০৮. মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি
(The Origin and Fate of the Universe)
আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে স্থান-কালের শুরু বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতায় এবং শেষ হবে হয় বৃহৎ সঙ্গোচনের (big crunch) অনন্যতায় (যদি সমগ্র মহাবিশ্ব আবার চুপসে যায়) কিম্বা একটি কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরকার অনন্যতায় (যদি তারকার মত স্থানীয় একটি অঞ্চল চুপসে যায়)। যে কোন পদার্থ ঐ গ্রহে পড়লে ঐ অনন্যতায় সেটা ধ্বংস হয়ে যাবে। বাইরে থেকে শুধুমাত্র ঐ ভরের মহাকর্ষীয় অভিক্রিয়াই gravitational effect) বোধগম্য হতে থাকবে। অন্যদিকে যখন আবার কণাবাদী অভিক্রিয়া (quantum effect) বিচার করা হল তখন মনে হল ঐ পদার্থের ভর কিম্বা শক্তি শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বের অবশিষ্টাংশে ফিরে যাবে এবং কৃষ্ণগহ্বরটি উবে যাবে এবং তার ভিতরে যদি কোন অনন্যতা থাকে তাহলে সেটা সমেত উবে যাবে (evaporate) এবং শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে (disappear)। কণাবাদী বলবিদ্যার কি বৃহৎ বিস্ফোরণ কিম্বা বৃহৎ সঙ্গোচনের অনন্যতার মত একই রকম একটি নাটকীয় অভিক্রিয়া থাকতে পারে? মহাবিশ্বের অতি প্রাথমিক অবস্থায় কিম্বা শেষ অবস্থায় যখন মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত শক্তিশালী কণাবাদী অভিক্রিয়াকে quantum effect) অগ্রাহ্য করা যায় না–তখন আসলে কি ঘটে? মহাবিশ্বের কি সত্যিই কোন শুরু কিম্বা শেষ আছে? যদি থাকে, তাহলে তারা কি রকম?
১৯৭০ দশকের পুরোটাই আমি কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করছি কিন্তু ১৯৮১ সালে জেসুইটদের ভ্যাটিক্যানে (Vatican) সংগঠিত সৃষ্টিতত্ত্বের (cosmology) উপর একটি আলোচনা সভায় যোগদানের পর মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং পরিণতি বিষয়ক প্রশ্নে আমার আবার নতুন করে আকর্ষণ জেগে উঠে। বৈজ্ঞানিক বিষয়ে আইন বানাতে গিয়ে ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওর ব্যাপারে একটি বিশ্রী ভুল করেছিল। তারা ঘোষণা করেছিলেন সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। এখন কয়েক শতাব্দী পর তারা সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে উপদেশ দেয়ার জন্য কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর সম্মেলনে অংগ্রহণকারীদের পোপ দর্শন দান করেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন, বৃহৎ বিস্ফোরণের পর মহাবিশ্বের বিবর্তন নিয়ে গবেষণায় কোন দোষ নেই কিন্তু বৃহৎ বিস্ফোরণ সম্পর্কে কোন গবেষণা করা উচিত হবে না। কারণ সেটা ছিল সৃষ্টির মুহূর্ত এবং সৃষ্টিটা ঈশ্বরের কর্ম। সেই সম্মেলনে তখনই আমি যে বক্তৃতা করে এসেছি সেটা ছিল স্থান-কালের সীমিত অথচ সীমাহীন হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে। অর্থাৎ এর কোন শুরু নেই, কোন সৃষ্টি-মুহূর্তও নেই। তিনি যে আমার বক্তৃতার বিষয়বস্তু জানতেন না তাতে আমি খুশি। গ্যালিলিওর সঙ্গে বেশ একাত্মতা বোধ করি কিন্তু আমার পরিণতি তার মত হোক এরকম কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। এই একাত্মতা বোধের আংশিক কারণ আমি জেনেছি তাঁর মৃত্যুর ঠিক তিনশ বছর পর।
মহাবিশ্বের এবং পরিণতি বিষয়ে কণাবাদী বলবিদ্যা কিরকম প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে বিষয়ে আমার এবং অন্যান্য কয়েকজনের চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করতে হলে প্রথম জানা দরকার “উত্তপ্ত বৃহৎ বিস্ফোরণ প্রতিরূপ” (not big bang model) নামে পরিচিত মহাবিশ্বের স্বীকৃত ইতিহাস বোঝা। এই তত্ত্ব অনুসারে অনুমান করা হয় : একদম শুরু থেকে মহাবিশ্বের বিবরণ পাওয়া যায় একটি ফ্রিডম্যান প্রতিরূপে (Friedmann’s model)। এই সমস্ত প্রতিরূপে দেখা যায় মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হলে তার ভিতরের যে কোন পদার্থ কিম্বা বিকিরণ শীতলতর হয়। (মহাবিশ্বের আকার দ্বিগুণ হলে তার তাপমাত্রা হয়ে যায় অর্ধেক)। তাপমাত্রা কণাগুলোর গড় শক্তি কিম্বা দ্রুতির পরিমাণ। সুতরাং মহাবিশ্বের শীতলতর হওয়ার ফলে তার অন্তর্ভূক্ত পদার্থের উপর ক্রিয়া হবে বৃহৎ (major effect)। তাপমাত্রার খুব বেশি হলে কণাগুলো এত দ্রুত চলাচল করতে থাকবে যে পারমাণবিক কিম্বা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় যে কোন বলজাত পারস্পরিক আকর্ষণ থেকে তারা মুক্ত হতে পারবে কিন্তু তারা শীতলতর হলে, আশা করা যায়, যে সমস্ত কণা পরস্পরকে আকর্ষণ করে তারা সংযুক্ত হতে শুরু করবে clump togeth er)। তাছাড়া মহাবিশ্বে কি রকম কণার অস্তিত্ব থাকবে সেটাও নির্ভর করবে তাপমাত্রার উপর। তাপমাত্রা যথেষ্ট উচ্চ হলে কণাগুলোর শক্তি এত বেশি হবে যে তাদের ভিতর সংঘর্ষ হলে নানারকম কণা এবং বিপরীত কণার জোড়া (particle/ antiparticle pair) উৎপন্ন হবে। বিপরীত কণাগুলোকে আঘাত করার ফলে এগুলোর কিছু কিছু ধ্বংস করে। কিন্তু কণাগুলো যত দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে উৎপন্ন হবে তার চাইতে দ্রুত। তাপমাত্রা নিম্নতর হলে কিন্তু সংঘর্ষমান কণাগুলোর শক্তি হবে এবং কণিকা/বিপরীত কণিকার জোড় উৎপন্ন হবে স্বল্প দ্রুত এবং ধ্বংসের হার হবে উৎপাদনের হারের চাইতে বেশি।
মনে করা হয় বিস্ফোরণের সময় মহাবিশ্বের আয়তন ছিল শূন্য সুতরাং উত্তাপ ছিল অসীম। কিন্তু মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকিরণের তাপমাত্রা কমতে থাকে। বৃহৎ বিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর তাপমাত্রা নেমে এসেছিল প্রায় এক হাজার কোটি ডিগ্রীতে। এ তাপ সূর্যের কেন্দ্রের তাপের চাইতে প্রায় এক হাজার গুণ বেশি। কিন্তু হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের সময় উত্তাপ এই মাত্রায় পৌঁছায়। এই অবস্থায় মহাবিশ্বের ভিতরে প্রায় সবটাই থাকত ফোটন, ইলেকট্রন এবং নিউট্রনে (অত্যন্ত হাল্কা কণিকা, এগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে শুধুমাত্র দুর্বল বল এবং মহাকর্ষ) এবং তাদের বিপরীত কণিকা–তাছাড়া থাকে কিছু প্রোটন এবং নিউট্রন। মহাবিশ্ব যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছিল তাপমাত্রা তেমনি কমছিল। সংঘর্ষের ফলে ইলেকট্রন/বিপরীতে ইলেকট্রনের জোড় তৈরির হার– সেগুলো ধ্বংসের হারের অনেক নিচে নেমে আসছিল। সুতরাং অধিকাংশ ইলেকট্রন আর বিপরীত ইলেকট্রন পরস্পরকে ধ্বংস করে আরো ফোটন উৎপন্ন করল– অবশিষ্ট রইল কিছু ইলেকট্রন। নিউট্রনে এবং বিপরীত নিউট্রনে পরস্পরকে ধ্বংস করতে পারল না, কারণ এই কণিকাগুলোর নিজেদের ভিতরে পারস্পরিক ক্রিয়া এবং অন্য কণিকার সঙ্গে ক্রিয়া খুবই দুর্বল। সুতরাং এখনও এগুলোর বর্তমান থাকা উচিত। এগুলোকে যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম তাহলে প্রথম যুগের উত্তপ্ত মহাবিশ্ব পরীক্ষার একটি ভাল সুযোগ পাওয়া যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে তাদের শক্তি এত কম হবে যে তাদের প্রত্যক্ষভাবে পরীক্ষা করা হবে অসম্ভব। ১৯৮১ সালের একটি রুশ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়–এগুলোর সামান্য নিজস্ব ভর রয়েছে। এই পরীক্ষাফল এখন সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। এটা যদি সত্য হয় তাহলে হয়ত পরোক্ষভাবে এর অস্তিত্বের নিদর্শন আমরা পেতে পারি। আগে যেরকম উল্লেখ করা হয়েছে সেরকম আলোকহীন পদার্থ (dark matter) তারা হতে পারে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বন্ধ করা এবং পুনর্বার চুপসে দেয়ার মত পর্যাপ্ত মহাকর্ষীয় আকর্ষণ তাদের থাকতে পারে।
বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রায় একশ সেকেন্ড পর তাপমাত্রা হয়ত একশ কোটি ডিগ্রীতে নেমে এসেছে। সব চাইতে উত্তপ্ত তারকাগুলোর অভ্যন্তরে এই তাপমাত্রা পাওয়া যায়। এই উত্তাপে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় বলের (strong nuclear force) আকর্ষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট শক্তি প্রোটন নিউট্রনের থাকে না–তখন তারা মিলিত হয়ে হয়ত ডুয়েটেরিয়াম (deuterium-ভারি হাইড্রোজেন) গঠন করতে শুরু করতে পারে। এই পরমাণুতে থাকে একটি প্রোটন এবং একটি নিউট্রন। তখন ডুয়েটেরিয়াম কেন্দ্রক হয়ত আরো প্রোটন এবং নিউট্রনের সঙ্গে মিলিত হয়ে হিলিয়াম কেন্দ্ৰক তৈরি করবে। হিলিয়ামে থাকে দুটি প্রোটন আর দুটি নিউট্রন, তাছাড়া হয়ত তৈরি হবে অল্প পরিমাণ অপেক্ষাকৃত ভারি দুটি মৌলিক পদার্থ মিথিয়াম (lithium) এবং বেরিলিয়াম (beryli um) হিসেব করে বলা যায় উত্তপ্ত বৃহৎ বিস্ফোরণ প্রতিরূপে প্রোটন এবং নিউট্রনের প্রায় এক চতুর্থাংশ পরিবর্তিত হবে অল্প পরিমাণ ভারি হাইড্রোজেনে এবং অন্যান্য মৌলিক পদার্থে। অবশিষ্ট নিউট্রনের অবক্ষয়ের ফলে তৈরি হবে প্রোটন। এগুলো সাধারণ হাইড্রোজেনের কেন্দ্রক।
বৈজ্ঞানিক জর্জ গ্যামো (George Gamow) তার একজন ছাত্র র্যালফ অ্যালফারের (Ralph Alpher) সঙ্গে ১৯৪৮ সালে লিখিত একটি বিখ্যাত গবেষণাপত্রে মহাবিশ্বের উত্তপ্ত প্রাথমিক অবস্থার একটি চিত্র প্রকাশ করেন। গ্যামো বেশ রসিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিউক্লীয় বিজ্ঞানী হান্স বেথেকে (Hans Bethe) ওই গবেষণাপত্রের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত করতে রাজি করান। ফলে লেখকদের তালিকা হয় “অ্যালফার, বেথে ও গ্যামো”। এই তিনটি নামের আদ্যক্ষর গ্রীক অক্ষর আলফা, বিটা ও গামার অনুরূপ। মহাবিশ্বের আদি পর্ব সম্পর্কে প্রবন্ধে এই তিনটি অক্ষর বিশেষভাবে উপযুক্ত। এই প্রবন্ধে তারা একটি উল্লেখযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : মহাবিশ্বের আদিপর্বের অতি উত্তপ্ত অবস্থার বিকিরণ (ফোটন রূপে) এখনও থাকা উচিত। তবে তার তাপমাত্রা হ্রাস পেয়ে চরম শূন্যের (-২৭৩ ডিগ্রী) কয়েক ডিগ্রী বেশি হতে পারে। ১৯৬৫ সালে এই বিকিরণই পেঞ্জিয়াস (Penzias) এবং উইলসন (Wilson) আবিষ্কার করেন। অ্যালফার, বেথে এবং গ্যামো যখন তাদের গবেষণাপত্রটি লিখেছিলেন, তখন প্রোটন এবং নিউট্রনের নিউক্লীয় প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে খুব বেশি জানা ছিল না। আদিম মহাবিশ্বে বিভিন্ন মৌলিক উপাদানের অনুপাত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী সেইজন্য খুব নিশ্চিত হয়নি। কিন্তু উন্নততর জ্ঞানের আলোকে এই গণনা আবার করা হয়েছে এবং এখন আমাদের পর্যবেক্ষণফলের সঙ্গে তার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তাছাড়া মহাবিশ্বে এত বেশি পরিমাণে হিলিয়ামের অস্তিত্ব অন্য কোনভাবে ব্যাখ্যা করা খুবই শক্ত। অন্ততপক্ষে বৃহৎ বিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর পর্যন্ত আমাদের চিত্রটি যে নির্ভুল সে বিষয়ে আমাদের মোটামুটি বিশ্বাস রয়েছে।
বৃহৎ বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টার ভিতরেই হিলিয়াম এবং অন্যান্য মৌলিক উপাদানের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তারপর প্রায় দশ লক্ষ বছর পর্যন্ত মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ছাড়া আর বিশেষ কিছু ঘটেনি। শেষে তাপমাত্রা যখন কয়েক হাজার ডিগ্রীতে নেমেছে এবং ইলেকট্রন ও কেন্দ্রগুলোর পারস্পরিক বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় আকর্ষণ অতিক্রম করার মত পর্যাপ্ত শক্তি আর থাকেনি, তখন তাদের মিলিত হয়ে পরমাণু গঠন করার সম্ভাবনা হয়। সম্পূর্ণ মহাবিশ্বই সম্প্রসারিত এবং শীতলতর হতে থাকত কিন্তু যে সমস্ত অঞ্চলের ঘনত্ব গড় ঘনত্বের চাইতে সামান্য বেশি সেই সমস্ত অঞ্চলের অতিরিক্ত মহাকর্ষীয় আকষণের দরুন সম্প্রসারণ ধীরতর হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এইজন্য অবশেষে কোন কোন অঞ্চলে সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে নতুন করে চুপসে যাওয়া শুরু হওয়ার কথা। চুপসে যাওয়ার সময় এই সমস্ত অঞ্চলের বাইরের পদার্থের মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ফলে এগুলোর সামান্য ঘূর্ণন শুরু হতে পারে। চুপসে যাওয়ার ফলে অঞ্চলগুলো যেমন ক্ষুদ্রতর হবে ঘূর্ণনও তত দ্রুত হবে। ব্যাপারটা অনেকটা যারা বরফের উপর স্কেটিং করে তাদের মত হাত দুটি গুটিয়ে নিলে তাদের ঘূর্ণনও দ্রুততর হয়। শেষে অঞ্চলটি যখন যথেষ্ট ক্ষুদ্র হবে তখন মহাকর্ষীয় আকর্ষণের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করার মত পর্যাপ্ত দ্রুতি হবে ঘূর্ণনের। এভাবেই ঘূর্ণায়মান চাকতির মত নীহারীকাগুলোর জন্ম হয়েছে। অন্যান্য যে সমস্ত অঞ্চলে ঘূর্ণন শুরু করতে পারেনি সেগুলো ডিম্বাকৃতি বস্তুপিণ্ডে (oval shaped objects) পরিণত হয়। এগুলোর নাম উপবৃত্তাকার নীহারিকা। এগুলোতে অঞ্চলটির চুপসে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু নীহারিকার অংশগুলো কেন্দ্রকে স্থির গতিতে প্রদক্ষিণ করবে তবে সম্পূর্ণ নীহারিকাটির কোন চক্রাকার গতি থাকবে না।
কালের গতির সঙ্গে নীহারিকাগুলোর হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাস ক্ষুদ্রতর মেঘ খণ্ডে ভেঙে যাবে এবং সেগুলো নিজেদের মহাকর্ষের চাপে চুপসে যেতে থাকবে। এগুলোর সঙ্কোচন এবং ভিতরকার পরমাণুগুলোর পরস্পর সংঘর্ষের ফলে গ্যাসের তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। শেষে যথেষ্ট উত্তপ্ত হলে কেন্দ্রীয় সংযোজন অভিক্রিয়া (neuclear fusion reaction) শুরু হয়ে যাবে। এর ফলে হাইড্রোজেনগুলো আরো হিলিয়ামে পরিণত হবে। এর দরুন যে উত্তাপ সৃষ্টি হবে তার ফলে চাপ বৃদ্ধি পাবে এবং সেজন্য মেঘগুলোর অধিকতর সঙ্কোচন বন্ধ হয়ে যাবে। এগুলো স্থির অবস্থায় বহুকাল পর্যন্ত আমাদের সূর্যের মত তারকা হয়ে থাকতে পারে তারা হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম তৈরি করে এবং তার ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় সেটা আলোক ও তাপ রূপে বিকিরণ করে। আরও বৃহৎ তারকাগুলোর নিজেদের বৃহত্তর মহাকর্ষণীয় আকর্ষণের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্য উত্তপ্ত হতে হয়, ফলে কেন্দ্রীয় সংযোজন প্রক্রিয়া এত দ্রুত হতে থাকে যে মাত্র দশ কোটি বছরেই তাদের হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যায়। তখন তাদের সামান্য সঙ্কোচন হয় এবং তাদের উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিলিয়াম, অক্সিজেন এবং অঙ্গারের carbon-কার্বন) মত আরো ভারি মৌলিক পদার্থে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। কিন্তু তার ফলে খুব বশি শক্তি মুক্ত হয় না, সুতরাং একটা সঙ্কট ঘনিয়ে আসে। কৃষ্ণগহ্বরের অধ্যায়ে এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তারপর কি ঘটে সেটা সম্পূর্ণ বোঝা যায় না, কিন্তু মনে হয় তারকাটির কেন্দ্রীয় অঞ্চল চুপসে নিউটন তারকা কিম্বা কৃষ্ণগহ্বরের মত খুব ঘন অবস্থায় পৌঁছায়। তারকাটির বাইরের অঞ্চল অনেক সময় বিরাট এক বিস্ফোরণের ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে যায়। এর নাম সুপারনোভা (supernova)। নীহারিকাটির সমস্ত তারকার তুলনায় এটা হয় সবচাইতে উজ্জ্বল। তারকার জীবনকালের শেষ দিকে উৎপন্ন কিছু কিছু ভারি মৌলিক পদার্থ নীহারিকার বায়ুর (gas) ভিতরে নিক্ষিপ্ত হয়। এগুলো পরিণত হয় পরের প্রজন্মের তারকাদের ব্যবহৃত কাঁচামালের একটি অংশে আমাদের সূর্য দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় প্রজন্মের তারকা। অতীতের সুপারনোভার ধ্বংসাবশেষেযুক্ত ঘূর্ণায়মান বায়বীয় পদার্থের মেঘ থেকে প্রায় পাঁচশ কোটি বছর আগে আমাদের সূর্য গঠিত হয়েছে। সেজন্য আমাদের সূর্যে অধিকতর ভারি মৌলিক পদার্থের অনুপাত প্রায় শতকরা দুই ভাগ। ঐ বায়বীয় পদার্থের অধিকাংশই লেগেছে সূর্যকে তৈরি করতে আর বাকিটা উড়ে বেরিয়ে গেছে। অবশিষ্ট্য অল্প পরিমাণ কিছু ভারি মৌলিক পদার্থ সংযুক্ত হয়ে কতকগুলো বস্তুপিণ্ড তৈরি হয়েছে। সেগুলোই এখন গ্রহ হয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবীর ঐরকম একটি গ্রহ।
শুরুতে পৃথিবী ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। পৃথিবীর কোন বায়ুমণ্ডল (atmosphere) ছিল না। কালে কালে পৃথিবী শীতল হল এবং বিভিন্ন প্রস্তর থেকে নির্গত হওয়া বায়বীয় পদার্থের সাহায্যে নিজস্ব বায়ুমণ্ডল গঠন করল। এই আদিম বায়ুমণ্ডল আমাদের জীবনধারনের উপযুক্ত ছিল না। সে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ছিল না কিন্তু মানুষের পক্ষে বিষাক্ত অনেক বায়ু ছিল। উদাহরণ : হাইড্রোজেন সালফাইড (পচা ডিমের গন্ধ হয় এই গ্যাসের জন্য)। কিন্তু অন্য কয়েক রকম আদিম জীব আছে যেগুলো এই পরিবেশে বৃদ্ধি পেতে পারে। সম্ভবত এগুলো প্রথম বিকাশ লাভ করেছিল মহাসমুদ্রে। বোধ হয় কতকগুলো পরমাণুর আকস্মিক সমন্বয়ে কয়েকটি বৃহত্তর অবয়ব সৃষ্টি হয়েছিল। সেগুলোর নাম স্কুল অণু (macromolecule)। এগুলো মহাসমুদ্রে থেকে অন্যান্য : পরমাণু সংগ্রহ করে সমরূপ অবয়ব গঠন করতে পারত। সুতরাং এইভাবে তারা বংশবৃদ্ধি এবং বংশরক্ষা করতে পারত। কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তান সৃষ্টিতে ভুল হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুলটা এমন হত যে নতুন স্কুল অণুগুলো নিজেদের বংশরক্ষা করতে অক্ষম হত এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু দুয়েকটি এমন ভুল হত, যার ফলে যে নতুন স্কুল অণু সৃষ্টি হত সেগুলো বংশরক্ষা এবং বংশবৃদ্ধিতে আরও বেশি পটু। সুতরাং তাদের অবস্থা হত আর একটু সুবিধাজনক এবং আদিম স্কুল অণুগুলোর পরিবর্তে নিজেদের প্রতিস্থাপন করার (replace) সম্ভাবনা থাকত। এভাবেই একটি বিবর্তনের ধারা শুরু হয়। তার ফলে ক্রমশ আরো জটিল থেকে জটিলতর আত্মজ সৃষ্টি করতে সক্ষম জীব বিকাশ লাভ করল। নানা পদার্থ আদিম জীবের ভক্ষ্য ছিল– হাইড্রোজেন সালফাইড সেগুলোর ভিতর একটি। এরা অক্সিজেন পরিত্যগ করত। এভাবে ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডল পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক অবস্থায় পৌঁছেছে। এর ফলে উচ্চতর জীবের বিকাশ সম্ভব হয়েছে, যেমন–মাছ, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী জীব এবং পরিশেষে মানবজাতি।
অত্যন্ত উত্তপ্ত অবস্থা থেকে প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে শীতলতর হয়েছে : মহাবিশ্বের এই চিত্রের সঙ্গে পর্যবেক্ষণজাত আধুনিক সমস্ত সাক্ষ্যের মিল রয়েছে। তবুও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় নি।
(১) আদিম মহাবিশ্ব কেন অত উত্তপ্ত ছিল?
(২) বৃহৎ মানে (large scale) বিচার করলে মহাবিশ্ব এরকম সমরূপ কেন?
স্থানের সমস্ত বিন্দু থেকে বিভিন্ন অভিমুখে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখায় কেন?
বিশেষ করে বিভিন্ন দিকে পর্যবেক্ষণ করলে পশ্চাৎপটের মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের তাপমাত্রা প্রায় একই রকম কেন? ব্যাপারটা অনেকটা পরীক্ষার সময় অনেকগুলো ছাত্রকে একটি প্রশ্ন করার মত। সবাই যদি একই রকম উত্তর করে তা হলে আপনি মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারেন যে ওদের নিজেদের ভিতর যোগাযোগ ছিল। আদিম মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল কাছাকাছি ছিল কিন্তু উপরে বর্ণিত প্রতিরূপ অনুসারে বৃহৎ বিস্ফোরণের পর আলোকের এক অঞ্চল থেকে দূরস্থিত অন্য অঞ্চলে যাওয়ার সময় ছিল না। অপেক্ষবাদ অনুসারে যদি এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে আলোক না যেতে পারে তাহলে কোন সংবাদই যেতে পারে না। সুতরাং ব্যাখ্যার অতীত কোন কারণ যদি একই তাপমাত্রা থেকে শুরু না হয়ে থাকে তাহলে মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের একই তাপমাত্রা হওয়ার কোন কারণ দেখা যায় না।
(৩) মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হারের যে বিভিন্ন প্রতিরূপ রয়েছে তার কয়েকটিতে মহাবিশ্বের আবার চুপসে যাওয়ার কথা আর অন্য কয়েকটি প্রতিরূপে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতেই থাকবে। এই হারকে বলা হয় ক্রান্তিক হার (critical rate)। সম্প্রসারণের এই ক্রান্তিক হার কেন হল যার জন্য এক হাজার কোটি বছর পরও মহাবিশ্ব প্রায় একই হারে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে? বৃহৎ বিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর যদি সম্প্রসারণের হার এক লক্ষ মিলিয়ন মিলিয়ান (১০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০) ভাগও কম হত তাহলে মহাবিশ্ব বর্তমান আয়তনে পৌঁছানোর আগেই চুপসে যেত।
(৪) বৃহৎ মানে (large scale) বিচার করলে দেখা যায় মহাবিশ্ব খুবই সমরূপ (uniform) এবং সমসত্বসম্পন্ন (homogeneous)। তা সত্ত্বেও স্থানিক অনিয়ম রয়েছে, যেমন– তারকা, নীহারিকা ইত্যাদি। মনে হয় আদিম মহাবিশ্বে ঘনত্ব সামান্য আঞ্চলিক পার্থক্যের জন্যই এগুলো সৃষ্ট হয়েছে। ঘনত্বের এই হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ কি ছিল?
ব্যাপক অপেক্ষবাদ স্বতত এই সমস্ত অবয়ব ব্যাখ্যা করতে পারে না কিম্বা এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারে না। তার কারণ, এই তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মহাবিশ্ব বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতার সময় শুরু হয়েছিল অসীম ঘনত্ব দিয়ে। এই অনন্যতার ক্ষেত্রে ব্যাপক অপেক্ষবাদ এবং অন্যান্য ভৌত বিধিগুলো ভেঙ্গে পড়বে : এই অনন্যতার ফলশ্রুতি কি হবে সে সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে না। এর আগে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বৃহৎ বিস্ফোরণ কিম্বা তার আগেরকার যে কোন ঘটনা এই তত্ত্ব থেকে বাদ দেয়া চলে। তার কারণ, আমাদের পর্যবেক্ষণফলের উপর সেগুলোর কোন প্রভাব থাকা হসম্ভব নয়। স্থান-কালের একটি সীমানা থাকবে। বৃহৎ বিস্ফোরণে তার শুরু।
মনে হয় বিজ্ঞান কয়েকটি বিধির গুচ্ছ আবিষ্কার করেছে। আমরা যদি যে কোন কালে মহাবিশ্বের অবস্থা জানতে পারি তাহলে এই বিধিগুলোর সাহায্যে কালের সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ বিকাশ সম্পর্কে বলা সম্ভব। অবশ্য এই ক্ষমতা অনিশ্চয়তার নীতির দ্বারা সীমিত। শুরুতে এগুলো ঈশ্বরের বিধান হতে পারে কিন্তু মনে হয় তারপর থেকে তিনি মহাবিশ্বকে ওই বিধিগুলো অনুসারে বিবর্তিত হওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং তিনি আর ও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন না। কিন্তু তিনি কিভাবে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা কিম্বা গঠন নির্বাচন করেছিলেন? কালের শুরুতে “সীমান্তের গঠন” (boundary condi tion) কি রকম ছিল?
একটি সম্ভাব্য উত্তর হল : ঈশ্বর কেন মহাবিশ্বের এই প্রাথমিক গঠন বেছে নিয়েছিলেন আমাদের সেটা বোঝার আশা নেই। সর্বশক্তিমান কোন জীবের পক্ষে নিশ্চয়ই এই সম্ভব ছিল কিন্তু কেন তিনি ব্যাপারটা এমনভাবে শুরু করলেন যা কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয়, আবার কেনই বা তিনি এমন বিধি অনুসারে এর বিবর্তনের স্বাধীনতা দিলেন যা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব? বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ ইতিহাস হল ধীরে ধীরে এই বোধ জাগ্রত হওয়া যে ঘটনাগুলো যাচ্ছিকভাবে ঘটে না, সেগুলো অন্তনিহিত একটি নিয়মের প্রতিফলন। সে নিয়মগুলো ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে আবার নাও সৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে তার অনুপ্রেরণায়। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যেতে পারে, এ নিয়ম শুধু বিধিগুলো সম্পর্কেই প্রযোজ্য নয়। মহাবিশ্বের আদিম অবস্থার বৈশিষ্ট্য যে স্থান-কাল, তার সীমান্তের অবস্থা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার অনেকগুলো প্রতিরূপ থাকতে পারে এবং সবগুলো প্রতিরূপই বিধি মেনে চলতে পারে। একটি প্রাথমিক অবস্থা বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে একটি নীতি থাকা উচিত সুতরাং থাকা উচিত একটি প্রতিরূপ যা আমাদের মহাবিশ্বের প্রতীক একটি সম্ভাবনার নাম সীমানার শৃঙ্খলাহীন অবস্থা (chaotic boundary conditions)। এগুলোর ভিতরে এই অনুমান নিহিত রয়েছে যে মহাবিশ্ব হয় স্থানিকভাবে অসীম নয়ত অনন্তসংখ্যক মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে। বৃহৎ বিস্ফোরণের ঠিক পর পর বিশৃঙ্খল সীমান্ত অবস্থায় মহাবিশ্বের একটি বিশেষ আকারে (configuration) স্থানের একটি বিশেষ অঞ্চল খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা এবং কোন কোন অর্থে অন্য যে কোন আকারপ্রাপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা একই : মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা নির্বাচিত হয়েছে সম্পূর্ণ লক্ষ্যহীনভাবে (random)। এর অর্থ আদিম মহাবিশ্ব ছিল সম্ভবত অত্যন্ত বিশৃঙ্খল এবং নিয়মবিহীন অবস্থায়। তার কারণ মহাবিশ্ব সাপেক্ষ নিয়মবদ্ধ এবং মসৃণ আকারের তুলনায় বিশৃঙ্খল এবং নিয়মবিহীন আকারের সংখ্যা অনেক বেশি। (প্রতিটি আকারের সম্ভাবনা যদি একই রকম হয় তাহলে হয়ত মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল বিশৃঙ্খল এবং নিয়মবিহীন অবস্থায়, তার সহজ সরল কারণ হল: এরকম সম্ভাব্য আকারের সংখ্যা বেশি)। এরকম বিশৃঙ্খল প্রাথমিক অবস্থা থেকে আমাদের বর্তমান মহাবিশ্ব কি করে সৃষ্ট হল সেটা বোঝা কঠিন, কারণ বৃহৎ মানে (large scale) বিচার করলে দেখা যায় আমাদের আজকের মহাবিশ্ব মসৃণ এবং নিয়মবদ্ধ (regular)। গামা রশ্মি পর্যবেক্ষণ থেকে যে উচ্চতর সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তার চাইতে অনেক বেশি সংখ্যক আদিম কষ্ণগহ্বর গঠিত হওয়া উচিত ছিল ঐ প্রতিরূপে ঘনত্বের যে হ্রাস-বৃদ্ধি আশা করা যায় তার ভিত্তিতে।
মহাবিশ্ব যদি সত্যিই স্থানিকভাবে অসীম হয় কিম্বা মহাবিশ্বগুলোর সংখ্যা যদি অনন্ত হয় তাহলে সম্ভবত কোন স্থানে এমন কতকগুলো বৃহৎ অঞ্চল থাকবে যেগুলো হয়েছিল মসৃণ সমরূপভাবে। ব্যাপারটি অনেকটা সেই বহু পরিচিত বাদরের বিরাট দলের মত । তারা টাইপরাইটারে আঙুল ঠুকে চলেছে– যা ছাপা হচ্ছে তার বেশির ভাগটাই ভুষিমাল কিন্তু দৈবাৎ তারা শেক্সপিয়রের একটি সনেটও টাইপ করে ফেলতে পারে। তেমনিভাবে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে এমন কি হতে পারে যে আমরা এমন একটি অঞ্চলে রয়েছি যেটা ঘটনাচক্রে মসৃণ এবং নিয়মবদ্ধ? আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুবই অসম্ভব বলে মনে হতে পারে কারণ ওই রকম মসৃণ অঞ্চলের চাইতে বিশৃঙ্খল এবং নিয়মবিহীন অঞ্চলের সংখ্যা হবে অনেক বেশি। কিন্তু যদি অনুমান করা যায় মসৃণ অঞ্চলগুলোতেই নীহারিকা এবং তারকা গঠিত হয়েছে এবং এই সমস্ত অঞ্চলে আমাদের মত আত্মজ (self replicat ing) সৃষ্টি করতে সক্ষম জটিল জীব বিকাশের মত সঠিক পরিস্থিতি রয়েছে এবং এই জীবরাই প্রশ্ন করতে সক্ষম : মহাবিশ্ব এরকম মসৃণ কেন? এটা হল যাকে নরত্বীয় নীতি (anthropic principle) বলে তার প্রয়োগের একটি উদাহরণ। একেই অন্য বাগ্বিধিতে প্রকাশ করা যায়– “মহাবিশ্ব যেমন রয়েছে আমরা সেভাবে দেখতে পাই তার কারণ আমাদের অস্তিত্ব রয়েছে।”
নরত্বীয় নীতির দুরকম প্রকাশ রয়েছে দুর্বল এবং সবল। দুর্বল নরত্বীয় নীতির বক্তব্য মহাবিশ্ব যদি স্থানে এবং কালে বৃহৎ কিম্বা/এবং (and/or) অসীম হয় তাহলে বুদ্ধিমান জীবের বিকাশের পক্ষে প্রয়োজনীয় অবস্থা শুধুমাত্র কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলেই পাওয়া সম্ভব এবং সেই অঞ্চলগুলো স্থানে এবং কালে সীমিত। সুতরাং বুদ্ধিমান জীবরা যদি দেখতে পান যে মহাবিশ্বে শুধুমাত্র তাদের নিজেদের অস্তিত্ব সম্ভব করার মত অবস্থা রয়েছে তাহলে তাদের বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। ব্যাপারটা অনেকটা ধনী লোকের ধনী অঞ্চলে বসবাস করে কোন দারিদ্র দেখতে না পাওয়ার মত।
দুর্বল নরত্বীয় নীতির প্রয়োজনীয়তার একটি উদাহরণ–বৃহৎ বিস্ফোরণ কোন এক হাজার কোটি বছর আগে হয়েছিল সেই প্রশ্নের এই উত্তর : বিবর্তনে বুদ্ধিমান জীব সৃষ্টির জন্য প্রায় ঐরকম সময়ই লাগে। এর আগে ব্যাখ্যা করা হয়েছে : প্রথমে প্রয়োজন ছিল পূর্ব প্রজন্মের একটি তারকা গঠন করা। এই তারকাগুলো আদি হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের কিছু অংশকে কার্বন (অঙ্গার) এবং অক্সিজেনের (অম্লজানের) মত পরমাণুতে পরিণত করে। এই পরমাণুগুলো দিয়েই আমরা তৈরি। এরপর তারকাগুলোতে বিস্ফোরণ হয়ে সুপারনোভা (supernovas) সৃষ্টি হয়েছে। তাদের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে তৈরি হয়েছে অন্যান্য তারকা এবং গ্রহ। তার ভিতরে রয়েছে আমাদের সৌরজগৎ। এর বয়স পাঁচশ কোটি বছর। পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রথম একশ কিম্বা দুশো কোটি বছর পৃথিবী এত উত্তপ্ত ছিল যে জটিল কিছু সৃষ্টি হওয়া সম্ভব ছিল না। বাকি প্রায় তিনশ কোটি বছর কেটেছে ধীর গতিতে জৈব বিবর্তন নিয়ে। এর শুরু হয়েছে সরলতম জীব দিয়ে এবং এমন জীব সৃষ্টি পর্যন্ত পৌঁছেছে যারা বৃহৎ বিস্ফোরণ পর্যন্ত অতীত কাল মাপতে পারে।
দুর্বল নরত্বীয় নীতির সভ্রতা কিম্বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে খুব কম লোকই প্রশ্ন করবে। কিছু লোক কিন্তু আরো অনেকটা অগ্রসর হয়ে এই নীতির একটি সরল রূপ প্রস্তাব করেছেন। এই তত্ত্ব অনুসারে হয় ভিন্ন ভিন্ন বহু মহাবিশ্ব রয়েছে, নয়ত একই মহাবিশ্বের রয়েছে নানা অঞ্চল এবং তাদের প্রাথমিক আকারও configuration) নিজস্ব। তাদের নিজস্ব বৈজ্ঞানিক বিধির গুচ্ছও রয়েছে। এই সমস্ত মহাবিশ্বের অধিকাংশেই জটিল জীবের বিকাশের উপযুক্ত সঠিক অবস্থা নেই। শুধুমাত্র আমাদের মহাবিশ্বের মত কয়েকটি মহাবিশ্বের বুদ্ধিমান জীব বিকশিত হতে পারে এবং প্রশ্ন করতে পারে– “আমরা যেমন দেখছি মহাবিশ্ব সেরকম হল কেন?” উত্তরটা খুব সহজ– “মহাবিশ্ব অন্যরকম হলে আমরা এখানে থাকতাম না।”
বর্তমানে জ্ঞান বৈজ্ঞানিক বিধিগুলোতে কয়েকটি মূলগত সংখ্যা আছে। যেমন– ইলেকট্রনের বৈদুতিক আধানের আয়তন (size) এবং প্রোটন আর ইলেকট্রনের ভরের অনুপাত। তত্ত্বের সাহায্যে আমরা এই সংখ্যাগুলো বলতে পারি না। অন্তত এই মুহূর্তে পারি না। এই সংখ্যাগুলো পেতে হবে পর্যবেক্ষণের সাহায্যে। হতে পারে কোন একদিন আমরা একটি সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কার করব এবং সে তত্ত্বগুলো সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে কিন্তু এও সম্ভব হতে পারে যে এগুলোর কিছু কিছু কিম্বা সবগুলোই মহাবিশ্ব থেকে অন্য মহাবিশ্বে পৃথক হবে কিম্বা একই মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক হবে। একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার : মনে হয় এই সংখ্যাগুলোর মান এমন সূক্ষ্মভাবে বিন্যস্ত (adjusted) করা হয়েছে যাতে জীবনের বিকাশ সম্ভব হয়। উদাহরণ : যদি ইলেকট্রনের আধান সামান্য পৃথক হত তাহলে তারকাগুলো হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম পোড়াতে পারত না কিম্বা তাদের বিস্ফোরণ হত না। অন্য ধরনের বুদ্ধিমান জীব অবশ্যই থাকতে পারে, এমন জীব যাদের কথা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকরাও ভাবতে পারেন নি। তাদের হয়ত আমাদের সূর্যের মত তারকার আলো প্রয়োজন হয় না । প্রয়োজন হয় না যে গুরুভার রাসায়নিক মৌলিক পদার্থগুলো তারকার ভিতরে তৈরি হয় এবং তারকা বিস্ফোরণের সময় স্থানে নিক্ষিপ্ত হয় সেরকম কিছুই। তবুও মনে হয় সংখ্যার মানের অল্পসংখ্যাক বিন্যাসই (range) যে কোন প্রকার বুদ্ধিমান জীব বিকাশ অনুমোদন করত। মূল্যমানের অধিকাংশ গুচ্ছই মহাবিশ্বের জন্ম দিতে পারত, সে মহাবিশ্ব খুবই সুন্দর হলেও সে সৌন্দর্য দেখে অবাক হওয়ার কেউ থাকত না। এই তথ্যকে সৃষ্টির ব্যাপারে এবং বৈজ্ঞানিক বিধি নির্বাচনের ব্যাপারে ঐশ্বরিক উদ্দেশ্যের সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে কিম্বা গ্রহণ করা যেতে পারে সকল নরত্বীয় তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে।
মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণ করা অবস্থার ব্যাখ্যা হিসেবে সবল নরত্বীয় নীতিকে উপস্থাপনের বিরুদ্ধে কয়েকটি আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে। প্রথমত, বিভিন্ন মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কথা কি অর্থে বলা যায়? তারা যদি সত্যিই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে তাহলে অন্য মহাবিশ্বে যা ঘটছে আমাদের মহাবিশ্বে তার কোন পর্যবেক্ষণযোগ্য ফল থাকতে পারে না। সুতরাং আমাদের উচিত মিতব্যয়িতার নীতি ব্যবহার করে ঐ মহাবিশ্বগুলোকে তত্ত্ব থেকে বাদ দেয়া। অন্যদিকে তারা যদি একই মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল হয় তাহলে বিজ্ঞানের বিধি প্রত্যেক অঞ্চলেই অভিন্ন হওয়া উচিত, কারণ তাছাড়া এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে অবিচ্ছিন্নভাবে যাতায়াত সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে অঞ্চলগুলোর ভিতর একমাত্র পার্থক্য হবে তাদের প্রাথমিক আকারে সুতরাং সবল নরতীয় নীতি পরিণত হবে দুর্বল নরত্নীয় নীতিতে।
সবল নরত্বীয় নীতির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আপত্তি হল : এ নীতি বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ ইতিহাসের স্রোতের বিরুদ্ধে। আমরা বিকাশ লাভ করছি টোলেমী এবং তার পূর্বগামীদের পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব তত্ত্ব থেকে, কোপারনিকাস এবং গ্যালিলিওর সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব তত্ত্বের ভিতর দিয়ে আধুনিক মহাবিশ্ব চিত্রে। এ চিত্রে পৃথিবী একটি সাধারণ সর্পিল (spiral) নীহারিকার প্রান্তিক অঞ্চলে অবস্থিত একটি সাধারণ তারকাকে প্রদক্ষিণরত মাঝারি আকারের গ্রহ। এই নীহারিকাটি পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের এক লক্ষ্য কোটি নীহারিকার ভিতরে একটি। তবুও সবল নরত্বীয় নীতির দাবি এই বিরাট সংগঠনের অস্তিত্ব শুধু আমাদের জন্যই। এটা বিশ্বাস করা খুবই শক্ত। আমাদের সৌরজগৎ নিশ্চয়ই আমাদের অস্তিত্বের একটি পূর্ব শর্ত এবং পূর্ব প্রজন্মের যে তারকাগুলো ভারি মৌলিক পদার্থগুলো তৈরি করেছিল সেগুলোও প্রয়োজন ছিল। সেজন্য এই পূর্ব শর্ত আমাদের নীহারিকা অবধি আমরা বিস্তার করতে পারি। কিন্তু অন্য নীহারিকাগুলোর কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না কিম্বা মনে হয় না এই মহাবিশ্বের প্রতিটি অভিমুখেই এমন সুষম এবং সমরূপ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে।
যদি দেখানো যেত যে, আমরা যে মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছি সেটা সৃষ্টি করার জন্য বিবর্তনে বেশ কয়েক রকম প্রাথমিক আকারের মহাবিশ্ব সৃষ্ট হয়েছিল, তাহলে নরত্বীয় নীতি (অন্ততপক্ষে তার দুর্বল রূপটিকে) মেনে নেয়া সহজতর হত। ব্যাপারটি যদি তাই হয় তাহলে, যে মহাবিশ্বের বিবর্তন হয়েছে প্রাথমিক একটি এলোমেলো অবস্থা থেকে, সে ক্ষেত্রে সেখানে এমন কিছু অঞ্চল থাকা উচিত ছিল যেগুলো মসৃণ আর সমরূপ এবং বিবর্তনের ধারায় বুদ্ধিমান জীব সৃষ্টির উপযুক্ত। আবার অন্যপক্ষে বলা যায়, আমরা আমাদের চারদিকে যা দেখেছি সেই রকম একটাকিছু সৃষ্টি করার জন্য যদি অত্যন্ত সতর্কভাবে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা নির্বাচন করা হত, তাহলে সে মহাবিশ্বে জীবের আবির্ভাব হতে পারে এরকম কোন অঞ্চলের অস্তিত্বের সম্ভাবনা থাকত খুবই কম। এর আগে যে উত্তপ্ত বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রতিরূপ দেয়া হয়েছে সেরকম ক্ষেত্রে আদিম মহাবিশ্বে উত্তাপের স্রোতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সময় থাকত না। এর অর্থ : আমরা যে দিকে তাকাই সর্বত্র মাইক্রোতরঙ্গের তাপমাত্রা একই রকম–এই তথ্য ব্যাখ্যা করতে হলে বলতে হয় আদিম অবস্থায় মহাবিশ্বের সর্বত্রই নিখুঁতভাবে একই তাপমাত্রা ছিল। মহাবিশ্বের আবার চুপসে যাওয়া এড়ানোর জন্য সম্প্রসারণের যে ক্রান্তিক (critical) হার প্রয়োজন, বাস্তবে সম্প্রসারণের হার এখনও তার এত কাছাকাছি যে সম্প্রসারণের প্রাথমিক হার খুবই নিখুঁতভাবে নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল। এর অর্থ হল উত্তপ্ত বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রতিরূপ যদি কালের আরম্ভ থেকেই সত্য হয় তাহলে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা খুবই সতর্কভাবে বেছে নেয়া হয়েছিল। মহাবিশ্ব কেন এভাবে শুরু হয়েছিল এ তথ্য ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে একজন ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করার ইচ্ছায় এভাবে কাজ করেছিলেন।
ম্যাসাচুসেটস্ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বৈজ্ঞানিক অ্যালান গুথ (Alan Guth) এর চেষ্টা ছিল মহাবিশ্বের এমন একটি প্রতিরূপ অন্বেষণ করা যে প্রতিরূপে বহু প্রাথমিক আকার বিবর্তনের ফলে আধুনিক মহাবিশ্বের মত একটি জিনিস সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ইঙ্গিত করেছেন আদিম মহাবিশ্ব হয়ত একটি অতি সম্প্রসারণ কালের ভিতর দিয়ে গেছে। এই সম্প্রসারণকে বলা হয় “অতিস্ফীতি” (inflation)। কথাটির অর্থ হল : এখন যে রকম সম্প্রসারণের হার হ্রাস পাচ্ছে এক সময় সে রকম না হয়ে সম্প্রসারণের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গুথের মতে, এক সেকেন্ডের সামান্য ভগ্নাংশ কালের ভিতরে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান (একের পিঠে ত্রিশটি শূন্য) গুণ বেড়েছে।
গুথের প্রস্তাবনা অনুসারে বৃহৎ বিস্ফোরণের পর মহাবিশ্বে শুরু অত্যন্ত উত্তপ্ত কিন্তু বিশৃঙ্খল chaotic) অবস্থায়। এই উচ্চ তাপমাত্রার অর্থ হত : মহাবিশ্বের কণাগুলো ছিল অতি দ্রুতগতি, তাদের ভিতরে শক্তি ছিল বেশি। এর আগে আলোচনা করা হয়েছে এরকম উচ্চ তাপমাত্রায় সবল কেন্দ্রীয় বল (strong neuclear force), দুর্বল কেন্দ্রীয় বল (weak neuclear force) এবং বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল একীভূত হয়ে একটি বলে পরিণত হয়। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতলতর হবে এবং কণাগুলোর শক্তিও হ্রাস পাবে। শেষে একটি অবস্থা হবে, তার নাম দশার রূপান্তর (phase transition)। এ অবস্থায় বলগুলোর ভিতরকার সামঞ্জস্য (symmetry) ভেঙে যাবে। সবল বল বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল এবং দুর্বল বল থেকে পৃথক হয়ে যাবে। দশার রূপান্তরের একটি সাধারণ উদাহরণ হল : জল ঠাণ্ডা হলে জমে যাওয়া। তরল জল প্রতিসম (summetrical) প্রতিটি বিন্দুতে প্রতিটি অভিমুখেই একরূপ। কিন্তু বরফের ক্রিস্টাল গঠিত হলে তারা কোন একটি অভিমুখে শ্রেণীবদ্ধ হয়। এর ফলে জলের প্রতিসম অবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।
সাবধান হলে জলকে অতি শীতল (super cool করা সম্ভব। অর্থাৎ তাপমাত্রাকে হিমাঙ্কের (0 ডিগ্যসে) নিচে নিয়ে আসা কিন্তু বরফ জমতে না দেয়া। গুথের প্রস্তাবনা ছিল মহাবিশ্বও একই রকম আচরণ করতে পারে অর্থাৎ তাপমাত্রা ক্রান্তিক মানের নিচে নামলেও বলগুলোর ভিতরকার সামঞ্জস্য (summetry প্রতিসম অবস্থা) না ভাঙতে পারে। এরকম হলে মহাবিশ্ব সুস্থিত (stable) অবস্থায় থাকবে না এবং প্রতিসম অবস্থা ভেঙে পড়লে যা থাকত তার চাইতে বেশি শক্তি থাকবে। দেখানো যেতে পারে এই বিশেষ বাড়তি শক্তির একটি মহাকর্ষ বিরোধী ক্রিয়া থাকে। আইনস্টাইন যখন মহাবিশ্বের একটি সুস্থিত প্রতিরূপ (static model) গঠন করতে চেষ্টা করেছিলেন তখন তিনি ব্যাপক অপেক্ষাবাদে একটি সৃষ্টি তত্ত্ব বিষয়ক ধ্রুবক (cosmological constant মহাজাগতিক ধ্রুবক) উপস্থিত করেছিলেন। উপরে লিখিত মহাকর্ষবিরোধী অভিক্রিয়ার আচরণ হতে পারে ঠিক ঐ ধ্রুবকের মত। উত্তপ্ত বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রতিরূপের মত মহাবিশ্বের প্রসারণ আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, সুতরাং সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক ধ্রুবকের বিকর্ষণী ক্রিয়ার ফলে মহাবিশ্ব ক্রমবর্ধমান হারে প্রসারিত হতে থাকত। এমন কি সেসমস্ত অঞ্চলে পদার্থ কণিকার পরিমাণ গড় পরিমাণের চাইতে বেশি সেখানেও পদার্থের আকর্ষণ সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক ধ্রুবকের কার্যকর বিকর্ষণের চাইতে কম। সুতরাং এই অঞ্চলগুলো একটি ত্বরিত স্ফীতির (accelerated inflationary manner) মত প্রসারিত হত। সম্প্রসারিত হওয়া এবং পদার্থ কণিকাগুলোর পরস্পর থেকে দূরতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটি প্রসারমান মহাবিশ্ব পাওয়া যেত যেখানে পদার্থ কণিকা প্রায় নেই বললেই চলে এবং যে মহাবিশ্ব তখনও অতি শীতল (super cooled) অবস্থায়। ঠিক যেমন একটি বেলুন ফোলালে তার ভাঁজগুলো মসৃণ হয়ে যায় ঠিক তেমনি সম্প্রসারণের ফলে মহাবিশ্বের বর্তমান মসৃণ এবং সমরূপ অবস্থা নানা ধরনের অমসৃণ প্রাথমিক অবস্থা থেকে বিবর্তিত হতে পারে।
যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ পদার্থের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ দ্বারা মন্দীভূত না হয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক ধ্রুবকের দ্বারা ত্বরিত হয়েছে সেই মহাবিশ্বের আদিম অবস্থায় আলোকের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়ার মত পর্যাপ্ত সময় থাকবে। এর আগে একটি সমস্যার উল্লেখ করা হয়েছিল : আদিম মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের একই ধর্ম কেন? উল্লিখিত তথ্য সে সমস্যার একটি সমাধান দেখাতে পারে। তাছাড়াও মহাবিশ্বের শক্তির ঘনত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে সম্প্রসারণের হার স্বতত ক্রান্তিক হারের খুব নিকটে চলে আসবে। সম্প্রসারণের হার ক্রান্তিক হারের এত নিকটে কেন তারও একটি ব্যাখ্যা এ তথ্য থেকে পাওয়া যেতে পারে। তার জন্য এ অনুমানের প্রয়োজন নেই যে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার খুব সতর্কতার সঙ্গে বেছে নেয়া হয়েছিল।
অতিস্ফীতি (inflation) সম্পর্কীয় ধারণা দিয়ে মহাবিশ্বে অত বেশি পরিমাণ পদার্থের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মহাবিশ্বে যে অঞ্চল আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি সে অঞ্চলে প্রায় দশ মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান, মিলিয়ান (একের পিঠে পঁচাশিটা শূন্য) কণিকা রয়েছে। এগুলো এল কোত্থেকে? এর উত্তর : কণাবাদীতত্ত্ব (কোয়ান্টাম তত্ত্ব) অনুসারে শক্তি থেকে কণিকা/বিপরীত কণিকার জোড়া রূপে কণিকা তৈরি হতে পারে। কিন্তু তারপরেই প্রশ্ন আসে শক্তি কোত্থেকে এল? উত্তর হল : মহাবিশ্বে মোট শক্তির পরিমাণ ঠিক শূন্য। মহাবিশ্বের পদার্থ সৃষ্টি হয় পরা (positive) শক্তি থেকে। কিন্তু পদার্থ মহাকর্ষের সাহায্যে নিজেকে সম্পূর্ণ আকর্ষণ করছে। দুটি বস্তুখও যদি কাছাকাছি থাকে তাহলে তাদের শক্তির পরিমাণ তারা যদি বহু দূরে থাকে তাহলে তাদের শক্তির পরিমাণের চাইতে কম। তার কারণ, যে মহাকর্ষীয় বল তাদের পরস্পরের নিকটে টানছে তার বিরুদ্ধে বস্তুখণ্ড দুটিকে বিচ্ছিন্ন করতে শক্তি ক্ষয় হয়। সেজন্য এক অর্থে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের একটি অপরা (negative) শক্তি রয়েছে। যে মহাবিশ্ব স্থানে মোটামুটি সমরূপ তার ক্ষেত্রে দেখানো যেতে পারে এই অপরা মহাকর্ষীয় শক্তি (negative gravitational energy) এবং বস্তু যে পরা শক্তির (positive energy) প্রতিনিধি, এরা পরস্পরকে নির্ভুলভাবে বাতিল (cancel) করে। সুতরাং মহাবিশ্বের মোট শক্তি শূন্য।
শূন্যের দ্বিগুণও শূন্য। তাহলে মহাবিশ্ব তার পরা পদার্থ শক্তি এবং অপরা মহাকর্ষীয় শক্তিকে দ্বিগুণ করতে পারে। সেক্ষেত্রেও শক্তির অক্ষয়ত্ব বিধি লজ্জিত হবে না। মহাবিশ্বের সাধারণ সম্প্রসারণে এরকম ঘটনা ঘটে না। সেক্ষেত্রে মহাবিশ্ব বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বস্তু শক্তির ঘনত্ব হ্রাস পায়। তবে অতিস্ফীতিরূপে সম্প্রসারণে (inflation ary expansion) সে রকম হয়, তার কারণ, অতি শীলত অবস্থায় শক্তির ঘনত্ব থাকে অচল (constant) অথচ মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু মহাবিশ্ব যখন সম্প্রসারিত হয় তখন পরা বস্তুশক্তি (positive matter energy) এবং অপরা মহাকর্ষীয় শক্তি দুইটি দ্বিগুণ হয়, ফলে মোট শক্তি শূন্যই থাকে। অতিস্ফীতির দশায় (inflationary phase) মহাবিশ্বের আয়তন খুব বেশি বেড়ে যায়। সুতরাং কণিকা গঠন করার জন্য প্রাপ্তব্য শক্তির পরিমাণও বিরাট বৃদ্ধি পায়। গুথ মন্তব্য করেছেন : “লোকে বলে কোথাও মাগনা খেতে পাওয়া যায় না, কিন্তু মহাবিশ্ব চরম মাগনা খাওয়া।”
আজকের দিনে মহাবিশ্ব আর অতিস্ফীতি রূপে (inflationary way) সম্প্রসারিত হচ্ছে না। সুতরাং এমন কিছু ব্যবস্থা থাকবার কথা যার জন্য কার্যকর বিরাট সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক ধ্রুবক নিষ্ক্রিয় হবে এবং সম্প্রসারণের হার তৃরিত না হয়ে মহাকর্ষের ফলে বর্তমান কালের মত মন্থর হবে। ঠিক যেমন অতি শীলত জল শেষ পর্যন্ত জমে যায়, তেমনি অতিস্ফীতিরূপ সম্প্রসারণের আশা করা যেতে পারে শেষ পর্যন্ত বলগুলোর প্রতিসাম্য (symmetry) ভেঙ্গে পড়বে। অভগ্ন প্রতিসম অবস্থার বাড়তি শক্তি তাহলে মুক্ত হবে এবং মহাবিশ্বকে উত্তপ্ত করে এমন তাপমাত্রায় নিয়ে আসবে যা বলগুলোর ভিতর প্রতিসাম্য রক্ষা করার উপযুক্ত ক্রান্তিক তাপমাত্রার ঠিক নিচে। উত্তপ্ত বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রতিরূপের মতই তখনও মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে থাকবে এবং শীতল হতে থাকবে, কিন্তু তখন মহাবিশ্ব কেন সঠিক ক্রান্তিক হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং কেন মহাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের একই তাপমাত্রা তার একটি ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে।
গুথের প্রাথমিক প্রস্তাবে দশা রূপান্তর (phase transition) হঠাৎ ঘটে। অনেকটা অতি শীতল জলে স্ফটিক (crystal) দেখা দেয়ার মত। চিন্তনটি ছিল– ফুটন্ত জল দিয়ে পরিবৃত বাষ্পের বুদ্বুদের মত ভগ্ন প্রতিসম অবস্থার নতুন দশার বুদ্বুদ পুরাতন দশার ভিতর গঠিত হয়। অনুমান করা হত বুদ্বুদগুলো সম্প্রসারিত হয়ে পরস্পর যুক্ত হতে হতে পুরো মহাবিশ্বই নতুন দশা প্রাপ্ত হয়। মুশকিলটা হল : মহাবিশ্ব এত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছিল যে বুদ্বুদগুলো যদি আলোকের দ্রুতিতেও বৃদ্ধি পায় তাহলেও তারা পরস্পর থেকে দূরে অপসরণ করতে থাকবে, সুতরাং পরস্পর যুক্ত হতে পারবে না। এ বিষয়ে আমি এবং অন্য কয়েকজন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। মহাবিশ্ব থাকবে একটি অসমরূপ অবস্থায় এবং কতকগুলো অঞ্চলে তখনো বিভিন্ন বলের প্রতিসম অবস্থা থাকবে। মহাবিশ্বের এই রকম প্রতিরূপ আমরা মহাবিশ্বকে যে অবস্থায় দেখছি তার সঙ্গে মেলে না।
১৯৮১ সালের অক্টোবর মাসে আমি মস্কোতে একটি কণাবাদী মহাকর্ষ quan tum gravity) সম্পর্কীয় আলোচনা সভায় যোগ দিয়েছিলাম। সভা শেষ হওয়ার পর আমি স্টার্নবার্গ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইনস্টিটিউটে একটি সেমিনার করি। অধিকাংশ লোকই আমার কথা বুঝতে পারত না, সেজন্য এর আগে আমার হয়ে বক্তৃতা দেয়ার জন্য অন্য একজনকে নিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু এবার সেমিনারের জন্য তৈরি হওয়ার সময় ছিল না, সুতরাং বক্তৃতাটি আমি নিজেই দিয়েছিলাম। আমার একজন গ্র্যাজুয়েট ছাত্র আমার কথার পুনরুক্তি করেছিল। ব্যাপারটি ভালই হয়েছিল এবং এর ফলে আমার শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগও বেশি হয়েছে। শ্রোতাদের ভিতর মস্কোব লেবেডে ইনস্টিটিউটের একজন তরুণ রুশ ছিলেন। তার নাম আন্দ্রে লিন্ডে (Landrei Linde)। তিনি বলেছিলেন, বুদ্বুদগুলো সংযুক্ত না হওয়ার অসুবিধা এড়ানো যায় যদি বুদ্বুদগুলো এত বড় হয় যে মহাবিশ্বে আমাদের অঞ্চলটি সম্পূর্ণই একটি বুদ্বুদের অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্যাপারটা এরকম হতে হলে বুদ্বুদটির ভিতর প্রতিসম অবস্থা থেকে ভগ্ন প্রতিসম অবস্থায় (bro ken symmetry) উত্তরণ অবশ্যই খুব ধীরে ধীরে হত। পূর্ণাঙ্গ (Grand) ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বগুলো অনুসারে ব্যাপারটা সত্যিই সম্ভব। ধীরে প্রতিসম অবস্থা ভগ্ন হওয়া বিষয়ক লিন্ডের ধারণাটি খুবই ভাল। কিন্তু পরে আমার মনে হল–সেক্ষেত্রে বুদ্বুদগুলোর যে আয়তন হতে হত সেটা তদানীন্তন মহাবিশ্বের আয়তনের চাইতে বেশি। আমি দেখেছিলাম শুধুমাত্র বুদ্বুদগুলোর ভিতরে না হয়ে একসঙ্গে সর্বত্রই এতিসম অবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। তাহলে তার ফল হবে আমরা যে রকম দেখছি সেই রকম একটি সমরূপ (uniform) মহাবিশ্ব। এই চিন্তাধারার ফলে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ি এবং আয়ান মস্ (lan Moss) নামে আমার এক ছাত্রের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করি। প্রকাশের উপযুক্ত কিনা জানবার জন্য লিন্ডের প্রবন্ধটি একটি বৈজ্ঞানিক পত্রিকা আমার কাছে পাঠায়। কিন্তু লিন্ডে আমার বন্ধু, সেজন্য আমি একটু বিব্রত বোধ করি। আমি উত্তম দিই–ধীর গতিতে প্রতিসম অবস্থা ভগ্ন হওয়া বিষয়ক চিন্তাধারা মূলত খুবই ভাল কিন্তু একটিই খুঁত থেকে যায়। সেটা হল বুদ্বুদগুলোকে হতে হয় মহাবিশ্বের চাইতে বড়। আমি সুপারিশ করলাম গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করা হোক, কারণ ওটা সংশোধন করতে লিন্ডের কয়েক মাস লেগে যাবে। পশ্চাত্য দেশে যাই আসুক না কেন, তাকে সোভিয়েত সেন্সর পেরোতে হবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের ব্যাপারে তারা খুব কুশলী কিম্বা চটপটে নন। তার বদলে আমি আয়ান মসের (lan Moss) সঙ্গে একটি ছোট প্রবন্ধ একই পত্রিকায় লিখলাম। সে প্রবন্ধে আমি বুদ্বুদ বিষয়ক সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করি এবং কি করে সে সমস্যার সমাধান করা যায় সেটাও দেখাই।
মস্কো থেকে যেদিন ফিরি সেদিনই আমি ফিলাডেলফিয়া রওনা হই। সেখানে ফ্র্যাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট থেকে আমার একটি পদক পাওয়ার কথা ছিল। আমার সেক্রেটারী জুডি ফেলা (Judy Fella) প্রচারের স্বার্থে কনকর্ডে তাঁর এবং আমার জন্য বিনামূল্যে দুটি আসন সগ্রহ করার জন্য তাঁর অসামান্য মোহিনীশক্তি ব্যবহার করেন। কিন্তু বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আমি আটকে যাই, ফলে প্লেনটা ধরতে পারিনি। তবুও শেষ পর্যন্ত আমি ফিলাডেলফিয়াতে পৌঁছাই এবং পদক গ্রহণ করি। তখন আমাকে ফিলাডেফিয়ার ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, মস্কোতে যেমন দিয়েছিলাম, সেই রকম অতি স্ফীতিমান মহাবিশ্ব (inflationary universe) সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দিতে বলা হয়।
কয়েক মাস পরে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পল স্টাইনহার্ড (Paul Steinhardt) এবং অ্যানড্রিয়াস অ্যালব্রেখট (Andress Albrecht) স্বাধীনভাবে লিভের মতই একটি ধারণা উপস্থিত করেন। এখন তাঁদের দুজনকে এবং লিন্ডকে যুক্তভাবে প্রতিসম অবস্থা ধীরগতিতে ভগ্ন হওয়ার চিন্তনের ভিত্তিতে গঠিত “নব্য স্ফীতিমান পতিরূপ” গঠনের কৃতিত্ব দেয়া হয়। (প্রাচীন অতিস্ফীতিমান প্রতিরূপ ছিল গুথের প্রতিসাম্য ভগ্ন হওয়া এবং বুদ্বুদ সৃষ্টি হওয়া বিষয়ে প্রথম উপস্থাপিত ধারণা)।
নব্য অতিস্ফীতিমান প্রতিরূপ মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করার একটি উত্তম প্রচেষ্টা। কিন্তু আমি এবং আরও কয়েকজনে দেখিয়েছিলাম : অন্তত পক্ষে প্রতিরূপের যে প্রাথমিক রূপ ছিল সে রূপ পর্যবেক্ষণ করা মাইক্রোতরঙ্গ পশ্চাৎপট বিকিরণের তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশি হ্রাস-বৃদ্ধি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। অতি আদিম মহাবিশ্বে যে রকম প্রয়োজন হতে পারত সে রকম কোন দশা রূপান্তর (phase transition) হওয়া সম্ভব ছিল কিনা সে সম্পর্কে পরবর্তী অনেক গবেষণাতেই সন্দেহ প্রকাশ পায়। আমার ব্যক্তিগত মতে, নব্য অতিস্ফীতিমান প্রতিরূপের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে মৃত্যু হয়েছে। তবে অনেকেই এর মৃত্যু সংবাদ রাখেন না। অনেকেই এখনো এমন ভাবে গবেষণাপত্র লিখে চলেছেন যেন এ তত্ত্ব এখনও জীবিত। ১৯৮৩ সালে লিন্ডে (Linde) শৃঙ্খলাহীন অতিস্ফীতিমান প্রতিরূপ (chaotic inflationary model) নামে আরো ভাল একটি প্রতিরূপ উপস্থিত করেন। এ প্রতিরূপে কোন দশা রূপান্তর (phase transition) কিম্বা অতি শীতল হওয়া (super cooling) নেই। তার বদলে রয়েছে O চক্রণ ক্ষেত্র (spin O field), সে ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম হ্রাস-বৃদ্ধির দরুন আদিম মহাবিশ্বের কোন কোন অঞ্চলের মান (value) হত বৃহৎ। এই সমস্ত অঞ্চলের ক্ষেত্রের শক্তি এক মহাজাগতিক ধ্রুবকের মত আচরণ করবে। এর একটি বিকর্ষণকারী মহাকর্ষীয় অভিক্রিয়া থাকবে। তার ফলে ঐ অঞ্চলগুলো অতি দ্রুত স্ফীত হবে। প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ক্ষেত্রের শক্তিও ধীরে ধীরে কমবে। শেষ পর্যন্ত অতিদ্রুত প্রসারণ (inflationary expansion) হ্রাস পেয়ে উত্তপ্ত বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রতিরূপের মত প্রসারণে রূপান্তরিত হবে। এই অঞ্চলগুলোর একটি হবে আমরা যাকে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বরূপে দেখি সেই অঞ্চল। এই প্রতিরূপের আগেরকার দ্রুত স্ফীতিমান প্রতিরূপের সমস্ত সুবিধাই রয়েছে কিন্তু এটি সন্দেহজনক দশা রূপান্তরের (dubius phase transition) উপর নির্ভর করে না। তাছাড়া এ প্রতিরূপে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মাইক্রোতরঙ্গের পশ্চাৎপটের তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির একটি যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ পাওয়া যায়।
অতি স্ফীতিমান প্রতিরূপের উপর এই গবেষণা দেখিয়েছে মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থা বহুসংখ্যক পৃথক পৃথক প্রাথমিক আকৃতি (configuration) থেকে উদ্ভুত হতে পারে। এ তথ্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ থেকে বোঝা যায় মহাবিশ্বের যে অংশে আমরা বাস করি সে অংশের প্রাথমিক অবস্থা খুব সযত্নে নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল না। সুতরাং আমরা যদি ইচ্ছা করি তাহলে মহাবিশ্বকে এখন যেরকম দেখায় সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য দুর্বল নরত্বীয় নীত (weak anthropic principle) ব্যবহার করতে পারি। তবে এরকম কখনো হতে পারে না যে, যে কোন প্রাথমিক আকৃতিই (configuration) আমরা যে রকম মহাবিশ্ব দেখছি তার পথিকৃৎ হতে পারত। বর্তমান কালের মহাবিশ্বের অত্যন্ত অন্যরকম অবস্থা (ধরুন–বিচ্ছিন্ন অত্যন্ত পিণ্ডাকৃতি এবং অসমvery lumpy and irregular) বিচার করে এটা দেখানো যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক বিধিগুলোর সাহায্যে কালে মহাবিশ্বের অতীতমুখী বিবর্তন বিচার করে পূর্বতন যুগের আকৃতি নির্ধারণ করা যায়। চিরায়ত ব্যাপক অপেক্ষবাদের অনন্যতা উপপাদ্য (singu larity theorem) অনুসারে এসত্ত্বেও একটি বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতা থাকতে হত। আপনি যদি বিজ্ঞানের বিধি অনুসারে এই রকম একটি মহাবিশ্বের ভবিষ্যকালের অভিমুখে বিবর্তন করান তাহলে যে বিচ্ছিন্ন পিণ্ডাকৃতি অসম মহাবিশ্ব নিয়ে আপনি শুরু করেছিলেন সেখানেই এসে পৌঁছে যাবেন। সুতরাং এমন প্রাথমিক আকৃতি নিশ্চয়ই থাকতে পারত যা থেকে আমরা আজ যে মহাবিশ্ব দেখছি সে রকম মহাবিশ্ব উৎপন্ন হত না। সুতরাং প্রাথমিক আকৃতি কেন এরকম হয়নি, যার ফলে আমরা যা পর্যবেক্ষণ করছি তার চাইতে অত্যন্ত পৃথক কিছু সৃষ্টি হতে পারেনি, সে প্রশ্নের উত্তর অতিস্ফীতিমান প্রতিরূপও দিতে পারে না। তাহলে কি ব্যাখ্যার জন্য আমাদের নরত্বীয় নীতির আশ্রয় নিতে হবে? এটা কি তবে ছিল সৌভাগ্যজনক দৈব ঘটনা? এ যুক্তি মনে হয় নেহাই হতাশার–মহাবিশ্বের মূলগত বিন্যাস (underlying order) বোঝার সমস্ত আশা শেষ হয়ে যাওয়ার।
মহাবিশ্বের কিভাবে শুরু হওয়া উচিত ছিল সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে এমন বৈজ্ঞানিক বিধি প্রয়োজন, যে বিধি কালের প্রারম্ভে সত্য ছিল। ব্যাপক অপেক্ষবাদের চিরায়ত তত্ত্ব যদি সত্য হয় তাহলে আমার এবং রজার পেনরোজের প্রমাণিত অনন্যতা উপপাদ্য থেকে দেখা যায় কালের প্রারম্ভ এমন একটি বিন্দু, যে বিন্দুতে ঘনত্ব ছিল অসীম এবং স্থান-কালের বক্রতাও ছিল অসীম। সে বিন্দুতে বিজ্ঞানের জাতি সমস্ত বিধিই ভেঙে পড়বে। অনুমান করা যেতে পারে অনন্যতার সময় নতুন বিধি ছিল কিন্তু যে সমস্ত বিন্দুর আচরণ এমন মন্দ যে সেই সমস্ত বিন্দুর বিধি গঠন করা খুবই কঠিন এবং সে বিধিগুলোর কিরকম হওয়া উচিত সে সম্পর্কে কোন ইঙ্গিত আমরা পর্যবেক্ষণ থেকেও পাব না। কিন্তু আসলে অনন্যতা উপপাদ্যগুলোর ইঙ্গিত হল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতই শক্তিশালী হয় যে কোয়ান্টাম মহাকর্ষীয় অভিক্রিয়াগুলো গুরুত্বলাভ করে : চিরায়ত তত্ত্ব আর মহাবিশ্বের বিবরণের পক্ষে উত্তম নয়। সুতরাং মহাবিশ্বের অতি আদিম অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে হলে কণাবাদী মহাকর্ষীয় তত্ত্ব ব্যবহার করতে হবে। আমার দেখতে পাব কণাবাদী তত্ত্বে বিজ্ঞানের সাধারণ তত্ত্বগুলো সর্বত্র প্রযোজ্য হওয়া সম্ভব অর্থাৎ প্রযোজ্য হওয়া সম্ভব কালের প্রারম্ভেও। অনন্যতার জন্য নতুন বিধি প্রণয়ন প্রয়োজন হয় না কারণ কোয়ান্টাম তত্ত্বে অনন্যতার কোন প্রয়োজন নেই।
কণাবাদী বলবিদ্যা quantum mechanics) এবং মহাকর্ষকে যুক্ত করে, সম্পূর্ণ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ এরকম তত্ত্ব এখন পর্যন্ত আমাদের নেই। কিন্তু এরকম একটি ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের অবয়বে কি থাকা উচিত তার কিছু কিছু সম্পর্কে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত। একটি হল ফেনম্যানের Fেeynman) প্রস্তাবকে এ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ প্রস্তাব অনুসারে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বহু ইতিহাসের যোগফলের বাগ্বিধিতে গঠন করতে হবে। চিরায়ত তত্ত্ব অনুসারে একটি কণিকার একটিই ইতিহাস থাকে কিন্তু ফেনম্যানের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে কণিকার ইতিহাস একটি মাত্র নয়। তার বদলে অনুমান করা হয় কণিকাটি স্থান-কালের সম্ভাব্য সমস্ত পথই অনুসরণ করে এবং এর প্রতিটি ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িত রয়েছে দুটি সংখ্যা। একটি প্রকাশ করে তরঙ্গের আয়তন (size) অন্যটি প্রকাশ করে চক্রের ভিতরে (in the cycle) তার অবস্থান (এক দশা its phase)। ধরুন কোন বিশেষ বিন্দুর ভিতর দিয়ে কণিকাটি গমন করার সম্ভাব্যতা, এই সম্ভাব্যতা পাওয়া যায় ঐ বিন্দুর ভিতর দিয়ে গমনকারী সম্ভাব্য সমস্ত ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরঙ্গগুলোর যোগফল দিয়ে। কিন্তু এই অঙ্কগুলো করতে গেলে প্রযুক্তির দিক থেকে কঠিন অসুবিধায় পড়তে হয়। অসুবিধা এড়ানোর একমাত্র পথ হল নিম্নলিখিত অদ্ভুত ব্যবস্থাপত্র : সেই সমস্ত কণিকা ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরঙ্গ যোগফল নিতে হবে যেগুলোর অস্তিত্ব আমার আপনার পরিচিত “বাস্তব” (real) কালে নয়। সেগুলোর অস্তিত্ব, যাকে বলা হয় কাল্পনিক (imaginary) কাল, সেই কালে। কাল্পনিক কাল কথাটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত শোনাতে পারে, কিন্তু আসলে এটি একটি সুসংজ্ঞিত গাণিতিক চিন্তন। আমরা যদি একটি সাধারণ সংখ্যা (বাস্তব) নিয়ে সংখ্যাটিতে সেই সংখ্যার সঙ্গেই গুণ করি তাহলে গুণফল হবে একটি পরা সংখা (positive num ber)। (উদাহরণ : দুই দুগুণে চার কিন্তু– ২ (দুই) কে– ২ (দুই) দিয়ে গুণ করলেও চার হয়)। তবে কতকগুলো বিশেষ সংখ্যা আছে (সেগুলোকে বলা হয় কাল্পনিক) সেগুলোকে সেই সংখ্যা দিয়ে গুণ দিলে অপরা (negative) সংখ্যা হয়। (একটির নাম i, সেটিকে ঐ সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে গুণফল হয়–১, ২i কে ২i দিয়ে গুণ করলে গুণফল হয় ৪, এইরকম)। ফেনম্যানের ইতিহাসের যোগফলের প্রযুক্তিভিত্তিক অসুবিধা এড়ানোর জন্য কাল্পনিক সংখ্যা দিয়েই। স্থান-কালের উপর এর ক্রিয়া আকর্ষণীয় : স্থান এবং কালের ভিতর পার্থক্য সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়। যে স্থান-কালের কালিক স্থানাঙ্ক (time coordinate) কাল্পনিক তাকে বলা হয় ইউক্লিডীয়। দ্বিমাত্রিক তলের জ্যামিতির প্রতিষ্ঠাতা গ্রীক ইউক্লিডের নামে এই মান। এখন আমরা যাকে ইউক্লিডীয় স্থান-কাল বলি তার সঙ্গে এর খুবই মিল, শুধুমাত্র দুই মাত্রার বদলে এতে রয়েছে চার মাত্রা (four dimensions)। ইউক্লিডীয় স্থান-কালে কালের অভিমুখ এবং স্থানের অভিমুখগুলোর ভিতরে কোন পার্থক্য নেই। অন্য দিকে বাস্তব স্থান-কালে যেখানে ঘটনাগুলো কালিক স্থানাঙ্কের সাধারণ বাস্তব মান (real values) দিয়ে চিহ্নিত, সেখানে পার্থক্য নির্ধারণ করা সহজ সমস্ত বিন্দুতেই সময়ের অভিমুখ থাকবে আলোক শঙ্কুর light cone) ভিতরে এবং স্থানের অভিমুখগুলো থাকবে তার বাইরে। সে যাই হোক, দৈনন্দিন কণাবাদী বলবিদ্যা অনুসারে এই পর্যন্ত বলা যেতে পারে যে আমাদের কাল্পনিক সময় এবং ইউক্লিডীয় স্থান-কাল ব্যবহার বাস্তব স্থান-কাল সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার একটি গাণিতিক কৌশল (কিম্বা চালাকি trick) মাত্র আমাদের বিশ্বাস চূড়ান্ত তত্ত্বের দ্বিতীয় একটি অংশ অবশ্যই হবে আইনস্টাইনের এই চিন্তাধারা যে বঙ্কিম স্থান কাল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রতিনিধি : বঙ্কিম স্থানে কণাগুলো অনুসরণ করে ঋজুপত্রের নিকটতম একটা কিছু কিন্তু যেহেতু স্থান-কাল সমতল (flat) নয়, সেজন্য মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের জন্যই যেন তাদের পথগুলোকে বঙ্কিম দেখায়। মহাকর্ষ সম্পর্কে আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গির উপর ফেনম্যানের ইতিহাসগুলোর যোগফল প্রয়োগ করলে কণিকার ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায় সম্পূর্ণ বঙ্কিম স্থান-কালের সদৃশ (analogue) সেটাই সমগ্র মহাবিশ্বের ইতিহাসের প্রতিরূপ। কার্যক্ষেত্রে ইতিহাসগুলোকে যোগ করার প্রযুক্তিগত অসুবিধা এড়ানোর জন্য এই বঙ্কিম স্থান-কালকে ইউক্লিডীয় বলে মেনে নেয়া আবশ্যিক। অর্থাৎ কাল কাল্পনিক এবং স্থানের অভিমুখের সঙ্গে তার কোন পার্থক্য করা সম্ভব নয়। একটি বিশেষ ধর্ম সমন্বিত (যথা–প্রতিটি বিন্দুতে এবং প্রতিটি অভিমুখে একই রকম দেখাবে) বাস্তব স্থান-কাল পাওয়ার সম্ভাবনা খুঁজতে গেলে যাদের এই রকম ধর্ম আছে সেই রকম ইতিহাসগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত সমস্ত তরঙ্গের যোগফল বার করতে হবে।
ব্যাপক অপেক্ষবাদের চিরায়ত তত্ত্বে সম্ভাব্য বিভিন্ন বঙ্কিম স্থান-কাল রয়েছে, এগুলোর প্রতিটি, মহাবিশ্বের সম্ভাব্য বিভিন্ন প্রাথমিক অবস্থার অনুরূপ। মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা যদি আমাদের জানা থাকত তাহলে তার সম্পূর্ণ ইতিহাসটি আমরা জানতাম। অনুরূপভাবে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্বে মহাবিশ্বের সম্ভাব্য বিভিন্ন কোয়ান্টাম অবস্থা রয়েছে। তাছাড়া আমাদের যদি জানা থাকত ইতিহাসগুলোর ভিতরে ইউক্লিডীয় বঙ্কিম স্থান-কালের আদিম যুগে আচরণ কি ছিল তাহলে আমরা মহাবিশ্বের কোয়ান্টাম অবস্থা জানতে পারতাম।
চিরায়ত মহাকর্ষীয় তত্ত্বের ভিত্তি বাস্তব স্থান-কাল, সে তত্ত্বে মহাবিশ্বের আচরণের দুটি মাত্র সম্ভাব্য পথ রয়েছে : হয় এর অস্তিত্ব রয়েছে অনন্তকাল থেকে নয়ত অতীতের কোন সীমিতকালে এক অনন্যতা থেকে এর শুরু। অন্যদিকে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্বে একটি তৃতীয় সম্ভাবনা দেখা দেয়। যে ইউক্লিডীয় স্থান-কাল ব্যবহার করা হচ্ছে সে স্থান কালে সময়ের অভিমুখ এবং কালের অভিমুখ একই, সুতরাং স্থান-কালের বিস্তার সীমিত হলেও একটি অনন্যতা দিয়ে তার সীমানা কিম্বা কিনারা না হতে পারে। স্থান-কাল হতে ধরাপৃষ্ঠের মত, শুধুমাত্র দুটি মাত্রা (dimension) বেশি থাকবে। ধরাপৃষ্ঠ বিস্তারের দিক দিয়ে সীমিত কিন্তু তার কোন সীমানা কিম্বা কিনারা নেই। আপনি যদি জাহাজে করে সূর্যাস্তের ভিতরে ঢুকে পড়েন তাহলে আপনি পৃথিবীর কিনারা দিয়ে পড়ে যাবেন না কিম্বা একটি অনন্যতায় ঢুকে পড়বেন না। (আমি সারা পৃথিবী ঘুরেছি,–সেজন্য আমি জানি।
ইউক্লিডীয় স্থান-কাল যদি কাল্পনিক সীমাহীন অতীত বিস্তৃত হয় কিম্বা যদি কাল্পনিক কালের একটি অনন্যতায় শুরু হয়, তাহলেও আমাদের চিরায়ত তত্ত্বের মত একই সমস্যা থেকে যায় অর্থাৎ মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা নির্দিষ্টরূপে নির্দেশ (specifying) করা : ঈশ্বর হয়ত জানেন মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হয়েছিল কিন্তু মহাবিশ্ব একভাবে শুরু না হয়ে কেন অন্যভাবে শুরু হয়েছিল সেটা বিচার করার বিশেষ কোন কারণ আমরা দেখাতে পারব না। অন্যদিকে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব একটি নতুন সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। এ সম্ভাবনায় স্থান-কালের কোন সীমানা থাকবে না, সুতরাং সীমানার আচরণ নির্দিষ্ট করারও কোন প্রয়োজন থাকবে না। সেক্ষেত্রে এমন কোন অনন্যতা থাকবে না যেখানে বিজ্ঞানের বিধি ভেঙে পড়েছিল এবং স্থান-কালের এমন কোন কিনারা (edge) থাকবে না যেখানে স্থান-কালের সীমানা স্থির করার জন্য ঈশ্বর কিম্বা অন্য কোন বিধির দ্বারস্থ হতে হবে। বলা যেতে পারে “মহাবিশ্বের সীমান্তের অবস্থা হল কোন সীমান্তের অনস্তিত্ব।” মহাবিশ্ব হবে সম্পূর্ণ আত্ম-অন্তর্ভুক্ত (self-contained) এবং বাইরের কিছু দিয়ে প্রভাবিত নয়। এটা সৃষ্টিও হবে না ধ্বংসও হবে না। এটা শুধুমাত্র থাকবে।
ভ্যাটিক্যানের যে কনফারেন্সের কথা এর আগে উল্লেখ করেছি সেই কনফারেন্সে আমি প্রস্তাব উত্থাপন করি যে, হয়ত স্থান আর কাল মিলিয়ে এমন একটি তল (sur face) গঠন করেছে যেটা আয়তনে সীমিত কিন্তু তার কোন সীমানা কিম্বা কিনারা নাই । আমার গবেষণাপত্রটি ছিল একটু গাণিতিক, সেজন্য মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে ঈশ্বরের ভূমিকা সম্পর্কে তার ফলশ্রুতি সে সময় সাধারণভাবে বোধগম্য হয় নি। (আমার পক্ষে ভালই হয়েছিল)। ভ্যাটিক্যান কনফারেন্সের সময় মহাবিশ্ব সম্পর্কে ভবিষৎদ্বাণী করার জন্য “সীমানাহীনতার চিন্তাধারা কি করে ব্যবহার করা যায় সেটা আমার জানা ছিল না। যাই হোক, পরবর্তী গ্রীষ্মকালটা আমি কাটাই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্টা বারবারায় (Santa Barbara)। সেখানে আমি এবং জিম হার্টল Jim Hartle) নামে আমার একজন বন্ধু এবং সহকর্মী একসঙ্গে গবেষণা করি। গবেষণার বিষয় ছিল : যদি স্থান-কালের সীমানা না থাকে তাহলে মহাবিশ্বের কি কি শর্ত পালন করতে হবে? কেম্ব্রিজে ফেরার পর জুলিয়ান লুট্টেল Julian Luttrel) এবং জোনাথান হ্যাঁলিওয়েল (Jonathan Halliwell) নামে আমার দুজন গবেষণাকারী ছাত্রের সঙ্গে আমি এই গবেষণা চালিয়ে যাই।
আমি জোরের সঙ্গে বলতে চাই স্থান এবং কাল সীমিত কিন্তু তার কোন সীমানা নেই এই ধারণা একটি প্রস্তাব মাত্রা : অন্য কোন নীতি থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। যে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মতই প্রথমে এ প্রস্তাব হয়ত করা হয়েছিল সৌন্দর্য কিম্বা অধিবিদ্যামূলক কারণে কিন্তু পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কি না সেটাই তত্ত্বের আসল পরীক্ষা। তবে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের ক্ষেত্রে দুটি কারণে এটা নির্ণয় করা কঠিন। প্রথমত, (এটা ব্যাখ্যা করা হবে পরের অধ্যায়ে) কোন তত্ত্ব কণাবাদী বলবিদ্যা এবং ব্যাপক অপেক্ষবাদ সাফল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে, সে বিষয়ে আমরা এখনও নিশ্চিত নই। কিন্তু সেরকম একটি তত্ত্বের অবয়ব কি রকম হতেই হবে সে সম্পর্কে আমরা অনেকটা জানি। দ্বিতীয়ত সমগ্র মহাবিশ্বের বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দিতে পারে এরকম প্রতিরূপ আমাদের পক্ষে গাণিতিকভাবে এমন জটিল হবে যে আমরা নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী গণনা করতে পারব না। সুতরাং আমাদের করতে হবে সরলীকরণ করতে পারে এরকম অনুমান এবং আন্নতা (approximation)। কিন্তু তবুও ভবিষ্যদ্বাণী বার করা হবে অতীব দুরূহ।
ইতিহাসগুলোর যোগফলের প্রতিটি ইতিহাস শুধু স্থান-কালের বিবরণই দেবে না বিবরণ দেবে তার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি জিনিসেরই। তার ভিতরে মানুষের মত জটিল জীবও থাকবে অর্থাৎ এমন জীব যারা মহাবিশ্বের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এটা নরত্বীয় নীতির সপক্ষে আর একটি যুক্তি হতে পারে। কারণ যদি সবকটি ইতিহাসই সম্ভব হয় তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত ইতিহাসগুলোর একটিতে আমাদের অস্তিত্ব রয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মহাবিশ্ব যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থা ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা নরত্নীয় নীতি ব্যবহার করতে পারি। যে ইতিহাসগুলোতে আমাদের অস্তিত্ব নেই সেগুলোতে ঠিক কি অর্থ আরোপ করা যেতে পারে সেটা স্পষ্ট নয়। যদি ইতিহাসগুলোর যোগফলের সাহায্যে দেখানো যেত যে আমাদের মহাবিশ্ব শুধুমাত্র সম্ভাব্য ইতিহাসগুলোর একটি নয়, এটা সবচাইতে সম্ভাব্যগুলোর একটি, তাহলে মহাকর্ষের কণাবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি আরও অনেক বেশি সন্তোষজনক হত। এই কাজ করার জন্য সম্ভাব্য সমস্ত সীমানাবিহীন ইউক্লিডীয় স্থান-কালের ইতিহাসের যোগফল বার করতে হবে।
সীমানাহীনতার প্রস্তাব থেকে জানা যায় মহাবিশ্বের সম্ভাব্য প্রতিটি ইতিহাস অনুসরণ করার সম্ভাবনা অতি সামান্য, তবে ইতিহাসগুলোর একটি বিশেষ গোষ্ঠী আছে যার সম্ভাবনা অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। এই ইতিহাসগুলোকে অনেকটা কল্পনা করা যায় ভূপৃষ্ঠের মত উত্তর মেরু থেকে দূরত্ব কাল্পনিক কালের প্রতিরূপ এবং উত্তর মেরু থেকে স্থির দূরত্ব বিশিষ্ট একটি বৃত্তের আয়তন মহাবিশ্বের স্থানিক আয়তনের প্রতিরূপ। উত্তর মেরুতে একক একটি বিন্দুরূপে মহাবিশ্বের আরম্ভ। সেখান থেকে যত দক্ষিণে যাওয়া যাবে উত্তর মেরু থেকে স্থির দূরত্বে অক্ষাংশের (latitude) বৃত্তগুলো ততই বৃহত্তর হবে। এটা হবে কাল্পনিক সময়ের সঙ্গে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের অনুরূপ (চিত্র : ৮.১)। বিষুবরেখায় মহাবিশ্বের আয়তন হবে বৃহত্তম এবং কাল্পনিক সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্কুচিত হতে হতে দক্ষিণ মেরুতে এসে একটি মাত্র বিন্দুতে পরিণত হবে। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুতে মহাবিশ্বের আয়তন শূন্য হলেও এই বিন্দুগুলো অনন্য (singularities) হত না। পৃথিবীর উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু যতটা অনন্য তার চাইতে বেশি কিছু নয়। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু সাপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বিধিগুলো যেমন সত্য, ওগুলো বৈজ্ঞানিক বিধিগুলো তেমনি সত্য হবে।
কিন্তু বাস্তব কালে মহাবিশ্বের ইতিহাস বেশ অন্যরকম দেখাবে। এক হাজার কিম্বা দু’হাজার কোটি বছর আগে এর আয়তন হত সর্বনিম্ন। সেটি হত কাল্পনিক কালের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যাসার্ধের সমান। পরবর্তী বাস্তব কালে মহাবিশ্ব লিন্ডে (Linde) প্রস্তাবিত শৃঙ্খলাহীন অতি স্ফীতিমান প্রতিরূপের অনুরূপ সম্প্রসারিত হবে (কিন্তু মহাবিশ্ব কোনক্রমে সঠিক অবস্থায় সৃষ্ট হয়েছিল এরকম অনুমান করার প্রয়োজন এক্ষেত্রে হবে না)। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে হতে বিরাট আয়তন প্রাপ্ত হবে এবং তারপর আবার চুপসে যাবে। সেটি দেখাবে অনেকটা বাস্তব কালের অনন্যতার মত। সুতরাং এক অর্থে, কৃষ্ণগহ্বর থেকে দূরে থাকলেও আমাদের সবারই মৃত্যু অবধারিত। মহাবিশ্ব শুধুমাত্র যদি কাল্পনিক কালের বাগ্বিধিতে কল্পিত হয় তাহলেই কোন অনন্যতা থাকবে না।
মহাবিশ্ব যদি বাস্তবিকই এরকম একটি কণাবাদী অবস্থায় থাকে তাহলে কাল্পনিক কালে মহাবিশ্বের ইতিহাসে কোন অনন্যতা থাকবে না। সুতরাং মনে হতে পারে আমার আধুনিকতর গবেষণা আমার অনন্যতা বিষয়ে পূর্বতন গবেষণাগুলোকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছে। কিন্তু অনন্যতা উপপাদ্যগুলোর বাস্তব গুরুত্ব ছিল : তারা দেখিয়েছে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রগুলো অবশ্যই এত শক্তিশালী হত যে কণাবাদী মহাকর্ষীয় অভিক্রিয়াকে quantum gravitational effect) অগ্রাহ্য করা যেত না। এরকম ইঙ্গিত আগে দেয়া হয়েছে। কাল্পনিক কালে মহাবিশ্ব সীমানাহীন কিম্বা অনন্যতাহীন হলেও সীমিত হতে পারে এই ধারণার পথিকৃৎ পূর্বোক্ত চিন্তাধারা। যে বাস্তব কালে আমরা বাস করি সেই বাস্তব কালে ফিরে এলে কিন্তু তখনও অনন্যতার অস্তিত্ব থাকবে বলে মনে হয়। যে মহাকাশচারী বেচারা কৃষ্ণগহ্বরে পড়বে তখনও তার চটচটে (sticky) মৃত্যুই হবে। শুধুমাত্র কাল্পনিক কালে বাস করলেই তার কোন অনন্যতার সঙ্গে দেখা হবে না।
এ থেকে মনে হতে পারে তথাকথিত কাল্পনিক কালই আসলে বাস্তব কাল আর যাকে আমরা বাস্তব কাল বলি সেটা আমাদের কল্পনার উদ্ভাবন। বাস্তব কালে অনন্যতাগুলোর ভিতরে মহাবিশ্বের শুরু আর শেষ রয়েছে। এ অনন্যতাগুলোই স্থান কালের সীমানা এবং এখানে বিজ্ঞানের বিধিগুলো ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু কাল্পনিক কালে কোন অনন্যতা কিম্বা সীমানা নেই। সেজন্য আমরা যাকে কাল্পনিক কাল বলি হয়ত সেটাই আরো বেশি মূলগত (more basic), হয়ত যাকে আমরা বাস্তব বলি সেটা একটি চিন্তন মাত্র। সে চিন্তনকে আমরা আবিষ্কার করি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিন্তনের বিবরণ দেয়ার জন্য। কিন্তু প্রথম অধ্যায়ে বিবৃত প্রথম মত অনুসারে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব একটি গাণিতিক প্রতিরূপ মাত্র। এগুলো আমরা তৈরি করি আমাদের পর্যবেক্ষণের বিবরণ দেয়ার জন্য। তত্ত্বের অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের মনে। সুতরাং কোনটা বাস্তব কোনটা বাস্তব কাল কিম্বা কোনটা কাল্পনিক কাল–এসমস্ত প্রশ্ন অর্থহীন। কোন বিবরণটি বেশি কার্যকর সেটাই একমাত্র বিচার্য বিষয়।
মহাবিশ্বের কোন কোন ধর্ম একসঙ্গে বর্তমান থাকতে পারে সেটা নির্ধারণ করার জন্য সীমানাহীনতার প্রস্তাবের সঙ্গে ইতিহাসগুলোর যোগফল একসঙ্গে ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণ : যখন মহাবিশ্বের ঘনত্বের বর্তমান মূল্যাঙ্ক রয়েছে তখন মহাবিশ্বের প্রায় এক হারে প্রত্যেক বিভিন্ন দিকে যুগপৎ সম্প্রসারণের সম্ভাবনা গণনা করা যেতে পারে। এ পর্যন্ত যে কটা সরলীকৃত প্রতিরূপ নিয়ে গবেষণা হয়েছে সে সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এ সম্ভাবনা বেশি। অর্থাৎ মহাবিশ্বের বর্তমান সম্প্রসারণের হার সর্বদিকেই প্রায় সমান হওয়ার সম্ভাবনা অত্যধিক। এই ভবিষ্যদ্বাণীর পথিকৃৎ হল প্রস্তাবিত সীমানাহীনতার অবস্থা। এ সম্ভাবনার সঙ্গে মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের পশ্চাৎপটের সঙ্গতি রয়েছে। এ থেকে দেখা যায় : যে কোন অভিমুখেই এই বিকিরণের তীব্রতা প্রায় নির্ভুলভাবে সমান। যদি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ কতকগুলো অভিমুখের তুলনায় অন্য কোন কোন অভিমুখে দ্রুততর হত তাহলে ঐ সমস্ত অভিমুখে বিকিরণের তীব্রতা কম হত । হ্রাসের পরিমাণ হত একটি বাড়তি লোহিত বিচ্যুতি (by an additional red shift)।
সীমানাহীন অবস্থা সাপেক্ষ অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে বর্তমানে কাজ চলছে। আদিম মহাবিশ্বের একরূপ ঘনত্ব থেকে যে সমস্ত সামান্য বিচ্যুতির ফলে প্রথমে নীহারিকা, তার পর তারকা এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের উদ্ভব হয়েছে সেগুলোর পরিমাণ এক বিশেষ আকর্ষণীয় সমস্যা। আদিম মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ একরূপ হতে পারত না, তার কারণ কণিকাগুলোর অবস্থান এবং গতিবেগে (velocity) কিছু অনিশ্চয়তা এবং হ্রাস-বৃদ্ধি থাকতেই হত : অনিশ্চয়তার নীতির ভিতরেই এ তথ্য নিহিত আছে। সীমানাহীন অবস্থা বিচার করে আমরা জানতে পারি আসলে মহাবিশ্ব নিশ্চয়ই শুরু হয়েছিল অনিশ্চয়তার নীতি অনুমোদিত সম্ভাব্য সর্বনিম্ন বিচ্যুতি দিয়ে। তারপর মহাবিশ্ব কিছুকাল অতিস্ফীতিমান প্রতিরূপে যে রকম অনুমান করা হয়েছে সে রকম দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছিল। এ যুগে মহাবিশ্বের প্রাথমিক একরূপত্বের অভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যা আমাদের সর্বদিকে পর্যবেক্ষণ করা গঠনগুলোর উদ্ভব (origing of the structures) ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। যে সম্প্রসারণমান মহাবিশ্বে স্থান থেকে স্থানান্তরে পদার্থের ঘনত্বের সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি হয়, সেখানে মহাকর্ষের ক্রিয়ায় ঘনতর অঞ্চলের সম্প্রসারণ শ্লথতর হবে এবং সে অঞ্চলগুলোর সঙ্কোচন শুরু হবে। এর ফলে গঠিত হবে নীহারিকা, তারকা এবং শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি হবে আমাদের মত নগণ্য জীব? সেজন্য আমরা যে সমস্ত জটিল গঠন দেখতে পাই সেগুলো মহাবিশ্বের সীমানাহীন অবস্থা এবং কণাবদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
স্থান এবং কাল একটি সীমানাহীন বদ্ধ পৃষ্ঠ (closed surface) গঠন করতে পারে: মহাবিশ্বের ব্যাপারে ঈশ্বরের ভূমিকা বিষয়ে এই চিন্তনের ফলশ্রুতি হতে পারে গভীর। ঘটনাবলি ব্যাখ্যায় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর সাফল্যের ফলে অধিকাংশ লোকই এখন বিশ্বাস করেন ঈশ্বর একগুচ্ছ বিধি অনুসারে মহাবিশ্বের বিবর্তন অনুমোদন করেন এবং এই বিধি ভঙ্গ করে তিনি মহাবিশ্বে হস্তক্ষেপ করেন না। কিন্তু শুরুতে মহাবিশ্বের চেহারা কি রকম ছিল সে বিষয়ে বিধিগুলো কিছুই বলে না। এই ঘড়ির মত গতি বন্ধ করা ঈশ্বরেরই দায়িত্ব এবং কি করে এটি আবার শুরু করবেন সে পদ্ধতি নির্বাচনের দায়িত্বও ঈশ্বরেরই। যতক্ষণ পর্যন্ত মহাবিশ্বের শুরু ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অনুমান করতে পারতাম মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টাও ছিল। কিন্তু মহাবিশ্ব যদি সত্যিই পূর্ণরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় এবং যদি এর কোন সীমানা কিম্বা কিনারা না থাকে, তাহলে এর আদিও থাকবে না, অন্তও থাকবে না– থাকবে শুধু অস্তিত্ব। তাহলে স্রষ্টার স্থান কোথায়?