॥ ৮ ॥
পরদিন সকালে টমকে দেখলাম সে অনেকটা সামলে নিয়েছে। বলল ব্যথাটা এখনো সম্পূর্ণ যায়নি। কিন্তু আর দু’দিনের মধ্যেই চলে যাবে।
পাথর চুরির ব্যাপারটায় দুই বন্ধুই দেখলাম সমান কাতর। এই ভাবে পাথরটাকে ভারতবর্ষে রেখে যাবার কথাটা পিটার মোটেই ভাবেনি, আর টম আপসোস করছে প্রথম দিনই কেন সেটাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়নি, যখন ঢানঢানিয়াও এত ভালো অফার দিল।
মিস্টার চৌবে সকালে আমাদের ঘরে এলেন এগারটা নাগাত। বললেন এসে প্রথমে একবার টমকে দেখেছেন, তারপর আমাদের কাছে এসেছেন রিপোর্ট নিতে।
‘কিছু এগোল?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
‘একজন সাসপেক্টকে বাদ দিতে হয়েছে।’
‘কে?’
‘কিশোরীলাল।’
‘কেন? বাদ কেন?’
প্রথমত, আমি যতদূর জানি কিশোরীলালকে, সে অত বেপরোয়া নয়। তাছাড়া—এটা আমি জানতাম না—মাস খানেক হল ঢানঢানিয়া বেশ কয়েক লাখ টাকা খরচ করে তার ছেলেকে একটা প্ল্যাস্টিকের ফ্যাক্টরি বানিয়ে দিয়েছে। কিশোরী রেগুলার কাজে যাতায়াত করছে। তার বাবা কড়া নজর রেখেছেন তার উপর। এই সময় একটা পাথর চুরি করে বিক্রি করে হাতে কাঁচা টাকা পেলে সেটা বাবার দৃষ্টি এড়াত না। সো—কিশোরীলাল ইজ আউট।’
‘চাঁদু মল্লিক?’
‘আমাদের যা হিসেব, তাতে টম মাথায় আঘাত পায় পৌনে এগারটা নাগাত। তখন চাঁদু বোলপুরে নবীন ঘোষের মদের দোকানে। একাধিক সাক্ষী আছে। তাদের সবাইকে জেরা করে দেখেছি। চাঁদু ইজ আউট টূ।’
‘বাকি দু’জন?’
‘আজ সকালে নস্করের বাড়ি সার্চ করেছিলাম। পাথরটা পাওয়া যায়নি। অবিশ্যি তাতে কিছু প্রমাণ হয় না। এতটুকু পাথর লুকিয়ে রাখা তেমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। তবে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ পড়ছে কিন্তু বীরভূম এক্সপার্ট জগন্নাথ চ্যাটার্জির ওপর।’
‘এটা কেন বলছেন?’
‘ও বীরভূম এসেছে মাত্র তিন বছর হল। ওর বাড়িতে একটা টুরিস্ট গাইড আছে, সেটার নাম হল ভ্রমণসঙ্গী। তা থেকেই ও তথ্য সংগ্রহ করে। বোলপুরের আগে বর্ধমানে ছিল। সেখানে তার পুলিশ রেকর্ড রয়েছে—জালিয়াতির কেস।’
‘তাই বুঝি?’
‘ইয়েস স্যার। আমার মতে হি ইজ আওয়ার ম্যান। সাহেবদের কাছ থেকেও ও পারিশ্রমিক আদায় করছিল। ওয়ান হান্ড্রেড রুপিজ পার ডে। সমস্ত ব্যাপারটা খুবই সন্দেহজনক।’
‘ওর বাড়ি সার্চ করেছেন?’
‘করব আজ দুপুরে। শুধু সার্চ না—কারণ সার্চ করে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না—কড়া কথা বলে ওর মনে চরম ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে। ভালো কথা—আপনি নিজে কোনো তদন্ত করবেন না?’
‘বর্তমান ক্ষেত্রে আপনি অনেক বেশি কার্যকরী হবেন বলে মনে হয়। তবে মাথা খেলবে ঠিকই, আর কিছু মনে এলে আপনাকে জানাব । ইয়ে—আমি যে সাসপেক্টটার কথা বলেছিলাম তার কী হল?’
‘পিটার রবার্টসন?’
‘হ্যাঁ, কারণ আমার ধারণা ওর এখন যে মনের অবস্থা তাতে ও বন্ধুবিচ্ছেদটা মেনে নিতে প্রস্তুত। প্যাট্রিক রবার্টসনের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করাটাও ওর এখন প্রধান লক্ষ্য।’
‘আপনার কথা মনে রেখেই আমি একটু আগেই ওর ঘরটা ভালো করে সার্চ করেছি। কিছু পাইনি।’
চৌবে চা আর বিস্কুট খেয়ে উঠে পড়লেন; বললেন ওবেলা আবার আসবেন।
ফেলুদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বড় গোলমেলে ব্যাপার। পাঁচটা সাসপেক্ট পাঁচ জায়গায় ছড়িয়ে আছে। এখানে শখের গোয়েন্দাকে পুলিশ টেক্কা দেবে তাতে আর আশ্চর্যের কী?’
‘আপনার কি কারুর উপর সন্দেহ পড়ল?’ জটায়ু প্রশ্ন করলেন।
‘এই পাঁচজনের মধ্যে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিশোরীলালের ব্যবসার ব্যাপারটা যদিও জানতাম না, কিন্তু তাও আমার মন ওকে বাতিল করে দিচ্ছিল। তার কারণ ছেলেটার মধ্যে হিম্মতের অভাব। কাউকে মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করার সামর্থ্য ওর আছে বলে মনে হয় না, আর তার উপর ওই ভিড়ের মধ্যে ব্যাগ খুলে তার থেকে পাথর বার করে নিয়ে পালানো…’
‘চাঁদু মল্লিক?’
‘ওর সামর্থ্য আছে সন্দেহ নেই, তবে রুবি সম্বন্ধে—বিশেষ করে টমের ব্যাগে রুবি আছে সেটা ওর পক্ষে জানা খুবই অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। নস্কর লোকটাকেও সন্দেহ করতে আমার মন চায় না। বিশেষ করে মাথায় বাড়িটাড়ি মারার ব্যাপারে ও মোটেই নিজেকে জড়াবে না। তাছাড়া এটা মনে রাখতে হবে লোকটার টাকার অভাব একেবারেই নেই।’
‘একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।’
‘কী?’
‘হিপ্নোটাইজ হয়ে মানুষ সত্যি কথা বলে?’
‘কোন সত্যিটা বলছেন আপনি?’
‘বাঃ, তপেশ যে বললে ওদের বয়স বলে দিলুম। ওরা ল্যাঙ্কেশিয়ার থেকে এসেছে বলে দিলুম।’
‘দুটো তথ্যই স্টেটসম্যানের লেখার গোড়ার দিকেই ছিল।’
‘তাই বুঝি?’
‘ইয়েস স্যার। আর বাকি যা বলেছেন সেটা যে মিথ্যে সে তো প্রমাণই হয়ে গেল।’
‘তা বটে। … তাহলে জগন্নাথ চ্যাটার্জিই কালপ্রিট?’
‘চৌবে যা বলল, তাতে ত সেরকমই মনে হচ্ছে। মামলাটার পরিসমাপ্তি খুব জমাটি হল না সেটা—’
ফেলুদার কথা শেষ হল না। কারণ দরজায় টোকা পড়েছে।
খুলে দেখি টম ম্যাক্সওয়েল—তার মুখ গম্ভীর। ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল টমের দিকে। টম মাথা নাড়ল।
‘আমি বসতে আসিনি।’
‘আই সী।’
‘আমি এসেছি তুমি এবং তোমার দুই বন্ধুর ঘর সার্চ করতে।’
‘সার্চ তো কাল একবার করা হয়ে গেছে। তাতে তোমার বিশ্বাস ল না!’
‘নো। সে সার্চ করেছে ইন্ডিয়ান পুলিশ। আমার তাদের ওপর কোনো বিশ্বাস নেই।’
‘সার্চ করতে ওয়ারেন্ট লাগে তা জান? যে কেউ সার্চ করতে চাইলেই সার্চ করতে পারে না।’
‘তাহলে তুমি আমাকে সার্চ করতে দেবে না?’
‘নো, মিঃ ম্যাক্সওয়েল। ও ব্যাপারটা কালই হয়ে গেছে। আজ আর হবে না।’
ম্যাক্সওয়েল আর দ্বিরুক্তি না করে অ্যাবাউট টার্ন করে চলে গেল।
‘বোঝো’, বললেন লালমোহনবাবু। ‘আপনার সঙ্গে অনেক তদন্তেই অংশগ্রহণ করলুম, কিন্তু ক্রিমিন্যাল বলে সাসপিশন এই প্রথম পড়ল আমাদের উপর।’
‘সব রকম অভিজ্ঞতাই হয়ে থাকা ভালো, তাই নয় কি?’
‘তা বটে। তা আপনি কি স্রেফ ঘরে বসে তদন্ত করবেন! বেরোবেন না কোথাও?’
‘দরকার হলে নিশ্চয়ই বেরোব। তবে এখনকার স্টেজটা হল চিন্তা করার স্টেজ, আর সেটা ঘরে বসেই সবচেয়ে ভালো হয়। অবিশ্যি তাই বলে আপনাদের ধরে রাখতে চাই না। আপনারা স্বচ্ছন্দে বেরোতে পারেন। শান্তিনিকেতন এবং তার আশেপাশে এখনও অনেক কিছুই দেখতে বাকি আছে।’
‘ভেরি ওয়েল। আমরা তাহলে একবার শতদলকে গিয়ে ধরি। ও বলছিল ওর আজ কোনো ক্লাস নেই। দেখি ও কী সাজেস্ট করে। আপনাকে বরং একটা জিনিস দিয়ে যাচ্ছি—শতদলের দেওয়া সেই বই। সেই পাদ্রী প্রিচার্ডের লেখা। দারুণ বই মশাই। কাল রাত্তিরে শেষ করেছি। এই ম্যাক্সওয়েলের পূর্বপুরুষ সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাবেন। আর নীল চাষ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা হয়ে যাবে।’
ফেলুদাকে বইটা দিয়ে আমি আর লালমোহনবাবু বেরিয়ে পড়লাম।
শতদলবাবু বললেন, ‘চল তোমাদের একটা খাঁটি গ্রাম দেখিয়ে নিয়ে আসি। গোয়ালপাড়া। আর তার পিছনেই আছে গুরুদেবের প্রিয় নদী কোপাই। এ দুটো না দেখলে শান্তিনিকেতন দর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’
গ্রাম এর আগে যে দেখিনি তা নয়, তবে গোয়ালপাড়ার মতো খাঁটি গ্রামের চেহারা এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লালমোহনবাবুকে কবিতায় পেয়েছে। তাঁর প্রিয় কবি বৈকুণ্ঠ মল্লিকের একটা কবিতার খানিকটা অংশ আবৃত্তি করে ফেললেন—
‘বাংলার গ্রামে স্পন্দিছে মোর প্রাণ
সেই কবে দেখা—আজও স্মৃতি অম্লান
যেদিকে ফেরাও দৃষ্টি
মানুষ ও প্রকৃতি দুইয়ে মিলে দেখ কী অপরূপ সৃষ্টি!’
কোপাই দেখেও সেই একই ব্যাপার। এটাতে বোঝা যায় যে বৈকুণ্ঠ মল্লিক শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন—
‘জীর্ণ কোপাই সর্পিল গতি
মন বলে দেখে—মনোরম অতি
দুই পাশে ধান
প্রকৃতির দান
দুলে ওঠে সমীরণে,
বলে দেবে কবি
আঁকা রবে ছবি
চিরতরে মোর মনে।’