অধ্যায় ৮
মহাজাগতিক উদ্দেশ্য
আধুনিক বিজ্ঞানবিদগণ যদি ধর্মের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন অথবা উদাসীন না হলেও, তাঁরা একটা বিশ্বাস আঁকড়ে থাকেন। তাঁদের মতে এই বিশ্বাস পূর্বতন গোঁড়ামির ধ্বংসের মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে। প্রধানত এই বিশ্বাসটা হলো মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাসী। উদার ধর্মতাত্ত্বিকেরা সমানভাবে এই বিশ্বাসকে তাদের ধর্মমতের কেন্দ্রীয় বিষয় করে তোলেন। এই মতবাদের কতিপয় প্রকরণ আছে। কিন্তু সব প্রকরণেরই সাধারণ বিষয়টা হলো বিবর্তনের ধারণা। এই ধারণার নির্দেশিকা হলো এমন কিছুর প্রতি যেটা নৈতিকভাবে মূল্যবান এবং যেটা সমগ্র দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণটা জানতে পারে। আমরা যেমনটা দেখেছি, স্যার জে আর্থার টমসন মনে করতেন যে, বিজ্ঞান অসম্পূর্ণ কারণ ‘কেন এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না। তার ভাবনায় ধর্ম এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। নক্ষত্র কেন সৃষ্টি করা হয়েছিল? সূর্য গ্রহদের সৃষ্টি করেছিল কেন? পৃথিবী ঠাণ্ডা হলো কেন এবং অবশেষে জীবনের উদ্ভব ঘটল কেন? কারণ, পরিশেষে, প্রশংসনীয় কিছু ঘটতে চলেছে। সেটা কি আমি জানি না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এরা সব বৈজ্ঞানিক ধর্মতাত্ত্বিক এবং ধর্মমনস্ক বিজ্ঞানী।
এই মতবাদের তিনটি প্রকরণ রয়েছে–ঈশ্বরবিশ্বাসী, সর্বেশ্বরবাদী এবং অন্যটিকে বলা যেতে পারে উত্থানশীল। প্রথমটি সহজতম এবং একান্তই গোঁড়া। এদের মতে, ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং প্রাকৃতিক নিয়মের বিধান দিয়েছেন কারণ তিনি পূর্বাহ্নে দেখাতে পেরেছেন কোনো এক সময়ে ভালো কিছু বিকশিত হবে। এই মতে, উদ্দেশ্যটা সচেতনভাবে স্রষ্টার মনে রয়েছে এবং এই স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির বাইরে থাকেন। সর্বেশ্বরবাদীর প্রকরণে, ঈশ্বর ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে থাকেন না, কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডকে বিবেচনা করা হয় একটা সমগ্র হিসাবে। সুতরাং সৃষ্টিকার্য বলে কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের অভ্যন্তরে এক ধরনের সৃষ্টিশীল শক্তি রয়েছে যা একটা পরিকল্পনা অনুসারে এটাকে বিকশিত করে। এটা করার গোটা প্রক্রিয়ার সময় সৃষ্টিশীল শক্তির মনে আগে থেকে এই পরিকল্পনাটা থাকতে পারে বলে বলা যায়। উত্থানশীল মতবাদের প্রকরণে উদ্দেশ্যটা অধিকতর দৃষ্টিহীন। পূর্বতন স্তরে ব্রহ্মাণ্ডের কিছুই পরবর্তী স্তরকে আগে থেকে দেখতে পারে না। কিন্তু এক ধরনের অন্ধ মানসিক ঝেকে ওইসব পরিবর্তনের দিকে চালিত করে, যা আরও বিকশিত প্রকরণ বাস্তবে নিয়ে আসে যাতে অন্য কোনো অজ্ঞাত ধারণার শুরুতেই পদ্ধতিটা অন্তর্নিহিত থাকে।
এই তিন ধরনের প্রকরণই বিবিসি আলোচনায় প্রতিনিধিত্ব করেছে যেটা নিয়ে আগেই আমি আলোচনা করেছি। বিরমিংহামের বিশপ ঈশ্বরবিশ্বাসী প্রকরণের পক্ষে বলেন। প্রফেসর জেএস হলডেন সর্বেশ্বরবাদী প্রকরণের পক্ষে এবং প্রফেসর আলেকজান্ডার বলেন উত্থানশীল প্রকরণের সপক্ষে। যদিও সম্ভবত এই শেষতম প্রকরণের অধিকতর প্রতিভূস্থানীয় প্রতিনিধি হলেন বার্গসন এবং প্রফেসর লয়েড মর্গান। এইসব মতবাদ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে মতাবলম্বীদের নিজেদের বক্তব্যে।
বিরমিংহামের বিশপ মনে করেন, মানুষের মনের সমধর্মী একটি বিচারবুদ্ধি এই ব্রহ্মাণ্ডে রয়েছে এবং এটা আমাদের সংশয়ী করে তোলে এই ধারণায় যে, মহাজাগতিক প্রক্রিয়া একটি মন দ্বারা পরিচালত নয়। এই সংশয়টা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তৎক্ষণাৎই আমরা জেনে যাই যে, এই বিশাল দৃশ্যপটে স্পষ্টতই একটা অগ্রগতি রয়েছে, যেটা সভ্য মানুষের সৃষ্টির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। ওই অগ্রগতি কি দৃষ্টিহীন শক্তির পরিণাম? আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে এটা বলতে যে, এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ….। বস্তুত, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লব্ধ আধুনিক জ্ঞান থেকে যে-স্বাভাবিক সিদ্ধান্তে আসতে হয় তা হল, ব্রহ্মাণ্ড চিন্তার প্রভাবের অধীন-চিন্তা যা সুনির্দিষ্ট পরিণামের দিকে ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত। এইরূপে, মানুষের সৃষ্টি ইলেকট্রন এবং প্রোটনের উপাদানের সম্পূর্ণ অজ্ঞেয় এবং পুরোপুরি অসম্ভব পরিণতি ছিল না। অথবা আপনি চাইলে এভাবেও বলতে পারেন স্পেস-টাইমের অবচ্ছিন্নতা, এটা ছিল কোনো মহাজাগতিক উদ্দেশ্যে এবং যে-লক্ষ্যের দিকে ওই উদ্দেশ্য কাজ করেছিল সেটাকে অবশ্যই দেখতে হবে মানুষের স্বাতন্ত্র্যসূচক গুণাবলী এবং ক্ষমতার মধ্যে। বস্তুত, মানুষের সর্বোচ্চ নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক সক্ষমতা মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের প্রকৃতি দেখিয়ে দেয় যেটা হলো তার সত্ত্বার উৎস।
যেমনটা আমরা দেখলাম যে, বিশপ সর্বেশ্বরবাদ প্রত্যাখ্যান করছেন, কারণ বিশ্বই যদি ঈশ্বর হন তাহলে বিশ্বের অশুভ সবকিছু ঈশ্বরের মধ্যে রয়েছে। এবং আরও এই কারণে যে, আমাদের অবশ্যই বলতে হবে ঈশ্বর তার ব্রহ্মাণ্ডের মতো সৃষ্টিতে নেই। তিনি স্পষ্টভাবে পৃথিবীর অমঙ্গল স্বীকার করেন এবং বলেন, আমরা বিমূঢ় যে, এত অমঙ্গল থাকবে এবং এই বিভ্রান্তি খ্রিস্টীয় আস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে প্রধান যুক্তি।’ প্রশংসনীয় সততায় তিনি এটা দেখানোর চেষ্টা করেননি যে, আমাদের বিভ্রান্তি অযৌক্তিক।
ড. বার্নেসের বিবরণ দু’ধরনের সমস্যা তৈরি করে। একদল যারা সাধারণভাবে মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং অন্যদল যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী প্রকরণের সঙ্গে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট। প্রথম দলের বিষয়ে আমি পরে বলব। পরের দলের বিষয়ে এখনই অবশ্যই কিছু বলতে হবে আমাকে।
উদ্দেশ্যের ধারণা হলো একটি স্বাভাবিক ধারণা যেটা সুদক্ষ কারিগরী মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আরব্য উপন্যাস ছাড়া একজন মানুষ একটি গৃহ পেতে চাইলে এটা তার বাসনা থেকেই পাওয়া যায় না। তার বাসনা চরিতার্থ করতে সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়। কিন্তু সর্বশক্তিমান এ-ধরনের কোনো সীমাবদ্ধতার অধীন নন। ঈশ্বর যদি মানবজাতি সম্পর্কে ভালোভাবে চিন্তা করেন–আমার কাছে এটা একটি আপাতদৃষ্টিতে অসঙ্গত প্রকল্প কেন তিনি, যেমনটা সৃষ্টিতত্ত্বে রয়েছে, তৎক্ষণাৎ মানুষ সৃষ্টি করতে উদ্যেগী হলেন না? ইসথাইসারস, ডাইনোসারস, ডিপলোডোসি, ম্যাস্টোডনস এবং অন্যান্য প্রাণীদের বিষয়েই-বা কী বলার?
কোথাও ড. বার্নেস নিজে স্বীকার করেছেন যে, ফিতে-কৃমির উদ্দেশ্যটাই একটা রহস্য। র্যাবিস এবং জলাতঙ্ক রোগে কী উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে? বলার মতো এটা কোনো উত্তর নয় যে, প্রাকৃতিক নিয়ম অপরিহার্যভাবে শুভ এবং অশুভ সৃষ্টি করে কারণ ঈশ্বরই প্রাকৃতিক নিয়মের বিধান দিয়েছেন। পাপের কারণে যে অমঙ্গল সেটাকে আমাদের মুক্ত ইচ্ছার ফল হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু মানব পূর্ব পৃথিবীতে অমঙ্গলের সমস্যা থেকেই যায়। আমার মনে হয় না উইলিয়াম গিলেসৃপির সমাধান বার্নেস গ্রহণ করবেন। গিলেসৃপির সমাধানের কথা, শিকারী পশুদের দেহে শয়তান বাস করত, যাদের প্রথম পাপ পশুসৃষ্টির পূর্বতন সময়ের। তবুও এটা বোঝা অসুবিধাজনক যে, অন্যান্য যৌক্তিকভাবে সন্তোষজনক উত্তর কী হতে পারে। এ-অসুবিধাটা প্রাচীন কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তব। সর্বশক্তিমান এক সত্ত্বা যিনি পাপ থেকে উদ্ভূত নয়, এমন একটা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনি তো নিজেও অন্ততপক্ষে আংশিক অমঙ্গল।(১)
এই আপত্তিতে মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের সর্বেশ্বরবাদী এবং উত্থানশীল মতবাদের প্রকরণ কম উন্মোচিত হয়।
সংশ্লিষ্ট সর্বেশ্বরবাদের নির্দিষ্ট স্থান অনুসারে সর্বেশ্বরবাদী বিবর্তনের বৈচিত্র্য রয়েছে। আমাদের বিবেচনায় জে এস হলডেনের এই মতবাদটা হেগেলের সঙ্গে সংযুক্ত এবং হেগেলের সব কিছুর মতোই এটা বোঝাও খুব সহজ নয়। কিন্তু এই ধারণাটা এমনই যে, গত একশো বছরের বেশি সময় ধরে এটার যথেষ্ট প্রভাব ছিল এবং সে-কারণেই এটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। অধিকন্তু, প্রফেসর হলডেন নানাবিধ বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর কাজের জন্য প্রখ্যাত। তিনি তাঁর সাধারণ দর্শনকেও বিশদ অনুসন্ধানে দৃষ্টান্তের সাহায্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এটা তিনি বিশেষভাবে করেছেন শারীরবিজ্ঞানে। যুক্তির সাহায্যে এটা দেখানো তার কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল যে, রসায়নবিদ্যা এবং পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম ছাড়াও জীবন্ত দেহের বিজ্ঞানের জন্য অন্য নিয়মও দরকার। এই ঘটনা তার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুত্ব বাড়িয়েছে।
এই দর্শন অনুযায়ী বিশেষভাবে বলতে গেলে, মৃত বস্তু বলে কোনো দ্রব্য নেই, এমন কোনো জীবন্ত দ্রব্য নেই যার মধ্যে অন্তত কিছুটা পরিমাণে চৈতন্যের প্রকৃতি নেই। এবং এক পা এগিয়ে বলতে হয়, এমন কোনো চৈতন্য নেই যা অন্তত কিছু পরিমাণে ঐশ্বরিক নয়। দৃষ্টিগোচরতা এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য যা আমরা এর আগের অধ্যায়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি, সেটা প্রফেসর হলডেনের দৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট, যদিও তিনি এটার উল্লেখ করেন না। কিন্তু এখন, হেগেলের প্রসঙ্গে এটা প্রকারের পার্থক্য নয়, পরিমাণের পার্থক্য হয়ে উঠেছে। মৃত বস্তু কম বাস্তব, জীবন্ত বস্তু আর একটু বেশি পরিমাণে বাস্তব, মানবীয় চৈতন্য আরও একটু বেশি। কিন্তু কেবলমাত্র সম্পূর্ণ বাস্তবতা হলো ঈশ্বর অর্থাৎব্রহ্মাণ্ড যাকে ঈশ্বরীয় বলে ধারণা করা হয়। হেগেল এসব ধারণার যৌক্তিক প্রমাণ প্রদানের প্রয়াস করেন, কিন্তু আমরা এখানে এসব আলোচনা এড়িয়ে যাব কারণ এসব আলোচনা একটা মহাভারত হয়ে যাবে। আমরা বরঞ্চ প্রফেসর হলডেনের ধারণার বিশদ আলোচনা করব বিবিসি আলোচনা থেকে কতিপয় উদ্ধৃতি সহকারে।
তিনি বলেন, আমরা যদি আমাদের জীবনদর্শনের একমাত্র ভিত্তিকে অধিযান্ত্রিক হিসাবে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হই, তাহলে ঐতিহ্যগত ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অন্যান্য অনেক সাধারণ বিশ্বাসকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করতে হবে।’ সৌভাগ্যবশত তিনি ভাবেন যে, সবকিছু অধিযান্ত্রিকভাবে অর্থাৎ রসায়নবিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যার সাহায্যে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। বাস্তবিকপক্ষে এটা সম্ভবও নয়, কারণ জীববিদ্যায় জীবসত্ত্বার ধারণা প্রয়োজন। ভৌত দৃষ্টিকোণ থেকে জীবন চলমান অলৌকিকতা থেকে কিছু কম নয়। উত্তরাধিকারমূলক সঞ্চার…নিজেই সূচিত করে জীবনের পৃথকীকরণ বৈশিষ্ট্য, যেমন সুসংহত ঐক্য সর্বদা নিজেকে রক্ষা ও পুনরুৎপাদনে সচেষ্ট।
‘আমরা যদি ধরে নেই যে, জীবন প্রকৃতিতে সহজাত নয়, এবং জীবনের অস্তিত্বের আগে অবশ্যই একটা সময় ছিল, এটা তাহলে একটা অসমর্থিত ধারণা যা জীবনের আবির্ভাবকে পুরোপুরি অবোধগম্য করে তোলে।‘ ঘটনা হল, আমাদের অভিজ্ঞতার একটা চূড়ান্ত অধিযান্ত্রিক অথবা গাণিতিক ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে জীববিজ্ঞান তার দরজা চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেয়। এই ঘটনাটা ধর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণার বিষয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। জীবনের প্রতি সচেতন আচরণের সম্পর্ক, যান্ত্রিকতার প্রতি জীবনের আচরণের সম্পর্কের অনুরূপ। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার জন্য বর্তমান কোনো স্বল্পস্থায়ী মুহূর্ত নয়। এটা নিজের মধ্যে অতীত এবং ভবিষ্যৎ দুটোকেই ধারণ করে। জীববিজ্ঞানের জীবসত্ত্বার ধারণা প্রয়োজন, সুতরায় মনস্তত্বের দরকার ব্যক্তিত্বের। একজন ব্যক্তি সম্পর্কে এটা ভাবা ভুল যে, সে কেবল একটা আত্মা’ এবং একটা শরীর নিয়ে গঠিত। অথবা এটা ধরে নেওয়াও ভুল যে, আমরা বাহ্যিক পৃথিবী নয়, কেবল সংবেদনশীলতাকেই জানি, কারণ সত্যের নিরিখে পরিপার্শ্ব আমাদের সত্ত্বার বাইরে নয়। স্থান এবং সময় ব্যক্তিত্বকে পৃথক করে না, এরা এর মধ্যে একটা শৃঙ্খলাকে ব্যক্ত করে যাতে স্থান ও সময়ের প্রকাণ্ডতা এর মধ্যেই থাকে, এমনটাই কান্ট দেখেছিলেন। ব্যক্তিসত্ত্বাগুলোর একটি অন্যটিকে বর্জন করে না। আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে এটি একটি নিছক মৌলিক ঘটনা যে, সত্যের একটি সক্রিয় আদর্শ, ন্যায়বিচার, দানশীলতা এবং সৌন্দর্য প্রভৃতি সর্বদাই আমাদের কাছে উপস্থিত এবং এটাই আমাদের আগ্রহ, কিন্তু কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আগ্রহ নয়। অধিকন্তু, আদর্শটা একটিই আদর্শ, যদিও এর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ রয়েছে।
এই বক্তব্য থেকে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত, একক ব্যক্তিসত্ত্বা থেকে ঈশ্বরে পৌঁছানো। ব্যক্তিত্ব নিছক ব্যক্তিগত নয়। এই ঘটনায় এটা আমরা ঈশ্বরের উপস্থিতি হিসাবে স্বীকার করি–ঈশ্বর আমাদের বাইরের কোনো সত্ত্বা হিসাবে উপস্থিত নন কিন্তু আমাদের মধ্যে, আমাদের পারিপার্শ্বে ব্যক্তিত্বসমূহের মধ্যে ব্যক্তিত্ব হিসাবে বর্তমান।
‘কেবলমাত্র আমাদের মধ্যেই, আমাদের সত্যের সক্রিয় আদর্শ ন্যায়, দানশীলতা এবং সৌন্দর্য্যের মধ্যে, এবং অন্যদের সঙ্গে সংঘটিত সৌহার্দের মধ্যে আমরা ঈশ্বরের প্রকাশ প্রত্যক্ষ করি। আমাদের বলা হয়েছে স্বাধীনতা এবং অমরত্বের মালিক ঈশ্বর, কোনো ব্যক্তি মানুষ নয়। কারণ এই ব্যক্তি মানুষ, যেভাবেই হোক না কেন পুরোপুরি বাস্তব নন। গোটা মানবজাতি লুপ্ত করে দিলেও, ঈশ্বর একাই সমুদয় চিরন্তনতা থেকে কেবলমাত্র বাস্তব সত্ত্বা হবেন এবং তার অস্তিত্বে আমাদের মধ্যে যা বাস্তব তাই বেঁচে থাকবে।’
একটা সান্ত্বনাযযাগ্য শেষ ভাবনা : ঈশ্বরের একমাত্র বাস্তবতা থেকে এটা বলতে হবে যে, গরিবের গরিব হবার জন্য কিছু মনে করা উচিত নয়। অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতার মতো চলমান মুহূর্তের অবাস্তব ছায়া’ ধরার চেষ্টা নির্বুদ্ধিতা। গরিবের বাস্তবটা ধনীর চেয়ে অধিকতর সন্তোষজনক। যারা উপবাসে রয়েছে তাদের পক্ষে এটা স্মরণ আরামদায়ক হবে যে, একমাত্র অন্তিম পরিণাম হলো আধ্যাত্মিক অথবা ব্যক্তিগত বাস্তবতা যেটা আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব দিয়ে নির্দেশ করি।
এই তত্ত্ব অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করে। আমরা সব থেকে নির্দিষ্ট বিষয়টা নিয়ে শুরু করছি। কোন অর্থে, যদি কোনো অর্থ থাকে, জীববিদ্যা কেন পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নশাস্ত্রে রূপান্তরযোগ্য হবে না? কিংবা মনোবিদ্যা জীববিদ্যায়?
রসায়নশাস্ত্র এবং পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে জীববিদ্যার সম্পর্কে প্রফেসর হলডেনের ধারণাটা এখন বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা মান্য করেন না। হলডেনের মতের বিপরীত প্রশংসনীয় বক্তব্যটা জ্যাকুইস লোয়েবের ১৯১২ সালে প্রকাশিত পুস্তক The Mechanistic Conception of Life গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই বইয়ের দারুণ মজাদার কতিপয় অধ্যায় পুনরুৎপাদন সম্পর্কে পরীক্ষণের ফলাফল জানায়। প্রফেসর হলডেনের মতে এগুলো যান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী অনির্ণেয়। অধিযান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিটা যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণযোগ্য হয়ে Encyclopaedia Britannica-এর শেষ সংস্করণে অন্তভূক্ত করা হয়েছে। এখানে মি.ই এস ডেরিচ ‘বিবর্তন’ শিরোনামে বলেন, তাহলে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকারীর ধারণায় একটি জীবন্ত জীবসত্ত্বা হলো স্ব-নিয়ন্ত্রিত, স্ব-সংস্কারমূলক, ভৌত-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সমষ্টি যা ছেদহীন আন্তঃনির্ভর ক্রম গঠন করে এবং এর মধ্যে কোনো রহস্যজনক বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ নেই।
জীবন্ত বস্তুতে এমন প্রক্রিয়া রয়েছে যা পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নশাস্ত্রে হ্রাসযোগ্য নয়, এমন কোনো ইঙ্গিতের জন্য আপনার এই লেখাটা পড়া বৃথা হবে।
লেখক এটা বলছেন যে, জীবন্ত এবং মৃত বস্তুর মধ্যে কোনো স্পষ্ট রেখা নেই, জীবন্ত এবং মৃত বস্তুর মধ্যে কোনো বাঁধাধরা রেখা টানা যায় না। কোনো বিশেষ জীবন্ত রাসায়নিক দ্রব্য, মৃত বস্তু থেকে পৃথক বিশেষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এবং কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শক্তিকে কাজ করতে দেখা যায় না। প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ধারিত হয় পূর্ববর্তী কোনো কিছুর দ্বারা এবং যা অনুসৃত হয় তাকে নির্ধারণ করে। জীবনের উৎস সম্পর্কে ‘এটা ধরে নিতেই হবে যে, বহুপূর্বে যখন অবস্থা অনুকূলে এল, নানা ধরনের তুলনামূলকভাবে উন্নত যৌগ তৈরি হলো। এসবের অনেকগুলো সম্পূর্ণ অস্থায়ী হবে, গঠনের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়বে, অন্যগুলো স্থায়ী এবং পুরোপুরি থেকে যাবে। কিন্তু আরও অন্যেরা যত দ্রুত ভাঙবে ততই পুনর্গঠিত এবং সংলগ্ন হতে চেষ্টা করবে। একবার এভাবে শুরু করে এ-ধরনের বিকাশশীল যৌগ অথবা মিশ্রণ অবশ্যম্ভাবীভাবে নিজেকে চিরস্থায়ী করে তুলতে চায় এবং অন্যদের যারা কম জটিল তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে অথবা অন্যদের খাদ্য হিসাবে পেতে চায়। প্রফেসর হলডেনের থেকে পৃথক এই ধারণা বর্তমানের জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রবল। তারা এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেন যে, জীবন্ত এবং মৃত বস্তুর মধ্যে কোনো স্পষ্ট রেখা নেই। কিন্তু প্রফেসর হলডেন মনে করেন যে, আমরা যাকে মৃত বস্তু বলে ভাবি সেটি সত্যিকারে জীবন্ত বস্তু। জীববিজ্ঞানীদের অধিকাংশ মনে করেন যে, জীবন্ত বস্তু আসলে একটি ভৌত রাসায়নিক যান্ত্রিকতা।
শারীরবিদ্যা এবং মনস্তত্ত্বের মধ্যে সম্পর্কের প্রশ্নটা অধিকতর জটিল। এ নিয়ে দুটো স্পষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের শারীরিক আচরণ কি কেবলমাত্র মনস্তাত্ত্বিক কারণে ঘটে বলে ধরা যাবে? মনের ঘটনার সঙ্গে দেহের সংঘটনশীল কার্যাবলীর সম্পর্ক কী? কেবলমাত্র শারীরিক আচরণই কি মানুষের পর্যবেক্ষণের জন্য উন্মুক্ত? আমাদের চিন্তা অন্যেরা অবধারণ করতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র আমরাই সেটা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারি। অন্ততপক্ষে এটাই আমাদের সাধারণ জ্ঞানের কথা। তাত্ত্বিক কড়াকড়িতে আমরা শরীরের কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করতে পারি না, কিন্তু প্রত্যক্ষ করি কতিপয় ফলাফল যেগুলো আমাদের উপর বর্তায়। একই সময়ে অন্যেরা যা প্রত্যক্ষ করে সেটা একরকম হতে পারে, কিন্তু তাদের এই প্রত্যক্ষ করাটা আমাদের প্রত্যক্ষ করা থেকে পরিমাণে কম-বা বেশি হবে। এটা এবং অন্যান্য কারণে পদার্থবিজ্ঞান এবং মনস্তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্যটা আগে-ভাবা পার্থক্যের মতো অতটা প্রশস্ত নয়। কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আমরা কী দেখব সেটা পদার্থবিদ্যা অগ্রিম জানাতে পারে এবং এই অর্থে পদার্থবিজ্ঞান মনোবিদ্যার একটা শাখা কারণ আমাদের প্রত্যক্ষ করার বিষয়টা একটা মানসিক ঘটনা। সেইসব অভিলাষ যেগুলো কেবল অভিজ্ঞতালব্ধ, তাকে প্রমাণযোগ্য ঘোষণা করে সেগুলোর মাধ্যমে এই দৃষ্টিকোণ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সামনে চলে এসেছে। এর সাথে এই ঘটনাটাও যুক্ত থাকে যে, একটা সত্যতা নিরূপণ সর্বদা মানুষের দ্বারা একটা প্রত্যক্ষকরণ এবং সেই কারণে এটা একটা এমন ঘটনা যা মনস্তত্ব বিবেচনা করে। কিন্তু এসব কিছুই তাদের অনুশীলনে নয়, দুটো বিজ্ঞানের দর্শনের অন্তর্ভুক্ত। বিষয়বস্তুগত সৌহার্দ সত্ত্বেও এদের প্রকরণ স্বতন্ত্রই থাকে।
ঠিক আগের অনুচ্ছেদের শুরুতে উত্থাপিত প্রশ্ন দুটো, যে-দুটো প্রশ্নের বিষয় আগের একটা অধ্যায়েও দেখেছি, সেখানে ফিরে গিয়ে বলতে হয়, যদি আমাদের সমুদয় শারীরিক ক্রিয়াকলাপের শারীরবিদ্যাগত কারণ থাকে, তাহলে আমাদের মন কার্য-কারণগতভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। কেবলমাত্র শারীরিক কাজের দ্বারা আমরা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি, অথবা বাইরের পৃথিবীর উপর কোনো ফলাফল পেতে পারি, যেগুলোকে আমরা কেবল বস্তু বলেই ভাবি যদি এটা আমাদের শরীর যা করে তাকে প্রভাবিত করতে পারে। যাই হোক, যা মানসিক এবং যা শারীরিক, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো কেবল একটা সুবিধার বিষয়। আমাদের শারীরিক কাজের কারণসমূহ পুরোপুরি পদার্থবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, এবং মানসিক ঘটনাসমূহ এসবের কারণ হতে পারে। বাস্তব বিষয়টা মন এবং শরীরের সংশ্লিষ্টতায় বর্ণনা করা যাবে না। এটা সম্ভবত এভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে, আমাদের শারীরিক ক্রিয়াসমূহ কি ভৌত-রাসায়নিক নিয়মে নির্ধারিত? এবং যদি সেটাই হয়, তা সত্ত্বেও মনস্তত্ত্বের একটা স্বাধীন-বিজ্ঞান কি এখানে নেই, যার মধ্যে কৃত্রিমভাবে গঠিত বস্তুর ধারণার হস্তক্ষেপ ছাড়া আমরা মানসিক ঘটনাগুলোকে সরাসরি বুঝতে চাই?
কোনো আস্থা সহকারে এই দুটো প্রশ্নের কোনোটারই উত্তর দেওয়া যাবে না, যদিও প্রথম প্রশ্নটার সদর্থক উত্তরের সপক্ষে কিছু সাক্ষ্য রয়েছে। সাক্ষ্যটা প্রত্যক্ষ নয়, আমরা যেভাবে শুক্রগ্রহের চলাফেরা নির্ণয় করি, সেভাবে মানুষের গতিবিধি নির্ণর করতে পারি না। কিন্তু মানুষের শরীর এবং নিম্নতর জীবনের ধরনের মধ্যে কোনো স্পষ্ট রেখা টানা যায় না। কোথাও এমন কোনো ফাঁক নেই যা আমাদের এমনটা বলতে প্রলুব্ধ করবে–এখানে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নবিদ্যা পর্যাপ্ত নয়। এবং এতক্ষণ আমরা যা দেখলাম, জীবন্ত এবং মৃত দ্রব্যের মধ্যে কোনো স্পষ্ট রেখা নেই। সুতরাং এটা সম্ভাব্য মনে হয় যে, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নবিদ্যা সর্বাংশে সর্বোচ্চ।
মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের স্বাধীন সম্ভাবনা সম্পর্কে এই মুহূর্তে কমই বলা যাবে। কতক পরিমাণে মনোবিশ্লেষণ এই ধরনের বিজ্ঞান নির্মাণে চেষ্টা চালিয়েছে। এই প্রচেষ্টা শারীরবিদ্যাগত কার্য-কারণ এড়াতে চায় বলে এর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। দ্বিধা নিয়েও আমি এই ধারণার পক্ষে যে, পদার্থবিজ্ঞান এবং মনস্তত্ত্বের মিলনে পরিশেষে এটা বিজ্ঞান হয়ে উঠবে, যদিও সেটা হবে এর বর্তমান বিকাশ থেকে পৃথক। পদার্থবিজ্ঞানের প্রকরণের বিকাশ ঘটেছে, ‘বস্তুর’ অধিবিদ্যক বাস্তবতায় বিশ্বাসের প্রভাবে। এই বিশ্বাস কিন্তু আজ আর বেঁচে নেই। একটা নতুন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ভিন্নতর প্রকরণ তৈরি করেছে যেটা মিথ্যা অধিবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। মনস্তত্ত্বের প্রকরণও কতক পরিমাণে মনের’ অধিবিদ্যক বাস্তবতায় বিশ্বাসের প্রভাবে বিকশিত হয়েছিল। এটা সম্ভব বলেই মনে হয় যে, যখন পদার্থবিজ্ঞান এবং মনস্তত্ত্ব এইসব দীর্ঘস্থায়ী ক্রটি থেকে পুরোপুরি মুক্ত হবে, এরা তখন দুটোই মিলে গিয়ে একটা বিজ্ঞানে পরিণত হবে। এই বিজ্ঞানটা তখন মন অথবা পদার্থ কোনোটা নিয়েই কাজ করবে না, কাজ করবে একমাত্র ঘটনা নিয়ে। এবং এই ঘটনাগুলোকে শারীরিক কিংবা মানসিক বলে লেবেল এঁটে দেবে না। ইতিমধ্যে মনস্তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক মর্যাদার প্রশ্নটা অবশ্যই খোলা থাকবে।
যাই হোক, মনস্তত্ত্ব বিষয়ে প্রফেসর হলডেনের ধারণা একটা সংকীর্ণতর বিষয় উত্থাপন করে। সেটা হলো, কোন ব্যাপারে অনেক বেশি নির্দিষ্ট বস্তুসমূহের কথা বলা যায়। তিনি মনে করেন যে, মনস্তত্ত্বের স্বাতন্ত্র্য নির্দেশক ধারণা হলো ব্যক্তিত্ব। এই শব্দটাকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেন না, কিন্তু আমরা এটার অর্থ এটা করতে পারি কিছু একীভূত নীতি, যা একটা মনের সংঘটক উপাদানগুলোকে একত্রে বেঁধে রাখে। এবং এগুলো একে অন্যকে পরিমার্জিত করে। ধারণাটা অস্পষ্ট। এটার অর্থ আত্মা’ এখনও সমর্থনযোগ্য। নেহাৎ সত্ত্বা হিসাবে এটা আত্মা থেকে পৃথক নয় শুধু, কিন্তু সামাজিকতার এক ধরনের গুণ। যারা এটাতে বিশ্বাস করেন তাঁরা ভাবেন যে, জন স্মিথের মনের মধ্যে সব কিছুর জন্য স্মিথি গুণ রয়েছে যা অন্য যে-কোনো ব্যক্তির মনের কোনো কিছুর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া অসম্ভব। আপনি যদি জন স্মিথের মনের একটা বৈজ্ঞানিক বিবরণ দিতে চেষ্টা করেন, তাহলে আপনি সাধারণ নিয়ম নিয়ে সন্তুষ্ট হবেন না, যেমনটা সমস্ত বস্তুর অংশ নিয়ে, এলোমেলোভাবে দেওয়া সম্ভব। আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো ওই বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ঘটছে এবং তার পূর্ণ ইতিহাস তো চরিত্রের কারণে সেসব যা,তাই রয়েছে।
এই ধারণার কতিপয় আকর্ষণীয় দিক রয়েছে কিন্তু আমি এটাকে সত্য বলার মতো কোনো কারণ দেখি না। এটা অবশ্যই বোধগম্য যে, তাদের অতীত ইতিহাসের পার্থক্যের জন্য দু’জন মানুষ একই পরিস্থিতিতে বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। দুই টুকরো লোহা যার একটিকে চুম্বকিত করা হয়েছে এবং অন্যটিকে করা হয়নি, এদের ক্ষেত্রেও এটা একইভাবে সত্য। কারোর ধারণায় স্মৃতিশক্তি মস্তিষ্কে খোদিত থাকে এবং শারীরিক গঠনের ভিন্নতার মাধ্যমে এটা আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। একই অবস্থা চরিত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একজন মানুষ যদি ক্রুদ্ধ এবং অন্যজন যদি স্বভাব-শীতল হন, এদের এই পার্থক্য গ্রন্থি থেকে নির্ণয়যোগ্য। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভেষজ প্রয়োগে এটা বিলুপ্ত করা সম্ভব। ব্যক্তিত্ব রহস্যময় এবং অরূপান্তরযোগ্য, এমন বিশ্বাসের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এই বিশ্বাসটা গ্রহণ করার প্রধান কারণ এটা আমাদের মানবীয় আত্মশ্লাঘার পক্ষে একটি স্তাবকতা।
পুনরায় দুটো বিবৃতি বিচার করুন। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার জন্য বর্তমানটা আর ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত নয়, এটা অতীত এবং ভবিষ্যৎ দুটোকেই নিজের মধ্যে ধারণ করে। এবং স্থান ও সময় ব্যক্তিত্বকে পৃথক করে না; এরা এর মধ্যে একটা ক্রমকে ব্যক্ত করে। অতীত এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে, আমার মনে হয়, প্রফেসর হলডেনের মনে এমন বিষয় রয়েছে, যেটা আমাদের এমন একটা অবস্থা যখন আমরা বিদ্যুৎ চমকাতে দেখি এবং তখনই বজ্রপাতের প্রত্যাশা করি। এটাকে এভাবে বলা যায় যে, বিদ্যুৎ-চমক–এটা হলো অতীত এবং বজ্রপাত–এটা ভবিষ্যৎ, উভয়ই আমাদের বর্তমান মানসিক অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু পরোক্ষ উপমা দিয়ে এটাকে বিপথে চালিত করতে হয়। বিদ্যুতের স্মরণ বিদ্যুৎ নয় এবং বজ্রপাতের প্রত্যাশাও বজ্রপাত নয়। আমি কেবল এটাই ভাবছি না যে, স্মরণ এবং প্রত্যাশার কোনো শারীরিক ফলশ্রুতি নেই, আসলে আমি আত্মগত অভিজ্ঞতার যথার্থ গুণের কথা চিন্তা করছি–দেখাটা এক জিনিস, স্মরণ করাটা অন্য, শোনাটা এক জিনিস, প্রত্যাশা করাটা অন্য। মনস্তত্ত্ব কিংবা অন্যত্র অতীত এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে বর্তমানের সম্পর্ক হলো কার্য-কারণগত সম্পক, এ সম্পর্কটা কিন্তু ব্যাখ্যাজাত সম্পর্ক নয়। (অবশ্যই আমি এটা বলতে চাইছি না যে, আমার প্রত্যাশাই বজ্রপাত ঘটায়। কিন্তু বিদ্যুৎ-চমকের পরেই বজ্রপাতের অতীত ঘটনা এবং বর্তমানের বিদ্যুৎ চমক মিলে বজ্রপাতের প্রত্যাশা জাগায়। স্মৃতি অতীতের অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করে না, এটা কেবল একটা উপায় যার মধ্যে দিয়ে অতীতের ফলোদয় ঘটে ।)
স্থান বিষয়ে বলার, বস্তু একই ধরনের কিন্তু অধিকতর জটিল। দু’ধরনের স্থানের ধারণা রয়েছে। এর একটার মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসমূহ এবং সেটা পদার্থবিদ্যা, যার মধ্যে আছে অন্য ব্যক্তিদের শরীর, চেয়ার-টেবিল, সূর্য চন্দ্র এবং নক্ষত্র। এগুলো সব কেবলমাত্র আমাদের ব্যক্তিগত অনুভবের মধ্যেই নয়, কিন্তু এগুলো ওইসব জিনিসের মধ্যে বিদ্যমান যেমনটা আমরা ধরে নেই। দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে প্রকল্পিত এবং যথার্থ তর্কবিদ্যায় যে-কোনো ব্যক্তি এটা অস্বীকার করতে পারে, যে-ব্যক্তি এমনটা ধরে নিতে ইচ্ছুক যে, পৃথিবীতে তার নিজের অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নেই। প্রফেসর হলডেন এমনটা বলতে ইচ্ছুক নন, সুতরাং তিনি অবশ্যই স্বীকার করেন যে, স্থান যা বস্তুকে ধারণ করে সেটা তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে পৃথক। স্থানের ব্যক্তিগত ধরন সম্পর্কে বলার, দৃশ্যগত স্থান আমার সমুদয় দৃশ্যগত অভিজ্ঞতা ধারণ করে। এছাড়া স্পর্শগত স্থান রয়েছে, যেমনটা উইলিয়াম জেমস নির্দেশ করেছিলেন। অসংখ্যা বস্তুনিচয়ের মধ্যে একটি বস্তু হিসাবে যখন আমি বিবেচিত হই তখন আত্মগত স্থানের প্রতিটি ধরন আমার মধ্যেই থাকে। নক্ষত্রখচিত যে আকাশ আমি দেখি সেটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের নক্ষত্রখচিত দূরতম আকাশ নয়। এটা হলো আমার উপর নক্ষত্রদের ফলশ্রুতি। যেটা আমি দেখি সেটা আমারই মধ্যে, আমার দেহের বাইরে নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নক্ষত্রমণ্ডলী ভৌতিক স্থানে, যেগুলো আমার শরীরের বাইরে কিন্তু যেগুলোতে আমি পৌঁছই আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণে নয়, ওখানে পৌঁছই অবধারণের সাহায্যে। প্রফেসর হলডেনের বিবৃতি, স্থান ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা ক্রম নির্দেশ করে। একথাটা ঠিক আমার ব্যক্তিগত স্থান সম্পর্কে কিন্তু ভৌত স্থান সম্পর্কে নয়। এই প্রসঙ্গে তার অন্য বিবৃতিটি স্থান ব্যক্তিত্বকে বিচ্ছিন্ন করে না– এটা কেবলমাত্র তখনই সত্য হবে যদি ভৌত স্থানটাও আমার মধ্যেই থাকে। যে-মুহূর্তে এই বিভ্রান্তি দূরীভূত হয়, তখনই তার অবস্থান গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
যারা হেগেলকে অনুসরণ করেন, তাঁদের সকলের মতো হলডেনও এটা দেখাতে উদগ্রীব যে, সত্যি সত্যি কোনো কিছুই অন্য কিছু থেকে পৃথক নয়। কেউ যদি তাঁর যুক্তি গ্রহণ করেন, তিনি এখন এটা দেখিয়েছেন যে, প্রতিটি মানুষের অতীত এবং ভবিষ্যৎ তার বর্তমানের সঙ্গে সহাবস্থান করে এবং যে-স্থানের মধ্যে আমরা সবাই বাস করি সেটাও আমাদের মধ্যেই বর্তমান। কিন্তু প্রমাণস্বরূপ তাঁকে আর একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে, ব্যক্তিত্বসমূহের একটি অন্যটিকে বর্জন করে না। এটা দেখা যায় যে, একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তাঁর আদর্শ দ্বারা গঠিত এবং আমাদের আদর্শসমূহ সবই সমান। আমি আর একবার তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করছি, সত্যের সক্রিয় আদর্শ, ন্যায়, দানশীলতা এবং সৌন্দর্য সর্বদা আমাদের কাছে উপস্থিত…। অধিকন্তু, আদর্শটা হলো, এক আদর্শ, যদিও এর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ রয়েছে। এসব সাধারণ আদর্শ এবং যে-সৌহার্দ তারা তৈরি করে তা থেকেই ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটে।
আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এই ধরনের বিবৃতি আমাকে খাবি খাওয়ায় এবং আমি বুঝতেই পারি না, কোথা থেকে শুরু করতে হবে। আমি প্রফেসর হলডেনের কথায় সংশয় প্রকাশ করি না যখন তিনি বলেন যে, সত্যের একটা সক্রিয় আদর্শ, ন্যায়, দানশীলতা এবং সৌন্দর্য, সর্বদা তাঁর মধ্যে বর্তমান। আমি নিশ্চিত, অবশ্যই এমনটা হবে কারণ তিনিই এটা বলেছেন। কিন্তু যখন এই সদাচারের অসাধারণ পরিমাণ সাধারণভাবে মানবজাতির কল্যাণে আরোপ করা হয়, তখন আমার মনে হয় আমার মতবাদে আমার সন্নিষ্ঠ থাকার অধিকার আছে, যেমনটা রয়েছে তার নিজের। আমি তো আমার মতো করে দেখতে পাচ্ছি যে, অসত্য, অন্যায়, অদানশীলতা এবং কদর্যতা প্রভৃতি অনুসৃত হচ্ছে, কেবলমাত্র ঘটনায় নয়, আদর্শ হিসাবেও। তিনি কী সত্যি সত্যি ভাবেন যে, হিটলার এবং আইনস্টাইনের ‘একই আদর্শ যদিও এর দৃষ্টিকোণ পৃথক? আমার মনে হয় যে, এ-ধরনের বিবৃতির জন্য প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ আনা যেতে পারে। অবশ্যই এমনটা বলা যায় যে, এদের একজন খলনায়ক এবং নিজের অন্তরে থাকা যে আদর্শে তিনি বিশ্বাস করেন সেটা তিনি অনুসরণ করছেন না। কিন্তু আমার কাছে এটা একটা সহজসাধ্য সমাধান বলে মনে হয়। হিটলারের আদর্শ প্রধানত নিৎসের কাছ থেকে এসেছে যার মধ্যে সম্পূর্ণ আন্তরিকতার প্রতিটি সাক্ষ্য রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত হেগেলের দ্বান্দ্বিকতা ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে এই বিষয়টা হটানোনা যাবে, ততক্ষণ আমি বুঝতে পারছি না আমরা কীভাবে জানবো যে, ঈশ্বর, যার মধ্যে আদর্শটি মূর্তমান, তিনি জিহ্বা অথবা ওটান।
এই ধারণাটা যে, ঈশ্বরের চিরন্তন স্বর্গসুখ গরিবের কাছে একটা স্বাচ্ছন্দ্য, এটা তো সর্বদা ধনীদেরই রয়েছে, কিন্তু গরিবরা এতে তো চরম বীতশ্রদ্ধ হতে শুরু করেছে। সম্ভবত, এ-সময় পর্যন্ত ঈশ্বরের এই ধারণাকে আর্থিক অবিচারের সমর্থনে সংযুক্ত করা আদৌ বিচক্ষণ হবে না।
মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের ঈশ্বরবিশ্বাসী মতবাদের মতো সর্বেশ্বরবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, সময় যদি শেষাবধি বাস্তব না হয়, তাহলে বিশ্ব ইতিহাসের সর্বোত্তম জিনিসগুলো আগে না এসে, পরে আসে কেন? বিপরীত ক্রমটা কী সঠিক হতে পারত না? ঘটনাসমূহের তারিখ থাকাটা যদি বিভ্রম হয়, যে-বিভ্রম থেকে ঈশ্বর মুক্ত, তাহলে তিনি কেন প্রীতিজনক ঘটনাবলীকে শেষে ঘটিয়ে অপ্রীতিজনক ঘটনাসমূহকে প্রথম ঘটান? এই বিষয়টার ভাবনায় আমি ডিন ইনগের সঙ্গে একমত যে, এই প্রশ্নটা উত্তরহীন।
এর পরেই আমরা ‘উত্থানশীল’ মতবাদের আলোচনায় গিয়ে বলতে পারি যে, এই মতটা এই অসুবিধা এড়াতে পারে এবং দৃঢ়ভাবে সময়ের বাস্তবতা সমর্থন করে। কিন্তু আমরা এটা দেখব যে, এই মতবাদ বেশ বড়ো মাপের অন্যান্য অসুবিধা ডেকে আনে।
বিবিসি-র আলোচনার পরিধিতে, যেখান থেকে আমি এইসব উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করছি, সেখানে এই ‘উত্থানশীল’ মতবাদের একমাত্র প্রতিনিধি প্রফেসর আলেকজান্ডার। তিনি শুরু করেন এটা বলে যে, মৃত বস্তু, জীবন্ত বস্তু, এবং মন পরম্পরাগতভাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং তিনি বলে চলেন যে, ‘মি. লয়েড মরগান এই ধারণা এবং এই শব্দটি প্রচলন এবং পুনঃপ্রচলন করেছেন। এখন তাঁর ধারণার বিকশিত রূপ হলো উত্থানশীলতা। জীবন, বস্তু থেকে আবির্ভূত হয় এবং মন, আবির্ভূত হয় জীবন থেকে। একটি জীবন্ত সত্ত্বা একটি বস্তুগত সত্ত্বাও বটে। কিন্তু একটি নতুন গুণ প্রমাণে এত সচেষ্ট যে এই নতুন গুণটাই হলো জীবন। জীবন থেকে মনে উত্তরণের ব্যাপারে এই একই কথা বলা যায়। একটি মননশীল সত্ত্বা একই জীবন্ত সত্ত্বা। কিন্তু বিকাশের এত জটিলতা, এর কোন্ অংশে এত সূক্ষ্মভাবে এটা সংগঠিত বিশেষত স্নায়ুতন্ত্রে? এই স্নায়ুতন্ত্র মনকে বহন করে। আপনি চাইলে এটাকে চৈতন্যও বলতে পারেন।
তিনি আরও বলেন যে, এমন কোনো কারণ নেই যার ফলে এই প্রক্রিয়া মনের সঙ্গে থেমে যাবে। পক্ষান্তরে, এটা মনের অতীত একটি অতিরিক্ত অস্তিত্বের গুণের কথা বলে, যেটি মনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ মন তো জীবন এবং জীবন তো বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত। এই গুণটাকে আমি দেবতা বলি এবং যে-সত্ত্বা এই গুণকে ধারণ করে সেই-তো ঈশ্বর। অতএব, আমার আছে এটা মনে হয় যে, সমুদয় বস্তুই এই গুণের প্রকাশমানতার দিকে নির্দেশ করে। এই কারণেই আমি বলেছিলাম যে, বিজ্ঞান নিজে, যখন একটা ব্যাপকতর ধারণা গ্রহণ করে, তখন এর একটি দেবতার প্রয়োজন হয়। তিনি বলেন যে, পৃথিবীটা চেষ্টা করছে অথবা ঝুঁকে পড়ছে, দেবত্বের দিকে। কিন্তু পৃথিবীর অস্তিত্বের এই পর্যায়ে দেবতা তাঁর স্বাতন্ত্র্যনির্দেশক প্রকৃতি নিয়ে এখনও পর্যন্ত আবির্ভূত হননি।’ তিনি আরও বলেন যে, তাঁর কাছে ঈশ্বর ঐতিহাসিক ধর্মে বলা একজন স্রষ্টা নন, কিন্তু তিনি সৃষ্ট।
প্রফেসর আলেকজান্ডারের ধারণার সঙ্গে বার্গসনের সৃষ্টিশীল বিবর্তনের ধারণার একটা ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য রয়েছে। বার্গসন মনে করেন যে, বহিঃর্নিয়ন্ত্ৰণবাদ ভুল, কারণ বিবর্তনের গতিপথে প্রকৃত অভিনবত্ব দেখা দেয় যা নিয়ে আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না এবং এমনকি কল্পনাও করা যায় না। একটা রহস্যজনক শক্তি যা সবকিছুকেই বিবর্তিত হতে তাড়িত করে। উদাহরণস্বরূপ, দেখতে পায় না এমন একটি প্রাণীর দর্শনের কতিপয় রহস্যময় পূর্বাভাস আছে এবং প্রাণীটি এমনভাবে কাজ করে যা তার চোখের বিকাশকে চালিত করে।
প্রতি মুহূর্তে নতুন কিছুর আবির্ভাব ঘটে কিন্তু অতীত কখনও মরে যায় না। এটা স্মৃতিতে সংরক্ষিত থাকে, কারণ ভুল কেবলমাত্র আপাত। এভাবে পৃথিবী ধারাবাহিকভাবে, বিষয়বস্তুগতভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটি একটি সুন্দর আবাস হয়ে উঠবে। যেটা এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তা হলো প্রজ্ঞাকে এড়িয়ে চলতে হবে যেটা পশ্চাঙ্গামী এবং নিশ্চল বলে প্রতিভাত হয়। আমাদের যেটা অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে তা হলো স্বজ্ঞা, যা নিজের মধ্যে সৃষ্টিশীল অভিনবত্বের তাড়না ধারণ করে থাকে।
এটা অবশ্যই ধরে নেওয়া যাবে না যে, মন্দ জীববিজ্ঞানের আনুষঙ্গিক টুকরোসমূহের বাইরে ল্যামার্কের স্মারক হিসাবে এসব কিছু বিশ্বাস করার জন্য কারণ দর্শানো হয়েছে। বার্গসনকে কবি হিসাবে বিবেচনা করতে হবে এবং তার নিজের নীতিসমূহের বিষয়ে সবকিছু এড়িয়ে যেতে হবে যা প্রজ্ঞার কাছে আবেদন রাখে।
আমি মনে করি না যে, প্রফেসর আলেকজান্ডার বার্গসনের দর্শনকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ধারণাগত মিল রয়েছে যদিও তারা দু’জনেই স্বাধীনভাবে এই ধারণা বিকশিত করেছেন। যাই হোক, তত্ত্বাবলী সময়ের উপর জোর দেবার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে। ঐকমত্য বজায় রাখে এ-ব্যাপারেও যে, বিবর্তনের গতিপথে অনির্দেশ্য অভিনবত্বের আবির্ভাব ঘটে।
নানাবিধ অসুবিধা উত্থানশীল বিবর্তনের দর্শনকে অসন্তোষজনক করে। সম্ভবত এসবের মধ্যে প্রধান অসুবিধাটা হলো, বহিঃনিয়ন্ত্ৰণবাদ থেকে বেরিয়ে আসতে, ভবিষ্যদ্বাণীকে অসম্ভব করে তোলে এবং তবুও এই তত্ত্বের অনুগতরা ঈশ্বর-অস্তিত্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে। এরা যথার্থভাবেই বার্গসনের সেল-ফিসের (shell-fish) অবস্থায় যারা দর্শন করতে চায় যদিও জানে না দর্শন করাটা আসলে কী। প্রফেসর আলেকজান্ডার মনে করেন যে, কতিপয় অভিজ্ঞতায় ‘দেবতা’ সম্পর্কে আমাদের অস্পষ্ট সচেতনতা রয়েছে। এটাকে তিনি ‘ঐশ্বরিক’ বলে বর্ণনা করেন। এ-ধরনের অভিজ্ঞতাকে বৈশিষ্ট্য দান করে এমন অনুভূতি হলো, তার মতে, কোনো কিছুর রহস্যের জ্ঞান যা আমাদের আতঙ্কিত করতে পারে অথবা আমাদের অসহায় অবস্থায় সহায়তা করতে পারে। কিন্তু এটা হলো যে-কোনো কিছু আলাদা যা আমরা আমাদের জ্ঞান অথবা আমাদের ভাবনার সাহায্যে জানতে পারি। এই অনুভূতিকে গুরুত্ব দেবার কোনো কারণ তিনি দেন না, অথবা তার তত্ত্ব যেমন দাবি করে, মানসিক বিকাশ জীবনে একটি বৃহত্তর উপাদান হিসাবে তৈরি করে দেয়। নৃতত্ত্ববিদদের কাছ থেকে যে-কেউ পুরোপুরি বিপরীত ধারণাটাই অবধারণ করবেন। বন্ধুত্বপূর্ণ কিংবা শত্রুতাপূর্ণ অ-মানবীয় শক্তির রহস্যের জ্ঞান, সভ্য মানুষের চেয়ে আদিম বর্বর মানুষের জীবনে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করে। বস্তুত, ধর্মকে যদি এই অনুভূতির সঙ্গে চিহ্নিত করতে হয় তাহলে জ্ঞাত মানুষের উন্নতির প্রতিটি পদক্ষেপে ধর্মের হ্রাসপ্রাপ্তির কথা বলতে হয়। তাহলে উত্থানশীল দেবতার জন্য ধরে-নেওয়া বিবর্তনমূলক যুক্তি এক্ষেত্রে খাটে না।
যুক্তিটা, যেভাবেই হোক, লক্ষণীয়ভাবে হালকা। যুক্তি দিয়ে বলা হয়, বিবর্তনের তিনটি স্তর–বস্তু, জীবন এবং মন। এটা ধরে নেবার কোনো কারণ নেই যে, পৃথিবীর বিবর্তন পর্যায় শেষ করে ফেলেছে। সুতরাং, সম্ভবত পরে কোনো এক সময়ে শুরু হবে চতুর্থ পর্যায়, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ প্রভৃতি, এমনটা কেউ ধরে নিতে পারে। কিন্তু এমনটা হবে না, চতুর্থ পর্যায়ের সঙ্গেই বিবর্তন সম্পূর্ণ হবে। এখন বস্তু আগাম জীবনকে দেখতে পাচ্ছে না এবং জীবনও আগে থেকে মনকে দেখতে পারছে না, কিন্তু মন ক্ষীণভাবে পরবর্তী পর্যায় আগেই দেখতে পারছে, বিশেষত এটা যদি একজন পুয়ার অধিবাসী কিংবা একজন বুশমানের মন হয়। এটা স্পষ্ট যে, এসব কিছুই কেবল আন্দাজি ব্যাপার। এটা সত্য হিসাবে ঘটতেও পারে কিন্তু এটা ঘটবে এমনটা ধরে নেবার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। উত্থানশীল দর্শন এটা বলায় পুরোপুরি সঠিক যে, ভবিষ্যৎ অনির্দেশ্য। কিন্তু এই দর্শনটা এটা বলেই আবার ভবিষ্যদ্বাণী পড়তে এগিয়ে যায়। যে-ধারণার জন্য ‘ঈশ্বর’ শব্দটা, এ পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে, এই ধারণার চেয়ে মানুষ ‘ঈশ্বর’ শব্দটা ত্যাগ করতে বেশি অনিচ্ছুক। ঈশ্বর এই পৃথিবী সৃষ্টি করেননি, এটা উত্থানশীল বিবর্তনবাদীদের বোঝানোর পর তারা এটা বলতে সন্তুষ্ট যে, পৃথিবী ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। কিন্তু নামটি ছাড়া এ ধরনের ঈশ্বরের সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে পূজিত বস্তুর প্রায় কোনো সাযুজ্য নেই।
এর রূপ যাই হোক সাধারণভাবে মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের দুটো সমালোচনা রয়েছে। প্রথমত, যারা মহাজাগতিক উদ্দেশ্যে বিশ্বাস করেন তাঁরা সর্বদা ভাবেন যে, এ পর্যন্ত বিবর্তিত পৃথিবীর গতিপথের মতো পৃথিবীটা বিবর্তিত হতেই থাকবে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা মনে করেন যে, এ-পর্যন্ত যা ঘটে গেছে সেটাই ব্রহ্মাণ্ডের শুভ মনোভাবের লক্ষ্য। এই দুটো বিবৃতি নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে।
বিবর্তনের গতিপথ নিয়ে যুক্তিটা প্রধানত আহরিত হয়েছে জীবন-শুরু-হওয়া থেকে এই পৃথিবীতে যা ঘটেছে সেই ঘটনা থেকে। পৃথিবীটা এখন ব্রহ্মাণ্ডের একটি ক্ষুদ্র কোণ, এবং এটা ধরে নেবার মতো কারণ রয়েছে যে, এই পৃথিবীটা বাকি অংশের মতো নির্দিষ্ট ধরনের নয়। বর্তমান সময়ে অন্য কোথাও জীবন আছে কি না, তা নিয়ে জেমস জিনস্ খুবই সংশয়ী। কোপার্নিকাসের বিপ্লবের আগে এটা ধরে নেওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্য বিশেষভাবে পৃথিবীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এটা এখন একটা অগ্রহনযোগ্য প্রকল্প হিসাবে বিবেচিত হয়। মহাবিশ্বের যদি মনের বিবর্তন ঘটানোই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই এটাকে এত দীর্ঘ সময়ে এত কম উৎপাদনের জন্য অযোগ্য বিবেচনা করতে হবে। এটা অবশ্যই সম্ভব যে, পরে অন্য কোথাও আরও মন সৃষ্টি হবে। কিন্তু এ সম্পর্কে আমাদের সামান্যতম বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য নেই। এটা উদ্ভটই মনে হয় যে, আকস্মিকভাবে জীবন শুরু হবে কিন্তু এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে আকস্মিকতা তো ঘটবেই।
এমনকি যদি আমরা এই কৌতূহলী ধারণাটাও গ্রহণ করি যে, মহাজাগতিক উদ্দেশ্যটা বিশেষভাবে আমাদের এই ক্ষুদ্র গ্রহ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট, তাহলেও আমরা দেখবো সংশয় করার কারণ রয়েছে যে, এই গ্রহের কাজ সম্পর্কে ধর্মতাত্ত্বিকরা যা বলেন পৃথিবী নামক গ্রহটা কি তাই করে? পৃথিবীটা (যদি না আমরা যথেষ্ট বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে সমুদয় জীবন ধ্বংস করে ফেলি) সম্ভবত আরও বহু সময় ধরে বাসযোগ্য থাকবে, কিন্তু চিরকাল থাকবে না। সম্ভবত, আমাদের পরিমণ্ডল ক্রমে ক্রমে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবে, সম্ভবত জোয়ার-ভাটা পৃথিবীর একটা দিককে সর্বদা সূর্যমুখীন করে দেবে। এর ফলে একটা গোলার্ধ ভীষণ গরম হবে এবং অন্যটি বেজায় ঠাণ্ডা হবে। সম্ভবত (যেমনটা জেবিএস-এর একটা নীতিগল্পে রয়েছে) চাঁদ হুমড়ি খেয়ে পৃথিবীতে পড়বে। প্রথম যদি এসব ঘটনার একটিও না ঘটে, আমরা সবাই যেভাবেই হোক ধ্বংস হয়ে যাবো যখন সূর্যটা বিস্ফোরিত হয়ে একটি ঠাণ্ডা শ্বেত বামনে পরিণত হবে। যেমনটা জিনস্ আমাদের বলেছেন যে, এটা ঘটবে প্রায় এক মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে, যদিও সঠিক তারিখটা এখনও কতকটা অনিশ্চিত।
এক মিলিয়ন মিলিয়ন বছর শেষের সে-দিনের জন্য তৈরি হবার কিছুটা সময় দেবে এবং আমরা আশা করি ইতোমধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানে এবং বড়ো কামনা নির্মাণ কৌশলে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বাসযোগ্য গ্রহ সমেত আর একটা নক্ষত্র আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন এবং গোলন্দাজরা ওই গ্রহের অভিমুখে আমাদের উড়িয়ে দিতে পারেন আলো চলার গতিতে। এমন হলে, এমন, যাত্রার যাত্রীরা যৌবনে যাত্রা শুরু এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুর আগে ওই গ্রহে পৌঁছতে পারবেন। এটা সম্ভবত একটা ক্ষীণ আশা। কিন্তু এটার ভালো দিকটা ভাবনায় থাকুক।
যাই হোক, ব্রহ্মাণ্ডের চারদিকে ভ্রমণ, এটা যদি সর্বোত্তম যথার্থ, বৈজ্ঞানিক দক্ষতায় করা হয় তবুও এটা চিরকালের জন্য জীবনকে প্রসারিত করতে পারে না। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র আমাদের জানায় যে, মোটের ওপর, শক্তি সর্বদা বেশি সঙ্কুচিত থেকে কম সঙ্কুচিত অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়, এবং পরিশেষে সব শক্তিকেই একটা রূপের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হবে যেখানে পরবর্তী পরিবর্তন অসম্ভব। এটা যখন ঘটে গেছে, যদি আগে না ঘটে থাকে, জীবনকে অবশ্যই থেমে যেতে হবে। আর একবার জিনকে উদ্ধৃত করা যায়, ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে মরণশীলদের একটাই সম্ভাব্য জীবন হলো কবরের দিকে অগ্রগমন। এটা কতিপয় ধারণার দিকে তাকে চালিত করে যেটা আমাদের বিষয়ের পক্ষে প্রাসঙ্গিক।
‘পৃথিবীর বহুত্ববাদে বিশ্বাসের জন্য জিওর্দানো ব্রুনোর শহীদত্ব বরণের পরে অতিবাহিত তিনটি শতক ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে প্রায় বর্ণনাতীতভাবে বদলে দিয়েছে। কিন্তু এসব ধারণা (প্রশংসনীয়ভাবে) জীবনের সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের সম্পর্কের ব্যাপারে বোধগম্যতার কাছে পৌঁছে দেয়নি। আমরা এখনও জীবনের অর্থ সম্পর্কে কেবলমাত্র অনুমান করতে পারছি যা সমস্ত দৃশ্যতার কাছে এত বিরল। এটাই কি শেষ শীর্ষবিন্দু যার অভিমুখে সমুদয় সৃষ্টি চলমান, যার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে অবাসযোগ্য নক্ষত্র এবং নেবুলায় বস্তুর রূপান্তর, এবং মরুভূমিতে বিকিরণের অপচয়, এসবগুলো অবিশ্বাস্য বেহিসাবি প্রস্তুতি? অথবা এটা কি কেবল আকস্মিক এবং সম্ভবত পুরোপুরি গুরুত্বহীন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপজাত, যেগুলোর অন্য কোনো এবং আরও প্রকাণ্ড সমাপ্তি, যেটা দেখা যাচ্ছে? অথবা এটা কি আরও বিনয়ী চিন্তার দিকে দিকপাত? এটাকে কি আমরা একটা রোগের প্রকৃতির মতো কিছু বলে বিবেচনা করব, যেটা বস্তুকে পরিণত অবস্থায় প্রভাবিত করে যখন এটা অধিক উত্তাপ হারিয়েছে এবং উচ্চমাত্রার বিকিরণ তৈরির ক্ষমতা যার সঙ্গে মিশে কম বয়েসি এবং অধিক সবল বস্তু তৎক্ষণাৎ জীবন ধ্বংস করবে? অথবা দীনতা পাশে সরিয়ে রেখে আমরা কি কল্পনার ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ নেবো যে, এটাই একমাত্র বাস্তব যেটা সৃষ্ট হবার পরিবর্তে সৃষ্টি করে নক্ষত্র ও নেবুলার বিপুল ভর এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় সময়ের প্রায় অভাবনীয় দীর্ঘ দিগন্ত?
এটা, আমি মনে করি, বিকল্পের বর্ণনা করে যেটা বিজ্ঞান সঠিকভাবে এবং পক্ষপাতিত্বহীনভাবে হাজির করেছে। সর্বশেষ সম্ভাবনা যে, মনই হলো একমাত্র বাস্তবতা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের স্থান ও সময় এটার দ্বারাই সৃষ্ট, এটার পক্ষেই যৌক্তিকভাবে অনেক কিছু বলতে হবে। কিন্তু বিষণ্ণ সিদ্ধান্ত এড়ানোর আশায় যারা এটা গ্রহণ করেন তাঁরা পুরোপুরি বুঝতে পারেন না এটা কী দরকার। আমি সরাসরি যে সব জানি সেসব আমার মনের অংশ এবং যে-অনুমান থেকে অন্যান্য বস্তুর অস্তিত্বে পৌঁছই সেগুলো কোনোক্রমেই তর্কাতীত নয়। সুতরাং এটা হতে পারে যে, আমার মন ছাড়া কিছুই অস্তিত্বশীল নয়। সেক্ষেত্রে আমি যখন মারা যাব, ব্রহ্মাণ্ডটা শেষ হবে। কিন্তু আমি যদি আমার নিজের মনটি ছাড়াও অন্যের মন স্বীকার করি, তখন আমাকে অবশ্যই গোটা জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ব্রহ্মাণ্ডকে স্বীকার করতে হবে, কারণ উভয় ক্ষেত্রেই সাক্ষ্য সমান শক্তিশালী। অন্য লোকেদের দেহ নেই, কিন্তু তাদের মন আছে, জিনসের এই শেষ বিকল্পটা সন্তোষজনক তত্ত্ব নয়। এটা এমন একটা তত্ত্ব যার কথা, আমি একা শূন্য ব্রহ্মাণ্ডে, মানবজাতি, পৃথিবীর ভূবিদ্যার বয়স, সূর্য, নক্ষত্র, এবং নেবুলা এসব আবিষ্কার করছি আমার উর্বর কল্পনার সাহায্যে। আমি যতদূর জানি এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে কোনো স্বীকার্য তর্কশাস্ত্রীয় যুক্তি নেই। কিন্তু অন্য কোনো মতবাদের বিরুদ্ধে যে, মনই হলো একমাত্র বাস্তবতা সেখানে অন্য মানুষের মন থাকার সাক্ষ্য তাদের দেহ থাকার সাক্ষ্য থেকে গৃহীত। অন্য মানুষদের যদি তাদের মন থাকে তাহলে তাদের দেহও রয়েছে। কেবলমাত্র একজনেরই বিদেহী মন থাকতে পারে, কিন্তু কেবলমাত্র এই একজনই যদি অস্তিত্বশীল থাকে।
মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের আলোচনায় আমি এখন শেষ প্রশ্নটায় আসব। ব্রহ্মাণ্ডের শুভ মনোভাবের এ-পর্যন্ত সাক্ষ্যের কি ঘটল? এটা বিশ্বাস করার তথাকথিত কারণ, যেটা আমরা দেখেছি, ব্রহ্মাণ্ডে আমাদিগকে সৃষ্টি করেছে। আমি এটা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু এই ধরনের একটি দীর্ঘ প্রস্তাবনায় যথার্থতা বিচার করতে আমরা কি সত্যি সত্যি এত গৌরবমণ্ডিত? দার্শনিকগণ মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা বলেন যে, আমরা ভাবি কতিপয় বস্তু উৎকৃষ্ট এবং যেহেতু এই বস্তুগুলো উৎকৃষ্ট, ওগুলো উৎকৃষ্ট ভাবতে আমাদেরও উৎকৃষ্ট হতে হবে। কিন্তু এটা একটা প্যাচালো যুক্তি। ভিন্ন মূল্যবোধ নিয়ে একজন ব্যক্তি আমাদের এত নৃশংস বলে ভাবতে পারেন যে, প্রমাণ স্বরূপ তিনি বলবেন আমরা শয়তানের দ্বারা অনুপ্রাণিত। মানুষ একখানা আয়না সামনে ধরে তার দিকে তাকিয়ে এটা কী ভাববে যে তারা অসাধারণ সুন্দর যা কিছু দেখতে পায় সবই মহাজাগতিক উদ্দেশ্য যা সর্বদা তাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে? মানুষের এই গৌরবান্বিত হওয়া কেন? সিংহ এবং বাঘের ব্যাপারে কী হবে? এরা, আমরা যা করি, তার চেয়ে অনেক কম প্রাণী অথবা মানবজীবন ধ্বংস করে এবং এরা আমাদের থেকে অনেক সুন্দর। পিঁপড়েদের ব্যাপারটাই-বা কী? যে-কোনো ফ্যাসিস্টের তুলনায় এরা অনেক ভালোভাবে কর্পোরেট স্টেট পরিচালনা করে। আমাদের মানুষদের নিষ্ঠুরতা, অবিচার এবং যুদ্ধের পৃথিবী থেকে নাইটিঙ্গেল, গায়ক পাখি, এবং হরিণের পৃথিবী অধিকতর ভালো নয় কী? মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের বিশ্ববাসীরা তখাকথিত বুদ্ধিবৃত্তির থেকে বেশি প্রদর্শনের চেষ্টা করেন কিন্তু তাদের লেখাপত্র যে কোনো ব্যক্তিকে এ-ব্যাপারে সংশয়ী করে তোলে। যদি আমাকে সর্বশক্তিমান হওয়ার যোগ্যতা প্রদান করা হত, এবং লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরীক্ষণের সুযোগ পেতাম, তাহলে আমার সমুদয় প্রচেষ্টার ফলাফল হিসাবে মানুষকে বেশি গর্ব করতে দিতাম না।
অনালোকিত স্থানের একটা কৌতূহলী দুর্ঘটনা হিসাবে মানুষ বোধগম্য। তার পাপ ও পুণ্যের মিশ্রণ এমনই যা আকস্মিক উৎস থেকে উঠে-আসা ফলাফল হিসাবে প্রত্যাশিত। কিন্তু কেবল সীমাহীন আত্মতুষ্টি মানুষের মধ্যে একটা কারণ যেটা সর্বশক্তিমান পর্যাপ্ত বলে বিবেচনা করতে পারেন, স্রষ্টার একটা উদ্দেশ্য হিসাবে। কোপার্নিকাসের বিপ্লব তার কাজটা ঠিকমতো করতে পারবে না যে-পর্যন্ত না এটা মানুষকে আরও বেশি বিনয় শেখাতে পারছে, যে-বিনয় তাদের মধ্যে দেখা যায় এবং এরাই ভাবেন মানুষ হলো মহাজাগতিক উদ্দেশ্যের পর্যাপ্ত সাক্ষ্য।
——–
১. ডিন ইনৃগে বলেছেন, আমরা আমাদের সংকীর্ণ নৈতিকতা দিয়ে অমঙ্গলের সমস্যাটা বড়ো করে দেখি, যেটা আমরা অভ্যাসগত ভাবে স্রষ্টার উপর চাপিয়ে দেই। এই তত্ত্বের সপক্ষে কোনো সাক্ষ্য নেই যে, ঈশ্বর কেবলমাত্র একজন নৈতিক সত্ত্বা এবং আমরা তার বিধান এবং প্রয়োগ সম্পর্কে যা পর্যবেক্ষণ করি সেসব বলিষ্ঠভাবে এটা নির্দেশ করে, যে তিনি তেমনটা নন।’ Outspoken Essays, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪।