০৮. বিদেশী টুরিস্টদের মত লাগছে

কামরুল ইসলাম সাহেবকে আজ বিদেশী টুরিস্টদের মত লাগছে। তাঁর গায়ে থাই সিল্কের ঢোলা সার্ট। সেই সার্ট লাল, নীল, সবুজ অনেক কটা রঙ। চোখে সানগ্লাস। গলায় ক্যামেরা ঝুললেই পুরোপুরি টুরিস্ট। তাঁর গা থেকে ভুর ভুর করে গন্ধও বের হচ্ছে। গাড়ির পেছনের সীটে তিনি গা এলিয়ে বসে আছেন। ফরহাদ তাঁর পাশে। গাড়ি এয়ারপোর্ট রোড ধরে চলছে। তিনি কোথায় যাচ্ছেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ফরহাদ ভেবেছিল তাকে নিয়ে তিনি যাচ্ছেন, পিজিতে। আসমানী আছে পিজিতে। কিন্তু শাহবাগের মোড়ে এসে তিনি ড্রাইভারকে বললেন—এয়ারপোর্ট রোড ধরে এগিয়ে যাও। তারপরই ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের এদিকে ভাল কফি শপ নেই তাই না।

ফরহাদ বলল, আমি ঠিক বলতে পারছি না।

আসমানী বলেছে নেই। আসমানী আর নিশাকে নিয়ে একবার কফি শপের সন্ধানে বের হয়েছিলাম।

পান নি?

কয়েকটি পেয়েছি। গুলশানের দিকে। তবে ঠিক কফি শপ না। ফাস্ট ফুডের দোকান। চা কফিও বিক্রি করে। সবগুলিই ইয়াং ছেলেমেয়েদের দখলে। আমার এমন কফি শপ দরকার যেখানে আমার মত বুড়ো মানুষও যেতে পারে।

আমরা কি এখন কোন কফি শপে যাচ্ছি?

হ্যাঁ। কিছু কথা আছে বাড়িতে নিরিবিলি বসে বলতে হয়। কিছু কথা আছে পার্কে হাঁটতে হাঁটতে বলতে হয়। আবার কিছু কথা আছে বলতে হয় ভীড়ের মধ্যে। কফি শপে কিংবা পাবে। তোমার চারপাশে লোজন থাকবে। তারা সবাই কথা বলবে। তুমিও বলবে। কেউ কারো কথা শুনবে না। জনতার মধ্যেই আছে নির্জনতা।

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীর মামা তাকে বিশেষ কিছু কথা বলতে চান। সেই বিশেষ কথাগুলি কি সে ধরতে পারছে না। তিনি কি তাকে বলবেন, আসমানীর ভয়ংকর কোন অসুখ হয়েছে। এটা তাকে বলার দরকার নেই। এটা সে কারো সঙ্গে কথা না বলেও বুঝতে পারছে।

ফরহাদ?

জ্বি।

তোমার দাদাজানের মৃত্যুশোক তোমরা কি সামলে উঠেছ?

ফরহাদ বলল, জ্বি।

এখন কেউ কান্নাকাটি করছে না?

উনার বয়স হয়েছিল। মৃত্যু তার জন্যে প্রয়োজন ছিল। কেউ তেমন কান্নাকাটি করে নি।

তোমার খুব খারাপ সময় যাচ্ছে তাই না?

জ্বি।

শুনলাম যে বাড়িতে থাকতে সেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হচ্ছে?

জ্বি।

যাচ্ছ কোথায়? নতুন বাসা ভাড়া করছ?

এখনো করি নি।

তোমার যে চাকরি নেই এটাও জানতাম না। এটা আমাকে বলা দরকার ছিল। আসমানী কি জানে?

জ্বি জানে।

এটা ভাল যে তাকে বলেছ। তার কাছে কিছু গোপন করনি। চাকরি যে নেই, সংসার কিভাবে চলবে না চলবে কিছু ভেবেছ?

জ্বি না।

যে ছেলে বিয়ে করবে তার কোন প্ল্যানিং থাকবে না? তোমার মার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। চমৎকার মহিলা। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন তুমি যে বিয়ে করতে যাচ্ছ এই খবরটা তুমি তাঁকেও দাও নি। তোমার যে চাকরি নেই এটাও তিনি জানতেন না। তুমি একটা মেয়ের গভীর প্রেমে পড়েছ এটা খুবই ভাল কথা। যখন ঠিক করলে মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করবে তখনই কিন্তু রেসপনসিবিলিটির ব্যাপারই চলে আসছে। আসছে না?

জ্বি।

সিনেমায় বা রোমান্টিক উপন্যাসে কপর্দকহীন ছেলে প্রেমিকাকে বিয়ে করে। তাদের কোন সমস্যা হয় না, তারা সুখেই সময় কাটায়। রিয়েল লাইফে তা হয় না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কল্পনা এবং বাস্তবের সীমারেখা সম্পর্কে তুমি জান না। তুমি পুরোপুরি কল্পনাতেও বাস করছ না, আবার বাস্তবেও বাস করছ না। দুয়ের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় বাস করছ। আমি নিজে যে ভুলটা করেছি সেটা হচ্ছে আসমানীর আবেগের মূল্য দিয়েছি। তোমার বিষয়ে কোনরকম খোঁজ খবর করার প্রয়োজন বোধ করি নি।

খোঁজ খবর করে সব জানলে বিয়েতে রাজি হতেন না?

রাজি হতাম। আসমানীর দিকে তাকিয়ে রাজি হতাম।

কফি শপ একটা পাওয়া গেল। কামরুল ইসলাম সাহেবের পছন্দ হল না। ছোট্ট জায়গা। ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বার্গার-ফার্গার খাচ্ছে। এদের দেখে মনে হচ্ছে এদের বাড়িতে রান্না হয় না। দোকানের বার্গারই একমাত্র ভরসা। কামরুল সাহেব বললেন, চল এক কাজ করা যাক কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসি।

ফরহাদ বলল চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কফি পাওয়া যায় না।

চাইনিজ চা নিশ্চয়ই আছে। চল চা খেতে খেতে কথা বলি। এই এলাকায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেস্টুরেন্ট কোনটা?

আমি বলতে পারব না মামা। গুলশান বিত্তবান লোকদের এলাকা। আমি এদিকে আসি না।

চল খুঁজে বের করি। একটা পছন্দ না হলে আরেকটায় যাব। আসলে আজ আমার ঘুরতে ইচ্ছা করছে। কোন কোন দিন আসে যখন ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় সারাদিন ঘুরি। তাই না?

জ্বি।

আবার কোন কোন দিন আসে যখন ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছা করে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় দরজা জানালা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকি। মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রণা আছে। ঠিক বলছি না ফরহাদ?

জ্বি।

আচ্ছা ধর তোমাকে একটা চয়েস দেয়া হল—তুমি মানুষ না হয়ে অন্য যে কোন পশুপাখি কীট পতঙ্গ হয়ে জন্মাতে পার। তুমি কি হতে চাইবে?

কামরুল সাহেব তাকিয়ে আছেন। কালো চশমার কাৰণে তার চোখ দেখা যাচ্ছে না, তবে তিনি যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তা বোঝা যাচ্ছে। ফরহাদ বুঝতে পারছে আসমানীর মামা অস্থির বোধ করছেন। অস্থির মানুষ নিজের অস্থিরতা চারদিকে ছড়িয়ে দিতে চায়। এই অস্থিরতা কি অসমানীর বিয়ে নিয়ে? না-কি আসমানীর অসুখ নিয়ে? চাইনিজ রেস্টুরেন্টের নিরিবিলিতে তিনি ফরহাদকে কি জিজ্ঞেস করবেন? সে পরের জন্মে কি হয়ে জন্মাতে চায়? না-কি উনি বলবেন—আসমানীর সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত স্থগিত। তুমি কোন ভদ্র চাকরি জোগাড় কর। বউকে নিয়ে কোথায় তুলবে সেই ব্যবস্থা কর। তারপর দেখা যাবে।

পছন্দের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট একটা পাওয়া গেছে। এরা আবার কফিও বিক্রি করে। কামরুল সাহেব দু কাপ এসপ্রেসো কফির অর্ডার দিলেন ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করলে খাও। আমাকে গুরুজন হিসেবে সম্মান দেখাতে গিয়ে সিগারেট বন্ধ রাখার দরকার নেই। তোমার কাছে সিগারেট আছে?

জ্বি না।

আচ্ছা আমি আনিয়ে দিচ্ছি। আমার নিজেরও সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে।

কামরুল ইসলাম সিগারেট আনতে পাঠালেন। সব চায়নীজ রেস্টুরেন্ট অন্ধকার অন্ধকার থাকে। এটিও তাই। কামরুল ইসলাম এই অন্ধকারেও চোখ থেকে সানগ্লাস খুলেন নি।

ফরহাদ!

জ্বি।

আসমানীর অসুখটা ভাল না বলে ডাক্তাররা সন্দেহ করছেন।

ও।

আগেও একবার ডাক্তাররা এ জাতীয় সন্দেহ করেছিলেন। অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করার পর তারা সন্দেহমুক্ত হয়েছিলেন। বিউমেটিক ফিভারের চিকিৎসা করা হয়। এতে উপকারও পাওয়া যায়। এখন মনে হচ্ছে ভুল চিকিৎসা হয়েছে। ভুল চিকিৎসার মাশুল খুব চড়া হয়। চড়া মাশুল দিতে হবে।

ওর অসুখটা কি?

এখনো জানি না। এখনো পরীক্ষা নীরিক্ষার পর্যায়ে আছে। নিশ্চিতভাবে জানা যায় নি।

ডাক্তাররা কি সন্দেহ করছেন?

ভয়ংকর কিছু সন্দেহ করছেন। রেড ব্লাড সেল কাউন্ট অনেক বেশী। বেশী হলেও এরা ঠিক মত অক্সিজেন সাপ্লাই করতে পারছে না। নানান হাবিজাবি বলছে। ব্লাড ট্রান্সফিউশান করা হয়েছে। এতে ডাক্তাররা ভাল ফল পেয়েছেন। লোহীত রক্ত কণিকার অসুখ।

চিকিৎসা আছে?

লোহিত রক্ত কণিকার অসুখের আবার না-কি নানান ভেরাইটি আছে। কিন্তু কিছু ভেরাইটির ভাল চিকিৎসা আছে। এমনও আছে যে বোন-মেরো ট্রান্সপ্রেন্ট করে রোগ পুরোপুরি সারানো যায়। বোন-মেরো পাওয়াটাই সমস্যা।

সমস্যা কেন? সব বোন-মেরো ট্রান্সপ্লেন্ট করা যাবে না। ক্রস ম্যাচিং এ দেখতে হবে ম্যাচ করে কি-না। ক্রস ম্যাচিং করতে হবে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে। বিরাট জটিলতা। বাংলাদেশে ক্রস ম্যাচিং এর ব্যবস্থাও নেই। সিঙ্গাপুরে আছে।

আসমানী কি তার অসুখের কথা জানে?

না। তাকে বলা হয়েছে রিউম্যাটিক ফিভারের কথা। তোমাকে নিরিবিলিতে ডেকে আনার উদ্দেশ্যটা কি জান?

জ্বি না।

আসমানীর অসুখের খবর দেয়ার জন্যে তোমাকে ডাকি নি। অসুখের খবর দেয়ার জন্যে চাইনিজ রেস্টুরেন্টও লাগে না, এসপ্রেসো কফিও লাগে না। তোমাকে ডেকেছি এই কথাটা বলার জন্যে যে বিয়ের ব্যাপারটা তুমি আপাতত মাথা থেকে সরিয়ে দাও। আসমানী বিয়ের জন্যে খুব অস্থির হয়ে আছে। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম সে যে কথাটা বলেছে তা হচ্ছে আমার বিয়ে হয়নি?

ওকে কি সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হবে?

জানি না। আমার এত টাকা নেই। শুধু আসমানীকে একা নিলেতো হবে না। বোন-মোরো ক্রস ম্যাচিং করার জন্যে আরো অনেককে নিতে হবে। আমার এত টাকা নেই।

সিগারেট চলে এসেছে। ফরহাদ সিগারেট ধরাল। কামরুল ইসলাম সাহেব সিগারেট খেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ালেন না।

কফির কাপে চুমুক দিতে নড়ালেন।

ফরহাদ!

জ্বি।

চল আসমানীকে দেখতে যাই।

জ্বি চলুন।

কামরুল ইসলাম সাহেব উঠলেন না বসে রইলেন। কফি শেষ হয়ে গেছে তারপরেও তিনি শূন্য কাপে চুমুক দিচ্ছেন।

ফরহাদ।

জ্বি।

তুমি কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও নি।

কোন প্রশ্ন?

পরের জন্মে তুমি কি হয়ে জন্মাতে চাও? আসমানীকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম সে খুব অদ্ভুত উত্তর দিল। সে বলল…

কামরুল ইসলাম সাহেব কথা শেষ না করে উঠে পড়লেন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, আমি হাসপাতালে যাব না। আমাকে বাসায় নামিয়ে রেখে তুমি যাও। আরেকটা কথা আসমানীর অসুখটা যে ভয়াবহ এই তথ্য অবশ্যই গোপন রাখবে।

জ্বি রাখব।

আসমানী যখন ছোট ছিল তখন সে কিছু অদ্ভুত কান্ড করতো। একটা তোমাকে বলি…।

ফরহাদ অদ্ভুত কান্ড শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে, কিন্তু কামরুল ইসলাম সাহেব চুপ করে গেছেন। মনে হয় অদ্ভুত কান্ডের গল্প করতে এখন তিনি আর উৎসাহ পাচ্ছেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *