০৮. বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়ে

বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়ে রাতের অন্ধকারে। তার স্পর্শে, ভালোবাসায় ধীরে ধীরে জন্ম নেয় ফুল। রাতে অন্ধকারে এ খেলা দেখা যায় না, বোঝা যায় না, অনুভব করাও যায় না। কিন্তু ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে ফুলের মেলা।

ক্যাপ্টেন আর মণিকাও বুঝতে পারেনি। যেমন রজনী স্বপনে ভরে সৌরভে, তুমি জান নাই, তুমি জান নাই, মরমে আমার ঢেলেছে তোমার গান। কোথায় লুকিয়ে ছিল এই মন? চোখের এই দীপ্তি? আঁখি-পল্লবে এই মায়াকাজল?

ডক্টর ব্যানার্জি বড় খুশি হলেন ক্যাপ্টেনকে দেখে। তোমার প্রেজেন্ট অ্যাসাইনমেন্টটা তো খুব ইন্টারেস্টিং?

হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন বলল, হ্যাঁ, তা কিছুটা।

তোমরা বুঝি এলাহাবাদের বাসিন্দা?

হ্যাঁ।

কতদিন এলাহাবাদে আছ?

বাবা ল পাশ করার পরই এলাহাবাদ যান। সেই থেকেই…

তোমার বাবা এখনও প্র্যাকটিশ করেছেন?

বছর দুই হল এলাহাবাদ হাইকোর্টের জর্জ হয়েছেন বলে…

ডক্টর ব্যানার্জি খুশি হয়ে বলেন, আই সি!

পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিসেস ব্যানার্জি। বলেন, তোমার আর ভাইবোনেরা এলাহাবাদেই?

ক্যাপ্টেন মজা করে বলে, সেদিন খাওয়া-দাওয়া দেখে বুঝতে পারেননি আমিই বাড়ির একমাত্র ছেলে?

ইতিমধ্যে ডক্টর ব্যানার্জির এক পাবলিশার্স এসে হাজির হলেন এক বান্ডিল প্রফ আর কিছু কাগজপত্তর নিয়ে।

মিসেস ব্যানার্জি ক্যাপ্টেনকে নিয়ে মণিকার ঘরে বসিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। একটু পরেই দীর্ঘ বিনুনির শেষে বাঁধুনী দিতে দিতে মণিকা এলো।

এইভাবে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে আর কতদিন নেগলেকট্ করবেন?

বিনুনি বাঁধা শেষ হল। বুকের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল যে বিনুনি তাকে ছুঁড়ে দিল পিছন দিকে। ঈষৎ বাঁকা চাহনি আর চোরা হাসি হাসতে হাসতে মণিকা বলে, তার মানে?

আপনি আসতে বললেন আর আপনারই পাত্তা নেই?

স্নান করতে গিয়েছিলাম। বিকেলে এক পুরনো বন্ধু আর তার স্বামী এসেছিলেন বলে গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল।

ভালই হয়েছে।

কেন বলুন তো?

ইউ লুক ভেরি ফ্রেশ।

আরো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল ক্যাপ্টেনের। মন বলছিল, তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা মম শূন্যগগনবিহারী।

অথবা…

কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম চয়নে।

সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দু-খানি নয়নে।

মনে মনে ভাবতে গিয়েও ঠোঁটটা বোধহয় একটু নড়েছিল, একটু কেঁপেছিল। মণিকার দৃষ্টি এড়ায়নি।

কি বলছেন মনে মনে? গালাগালি দিচ্ছেন না তো?

মনের কথাও জানতে পারে মণিকা? ক্যাপ্টেন চমকে ওঠে। কি করে বুঝলেন মনে মনে কিছু বলছি?

এটা মেয়েদের ট্রেড-সিক্রেট। বলতে নেই।

তাই নাকি?

তবে কি?

মিসেস ব্যানার্জি ঘরে ঢুকেই একটা প্লেট এগিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেনের দিকে।

মাছ ভাজা দুটো খেয়ে নাও।

সে কি মাসিমা?

রান্নাবান্না কিছু হয়নি। আজ খেতে খেতে অনেক দেরি হবে!

মা-মাসির কাছে এলে না খেয়ে কে যায়? মিসেস ব্যানার্জি আর কথা না বলে ভিতরে চলে গেলেন।

মণিকা তখনও দাঁড়িয়ে।

ক্যাপ্টেন জানতে চাইল, বসবেন না?

মণিকা পাশের বুক শেলফ-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল, সারাদিন শুয়ে-বসে তো টায়ার্ড হয়ে গেলাম। আপনার মতো মুক্ত বিহঙ্গ হলে তো বেঁচে যেতাম।

এ শুধু অলস মায়া, এ শুধু মেঘের খেলা।

ভ্রু কুঁচকে বাঁকা চোখে মণিকা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি আটকে রেখে জানতে চাইল, একটা কথা বলবেন?

আপনাকে না বলার মতো তো কিছু নেই।

এত কাব্য সাহিত্য চর্চা করলেন কোথায়?

আমার কর্মজীবনে কাব্য-সাহিত্যের স্থান নেই বলেই অবসর কাটাই কাব্য পড়ে।

ক্যাপ্টেন একটু থামে। মুখটা উঁচু করে মণিকার দিকে তাকিয়ে বলে, তাছাড়া অবসর যে প্রচুর! একটু গল্প করে সময় কাটাবার মতো কেউ নেই আমার। গত্যন্তর নেই বলেই শুয়ে শুয়ে বই পড়ি।

আমাদের এখানে চলে এলেই তো পারেন।

আপনিও তো আসতে পারেন আমার ওখানে।

কোনোদিন তো বলেননি।

সব কথাই কি বলতে হয়?

তা বটে। আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে, তোমার ভাবনা তারার মতো বাজে। মণিকা বোঝে বৈকি।

সত্যি, আমার যাওয়া উচিত ছিল।

মণিকা গিয়েছিল। টেলিফোন করে ক্যাপ্টেনের ছুটির দিনে গিয়েছিল।

নর্থ গেট পুলিশ অফিস থেকে টেলিফোন পাবার পরই ওই পায়জামা পাঞ্জাবি পরেই ক্যাপ্টেন গিয়েছিল পোর্টিকোতে মণিকাকে অভ্যর্থনা জানাতে।

ইউনিফর্ম বা স্যুট পরতেই দেখেছে এর আগে। নতুন বেশে বেশ লাগল। লিফট-এর ওখানে পৌঁছে ক্যাপ্টেন বাট পুশ করল। পাশে দাঁড়িয়ে মণিকা এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, আজ এই পোশাকে তো বেশ লাগছে!

থ্যাঙ্ক ইউ। আবার থ্যাঙ্ক ইউ বলছেন? অমন করে প্লিজ আর থ্যাঙ্ক করলে এক্ষুনি চলে যাব।

এর মধ্যে লিট নেমে এলো। মুখের ঝগড়া চোখের হাসিতে মিটমাট হয়ে গেল। তবে নিজের ঘরে ঢুকেই ক্যাপ্টেন বলল, বার্মিজ মেয়েদের মতো আপনি একটু শাসন করতে পছন্দ করেন, তাই না?

শুধু বার্মিজ মেয়েরাই নয়, সব দেশের মেয়েরাই পুরুষদের উপর খবরদারি করতে পছন্দ করে। আমিও পছন্দ করি!

থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইওর ফ্র্যাঙ্কনেস্।

মণিকা বসেছে। ক্যাপ্টেন তখনও দাঁড়িয়ে।

বসুন।

বসছি।

নাকি ভাবছেন সিরাজদৌল্লার ওই পরাজিত সৈনিকদের ডেকে কাটলেট-ওমলেট চা-কফির অর্ডার দিতে হবে?

মণিকার কথায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন না হেসে পারে না।

মণিকা আবার বলে, আচ্ছা এখানকার খাবার-দাবার খেতে আপনার ভালো লাগে?

ভালো লাগলেই কি সবকিছু পাওয়া যায়? নাকি, খারাপ লাগলেই দুরে রাখা যায়?

মণিকা কথাটা ঘুরিয়ে দেয়, এখানকার কাটলারিজ ক্রকারিজ দেখলেই কি মনে হয় জানেন?

কি?

মনে হয় সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাতিয়া তোপি, ঝাসির রানির প্যালেস লুঠ করে এসব জোগাড় করা হয়েছিল। আর কিছু এসেছিল উইন্ডসর ক্যাসেল-এর পুরনো স্টোর রুম থেকে।

দুজনে হাসে। হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মণিকার দিকে। বেশ লাগে মণিকাকে। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যাবার পর হঠাৎ লজ্জা লাগে।

দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, বসুন।

এবার ক্যাপ্টেন বসে। একই কৌচের অপর কোণায়।

সেন্টার টেবিল থেকে সিগারেট-কেস খুলে একটা সিগারেট তুলে নেয়। মণিকা সঙ্গে সঙ্গে তুলে নেয় লাইটার। জ্বালিয়ে ধরে ক্যান্টেনের সামনে। সে একটা টান দিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে বলে, ধন্যবাদ জানাব?

প্রয়োজন নেই!

আরো দু-একবার সিগারেট টান দিয়ে ক্যাপ্টেন বলে, চা আনতে বলি?

নাক উঁচু করে, ঠোঁটটা উল্টে মণিকা বলল, চা? এখানে নয়, চলুন বাইরে খাব।

চলনু বলেই ক্যাপ্টেন উঠে পড়ল। ঘরের কোণায় ওয়াড্রোব খুলে একটা লাইট কালারের সুট বের করে বাথরুমের দিকে এগুতে গেলেই মণিকা বলল, ছুটির দিনেও স্যুট পরবেন?

তবে কি পরব?

কেন, আপনার ধুতি নেই?

সরি! একটাও ধুতি নেই।

সে কি? বাঙালির ছেলে অথচ একটাও ধুতি নেই?

বাঙালিপনা দেখাবার সুযোগ পেলাম কোথায় বলুন?

একটু থেমে ক্যাপ্টেন জানতে চায়, কেন, স্যুট পরলে কি দেখতে খারাপ লাগে?

না, না, তা তো বলিনি। তবে বাঙালির ছেলেরা মাঝে মাঝে ধুতি-পাঞ্জবি পরবে বৈকি।

ধুতি না পরার জন্য মার কাছেও কি কম বকাবকি শুনি?

এবার আরো শুনবেন।

তা তো বুঝতেই পারছি।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্যাপ্টেন স্যুট-টাই পরে বেরিয়ে এলো।

বেশি দেরি করি নি তো?

বার্মিজ মেয়েরা আরো অল্প সময় নেয়। নীচের ঠোঁটটা ডান দিকে টেনে চাপা হাসি মুখে এনে মণিকা বলল।

ভগবান সবাইকে তো আপনার মতো রূপ দিয়ে পাঠান না।

যেমন বোলিং তেমনি ব্যাটিং। তাছাড়া ক্রিজটাও বোধকরি ভালো ছিল। অপরাহ্নের ক্লান্ত সূর্য রাজভবনের চারপাশের পাম গাছের মধ্য দিয়ে উঁকি দিতে দিতে গোধূলির আলাপ শুরু করে দিয়েছিল। মাঝে মাঝে দুটো একটা কোকিলের ডাকও ভেসে আসছিল।

ভাল লাগারই তো সময়।

আমাকে কী খুব রূপসী মনে করেন?

খুব বেশি রূপসী হলে আপনার সঙ্গে মেলামেশাই করতাম না।

অবাক হয় মণিকা। তার মানে?

বেশি সুন্দরীদের দিয়ে কোনো কাজ হয় নাকি?

অনেক সুন্দরীর সঙ্গে মিশেই কী এই অভিজ্ঞতা? জেরা করে মণিকা।

হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন বলে, Remember that the most beautiful things in the world are the most uselesspeacocks and Lilies for example.

