০৮. মতিন তার মেসের ঘরে শুয়ে আছে

মতিন তার মেসের ঘরে শুয়ে আছে। ঘরটাকে সে তার দুলাভাইয়ের ঘুমঘরের মতো করার চেষ্টা করেছে। শীতলপাটি আগেই ছিল, ঘর অন্ধকার করার জন্যে একমাত্র জানালাটা স্থায়ীভাবে পেরেক মেরে বন্ধ করে দিয়েছে। বাইরের দৃশ্য এমন কিছু নয়নাভিরাম না যে, জানালা খুলে রাখতে হবে। জানালা খুললেই বস্তির দৃশ্য চোখে পড়ে। সেই দৃশ্যে সবসময় মারামারি কিংবা ঝগড়া আছে। এইসব দৃশ্য এক দুদিন দূর থেকে দেখতে ভালো লাগে। দিনের পর দিন দেখতে ভালো লাগে না।

দুপুর বারোটা। আকাশ মেঘলা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ছে। মতিনের মেসের কিছু অংশে টিনের ছাদ। বৃষ্টির শব্দ সে দরজা জানালা বন্ধ করেও শুনতে পাচ্ছে। সারা সকাল সে বৃষ্টি শব্দটা নিয়ে চিন্তা করছিল। যেমন, বৃষ্টি শব্দটা কোত্থেকে এলো? এই শব্দটা কে প্রথম বলল? এরকম কি হতে পারে যে, প্রথম একজন আকাশ থেকে পানি পড়ার নাম দিল বৃষ্টি? সবার সেই শব্দটা পছন্দ হলো বলে সবাই বৃষ্টি বলা শুরু করল। সমস্যা হচ্ছে একসঙ্গে এই শব্দটা তো সবার কাছে পৌঁছানো অতি জটিল ব্যাপার। আচ্ছা এমন কি হতে পারে, বাংলা ভাষাভাষি সমস্ত মানুষ হঠাৎ একদিন আকাশ থেকে পানি পড়ার নাম দিল বৃষ্টি?।

এমন ঘটনা ঘটলে আমাদের স্বীকার করতে হবে, শব্দ আমাদের মাথায় বাইরে থেকে কেউ একজন ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেই কেউ একজনটা কে?

মতিন বিষয়টা নিয়ে আরো চিন্তা করত, এখন চিন্তা করতে পারছে না, কারণ তার খাটের পাশের চেয়ারে আহমেদ ফারুক নামের মানুষটি বসে আছে। অনেক চেষ্টা করেও মতিন তাকে বিদায় করতে পারছে না।

।ফারুক বললেন, আপনি কি সমস্যা বুঝতে পেরেছেন? Autistic শিশু নিয়মের বাইরে কখনো যায় না। নিয়মকে তারা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। সেখানে কমল নিয়মভঙ্গ করেছে। সে আপনার সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত কিছু খাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে।

মতিন বলল, তার দুই গালে কষে দুটা চড় দিন, দেখবেন সোনামুখ করে খাচ্ছে। চড়টা মালদার হতে হবে। ধরি মাছ না ছুঁই পানি মার্কা প্যাকেজ নাটকের চড় না।

ভাই, আপনি বিষয়টা বুঝতে পারছেন না।

আপনিও আমার বিষয়টা বুঝতে পারছেন না। দুদিন পর আমার বিয়ে। আজ মেয়ের গায়েহলুদ হচ্ছে। কাল আমার গায়েহলুদ হবে। এই অবস্থায় আমি আমার ঘর থেকে বের হতে পারি না।

কেন পারেন না?

নিয়ম নাই। বাইরে বের হলাম, একটা অ্যাকসিডেন্ট হলো। মরে গেলাম। বিয়ের দুই দিন আগে মৃত্যু, এটা ঠিক হবে না। নিয়ম হচ্ছে, গায়েহলুদের পর বর কনে কেউ ঘর থেকে বের হতে পারে না। প্রাচীন ভারতে গায়েহলুদের পর বর কনে দুজনকেই তালাবন্ধ করে রাখা হতো।

ভাই আপনি প্রাচীন ভারতবর্ষে বাস করছেন না। আপনি আধুনিক বাংলাদেশে বাস করছেন।

কি প্রাচীন ভারতে যে নিয়ম আধুনিক বাংলাদেশেও একই নিয়ম।

আহমেদ ফারুক একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা মতিনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মতিন সিগারেট নিল। ফারুক বললেন, ম্যাডামের সঙ্গে আপনার ঐ বাড়িতে যাওয়া নিয়ে কথা হয়েছে। ম্যাডাম বলেছেন যেহেতু আপনার উপর হঠাৎ করে আমরা একটা বিষয় Impose করি সেহেতু আপনাকে Compensate করা হবে।

মতিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, কীরকম Compensation? টাকা দেবেন?

জি। টাকার অ্যামাউন্ট নিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে কথা হয় নি। আপনি বললে কথা বলতে পারি।

মতিন আগ্রহের সঙ্গে বলল, আপনার ধারণা কী? একেকবার ঐ বাড়িতে যাওয়া বাবদ কত পেতে পারি?

তাদের একটা মাত্র ছেলে এবং ছেলেটা তাদের চোখের মণি। তারা অর্থ বিক্তের শীর্ষে বসে আছেন। ছেলের জন্যে টাকা খরচ করতে তাঁদের কোনো দ্বিধা আছে বলে আমি মনে করি না।

আপনি তো মূল প্রসঙ্গে আসছেন না। মূল কথাটা বলুন, ওরা কত দিতে পারে?

ধরুন দশ হাজার। আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। ফেরার সময় দশ হাজার টাকা নগদ আপনার হাতে দেয়ার দায়িত্ব আমার। দুদিন পর বিয়ে করছেন। বাড়তি টাকাটা আপনার কাজে আসবে।

মতিন বলল, আপনার সিগারেট শেষ না?

ফারুক বললেন, প্রায় শেষ।

তাড়াহুড়া করবেন না। আরাম করে সিগারেট শেষ করে বিদায় হয়ে যান।

আপনি যাবেন না?

না। আমাকে হাতি দিয়ে টেনেও নিতে পারবেন না।

একটা কোনো Solution-এ তো আসতে হবে।

ছেলেটাকে আমার কাছে নিয়ে আসুন। সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে। এই দেখাটা যে-কোনো জায়গায় হতে পারে। আগামীকাল তাকে নিয়ে আসুন। আগামীকাল আমার গায়েহলুদ। সে কিছু হলুদ আমার গায়ে মাখিয়ে দিল।

ফারুক হতাশ গলায় বললেন, এইসব কী বলছেন?

মতিন বলল, আকাশ থেকে পড়লেন কেন? রাজপুত্র এদিকে আসতে পারে? রাজপুত্রের সম্মানের হানি হবে?

আচ্ছা আমি যাই।

চলে যান। যাবার আগে একটা সিগারেট আমার দিকে ছুড়ে মেরে যেতে পারেন।

আহমেদ ফারুক সিগারেটের পুরো প্যাকেটটাই মতিনের বিছানার পাশে রেখে দিলেন। মতিন বলল, দান্যধ!

ফারুক বললেন, কী বললেন?

মতিন বলল, কমলের ভাষায় কথা বলেছি। দন্যধ মানে ধন্যবাদ।

বৃষ্টি জোরেসোরেই নেমেছে। মতিন তার পুরনো চিন্তায় ফিরে গেল। বৃষ্টি শব্দটা নিয়ে গবেষণা।

বৃষ্টি একটি সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় যে সব শব্দ এসেছে। সেগুলি খানিকটা কোমল হয়ে এসেছে। যেমন রাত্র হয়েছে রাত। বৃষ্টির বেলায় তেমন কিছু হয় নি। বৃষ্টি, বৃষ্টিই রয়ে গেছে। বিষটি হয় নি। কিছু শব্দ কঠিন থাকবে কিছু আবার কোমলই থাকবে, এটা কেমন কথা?

বালিশের নিচে রাখা মোবাইল টেলিফোন শব্দ করছে। মতিন মোবাইল সেট হাতে নিল। নিশুর নাম্বার। ধরবে কি ধরবে না এই সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে। বেশ কয়েক দিন হলো কী জানি হয়েছে, নিশুর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না।

হ্যালো মতিন?

হুঁ। রিং বেজেই যাচ্ছে বেজেই যাচ্ছে, তুমি ধরছ না কেন? শোন, তোমার না-কি বিয়ে?

হুঁ

কবে?

এ মাসের ২৮ তারিখ।

তার মানে তো পরশু।

হুঁ।

আশ্চর্য ব্যাপার, তুমি আমাদের কিছুই জানাবে না!

গরিবের বিয়ে। কার্ড নেই, বৌ ভাত নেই, শুধু কবুল কবুল।

তারপরেও আমাদের কিছু বলবে না? তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রাগ করেছ?

না।

তোমার বিয়েতে আমি যদি বাবাকে নিয়ে উপস্থিত হই তোমার কি আপত্তি আছে?

না।

আমরা বরযাত্রী যাব। বর রওনা হবে কোত্থেকে?

আমার দুলাভাইয়ের ঘুমঘর থেকে। হেঁটে চলে যাওয়া যাবে।

তোমার বিয়ে কি সত্যি হচ্ছে? আমার মনে হচ্ছে পুরোটাই ঠাট্টা। An elaborate fun game.

আমাদের পুরো জীবনটাই তো একটা elaborate fun game. নিশু, রাখি, আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাব।

না, রাখবে না। আমি তোমার সঙ্গে জরুরি কথা বলব।

বলো শুনছি।

আমি একটা বিষয় নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ করছিলাম, এখন আমি ৯৮ পারসেন্ট নিশ্চিত। বিষয়টা হচ্ছে You are in love with me.

তাই না-কি?

হ্যাঁ তাই। তুমি Timid প্রকৃতির পুরুষ বলে আমাকে জানাতে সাহস কর নি। তুমি যে হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলে তার কারণ আমি বিয়ে করছি। আমার বিয়েটা তুমি নিতে পারছ না। আরো লজিক দেব?

দাও।

তুমি বিয়েতে আমাকে আসতে বলে নি। তুমি কি আমার লজিক মানছ?

বুঝতে পারছি না।

মতিন শোন, বিয়ে অনেক বড় ব্যাপার। আমার উপর অভিমান করে কিছু করা ঠিক না।

বিয়ে বাতিল করে দিতে বলছ?

ভালো মতো চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে বলছি। Be rational, তুমি বাসায় চলে আস, তোমার সঙ্গে কথা বলি।

কখন আসব?

এখনই আসবে। আমি এখনো লাঞ্চ করি নি। তুমি এলে দুজনে একসঙ্গে খাব।

রান্না কী?

আজ বাসায় রান্না হয় নি। ভেবেছিলাম রেস্টুরেন্ট থেকে তেহারি এনে খাব। তুমি তো আবার রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে পার না। আচ্ছা এসো, আমি রান্না করব।

তুমি রাঁধতে পার না-কি?

ভাত ডাল অবশ্যই রাঁধতে পারি। কথা বলে সময় নষ্ট করো না। রওনা হও।

একটু দেরি হবে। গোসল এখনো করা হয় নি। গোসল সেরে আসি?

না, তুমি এক্ষুনি আসবে।

 

নিশু বলল, খেতে পারছ?

মতিন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

নিশু বলল, ভাতটা ড্যালডালা হয়ে গেছে। ডালে লবণ হয়েছে বেশি। বেগুনভাজা ঠিক আছে না?

মতিন বলল, বেগুনভাজা Do0g হয়েছে। ডাল Dab হয়েছে এবং তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে–তুমি একজন Secnirp.

সেকনিরপটা কী?

মতিন বলল, সেকনিরপ মানে প্রিন্সেস। তবে কপালে যে টিপটা দিয়েছ সেই টিপ মাঝামাঝি হয় নি।

নিত বলল, টিপ দিয়ে অভ্যাস নেই তো, হঠাৎ দিলাম।

হঠাৎ দিলে কেন?

সাজতে ইচ্ছা করল।

হঠাৎ সাজতে ইচ্ছা করল কেন? শকা ড়েঝে।

শকা ড়েঝে মানে?

মতিন বলল, শকা ড়েঝে মানে ঝেড়ে কাশ। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ তোমার সাজতে ইচ্ছা করল। তুমি ইস্ত্রি করা শাড়ি পরলে, কপালে টিপ দিলে, আয়োজন করে একজনের জন্যে রাঁধলে। মানে কী?

নিশু থমথমে গলায় বলল, তুমি কী বলতে চাচ্ছ?

মতিন বলল, আমি দুই-এ দুই-এ চার মেলাবার চেষ্টা করছি, তোমার কর্মকাণ্ডের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার চেষ্টা করছি।

ব্যাখ্যা পেয়েছ?

ছিয়েপে।

ফাজলামি বন্ধ করে ঠিকমতো কথা বলো। ব্যাখ্যা পেয়েছ?

পেয়েছি।

বলো, আমিও শুনি।

আমি বিয়ে করছি, এই বিষয়টা তুমি নিতে পারছ না। তোমার মধ্যে ঈর্ষা জেগে উঠেছে।

নিশু থমথমে গলায় বলল, তোমার ধারণা আমি কখনো সাজগোজ করি না? কখনো ইস্ত্রি করা শাড়ি পরি না? কখনো কপালে টিপ দেই না?

অবশ্যই দাও। তবে আজকেরটা অন্যরকম।

অন্যরকম কেন? তোমার মতো মহাপুরুষের পদধূলি পড়েছে এইজন্যে?

মতিন বলল, আজকের বিষয়টা অন্যরকম। কারণ আজ চাচাজির শরীর প্রচণ্ড খারাপ। তার জ্বর এসেছে। বেশ ভালো জ্বর। তিনি তার ঘরে শুয়ে কাতরাচ্ছেন! চাচাজিকে এই অবস্থায় রেখেও তুমি সাজসজ্জার কর্মকাণ্ড চালিয়েছ।

নিশু বলল, তুমি কী প্রমাণ করতে চাচ্ছ? তুমি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছ, তোমার মতো রাজপুত্র আমি আমার জীবনে দেখি নি? এবং রাজপুত্রের জন্যে আমি যে-কোনো মুহূর্তে জীবন বিসর্জন দিতে রাজি আছি?

আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না।

তোমাকে আমি কোন চোখে দেখি শুনতে চাও?

শুনতে চাই না।

শোন। অবশ্যই শুনতে হবে। তুমি এমন এক নিম্নবুদ্ধিবৃত্তির মানুষ যাকে সহজেই manipulate করা যায়। আমি সবসময় তাই করেছি। তোমাকে manipulate করে নানান কাজকর্ম করিয়ে নিয়েছি। আমার বাজার দরকার, বাবাকে ডেনটিস্টের কাছে নেয়া দরকার, ডাক পড়বে তোমার। তোমাকে যে আমি মোবাইল কিনে দিয়েছি কী জন্যে দিয়েছি? সময়ে অসময়ে তোমার অমৃতবাণী শোনার জন্যে না। তোমাকে যেন সময়ে অসময়ে কাজকর্মের জন্যে ডাকতে পারি সেজন্যে।

আজ দুপুরে কী জন্যে ডেকেছ?

বাবার পাশে বসার জন্যে। আমাকে ঘণ্টা তিনেকের জন্যে বের হতে হবে। এই ঘণ্টা তিনেক তুমি বাবার সঙ্গে থাকবে। আমি কেন সাজগোজ করেছি সেই রহস্য কি পরিষ্কার হয়েছে?

মতিন কিছু বলল না। নিশু বলল, নিজেকে স্মার্ট ভেব না। তুমি স্মার্ট না। তুমি অ্যাভারেজ IQ-এর একজন অ্যাভারেজ মানুষ। I am not.

নিশু খাবার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, দয়া করে থালাবাসন ধুয়ে দিয়ে যাও। বাবার কাছে একটু বসো। আমার দেরি হয়ে গেছে। এক্ষুনি বের হবো।

কোথায় যাচ্ছ?

That’s none of your business.

 

মতিন আজিজ সাহেবের ঘরে বসে আছে। একটু আগে তাঁর জ্বর মাপা হয়েছে। জ্বর একশ তিন পয়েন্ট ফাইভ। তিনি ঝিম ধরে আছেন। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছেন। শ্বাস নেবার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে তার সামান্য হলেও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি মতিনের দিকে ফিরে চাপা গলায় বললেন, নিশু কোথায় গেছে তুমি জানো?

মতিন না-সূচক মাথা নাড়ল।

তার কাজ কারবার কিছুই বুঝি না। সে কোথায় যায় কী করে তাও বুঝি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি মেয়েটার মাথায় বোঝার মতো চেপে আছি।

মতিন বলল, নিজেকে সিন্দাবাদের দৈত্য মনে হয়?

ঠিক বলেছ, সিন্দাবাদের দৈত্য। ঘাড়ে চেপে বসেছি, আর নামব না। বুঝেছ। মতিন, আমরা সবাই কোনো-না-কোনো অর্থে সিন্দাবাদের দৈত্য। এর তার ঘাড়ে চেপে আছি।

চাচাজি, আপনি কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকুন। আমি আপনার মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করছি।

পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে হবে না। তুমি যেখানে বসে আছ সেখানে বসে থাক। তোমার সঙ্গে গল্প করি। আমার গল্প করার লোক নেই। আমার মেয়ে আমার সঙ্গে গল্প করে না। সে আছে তার জগৎ নিয়ে। ভালো কথা, শুনলাম তুমি বিয়ে করছ?

জি।

বেকার ছেলেদের বিয়ের ব্যাপারে খুব উৎসাহ থাকে। বিয়ের কথা শুনলেই তারা এক পায়ে খাড়া। বিয়ের পর সে বউকে কী খাওয়াবে এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তুমি আবার আমার কথায় কিছু মনে করো না।

আমি কিছু মনে করছি না।

মেয়ের নাম কী?

তার নাম তৌ।

তৌ আবার কেমন নাম!

আসল নাম তৌহিদা। আমি শর্ট করে তৌ ডাকি।

শর্ট করে ডাকার দরকার কী?

সামান্য ঢং করছি।

বুঝতে পারছি। বেকার ছেলেরা ঢং ঠাট্টা তামাশায় একনম্বর। আসল কাজে লবডঙ্কা। লবডঙ্কা শব্দের মানে জানো?

জানি।

বলো, মানে বলো।

লব শব্দের মানে ছিদ্র। ছেদন। লবডঙ্কা মানে ছিদ্র হওয়া ঢোল। ছিদ্র করা ঢেলে কোনো শব্দ হয় না।

তুমি তো বাংলা ভালো জানো। বেকার ছেলেরা অপ্রয়োজনীয় বিষয় ভালো জানে। কাজ চলবার মতো বাংলা জানলেই তোমার চলত। চলত কি-না?

জি চলত।

মতিন, আমার নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।

আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি। জানালা খুলে দেই।

না। জানালা বন্ধ থাকুক। নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে। তোমার কাছে। সিগারেট আছে? সিগারেট থাকলে ধরিয়ে আমার হাতে দাও। শ্বাসকষ্টের মধ্যে সিগারেট, এতে কষ্টটা আরো বাড়বে। নিজেকে কষ্ট দেয়ার মধ্যেও আনন্দ। আছে। বুঝেছ? নিজেকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি।

চাচাজি, আমার কাছে সিগারেট নেই। আপনি চাইলে এনে দিতে পারি।

দরকার নেই, তুমি এখানে বসে থাক। তুমি বেকার মানুষ। তোমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকায় তো কোনো সমস্যা নেই।

জি-না, সমস্যা নেই।

এক থেকে দশের ভেতর একটা সংখ্যা বলো।

পাঁচ।

আজিজ সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, বোকা ধরনের মানুষদের যদি এক থেকে দশের ভেতর কোনো সংখ্যা ধরতে বলা হয় সে মাঝখানেরটা ধরে। সে কখনো এক ধরে না বা দশ ধরে না। তুমি একজন বোকা মানুষ। বোকা এবং বেকার, সংক্ষেপে হলো বোবে। ইংরেজিতে হবে BB.

মতিন থার্মোমিটার হাতে নিল। মানুষটা ভুল বকতে শুরু করেছে। তার জ্বর আবার দেখা দরকার।

মতিন।

জি চাচাজি।

জানালা দরজা সব খুলে দাও। নিঃশ্বাসের কষ্টটা বাড়ছে।

মতিন জানালা খুলল! বৃষ্টি খুব বেড়েছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট টুকছে। আজিজ সাহেব হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তার বুক হাপরের মতো ওঠা-নামা করছে। চোখ রক্তবর্ণ।

 

তৌহিদা নিজের ঘরে বসে আছে। তার গায়েহলুদ হয়ে গেছে। হলুদের মান ও সম্পন্ন। হলুদ স্নান মনে হয় ভালো হয় নি। গা থেকে কাঁচা হলুদের গন্ধ আসছে। গন্ধটা তৌহিদার ভালো লাগছে। গন্ধটার মধ্যেই যেন একধরনের রহস্য।

গায়েহলুদের বাড়িতে লোকজন থাকবে, হৈচৈ হবে। গান বাজনা হবে। সরকম কিছুই হচ্ছে না। তৌহিদা তার কলেজের কোনো বান্ধবীকে কিছু বলে নি। তার লজ্জা লাগছিল, বান্ধবীরা এসে দেখবে ফকির ফকির গায়েহলুদ। তারা হাসাহাসি করবে। দরকার কী? তার নিরিবিলি গায়েহলুদই ভালো। নিরিবিলি গায়েহলুদ নিরিবিলি বিয়ে। তার মন বলছে একদিন তার অনেক টাকা-পয়সা হবে। নিজের ফ্ল্যাট বাড়ি থাকবে। লাল রঙের একটা গাড়ি থাকবে। তার ছেলেমেয়েরা গাড়িতে করে স্কুলে যাবে। তখন সে বড় বড় অনুষ্ঠান করবে। ছাদে শামিয়ানা খাঁটিয়ে বড় মেয়ের জন্মদিন। কিংবা তাদের ম্যারেজ ডে।

এই যে সে এখন জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে তার তো মোটেও খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। একা আছে বলেই সে সুন্দর সুন্দর চিন্তা করতে পারছে। বিয়ের রাতে সে কী করবে এটা নিয়ে সে অনেকবার ভেবেছে। একেকবার একেকরকম করে ভেবেছে। আজ আবার ভাববে। আজকের ভাবনাটা হবে আরেকরকম। তৌহিদা ভাবতে বসল। সে ঠিক করল বিয়ের রাতে সে জবুথবু হয়ে থাকবে না। লজ্জায় নুয়ে পড়া লবঙ্গ লতিকা না। সে ফুটফট করে। কথা বলবে যেন মানুষটা চমকে যায় এবং ভাবে এই মেয়ে তো মুখ ফুটে একটা কথাও বলত না। আজ এমন ফটফট করছে কেন? ব্যাপার কী?

মানুষটা ঘরে ঢুকছে। সে বসে আছে খাটে। সে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে, কিন্তু লক্ষ রাখছে লোকটা কী করছে। লোকটা দরজা বন্ধ করে তার দিকে তাকাল। সে তখন হাই তুলতে তুলতে এবং সামান্য পা নাচাতে নাচাতে বলল, অ্যাই, কয়টা বাজে একটু দেখ তো!

লোকটা থতমত খেয়ে ঘড়ি দেখে বলল, এগারোটা।

সে তখন বলবে, সর্বনাশ, এত রাত হয়ে গেছে। কাল সারারাত আমার ঘুম হয় নি। আজ না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে। ভয় নেই, বেশিক্ষণ ঘুমাব না। দুঘণ্টা ঘুমাব। তুমি ঘড়ি হাতে আমার পাশে বসে থাকবে। দুঘণ্টা পর আমাকে ডেকে দেবে। তখন আমরা গল্প করব। পারবে না?

লোকটা বিস্মিত গলায় বলবে, পারব।

এখন তুমি পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাক। সকাল থেকে বেনারসি শাড়ি পরে আছি, গরমে ঘেমে যাচ্ছি। আমি শাড়ি বদলাব। তাকাও অন্যদিকে। চোখ বন্ধ। খবরদার, আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না। Good boy.

লোকটা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সে শাড়ি বদলাচ্ছে। শাড়ি বদলাতে বদলাতে হালকা মেজাজে গল্প করছে, অ্যাই শোন, তোমার এক বান্ধবী আছে না, নিশু না-কি শিশু নাম। ওকে একদিন খবর দিয়ে এনো তো।

লোকটা বলবে, কেন?

সে বলবে, আমি ঐ শাকচুন্নিটার দুই গালে দুটা থাপ্পড় দেব।

এইসব কী ধরনের কথা বলছ?

আমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না, ঐ শাকচুন্নির কথা শুনতে ভালো লাগছে? যাও তাহলে আর কথা বলব না। এখন চোখ খোল।

লোকটা চোখ খুলে হয়ে যাবে হতভম্ব। কারণ সে গা থেকে বেনারসি শাড়ি ঠিকই খুলেছে, তবে অন্য শাড়ি পরতে ভুলে গেছে।…

চিন্তাটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। খারাপ দিকে। তৌহিদার গা ঝিমঝিম করছে। শরীর কাঁপছে। আচ্ছা সে কি খুব খারাপ মেয়ে? সে এত খারাপ মেয়ে। কীভাবে হয়ে গেল! সে বিছানা থেকে নামল। একগ্লাস পানি খাবে। মাথার তালুতে সামান্য পানি দেবে।

রান্নাঘরের দিকে যাবার আগে সে সালেহার ঘরে উঁকি দিল। সালেহা পা। ছড়িয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসা। তার দৃষ্টি স্থির। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। তৌহিদা বলল, বুবু, আপনার কি শরীর খারাপ?

সালেহা অস্পষ্টভাবে বললেন, হুঁ।

পায়ে তেল মালিশ করে দেব?

না।

পানি খাবেন? একগ্লাস পানি এনে দেই?

না।

সালেহা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তার ধারণা যে-কোনো সময় তার নিঃশ্বাস আটকে যাবে। তার হাতের মুঠিতে একটা কুঁচকানো কাগজ। মতিনের লেখা চিঠি। মতিন লোক দিয়ে এই চিঠি তার দুলাভাইয়ের ফার্মেসিতে পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে ফার্মেসির সেলসম্যান এসে চিঠি দিয়ে গেছে। মতিন লিখেছে–

আপা,

আমি বিয়েটা করতে পারব না! আমি বিয়ে করা টাইপ পুরুষ না। পাকেচক্রে রাজি হয়ে বিরাট ঝামেলা করে ফেলেছি। আমি তৌহিদার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

মতিন

 

মেইন গ্রিডে কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে ঢাকা শহরে ইলেকট্রিসিটি নেই। অন্ধকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঝড়-বৃষ্টি। বৃষ্টি দুপুর থেকেই পড়ছিল। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড় যুক্ত হয়েছে সন্ধ্যার পর। মতিন মোমবাতি কিনে এনেছে। তার টেবিলে দুটি মোমবাতি। সে কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে। নদ্দিউ নতিমকে নিয়ে নতুন প্রবন্ধে হাত দিয়েছে। প্রবন্ধের শিরোনাম–

নদ্দিউ নতিমের ব্যক্তিগত জীবন
প্রথম বিবাহ বিষয়ক জটিলতা

এই প্রবন্ধে নদ্দিউ নতিম বিয়ের আসর থেকে হঠাৎ কী কারণে উঠে আসেন এবং সেই রাতেই পর পর তিনটি দীর্ঘ কবিতা লিখেন তার বর্ণনা আছে। নদ্দিউ নতিমকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কেন বিয়ের আসর থেকে উঠে এলেন? তিনি জবাব দিলেন, এক স্ত্রী থাকলে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ বৈধ না। কবিতা আমার স্ত্রী ও প্রণয়িনী। যেদিন থেকে আমার জীবনে কবিতা থাকবে না শুধু সেদিনই আমি দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে চিন্তা করব।

মতিনকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। বিয়ে উপলক্ষে সে চুল কাটিয়েছে। চুলে শ্যাম্পু দিয়েছে। তার গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি। মোমের আলোতে পাঞ্জাবি চকচক করছে।

প্রবন্ধের শুরুতেই নিশুর টেলিফোন। মতিন টেলিফোন ধরল।

হ্যালো, তোমাদের ওদিকে কি ঝড় হচ্ছে?

মতিন বলল, ঝড় না হলেও বাতাস হচ্ছে। জানালা খটখট করছে।

আজ তো তোমার বিয়ে?

হুঁ।

আমি বলেছিলাম তোমার বিয়েতে থাকব! থাকতে পারছি না।

অসুবিধা নেই।

কেন থাকতে পারছি না জানতে চাইলে না?

থাকতে পারছ না এটাই বড় কথা। কারণ জেনে কী হবে! যুদ্ধে কামান দাগা হয় নি এটাই মুখ্য। কেন দাগ হয় নি এটা গৌণ।

বিয়ে কোনো কামান দাগাদাগি না। মতিন শোন, আমি তোমার বিয়েতে যেতে পারছি না, কারণ বাবাকে ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছি।

কেন?

উনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। শেষে এমন হলো নিঃশ্বাস নিতে পারেন না।

এখন কী অবস্থা?

এখন অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। মতিন শোন, তোমার স্ত্রীর জন্যে আমি একটা উপহার কিনে রেখেছি। গলার এবং কানের একটা সেট।

গলার এবং কানের সেট মানে কী?

গয়না।

সোনার গয়না?

গয়না তো সোনারই হবে।

দাম কত?

উপহারের দাম এবং চাকরির বেতন জিজ্ঞেস করতে হয় না, এটা জানো।?

জানি। কৌতূহল সামলাতে পারছি না।

উনিশ হাজার সাতশ টাকা।

কী সর্বনাশ, এত দাম!

সেটের অনেক দাম হয়, এটা মোটামুটি কম দাম। বাবা টাকাটা আমাকে দিয়েছেন। উনি চাচ্ছিলেন তোমার বিয়েতে যেন দামি কিছু দেয়া হয়। বাবা যে তোমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি পছন্দ করেন, এটা তুমি জানো?

জানি। বরযাত্রী কখন রওনা হবে?

ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে তো, টাইম ঠিক থাকবে বলে মনে হয় না। দেরি হতে পারে।

তোমার পক্ষে কি সম্ভব ক্লিনিকে এসে আমাদের উপহারটা নিয়ে যাওয়া? তোমার স্ত্রী বিয়ের দিন গয়নাটা পরল। আমাদের ক্লিনিকটা কিন্তু তোমার মেস থেকে দূরে না।

ঠিক আছে, চলে আসছি।

তুমি কি তোমার স্ত্রীকে গয়না টয়না কিছু দিচ্ছ?

পাগল! আমি গয়না পাব কোথায়!

তোমাকে একটা ছোট্ট উপদেশ দেই?

দাও।

তোমার স্ত্রীকে আমাদের এই গয়নার সেটটা দিয়ে বলল এটা তুমি দিয়েছ।

তাতে লাভ?

স্বামীর দেয়া উপহার স্ত্রীর কাছে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

তুমি জানলে কীভাবে? তুমি তো বিয়ে করো নি।

আমি বিয়ে না করলেও আমার মা বিয়ে করেছিলেন। মাকে দেখেছি বাবার দেয়া সামান্য দুগাছি সোনার চুড়ি তিনি কীভাবে সারাজীবন যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন।

সেই দুগাছি চুড়ি কোথায়?

ট্রাংকে তোলা আছে। মা বলে দিয়েছেন আমার বিয়ের দিন আমাকে এই দুগাছি চুড়ি পরতে হবে। কথা বলে সময় নষ্ট করছ। তুমি টেলিফোন রেখে চলে এসো। ঠিকানাটা মনে রেখ–চৌধুরী ক্লিনিক। আঠারো বি মালিবাগ। পেট্রোল পাম্পের গলি। মনে থাকবে?

থাকবে।

মতিন টেলিফোন রেখে লিখতে বসল। আজ লেখার মুড এসেছে। সবসময় এরকম আসে না।

নদ্দিউ নতিম বাড়ি ফিরলেন বিষণ্ণ হৃদয়ে। তিনি লেখার টেবিলে বসলেন। দুটা মোমবাতি জ্বালালেন। মনে মনে ভাবলেন, মোমবাতি দুটির একটি পুরুষ অন্যটি রমণী। এরা দুজন আলো জ্বেলে একে অন্যকে পথ দেখাচ্ছে। হঠাৎ পুরুষ মোমবাতির আলো নিভে গেল। এখন শুধু মেয়েটির আলো জ্বলছে। পুরুষ তাকিয়ে আছে আলোর রমণীর দিকে। নদ্দিউ নতিমের হৃদয়ে কবিতা ভর করল। তিনি লিখলেন তাঁর অতি বিখ্যাত কবিতা কে কথা কয়?

ক্লান্ত দুপুর, মধ্য রজনীতে
প্রথম সকাল প্রথম সন্ধ্যারাতে
কে কথা কয়
ফিসফিসিয়ে আমার কথার সাথে?
তাকে চিনি
সত্যি চিনি না-কি?
তাকে চেনার কতটুকু বাকি?
নাকি সে স্বপ্নসম ফাঁকি?

মতিন ফুঁ দিয়ে একটি মোমবাতি নিভিয়ে দিল। নদ্দিউ নতিম একটি মোমবাতি জ্বেলে কবিতা লিখেছেন। সে দুটি জ্বালাতে পারে না। ।

কাজি সাহেব রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে গেলেন। বাড়তি সময় বসিয়ে রাখার জন্য কাজি সাহেবকে আলাদা টাকা দিতে হলো। তাকে বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হলো।

হাবিবুর রহমান প্লাস্টিকের বাটিতে কাজি সাহেবের জন্যে খাসির মাংসের তেহারি দিয়ে দিলেন। তৌহিদার বিয়ে উপলক্ষে তিনি বাবুর্চি দিয়ে খাসির মাংসের তেহারি রান্না করিয়েছেন। কাজি সাহেব চলে যাবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ভেবেছেন মতিন তার মত বদলাবে। ট্যাক্সি করে বাসায় চলে এসে মাথা নিচু করে বলবে, সরি। হাবিবুর রহমানের মতে মতিন তার বোনের কাছে চিঠিটি লিখে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। তারপরেও সে চলে এলে তিনি তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিলেন।

তৌহিদা বিয়ের সাজ-পোশাক খুলে সাধারণ ঘরে পরার শাড়ি পরেছে। সাবান দিয়ে মুখ ধুয়েছে। চোখের কাজল পুরোপুরি যায় নি। দুটি চোখেই কাজল লেপ্টে তাকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।

তৌহিদার খুবই ক্ষিধে লেগেছিল। সে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সহজভাবেই খেতে বসল। সালেহা কিছু খাবেন না। তার শরীর ভয়ঙ্কর খারাপ করেছে। সন্ধ্যাবেলায় দুবার বমি করে তিনি নেতিয়ে পড়েছেন! গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না।

হাবিবুর রহমান তৌহিদার প্লেটে তেহারি তুলে দিতে দিতে বললেন, মন। খারাপ করিস না। বিয়েশাদি আল্লাহ পাকের হাতে। তিনি পাঁচটা জিনিস নিজের হাতে রেখেছেন, ধন-দৌলত, রিজিক, হায়াত, মউত এবং বিবাহ। যখন কারো বিয়ে ভেঙে যায় তখন বুঝতে হয় আল্লাহপাক চান না বিয়েটা হোক। বুঝেছিস?

তৌহিদা বলল, বুঝেছি ভাইজান।

হাবিবুর রহমান বললেন, যে সব মেয়ের বিয়ে ভেঙে যায় তাদের পরে খুবই ভালো বিবাহ হয় এটা পরীক্ষিত তোর ইনশাল্লাহ এমন বিয়ে হলে যে, অঞ্চলে সাড়া পড়ে যাবে। বুঝেছিস?

জি।

আর মতিনের জন্যে আমি কী ব্যবস্থা করে রেখেছি শুনে রাখ। তাকে যদি কানে ধরে আমি দশবার উঠবোস না করাই আমার নাম হাবিবুর রহমান না। আমার নাম হাবা রহমান। ভোতা দায়ে ধার উঠলে মারাত্মক ব্যাপার হয়। ভোতা দায়ে ধার উঠে না। একবার উঠে গেলে সর্বনাশ। চারিদিকে কাটাকাটি। আমি হলাম ভোতা দা। মতিনের কী অবস্থা হয় দেখ। দেখ আমি কী করি।

কিছু করতে হবে না ভাইজান।

অবশ্যই করতে হবে। আমি ছাড়ার পাত্র না। তৌহিদা শোন, তুই আজ একা ঘুমাবি না। তোর বুবুর সাথে ঘুমাবি। একা ঘুমাতে গেলে সারারাত ফুস ফুস করে কাঁদবি। এইসব চলবে না।

ভাইজান, কোনো সমস্যা নেই। আমি কাঁদব না।

গুড। ভেরি গুড। তেহারি কেমন হয়েছে বল?

ভালো হয়েছে।

ভালো তো হবেই, এক্সট্রা ঘি দিতে বলেছি।

তৌহিদা তার ঘরে ঘুমুতে গেল। এই ঘরেই বাসর হবার কথা ছিল। ঘর সামান্য সাজানো হয়েছে। তেমন কিছু না। বিছানার চারদিকে বেলিফুলের ঝালর। কিছু লাল-নীল বেলুন। বিছানার উপর গোলাপের পাপড়ি ছিটানো।

একা একা গোলাপের পাপড়ির উপর শুয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। তৌহিদার খুবই ক্লান্তি লাগছে। এখন আর বিছানা ঝাড়তে ইচ্ছা করছে না। সে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল আর তখনই শুনল কলিংবেল বাজছে। হাবিবুর রহমান বললেন, কে?

বাইরে থেকে মতিন বলল, দুলাভাই আমি।

কী চাও?

কী আশ্চর্য কথা দুলাভাই! আজ না আমার বিয়ে!

আমার সঙ্গে ফাজলামি কর? একঘণ্টা আগে কাজি চলে গেছে।

দরজাটা খুলুন দুলাভাই।

দরজা অবশ্যই খুলব। তারপর দশবার তোমাকে কানে ধরে উঠবোস করাব।

তৌহিদা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজা খোলার শব্দ শুনল। তারপর শুনল তার ভাইজানের কঠিন গলা।

কোনো কথা নেই। উঠবোস। কানে ধরে উঠবোস। আগে কানে ধরে উঠবোস, তারপর কথা। এক, দুই, তিন…

তৌহিদা ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল। এটা কোনো কথা? বরকে কেউ কানে ধরে উঠবোস করায়? ভাইজানের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! তৌহিদা দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে চারদিকে সুনসান নীরবতা। পুরো বাড়ি অন্ধকার। সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। কেউ আসে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *