০৮. মতিয়ুর রহমানকে আজ অতি আনন্দিত মনে হচ্ছে

মতিয়ুর রহমানকে আজ অতি আনন্দিত মনে হচ্ছে। এমনিতেই তিনি আনন্দে থাকেন। তাঁর মুখভর্তি পান। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। পান-সিগারেট কিছুদিন আগে ছেড়ে দিয়েছিলেন। দুটাই আজ ধরেছেন। ঘরে পান ছিল না। দোকান থেকে পাঁচ খিলি জরদা দেয়া পান এনেছেন। সেই পাঁচ খিলির তিনটা শেষ হয়ে গেছে। তাঁকে আবারো পান কিনতে যেতে হবে।

মতিয়ুর রহমানের আনন্দের কারণ তার বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে ভালো। গ্রামে খামারবাড়ি করেছে। দুটা পুকুর কাটিয়েছে। পুকুরে মাছের চাষ হয়। হাঁস-মুরগি গরু-ছাগল নিয়ে থাকে বলেই বোধহয় চেহারায় চাষা চাষা ভাব আছে। সেটা কোনো বড় ব্যাপার না। পুরুষের পরিচয় চেহারায় না, কর্মে। ছেলে কর্মবীর।

বিয়ের এই প্রস্তাব এসেছে মিতুর শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে। মিতুর শ্বশুর ওয়াজেদ আলী খোঁজখবর করে বের করেছেন। তাদের দিক থেকে সামান্য আত্মীয়তাও আছে। ওয়াজেদ আলী মানুষটাকেও মতিয়ুর রহমান খুব পছন্দ করেছেন। ওয়াজেদ আলীর যে পরিচয় পেয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে না এতদিনে মনের মতো একজনকে পাওয়া গেছে।

ওয়াজেদ আলী গলা নামিয়ে বলেছেন, বুঝেছেন বেয়াই সাহেব, আমাদের বয়স হয়ে গেছে। বেশিদিন নাই। যে-কোনো সময় আজরাইল এসে বলবে, এই শুওয়ের বাচ্চা, উঠ। সময় হয়েছে। বলবে না?

বলবে তো বটেই।

শেষ কয়েকটা দিন যদি আমরা একটু রঙঢঙ করি, অসুবিধা আছে?

অসুবিধা কী?

ওয়াজেদ আলী আনন্দিত গলায় বললেন, সার কথা বলে ফেলেছেন। জগতের সার কথা হলো— অসুবিধা কী? তোমরা ইয়াংম্যানরা যদি ফুর্তি করতে পার, আমরা কেন পারব না? আমাদের দাবি আরো বেশি। আমাদের দিন শেষ। দিন শেষ কি-না বলেন?

অবশ্যই দিন শেষ।

এখন যদি এই শেষ বেলায় মাঝে-মধ্যে সামান্য ওষুধ খাই, কার বাপের কী? নিজের পয়সায় ওষুধ খাচ্ছি। তোর পয়সায় তো না।

মতিয়ুর রহমান বললেন, ওষুধ জিনিসটা বুঝলাম না।

ওয়াজেদ আলী বললেন, না বোঝার কী আছে! যে ওষুধ খেলে মনে আনন্দ হয়, রাতে ঘুম ভালো হয়, সেই ওষুধ। এখনো বুঝেন নাই?

বুঝেছি।

কোকের সঙ্গে মিক্স করে নিয়ে এসেছি। খাবেন না-কি এক টোক? গরমের সময় ভালো লাগে।

মতিয়ুর রহমানের খেতে খুবই ইচ্ছা করছে, তারপরেও বললেন, না থাক।

ওয়াজেদ আলী বললেন, আপনি না খেলে আমিও খাব না। এই জিনিস একা একা খেলে আর ওষুধ থাকে না, তখন হয়ে যায় বিষ।

মতিয়ুর রহমান তখন বেয়াইকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে ওষুধ মেশানো কোক বেশ খানিকটা খেয়ে ফেললেন।

ওষুধের গুণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, খামারবাড়ি দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। বেশ কয়েকবার বললেন, এই ছেলে কর্মবীর, আসল কবীর। আমার মেয়ের সঙ্গে যদি বিয়ের কথাবার্তা না হতো, তাহলে আমি এই ছেলের পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। কদমবুসি করার মতো ছেলে।

ফেরার পথে তিনি খামারের চার কেজি দুধ, লাউ, লাউ শাক, পুকুরের সরপুটি, এক ঝুড়ি কাঁচা বাদাম নিয়ে ফিরলেন। ছেলে এই প্রথমবার চিনাবাদামের চাষ করেছে। ভালো ফলন হয়েছে।

মতিয়ুর রহমান ছেলের দুটা ছবিও নিয়ে এসেছেন। আনিকাকে দেখাবেন।

পাত্রের ছবি হিসেবে দুটা ছবির কোনোটাই চলে না। একটা ছবিতে ছেলে অস্ট্রেলিয়ান গরুর পিঠে হাত দিয়ে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটায় সে মালকোচা মেরে পুকুরে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চার কেজি ওজনের এক রুই মাছ।

রাতের খাবারের পর মতিয়ুর রহমান আনিকা এবং তার মাকে ডেকে পাঠালেন।

তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে মূল প্রসঙ্গে যাবার শখ ছিল। আনিকা তা হতে দিল। গম্ভীরমুখে বলল, যা বলার তাড়াতাড়ি বলল। আমি শুয়ে পড়ব, আমার মাথা ধরেছে।

মতিয়ুর রহমান বললেন, তোর বিখ্যাত মাথা কি সবসময় ধরা অবস্থায় থাকে?

আনিকা বলল, সবসময় থাকে না। এখন মাথা ধরেছে। কী বলবে বলো।

কিছুক্ষণের জন্যে হলেও শান্ত হয়ে বস, তারপর বলি।

আনিকা বসল। মতিয়ুর রহমান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তুই কী ঠিক করেছিস? বিয়ে করবি নাকি করবি না?

বিয়ে করব না এমন কথা তো কখনো বলি নি।

ছেলে কি তোর বোনের মতো তুই ঠিক করবি? নাকি আমাদের হাতে ছেড়ে দিবি?

আমার পছন্দের একজন আছে, তাকে বিয়ে করব।

সেই একজনটা কে?

এখন কিছু বলতে চাচ্ছি না বাবা, যখন সব ঠিকঠাক হবে তখন বলব।

সব ঠিকঠাক হবে মানে কী? কোন জিনিসটা বেঠিক?

সবই বেঠিক। ঠিক করার চেষ্টা করছি।

মতিয়ুর রহমান বললেন, যে ছেলেকে বিয়ের কথা ভাবছিস, তাকে কি আমরা চিনি?

হ্যাঁ চেন।

শওকত না তো?

আনিকা কিছু বলল না। মতিয়ুর রহমান বললেন, এই বিষয় আমি আগেই সন্দেহ করেছি। আমি তো ফিডার দিয়ে দুধ খাই না। জগতের হিসাব জানি। আধবুড়া এক ছেলে, তাকে বিয়ে করবি কোন দুঃখে? টাকা নাই পয়সা নাই, আয়-রোজগার নাই। ভ্যাগাবন্ড।

আনিকা বলল, আমি কিছু কথা বলব। আমার কথাগুলি মন দিয়ে শোন। তুমি তো টিভির সিনেমার কথাবার্তা ছাড়া অন্য কোনো কথা মন দিয়ে শোন না।

মতিয়ুর রহমান বললেন, তুই কী বাণী দিবি যে মন দিয়ে মহামানবীর বাণী শুনতে হবে?

আনিকা বলল, হ্যাঁ আমি বাণীই দেব। যে বুড়োর কথা তুমি বলছ, আমি যদি সেই বুড়োকে বিয়ে করি, তাহলে তোমাদের না খেয়ে থাকতে হবে না। অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমাকে তার সংসারে উঠতে হবে। আমার চাকরির একটা পয়সা তোমরা পাবে না। ওরা দিতে দিবে না। কোনো জামাই শ্বশুরশাশুড়িকে তার বাড়িতে পুষবে না। আমার ভবিষ্যৎ চিন্তা করার আগে তোমরা তোমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা কর।

মতিয়ুর রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, মেয়ে হয়ে তুই আমাকে ভাতের খোটা দিলি?

সারাজীবন তুমি আমাকে নানান বিষয়ে নানান খোঁটা দিয়েছ। আমি একটা দিলাম।

আজ থেকে যদি আমি তোর ভাতের দানা একটা মুখে দেই, তাহলে আমি মানুষের বাচ্চা না। আমি নেড়িকুত্তার বাচ্চা।

আনিকা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি ঘুমুতে যাচ্ছি। ব্যথায় আমার মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে।

মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনোয়ারাও উঠে গেলেন।

মতিয়ুর রহমান পান মুখে দিলেন। সিগারেট ধরালেন। তিনি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। মেয়ের চাকরির টাকায় ভাত খেতে হবে— এই দুশ্চিন্তা না। তিনি খামারের ছেলেটাকে আগামীকাল সন্ধ্যায় বাসায় চা খেতে ডেকেছেন। উদ্দেশ্য চা খেতে খেতে আনিকার সঙ্গে দুএকটা কথা বলবে।

এই সমস্যার সমাধান কী? সন্ধ্যায় চায়ের ব্যাপারটা বাদ দেয়া যায় কীভাবে? বিয়ে না হলে না হবে। ভদ্রভাবে আনিকা ছেলেটার সঙ্গে টুকটাক কিছু কথা তো বলবে?

মতিয়ুর রহমান টিভি ছাড়লেন। HBO-তে প্রায়ই ভূতের ছবি দেখায়। মতিয়ুর রহমান ইংরেজি মোটেই বুঝেন না। ভূতের ছবির সুবিধা হলো, ইংরেজি না বুঝলেও ছবি বুঝতে কষ্ট হয় না। রাতদুপুরে ভূত-প্রেতের ছবি দেখতে তার ভালোই লাগে। জীবনের শেষপ্রান্তে যে চলে এসেছে, তার কাছে ভালো লাগাটা জরুরি।

আনিকা বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে। মনোয়ারা মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। মাথায় সিঁথি করে আঙুলের ডগায় তেল নিয়ে সেই তেল ঘসা। মনোয়ারা এই কাজটা খুব ভালো পারেন। নারিকেল তেল তিনি আগে গরম করে নেন। পাশে ঠাণ্ডা পানির একটা বাটি থাকে। গরম তেল মাথায় ঘষার পরপর তিনি তাঁর আঙুল ঠাণ্ডা পানিতে ড়ুবিয়ে ম্যাসেজ শুরু করেন। এই অংশটা খুব আরামদায়ক।

মনোয়ারা দ্রুত আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, ভাতের খোটা দেয়া ভালো না রে মা।

আনিকা জড়ানো গলায় বলল, আমার মেজাজ ঠিক ছিল না।

মনোয়ারা বললেন, তোর বাবা মুখে কিছু না বললেও মেয়ের উপর ভর করে বেঁচে আছে— এটা ভেবে সবসময় ছোট হয়ে থাকেন। কেউ কিছু না বুঝলেও আমি বুঝি। ছেলেমেয়ের কাছে ছোট হয়ে থাকা বড় কষ্টের।

আনিকা কিছু বলল না। তার ঘুম পাচ্ছে। কথা বললেই ঘুম কেটে যাবে। আরামের ঘুম কাটাতে ইচ্ছা করছে না।

মনোয়ারা বললেন, আনিকা ঘুমিয়ে পড়েছিস?

আনিকা বলল, না।

তাহলে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোন। আমার মেজোভাই তোর মিজু মামা, একসময় সস্তা জমি পাওয়া যাচ্ছে দেখে বান্দরবানে অনেক জমি কিনেছিল। ঘর-দুয়ার বানিয়েছিল। পাহাড়িদের সঙ্গে সমস্যা শুরু হলে সে চিটাগাং চলে আসে। তার জমিজমা এখনো সেখানে আছে। বিক্রির চেষ্টা করছিল, বিক্রি করতে পারে নি।

আনিকা বলল, আসল কথা কী বলতে চাচ্ছ, সেটা বলো। এতক্ষণ ধরে তবলার টুকটাক শুনতে পারব না।

আসল কথা হলো, আমি মেজোভাইকে চিঠি লিখেছিলাম। উনার জায়গাজমি আমি আর তোর বাবা দেখাশোনা করব, সেখানে গিয়ে থাকব। ভাইজান চিঠি পেয়ে খুবই খুশি হয়েছেন। আমাদের যেতে বলেছেন।

এই বিষয় কি বাবা জানে? বাবাকে কিছু বলেছ?

না। তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেই তোর বাবাকে বলব। সে খুশি হয়েই রাজি হবে।

কানের কাছে আর ঘ্যানঘ্যান করবে না, আমার ঘুম পাচ্ছে।

মনোয়ারা ক্ষীণ স্বরে বললেন, তোর যাকে খুশি তাকে বিয়ে কর। বিয়ে করে সুখী হ। আমাদের কথা ভাববি না। আমরা আমাদের ব্যবস্থা করব।

আচ্ছা ঠিক আছে।

মা, আরেকটা কথা বলি?

আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, সব কথা কি তোমার আজই বলতে হবে?

থাক আরেকদিন বলব। না বললেও চলে, এমন কোনো জরুরি কথা না। জরুরি কথাটা আগে বলে ফেলেছি।

আনিকা বলল, কী বলতে চাচ্ছ বলো। যে ভণিতা দিয়ে কথা শুরু করেছ, এখন বাকিটা না শুনলে রাতে ঘুম হবে না।

মনোয়ারা বললেন, কথাটা মনজু সম্পর্কে।

ভাইয়াকে নিয়ে কথা? তার নাম উচ্চারণ করাই তো নিষিদ্ধ। বলো কী কথা তার বিষয়ে।

তার মৃত্যুর জন্যে তুই মনে মনে আমাকেও দায়ী করিস। তোর ধারণা আমার এবং তোর বাবার— এই দুইজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে।

মা, কথাটা কি ভুল?

আমার বিষয়ে কথাটা ভুল। আমার অপরাধ একটাই— তোর বাবা যখন তার উপর রাগ করত, গালাগালি করত, আমি চুপ করে থাকতাম। কিছু বলতাম না। মা শোন, চুপ করে থাকা আমার স্বভাব। তার বাবা যখন রেগে গিয়ে হৈচৈ করে, তখন আমি চুপ করে থাকি। তোর উপর যখন রেগে যায়, তখনো কিন্তু চুপ করেই থাকি। যখন বুঝি তুই মনে কষ্ট পেয়েছিস, তখন মাথায় তেল মাখিয়ে দেই। তোর মাথায় যেমন আমি বিলি কেটে দেই, মনজুর মাথায়ও দিতাম।

আনিকা বিছানা থেকে উঠে বসল। মার দিকে তাকাল।

মনোয়ারা বললেন, মনজু ঘুমের ওষুধ খাবার আগে দুটা চিঠি লিখেছিল। একটা তোর বাবাকে, একটা আমাকে। আমার চিঠিটা তুই একদিন পড়ে দেখিস। চিঠিটা কাউকে পড়াতে আমার লজ্জা লাগে বলেই লুকিয়ে রাখি।

চিঠি তুমি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছ, তাই না মা?

হ্যাঁ।

চিঠিটা রাখ। রেখে চলে যাও।

আমার সামনেই পড়।

না।

মনোয়ারা তেলের বাটি নিয়ে উঠে গেলেন।

 

দামি রেডিও বন্ড কাগজে গুটি গুটি করে লেখা চিঠি। মুক্তার মতো হাতের লেখা। যেন সাদা কাগজে অক্ষর সাজিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে।

মাগো,

আমি খুব বড় একটা ভুল করতে যাচ্ছি। মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। একটা কষ্ট নিয়ে আমি পৃথিবী থেকে যাচ্ছি। কষ্টটা হচ্ছে, তোমার স্নেহের ঋণ আমি শোধ করতে পারলাম না।

প্রায়ই খুব কষ্ট পেয়ে আমি রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদতাম। আমার ঘুম আসত না। তুমি গভীর রাতে তেলের বাটি নিয়ে আসতে। একটা কথাও বলতে না। আমার মাথা তোমার কোলে তুলে নিয়ে চুলে বিলি কাটতে। কেন কিছু কিছু মানুষ তোমার মতো ভালো হয়? মা শোন, আমরা সবচে কষ্ট পাই কিন্তু ভালো মানুষদের জন্যে। তুমি এত ভালো কেন হলে?

তোমার ছেলে
মনজু

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *