এই সময়ে পাণ্ডু মাদ্রীর সঙ্গে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন– ভূতসম্মোহনে রাজা সভার্যো ব্যচরণ বনে। ওই একটিমাত্র শব্দ ‘ভূতসম্মোহন’কাল– ওই একটি শব্দেই কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, অন্য প্রাণীর সঙ্গে পাণ্ডুর আর কোনও তফাৎ নেই। তাতে আবার মাদ্রীর মতো রূপবতী এক রমণী তাঁর সঙ্গে।
নায়ক-নায়িকার হৃদ্য-সুপ্ত প্রেম যে মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে আলংকারিকেরা তাকে পরিভাষায় বলেন উদ্দীপন বিভাব, সেই উদ্দীপনের উদাহরণ বসন্ত। কবি লিখেছেন– শতশৃঙ্গ পর্বতের বনে বনে– পলাশ ফুলের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। চম্পক, অশোক, নাগকেশরের গন্ধে ম ম করছে চারদিক। দেবদারু এবং স্থলপদ্মেরও অভাব নেই। ভ্রমর কোকিলের শব্দ এবং পার্বত্য জলস্থানে বিকচ পদ্মিনীর শোভা পাণ্ডুর পক্ষে এ এক হন্তারক সময়, তার হৃদয়ে ভালবাসার সঙ্গে আসঙ্গ-লিপ্সা প্রবল হয়ে উঠল– প্রজজ্ঞে হৃদি মন্মথঃ। মাদ্রীকে দেখে তিনি অভিভূত হলেন।
তত্ত্ববিদ ব্যক্তিরা বলে থাকেন– প্রজনন-শক্তি যাদের নেই, তাদের অক্ষমতা বিভিন্ন কারণেই ঘটে থাকতে পারে, এমনকী স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হবার শারীরিক উপক্রমেও তার সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু তাতে তার আসঙ্গ-লিপ্সায় ভাটা পড়ে না, কেননা সেটা মনের ব্যাপার। তা ছাড়া অনেক সময় পুরুষের শক্তি-বীজেও অসম্ভাবনার কারণ নিহিত থাকে, সেখানেও তার শারীরিক লিপ্সা ব্যাহত হয় না। এর আগেও যে দু’একটি মন্তব্য আছে মহাভারতে এবং এখন তো জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল যে, প্রজনন-ক্ষমতা না থাকলেও পাণ্ডুর সম্ভোগেচ্ছা লুপ্ত হয়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে মাদ্রীকেও আমরা খুব নির্দোষ মনে করি না।
মাদ্রী তো জানতেন যে মিলিত হবার উপক্রমেই সম্ভোগদৃঢ় পাণ্ডুর ওপর কিমিন্দম মুনির মৃত্যুর অভিশাপ নেমে আসবে। এই অভিশাপের মধ্যে অলৌকিকতাই থাকুক অথবা সঙ্গমেচ্ছু ব্যক্তির পক্ষে এ কোনও মরণ ব্যাধিই হোক, মাদ্রী তো জানতেন যে, পাণ্ডু সকাম হলেই তার মৃত্যু অনিবার্য। তবু তিনি তা মনে রাখেননি। হয়তো বেশ রূপবতী ছিলেন বলেই অথবা হৃদয়ের মধ্যে পুষ্পে কীটসম সেই সঙ্গমেচ্ছা লুকিয়ে ছিল বলেই আজ এই বসন্তের উত্তাল প্রকৃতির মধ্যে নিজেকেও তিনি মোহিনী করে তুলেছিলেন। তার বয়স তো চলে যায়নি, মনুষ্য শরীরের স্ত্রীজনোচিত সন্ধিগুলি তো এখনও শিথিল হয়ে যায়নি তার। অতএব আজ কী কথা তার জাগল প্রাণে, তিনি এমন করেই সাজলেন, যাতে তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি একেবারে প্রকট হয়ে ওঠে। মহাকাব্যের কবি সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন মাদ্রীর মন-রাঙা পরিধেয় বসনখানির ওপর। সে বসন এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যা মাদ্রীর যুবতী শরীরকে প্রকট করে তুলেছিল স্কুটাস্ফুট ব্যঞ্জনায় অন্তত পাণ্ডুর কাছে মাদ্রীর এই রূপই প্রকট হয়ে উঠেছে। একাকী অরণ্যমধ্যে মাদ্রীর পিছন পিছন যেতে যেতে সূক্ষ্মবস্ত্রভেদী মাদ্রীর যুবতী শরীরের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন তিনি সমীক্ষমাণঃ স তু তাং বয়স্থাং তনুবাসসম।
.
০৩.
পাণ্ডু পাগল হয়ে গেলেন। তার শরীরে মনে আগুন জ্বলে উঠল। জেগে উঠল এতদিনের উপবাসী আকাঙ্ক্ষা যেন গহন বনের গভীরে আগুন লেগেছে তস্য কামঃ প্রববৃধে গহনেহগ্নিরিবোঙ্খিতঃ। স্ত্রীর সঙ্গে বিচরণ করতে করতে অরণ্যপথে বহু দূর চলে এসেছেন পাণ্ডু। এখানে জন-মানব নেই কোনও দিকে। নির্জন স্থান, বাসন্তী প্রকৃতি এবং সামনে সুসূক্ষ্মাম্বরধারিণী মদ্ররাজনন্দিনী এবং তিনি কিনা পাণ্ডুর বিবাহিতা স্ত্রী। পাণ্ডু নিজের শরীর মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না–ন শোক নিয়ন্তুং তং কামং কামবলার্দিতঃ। তিনি প্রায় জোর করে মাদ্রীকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন– বলাদ রাজা নিজগ্রাহ। জোর করে’ এইজন্য যে, মাদ্রী মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেছেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে তার চোখের সামনে, তার জ্ঞাতসারে। তিনি হাত দিয়ে, পা দিয়ে, সমস্ত শরীর দিয়ে যথাসম্ভব, যথাশক্তি বাধা দিতে লাগলেন স্বামীকে বাৰ্যমানস্তয়া দেব্যা বিস্ফুরন্ত্যা যথাবলম– যাতে সেই মধুর আলিঙ্গন পর্যন্তই তার স্বামীর মিলন-সুখ সিদ্ধ হয়, তার চাইতে বেশি নয়।
মাদ্রীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহু-ক্ষেপণ, নিৰ্বল স্ত্রী-শরীরের বাধা এতটুকুও আমল দিলেন না পাণ্ডু। তাঁর মনে থাকল না কিমিন্দম মুনির অভিশাপ; তাকে আক্রান্ত করল না মৃত্যুভয়। প্রায় বলাৎকারে তিনি মাত্রীর সঙ্গে সঙ্গত হলেন মৃত্যুর সঙ্গে চিরসঙ্গত হবার জন্য– মাদ্রীং মৈথুনধৰ্মেন সোহন্বগচ্ছন বলাদিব। মহাকাল গ্রাস করল পাণ্ডুর বুদ্ধি, মাদ্রীকে আলিঙ্গন-রত অবস্থাতেই পাণ্ডু ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে স তয়া সহ সঙ্গম্য… যুযুজে কালধর্মণা। স্বামী পাণ্ডুর গতসত্ত্ব অবস্থা দেখে মাদ্রী বুঝলেন– এক মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেছে। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল সেই হাহাকার-চিৎকার, সদ্য বিধবার প্রথম বিস্ফোরক ক্রন্দন ধ্বনি– মুমোচ দুঃখজং শব্দং পুনঃ পুনরতীব চ।
মাদ্রীর আর্ত চিৎকার শুনে কুন্তী ছুটে চললেন বনের অভ্যন্তরে, তার পিছন পিছন তার তিন পুত্র এবং অবশ্যই মাদ্রীর পুত্রেরাও– নকুল এবং সহদেব।
এই আকুল অবস্থাতেও মাদ্রী বুঝলেন– ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। পাণ্ডু যেভাবে মিলন সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর সঙ্গে, তাতে তার বেশ-বাস বিস্ত, বিধ্বস্ত, অসংবৃত হয়ে গেছে। এই অবস্থায় পুত্রেরা তাকে দেখলে যে তিনি পতিমৃত্যুর দুঃখের চেয়েও সমূহ লজ্জায় পতিত হবেন– এটা মাদ্রী অনুভব করলেন। বনের অন্তরাল থেকে কুন্তীকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই তিনি বাস্তব-বোধের তাড়নায় বললেন- তুমি এখানে একা এসো দিদি, ছেলেদের তুমি ওইখানেই রেখে এসো একৈব ত্বমিহাগচ্ছ তিষ্ঠত্ত্বত্রৈব দারকাঃ।
কুন্তী যেন খানিকটা আন্দাজই করে ফেলেছিলেন যে, ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। মাদ্রী যে প্রলোভন সৃষ্টিকারী সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করে রাজার সঙ্গে গভীর নির্জন পথে একাকী গেছেন- এটা কুন্তী দেখেননি- এমনটি হতে পারে না। অতএব এখন মাদ্রীর এই চিৎকার এবং ছেলেদের দাঁড় করিয়ে রেখে একা তাকে আসতে বলার মধ্যে একটা ভয়ংকর আশঙ্কা তৈরি হয়ে গিয়েছিল কুন্তীর মনে। তিনি মাদ্রীর কথা শুনে পাঁচ পাণ্ডব-ভাইকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখেই একা চলে এলেন মাদ্রীর কাছে এবং মুখে বলতে লাগলেন– শেষ হয়ে গেলাম, আমি শেষ হয়ে গেলাম–হতাহমিতি চাকুশ্য সহসৈবাজগাম সা।
কুন্তী দেখলেন– মাদ্রী এবং পাণ্ডু– দু’জনেই শায়িত পড়ে আছেন ভূমিতে। তার মধ্যে পাণ্ডু মৃত এবং সেই মৃত স্বামীর দেহ আগলে ধরে পড়ে আছেন বিস্ৰস্তবাসা মাদ্রী দৃষ্টা কুন্তীঞ্চ মাদ্রীঞ্চ শয়ানৌ ধরণীতলে। স্বামীর মৃত্যুতে কুন্তী হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন এবং এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করে তিনি তিরস্কার করতে লাগলেন মাদ্রীকে। বললেন– আমার তো আশ্চর্য লাগছে, মাদ্রী! কিমিন্দম মুনির অভিশাপের কথা মাথায় রেখে তিনি নিজে সর্বদাই নিজেকে রক্ষা করে চলতেন এবং আমি তাকে রক্ষা করেই চলতাম– রক্ষ্যমাণো ময়া নিত্যং বনে সতত আত্মবান্। এ-কথাটার সোজা অর্থ হল– মুনির অভিশাপের কথা মনে রেখেই হোক অথবা অতিরিক্ত উত্তেজনায় নিজের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনে পাণ্ডু নিজে সমসময়ই শারীরিক সংসর্গ এড়িয়ে চলতেন স্ত্রীদের সঙ্গে এবং এমন ভাবনা এলে কুন্তীও তাকে এই সংসর্গ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন সব সময়। কুন্তীর তিরস্কার-শাসন মাদ্রীর উদ্দেশ্যে– আমি যখন পেরেছি তো তুই পারিসনি কেন? মুনির শাপের কথা মনে রেখেও রাজা তোকে এইভাবে আক্রমণ করলেন কী করে কথং ত্বমভ্যতিক্রান্তঃ শাপং জানন বনৌকসঃ।
আক্রমণ। আক্রমণই বটে। মাদ্ৰীও সত্যি নিশ্চয়ই চাননি যে, তার প্রিয় স্বামীর জীবনে মৃত্যু ঘনিয়ে আসুক। কিন্তু জ্যেষ্ঠা সপত্নী কুন্তীর মতো এখনও তার মনের মধ্যে স্বামী-স্নেহ আসেনি। অনেকেরই হয় এমন, অনেক স্ত্রীলোকেরই এমন হয় যে, একটু বয়স হলে তার পুত্র-বাৎসল্যের ভাগ স্বামীও কিছু পান। জায়া-বৃত্তির চরম স্থানে জননী-বৃত্তি এইভাবেই। ভারতবর্ষে মিশে গেছে। কিন্তু কুন্তীর ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য হলেও মাদ্রীর সম্বন্ধে এটা প্রযোজ্য নয়। তার বয়সও হয়তো কুন্তীর চেয়ে কিছু কম ছিল, এবং সৌন্দৰ্য্য কিছু বেশি। অন্যদিকে অভিশাপের ফলেই হোক অথবা ব্যাধির ফলেই হোক পাণ্ডুর আকালিক তথা বাধ্যতামূলক ইন্দ্রিয়সংযম মাদ্রীর যৌবন-বাসিত হৃদয়ের মধ্যে অতৃপ্তি জাগিয়ে রেখেছিল।
এই অতৃপ্তি সর্বদা অস্বাভাবিকও নয় এবং হয়তো সেই অতৃপ্তি এবং অপূর্ণতার বিকারটুকুই পথ খুঁজে নিয়েছিল তার বাধাবন্ধহীন প্রলোভক সাজ-সজ্জায়, যেখানে তার যৌবনোদ্ভিন্ন দেহসন্ধিগুলি ব্যাধিগ্রস্ত নিরিন্দ্রিয় পাণ্ডুকেও পাগল করে দিয়েছিল– সমীক্ষমাণঃ স তু তাং বয়স্থাং তনুবাসসম। তিনি প্রলুব্ধ হয়ে প্রায় আক্রমণ করেছিলেন মাদ্রীকে। মাদ্রী যতই বাধা দেবার চেষ্টা করুন, নিজের যৌবনোচিত অভিসন্ধিগুলি যেহেতু স্বামীর চোখে যাচিয়ে নেবার চেষ্টাই তিনি করেছিলেন, অতএব আক্রান্ত হওয়াটাই তাঁর বিধিলিপি ছিল।
কুন্তীর মধ্যে যৌবনের অতৃপ্তি ছিল না, যে কোনও কারণেই হোক ছিল না। মাদ্রীর জ্বালা তিনি বোঝেননি, অতএব তাকে তিরস্কার করে বলেছেন– তোর কি উচিত ছিল না এই অবাধ্য কামসংসর্গ থেকে রাজাকে বাঁচিয়ে রাখার। কেন এই নির্জন বনের মধ্যে একা এসে এমন করে তুই প্রলুব্ধ করলি তাকে সা কথং লোভিতবতী বিজনে ত্বং নরাধিপম। মুনির অভিশাপের কথা স্মরণ করে সব সময় তিনি বিষণ্ণ থাকতেন, সে-কথা আমি জানি, নিজের দুর্দম বাসনাকে তিনি কখনও জাগ্রত হতে দিতেন না, কিন্তু তোকে নির্জনে দেখে হঠাৎ কেন তার এই আনন্দ আবেগ উথলে উঠল– কথং দীনস্য সততং ত্বামাসাদ্য রহোগতাম।… প্রহর্ষঃ সমজায়ত।
এই তিরস্কারের পরে কুন্তী যেন একটু ঈর্ষাই করতে লাগলেন মাদ্রীকে। মাদ্রীর সংসর্গ লাভের জন্য পাণ্ডুর উচ্ছ্বসিত পুলকিত মুখখানি তিনি স্বপ্নদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন। সত্যিই তো কত কাল তিনি পাণ্ডুর এই আবেগ বিধুর মুখখানি দেখেননি। কিমিন্দম মুনির অভিশাপে স্ত্রী-সংসর্গ এবং পুত্রলাভের প্রত্যক্ষ উপায় যখন থেকে স্তব্ধ হয়ে গেল, সেদিন থেকেই তিনি বিষণ্ণ বসে থাকেন। আপন স্ত্রীদের অন্য দেব-পুরুষের সংসর্গে নিযুক্ত করে পাণ্ডু ঠিকই পুত্র লাভ করলেন বটে, কিন্তু নিজের অক্ষমতা এবং পৌরুষ প্রকাশের অবসর না থাকায় পাঁচ-পাঁচ বার অন্যকৃত এই স্ত্রী-সংসর্গ তার মনকে আক্রান্ত করেছিল– যার বহিঃপ্রকাশ ওই বিষণ্ণতা– তং বিচিন্তয়তঃ শাপং দীনস্য– আর পরিশেষে স্বাভাবিক বিকার– মাদ্রীর ওপর এই আসঙ্গ-লুব্ধ আক্রমণ। মৃত্যুর মূল্যেও মাদ্রীকে এমন করে কামনা করেছেন বুঝেই সেই তিরস্কারের মুহূর্তেও কুন্তীর একটু দুঃখ হল, একটু ঈর্ষাও হল। মাদ্রীকে তিনি বললেন– তবু তোর আপন ভাগ্যে ধন্যি বটে তুই, অন্তত আমার চেয়ে তোর ভাগ্য ভাল- ধন্যা ত্বমসি বাহ্বীকি মতো ভাগ্যতরা তথা। তবু তো একবারের তরেও রাজার পুলকিত প্রসন্ন মুখখানি তুই দেখেছিস; আমি তো তা দেখিনি কতকাল– দৃষ্টবত্যাসি যদবং প্রহৃষ্টস্য মহীপতেঃ।
তিরস্কৃত হবার পরেও কুন্তীর মুখে এই সামান্য প্রশ্রয়সূচক ধন্যিমানি কথা শুনেই মাদ্রী একটু সাহস পেলেন কথা বলতে বোঝাতে চাইলেন– তাঁর খুব দোষ ছিল না। বললেন– আমি বার-বার কেঁদে-কেটে অনেক জোর করে বারণ করেছি তাকে বিপন্ত্যা ময়া দেবি বাৰ্যমাণেন চাসকৃৎ–কিন্তু তিনি শুনলেন সে-কথা! কপাল আর দুরদৃষ্ট। রাজা নিজের মনকে সংযত করেননি, হয়তো এই সুচিরনির্দিষ্ট মৃত্যু আজ ঘটবে বলেই তিনি নিজের মনের। মধ্যে এই কামভাবকে সংযত করেননি– আত্মা ন বারিতেহনেন সত্যং দিষ্টং চিকীষুণা।
এ হল সেই চিরকালীন দ্বন্দ্ব– সুমতি-কুমতির দ্বন্দ্ব, প্রাচীন-নবীনের দ্বন্দ্ব, সংরক্ষণশীল আর প্রগতিবাদীর দ্বন্দ্ব। কিন্তু যত গালভরা নামই থাক, এত বড় কথা না বললেও বলা যেতে পারে, এ হল চিরকালের কথা, চিরকালীন বিবাদ। কুন্তী বলবেন– তুই এমন করে সেজেছিস কেন যাতে রাজার মন প্রলুব্ধ হয়? আর মাদ্রী বলবেন- আমি তো অনেক বাধা দিয়েছি, কিন্তু পুরুষ কেন তার মন সংযত করতে পারে না। এমন করে কেন সে মৃত্যু ডেকে আনে নিজের!
যাই হোক, কুন্তী আর মাদ্রীর মধ্যে এই বিবাদ বেশিক্ষণ চলেনি। প্রিয় স্বামীর মৃত্যুতে বিহ্বল দুই রমণীই খুব শীঘ্রই আপন ব্যক্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত হলেন এবং কুন্তী প্রস্তাব দিলেন তিনি স্বামীর সঙ্গে সহমৃতা হবেন।
তার যুক্তি ছিল– আমি যেহেতু বড় এবং যেহেতু আমার সঙ্গেই রাজার প্রথম বিয়ে হয়েছে অতএব আমিই তার ধর্মপত্নী। আর ধর্মপত্নীরই অধিকার থাকে সহমরণে গিয়ে ধর্মফল আত্মস্থ করার। তুমি বাছা, এই মৃতদেহ ছেড়ে ওঠো, আমি এখনই অনুমৃতা হব স্বামীর সঙ্গে। তুমি উঠে গিয়ে এই বালকদের পাশে সঁাড়াও এবং মানুষ করো তাদের উত্তিষ্ঠ ত্বং বিস্জ্যৈনমিমান পালয় দারকান।
যে সময়ে কুন্তী সহমরণে যাবার কথা বলছেন, এই সময়টাতে সহমরণ প্রথা যে খুব চালু ছিল, তা মনে হয় না। অতীত বৈদিক যুগের উত্তরাধিকারে মহাকাব্যিক সমাজের গঠন তৈরি হয়েছিল, তাতে রামায়ণ এবং মহাভারত কোনওটাতেই সহমরণের কথা বিশেষ একটা নেই। সহমরণ বা অনুমরণের কথা উঠলেই গবেষকেরা মহাভারতে এই স্থানটির কথা উল্লেখ করেন এবং সেই কারণেই জানাতে চাই যে, কুন্তী বা মাদ্রীর এই প্রচেষ্টা একেবারেই প্রথাগত নয়। এটার মধ্যে প্রেমের কিছু তত্ত্ব নিহিত আছে। কুন্তী এবং মাদ্রী দু’জনেই পাণ্ডুকে বড় ভালবাসতেন এবং তা প্রায় রেষারেষি করে ভালবাসা। একেবারে জৈব মিলনের ক্ষেত্রে পাণ্ডুর অক্ষমতা থাকায় অথচ সেই ব্যাপারে পাণ্ডুর অভিলাষ অমলিন থাকায় কুন্তী এবং মাদ্রীর অতৃপ্তি ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই অতৃপ্তি তারা প্রেমের সরসতায় ঢেকে দিতে পেরেছিলেন। একথা মানতে হবে যে, নিজের জীবনের বহুতর জটিল অভিজ্ঞতায় জ্যেষ্ঠা কুন্তী পাণ্ডুর জৈবিক অক্ষমতার ঘটনাটুকু খুব সহজে মেনে নিয়েছিলেন, তার নিজের তাড়নাও তেমন ছিল না। কিন্তু বয়স কম হওয়ার জন্যই হোক বা রূপবত্তার কারণে পাণ্ডুর প্রিয়তরা হওয়ার জন্যই হোক– মাদ্রীর নায়িকা ভাবটুকু কোনও দিনই যায়নি। জৈবিক ভাবনাতেও তার খানিকটা অতৃপ্তি ছিল হয়তো।
লক্ষণীয়, কুন্তী যে অনুমরণের কথা বলছেন, তার মধ্যে স্বামীর প্রতি তাঁর প্রকট ভালবাসার সূত্র যতখানি আছে, তার চেয়ে বেশি আছে জ্যেষ্ঠা পত্নীর কর্তব্যবোধ এবং সামাজিক ঔচিত্যের প্রাধান্য। তিনি বলেছিলেন, আমি সহমরণে যেতে চাই, তার কারণ আমি বাড়ির বড় বউ, ধর্মপত্নী এবং জ্যেষ্ঠা পত্নীই প্রথম ধর্মফলের অধিকারী– অহং জ্যেষ্ঠা ধর্মপত্নী জ্যেষ্ঠং ধর্মফলং মম– যেন স্বামীর অনুমরণে পুণ্যধর্ম বলে যদি কিছু থাকে, তবে সে পুণ্য নিয়ম অনুসারে তারই প্রাপ্য। মাদ্রী কিন্তু এমন কথা বলেননি; তিনি স্বামীর জৈবিক চরিত্রটি ধরতে পেরেছেন এবং নিজের জৈবিকতাও প্রকট করে তুলতে তার লজ্জা হয়নি। মাদ্রী বলেছেন- দিদিগো! স্বামী আমার কাছ থেকে চলে গেছেন বলে আমি মনে করি না, অতএব আমিই তাকে অনুগমন করতে চাই। আমার অন্তর্বহা কামনা, আসঙ্গলিপ্সা এখনও তৃপ্ত হয়নি। তুমি তাই বাধা দিয়ো না আমাকে– ন হি তৃপ্তাস্মি কামানাং জ্যেষ্ঠে মামনুন্যতা।
ভারতীয় ধর্মদর্শনের জটিল তাত্ত্বিকতা পরিহার করেই একটা বিশ্বাসের কথা আমাদের জানাতে হবে। সেই বিশ্বাসটার পারিভাষিক তথা দার্শনিক নাম বাসনা-সংস্কার। এতবড় কথা এখানে পাঁচ লাইনে বোঝানো যাবে না। কিন্তু এটাই হল বিশ্বাস যে, আমাদের ইহলোকের কামনা-বাসনা-তৃপ্তি-অতৃপ্তি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা– সব কিছু অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ‘মনোবুদ্ধিচিন্তাহংকারাত্মক’ সূক্ষ্ম দেহের মধ্যে নিহিত হয়ে মরণের পর প্রেতলোকে এবং পরজন্মেও সঞ্চারিত হয়। এই দর্শনের কথা উপাখ্যানের আকারে সবচেয়ে ভাল বলা আছে। জড়-ভরতের কাহিনিতে ভাগবত পুরাণে। এখানে মাদ্রীও সেই সাংস্কারিক বিশ্বাসেই কথা বলছেন– স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সংশ্লেষের সমস্ত অতৃপ্তি আমার শরীরে, হয়তো সেই অতৃপ্তি রয়ে গেছে স্বামী পাণ্ডুর মধ্যেও যার জন্য নিজের সর্বনাশ জেনেও আমারই সংসর্গ লাভ করতে গিয়ে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলেন– মাঞ্চাভিগম্য ক্ষীণোহয়ং কামাদ ভরতসত্তমঃ। অতএব আমিই অনুমৃতা হব।
মাদ্রীর কথাগুলি শুনলে ভদ্র-জীবের মনে এমন ভাবনা উদয় হতে পারে যে, এ তো বড় নচ্ছার মহিলা, নিজের শারীরিক কামনার কথা এমন সোচ্চারভাবে বলে যাচ্ছে, এ তো সভ্য সমাজের দৃষ্টিকটুতা, শ্রবণকটুতা কিছুরই তোয়াক্কা করে না। হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে এমনটা হয়তো বলা যেতে পারে, কিন্তু সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এটা মহাভারত মহাকাব্য। এখানে উপন্যস্ত কাহিনির মধ্যে নায়ক-নায়িকা, পাত্র-পাত্রী, সকলেই স্পষ্ট কথা বলেন এবং পরবর্তী কালের সভ্যতার নিয়মে অতিরিক্ত সাংস্কৃতিক সংকোচে মনে ভাব অবদমিত রেখে উত্তর জীবনে কোনও ফ্রয়েডীয় তাত্ত্বিক বিকারের শিকার হওয়া পছন্দ করতেন না তারা। এ সবের চাইতে নিজের সাংস্কারিক ধারণায় স্বামীর সঙ্গে শীঘ্র মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই মাদ্রী স্বেচ্ছায় অনুমৃতা হতে চেয়েছেন– একেবারেই স্বেচ্ছায়, সহমরণের কোনও আনুষ্ঠানিক তথা প্রথাগত কারণে নয়।
ঠিক এই মুহূর্তে, অনুমরণের এই অন্তিম মুহূর্তে মাদ্রীর অদ্ভুত স্পষ্ট উচ্চারণগুলি একদিকে যেমন তাকে কুন্তী, গান্ধারী– এইসব উদার বৃহৎ মহাকাব্যিক চরিত্রের প্রতি তুলনায় ক্ষুদ্র করে তোলে, অন্যদিকে এই ক্ষুদ্রতাই শত শত সমকালীন পরিবারের সপত্নীবৃত্তিতার বাস্তব প্রতিভূ করে তোলে তাঁকে। মাদ্রী তার স্বামীর সম্পূর্ণ অধিকার চান; স্বামীর মানসিক এবং শারীরিক ক্ষেত্রটি একান্তভাবেই তিনি নিজের করে পেতে চান, তার জ্যেষ্ঠা অতএব ধর্মপত্নীর অধিকারের গরিমা নিয়ে কুন্তী পাণ্ডুর সহমৃতা হবেন– এই অধিকার মাদ্রীর কাছে নিতান্তই কৃত্রিমতা। আপন শারীরিক আসঙ্গ-লিপ্সার প্রকট উচ্চারণ করে তিনি কুন্তীর ওই কৃত্রিমতা এক মুহূর্তে ভেঙে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন– মরণের স্পষ্ট ইঙ্গিত উপেক্ষা করেও যে স্বামী তারই শারীরিক সঙ্গ কামনা করেছেন, সে স্বামী যেন একান্তভাবে তারই, কুন্তীর নয়। এমনকী এই মৃতদেহটির ওপরেও যেন তারই সর্বাঙ্গীণ অধিকার। কুন্তীকে বলতে হচ্ছে– তুই এই মৃতদেহটি ছেড়ে উঠে আয় এবার উত্তিষ্ঠ ত্বং বিস্জ্যৈনম্।
.
০৪.
মাদ্রী আরও বেশি রূঢ় এবং বাস্তব হয়ে ওঠেন পুত্রদের কথায়। কুন্তী বলেছিলেন এই ছেলেপিলেদের ভার তোর ওপরে থাকল বোন। আমি স্বামীর অনুমৃতা হব। মাদ্রী এখানেও সেই ক্ষুদ্রতা প্রকট করে তুলেছেন, কিন্তু ক্ষুদ্রতা এতই বাস্তব এবং স্পষ্ট যে মাদ্রী এখানে সপত্নীবৃত্তির প্রকট মহাকাব্যিক প্রতিবাদ হয়ে ওঠেন। মহাকাব্যিক এইজন্য বলছি যে, মাদ্রী নিজের দীনতা, ক্ষুদ্রতা প্রকাশ করছেন একজন সমকালীন কনিষ্ঠা সপত্নীর প্রতিভূ হিসেবে কিন্তু একই সঙ্গে জ্যেষ্ঠার উদারতাটুকুও তিনি অস্বীকার করেন না। যা তিনি পারেন না, মাদ্রী তার ভানও করেন না। অতএব মাদ্রীপুত্রদের সঙ্গে তিন জন কৌন্তেয়কে সুরক্ষা দিয়ে বড় করার কথা কুন্তীর মুখে প্রস্তাবিত হতেই মাদ্রী নিজের অক্ষমতা জানিয়ে বললেন– আমি পারব না দিদি! আমি পারব না। আমি তোমার ছেলেদের ওপর নিজের ছেলেদের সমান ব্যবহার করতে পারব না, আমার পক্ষপাত আসবেই– ন চাপ্যহং বর্তয়ন্তী নির্বিশেষং সুতেষু তে। আমি জেনেশুনে এই পাপ করতে পারব না। তার চেয়ে এই ভাল, আমার দুটি ছেলেকে তুমি নিজের ছেলের স্নেহ দিয়ে দেখো- তম্মন্মে সুতয়োঃ কুন্তি বর্তিতব্যং স্বপুত্রবৎ।
নিজের ছেলের সমান করে সপত্নী-পুত্রদের দেখা– এটা সহজ কথা নয়, অনেকেই তা পারেন না। কিন্তু সেই সত্যটাকে এমন অকপটে স্বীকার করাটা সহজ নয়, আর ঠিক এইখানেই মাদ্রীকে অন্যতর এক মর্যাদায় দেখতে পাই আমরা। তিনি এতটাই জোর দিয়ে নিজের ক্ষুদ্রতাকে সত্যের মহিমায় প্রকাশ করেন যে কুন্তীর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বও কেমন কথা হারিয়ে নিশূপে দাঁড়িয়ে থাকেন।
মাদ্রী শেষ কথা বলেন আমার সঙ্গে উপগত হবার চেষ্টাতেই রাজা মৃত্যুবরণ করেছেন– মাং হি কাময়মানোহয়ং রাজা প্রেতবশং গতঃ–অতএব আমার মৃত শরীর তার শরীরের সঙ্গে একত্র আবৃত করে দগ্ধ কোরো। তাতেই আমার প্রিয় আচরণ করা হবে। আর কী বলব, দিদি! তুমি চিরকালই আমার ভাল করে এসেছ, অতএব আমার ছেলে দুটির ওপরেও তোমার সমান দৃষ্টি থাকবে, এটাই যেন হয়–দারকেপ্রমত্তা চ ভবেথাশ্চ হিতা মম।
এই কথোপকণ্বনের পর মহাভারতে যেমনটি লেখা আছে তাতে শব্দগতভাবে মনে হতে পারে যেন মাদ্রী স্বামীর চিতাগ্নিতে আরোহণ করলেন– ইত্যুত্ত্বা তং চিতাগ্নিস্থং ধর্মপত্নী নরর্ষভম। অর্থাৎ যেন মনে হয়, মাদ্রী জ্বলন্ত চিতায়-শোয়া স্বামীর অনুগমন করলেন। কিন্তু আপাতভাবে শব্দের চেহারা দেখে বিশেষত চিতাগ্নি’ কথাটি দেখে এমন মনে হতে পারে বটে যে, মাদ্রী মধ্যযুগীয় ভাবনামতো সতী হলেন স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিয়ে। কিন্তু মহাভারতের প্রমাণেই বলা যায় এমনটি ঘটেনি। আসলে ‘চিতাগ্নিস্থ’ শব্দের সোজাসুজি অর্থ এইরকমই অর্থাৎ পাণ্ডুকে যেন চিতায় তোলা হয়েছে। কিন্তু তা নয়, এখানে চিতাগ্নিস্থ’ মানে করতে হবে– যাকে চিতায় ওঠাবার অবস্থা তৈরি হয়েছে। এইরকম একটা অর্থান্তর ভাবনা করতেই হচ্ছে কেননা আমরা জানি যে পাণ্ডুর শবশরীর এখনও দাহ করা হয়নি, অতএব মাদ্রীর চিতাগ্নি প্রবেশের প্রশ্নই ওঠে না। এই অধ্যায়ের পরের অধ্যায়ে দেখছি– শতশৃঙ্গবাসী মুনি-ঋষিরা পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃতদেহ হস্তিনাপুরে পৌঁছে দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এবং তাদের দাহকার্য সম্পন্ন হয়েছে হস্তিনাপুরেই স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে। অতএব মাদ্রী চিতাগ্নিতে প্রবেশ করে সতী হননি মোটেই, তিনি যা করেছেন, সেটাকে যোগের দ্বারা আত্মমরণ ঘটানোর বিষয় বলে ভাবা যেতে পারে। এমনটি সেকালে অভিজাত জনেরা করতেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের ইতর-বিশেষ ঘটিয়ে যোগনিরুদ্ধ অবস্থায় যৌগিক কৌশলে নিজের মৃত্যু ঘটানোর কথা মহাভারতে একাধিক আছে। মাদ্ৰীও সেই যৌগিক মৃত্যুই বরণ করেছেন চিতাগ্নিযোগ্য পাণ্ডুর অনুমৃতা হয়ে।
পরের অধ্যায়ে মুনি-ঋষিদের ব্যস্ত হতে দেখছি। পাণ্ডু রাষ্ট্র ছেড়ে এসেছিলেন, তাঁকে স্বরাষ্ট্রে পৌঁছে দিতে হবে তাঁর দেহ-সংস্কার রাষ্ট্রের মধ্যেই হতে হবে। অতএব পাণ্ডুর শবদেহ এবং মাদ্রীর শবদেহ নিয়ে মুনিরা হস্তিনাপুরে এসেছেন। সঙ্গে অবশ্যই কুন্তী এবং পঞ্চপাণ্ডব। ঋষিরা ধৃতরাষ্ট্র-ভীষ্ম-বিদুরের সামনে পাণ্ডু-পুত্রদের সবিশেষ পরিচয় দিয়ে তারপর বলেছেন– আজ থেকে সতেরো দিন আগে পাণ্ডু মারা গেছেন এবং তিনি চিতাগ্নিতে স্থান পাবেন জেনেই মাদ্ৰীও তার সঙ্গে একত্র স্থান পাবার আশায় নিজের প্রাণত্যাগ করেছেন– সাগতা সহ তেনৈব… হিত্বা জীবিতমাত্মনঃ– এবারে আপনারা এঁদের অন্তিম সংস্কার করুন। এরপরে পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শব-শরীর দুটি হস্তিনার রাজপরিবারের সামনে রেখে ঋষিরা বলেছেন– এই রইল পাণ্ডু এবং মাদ্রীর দুটি শব দেহ, এই রইল তাঁদের ছেলেপিলেরা সব-ইমে তয়োঃ শরীরে দে সুতাশ্চেমে তয়োর্বরাঃ- এবারে পরবর্তী কর্ম আপনারা করুন।
মাদ্রী রাজপরিবারের জাতিকা, রাজবধূও বটে। অতএব ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শব সংস্কার কর্মের জন্য যথেষ্ট সমারোহের আদেশ দিলেন বিদুরকে– রাজব রাজসিংহস্য মাদ্রাশ্চৈব বিশেষতঃ। মাদ্রী মৃত রাজার সহধর্মচারিণী বলেই তার রাজমর্যাদা মাথায় রেখেই ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন- মাদ্রীর শবদেহ যেন অত্যন্ত আবৃত অবস্থায় চিতাস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়– এতটাই আবৃত, যেন সূর্যের কিরণ সেখানে প্রবেশ না করে, যেন সর্বব্যাপী বায়ুও তার স্পর্শ না পায়– যথা চ বায়ুর্নাদিত্যঃ পশ্যেতাং তাং সুসংবৃতাম্।
মাদ্রীর শব-শরীরের ব্যাপারে এই সংরক্ষণশীলতা ধৃতরাষ্ট্রের গোঁড়ামি, নাকি সেটা রাজমহিষীর মর্যাদা, সেটা বোঝা বেশ কঠিন। যাই হোক, ধৃতরাষ্ট্র আদেশ দিলেন কুন্তীই তার কনিষ্ঠা সপত্নীর অগ্নিসংস্কার করবেন। হয়তো মাদ্ৰীপুত্রেরা অত্যন্ত ছোট এবং মাতৃশোকে তাদের আকুল অবস্থা বুঝেই ধৃতরাষ্ট্র কুন্তীর ওপর এই মুখাগ্নি সংস্কারের ভার ন্যস্ত করেছেন। এই আদেশ-প্রক্রিয়া থেকে আরও মনে হয় যে, গোঁড়ামি নয়, তখনকার দিনের গৃহবধূ রমণীর মর্যাদা হয়তো এমনই ছিল, যাতে মরণের পরে তাকে সুসংবৃত করেই দেহসংস্কার করা হত। ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ এবং মাদ্রীর শেষ ইচ্ছা স্মরণে রেখে নিযুক্ত পুরুষেরা একই শিবিকাতে পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শব-দেহ গন্ধ-পুস্প মাল্যের রাজকীয় আড়ম্বরে সজ্জিত করে নিল। মাদ্রীর সঙ্গে পাণ্ডুর দেহখানিও একত্র আবৃত করে অনেকগুলি অভিজ্ঞ শিবিকাবাহী মানুষ সেই সুসজ্জিত শিবিকা বয়ে নিয়ে গেল গঙ্গার তীরভূমিতে অবহন যানমুখ্যেন সহ মাদ্রা সুসংবৃতম্।
মনোরম গঙ্গার তীরে যখন মাদ্রী এবং পাণ্ডুর শিবিকা এসে পৌঁছল, তখন সেই শিবিকা স্পর্শ করে যারা মাটিতে নামালেন, তাদের মধ্যে পঞ্চপাণ্ডব ভাইদের সঙ্গে বিদুর এবং ভীষ্মও আছেন– ন্যাসয়ামাসতুরথ তাং শিবিকাং সত্যবাদিনঃ। মৃতদেহ সৎকারের পূর্বে যে সব আচার-নিয়ম আছে- কালাগুরু-চন্দনের প্রলেপ দিয়ে মৃতদেহ স্নান করানো, স্নানের পর আবার চন্দনের অনুলেপন এসব পাণ্ডুকেও যেমন করা হল, মাদ্রীকেও তেমনই করা হল। ঘৃতলিপ্ত অলংকৃত পাণ্ডু এবং মাদ্রীর বস্ত্রাবৃত দেহ এবার তোলা হল চিতায়। চিতার চন্দনকাঠে আগুন দিতেই দুটি শব-শরীর যখন জ্বলে উঠল। পুত্র এবং পুত্রবধূর এমন বীভৎস প্রয়াণ দেখে পাণ্ডুর জননী প্রৌঢ়া অম্বালিকা মুর্ভূিত হয়ে পড়ে গেলেন– ততস্তয়ো শরীরে দ্ধে দৃষ্টা মোহবশং গতা।
এই শেষ হয়ে গেল মাদ্রীর জীবন। স্বামীর মৃত্যুর পর যোগবলে নিজের দেহপাত ঘটানোর পর এমন একটা ঘটনা ঘটেনি অথবা এমন একটি প্রক্রিয়া ছিল না, যেখানে মাদ্রী এবং পাণ্ডুর পৃথক কোনও সংস্কার ঘটেছে। মাদ্রী তো এই চেয়েছিলেন। কোনওভাবে তিনি প্রিয় স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থাকতে চাননি। মরণ তাঁকে এই একত্ৰস্থিতির নিশ্চিন্ততা দিয়েছে, কিন্তু বেঁচে থাকতে তার ইচ্ছাপূরণ ঘটেনি। জ্যেষ্ঠা সপত্নী কুন্তী পাণ্ডুর কাছে যে বড় অত্যাদর লাভ করেছেন, তা নয়, হয়তো সে তুলনায় মাদ্রীর প্রতিই রাজা বেশি আসক্ত ছিলেন। কিন্তু স্বামীর এই আসক্তি সত্ত্বেও মাদ্রীর মধ্যে একটা রিক্ততা কাজ করত। তাঁর হৃদয়ের মধ্যে যে অনন্ত প্রেম ছিল, যে নিবিড় আসঙ্গলিপ্সা ছিল, জীবন থাকতে সে প্রেম তার পথ খুঁজে পায়নি। কুন্তী তার কনিষ্ঠা সপত্নীকে খুব আদরও করেননি আবার কোনও অপব্যবহারও তার সঙ্গে করেননি। কিন্তু তিনিই বুঝি মাদ্রীর সর্বাঙ্গীণ প্রেমে বাধা দিলেন। প্রেমের ক্ষেত্রে, অথবা প্রেমের অধিকারে এতটুকু ভাগও মাদ্রী সহ্য করতে পারেন না। স্বামীকে তিনি সম্পূর্ণভাবে একান্ত আপন করে চান বলেই তিনি চিরতরে স্বামীর মরণশয্যার সঙ্গী হলেন পরজন্মের আশায়। তার এই মরণোত্তর বিবাহের সাক্ষী হয়ে রইল যুগল-চিতার আগুন।