০৮. বৃষ্টি শুরু হয়েছে

রাত নটার সময় বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি, বৃষ্টিরই সময়। তবে এবারের আষাঢ় বৃষ্টি বিহীন। মাঝে মাঝে দু এক পশলা বৃষ্টি যে হয় নি তা-না। সেই বৃষ্টিকে আর যাই বলা যাক আষাঢ়ের বৃষ্টি বলা যাবে না। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি সম্ভবত আজকেরটাই। মনে হচ্ছে আজ ঢাকা শহর ড়ুবে যাবে।

ব্যারিস্টার ইয়াসিন আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিপাত উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ছাদের চিলেকোঠায় ঘরে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা হয়েছে। দুটা বড় স্পিকারে ফুল ভালুমে গান দেয়া হবে। বর্ষার গান—

এসো কর স্নান নব ধারা জলে
এসো নীপ বনে ছায়াবীথি তলে।

অন্ধকারে বৃষ্টি দেখা যায় না বলে ফ্লাড লাইট ফেলার ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। আলোতে বৃষ্টির ফোটা দেখা যাবে। ইয়াসিন সাহেব তাঁর কন্যাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবেন। মাথার চুল ভিজলেই তাঁর ঠাণ্ডা লেগে যায় বলে তিনি মাথায় শাওয়ার ক্যাপি পরে আছেন। ছাদে টব ভর্তি বড় বড় গাছ। এই গাছগুলিকে কদম্ব গাছ কল্পনা করে নিতে বাধা নেই। চিলেকোঠার ঘরে গরম কফির ফ্রাঙ্ক রাখা হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লাগলে গরম কফি খেয়ে শরীর গরম করে নেয়া হবে।

সব আয়োজন শেষ করে তিনি মীরাকে খবর দিতে গেলেন। তাঁর ভয় একটাই— এখন প্ৰবল বর্ষন হচ্ছে। এই বর্ষন আবার থেমে না যায়। অবশ্যি ওয়েদার ফেরকাষ্টে বলা হয়েছে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের কথা। আগে ওয়েদার ফোরকস্ট মিলত না। আজকাল স্যাটেলাইট ফ্যাটেলাইট হওয়ায় আবহাওয়া দপ্তর অনেক কিছু বলতে পারে।

মীরা নেলপলিশ রিমুভার দিয়ে নেলপলিশ তুলছিল। সে তার বাবার আয়োজনের কথা বাঘার দিকে না তাকিয়েই শুনল। তারপর শান্ত গলায় বললবাবা সামনের চেয়ারটায় চুপ করে বস। আমি হাতের কাজ সেরে নেই।

ইয়াসিন সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি কররে মা। বৃষ্টি থেমে যাবে।

মীরা বলল, আজ সারারাত বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি থামবে না। তুমি শান্ত হয়ে বসতো। তোমার বয়সের সঙ্গে ছটফটানিটা যাচ্ছে না।

ইয়াসিন সাহেব বসলেন। মীরা বলল, বাবা তুমি কি জান তুমি খুবই বোরিং ধরনের মানুষ।

ইয়াসিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, তোর মুখে এই কথাটা অনেকবার শুনেছি। আমি নিজে তা বিশ্বাস করি না।

তুমি নিজেও তা বিশ্বাস করা। আর বিশ্বাস কর বলেই তুমি যে বোরিং টাইপ না এটা প্রমাণ করার জন্যে হাস্যকর সব কাণ্ডকারখানা কর। আজকের বৃষ্টি-স্নান পরিকল্পনা তারই এক নমুনা।

নব্যধারা জলে স্নান তোর কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে?

বৃষ্টিতে ভেজাটা হাস্যকর না, তবে বৃষ্টি ভেজার পেছনের আয়োজনটা হাস্যকর। ফ্লাড লাইট, গান, মাথায় শাওয়ার ক্যাপ পরে বৃষ্টিতে ভেজা— Oh my God.

বেশতো আয় গান, ফ্লাড় সব বাদ দেই! মাথায় শাওয়ার ক্যাপ রাখতেই হবে। এই বয়সে চুল ভেজালে উপায় নেই।

সরি বাবা, আমি বৃষ্টিতে ভিজব না।

কেন। তুইতো বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করিস।

সব মেয়েরাই করে। তাই বলে কোনো মেয়েকেই দেখবে না বুড়ো বাবাকে নিয়ে ধেই ধেই করে বৃষ্টিতে ভিজছে। বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে সবচে খারাপ কোম্প্যানি হল বুড়ো বাবা।

ইয়াসিন সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মা তুই কি কোনো কারণে আমার উপর রাগ করেছিস?

উহঁ। তুমি এমন এক ব্যক্তি যে রাগ করার মত কিছু কখনোই করে না। আবার…।

আবার কী?

না থাক। কিছু না।

বৃষ্টিতে ভিজবি না?

না। ইচ্ছা করছে না।

আমি নিজে যদি বোরিং ধরনের মানুষ হই তুইও কিন্তু তাহলে কঠিন ধরনের মেয়ে। পাথর কন্যা।

ঠিক বলেছ।

নিজের ইচ্ছা, নিজের ভাল লাগাটাই তোর কাছে ইস্পটেন্ট। আমি খুব আগ্ৰহ করে বৃষ্টিতে ভিজতে চাচ্ছি– যেহেতু তোর ইচ্ছা করছে না, সেহেতু তুই সেই কাজটা করবি না।

ভান করতে আমার ভাল লাগে না বাবা। তোমার ভান করতে ভাল লাগে। আমার লাগে না। এই যে তুমি আয়োজন করে বৃষ্টিতে ভেজার ব্যবস্থা করেছ— এটা পুরোপুরি ভান। এই ভানটা তুমি করছ নিজের সঙ্গে।

ও আচ্ছা।

আমি নিজে ভান করি না। কেউ ভান করলে সেটা আমার ভাল লাগে না।

মানুষ মাত্ৰই ভান করে। ভান করে না এমন মানুষ তুই পাবি না।

একদম যে পাব না তা না। আমি তিনজনকে চিনি যারা ভান করে না। একজন হল শুভ্র। আরেকজন—আর্কেটেক্ট আখলাক সাহেব।

তৃতীয়জনটা কে?

তৃতীয়জন আমি।

তিনজনে মিলে একটা ক্লাব করে ফেল। মেন্টেস ক্লাবের মত ভান-মুক্ত ক্লাব। যার সদস্য হতে হলে মুক্ত মানুষ হতে হবে।

মীরা হাসল। ইয়াসিন সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোর ভান-মুক্ত ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে মাত্র একজনকে এ বাড়িতে প্রায়ই আসতে দেখি। শুভ্ৰকে আসতে দেখি না। এর কারণ কী?

ওকে আসতে বলি না বলে ও আসে না।

আসতে বলিস না কেন? শুভ্রকে কি তুই পছন্দ করিস না?

খুব পছন্দ করি। পছন্দ করি বলেই আসতে বলি না।

তোর লজিকটা বুঝতে পারছি না। যাকে পছন্দ করবি তার সঙ্গ কামনা করবি না?

না। প্ৰেম আমার খুব অপছন্দের ব্যাপার। আমি কারোর প্রেমে পড়তে চাই না।

প্রেমে পড়তে চাস না কেন?

প্রেমে পড়া মানে নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া। আমি যার প্রেমে পড়ব সে আমার জগতের বিরাট একটা অংশ নিয়ে নেবে। আমার জগৎটা ছোট হয়ে যাবে। তুমি তোমার নিজেকে দিয়ে বিচার কর। তুমি মার প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছিলে। তোমার জগতের সবটাই মা নিয়ে নিয়েছিল। মা যখন মারা গেল সে তার সঙ্গে সেই জগৎটা নিয়ে গেল। তুমি শূন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলে। ঠিক বলেছি বাবা?

ঠিক বলছিস কি-না জানি না। তবে কথা যে গুছিয়ে বলছিস তা বুঝতে পারছি। ফিজিক্স না পড়ে তোর আইন পড়া উচিত ছিল। তোর মা ছিল বোকা টাইপের মেয়ে। তুই এমন ক্ষুরের মত বুদ্ধি কীভাবে পেলি? ক্ষুরের এক দিকে থাকে ধার। তোর দুই দিকেই ধার।

মা বোকা ছিল?

খুবই বোকা ছিল। বোকা বলাটা ঠিক হচ্ছে না। সরল মহিলা ছিল। পৃথিবীর জটিলতা কিছুই বুঝত না। আমি যা বলতাম। তাই বিশ্বাস করত।

মীরা হেসে ফেলল। ইয়াসিন সাহেব বললেন, হাসছিস কেন?

মার সম্পর্কে তোমার উদ্ভট ধারণার কথা শুনে হাসছি। বাবা শোন, মা সারাজীবন তোমার সঙ্গে বোকা এবং সরল মেয়ের অভিনয় করে গেছে।

কেমন?

কারণ মা ছিল ভয়ঙ্কর বুদ্ধিমতী। মা তার বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছে তোমার প্ৰেম পেতে হলে বোকা এবং সরল মেয়ে সাজতে হবে। মা হল বহুরূপী গিরগিটি। বহুরূপী গিরগিটি কী করে জান? যে গাছে সে বাস করে সেই গাছের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে নিজের রঙ বদলায়। যাতে কেউ গাছ থেকে তাকে আলাদা করতে না পারে। মা তোমার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে নিজের রঙ বদলিয়েছে।

তোর কি ধারণা আমি বোকা?

অবশ্যই।

আমি বোকা বলেই তোর মা বোকা সেজে আমার সঙ্গে জীবন কাটিয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

ইয়াসিন সাহেব অবাক হওয়া গলায় বললেন, মারে আমিতো তোর কথাবার্তা প্ৰায় বিশ্বাস করা শুরু করেছি।

আমার উপর রাগ করছ নাতো?

না। রাগ করছি না। তোকে খুবই পছন্দ হচ্ছে। তোর ধারণা আমি সত্যি বোকা।

মানবিক সম্পর্কের ব্যাপারগুলিতে তুমি বোকা। তুমি যদি বোকা না হতে আমার জন্যে খুব লাভ হত। আমি আমার কিছু কিছু সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে পারতাম। আমি আলাপ করি না, কারণ আমি জানি আলাপ করে কোনো লাভ নেই।

ইয়াসিন সাহেব কৌতূহলী গলায় বললেন, লাভ না হলেও তোর একটা সমস্যা আমাকে বলতো শুনি। দেখি আমি বুদ্ধিমানের মত কোনো সাজেশন দিতে পারি কি-না।

পারবে না।

স্বীকার করলাম পারব না। তবু শুনি।

সত্যি শুনতে চাও?

হুঁ।

মীরা বিছানা থেকে উঠে বাবার সামনে চেয়ার টেনে বসল। ইয়াসিন সাহেব গভীর আগ্রহ নিয়ে মেয়ের কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছেন। তিনি জানেন তার মেয়েটা আর দশটা মেয়ের মত না। কিন্তু সে যে এতটা আলাদা তা বুঝতে পারেন নি।

মীরা শান্ত গলায় বলল, বাবা শোন, শুভ্ৰ মস্ত বড় বিপদে পড়েছে। আমি তাকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু আমি চাই না সে জানুক যে আমি তাকে সাহায্য করছি। সেটা কীভাবে করব তা বুঝতে পারছি না।

সে কী বিপদে পড়েছে?

শুভ্ৰর বাবা মারা গেছেন।

এটা কোনো বিপদ না। সবার বাবাই মারা যায়। আমিও মারা যাব।— তার মানে এই না যে তুই ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে যাবি।

শুভ্রর বাবা তোমার মত না বাবা। তিনি একটু আলাদা। আলাদা বলেই সমস্যা।

কী রকম?

শুভ্রর বাবার একটা ব্রোথেল আছে। তাঁর মৃত্যুর পর শুভ্ৰ উত্তরাধিকার সূত্রে সেই ব্রোথেলের মালিক হয়েছে।

কী আছে বললি? ব্রোথেল?

হ্যাঁ, ব্রোথেল এ হোর হাউজ যেখানে ফিফটি টু নিশিকন্যা থাকে।

কী বলছিস তুই! শুভ্রর বাবা…

হ্যাঁ, শুভ্ৰর বাবা।

সর্বনাশ! শুনেইতো আমার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

বাবা, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ – শুভ্ৰ এই ঘটনার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তার পুরো ভুবন এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন বল— আমি তার ভুবন ঠিকঠাক করার জন্যে কীভাবে সাহায্য করব?

কারোরই এখানে করার কিছু নেই। যা করার শুভ্রকে করতে হবে। সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করবে।

বাবা শোন, শুভ্ৰ যদি সাধারণ কেউ হতো। সে তা-ই করত। সে সাধারণ কেউ না। কাজেই সে কী করবে জান? সে বাবার ব্যবসা উঠিয়ে দিবে না। সে গভীর আগ্রহের সঙ্গেই ব্যবসাটা দেখবে। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করবে। বার বার মেয়েগুলির কাছে যাবে। তাদের বিচিত্র জগৎ বোঝার জন্যে নিজেকে সেই জগতের অংশ করার চেষ্টা করবে। শুভ্ৰ একশ ভাগ বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞানের ছাত্র জানে–কোনো সিস্টেমকে বুঝতে হলে সিস্টেমের অংশ হতে হয়। আমি তার ধ্বংসটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাকে কীভাবে সাহায্য করব কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি কি পারছ?

ইয়াসিন সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, না।

মীরা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, চল যাই বৰ্ষা যাপন করি।

বৃষ্টিতে ভিজি।

বৃষ্টিতে ভিজবি?

হ্যাঁ।

আমি নাচ জানলে খুব ভাল হত। আমার কী ধারণা জান বাবা— বৃষ্টিতে নাচ খুব ভাল হবে। পায়ে নুপুর বাজবে— বৃষ্টির শব্দও নুপূরের শব্দের মতই। বাবা কথা বলছ না কেন?

ইয়াসিন সাহেব ঘোর লাগা মানুষের গলায় বললেন, শুভ্ৰ সম্পর্কে কথাগুলি এখনো হজম করতে পারছি না।

শুভ্ৰ সম্পর্কে এখন না ভাবলেও হবে। ঐ সুইচটা অফ করে দিয়ে বর্ষা যাপনের সুইচটা অন কর।

ইচ্ছমত সুইচ অন-অফ করা যায়?

অবশ্যই যায়। চেষ্টা করে দেখ। আমি পারি, তুমি কেন পারবে না? ইয়াসিন সাহেব মেয়েকে নিয়ে ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *