০৮. বড় বৌঠানের সংবাদ

চার-পাঁচ দিন পরে উৎপলা পিওনের হাত থেকে একটা কার্ড নিয়ে পড়তে-পড়তে উৎফুল্ল হয়ে বললে, বড় বৌঠানের সংবাদ লিখেছে।

মাল্যবান সর্ষের তেল গায়ে মাখছিল, এই বয়েসে আবার সংবাদ— বলে নিরেস চোখে-মুখে তেল মাখতে লাগল আবার।

তা হবে তো। কেন হবে না?

বড় বৌঠানের বয়স না কত?

চুয়ান্ন।

এ-রকম বুড়ো গিন্নিদের যে ছেলেপুলে হয়, তা আমি জানতাম না।

উৎপলা কার্ডটা ব্লাউজের ভেতর গলিয়ে দিয়ে বললে, তুমি কি বলতে চাও ভেঙে বলো তো দিকি–

তা নয়, আমি বলছিলাম–মাল্যবান চুপচাপ তেল মাখতে লাগল।

না বললেও বুঝেছি আমি, পেটে-পেটে তুমি কী বলতে চাও

না, না আমি ভাবছিলাম–মাল্যবান-থেমে গিয়ে হঠাৎ এক ফাঁকে ঝপ করে বলে ফেলল, আবার এই বয়েসে ছেলেপুলে—

সে কি বাবা, ছেলেটা না আসতেই মারমুখো হয়ে আটকে দাঁড়াবে না-কি?

আমি দাঁড়ালেই—শোনে কে— দাঁতে কেটে-কেটে হাসতে হাসতে মাল্যবান বললে।

উৎপলা গুনগুন করে গাইতে-গাইতে ছাদের দিকে গেল—বড় বৌঠানের সন্তান হবে বলে ছায়ানট-ছায়ানটের পরে ভীমপলাশী-তারপরে বাগেশ্রী—কিন্তু প্রত্যেকটা গানেরই এক-আধ লাইন মাত্র। পিঠে তেল মাখতে-মাখতে মাল্যবান ভাবছিল : নিজের বেলা তো উৎপলা এই বারো বছর ধরে ষষ্ঠীকে # দেখিয়ে গেল, একটি সন্তান যা হল, তাও মেয়ে; এই প্রথম, এই-ই শেষ; বংশে ছেলে না হলে না-ই বা হল—এই তো ভাবে উৎপলা। কিন্তু পরের বেলা যে তেরোটির পর চৌদ্দটিকে দ্যাখ কেমন বেহাগ ভৈরবী কীর্তনের সুরে ফলাও করে ফলাচ্ছে ছাদে-ছাদে। এটা কী কাজ করছে উৎপলা, ঠিক কাজ করছে? ঠিক নয় অবিশ্যি। মোটেই ঠিক নয়। কিন্তু, তবুও, এইটেই ঠিক।

পায়ে তেল মাখতে-মাখতে মাল্যবানের মনে হল : কি জানি, আমার বদলে অন্য কোনো দশাসই পুরুষের স্ত্রী হলে এত দিনে উৎপলাও আট-দশটি সন্তানের মা না হয়ে ছাড়ত না হয়তো।

মাথায় তেল মাখতে-মাখতে কড়া রোদের আকাশটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল মাল্যবান : আমার প্রতি যে যতখানি বিমুখ, অন্য কোনো পুরুষ-মানুষের জন্যের ঠিক ততখানি আগ্রহ তার থাকতে তো পারত; তাহলে কী হত? বেশ ঝরঝরে নদীর পাশে তরতাজা সবুজে-সবুজে ফন-ফন করে উছলে উঠত পানের বন, তাহলে উৎপলার ধানের বন নীল কালো সাপশিষের মতো রোদে বাতাসে—হাওয়া বৃষ্টির নিঝোর ঝলসানির ভেতর।

উৎপলা কীর্তন গাইতে গাইতে ছাদের থেকে ফিরে এল—

তোমার দাদার বয়েস কতত হল এবারে?

চৌষট্টি।

চৌষট্টি!

তা তিনি কি আজকে জন্মেছেন—

খুব বুড়ো হয়ে গেছেন তোতা তাহলে,–

আজকের মানুষ তো নয়—

তাই তো, খুব বড়ো তো–

বুড়ো-বুড়ো করে মুখে গাজলা উঠল যে বুড়ো খোকার আমার। ঢং। উৎপলা বললে, নাও, এখন বড় বৌঠানের জন্যে কী জিনিস পাঠাবে বলো।

মাল্যবান গায়ে তেল পায়ে তেল মাথায় তেল মেখে ভরা রোদে একটা বিচিত্র সরীসৃপের মতো চিকচিক করছিল। ছাদের রোদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ধাঁধিয়ে উঠছিল উৎপলার চোখ; সরীসৃপকে সে একবার দেখছিল ঝিকমিক আঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, নুয়ে পড়ছে, হাত নাড়ছে, চোখ পাঁজলাচ্ছে, আর একবার মিলিয়ে যাচ্ছিল সব—অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত অন্ধকারের ভেতর কাউইে কিছুকেই আর দেখছিল না উৎপলা।

মাল্যবানকে যথেষ্ট হিংস্র, অথচ আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছুই না, বরং বেশ চকচকে মনে হচ্ছিল হয়তো উৎপলার; ঠিক বুঝতে পারছিল না। কিন্তু তার মানে হয়তো এই নয় যে, উৎপলার বেশ কাতর হয়ে পড়ছিল; এবং মাল্যবান বেশ প্রখর হয়ে উঠছিল। হলে হয়তো ভালো হত না।

আমার মনে হয়, যদি কিছু দিতে যাও, তাহলে তারা লজ্জা পাবেন।

কেন?

এ-রকম ব্যাপার যে হচ্ছে, এতে এখুনি লজ্জা পাচ্ছেন–

তুমি যখন তোমার মায়ের পেটে ছিলে, লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলেন তিনি! না কি? ম্যাদা মাদার ঠেলে বেরুল তো তবু লজ্জাবতীর ঝাড় থেকে। বেরুল তো! কী হল তাতে? ইঁদুরের গর্তে ঢুকে পড়ল পৃথিবীর জনমনিষ্যি সব! লজ্জা! লজ্জা! লজ্জা!

মনের বিষ ঝেড়ে কথা বলে ছাদে এক চক্কর ঘুরে এসে উৎপলা বললে, তেমন হোক-না-হোক, একটা বেনারসী শাড়ি অন্তত কিনে দিতে হবে পঞ্চাশ-ষাট টাকার মধ্যে। আর রুপোর সিঁদুরকৌটো একটা। আমর ইচ্ছে ছিল সোনার কৌটো দিই একটা। চল্লিশ বছর স্বামীর সঙ্গে ঘর করল তো পয়মন্ত এয়োতি—এই চুয়ান্নতেও তো ফল দিচ্ছে—

তোতাপুরি আমের গাছটা? মাল্যবান খ্যাক করে একটু হেসে, বেশি হাসির চাড় সামলে নিয়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে বললে, বড় বৌঠানকে চিনি আমি–

কেমন, বেনারসীতে তাকে মানাবে না।

তা আমি বলছি না মাল্যবান তেলের বাটিটার কাছে ফিরে এসে বাটিটার দিকে এক নগর তাকিয়ে বললে, এ-রকম একটা ব্যাপার নিয়ে কেউ যে ঘটা করে, সে-ইচ্ছে তার একটুও আছে বলে মনে হয় না।

দূরের রৌদ্রে সরীসৃপটা চিকচিক করে জ্বলে উঠেছে। উৎপলা পুডিঙের কামড়ে কঠিন কংক্রিটের মতো হয়ে গিয়ে তাকিয়ে দেখল একবার। মিলিয়ে গেল ছবিটা;রোদে বিহুলতায় চোখ ছটফট করে উঠেছে উৎপলার; অন্তশ্চক্ষু উপড়ে পড়ছে যেন অন্য রকম আগুনে—রৌদ্রে।

আসল কথা হচ্ছে, কিছু খসাতে চাও না তুমি; আপন লোককে পর মনে করো। শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার ভঁড়ামো, চিনি নে আমি তোমাকে! তেলের বাটিটা উৎপলা ছাদের ওপর ছুঁড়ে ভাঙল!

তেল পড়েছে, টাকা আসবে, মাল্যবান হেসে বললে, যাই চান করি গে।

অফিস থেকে ফিরে এসে সে বললে, চলো, বেরোই।

কোথায়?

কী কিনতে কাটতে হবে, চলো দেখি গিয়ে–

উৎপলার মনের থেকে কিছুটা ধোঁয়া কেটে গেল, তা তো বলেছিই বেনারসী—

কিন্তু আমি ও-সব জিনিস একা কিনতে ভরসা পাই না। এসো, আমার সঙ্গে—

ষাট সত্তরের কমে হবে না শাড়ি; যে তিন শো পঁচাত্তর টাকা মেজদার বাবদ আমার কাছে আছে, তার থেকে কিছু তো খরচ করতে পারি নে—

তার দরকার নেই—মাল্যবান রুমালে মুখ মুছে বললে।

তবে কোথায় পাবে টাকা?

প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে তুলে এনেছি।

কতো?

পঁচাত্তর–

নাক-মখের চেকনাইয়ে চনমন করে—হেসে উঠে উৎপলা বললে, বাঃ, বেশ গুড বয় তো তুমি। সত্যিই এমন না হলে—আ গেল, তুমি তো চাও খেলে না।

চায়ের প্রতীক্ষায় মাল্যবান চেয়ারে বসল গিয়ে। খানিকক্ষণ পরে উৎপলা ফিরে এল পরোটা ও চা নিয়ে নয়, মার্কেট যাবার জন্যে পোশাক-আশাকে তৈরি হয়ে।

মাল্যবান একটু হতচকিত হয়ে বললে, চা খেয়ে গেলে হত না।

ঠাকুরটা আজ বড় দেরি করে এসেছে, উৎপলা মাল্যবানের ছাড়া চেয়ারে ডান পা টা চড়িয়ে দিয়ে জুতোর পালিশে যে কিউটিকিউরা ট্যালকামের গুঁড়ি পড়ে ছিল, রুমাল দিয়ে তা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বললে, আমিই ভাত চড়িয়ে দিতে বললাম তাই। সকালবেলার সেই পরোটাগুলো ঠাণ্ডা মেরে গেছে—লোনার মাকে দিয়ে দিলাম; ওর ছেলের কুষ্ঠ হয়েছে, কিছু খেতে চায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *