‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন এক সাহিত্যিক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন শান্তিনিকেতনে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার লেখক নন, তিনি ‘প্রবাসী’র ও ‘সবুজপত্রে’র। জলধর সেন তাঁর কাছে লেখা চাইতে আসেননি, এসেছেন অন্য কারণে। জলধর সেনের আদি নিবাস নদীয়া জেলার কুমারখালি গ্রামে, সেই অঞ্চলটি ঠাকুরদের জমিদারির অন্তর্গত। জলধর সেন ঠাকুরদের প্রজা, কয়েক বছরের খাজনা বাকি পড়েছে, তিনি এসেছেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে কিছুটা খাজনা মকুব করে দেবার আবেদন জানাবার জন্য।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের নির্দিষ্ট সময়ের আগে জলধর সেন সর্বত্র ঘুরে ঘুরে দেখছেন বন্ধুটির সঙ্গে।
সকালের প্রার্থনা সভা সেরে রথী আসছে এদিকে, জলধর সেনকে দেখে চিনতে পেরে কথাবার্তা বলতে লাগল। কথার মাঝখানে জলধর তার পাশের শ্যামলা রঙের, মধ্যম আকৃতি, সাদামাটা চেহারার ব্যক্তিটিকে দেখিয়ে বললেন, এঁকে চেনেন? ইনি নভেলিস্ট শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।
রথী চমকিত হয়ে বলল, বিলক্ষণ! ওঁর নাম কে না শুনেছে। উনি সুবিখ্যাত লেখক।
নমস্কার বিনিময়ের পর রথী জিজ্ঞেস করল, আপনি এখানে এই প্রথম এলেন? কেমন লাগছে?
শরৎচন্দ্র বললেন, বেশ মনোরম পরিবেশ। তবে শুনেছিলাম, এখানে একটা ইস্কুল আছে। সেটা তো কোথাও দেখতে পেলাম না।
রথী মৃদু হাস্যে চারপাশের গাছগুলির দিকে হাত দেখিয়ে বলল, এই তো ইস্কুল।
শরৎচন্দ্র ঠিক বুঝতে না পেরে ভুরু কুঞ্চিত করলেন।
রথী আবার বলল, এইসব গাছতলাতেই ইস্কুল বসে। আমিও এখানে পড়েছি। বাবামশাই এখানেই ক্লাস নেন।
জলধর জিজ্ঞেস করলেন, বৃষ্টির সময় কী করে ক্লাস হয়?
রথীর বদলে শরৎচন্দ্রই উত্তর দিলেন, রেইনি ডে, ছুটি হয়ে যায়। বাল্যকালে এরকম ইস্কুল পেলে আমিও পড়তাম!
রথী বলল, আপনার বয়েসী অনেকেই কিন্তু বাবামশাইয়ের ক্লাসে এসে বসেন।
শরৎচন্দ্র বললেন, সে ভাগ্য কি আর আমার হবে।
রথী ওঁদের দুজনকে নিয়ে গেল পিতৃ সন্নিধানে।
কবি ভোর থেকেই খুব ব্যস্ত। উপাসনার সময় বক্তৃতা ও গান গাইতে হয়েছে। তারপর প্রাতরাশ সারার আগেই ঘিরে বসেছে অনেকজন, চলছে নানা রকম কাজের কথা।
শরৎচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর হাস্য পরিহাসেরও সময় নেই। কুশল বিনিময়ের পর তিনি জলধর সেনকে বেশি কথার সুযোগ দিলেন না। বিষয়টি শোনা মাত্র তিনি শুধু আংশিক খাজনা নয়, পুরো খাজনাই মকুব করে দিলেন। তারপর রথীকে বললেন, তুই এঁদের দেখাশুনো কর, যেন আতিথ্যের কোনও ত্রুটি না হয়। শরৎ, কিছু মনে কোরো না, আমি নিজে বেশি সময় দিতে পারছি না–
শরৎচন্দ্র আজ্ঞে না না বলে প্রণাম করে উঠে গেলেন।
কবির বিশেষ ব্যস্ততার কারণ, ৭ই পৌষের মেলা শুরু হয়ে গেছে, আগামিকাল আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। তার ব্যবস্থাদি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।
প্রাচীন আর্যদের আদলে তিনি এই শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করেছিলেন যৌবনকালে। তারপর এতগুলি বছরের মধ্যে তার চিন্তা ও আদর্শের অনেক ব্যাপ্তি ঘটেছে। শুধু বাংলার নয়, শুধু ভারতের নয়, সমস্ত বিশ্বের জ্ঞান বিনিময়ের কেন্দ্র গড়ে তুলতে চান এখানে। যে-জ্ঞান সব রকম ধর্মবিশ্বাসেরও উর্ধ্বে। সেই জন্য আগামিকাল যে প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন হবে, তার নাম দিয়েছেন বিশ্বভারতী।
শুধু তাই-ই নয়। উন্নত ধরনের কৃষি, গোপালন ইত্যাদি শিক্ষা দেবার জন্যও আর একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা চিন্তা করছেন। গ্রাম বাংলায় চাষবাস ও পশু পালনের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে কী করে?
প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেই তো হল না, সেসব চালাবার মতন রসদও চাই। এত টাকা আসবে কোথা থেকে? দক্ষিণ ভারত থেকে আমন্ত্রণ এসেছে, চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন, সভা ও কলেজে কয়েকটি বক্তৃতা দিতে হবে। দলবল সমেত রাহা খরচ ও শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের জন্য বেশ কিছু আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবে, সুতরাং যাওয়া দরকার। তদুপরি অসুস্থ শরীর নিয়েও এই কবির ভ্রমণে ক্লান্তি নেই।
আমন্ত্রণকারীদের মধ্যে আছেন স্বয়ং মহীশূরের রাজা, তাঁর বসন্ত মহলে সংবর্ধনা ও আতিথ্য দিতে চেয়েছেন। বেশি উদ্যোগ নিয়েছেন মহারাজের রাজস্ব সচিব জ্ঞানশরণ চক্রবর্তী। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ নামে একজন অধ্যাপক কবির বিশেষ ভক্ত, তিনিও খুব আগ্রহী, এত সব আহ্বান উপেক্ষা করা যায় না।
প্রায় সওয়া দুমাস ধরে তিনি পরিভ্রমণ করলেন দাক্ষিণাত্যের বহু স্থানে, মাঝখানে ইনফ্লুয়েঞ্জায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেও বক্তৃতায় কসুর হল না। কলকাতায় যখন ফিরলেন, রীতিমতন গরম পড়ে গেছে, এখানেও সভা-সমিতির বিরাম নেই। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। একটা অভাববোধ, একটা শূন্যতা কিছুতেই মেটে। বিখ্যাত ও অতি ব্যস্ত মানুষটির মনের মধ্যে যে একটি স্নেহকাতর, কাঙাল রয়েছে, সে আর কে বুঝবে? শুধু কাজ আর কাজ, এতে যে কাব্য স্রোতও শুকিয়ে যাবার উপক্রম।
রাণুরা এ বছর আর এল না।
ওকে দেখার জন্য কবি মাঝেমাঝে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন খুবই। কেন? ওই সরলা বালিকাটির সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়ে তিনি নিজের বয়েস ভুলে যেতে পারেন। হালকা কৌতুকে মন পরিশ্রুত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথকে সবাই ভক্তি শ্রদ্ধা করে, ভানুর কথা এখন আর কেউ মনে রাখেনি। এই মেয়েটির সান্নিধ্যে, এমনকী চিঠিপত্রেও তিনি ভানুকে আবার ফিরিয়ে এনেছেন। রাণু যখন তখন ঝুপ করে কোলে বসে পড়ে। গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে, চুল আঁচড়াওনি কেন বলে বকুনি দেয়, এমনটি তো আর কেউ নেই।
অনেককাল আগে ইন্দিরা ছিল এমনই, নিয়মিত দেখা না করলে কিংবা চিঠি লিখতে দেরি করলে সে কত অভিমান করত। তার জন্য একবার বিলেত থেকেও ফিরে এসেছিলেন তাড়াতাড়ি। ইন্দিরার সঙ্গে সে সম্পর্ক আর নেই, দেখা হয় অবশ্য, কিন্তু কথার সুর বদলে গেছে।
রাণু নিজে আসতে পারেনি, তাই কবিকে কাশীতে যাবার জন্য প্রতি চিঠিতে অনুরোধ করে। সে মনে করে, কবির কাজগুলির তেমন গুরুত্ব নেই, কাজ থেকে ছুটি নেওয়াটাই আসল। হয়তো তার মনে করাটাই ঠিক।
শুধু একটি বালিকা ডাক পাঠিয়েছে বলেই তো কাশী যাওয়া যায়, একটা উপলক্ষ চাই। এমনি এমনি যেতে গেলে অনেককে কৈফিয়ত দিতে হবে।
বারাণুসী থেকে আমন্ত্রণ এসে গেল, বক্তৃতা দিতে হবে সেখানকার সাহিত্য পরিষদে।
সদ্য দক্ষিণ ভারত থেকে ফিরেছেন ক্লান্ত হয়ে, ইনফ্লুয়েঞ্জার জের এখনও চলছে, এর মধ্যেই আবার কাশী যাওয়া কি ঠিক হবে? রথী, প্রতিমা এবং আরও অনেকের একেবারেই ইচ্ছে নয়। সাহিত্য পরিষদের বক্তৃতা তো কয়েক মাস পরেও হতে পারে। কিন্তু কবি যাবেনই যাবেন। কেন তার এত আগ্রহ তা আর কেউ বুঝবে না।।
সবাই নানা রকম কাজ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
শান্তিনিকেতন নিয়ে নিত্য নতুন সমস্যা। কোন শিক্ষা ঠিক এখানকার আদর্শ মেনে চলছেন না, কোন বিষয়ের জন্য নিয়োগ করতে হবে নতুন শিক্ষক, তা সবই দেখতে হয় কবিকে।
ছাত্রাবাসের ছাদ থেকে বৃষ্টির জল পড়লেও কবির কাছেই নালিশ আসে, তাঁকেই সুরাহা করতে হয়। প্রতিটি ছাত্র ভর্তির ব্যাপারেও তাঁর মতামত লাগে।
ওদিকে প্রমথ প্রায়ই আসে জমিদারির আদায় পত্তর নিয়ে আলোচনা করতে। অনেক দলিল-দস্তাবেজে কবির স্বাক্ষর দরকার।
কবি সে সব কাজ সেরে নিচ্ছেন দ্রুত, মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যেন দেখতে পাচ্ছেন কাশীর গঙ্গার দৃশ্য। অপরাহের স্তিমিত আলোয় নদীর ওপর দুলছে বজরাগুলো…ব্রহ্মকুণ্ডের গলির মধ্যে একটা বাড়ি, সে বাড়িতে থাকবার জন্য একটি বালিকা কতবার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছে, তার বাবা-মাও খুশি হবেন… সেখানে কোনও কাজের কথা নয়, শুধু বিশ্রম্ভালাপ, শুধু কৌতুক। এ রকম কিছু লঘু সময় এখন কবির বিশেষ প্রয়োজন।
অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখে কবি ট্রেনে চেপে বসলেন।
আগে থেকেই খবর রটে গিয়েছিল, বারাণুসী স্টেশন একেবারে লোকে লোকারণ্য। কবিকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য অনেকে মালা ও পুষ্পস্তবক এনেছে। প্ল্যাটফর্ম প্রায় সবটাই বাঙালি মুখে ভর্তি, শোনা যাচ্ছে ওই ভাষায় জোরে কথাবার্তা। কলরব মুখরিত খ্যাতির প্রাঙ্গন একেই বলে। ট্রেনের দরজার কাছে কবি কয়েক মুহূর্ত থমকে দাড়িয়ে রইলেন।
ফুল বর্ষণ ও প্রণামের ধুম পড়ে গেল। কর্তা ব্যক্তিগোছের কয়েকজন কবিকে ঘিরে রেখে ভিড় ঠেলে এগোবার চেষ্টা করলেন, কবি ব্যাকুল ভাবে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলেন একজনকে। কথা ছিল, রাণু এসে তাকে নিয়ে যাবে স্টেশন থেকে। কোথায় রাণু? এত জনতার মধ্যে একটি ছোট মেয়েকে খুঁজে বার করা অসম্ভব।
স্টেশনের বাইরে এনে কবিকে বসানো হল একটি মোটর গাড়িতে। কর্তাব্যক্তিরা জানালেন, তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কাশী নরেশের অতিথিভবন নদের প্যালেসে। কিন্তু ব্ৰহ্মকুণ্ডের গলির এক বাড়িতে এক বালিকা তার জন্য আসন পেতে রেখেছে, কবি যে সেখানেই থাকবেন ভেবে এসেছেন! সে কথা আর বলাই হল না। রাজ-আবাস প্রত্যাখ্যান করার যুক্তি তিনি কী দেখাবেন?
বিশাল প্রাসাদ, সুন্দর বাগান, এর মধ্যেই অজস্র দর্শনার্থী সেখানে অপেক্ষা করে বসে আছে।
কর্তাব্যক্তিরা জানালেন, কোথায় কোথায় তাঁর সংবর্ধনা ও বক্তৃতা সভার কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছে। পরপর কয়েকদিন একটু সময়েরও ফাঁক নেই।
বাঙালিদের আয়োজিত সংবর্ধনা সভাগুলিকে কবি বেশ ভয় পান। প্রশস্তি জানাবার ছলে বেশ কয়েকজন হোমরা-চোমরা লম্বা লম্বা বক্তৃতা ফেঁদে বসে, তাতে আশ কথা পাশ কথা, স্থানীয় সমস্যা, এমনকী পয়ঃপ্রণালীর জল নিষ্কাশনের অব্যবস্থার কথাও বাদ যায় না। কয়েকজন দীর্ঘ কবিতা শোনায়। এমনকী এই উপলক্ষে দু’একজন গানও লিখে ফেলে, স্বসুরারোপিত সেই গান যেন থামতেই চায় না। লঙ্গরখানার খিচুড়িতে যেমন চাল ও ডাল পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখে, এই গানেও সেরকম কথা ও সুরের মধ্যে অনেকখানি দূরত্ব।
সাহিত্য পরিষদের সভায় ঠিক সেই রকমই হল। কবি অসীম ধৈর্যের সঙ্গে, হাসি হাসি মুখে সব শুনে গেলেন। বাল্যকাল থেকে এরকমই সহবতের শিক্ষা পেয়েছেন, নিজের অপছন্দের কথা কিছুতেই বলতে পারেন না মুখ ফুটে।
রাণুরা দেখা করতে আসবে না?
পরদিন বিকেলে কবি আর একটি সভায় যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন, নদেশ্বর প্যালেসের সামনে একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। রাণুরা চার বোন, এক পিসি এসেছে মা বাবার সঙ্গে।
কর্মকর্তারা কবিকে নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা কবছেন, এখন কথা বলার সময় কোথায়?
রাণু যেন এর মধ্যে আর একটু লম্বা হয়েছে, একটু রোগা দেখাচ্ছে, তার মুখমণ্ডলের মধ্যে প্রধান তার দুটি আয়ত চক্ষু, সেই চক্ষু ভরা অভিমান।
ফণিভূষণ ও সরযূবালার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কবি এবার জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ, রাণু?
রাণু কোনও শব্দ না করে শুধু ঘাড় হেলাল।
সভার সময় বয়ে যাচ্ছে, আর দেরি করা যায় না, কবি ফণিভূষণকে বললেন, আপনারা কাল আর একবার আসুন। কোনও গল্পই হল না। কাল বিকেলে আমি কোথাও যাব না।
ফণিভূষণ বললেন, আমাদের বাড়ি এখান থেকে অনেকটা দূর। ভেবেছিলাম আপনাকে নিয়ে যাব, আমাদের সকলেরই খুব ইচ্ছে, আপনি যদি একবার আমাদের গৃহে পায়ের ধুলো দেন।
কবি বললেন, সেটা তো এখন সম্ভব হচ্ছে না। কাল বিকেলে আপনারা সবাই আবার আসুন, অবশ্যই আসবেন।
পরদিন ফণিভূষণ ও সরযূবালা আসতে পারলেন না, পিসিমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন চার বোনকে।
আজ কবি বাতিল করে দিয়েছেন একটি সভা, অন্য দর্শনার্থীদের বিদায় করে দিয়েছেন সংক্ষেপে। এদের জন্য তিনি আনিয়ে রেখেছেন কফি-আইসক্রিম। বেনারসের লোকেরা যখন তখন মালাই রাবড়ি খায়, কিন্তু এই বস্তুটি অভিনব।
অন্য বোনেরা তবু দু’একটা কথা বলছে, রাণু একেবারে নীরব।
পিসিমা জিজ্ঞেস করলেন, গুরুদেব রাজবাড়িতে অনেক ভাল ভাল রান্না হয় জানি। কিন্তু এখানে কি আপনাকে ভাত খেতে দেয়?
কবি বললেন, না। তবে আমি রুটিও বেশ পছন্দ করি।
পিসিমা বললেন, একদিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমার হাতের রান্না খাবেন না?
কবি বললেন, খুবই তো ইচ্ছে আছে।
রাণু সেখান থেকে উঠে গিয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়াল।
কবিও একটু পরে সেখানে গিয়ে মৃদু স্বরে বললেন, তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছ, না!
রাণু সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে বলল, করবই তো! আপনি কথা রাখেননি। আপনি আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকলেন না। আমাদের ছোট বাড়ি, এই রাজপ্রাসাদই আপনার বেশি পছন্দ।
কবি বললেন, তা মোটেই না। রাজবাড়িতে আমি স্বস্তি বোধ করি। দেখোনি, শান্তিনিকেতনে আমি মাটির বাড়িতে থাকি। রাজাদের নিয়ে মুশকিল এই, তারা যখন তখন কবিদের ধরে আনতে চায়। সেই বিক্রমাদিত্যের আমল থেকে এটা শুরু হয়েছে। তাছাড়া উদ্যোক্তারা বললেন, কয়েকটি জায়গায় বক্তৃতা দিতে হবে। এখান থেকেই যাওয়া আসার সুবিধে।
রাণু ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, আপনি অত বক্তৃতা দেন কেন? না দিলেই বা ক্ষতি কী?
কবি ছদ্ম বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, সে কী! আমি তো বক্তৃতা দিচ্ছি তোমাকেই খুশি করার জন্য। গলায় জরির চাদর ঝুলিয়ে, সেজে গুজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাঙা গলা আরও ভেঙে বক্তৃতা শক্তির চমৎকারিত্বে কাশীবাসীদের মুগ্ধ করে দিলেন, সবাই এটুকু অন্তত বুঝল যে লোকটি নিতান্ত হেলাফেলার নয়, মুখচোরা নয়, এতে ভানুদাদার রাণু খুশি হবে না? রাণু মুখ তুলে শুধু বলল, ভানুদাদা।
নিরিবিলিতে কথা বলার কি উপায় আছে। এর মধ্যে কারা যেন কিছু জরুরি বার্তা নিয়ে উপস্থিত হল।
তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে কবি পাশের ঘর থেকে একটি অতি সুদৃশ্য, রুপোর কাজ করা, হাতির দাত বাঁধানো এসরাজ এনে বললেন, এটা তোমার জন্য।
রাণু নিতে ইতস্তত করছে দেখে তিনি বললেন, তোমার অন্য বোনদের জন্যও কিছু কিছু উপহার এনেছি। আমার খুব ইচ্ছে, তুমি এসরাজ বাজানো শিখবে, তারপর আমার গানের সঙ্গে বাজাবে।
রাণু এবারে এসরাজটি নিয়ে গালে ছোঁয়াল।
সে আগে থেকেই এসরাজ বাজানো শিখেছে। লেখাপড়া শেখবার সঙ্গে সঙ্গে ফণিভূষণ মেয়েদের গান-বাজনা শেখাবারও ব্যবস্থা করেছেন। দু’জন মুসলমান ওস্তাদ নিয়মিত তালিম দিয়ে যান। বড় বোন সেতার বাজায়, অন্য দু’বোন গানের গলা সাধে, রাণুর গানের সুর ঠিক হয় না, কিন্তু এসরাজে সে এর মধ্যেই বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে।
কবি তো তা জানতেন না, তবু কেন এসরাজই আনলেন রাণুর জন্য?