প্রায় পুরোপুরি বিপরীত কারণেই মনে রাখব জুলফিকার আলি ভুট্টোকে। সিন্ধু প্রদেশের লারকানার কোটিপতি জমিদার স্যার শাহনাওয়াজ ভুট্টোর এই ছেলেটি মরিয়াও প্রমাণ করিল, সে মরেন নাই। স্যার শাহনাওয়াজ শুধু জমিদার ছিলেন না, তিনি বম্বে ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ও কিছুকাল মন্ত্রীও ছিলেন। জুলফি তখন মহানন্দে দিন কাটাচ্ছেন বোম্বেতে। খেলার সাথী স্যার হোমি মোদীর ছেলে পিলু। আলালের ঘরের দুলাল হলেও জুলফি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হবার পর অক্সফোর্ড থেকে এম. এ. পাশ করে লিঙ্কন-ইন থেকে ব্যারিস্টার হলেন। কিছুকাল বিলেতে অধ্যাপনা করার পর অধ্যাপনা আর ব্যারিস্টারী করার জন্য দেশে ফিরলেন। কিছুদিনের মধ্যেই আয়ুব পাকিস্তানের তখৎ-এ-তাউস দখল করলেন। তারপর হঠাৎ একদিন জুলফি তাঁর বাণিজ্য মন্ত্রী হলেন। তখন উনি সত্যি যুবক। বয়স তিরিশের ঘরের একেবারে প্রথম দিকে। দেখতে না দেখতে জুলফিকার আলি ভুট্টো আয়ুবের দক্ষিণহস্ত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হলেন। এই সময়ই ভুট্টোকে আমি কয়েকবার দেখি। সর্দার শরণ সিং ভুট্টোর বার বার কথা হয় ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ মীমাংসার চেষ্টায় কিন্তু ওঁর কথাবার্তা শুনে মনে হতো, এমন ভারত-বিদ্ধেষী আর জন্মাবেন না। এমন অনর্গলভাবে ভারতের সবকিছুর নিন্দা করতে আর কারুর কাছে কখনও শুনিনি। মনে হয়েছিল, ওর জিহ্বায় দুষ্টু সরস্বতী বিরাজমানা। তবে হ্যাঁ, প্রখর বুদ্ধিমান ছিলেন এবং জলপ্রপাতের ধারার মত সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন। সর্বোপরি ছিলেন মহা অহঙ্কারী। হাজার হোক ধনী ও বিখ্যাত জমিদারের ছেলে। দেখতে সুপুরুষ ও উচ্চশিক্ষিত। তার উপর অল্পবয়সে রাজনৈতিক খ্যাতি ও ক্ষমতা লাভ করে উনি বড় অহঙ্কারী হয়ে পড়েন। এবং প্রতিটি কথায় তা প্রকাশ হয়ে পড়ত।
প্রথমে বন্দী ও পরে কঁসিতে মৃত্যুর পরে এখন অনেকেই জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্রতি সমবেদনশীল হয়েছেন এবং মনুরে দিক থেকে তা স্বাভাবিক ও কাম্য। তবু ইতিহাস-প্রেমিক ভুট্টোকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিচার করলে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের জন্য ভুট্টো ব্যক্তিগতভাবে অনেকাংশে দায়ী। সর্বোপরি বাংলাদেশে বাঙালী নিধনযজ্ঞের অন্যতম হোতাও ছিলেন এই ভুট্টো। যে কারণে নাদির শাকে কোনদিনই শ্রদ্ধা করব না, ঠিক সেই কারণেই আমি পিলু মোদর এই বাল্য বন্ধুকেও চিরকাল ঘৃণা করব। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের সব অতীত কুকীতি মুছে ফেলা যায় না। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য এইরকম খামখেয়ালী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতাদের উপর বার বার দেশ শাসনের ভার পড়েছে।
পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিয়ার সঙ্গে মোলকাত করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে বইপত্তর পড়ে তার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে না পারলেও মানুষ জিন্নার প্রতি নিশ্চয়ই শ্রদ্ধাশীল হয়েছি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানকে একবারই দেখেছি। কয়েকবার দেখেছি ও সামান্য আলাপ-পরিচয় হয়েছিল পাকিস্তানের পরবর্তী এক প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলির (বগুড়া) সঙ্গে। এই মহম্মদ আলিকে নিয়েই আমার লেখক জীবনের প্রথম লেখা লিখি (রিপোর্টারের ডায়েরী : ভারতবর্ষ : পৌষ, ১৩৬৪) চৈত ছদ্মনামে।
মধ্যরাত্রির কিছু পরেই টেলিপ্রিন্টারে এক ফ্লাস মেসেজ এলো।
…Pakistans newly appointed Prime Minister, Mr. Mohammad Ali will pass through Calcutta early this morning on his way from Karachi to Dacca.
ইংরেজি মতে তখন ক্যালেণ্ডারের তারিখ বদলেছে। আর্লি দিস মর্নিং বলতে রাত একটা না দুটো, তিনটা না চারটে, তার কোন ইঙ্গিত নেই ক্লাসমেসেজে। কোন্ বিমানে তাঁর আগমন, তারও কোন হদিশ নেই এই সংক্ষিপ্ত খবরে। মাত্র কদিন আগে নিতান্ত নাটকীয় ভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে মহম্মদ আলি নিযুক্ত হয়েছেন। লিয়াকত আলি খানের আকস্মিক মৃত্যুর পর ঢাকার মসনদ ত্যাগ করে করাচীর তখৎ-এ-তাউস অলঙ্কত করে জব নাজিমুদ্দীন একদিন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও সেটা অচিন্তনীয় কিছু হয়নি। কিন্তু প্রৌঢ় বয়স্ক নবীন রাজনীতিবিদ মহম্মদ আলির পক্ষে মার্কিন মুলুকে দূত হওয়াই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হলেও, অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁকে প্রধান মন্ত্রীপদে নিয়োগে সারা দেশে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সুতরাং দমদম বিমান বন্দরে সেই সৌভাগ্য চূড়ামণির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের লোভ কলকাতার সাংবাদিকরা কর্তব্য ও আগ্রহের আতিশয্যে সম্বরণ করতে পারেননি। নাইট ডিউটির সব রিপোর্টাররা এখানে-ওখানে-সেখানে টেলিফোন করলেন। নানান মহলে খোঁজ-খবর করে জানলেন, প্রত্যুষে পাঁচটা নাগাদ বি-৪-এ-সি-বিমানে তার আগমন হচ্ছে দমদমে। বিমান ও বিমানযাত্রীরা প্রাতরাশ শেষ করে যাবেন ঢাকা।
এখনও এক সপ্তাহ হয়নি। করাচী রেলস্টেশনে নিয়মিত যাত্রীদের আগমন-নির্গমন সেদিনের মত শেষ হয়েছে। ভোরের আগে আর কোন বাষ্পীয় শকটের আবির্ভাব হবার কথা নয় করাচী স্টেশনে। হঠাৎ মধ্য-রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা ট্রেন স্টেশন প্লাটফর্মে প্রবেশ করল। অভ্যাস মত কুলিরা সব ঘুম থেকে চট করে উঠে বসল। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারল, এটা কোন সাধারণ যাত্রীগাড়ি নয়। আবার তারা সব গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। প্লাটফর্মে গাড়ি থামল। কর্তাব্যক্তিদের ত্বরিত গতিতে এদিকে ওদিকে ছুটাছুটি! সান্ত্রীদের উপস্থিতি। প্লাটফর্ম লাল কার্পেটে মুড়ে দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন যাবেন লাহোর না রাওয়ালপিণ্ডি। তাঁরই শুভাগমন প্রত্যাশায় স্টেশন প্লাটফর্মে রেল আর পুলিশের কর্তারা সব ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে করে অপলক নেত্রে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কয়েক মিনিট বাদেই টেলিফোনের আওয়াজ। তারপর আবার কর্তাদের মন্থর গতিতে এদিক-ওদিক যাওয়া-আসা। সামনের, লাল আলো নীল হল। নির্দিষ্ট যাত্রীকে না নিয়েই ট্রেনটা স্টেশন পরিত্যাগ করল। সান্ত্রীরা তাদের অস্ত্রাদি ঘাড়ে করে শিথিল পদক্ষেপে ফিরে গেল। পোটারের দল এগিয়ে এলো। লাল কার্পেট গুটিয়ে রাখা হল। করাচী স্টেশন আবার ঝিমিয়ে পড়ল।
সারা শহরটাও তখন নিস্ত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে শুধু আরব সাগর পারের করাচী বন্দর থেকে আত্মীয়-বন্ধুহীন প্রত্ত নাবিকদের চীৎকার শোনা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় তরণীর নাবিকদেরও সে রাত্রে ঘুন হয়নি। সারা রাত্রি চলেছিল শলা-পরামর্শ আর মন্ত্রণা। ব্যর্থতার দোহাই দিয়ে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মুক্তি দিলেন নাজিমুদ্দীন সাহেবকে। আর সেই সোনালী সিংহাসনে বসালেন মহম্মদ আলিকে এই রাত্রিতেই।
দেশ বিভাগের প্রাক্কালে কিছুকালের জন্য মহম্মদ আলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কিছুটা জড়িয়ে পড়েছিলেন। অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দীর ঐতিহাসিক রাজত্বকালে সাময়িক ভাবে অর্থমন্ত্রীর পদে মহম্মদ আলি নিযুক্ত হয়েছিলেন। সে কারণে কলকাতার রিপোর্টার মহলের সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। মধ্যরাত্রির অনেক পরে খবর পেয়েও ভোর পাঁচটায় দমদম বিমানবন্দরে কার্পণ্য হয়নি রিপোর্টারদের উপস্থিতিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি, আর পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের জনকয়েক কর্তাব্যক্তি কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য হাজির ছিলেন। আর বিশেষ কেউ ছিলেন না। ভোরের আলো তখন সবে ছড়িয়ে পড়লেও, সূর্যরশ্মি তখনও ঠিকরে পড়েনি দমদমের লম্বা রানওয়েতে। ঠিক সময় বি-ও-এ-সি বিমানটি এসে পৌঁছাল। বিমানের দরজা খুলতেই ভিতর থেকে এয়ার হোস্টেস্ ইঙ্গিত করে জানালেন, বিমানে ভি. আই. পি. (Very Important Person) রয়েছেন। নিম্ন কর্মচারীর পরিবর্তে পদস্থ কর্মচারীরাই অধিকতর উৎসাহী হয়ে বিমানে সিঁড়ি লাগালেন। সহাস্য বদনে নেহরুজীর মত এক ব্যাটন হাতে বেরিয়ে এলেন মিঃ আলি।
বিমান থেকে নেমে আলি সাহেব দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপে ভি-আই পি রুমে প্রবেশ করলেন। পিছন পিছন এলেন প্রধানমন্ত্রীর একজন ব্যক্তিগত কর্মচারী। তরুণ বাঙ্গালী যুবক। আগে রাইটার্স বিল্ডিংএ স্টেনোগ্রাফার ছিলেন। আর এলেন খাকি প্যান্ট ও মোটা শোলার হাট পরে পাকিস্তান সরকারের দেশরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি মিঃ ইস্কান্দার মীর্জা। মিঃ মীর্জা আর ঘরে ঢুকলেন না। বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। উপস্থিত অফিসারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলেন।
ঘরের ভিতর মিঃ আলির সোফার চারিদিকে বসে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা রিপোর্টারের দল। একজন প্রৌঢ় বাঙ্গালীকে প্রধানমন্ত্রীরূপে পেয়ে রিপোর্টারদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। প্রধানমন্ত্রী হয়েও মহম্মদ আলির মুখের হাসিকে অহেতুক গাম্ভীর্য গ্রাস করেনি। দেখে সবাই আনন্দিত। স্টেটম্যান পত্রিকার চীফ রিপোর্টারের দিকে ফরে বল্লেন, হাউ আর ইউ, মিঃ দাশগুপ্তা? পিছন দিকে ঘাড় ফিরিয়ে অমৃতবাজারের যতীনদার (মুখার্জী) দিকে লক্ষ্য করে তার কুশলবার্তা জানতে চাইলেন। কলকাতার স্মৃতি রোমন্থন করে জিজ্ঞেস করলেন, এর-ওর কথা। কাগজের অফিসের নানানজনের কথা। রাইটার্স বিল্ডিংসএর টুকিটাকি। ডাঃ রায়ের সংবাদ। তারপর শুরু হল কাজের কথা; বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানালেন, ভারত-পাকিস্তানের মৈত্রী বন্ধন কোনদিন কোনো কারণেই শিথিল হতে পারে না। বরং সে বন্ধন দৃঢ়তর হবে। নেহরুজীকে নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতার মতন শ্রদ্ধা করেন জানিয়ে নিকট-ভবিষ্যতে কাশ্মীর ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য তার সঙ্গে মিলিত হবার অভিপ্রায়ও মিঃ আলি জানান।
আমেরিকায় পাকরাষ্ট্রদূত ছিলেন মিঃ আলি। রাষ্ট্রদূত পদ থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী। ঘোড়ার থেকে সহিস না হলেও, অনুরূপ একটা কিছু বটে। আইসেনহাওয়ার প্রভুদের কোন হাত নেই তো এই পরিবর্তনে। আমেরিকা মহম্মদ আলিকে দিয়ে কোন বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করবে নাতো? সেদিন আরো পাঁচজনের সাথে সাথে কলকাতার রিপোর্টারদের কাছেও এ সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। লজ্জা, ঘৃণা, ভয় থাকলে যেমন তান্ত্রিক সাধনা সম্ভব নয়, তেমনি আজকের দিনে খবরের কাগজের রিপোর্টার হওয়াও অসম্ভব। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই প্রশ্ন করা হল। Is it not hut natural that the United States would enjoy some special favour during our Prime Ministership? সব সন্দেহ ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। সরাসরি এ আশঙ্কা অমূলক বল্লেন। এমন দরদ দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বল্লেন যে, তা অবিশ্বাস্য মনে হল।
সুদীর্ঘকাল পূর্বপাকিস্তানে কলকাতার সংবাদপত্রের প্রবেশ নিষিদ্ধ। যুগান্তরের চীফ রিপোর্টার অনিল ভট্টাচার্যই প্রথম সেকথা পাড়লেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন মিঃ আলি, ঢাকা যেয়েই এই সম্পর্কে খোঁজখবর করবেন। দমদম ত্যাগ করে ঢাকা যাবার জন্য আবার বিমানের দিকে রওনা হলেন। বিমানে চড়বার আগে সব রিপোর্টারদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। সিঁড়ি দিয়ে বিমানে উঠে গিয়ে অনুরোধ করলেন, দমদমে গৃহীত ফটোগুলির কপিগুলো যেত তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সম্মতি জানালেন তারক দাস ও অন্যান্য ফটোগ্রাফারের দল।
পরদিনের প্রভাতী সংবাদপত্রগুলির প্রথম ও প্রধান সংবাদরূপে দমদমে মহম্মদ আলির সঙ্গে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারের বিবরণী ছাপা হল। রিপোর্টারদের সঙ্গে তার ছবিও বেরুল। ঢাকা সফরের খবরও নিত্য বেশ ভালভাবেই বেরুতে লাগল। ঢাকা থেকে করাচী উড়ে যাবার পথে আবার দমদম আসবেন বলেও খবর ছাপা হল। এবার একটু বেলাতেই মিঃ আলির প্লেন দমদম এলো। দমদমের কিছু উৎসাহী লোকেরও জমায়েত হয়েছিল। প্রটেকটেড, এরিয়া থেকে বেরিয়ে ভিআইপি রুমে যাচ্ছেন মিঃ আলি! পাশে ভীড়ের মধ্যে থেকে একটা আধা ময়লা হাফসাট পায়জামা পরা এক ছোঁকরা এগিয়ে
কাকা, কাকাবাবু, ছেলেটি ডাকল।
মিঃ আলি পিছন ফিরলেন। ছেলেটি সোজাসুজি সামনে এলো। চিনতে পারেননি। মিঃ আলি। ছেলেটিই উৎসাহী হয়ে নিজের কাকার নাম করল। বগুড়া বাসিন্দা। হৃদ্যতা ছিল এই দুজনের মধ্যে। ফেলে আসা দিনের বন্ধুর খোঁজখবর করলেন। জানলেন, বন্ধু এখন উদ্বাস্তু ক্যাম্পের বাসিন্দা। ক্রটি করলেন না সংসারের আরো পাঁচজনের কুশলবার্তা নিতে। ছেলেটিকে সস্নেহে কাছে টেনে নিয়ে আদর করলেন। করাচীতে চিঠি লিখতেও বল্লেন। গদীর গুণে সারল্য বিসর্জন দেননি মহম্মদ আলি। দেখে সবাই খুশি।
দলবল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঢুকলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আতিথেয়তা রক্ষার জন্য। এক গেলাস অরেঞ্জ স্কোয়াস হাতে নিয়ে সেই চেনা মোটা শোলার হাট পরে ডিফেন্স সেক্রেটারি ইস্কান্দার মীর্জা বাইরে বেরিয়ে এলেন। দেশ বিভাগের আগে থেকেই দেশরক্ষা দপ্তরের উচ্চপদে বহাল ছিলেন মিঃ মীর্জা। লম্বা চওড়া চেহারা। মুখোনা বিশালকায়। স্যার আশুতোষকে রয়াল বেঙ্গল টাইগার বলা হত। মীর্জাকে বল্লেও অন্যায় বা অত্যুক্তি হবে না কোন দিক থেকেই। বারান্দার একপাশে সরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সামান্য সময়ের জন্য আলাপ আলোচনা করলাম। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে দেরী হল না, মিঃ মীর্জা একজন জাঁদরেল অফিসার। এর কাছে কেন জানি না মহম্মদ আলিকে যেন অসহায় মনে হল। পশুরাজ সিংহের সঙ্গে নেংটি ইঁদুরের খেলা নিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে গল্প আছে। আশঙ্কা হল ভবিষ্যতে পাকিস্তানের ইতিহাসে মীর্জা-আলি নিয়েও বোধ হয় এমনি গল্প আবার লেখা হবে।
আমাদের কৃষ্ণমেননের মতন স্বদেশী সাংবাদিক দেখলে ভ্রু কুঞ্চিত করেন না মিঃ আলি। প্রেস সাইনেসের বালাই নেই মহম্মদ আলির। এবারও রিপোর্টারদের কাছে এক লম্বা-চওড়া বিবৃতি দিলেন আগের দিনের সুরে। নির্দিষ্ট সময় বিশ্রাম করে সুইস-মেড ছাতিটাকে স্পোর্টস্ স্টিকের মতন ঘুরতে ঘুরতে প্লেনের দিকে চল্লেন। সিঁড়ি দিয়ে দুএক ধাপ উপরে উঠতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। আমরা সব কাছেই ছিলাম। আমাদের আগের দিনের আশঙ্কার মূলে কুঠারাঘাত করবার জন্য হাতের ছাতিটাকে দেখিয়ে বল্লেন :
জেন্টলম্যান অফ দি প্রেস! নেভার মাইণ্ড, দিস ইজ নট অ্যান আমেরিকান রাইফেল, যাস্ট অ্যান অর্ডিনারি আমব্রেলা।
উপস্থিত সকলের মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে নিজে হাসতে হাসতে বিদায় নিলেন মহম্মদ আলি।
উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলার প্রায় মাঝখান দিয়ে করতোয়া নদী বয়ে গেছে। করতোয়ার পশ্চিমে শেলবর্ষ পরগণার কুন্দগ্রামের জমিদার ছিলেন নবাব আবদুল সোহবান চৌধুরী। নবাবনন্দিনী আলতাফান্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নবাব আলি চৌধুরীর। রাষ্ট্র সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে এককালে বাংলাদেশের মন্ত্রিত্ব করেছেন এই নবাব আলি চৌধুরী। এদেরই পুত্র হলেন মহম্মদ আলির পিতৃদেব নবাব জাদা আলতাফ আলি চৌধুরী। এক ময়মনসিংহ দুহিতার সঙ্গে আলতাফ আলির প্রথম বিয়ে হয়। তারই গর্ভের পাঁচটি পুত্রের প্রথমটি হলেন মহম্মদ আলি। আলতাফ আলি মহম্মদ আলির গর্ভধারিণীকে তালাক দিয়ে পরে সাগর পারের এক কটা সুন্দরীর পানিগ্রহণ করেন। পূর্বাতন আলতাফ বেগমও মালা জপ করে জীবনের অবশিষ্টাংশ কাটাননি। তিনিও এক ব্যারিস্টারের সঙ্গে নিকায় বসেছিলেন এখন সে মহিলা ধরালোক ত্যাগ করেছিলেন। সাধারণভাবে ভদ্র বিনয়ী থাকলেও, আলতাফ আলি শনিবারের বারবেলায় বা রবিবারের প্রাক-গোধূলিতে খিদিরপুরের ঘোড় দৌড়ের মাঠের সঙ্গে গাঁটছড়া না বেঁধে থাকতে পারেননি। লক্ষ লক্ষ টাকা ঘোড়ার খুরের ধূলায় উড়িয়েছেন। সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে হস্তান্তরের দলিলে দস্তখতের সাথে সাথে কলকাতার বহু বাড়ি চৌধুরী পরিবারের হাতছাড়া হয়েছে। স্নো হর্স অ্যাণ্ড ফাঃ উমেনের কৃপায় মৃত্যুকালে লক্ষাধিক টাকা দেন। রেখে গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। সম্ভবতঃ আরো পাঁচজন ধনীর মত সে অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। আলতাফ আলির ফিরিঙ্গি পত্নীর গর্ভের প্রথম সন্তান হলেন ওমর আলি। লেস বসানো জরি-আঁটা লক্ষ্ণৌ চিকনের পাঞ্জাবী পরে কানে আতর গুঁজে সন্ধ্যায় তানপুরা হতে নিয়ে বসতেন ওমর আলি। পরে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিছুকাল। আরো পরে, নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহম্মদ আলি যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন সুরাবদীর পক্ষে ভ্রাতৃ বিদ্বেষ প্রচার করে পাক-রাজনীতিতে খ্যাতি অর্জন করেন।
মহম্মদ আলি করাচী থেকে দীর্ঘ পথ উড়ে নয়া দিল্লী এসেছিলেন। আনন্দভবন-নন্দনকে দাদা বলে ডেকেছিলেন। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানী নরক সৃষ্টির এক ফয়সালা করার চেষ্টাও করেছিলেন। শুধু মুখের হাসি দিয়েই আবার করাচী উড়ে গিয়েছিলেন। কাজের কাজ কিছু হয়েছিল বলে মনে হয় না।
মহম্মদ আলির নিয়োগকালীন আশঙ্কার বুদবুদ শুধু মধুমাখা বিবৃতিতেই তিরোহিত হয়নি। পলাশীর আম্রকুঞ্জে যেমন একদিন ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছিল, মহম্মদ আলির প্রধানমন্ত্রীত্বকালেও তেমনি করাচীতে মাকিনী আধিপত্যের বীজ বপন ও তাকে পল্লবিত করার দুর্নিবার প্রচেষ্টায় সিয়াটো প্যাক্টে পাকিস্তান দস্তখত করেছিল। অনাগত ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকরা গান অ্যাণ্ড গোল্ডের দেশ আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের মৈত্রীকে কি ভাবে গ্রহণ করবেন, তা সবার অজ্ঞাত হলেও, মহম্মদ আলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না। এরই রাজত্বকালে পাকিস্তানের উর্বরা ভূমিতে সিভিলিয়ান পলিটিসিয়ানদের জন্ম হয়। খাকি পোশাক, মেজর জেনারেল উপাধি, মোটা শোলার হাট আর ডিফেন্স সেক্রেটারি পদ ত্যাগ করে মিঃ ইস্কান্দার মীর্জা পলিটিসিয়ানের তিলক পরে দেশ সেবার নামাবলী জড়িয়ে পূর্ব বাংলাকে সায়েস্তা করবার জন্য লাট সাহেব হয়েছিলেন। স্বাস্থের অজুহাতে অতীতের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মতন গোলাম মহম্মদকে কায়েদী আজম পদে আসান দিতে হয়েছিল। মহম্মদ আলি ও বেশী দিন সুখে কাল কাটাতে পারেননি। মীর্জার ক্রমবর্ধমান প্রাধান্য ও মুসলিম লীগের অন্তকলহ ঈশান কোণের মেঘের মতন মহম্মদ আলির সারা অন্তর নিত্য আশঙ্কিত করে তুলেছিল। পাকিস্তানী রাজনীতি সম্পর্কে আরো আশঙ্কাগুলির মতন এ আশঙ্কাও সহজে চলে যায়নি। মীর্জা গভর্নর-জেনারেল হলেন। মার্কিনী রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মধুর বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে সিয়াটো প্যাক্টের প্রিমিয়াম দিলেন। মহম্মদ আলি বাপকো বেটা সিপাহীকে ঘোড়ার মতন প্রথম বেগমকে তালাক দিলেন। এক বিদেশিনীকে গাউন ছাড়িয়ে শাড়ি পরিয়ে হৃদয় সঁপে দিলেন। জীবন যৌবন নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন মহম্মদ আলি। জীবনের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঘর বাড়িরও নতুন চেহারা সৃষ্টিতে মন দিলেন। সারা বাড়ি লাইমজুস কলারে ডিস্টেম্পার করা হল। ভিতরের লনে সুইমিং পুল তৈরি আরম্ভ হল। রাজমিস্ত্রীদের কাজ শেষ হতে না হতেই রাজত্বের পরিবর্তন ঘটলো। পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রিত্বের ধ্বজা আর একবার নড়ে উঠল। উড়ে এসে জুড়ে বসলেন সিভিলিয়ান চৌধুরী মহম্মদ আলি।
মহম্মদ আলি আবার পাক রাষ্ট্রদূত হয়ে ডালেস-তীর্থে ফিরে গেলেন।
পাকিস্তানের পরবর্তী কর্ণধার জেনারেল আয়ুব খান। পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা রূপে তাঁর আবির্ভাব আকস্মিক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। মহম্মদ আলি প্রধানমন্ত্রী হবার কিছুকাল পরেই (১৯৫৪) গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ তাঁকে নির্দেশ দিলেন, মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, সোরাবদীকে আইন মন্ত্রী ও জেনারেল আয়ুব খানকে দেশরক্ষা মন্ত্রী নিয়োগ করো। মহম্মদ আলি নিঃশব্দে সে হুকুম তামিল করলেন। তারপর একদিন ( মার্চ ১৯৫৬) গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদকে হটিয়ে ইস্কান্দার মীর্জা তাঁর গদী দখল করলেন। দেড় বছরের মাথায় মীর্জাকে সরিয়ে স্বয়ং জেনালের আয়ুব খান নিজেই পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা হলেন। আয়ুব খান দীর্ঘদিন পাকিস্তানের কর্ণধার ছিলেন এবং বার কয়েক এর দর্শন পেয়েছি। তবে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য মোলাকাত হয় ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি লণ্ডনে।
সোভিয়েট ইউনিয়নের সরকারী আমন্ত্রণে ভারত সরকার মনোনীত ভারতীয় সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমি সে বছর সমগ্র সোভিয়েট ইউনিয়ন সফর করি। ঐ সফর শেষ করে প্রাগ ও জুরিখ ঘুরে আমি চলে যাই লণ্ডন মনাথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে। প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এই সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন ও হারল্ড উইলসন তখন ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন আয়ুব খান এবং ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বোধকরি রাজনৈতিক কারণেই আয়ুব খান ও শাস্ত্রীজিকে ক্লারিজস হোটেলে রাখেন।
ঐতিহাসিক মার্লবোরা হাউসে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর স্বাগত ভাষণ দিয়ে এবং তার পর পরই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস রিসেপশন। এটাই ব্রিটিশ ট্রাভিশন। এই রিসেপশনে সাংবাদিকরা কমনওয়েলথ দেশগুলির প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি এবং তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সঙ্গে পরিচিত ও আলাপ পরিচয় করার সুযোগ পান।
মার্লবোরা হাউসের প্রাইভেট লনের প্রবেশ পথেই হরল্ড উইলসন নিজে প্রত্যেক সাংবাদিককে এক একটি ড্রিঙ্কস তুলে দিলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ড্রিঙ্ক নিয়ে লনে প্রবেশ করার পর শাস্ত্রীজি আমাকে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার মধ্যে একজন আয়ুব খান। ইস্কান্দার মীর্জার মত অহংকার বা মহম্মদ আলির মত চটুলতা লক্ষ্য করলাম না ওঁর মধ্যে। কথাবার্তা বলে মনেই হলো না উনি একজন সমরবিশারদ, বরং বিচক্ষণ রাজনীতিবি বলেই মনে হলো। অত্যন্ত ধীর স্থির ভাবেই কথাবার্তা বললেন। মাঝে মাঝে একটু হাসেন। কিন্তু সব মিলিয়ে উনি সহজ সরল ও শান্তিকামী বলে নিজেকে প্রমাণ করতে চান, ঠিক তা মনে হলো না। প্রতিদিন সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় ক্লারিজ যাই শাস্ত্রীজির কাছে। ওঁর ব্যক্তিগত সচিব জগন্নাথ সহায় ও ভেঙ্কটরমনের কাছে নানা ব্যাপারে খোঁজখবর করি। মাঝে মাঝে হঠাৎ দেখা হয় আয়ুব খানের সঙ্গে। উনি ঠাট্টা করে বলেন, আমি প্রাইম মিনিস্টার শাস্ত্রীর সঙ্গে লড়াই করছি কিনা, তাই দেখতে এসেছেন?
আমি হাসি।
উনি হেসে বলেন, ডু ইউ নো, উই হ্যাভ বিকাম ফ্রেণ্ডস।
পাকিস্তান রাষ্ট্রপতির এই বন্ধুত্বের দাম কি হতে পারে, তা জানি বলেই আমিও হেসে জবাব দিই, আই অ্যাম সো হাপি টু নো ইট, ইওর একসেলেনসী!
এই ক্লারিজস হোটেলে পাকিস্তান হাই কমিশনের এক দল বাঙ্গালী কুটনীতিবিদ আয়ুব খানের জন্য ডিউটিতে ছিলেন এবং তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা হয়। ওঁরা মাঝে মাঝে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাঙ্গালী খানা খাইয়ে দিতেন এবং এদেরই কয়েক জনের উদ্যোগে ও সাহায্যে আমি দিল্লী ফেরার পথে করাচী ঘুরে আসি। মজার কথা, পাকিস্তানের ঐ বাঙ্গালী কূটনীতিবিদদের সঙ্গে হৃদ্যতার ফলেই জন্ম নেয় আমার উপন্যাস ডিপ্লোম্যাট। যাইহক লণ্ডন থেকে দিল্লী ফেরার পথে দুদিন করাচীতে কাটিয়েই বুঝেছিলাম, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আয়ুব খান পাকিস্তানের জনগণকে মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত করা শুরু করেছেন পুরোদমে। প্রতিটি সংবাদপত্র ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। অনুমান করতে কষ্ট হলো না নেপথ্যে সামরিক প্রস্তুতি আরো কতদূর এগিয়েছে।
পাকিস্তানের এই সব যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কদের অদূরদর্শিতার জন্যই জন্ম নেয় বাংলাদেশ। রঙের উপর বসান চড়িয়েছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর ইতিহাসে সে এক অনন্ত অধ্যায়।
.
বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে দিল্লীতে থাকি। বিকেলবেলায় কলকাতার বাংলা খবরের কাগজগুলো পড়তে পড়তে চোখের জল ফেলি মুজিব ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ঘটনা ঘটে চলে বিদ্যুত গতিতে! ভারত-সোভিয়েট ইউনিয়নের মৈত্রী চুক্তি, নিক্সনের হুমকি, আণবিক অস্ত্রসজ্জিত মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সন্দেহজনক গতিবিধি, জেনারেল ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর ছল-চাতুরি, ঢাকায় বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী নিধন। আরো কত কি। শেষ পর্যন্ত একদিন লেঃ জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলেন লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। তারপরও আরো কত কি! একদিন আবার মুজিব ফিরে এলেন ঢাকায় নবজাত রাষ্ট্রের কর্ণধাররূপে।….
দিল্লীতে বাংলাদেশের প্রথম হাই কমিশনার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী (বর্তমানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব)। নিছক খবর বা সৌজন্যের জন্য ওঁর গ্রেটার কৈলাসের দপ্তরে যাই। পরবর্তী হাই কমিশনার হলেন ডক্টর এ, আর মল্লিক। ইতিহাসের যশস্বী অধ্যাপক ও কূটনীতিবিদ ডঃ মল্লিকের সঙ্গে খুবই হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠল। আমার বই বেরুতে না বেরুতেই উনি আর ভাবীজি পড়ে ফেলেন। ঢাকা থেকে আগত অতিথিদের পড়ান। একদিন উনিই আমার মেমসাহেব ও ডিপ্লোম্যাট পাঠিয়ে দিলেন শেখ সাহেবের কাছে।
১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি মুজিব দিল্লী এলেন শ্ৰীমতী গান্ধীর আমন্ত্রণে। এয়ারপোর্টে উপস্থিত ছিলাম। সন্ধ্যায় রিপোর্ট পাঠালাম।
পরের দিন সকালে এক বন্ধুর পরিবারের কয়েকজনের জন্য ভিসা নেবার ব্যাপারে ইরাক দূতাবাসে গেছি। হঠাৎ ঐ দূতাবাসেই আমার টেলিফোন এলো বাড়ি থেকে-রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ফোন এসেছে এখুনি মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য। ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। বাড়ি এসেই রাষ্ট্রপতি ভবনে ফোন করলাম শেখ সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারিকে। হ্যাঁ, সত্যি আমাকে এখুনি মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। যে মানুষটির জন্য দিনের পর দিন চোখের জল ফেলেছি, যিনি লক্ষ-কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়-সম্রাট, সেই মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হলাম খানকয়েক বই হাতে নিয়ে। দীপ্তিও সঙ্গে চলল। বুঝলাম, মল্লিক সাহেব ও মেমসাহেব–ডিপ্লোম্যাটের জন্যই এই অভাবনীয় সৌভাগ্য সম্ভব হলো।
শেখ সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি বললেন, আপনার সময় পনের মিনিট বারোটা পঁয়তাল্লিশ থেকে একটা। ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইতিহাসের প্রবাদপুরুষের ঘরে ঢুকলাম। মল্লিক সাহেব আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বই দিলাম। মহা খুশি। তারপর পাশে বসিয়ে বললেন, নিমাইবাবু, আপনি ডিপ্লোম্যাট লিখে সাহিত্যিক হিসেবে একটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি আপনার মেমসাহেব আর ডিপ্লোম্যাট পড়ে সত্যি মুগ্ধ।
আমি সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানালাম।
উনি বললেন, যে বইগুলো দিলেন, তাও পড়ব তবে সময় লাগবে। এত কাজের চাপ যে পড়াশুনা করার সময় পাওয়াই মুস্কিল।
দীপ্তি মুগ্ধ হয়ে ওঁকে দেখে। আমিও বিশেষ কথা বলি না। উনি বলে যান, আমরা পলিটিসিয়ান। নানা কারণে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী অনেক সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য কিন্তু আপনারা সাহিত্যিকরা, শিল্পীরা মুক্ত মনের মানুষ হন বলেই ইতিহাসের পাতা থেকে পলিটি সিয়ানদের নাম মুছে গেলেও আপনাদের কেউ ভোল না।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত ওঁর কথা শুনি।
এই যে বাংলাদেশ হলো, তা কী আমি না আওয়ামী লীগ জন্ম দিয়েছে? এর আসল জন্মদাতা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিক আর একদল পাগল ছাত্র। ওরা সাহায্য না করলে কী আমরা কজন পলিটিসিয়ান দেশের মানুষকে এমনভাবে মরতে অনুপ্রাণিত করতে পারতাম?
উনি একটু থেমে বললেন, রবীন্দ্রনাথ কবে লিখেছিলেন, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি আর কবে আমরা তার মর্ম উপলব্ধি করলাম?
আরো কত কথা বলার পর উনি আলতো করে আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, নিমাইবাবু, ভাল করে লিখুন, সত্যি কথা লিখুন। আমরা পলিটিসিয়ানরা রাজনৈতিক কারণে চরিত্রহীন লম্পট অপদার্থ সিরাজদৌল্লাকে দেশপ্রেমিক বানিয়েছি। আমরা সত্যি কথা বলতে পারি না কিন্তু আপনাদের কী ভয়?
আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর উঠে দাঁড়ালাম। তবু কথা হয়। তারপর উনি ডক্টর মল্লিককে বলেন, মল্লিক সাহেব, নিমাইবাবুকে তাড়াতাড়ি ঢাকা পাঠান।
ওঁকে বার বার ধন্যবাদ জানিয়ে বিমুগ্ধ মনে রাষ্ট্রপতি ভবনের দ্বারকা সুইটের ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
পূজা সংখ্যার লেখা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম বলে তখনই ঢাকা যেতে পারলাম না। গেলাম কয়েক মাস পরে ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসবে যোগ দিতে।
ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেসান্স-এর অন্যতম জয়েন্ট সেক্রেটারি ও আমার বিশেষ বন্ধু শ্রীনিবাসন হঠাৎ একদিন ফোন করে বলল, নিমাই, ইণ্ডিয়ান রাইটার্স ডেলিগেশনের মেম্বার হয়ে তোমাকে ঢাকা যেতে হবে।
আমি হেসে প্রশ্ন করি, হঠাৎ আমাকে যেতে হবে কেন?
শ্ৰীনিবাসনও হেসে জবাব দেয়, আমি তো ভাবতেই পারি না তুমি সাহিত্যিক হয়েছ এবং আমার একটুও ইচ্ছা ছিল না, তোমাকে পাঠানো হোক। কিন্তু কী করব? ঢাকা থেকে বার বার টেলেক্স আসছে।
শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় সাহিত্যিক প্রতিনিধি দলের সব সদস্য পৌঁছবার তিন দিন পরে আমি ঢাকা পৌঁছলাম বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক রাত্রে শহীদ স্তন্তে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে মাল্য অর্পণ করতে গেলাম আমি আর সুশীলদা (রায়)। ঐ অনুষ্ঠানে শহীদ স্তম্ভে প্রথম মাল্য অর্পণ করলেন মুজিব, তারপর বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালিকা নীলিমাদি (ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম) এবং তারপরই আমরা। সেখানে মুজিবকে দেখে চমকে উঠলাম! গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রনায়কের জন্য এত স্টেনগানধারী দেহরক্ষী! বুঝলাম দেশের মানুষকেই দেশনায়ক বোধহয় বিশ্বাস করেন না। মনে মনে হাসি আর ভাবি, এইসব দেশনায়করা কী মনে করেন কজন সঙ্গীনধারীই তাদের একমাত্র ও নির্ভরযোগ্য ভরসা? পৃথিবীর কোন দেশের কোন রাষ্ট্রনায়ক শুধু সঙ্গীনধারীদের উপর নির্ভর করে চিরকাল গদী আঁকড়ে থাকতে পেরেছেন? কেউ না। ওঁরা কী ইতিহাসের এই সরল সত্যটিকেও ভুলে যান?
আমি সেই ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারির মাঝরাতেই ঈশান কোণে প্রথম ঘন কালো মেঘের ইঙ্গিত পাই।