আপন মনেই মণিকা বলে, শুধু রাশকি পড়েই কি এই অভিজ্ঞতা হয়?

নিশ্চয়ই… অত্যন্ত মার্জিতভাবে হাসতে হাসতে ঠাট্টা করলেও অন্য মেয়ের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের ঘনিষ্ঠতার সামান্যতম ইঙ্গিত মণিকাকে ঈর্ষান্বিত করে। মজা লাগে ক্যাপ্টেনের।

তর্ক করবেন না বেরুবেন?

তর্ক করছি?

তর্ক করছেন না?

তাই বলে আপনি আমাকে যা তা বলবেন?

সুন্দরকে সুন্দর, ভালোকে ভালো বলব না?

ক্যাপ্টেন কি করে বোঝায় মণিকাকে? একথা কি বলা যায় যে The beauty shall no more be found অথবা চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে। নবাব সিরাজদৌল্লার মতো কৈশোরের প্রারম্ভ থেকেই নারী-সাহচর্য উপভোগ করেনি ক্যাপ্টেন কমল রায় কিন্তু মেলামেশা তো করেছে বহুজনের সঙ্গে। এ-ডি-সি হয়ে কলকাতায় আসার পরই কি কম মেয়ের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল? গ্র্যান্ড-গ্রেটইস্টার্ন-স্পেনসেস, ক্যালকাটা ক্লাবে বা কোচবিহার কাপের খেলার দিন টার্ফ ক্লাবে গেলে কত ললিত-লাবণ্যের দেখা হয়। কথা হয়, হাসি হয়, ঠাট্টা-মস্করা হয় কিন্তু তারা তো, আধেক ঘুমে নয়ন চুমে স্বপন দিয়ে যায় না। বাগানে কত ফুল ফুটে থাকে; যাদের ফ্লাওয়ার ভাস-এ রাখলে ভালো লাগে তাদের দিয়ে কি পূজোর অঞ্জলি দেওয়া যায়?

ক্যাপ্টেনের মনের এসব কথা কি কোনো ভাষায় ব্যক্ত করা যায়?

একটু পরে ক্যাপ্টেন আবার বলে, আজ আর আপনার সঙ্গে তর্ক করব না।

ঘাড় বেঁকিয়ে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে মণিকা বলে, কেন?

তর্ক করলে কি গান শোনাবেন?

মাথাটা দোলাতে দোলাতে মণিকা বলে, বিশ্বাস করুন, আজকাল আর একেবারেই চর্চা করি না।

তাতে কি হয়েছে? আজ থেকেই না হয় আবার গানের চর্চা শুরু হবে।

ঘরের এপাশে-ওপাশে ঘুরে-ঘুরে ক্যাপ্টেন সিগারেট, দেশলাই, পার্স ও আরো কি কি পকেটে পুরে নিল। লম্বা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে একবার চুলটা ব্রাশ করে নিল।

চলুন, বেরিয়ে পড়ি।

মণিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন।

পাশাপাশি এগুতে গিয়েই একবার দুজনে দুজনকে দেখে নিল। মণিকা একটু লজ্জিত হল এমন করে চোখে চোখ পড়তে। চট করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সবকিছু নিয়েছেন তো?

ক্যাপ্টেন থমকে দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে বলল, দ্যাটস রাইট! ফোর্ট উইলিয়াম থেকে এক বন্ধুর গাড়ি নিয়ে এসেছি, কিন্তু চাবিটা নিতেই ভুলে গেছি।

তা না হলে পুরুষ মানুষ?

 ভুলে গেলে মনে করিয়ে দেবার জন্য তো আপনারা আছেন।

এ বহুবচনের অর্থ মণিকা বোঝে। মুখে কিছু বলে না, মনে মনে তৃপ্তি পায়।

রাজভবনের নর্থ-ইস্ট গেটের পাশে গাড়িটা একটা গাছের ছায়ায় ছিল। দরজার লক খুলে ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করল, কোথায় বসবেন? সামনে না পিছনে?

পিছনে বসলে লোকে যে আপনাকে ড্রাইভার ভাববে। হাসতে হাসতে মন্তব্য করে মণিকা।

ক্যাপ্টেন চুপ করে থাকে না। সামনে বসলে যে লোকে আপনাকে আমার স্টেনোগ্রাফার। ভাববে?

আমাকে দেখে কেউ স্টেনো ভাববে না।

এটা যে অফিস এরিয়া।

তবুও।

তবে কি ভাববে?

বিপদে পড়ে মণিকা। যা ইচ্ছে ভাবে ভাবুক।

ক্যাপ্টেনের পাশে বসে মণিকা।

এবার গাড়িতে স্টার্ট করে ক্যাপ্টেন প্রশ্ন করে, বলুন, কোথায় যাবেন? প্রস্তাব, পালটা প্রস্তাবের পর মণিকা বলল, চলুন, মধ্যমগ্রাম ঘুরে আসি।

সেখানে কি আছে?

আমাদের একটা ছোট্ট ফার্ম আছে।

ক্যাপ্টেনের মনে পড়ল মণিকার মা-ই একদিন বলেছিলেন, নিজেদের বাগানের শাক-সবজি কত কি আসে, কিন্তু খাবার লোক নেই।

ক্যাপ্টেন জানতে চেয়েছিল, কোথায় আপনাদের ফার্ম?

মধ্যমগ্রাম। একবার দেখে এসো, ভালো লাগবে। দু-এক বছর পর উনি তো ওখানেই থাকবেন বলেছেন।

স্টিয়ারিংটা ভালো করে ধরে গিয়ার দিতে দিতে মণিকাকে বলল, ঠিক আছে বাট-লেট আস হ্যাঁভ সাম টি বিফোর দ্যাট।

চলুন। আপনারা হোটেল-রেস্তোরাঁয় না গেলে ঠিক শান্তি পান না, তাই না?

ক্যাপ্টেন হাসে। বলে, যারা নিজের ঘর বাঁধতে পারেনি, তাদের আর কি গতি বলুন? মধ্যমগ্রামে গেলে চা খাওয়াবেন?

নিশ্চয়ই।

তাহলে চলুন।

সোজা মধ্যমগ্রাম গিয়েছিল। গাড়ি চালাতে চালাতে ক্যাপ্টেন বার বার এদিক-ওদিক কি যেন দেখছিল।

কি দেখছেন?

এই লোকজন।

লোকজন?

হ্যাঁ। প্রবাসী বাঙালি বলে কোনোদিন এত বাঙালি ছেলে-মেয়ের ভিড় দেখিনি। তাই তো কলকাতার রাস্তাঘাটে এত বাঙালি দেখতে ভীষণ ভালো লাগে।

ক বছর রেঙ্গুনে কাটিয়ে কলকাতা ফেরার পর আমারও এমনি হয়েছিল।

বাংলাদেশের অ্যাটমসফিয়ার এনজয় করব বলে এ-ডি-সি-র চাকরি নিয়ে এলাম, কিন্তু ঠিক যেটা চেয়েছিলাম সেটাই পেলাম না।

যতীন্দ্রমোহন এভিন পিছনে ফেলে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় পার হল।

মণিকা ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা রাজভবনের অ্যাটমসফিয়ারটা অমন পিকিউলিয়ার কেন বলুন তো?

কেন তা জানি না। তবে একটা জগা-খিচুড়ি অ্যাটমসফিয়ার। খানিকটা কলোনিয়াল, খানিকটা বাদশাহী, খানিকটা ইংলিশ। সব কিছু পাবেন, পাবেন না ইন্ডিয়ান অ্যাটমসফিয়ার।

ঠিক বলেছেন।

কোটিপতি ইন্ডিয়ানদের বাড়িতেও একটা আবছা আবছা ভারতীয় পরিবেশ পাবেন, কিন্তু এখানে তাও নেই।

অনেকটা হোটেল-হোটেল অ্যাটমসফিয়ার।

না, তাও না। হোটেলে মানুষ স্বাধীনভাবে হাসে, খেলে, গান গায় কিন্তু রাজভবনে সে অ্যাটমসফিয়ারও নেই।

এমন পরিবেশের মধ্যে থাকতে কষ্ট হয় না?

স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাস্তার মোড় ঘুরে ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতে তাকাল মণিকার দিকে। দারুণ কষ্ট হয়, কিন্তু কে আমাকে মুক্তি দেবে বলুন?

মণিকা আস্তে মাথাটা নীচু করল। মুখে কিছু বলল না।

.

ফার্মে সময়টা বেশ কেটেছিল। গাড়ি থেকে মণিকাকে নামতে দেখেই বনমালী ছুটতে ছুটতে এসে বলল, কি দিদিমণি? কি ব্যাপার?

বনমালী এক ঝলক ক্যাপ্টেনকেও দেখে নিল।

কি আবার ব্যাপার? তোমাকে দেখতে আসব না?

আনন্দে খুশিতে প্রায় লুটিয়ে পড়ল বৃদ্ধ বনমালী। তোমরা ছাড়া আমাকে আর কে দেখে বল?

এবার মণিকা ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা যখন রাজশাহী কলেজে, তখন থেকে বনমালী আমাদের সঙ্গে আছে। আমি এরই কোলে চড়ে মানুষ হয়েছি।

ইজ ইট?

হ্যাঁ। বনমালী হচ্ছে বাবার প্রাইভেট সেক্রেটারি।

বনমালীর মুখে আবার সেই খুশির হাসি। কি যে বল দিদিমণি!

একটু পরেই বলল, চল, চল ভিতরে যেয়ে বসবে চল।

ফার্মের এক কোণায় ছোট্ট দুখানি ঘর। ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন বলল, বেশ বোঝা যায় কোনো অধ্যাপকের ঘর।

বনমালী চেয়ার এগিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি আজ এসে ভালোই করেছ।

কেন?

কতকগুলো পেঁপে পেকে উঠেছে। আজকালের মধ্যে না খেলে নষ্ট হয়ে যাবে!

আবার ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে চাইল মণিকা, জানেন বনমালী কোনোদিন নিজের সংসার করল না কিন্তু আমাদের সংসার নিয়েই ও পাগল!

বনমালীর আদর-অভ্যর্থনার পর্ব শেষ হল। জিজ্ঞাসা করল, দিদিমণি, তোমরা কিছুক্ষণ আছ তো?

হ্যাঁ।

আমি তাহলে একটু ওদিকে যাচ্ছি। যাবার আগে আমাকে ডাক দিও কিন্তু।

নিশ্চয়ই!

বনমালী চলে গেল। যতক্ষণ ওকে দেখা গেল, ক্যাপ্টেন ওর দিকেই চেয়ে রইল। তারপর মণিকার দিকে ফিরে বলল, এই যুগেও এমন বনমালী পাওয়া যায়?

সত্যি হি ইজ এ রেয়ার ক্যারেকটার! তাছাড়া আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।

ছোট্ট একটু মুচকি হাসি হেসে ক্যাপ্টেন বলে, আপনাকে দেখছি সবাই ভালোবাসে!

ঠাট্টা করছেন? চোখের কোণে একটু বিদ্যুৎ হাসির ইঙ্গিত ফুটিয়ে মণিকা জানতে চায়।

প্রফেসর মঙ থেকে শুরু করে বনমালী পর্যন্ত সবাই-ই আপনাকে ভালোবাসে।

আপনাকে যতটা উদার ভেবেছিলাম, এখন দেখছি তা নয়।

ইজ ইট?

তবে কি?

মণিকা একটু হাসে, একটু চুপ করে। তারপর বলে, এখানে বসে বসে ঝগড়াই করবেন, নাকি একটু ঘুরে দেখবেন?

মজা করে ক্যাপ্টেন, এখানে বসে বসে ঝগড়া করতে পারলেই বেশি খুশি হতাম, কিন্তু বনমালী হয়ত পছন্দ করবে না।

ক্যাপ্টেন একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, চলুন একটু ঘুরেই আসি।

চলুন।

বাগানটি খুব বড় না হলেও নেহাত ছোট নয়। দেশ-বিদেশ ঘুরে এলে যে রুচিবান বাঙালিরও রুচির উন্নতি হয়, বাগানে ঘুরলেই তা নজরে পড়ে।

একি? স্ট্রবেরি?

মণিকা জবাব দেয়, হ্যাঁ।

ক্যাপ্টেন একটা সিগারেট ধরিয়ে মণিকার দিকে ফিরে বলল, বাঙালি একটু বাইরে ঘুরে-ফিরে এলে দৃষ্টিভঙ্গিটা অনেক পাল্টে যায়, তাই না?

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মণিকা বলে, হঠাৎ একথা বলছেন?

এই আপনাকে আর ওই স্ট্রবেরি গাছটা দেখে মনে পড়ল।

তার মানে?

বাংলাদেশের বাঙালির বাগানে আম-জাম-কলা পাবেন, পাবেন না স্ট্রবেরি।

কিন্তু তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?

হ্যাড ইউ বিন এ পিওর বেঙ্গলি গার্ল, তাহলে কি এত ফ্রি হতে পারতেন?

হোয়াট ডু ইউ মীন বাই এ পিওর বেঙ্গলি গার্ল?

মানে আপনার জন্ম-কর্ম, শিক্ষা-দীক্ষা সব কিছুই যদি বাংলাদেশে হতো…

ক্যাপ্টেন এক ঝলক দেখে নেয় মণিকাকে। মণিকা মাথা নিচু করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। খোঁপাটা ঢিলে হয়ে ঘাড়ের কাছে পড়েছে। কানের পাশ দিয়ে লম্বা জুলফির চুলগুলো ওর গালের উপর এসে পড়েছে। ক্যাপ্টেনের বেশ লাগছে ওকে দেখতে।

মণিকা এবার মুখ উঁচু করে ক্যাপ্টেনের দিকে ফিরে বলে, তাহলে কি হতো?

কি না হতে বলুন? আপনার সঙ্গে আমার মেলামেশার সুযোগ হতো?

কলকাতার কলেজ-ইউনিভার্সিটির কিছু ছেলেমেয়ে কমনরুমে বা কফি হাউসে একসঙ্গে গল্প-গুজব-আড্ডা দিলেও সহজ-সরলভাবে মেলামেশার পথে অনেক বাধা অনেক বিপত্তি।

সে কথা মণিকা জানে। জানে কলকাতা শহরে পাশাপাশি বাড়িতে ওরা দুজনে আজন্ম বাস করার পরও ক্যাপ্টেন বলতে পারত না চল মণিকা একটু বেড়িয়ে আসি। কিন্তু কলকাতার বাইরে বরাকরের ওপারে পাটনা, এলাহাবাদ, লক্ষ্মৌ, বোম্বের বাঙালি ছেলেমেয়েরা অনেক ঘনিষ্ঠ হতে পারে। শুধু ছেলে-মেয়েরা কেন? মা-বাবাও।

তাইতো ক্যাপ্টেন বলল, আপনার বাবা যদি শেয়ালদা কোর্টের উঁকিল হতেন আর সারপেনটাইন লেনেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতেন তাহলে কি তার মেয়েকে এত স্বাধীনতা দিতেন?

বাগানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দুচারটে পাখির ডাক হয়তো কানে এসেছিল ক্যাপ্টেনের। ঢলে পড়া সূর্যের গোলাপি রশ্মি বোধহয় মনটাকেও একটু রঙিন করেছিল। বনমালী না থাকলে আপনাকে একটা গান গাইতে বলতাম।

মণিকা হাসি চাপতে পারে না, বনমালীকে এত ভয় কেন?

ভয় না করলেও ওর বিরক্তিতে ভবিষ্যৎ নষ্ট করব কেন?

মজা লাগে মণিকার, তার মানে?

আজ নয় পরে বলব।

বেশ কেটেছিল সেদিনের অপরাহ্ন। বিদায়বেলায় বনমালী এক টুকরি ভর্তি পাকা পেঁপে দিয়ে বলেছিল, দিদিমণি মাকে বলল এগুলো কালকের মধ্যেই খেয়ে ফেলতে, নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে।

মণিকা এক ফাঁকে বনমালীকে ক্যাপ্টেনের পরিচয় দিয়ে এসেছিল। ক্যাপ্টেন তা জানত না।

বনমালী ক্যাপ্টেনকে বলল, আপনি লাটসাহেবের বাড়িতে থাকেন, কত মস্ত লোক। দয়া করে যে এসেছেন…

ক্যাপ্টেন আর এগোতে দিল না। মণিকার দিকে ফিরে বলল, এর ফাঁকে কখন ওকে এসব শিখিয়ে পড়িয়ে এলেন?

মিটমিট করে হাসতে হাসতে মণিকা বলল, হ্যাঁ বনমালীদা, তোমাকে আমি কিছু শিখিয়েছি?

বনমালী অত সাদা মিথ্যা কথাটা বলতে পারল না। মণিকার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ক্যাপ্টেনকে বলল, সময় পেলে দয়া করে আসবেন।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে যশোর রোডের ওপর আসার পরই ক্যাপ্টেন মণিকাকে বলল, বনমালীকে বলে দেবেন আমি মাঝে মাঝেই আসব।

মণিকা বলল, তাই নাকি?

কলকাতা ফেরার পথে গাড়ির স্পীডটা বেশ কম ছিল।

মণিকা জানতে চাইল, কি ব্যাপার? এত আস্তে চালাচ্ছেন? গাড়িতে কোনো ট্রাবল…

জোরে চালালেই তো এক্ষুনি সব ফুরিয়ে যাবে।

মণিকা কিছু বলে না। ক্যাপ্টেনও একটু চুপ করে থাকে। তারপর আবার বলে, ওই গরাদখানায় যেন আর মন টেঁকে না।

দুর থেকে রাজভবনের মানুষগুলোকে কত সুখী মনে হয়। মনে হয় ওরা সবাই সুখ-সম্ভোগ আনন্দ-বিলাসে মত্ত। ওখানে যারা থাকে, তাদের কি সাধারণ মানুষের মতো সুখ-দুঃখের অনুভূতি থাকে? দূর থেকে যারা রাজভবনকে দেখে তারা মনে করে, না। এত প্রাচুর্য, আনন্দবিলাসের মধ্যে কি দুঃখ থাকতে পারে?

ক্যাপ্টেনকে দেখে মণিকার উপলব্ধি হয়েছে, না ওখানকার সবাই সুখী হয়। মধ্যমগ্রাম থেকে কলকাতা ফেরার পথে সে কথাটা আরো বেশি করে উপলব্ধি করল।

এ-ডি-সি হবার আগে কি করে সময় কাটাতেন?

আর্মি লাইফে একটা সুন্দর উত্তেজনা আছে। বেশ কাটত দিনগুলো। কিন্তু এখানে তো কেউ প্রাণ খুলে হাসতেও পারে না।

হোয়াট অ্যাবাউট গভর্নর?

দুঃখের মধ্যেও ক্যাপ্টেনের হাসি পায়। তার অবস্থা আরো সঙ্গীন। আমি তো আমজাদের সঙ্গে গল্প করতে পারি, মণিকা ব্যানার্জিকে নিয়ে মধ্যমগ্রামে যেতে পারি, ভবিষ্যতে সিনেমা দেখতে পারি…

ক্যাপ্টেনের কথা শুনেই মণিকা হাসে, কে বলল আপনার সঙ্গে আমি সিনেমায় যাব?

কথাটা যেন কানেই তুলল না ক্যাপ্টেন।…লাটসাহেবের তো সে স্বাধীনতাও নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *