০৮. মটকু মিয়া এবং অন্যেরা
পুকুর ঘাটের একপাশে বুকপানিতে রাশা দাঁড়িয়ে আছে, অন্যপাশে জয়নব। জয়নব রাশাকে সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে, গত কয়েকদিন থেকে তার প্র্যাকটিস চলছে।
জয়নব বলল, “মাথাটা ডুবিয়ে তুই আমার কাছে চলে আয়।”
রাশা বলল, “বলা খুব সোজা। মাথা ডুবিয়ে চলে আসব কিভাবে? মাথা ডোবালে নাকে-মুখে-চোখে পানি ঢুকে যাবে না?”
জয়নব বলল, “না যাবে না। মাথা ডুবিয়ে সাঁতার শেখা সবচেয়ে সোজা। যখন শিখে যাবি তখন আস্তে আস্তে মাথাটা পানি থেকে বের করা শিখবি। আয়, চলে আয়।”
রাশা বলল, “ভয় করে।”
জয়নব বলল, “ভয়ের কী আছে? আমি আছি না? আয়।”
রাশা বলল, “তবু ভয় করে।”
জয়নব বলল, “তুই হচ্ছিস একটা ভীতুর ডিম! ঠিক আছে আমি কাছে আসছি, আমি তোকে ধরে রাখছি, এখন আয়।”
রাশা জয়নবকে ধরে হাত-পা ছুঁড়ে অনেক পানি ছিটিয়ে সাঁতার দেয়ার চেষ্টা করল, তার ফলে যেটা ঘটল সেটাকে আর যাই হোক সাঁতার দেয়া বলে না।
এ রকম সময় জিতু এসে হাজির, সে খানিকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে রাশার হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার দেয়ার চেষ্টাটা দেখল, তারপর হি হি করে হাসতে শুরু করল। রাশা তার পানি ছিটানো বন্ধ করে বলল, “কী হয়েছে? তুই এরকম দাঁত কেলিয়ে হাসছিস কেন?”
“তুমি যদি এইভাবে আরো কয়দিন সাঁতার শেখার চেষ্টা করো তাহলে পুকুরের সব পানি পাড়ে উঠে যাবে।”
“ঢং করবি না। তুই যখন প্রথম সাঁতার শিখেছিলি তখন তুইও নিশ্চয়ই এইভাবে সাঁতার শিখেছিলি।”
জিতু মিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু আমি সাঁতার শিখেছি এক ঘণ্টায়।”
“মিছে কথা বলবি না। মানুষ একঘন্টায় সাঁতার শিখতেই পারে না।”
“আমি শিখেছিলাম।”
“কিভাবে?”
“আমার বাবা আমাকে ধরে পানিতে ফেলে দিয়েছিল।”
“কী করেছিল?”
“পানিতে ফেলে দিয়েছিল।”
রাশা চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই সাঁতার জানিস না আর তোর বাবা তোকে পানিতে ফেলে দিল?”
“হ্যাঁ।”
“তারপর?”
“আমি পানি খেতে খেতে ডুবে গেলাম। যখন মরে যাচ্ছি তখন বাবা ঘাড় ধরে ওপরে তুলেছে। একটু নিশ্বাস নিয়ে যখন ঠিক হয়েছি, তখন আবার পানিতে ফেলে দিল।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। আমি তখন জান বাঁচানোর জন্যে কোনোমতে ভাসার চেষ্টা করি–যখন পারি না ভুবে যাই, নাকে দিয়ে মুখে দিয়ে পানি ঢোকে তখন বাবা ঘাড় ধরে টেনে তোলে। নিশ্বাস নেবার জন্যে একটু সময় দেয়। দুই একবার নিশ্বাস নেবার পর আবার পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।”
“খবরদার মিছে কথা বলবি না।”
“খোদার কসম, মিছা কথা না। এইভাবে কয়েকবার করার পর ভেসে থাকা শিখে গেলাম। একঘন্টার মাঝে।”
রাশা বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “কী সর্বনাশ! তোর বাবার বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করা উচিত ছিল।”
জিতু হি হি করে হেসে বলল, “রাশাপু তুমি আজিব! এক্কেবারে আজিব।”
রাশা বলল, “ঠিক আছে আমি আজিব হলে আজিব। তুই আমাকে ডিস্টার্ব করবি না।”
জিতু খানিকক্ষণ রাশার সাঁতার শেখার কসরত দেখে হতাশভাবে মাথা নেড়ে জয়নবকে বলল, “জয়নব বুবু তুমি রাশাপুকে সাঁতার শেখাতে পারবে না। আমার কাছে দাও, আমি শিখিয়ে দিই।”
রাশ জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে শিখাবি?”
“ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দিব। রাশাপু একটু পানি খেয়েটেয়ে সাঁতার দিয়ে পাড়ে উঠবে।”
রাশা চিৎকার করে উঠল, “জিতু, তোকে আমি খুন করে ফেলব। এক্কেবারে খুন করে ফেলব। খবরদার আমার কাছে আসবি না। আমার একশ মাইলের ভিতরে তুই আসবি না।”
জিতু রাশার আতঙ্কটা উপভোগ করে হি হি করে খানিকক্ষণ হাসিল তারপর নিজের শার্ট খুলে পুকুর ঘাটে রেখে ঝপাং করে একটা লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর ভুস করে পুকুরের মাঝামাঝি সে ভেসে ওঠে। দেখে মনে হয় সে যে পানিতে আছে সেটা তার মনেই নেই। হাত-পা কিছু না নাড়িয়ে পানিতে সে শুয়ে থাকতে পারে, কে জানে মনে হয় ঘুমিয়েও যেতে পারে। রাশা জিতুর দিকে হিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
অনেকবার অনেকভাবে চেষ্টা করেও রাশা যখন কোনোভাবেই ভেসে থাকতে পারল না, যখন সে প্রায় সাঁতার শেখার আশা ছেড়েই দিল ঠিক তখন সে হঠাৎ করে খানিকটা জায়গা পানিতে ভেসে চলে এলো। জয়নব খুশি হয়ে বলল, “এই তো হয়ে গেছে! তোর আর কোনো চিন্তা নাই! তুই এইবারে সাঁতার শিখে যাবি।”
রাশা চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি!”
জয়নবের কথা সত্যি বের হলো। গত কয়েকদিন রাশা কতবার কতভাবে ভাসার চেষ্টা করেছে, পারেনি, এখন হঠাৎ করে সে ভেসে থাকতে পারছে। ব্যাপারটা কিভাবে সম্ভব রাশা কিছুতেই বুঝতে পারল না, একটা মানুষ একসময় ভেসে থাকতে পারে না, পানিতে ছেড়ে দিলে মারবেলের মতো ডুবে যায়। সেই মানুষটাই আবার একসময় পানিতে ভেসে থাকতে পারে তাকে তখন চেষ্টা করেও ডোবানো যায় না! জিতুকে দেখেছে শরীরের একটা আঙুলও না নাড়িয়ে সে পানিতে ভেসে থাকে!
পরের কয়েকদিন রাশাকে পানি থেকে সহজে তোলা গেল না। পানিতে ডুবে থাকতে থাকতে তার আঙুলগুলি হয়ে যেত শুকনো কিশমিশের মতো, যখন পানি থেকে শেষ পর্যন্ত সে উঠত তখন তার চোখ হতো টকটকে লাল এবং তার চারপাশের সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া দেখাত। আজকাল যখন সে খেতে বসে তখন আবিষ্কার করে তার খিদে পায় রাক্ষসের মতো, পিঁড়িতে বসে সে একগাদা ভাত খেয়ে ফেলে! প্রথম যখন সে এখানে এসেছিল তার গায়ের রং ছিল ইটের নিচে চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মতো বর্ণহীন ফর্সা, এখন তার গায়ের রং হয়েছে তামাটে বাদামি। সেখানে বিচিত্র একধরনের সজীবতা, রাশা নিজেকে দেখে নিজেই কেমন অবাক হয়ে যায়। তিন মাইল হেঁটে স্কুলে যায়, তিন মাইল হেঁটে ফিরে আসে, সাঁতরে পুকুর এপার-ওপার করতে পারে অবলীলায়। নিজের ভেতরে সে কেমন যেন শক্তি অনুভব করে। দৈহিক একধরনের শক্তি। যে শক্তি তার আগে কখনো ছিল না।
সাঁতার শেখার পর রাশা গাছে ওঠা শেখায় মন দিল। এখানে তার ওস্তাদের দায়িত্ব পালন করল মতি। রাশা আবিষ্কার করল গাছে চড়তে শেখা সাঁতার শেখার মতো এত কঠিন না। কাজটা অনেক সহজ, গাছে চড়ার জন্যে দরকার খানিকটা সাহস আর অনেকখানি আত্মবিশ্বাস। জয়নব রাশাকে সাঁতার শিখিয়েছে অনেক আগ্রহ করে কিন্তু দেখা গেল তার গাছে চড়ার ব্যাপারে জয়নবের আগ্রহ অনেক কম। রাশা যখন পেয়ারা গাছ, আমগাহু চড়া শেষ করে একটা নারকেল গাছে চড়া শেখার চেষ্টা করতে লাগল, তখন জয়নব তাকে বাধা দিল। বলল, “দেখ রাশা, এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
“কোনটা?”
“এই যে নারকেল গাছে ওঠা শেখার চেষ্টা করছিস।”
“কেন? এটা বাড়াবাড়ি কেন?”
“সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। কিছু কিছু কাজ হচ্ছে পুরুষ মানুষের, কিছু কিছু কাজ মেয়ে মানুষের।”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “এটা সত্যি না। যে কাজ পুরুষ মানুষ করতে পারে, সেই কাজ মেয়ে মানুষেও পারে।”
“ঠিক আছে তুই তাহলে একজন মেয়ে মানুষকে বল দাড়ি কামাতে।”
রাশা মুখ শক্ত করে বলল, “সেটা অন্য জিনিস। মেয়েদের দাড়ি না উঠলে সেটা কামাবে কেমন করে?”
“মোটও অন্য জিনিস না। কিছু কিছু জিনিস মেয়েদের করা ঠিক না। মেয়েদের নারকেল গাছে ওঠা ঠিক না।”
“কেন?”
“তুই চিন্তা করে দেখ, বানরের মতো তুই নারকেল গাছে উঠছিস, পী বাঁকিয়ে গাছটাকে খিমচে ধরে রাখছিস, দৃশ্যটা কী সুন্দর হলো? মোটেও সুন্দর দৃশ্য না। দৃশ্যটা জঘন্য!”
রাশা এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার মানুষ না, কিন্তু জয়নব তখন অন্য একটা কায়দা করল। সে রাশার ওস্তাদ মতিকে ভয় দেখিয়ে বলল, মতি যদি রাশাকে নারকেল গাছে ওঠার তালিম দেয় তাহলে জয়নব তার ঠ্যাং ভেঙে দেবে! জয়নব চুপচাপ মানুষ কিন্তু তার পরিচিতরা তাকে বেশ সমীহ করে চলে। তাই মতি পিছিয়ে গেল, রাশার আর নারকেল গাছে চড়া শেখা হলো না।
মতি তাকে নারকেল গাছে চড়া না শেখালেও অন্য একটি জিনিস শেখাল সেটা হচ্ছে পাখি ধরার ফাঁদ দিয়ে বক ধরা। ফাঁদটা সে তৈরি করে নিজে। এক-দেড় হাত লম্বা একটা গাছের ডাল কেটে নেয় যেটা সামনে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। ডালের একমাথায় সাইকেলের একটা স্পেক গেঁথে নেয়। স্পোকের মাথায় শক্ত সুতোয় একটু ফাঁস লাগানো থাকে, পাখির খাবার জন্যে কিছু একটা রাখা হয়, বক যখন সেখানে ঠোকর দেয় সাথে সাথে তার গলায় ফাসটা আটকে যায়। পাখির এই ফাঁদের সবকিছুই রাশা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেছে, কিন্তু যখন তার খাবারটা দেখল তার গা গুলিয়ে এলো। সেখানে রাখা হয়েছে জীবন্ত এবং পুরুষ্ট একটা তেলাপোকা!
মতির সাথে সাথে রাশা ধানক্ষেতে গিয়ে ফাঁদ পেতে এসেছে তারপর দূরে একটা বটগাছের ছায়ায় বসে অপেক্ষা করেছে। মতি বলেছে বক ধরা খুব সহজ নয়, দুই-চারদিনে হয়তো একটা বক ধরা পড়বে, কিন্তু রাশার কপাল ভালো প্রথম দিনেই একটা বক ধরা পড়ল। ফঁদে আটকে পড়ে বকটা যখন ছট ফট করছে তখন মতির সাথে সাথে রাশা ছুটে গিয়েছে, গলা থেকে ফস খুলে মতি শক্ত করে বকটাকে ধরে রেখে রাশাকে বলল, “রাশবু, বক থেকে খুব সাবধান।”
“কেন?”
“বক কিন্তু ঠোকর দিয়ে তোমার চোখ গেলে দেবে।”
মতির হাতে বকটাকে দেখে এত শান্তশিষ্ট আর নিরীহ মনে হচ্ছিল যে রাশার বিশ্বাসই হচ্ছিল না এই বক ঠোকর দিয়ে কারো চোখ গেলে দিতে পারে। তারপরেও সে সাবধানে থাকল! মতি তাকে বকটা দিয়ে এটাকে পোষার জন্যে কী করতে হবে, দুই বেলা কখন কী খাওয়াতে হবে সবকিছু বলে দিল।
রাশা বকটাকে বাড়ি এনে একটা ঝাঁপির নিচে আটকে রাখল। মতির উপদেশমতো সে তাকে খেতে দিয়েছে কিন্তু বুকটা সেই খাবার ছুঁয়েই দেখল না। সারাক্ষণ সে ঋপির ভেতরে অস্থিরভাবে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় হেঁটে বেড়াতে লাগল। পারবে না জেনেও বকটা বারবার বের হয়ে যাবার চেষ্টা করে। মানুষের যখন মন খারাপ হয় তখন তার মুখ দেখে বোঝা যায় পাখিদের বেলায় সেরকম কিছু নেই। বকটার চোখ-মুখ দেখে বোঝার কোনো উপায়ই নেই যে তার মন খারাপ, কিন্তু সারাক্ষণ তার হাঁটাহাঁটি দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মনটা খুব খারাপ। হয়তো এই বকটা মা বক, তার বাচ্চাদের রেখে তাদের জন্যে খাবার নিতে এসেছিল। হয়তো এখন তার বাচ্চারা মায়ের জন্যে অপেক্ষা করছে, মা আর আসছে না। ব্যাপারটা চিন্তা করে রাশার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেল। বিকেলবেলা সে ঝাঁপির ভেতর হাত ঢুকিয়ে বকটাকে বের করে এনে গায়ে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তোকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি, তুই তোর বাচ্চাদের কাছে যা। যাবার সময় দুইটা টেংরা মাছ ধরে নিয়ে যাস। ঠিক আছে? আর শোন, একটু ভদ্র ব্যবহার করা শিখবি। ঠোকর দিয়ে মানুষের চোখ গেলে দেওয়া এইটা আবার কী রকম অভ্যাস। আর যদি এটা শুনি তাহলে কিন্তু ভালো হবে না–”
তারপর রাশা বকটাকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিল, সাথে সাথে সেটা ডানা ঝাঁপটিয়ে উঠে যায়, মাথার উপরে একটা চক্কর দিয়ে সেটা ধানক্ষেতের দিকে উড়ে গেল। রাশার স্পষ্ট মনে হলো সেটা তার মাথার উপর চক্কর দিয়েছে তাকে থ্যাংকু বলার জন্যে।
.
রাশা জিতুর কাছ থেকে শিখল কেমন করে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে হয়। মাছ ধরার জন্যে দরকার টোপ আর জিতুর মতে মাছের সবচেয়ে পছন্দের টোপ হচ্ছে কেঁচো। শুনেই রাশার গা ঘিন ঘিন করে উঠল, কিন্তু তার পরেও সে জিতুর পিছে পিছে গেল। সঁতসেঁতে জায়গায় ছোট ছোট যে মাটির টিবি সেগুলো নাকি কেঁচোর পেট থেকে বের হয়েছে। একটা কোদাল দিয়ে সেরকম একটা জায়গায় কোপ দিতেই অসংখ্য ছোট-বড় মাঝারি কেঁচো কিলবিল করে বের হয়ে এলো। একটা কচু পাতায় খানিকটা মাটি রেখে তার মাঝে জিতু কয়েকটা পুরুষ্ট কেঁচো এনে ছেড়ে দেয়। তারপর দুটো ছিপ আর মাছ রাখার জন্যে একটু চোপড়া নিয়ে সে রাশাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। গ্রামের এক কোনায় গাছগাছালি দিয়ে ঢাকা একটা মজা পুকুরে এসে জিতু ছিপ ফেলল। ছিপের বড়শিতে টোপ লাগানোর বিষয়টি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। জিতু নখ দিয়ে ঘামচি মেরে কেঁচোর খানিকটা ছিঁড়ে নেয় তারপর সেটা বড়শিতে গেঁথে ফেলে। রাশা অবাক হয়ে দেখে যে অংশটা ছিঁড়ে বড়শিতে লাগানো হয়েছে আর যে অংশটা রয়ে গেছে দুটোই কিলবিল করে নড়ছে। কী আশ্চর্য! কী ঘেন্না!
ছিপ ফেলে রাশা ফাতনার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পর হঠাৎ সেটা টুকটুক করে নড়তে থাকে। জিতু বলল, “মাছ ঠোকরাচ্ছে।”
“তুলব?”
“না–না–এখনই না। যখন ফাতনা ডুবে যাবে তখন।” রাশা অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু ফাতনা আর ডোবে না। শেষে ছিপটা তুলে দেখে মাছ টোপটা খেয়ে চলে গেছে! জিতু বলল, “মাছদের অনেক বুদ্ধি! খুব সাবধানে শুধু টোপটা খায়, বড়শিটা গিলে না।”
রাশা বলল, “এখন কী করব?”
“নূতন করে টোপ লাগাও।”
“আমি?”
“নয়তো কে? মাছ ধরতে এসেছ তুমি আর টোপ লাগাবে আরেকজন?” রাশা জীবনে কখনো কল্পনা করে নি যে সে নখ দিয়ে লাল রঙের পুরুষ্ট একটা কেঁচোকে ছিঁড়ে ফেলবে। সেটা তার হাতে কিলবিল করতে থাকবে এবং সে চিৎকার না দিয়ে শান্তভাবে ভেঁড়া অংশটা বড়শিতে গেঁথে ফেলবে। কিন্তু সে সেটাই করল এবং সেটা করার সময় সে ঘেন্নায় বমি পর্যন্ত করে দিল না।
দ্বিতীয়বার ছিপটা ফেলার কিছুক্ষণের ভেতরেই ফাতনাটা নড়তে থাকে তারপর হঠাৎ সেটা ডুবে গেল, সাথে সাথে রাশা টান মেরে ছিপটা তুলে ধরে! আর কী আশ্চর্য ছিপের মাথায় কুচকুচে কালো রঙের ভয়ঙ্কর একটা মাছ কিলবিল কিলবিল করছে।
জিতু আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “ইস! কত বড় মাগুর মাছ।”
“এইটা মাগুর মাছ? দেখে তো সাপের ভাতিজা মনে হচ্ছে।“
“ধুর। সাপের ভাতিজা কেন হবে? এটা মাগুর মাছ। মাগুর মাছ খেতে খুব মজা।”
মাগুর মাছটা ছটফট করতে থাকে, জিতু মুখ থেকে বড়শিটা খুলে খলুইয়ের ভেতর রেখে দেয়। রাশা অবাক হয়ে মাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে–তার জীবনের প্রথম ধরা একটি মাছ। কুতকুতে দুটি চোখে সেই মাছ তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাশা বলল, “আমার কী মনে হয় জানিস?”
“কী?”
“এটা আসলে মাছ না।”
“এটা তাহলে কী?”
“এটা আসলে একটা রাজকন্যা।”
“রাজকন্যা?”
“হ্যাঁ। একজন সন্ন্যাসী অভিশাপ দিয়ে এটাকে মাগুর মাছ বানিয়ে ফেলে এই পুকুরের নিচে রেখে গেছে।”
জিতু মিয়ার চোখে পরিষ্কার একটা ভয়ের ছাপ পড়ল, সে শুকনো গলায় বলল, “তোমার তাই মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ। দেখছিস না কেমন করে তাকাচ্ছে। পরিষ্কার মনে হচ্ছে বলতে চাইছে আমাকে ছেড়ে দাও, পিজ ছেড়ে দাও। যখন আমার অভিসাপ কেটে যাবে তখন আমি আবার রাজকন্যা হয়ে যাব। কিন্তু যদি কেটেকুটে খেয়ে ফেল তাহলে আর রাজকন্যা হতে পারব না।
রাশা এমন করে গলার মাঝে আবেগ দিয়ে কথাটা বলল যে জিতু বিভ্রান্ত হয়ে গেল। বলল, তাহলে কী করব? ছেড়ে দেব?
রাজেই রাশা আর জিতু অভিশপ্ত রাজকন্যাকে আবার মজা পুকুরটাতে ছেড়ে দিল। এতে অবশ্যি একটা লাভ হলো, ফিরে এলে জিতু যখনই এই মাগুর মাছটার গল্প করছিল তখন হাত দিয়ে সেটা কত বড় দেখানোর সময় তার আর কোনো বাধা-নিষধ থাকল না। কার সাথে গল্প করছে তার ওপর নির্ভর করে সে মাছটার সাইজটাও বড় থেকে বড় করতে লাগল।
রাশা যে শুধু গাছে চড়া শিখল, সাঁতার শিখল, কক আর মাছ ধরা শিখল না নয়, সে গ্রামের গাছগাছালিও চিনতে শিখল। এ ব্যাপারে তার নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষক নেই–সবাই কম বেশি তার শিক্ষক। যেমন নানি হঠাৎ করে পুকুর পাড় থেকে কোনো একধরনের লতাপাড়া ভেঙে এনে বেঁধে ফেলেন সেগুলো নাকি কলমি শাক। কিংবা জয়নব ছোট ছোট একধরনের গাছ তার সারা ফুল আর ফল দেখিয়ে বলে, এই গাছ থেকে খুব সাবধান। এটা হচ্ছে ধুতুরা গাছ। ধুতুরার সবকিছু হচ্ছে বিষ।
রাশা গাছটা আরো করে চিনে রাখে, বলে যদি কখনো মরে যেতে চাই তাহলে এই গাছের ফল খেলেই হবে?
জয়নব মাথা নেড়ে বলে, ছিঃ! এরকম বলে না। তুই মরে যেতে চাইবি কেন?
জিতু খুন নিরীহ ছোট একটা গাছ দেখিয়ে বলে, এই যে, এইটে হচ্ছে চুতরা গাছ। বুঝলে রাশাপু তুমি যদি কাউকে একটা শিক্ষা দিতে চাও তাহলে এই গাছটা নিয়ে তার ঘাড়ের মাঝে লাগিয়ে দিবে। তাহলে সে বুঝবে মজা।”
“কী মজা?”
“চুলকাতে চুলকাতে তার বারটা বেজে যাবে।” দৃশ্যটা কল্পনা করে জিতুর নিশ্চয়ই অনেক আনন্দ হলো কারণ তার চোখে-মুখে আনন্দের একটা আভা ফুটে উঠল।
রাশা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “অরি আমি যে গাছটা হাত দিয়ে ধরব তখন আমার হাত চুলকাবে না?”
“সাবধানে ধরবে। গাছের গোড়ায় ধরবে তাহলে চুলকাবে না। পাতাটা যেন হাতে না লাগে খুব সাবধান।”
এরকম অসংখ্য বিষয়ে রাশার জ্ঞান বাড়তে থাকে, সব জ্ঞানই যে তার জীবনে কাজে লাগবে তা নয় কিন্তু কোনো জ্ঞান তো আর ফেলে দেয়া যায় না! সে চাইছে কি না চাইছে তাতে কিছু আসে যায় না। হাজার রকমের প্রয়োজনীয় আর অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান তার মাথার ভেতরে এসে জমা হতে থাকে।
শুধু রাশার মাঝে যে জ্ঞান জমা হতে থাকে তা নয় সে নিজেও কিছু কিছু জ্ঞান অন্যদের মাঝে বিতরণ করল। যেমন ধরা যাক, জেঁকের ব্যাপারটা।
একদিন স্কুল থেকে আসছে, রাশার মনে হলো তার পায়ের কাছে একটু চুলকাচ্ছে, পা দিয়ে সেখানে একটু ঘষা দিয়ে সে হাঁটতে থাকে। যখন বাড়ির কাছাকাছি এসেছে তখন হঠাৎ মতি চিৎকার করে বলল, “রাশা বুবু। দাঁড়াও।”
রাশা ভয় পেয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“জোক।”
“জোক?” রাশা এবারে জোরে চিৎকার করে বলল, “কোথায়?”
“তোমার পায়ে।”
রাশা তখন আতঙ্কে লাফাতে থাকে, কী করবে বুঝতে পারে না। মতি বলল, “নড়বে না, তুমি নড়বে না।”
রাশার প্রায় হার্টফেল করার অবস্থা, কিন্তু তারপরেও সে স্থির হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, তখন যে কয়জন ছিল সবাই তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। রাশা দেখল কালোমতন তেলতেলে পিছলে একটা জিনিস তার গোড়ালিতে কামড়ে ধরে আছে। মতি সেটাকে টেনে ছোটানোর চেষ্টা করল, জিনিসটা রবারের মতন যতই টানা হয় ততই লম্বা হয় কিন্তু ছোটানো যায় না। কয়েকবার চেষ্টা করার পর শেষ পর্যন্ত সেটা ছুটে এলো। জোকটাকে মাটিতে ফেলে মতি পা দিয়ে সেটাকে পিষে ফেলতে যাচ্ছিল, রাশা তাকে থামাল, বলল, “দাঁড়া দাঁড়া।
“কী হয়েছে?”
“জোঁকটাকে মারিস না।”
“কেন?”
“কাজ আছে আমার।”
“কী কাজ?”
রাশা তার পায়ের গোড়াল্টিা দেখল, যেখানে জোকটা ধরেছে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে, সে জানে কিছুক্ষণ রক্ত বের হবে। ইন্টারনেটে সে পড়েছিল জোকের লালায় ব্যথানাশক জিনিস থাকে সেই জন্যে সে একটুও ব্যথা পায়নি, প্রথম যখন ধরছে তখন শুধু একটু চুলকিয়েছে। জোকের লালায় আরো একটা জিনিস থাকে যেটা দিয়ে সে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। সে জন্যে জোক এত নিশ্চিন্ত আরামে রক্ত খেতে পারে।
রক্ত খেয়ে সেঁকটা মোটা ঢোলের মতো হয়েছে এখন সে ধীরে ধীরে সরে যেতে চেষ্টা করল। রাশা বলল, “এই জোকটাকে ধরে নিতে হবে।”
“কী করবি।”
“পালব।”
জয়নব বলল, “পালবি? ছিঃ!”
রাশা বলল, “জোক হচ্ছে একটা অসাধারণ জিনিস। আমি বইয়ে পড়েছি একটা জোক যদি ভালো করে একবার রক্ত খেতে পারে তাহলে পরে টানা দুই বছর সে কিছু না খেয়ে থাকতে পারে।”
“যাহ।”
“সত্যি কথা। আমার তো মনে হয় এই ব্যাটা বদমাইশটা ভালো করেই আমার রক্ত খেয়েছে, এখন দেখি এইটা কত দিন না খেয়ে থাকতে পারে।”
জিতুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “তুমি সত্যি এটা পালবে?”
“হ্যাঁ। একটা বোতলের মাঝে পানি রেখে ছেড়ে দেব, দেখিস এটা কমপক্ষে একবছর বেঁচে থাকবে। তা ছাড়া আরো একটা জিনিস হবে।”
“কী হবে?”
“জোঁক বাতাসের চাপ বুঝতে পারে। ঝড় আসার আগে আগে দেখবি জোক পানি থেকে বের হয়ে আসবে।”
“যাহ।”
রাশা বলল, “সত্যি কথা। আমি ইন্টারনেটে পড়েছি।”
.
কাজেই জেঁকটাকে খুব সাবধানে বাড়ি এনে একটা প্লাস্টিকের বোতলে পানি ভরে সেখানে ছেড়ে দেয়া হলো। সেঁকটা বেশ আনন্দেই সেখানে ঘোরাঘুরি করতে লাগল।
রাশা বলল, “এই জোকটার একটা নাম দিতে হবে।”
“কী নাম দেবে?” জিতু মিয়ার চোখ আনন্দে চকচক করতে থাকে।
“তোরা বল।”
“তোমার রক্ত খেয়েছে, তাই এটার নাম দাও রক্তখেকো।”
“উঁহু। এটা বেশি কঠিন নাম, সোজা দেখে একটা নাম দে।”
“রক্ত খেয়ে যেমন ভোটকা হয়েছে। তাহলে এটার নাম দাও ভোটকা মিয়া। না হয় মটকু মিয়া।”
রাশা বলল, “ মটকু মিয়া নামটা ভালো। মটকু মিয়া নামটাই দেয়া যাক। কী বলিস?”
সবাই মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল।
নানি অবশ্যি মটকু মিয়াকে দেখে নাক-মুখ কুঁচকে বললেন, “জোঁক? বোতলের ভিতরে জোঁক? রাশা তোর কি ঘেন্না বলে কিছু নাই?”
“নানি এটার নাম হচ্ছে মটকু মিয়া।”
“জোঁকের আবার নামও আছে?”
“হ্যাঁ নানি। আমার রক্ত খেয়ে মোটা হয়েছে তাই মটকু মিয়া।”
“তুই আর কী কী রাখবি, আগের থেকে শুনে রাখি। সাপ, ব্যাঙ, বিছা?”
“না নানি, আর কিছু রাখব না। এই জোকটা আসলে হচ্ছে ব্যারোমিটার। যদি দেখো এটা পানি থেকে বের হয়ে উপরে উঠে যায় তাহলে বুঝবে সেদিন ঝড় হবে।”
নানি মাথা নাড়লেন, বললেন, “ঝড় হবে কি হবে না সেটা দেখার জন্যে তোর জোককে দেখতে হবে না। আকাশের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে।”
গ্রামে এমন কোনো মানুষ নেই কিংবা এমন কোনো গরু-ছাগল নেই যাকে সেঁক কামড়ায়নি, কাজেই জোঁক নিয়ে কারো আলাদা কৌতূহল থাকার কথা নয়, তারপরও মটকু মিয়া এখানকার সবার মাঝে জনপ্রিয় হয়ে গেল। এদিকে কেউ এলেই মটকু মিয়াকে একনজর দেখে যায়। মটকু মিয়া নিরিবিলি পানিতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে বসে থাকে, তাকে ঘিরে যে অনেক উত্তেজনা সেটা সে জানেও না।
তবে মটকু মিয়া রাশার সম্মানটা নষ্ট করল না। একদিন দুপুরবেলা খুব গরম, কেমন যেন দম আটকানো একটা পরিবেশ। নানি বললেন, “দিনটা ভালো লাগছে না।”
রাশা বলল, “কেন নানি? দিনটা ভালো লাগছে না কেন?”
“ঝড় হবে মনে হয়।”
রাশা তখন তার মটকু মিয়াকে নিয়ে আসে, সত্যি সত্যি সেটা পানি থেকে বের হয়ে উপরে উঠে এসেছে। রাশা বলল, “নানি! তুমি ঠিকই বলেছ। এই দেখো মটকু মিয়া পানি থেকে বের হয়ে এসেছে। মনে হয় আজকে আসলেই ঝড় হবে।”
আসলেই কিছুক্ষণের মাঝে আকাশের এক কোনায় এক টুকরো কালো মেঘ দেখা গেল, তারপর দেখতে দেখতে পুরো আকাশ কালো হয়ে উঠল। রাশা নিশ্বাস বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে কখনো এমন কুচকুচে কালো এমন ক্রুদ্ধ আর এমন ভয়ঙ্কর আকাশ দেখেনি। কিছুক্ষণের মাঝে আকাশ চিরে বিদ্যুৎ ঝলকে উঠতে থাকে, সাথে সাথে মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন। প্রথমে এতটুকু বাতাস নেই, তারপর হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা দমকা হাওয়া এলো, গাছের পাতা, খড়কুটো উড়তে থাকে, ধুলায় চারিদিক ঢেকে যায়। গরু-বাছুর গলা ছেড়ে ডাকতে ডাকতে ছুটতে থাকে, পাখি তার স্বরে শব্দ করতে করতে উড়তে থাকে! রাশা বাইরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল, বাতাসের ঝাঁপটার জন্যে পরিচিত মাঠঘাট, গাছপালা সবকিছুকে কী বিচিত্র দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে তাকে বুঝি বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
নানি চিৎকার করে ডাকলেন, “রাশ ভিতরে আয়। এক্ষুণি ঝড় শুরু হবে।”
“আমি বাইরে থাকি নানি? বৃষ্টিতে ভিজি?” নানি অবাক হয়ে রাশার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কী বললি?”
“বলেছি বৃষ্টিতে ভিজি?”
নানি কয়েক মুহূর্ত রাশার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে।”
রাশা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইল, প্রথমে বড় বড় কয়েকটা পানির ফোঁটা পড়ল, তারপর আরো কয়েকটা, তারপর আরো কয়েকটা। তারপর ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। রাশা তার দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে মুখ উপরে তুলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নাচতে থাকে। তার মনে হয় সে বুঝি কোনো এক জঙ্গলের আদিম একজন মানুষ, তার চারপাশে কেউ নেই, শুধু পশুপাখি, গাছপালা আর বনলতা। সেখানে সে নাচছে তার সাথে সাথে নাচছে বনের সব পশু, সব পাখি, সব গাছপালা! রাশা প্রথমে বিড়বিড় করে তারপর জোরে জোরে চেঁচিয়ে গাইতে লাগল :
“মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ।”
রাশা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নাচতে নাচতে গাইতে থাকে তখন হঠাৎ শুনল কে যেন ডাকছে, “রাশাপু রাশাপু—”
রাশা ঘুরে তাকাল, জিতু, মতি, জয়নব আরো অন্য বাচ্চারাও ভিজতে ভিজতে চলে এসেছে। রাশা আনন্দে হেসে ফেলল, “কী মজা দেখেছিস?
বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দে কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। সবাই আনন্দে লাফাতে থাকে, নাচতে থাকে, গাইতে থাকে, সে গানের যেন কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই।
নানি ঘরের দাওয়ায় বসে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তার স্বামীও এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গান গাইত। যেদিন রাজাকারেরা তাকে ধরে নিয়েছিল সেদিন ঠিক এভাবে বৃষ্টি হচ্ছিল।
নানি লক্ষ করেন তার হাতটা থরথর করে কাঁপছে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে চায়, সবকিছু কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে আসতে চায়। তার মাঝেও নানি স্থির হয়ে বসে থাকতে চান।