বড় আপা খুব কাঁদছে।
কাঁদার মূল কারণ দুলাভাই চিঠিতে লিখেছেন তার ফিরতে আরো দুসপ্তাহ দেরি হবে। সেমিনারের শেষ যে পেপার জমা দেয়ার কথা সেই পেপার তৈরিতে একটু সময় লাগছে। যে চিঠিতে তিনি এই সংবাদ দিয়েছেন সেই চিঠির সঙ্গে কয়েকটা ছবিও পাঠিয়েছেন। সেই সব ছবির একটিতে স্কার্ট পরা একটি মেয়েকে দুলাভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বড় আপার মর্মপীড়ার কারণ এই ছবি। বেহায়া ধরনের একটা মেয়ের গা ঘেঁষে সে ছবি তুলবে কেন? দুসপ্তাহ বাড়তি থাকছে কেন? এই দুসপ্তাহ সে কি মেয়েটার সঙ্গে ঘুরার পরিকল্পনা করেছে? আর যদি এ রকম পরিকল্পনা নাও থাকে তাহলেই বা সে থাকবে কেন? এতে তো এই মেয়েটার সঙ্গে ঘষাঘষির সুযোগ আরো বেশি হবে।
এখন আমাদের পরিবারে একটা ক্রাইসিস পিরিয়ড যাচ্ছে। এর মধ্যে বড় আপা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। খুব বিরক্তিকর ব্যাপার। তার কাছে লেখা চিঠি তিনি সবাইকে পড়াচ্ছেন। স্ত্রী কাছে লেখা স্বামীর চিঠিতে ভালোবাসাবাসির কথা তেমন থাকে না। তবে দুলাভাইয়ের চিঠিতে সেইসব যথেষ্টই আছে। আপা তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। কাঁদো কাঁদো মুখে সবাইকে চিঠি দেখাচ্ছেন। আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, এখন কী করি বল তো?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কিছু করতে হবে না।
কিছু করতে হবে না মানে? ও এসব করে বেড়াবে আর আমি…
বড় আপার গলা ধরে এল। আমি বললাম, তুমি কী করতে চাও?
ওকে আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে দে।
কী লেখা থাকবে সেই টেলিগ্রামে?
লিখবি আমার খুব অসুখ।
এসব ছেলেমানুষির কোনো মানে হয়। আপা?
তোর কাছে ছেলেমানুষি। আমার কাছে ছেলেমানুষি না। ওকে আমি চিনি। ও মেয়ে দেখলেই এলিয়ে যায়।
কী যে তুমি বল!
ঠিকই বলি। পুরুষ মানুষ চিনতে আমার বাকি নেই। নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে দেখলেই পুরুষ মানুষের মন উদাস হয়। তুই টেলিগ্রাম করবি কি করবি না, সেটা বল।
করব না।
আপা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন। তাঁকে শান্ত করবার জন্যেই বলতে হল, টাকা দাও টেলিগ্রাম করে আসছি।
লিখবি অবস্থা খুব সিরিয়াস। ডেথ বেড।
ফিরে এসে যখন দেখবেন তুমি দিব্যি ভালো তখন কী হবে?
কিছুই হবে না। ও খুশি হবে।
টেলিগ্রাম করবার জন্য বড় আপা আমাকে পাঁচশ টাকার একটা নোট দিলেন। উদাস গলায় বললেন, টেলিগ্রাম করার পর যদি কিছু টাকা থাকে সেটা ফেরত দিতে হবে না।
এর মধ্যে বাবার শরীর খুব খারাপ। এই খবর পেয়ে তানিয়া বাবাকে দেখতে এসেছিল। অনেকক্ষণ থাকলো। চা খেল না। নীতুর সঙ্গে গল্প করল। কথায় কথায় বলল, বাংলাদেশ তার ভালো লাগে। কিন্তু বেশিদিন থাকতে ইচ্ছা করে না। বাংলাদেশের মানুষদের কৌতূহল খুব বেশি। বিদেশে কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। যার কাজ তার কাছে। সেই এই মাসের শেষেই ইংল্যান্ডে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করবে। আজকাল ভিসা খুব কড়াকড়ি করেছে। তবু তার ধারণা, অসুবিধা হবে না। বেশ কিছু ডলার খরচ করতে হয়–এই যা।
তানিয়া হাসতে হাসতে বলল, সবাই আমাদের দেশের বদনাম করে। বলে, টাকা দিলে এই দেশে সবকিছু হয়। আমার নিজের ধারণা টাকায় সব দেশেই কাজ হয়। ঐসব দেশে টাকা বেশি লাগে, আমাদের দেশে কম। এই-ই হচ্ছে তফাত।
বাচ্চা একটা মেয়ে কিন্তু খুব গোছানো কথাবার্তা। নীতু বলল, তোমার বুঝি অনেক টাকা?
মেয়েটি একমুহূর্ত ও দ্বিধা না করে বলল, হ্যাঁ।
সে মার সঙ্গে কথা বলতে গেল। মা চাদর গায়ে শুয়েছিলেন। উঠে বসলেন। তানিয়া বিস্মিত গলায় বলল, চাচার চেয়ে তো আপনার শরীর বেশি খারাপ। প্ৰথমবার যখন এসেছিলাম। তখন তো এত খারাপ দেখি নি। কী হয়েছে আপনার বলুন তো?
মা বললেন, কিছু হয় নি।
অবশ্যই কিছু হয়েছে। ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার।
ডাক্তার তো দেখাচ্ছি।
দরকার হলে আপনি কোনো ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে যান। যেখানে সর্বক্ষণ হাতের কাছে ডাক্তার থাকবে।
আচ্ছা দেখি।
না, দেখাদেখি না–আপনি এটা অবশ্যই করবেন।
তুমি চা-টা কিছু খেয়েছ?
হ্যাঁ খেয়েছি। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আপনার অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। জানেন, বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে বাবা আপনার কথা খুব বলতেন।
মার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি বিব্রতমুখে আমার দিকে তাকালেন। আমি হাসলাম। সেই হাসিতে অভয় দেবার চেষ্টা ছিল, মা বোধহয় তা ধরতে পারলেন না।
তানিয়া বলল, বাবার যখন খুব অসহায় অবস্থা, আপনাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তাঁর একবার টাইফয়েড হল। সেই সময় আপনি নাকি তাঁর খুব সেবা করেছেন। একবার সারারাত জেগে তাঁর মাথায় পানিপট্টি দিলেন।
এসব কথা থাক, মা।
তানিয়া থামল না। সহজ স্বরে বলতে লাগলো।
বাবা এসব কথা আগে কখনো বলেন নি। অসুখ ধরা পড়ার পর খুব বলতেন। ব্যবসার জন্যে আপনি আপনার বিয়েতে পাওয়া গলার হার বিক্রি করে তাকে টাকা দিলেন। ঐ দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু। বাবা বলতেন, পবিত্র কিছু টাকা নিয়ে আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম বলে এতদূর আসতে পেরেছি। চাচি, আমরা এসব তো কখনো শুনি নি। যখন শুনলাম আপনার প্রতি খুব গ্রেটফুল বোধ করলাম।
মা অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, মা, আমার খুব মাথা ধরেছে। তুমি ওদেরকে নিয়ে গল্প কর।
আরেকটু বসি। আর কখনো দেখা হবে কিনা কে জানে, আমি চলে যাচ্ছি। আচ্ছা চাচি, আপনি নাকি একবার গল্প করতে করতে বাবাকে বলেছিলেন, আপনার যদি কখনো টাকা হয় তাহলে অনেকখানি জায়গা নিয়ে ধবধবে শাদা রঙের একটা বাড়ি বানাবেন। বলেছিলেন, তাই না চাচি?
হ্যাঁ।
বাবা সেই কথা মনে রেখেছিলেন। এই বাড়িটা ঠিক সেই রকম করে বানানো। আপনি কি কোনোদিন সেটা বুঝতে পারেন নি?
মা জবাব দিলেন না। নীতু বল, চল আমরা ছাদে যাই। ছাদটা খুব সুন্দর। বাগানবিলাস গাছে ছাদটা ঢেকে ফেলেছে। তানিয়া নীতুকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, আমরা গোড়া থেকে জানি এই বাড়ি আপনার। আর আপনারা কেউ কিছুই জানতেন না। মজার ব্যাপার না? বাবার অবশ্যি ভয় ছিল আপনারা এই বাড়ি নিতে রাজি হবে না। আপনারা যে রাজি হয়েছেন আমার এত খুশি লাগছে!
মার মুখ আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
মেয়েটির উপর আমার খুব রাগ লাগছে। মা কষ্ট পাচ্ছেন–এই বোকা মেয়ে কি তা বুঝতে পারছে না?
চাচি!
কী মা!
আপনার তরুণী বয়সের অসম্ভব সুন্দর দুটা ছবি আমাদের বাসায় আছে। শাদা-কালো ছবি। স্টুডিওতে তোলা কিন্তু এত সুন্দর। আপনার নাকি ছবি তোলার দিকে কোনো আগ্রহ ছিল না। বাবা জোর করে তুলিয়েছেন। আমি আপনাকে ছবি দুটো পাঠিয়ে দেব।
দরকার নেই, মা।
আমি পাঠাব। ছবি দেখলে আপনার ভালো লাগবে। আমি এখন উঠি, চাচি?
আচ্ছা মা।
বারান্দায় মেজোভাইয়ের সাথে তানিয়ার দেখা হল। তানিয়া বলল, আপনি কেমন আছেন?
মেজোভাই জবাব দিলেন না, ক্রুদ্ধচোখে তাকিয়ে রইলেন। সেই চোখে আগুন ধকধক করছে,
তানিয়া চলে যাবার প মেজোভাই আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, ঐ মেয়েটা চোখ ব্ৰাউন, তুই লক্ষ করেছিস?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
মইনুদিন চাচার চোখও ব্ৰাউন।
তাতে সমস্যা কী?
সমস্যা কিছুই না। তুই ভালোমতো চিন্তাভাবনা করে বল তো আমাদের পাঁচ ভাইবোনের কারো চোখ ব্ৰাউন কিনা?
ভাইয়া, তোমার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল?
মাথা খারাপ— ভালো প্রশ্ন না। আমি তোকে একটা প্রশ্ন করেছি, তুই হ্যাঁ বা না বলবি।
ছিঃ ভাইয়া।
মেজোভাই অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একবার মনে হল হয়তো তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন আমার উপর। আমি ভয় পেয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলাম।
রাতে ভয়ংকর একটি দৃশ্যের অবতারণা হল।
রাত তখন প্রায় বারটা, বুনোভাইয়ের ঘর থেকে ক্রুদ্ধ হুংকার শোনা যেতে লাগল। ছুটে গিয়ে দেখি বুনোভাইয়ের মতো মস্ত মানুষ মেজোভাইকে সমানে কিলঘুসি মেরে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে মেরেই ফেলবেন। বুনোভাইয়ের চোখ টকটকে লাল। আমার মনে হয়, যে-প্রশ্ন ভাইয়া আমাকে করেছিলেন সেই প্রশ্ন বুনোভাইকেও করেছিলেন। অসুস্থ শরীরে মা ছুটে এলেন। ভয়ার্ত গলায় বললেন, কী হচ্ছে? বুনোভাই বললেন, কিছু না মা, তুমি ঘুমাও।
মা মেজোভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হয়েছে রে?
মেজোভাই মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলেন। তার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। সেই অবস্থাতেই বললেন, কিছু হয় নি। তোমরা সবাই শুধু শুধু ভিড় করছ।