ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মহিমবাবু আপিসে ফিরে এলেন, বিজয়বাবুকে অনেকটা শান্ত করে রেখে এলেন। তাঁর বাড়িতেই। নিজের বাড়ির বিরাট বোবা শূন্যতা থেকে পালাতে পেরে বিজয়বাবু যেন একটু আরাম বোধ করলেন।
আপিসে এসেই মহিমবাবু ডেকে পাঠালেন চঞ্চলকে।
“নিউজ লিখে দিয়েছো?”
“দিয়েছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কাগজ বেরিয়ে যাবে। হকাররা এখন থেকেই আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে। খুব ডিমাণ্ড হয়েছে।”
“হ্যাঁ, শহরের সবাই ব্যস্ত হয়ে আছে তো। শোনো চঞ্চল, তোমাকে এখন ডায়মণ্ড হার্বরে পাঠাতে চাই।”
চঞ্চল চুপ করে রিল।
“পারবে তো?”
“পারব না কেন?”
“ভয় পাবে না?”
চঞ্চল দৃঢ়স্বরে বলল, “না। কী করতে হবে বলুন।”
“এক্ষুণি চলে যাও শেয়লদা। সেখান থেকে ট্রেন চেপে ডায়মণ্ড হার্বার। বাড়িটা খুঁজে বের করতে আশা করি তোমার কষ্ট হবে না। যতক্ষণ দিনের আলো থাকবে, কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করবে – নজর রাখবে কে ঢুকছে আর কে বেরুচ্ছে। সন্ধের পরে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে তোমার আসল কাজ শুরু। কৃষ্ণপক্ষের রাত আছে, সুবিধাই হবে।”
“সুবিধে পেলে, বাড়িটার ভিতরেই যাব।”
“তা যদি যেত পার তবে তো ভালোই। কিন্তু খুব সাবধান। ওরা লোক ভালো নয়, রিভলভার টিভলভারও আছে। যদি শুধু এইটেই জেনে আসতে পার যে পরীক্ষিৎ সত্যি ওখানে আছে, তাহলেই অনেকখানি হল। দুঃসাহস করো না, বুঝে সুঝে চল। যদি জানতে পাও যে পরীক্ষিৎ ওখানে আছে, তাহলেই তোমার কাজ শেষ হল। আর কিছু করবার চেষ্টা কোরো না। তারপর ডাক বাংলোয় গিয়ে ঘুমিয়ে কি কলকাতায় ফিরে এস, যদি ট্রেন পাও। আর একটা ফোন কোরো আমার বাড়ির নম্বরে। আমাকে না পেলেও বিজয়কে পাবে।”
“আপনি কি আজ রাত্রে বাড়ি থাকবেন না?”
“আমার আজ রাত্রে অনেক কাজ, চঞ্চল, কখন কোথায় থাকি, ঠিক নেই। এ হাঙ্গামা চুকে গেলে যা একচোট ঘুমিয়ে নেব!”
“রাত্তিরে এত কম ঘুমিয়ে আপনি কী করে পারেন! আশ্চ্চর্য!”
“সবই অভ্যেস! তাহলে আর দেরি কোরো না। এই নাও” বলে মহিমবাবু পকেট থেকে ব্যাগ বের করে দুটো দশটাকার নোট চঞ্চলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
“এত টাকা দিয়ে কী হবে?”
“রাখ সঙ্গে, যদি লাগে। আমার মনে হয়, পুলিশের লোকও আজ রাত্রেই যাবে ওখানে। দেখ, তারা যেন আবার তোমাকে শত্রুপক্ষের বলে সন্দেহ না করে! যতটা পার তাদের সাহায্য কোরো।”
“আপনার কি মনে হয়…”।।
“এখন আর মনে হওয়া না হওয়ার সময় নেই। পনেরো মিনিটের মধ্যেই একটা গাড়ি আছে। তুমি বেরিয়ে পড়।”
শেয়ালদা সাউথ স্টেশনে টিকিট কিনে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে চঞ্চল দেখল, গাড়ি ছাড়তে তখনও মিনিট পাঁচেক বাকি। ভিড় কম এমন একটা গাড়ি খুঁজে বের করে সে উঠে বসল। কী এক অদ্ভুত উদ্দেশ্য নিয়ে সে চলেছে। কে জানে হয়তো কোনো বিপেই পড়বে, কে জানে হয়তো, চিঠিটাই জাল, একদম ঠকে ফিরে আসবে। তার বুকের ভিতরটা ঈষৎ দুর দুর করতে লাগল – না জানি কী হয়!
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে প্রায় প্ল্যাটফর্মের বাইরে চলে এসেছে, পাশের কামরা থেকে একটা হৈ চৈ শব্দ উথল। চঞ্চল মুখ বাড়িয়ে দেখল, একটা লোক চলতি ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। এখনও লম্বা দুটো ঠ্যাং বাইরে ঝুলে আছে, কিন্তু একটু পরেই ভিতরের লোকেরা তকে টেনে তুলল, গাড়ি ছুটল, গাড়ি ছুটল বেগে। চঞ্চল লোকটার মুখ দেখতে পেল না, দেখতে পেলে খুশি হত। কেমন একটা সন্দেহ তার মনে খচ খচ করতে লাগল, লোকটা তারই পিছু নেয়নি তো? প্রত্যেক স্টেশনে সে মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগল, পাশের কামরা থেকে একে একে নামল। কহনও মনে হয় সে লোকটা নেমে গেল, কখনও মনে হয় উল্টোটা। কখনও আবার মনে হয়, বাজে কথা ভেবে সময় নষ্ট করছে, ও সব কিছুই নয়। এই রকম মনের অবস্থার মধ্যে সন্ধের একটু আগে সে ডায়মণ্ড হার্বারে এসে পৌঁছল। গাড়ি স্টেশনে আসতেই সে লাফ দিয়ে পড়ল প্ল্যাটফর্মে, পাশের কামরা থেকে বিশেষ কেউ নামে কিনা সেটা লক্ষ করে দেখবে এইরকম তার মতলব। কিন্তু মুহূর্তে প্ল্যাটফর্ম ভিড়ে ভরে উঠল, তার ভিতরে কাউকে আলাদা লক্ষ করা সম্ভব হল না।
ডায়মণ্ড হার্বারে সে আগেও এসেছে, পথঘাট মোটামুটি জানে। স্টেশনে এক পেয়ালা চা খেয়ে নিল তারপর বেরিয়ে এসে নদীর দিকের রাস্তা ধরল। একটু হাঁটে আর এদিক ওদিক তাকায় – কেউ তার পিছু নিয়েছে কিনা। ছোটো মফস্বল শহরের রাস্তায় বেশি লোক নেই, এর মধ্যে কেউ যে লুকিয়ে কারো পিছু নেবে সেটা সম্ভব নয়। চঞ্চলের সন্দেহ না যে এটা তার ভুল মাত্র।
নদীর ধার ধরে ঘোরাঘুরি করতে করতে শহরের খানিকটা বাইরে মস্ত পুরোনো একট বাড়ির কাছে সে এসে দাঁড়াল। দেখে সন্দেহ রইল না যে এই সেই বাড়ি। পাঁচিল ঘেরা প্রকাণ্ড বাড়ি, কম্পাউণ্ডে অনেক বড় বড় গাছ ছায়া রচনা করেছে, দোতলার সব জানলা বন্ধ, একতলাটা রাস্তা থেকে ভালো করে দেখা যায় না। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় না এখানে কোনো মানুষ আছে বা কোনোকালে থেকেছে। হয়তো কোম্পানির আমলে কোনো শৌখিন সাহেব নদীর ধারে বাড়িটি করেছিল। এখন কালের কবলে পড়ে এই দশা হয়েছে।
চঞ্চল বাড়িটির চারদিক ঘুরে একবার দেখল, তারপর নদীর ধারে ঘাসের উপর বসে ভাবতে লাগল, এখন কী করা।
জায়গাটি এমনিতেই নির্জন, তার উপর সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গেই দূর থেকে শেয়াল ডেকে উঠল, নদীর জলের ছলছল শব্দ যেন বেড়ে উঠল, হাওয়া হু হু করে ফিরতে লাগল। দেখতে দেখতে আকাশ ভরে তারা ফুটল আর কালো অন্ধকারে জোনাকি উঠল জ্বলে।
তখন চঞ্চল আস্তে আস্তে উঠে বাড়িটার ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল। ভাঙা ফটক হাঁ করে খুলে আছে, ঢুকতে বাধা নেই। চঞ্চল ঢুকল, ঢুকেই একটু থমকে দাঁড়াল। মনে হল বাড়িটার ভিতর থেকে মানুষের গলার চাপা আওয়াজ যেন আসছে। কোথায় কোন ঘরে একটা আলো জ্বলে উঠেই যেন নিতে গেল। না কি এসব তার মনের ভুল? চোখের ভুল? না, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ। চঞ্চলের গলা যেন বুজে আসতে চাইল, কিন্তু জোর করে সমস্ত ভয়ের ভাব মন থেকে তাড়িয়ে সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল, উথল এসে একতলার বারান্দায়।
এখন কোন দিকে যাবে?
অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। চঞ্চলের পকেটে ছোটো একটা টর্চ আছে বটে, কিন্তু সেটা তার জ্বালতে সাহস হল না। সবচেয়ে ভালো হবে তার পক্ষে কোনোখানে লুকিয়ে থাকা। নিজে গোপন থেকে এখানকার সব ব্যাপার দেখে নেবার চেষ্টাই তাকে করতে হবে। বেশি ভাববার সময় নেই, হাতের কাছে একটা দরজা ছিল খোলা, কী করে ঢুকে পড়ল। বহুদিনের পুরনো অব্যবহৃত ঘরে একটা ব্যাপসা গন্ধে তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। চোখে যখন অন্ধকার সরে গেল, দেখতে পেল কয়েকতা ভাঙা চেয়ার টেয়ারও আছে ঘরে। পা টিপে টিপে গিযে বসল তারই একটায়, চেযারটা ক্যাঁ ক্যাঁ করে উঠল। মাথার উপর দিয়ে চামচিকে গেল উড়ে, মেঝেয় আরশোলা ইঁদুরের দুদ্দাড় ছুটোছুটি। তারই মধ্যে বসে চঞ্চল অপেক্ষা করতে লাগল।
সময় আর কাটে না। বাড়িটার নানা অংশ থেকে নানারকম শব্দ আসতে লাগল, তবে হয়তো সে সব এমনি এমনিই হচ্ছে। পুরোনো পোড়ো বাড়িতে কত রকম শব্দ হয় তার কি অন্ত আছে! কিন্তু মানুষ যে এখানে আছে, সে সন্দেহ তার মন থেকে কিছুতেই গেল না। পরীক্ষিৎবাবু কোন ঘরে? সে উঠবে নাকি? দেখবে নাকি সমস্ত বাড়ি খুঁজে? মহিমবাবুর উপদেশ মনে পড়ল – দুঃসাহস কোরো না। এদিকে রণজিৎবাবুই বা কী করছেন? তিনি তাঁর দলবল নিয়ে তো এখন চলে এলেই পারেন। না কি তিনি অসবেনই না?