০৮.
বিকালবেলা শিউলি, বল্টু আর খোকন হাঁটতে বের হয়েছে। বল্টু আর খোকন আজকাল পড়তে শিখে গেছে, দোকানের সাইনবোর্ড দেখলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা পড়ার চেষ্টা করে। বড় একটা গয়নার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বল্টু সাইনবোর্ডটা পড়ে শেষ করল, “হীরামন জুয়েলার্স ডড নং কামারপাড়া রোড।” বল্টু একটু অবাক হয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “শিউলি আপু, ডড নং মানে কী?”
শিউলি হিহি করে হেসে বলল, “দূর গাধা, ডড নং না, এটা হচ্ছে ৬৬ নং।”
বল্টু একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “তাই বলো! আমি আরও ভাবছি ডড নং কী!”
খোকন গয়নার দোকানের পাশে একটা মিষ্টির দোকানের সাইনবোর্ড পড়তে শুরু করেছে, হঠাৎ শিউলি চমকে উঠে বল্টর পিছনে লুকিয়ে গেল। বল্টু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে শিউলি আপু?”
শিউলি ফিসফিস করে বলল, “চুপ কর গাধা, কথা বলবি না।”
“কেন?”
“ঐ যে দূরে দুইজন লোক, একজন ছাগলদাড়ি আর নীল পাঞ্জাবি ঐ লোকগুলোকে আমি চিনি। বুড়াটার নাম মোল্লা কফিলউদ্দিন।”
“একজনের কোলে যে একটা বাচ্চা, সেই লোকটা?”
“হ্যাঁ। আর তার পাশে যে লোকটা তার নাম ফোরকান আলি। মহা বদমাইশ লোক। কিডনি-ব্যাপারী।”
“কিডনী-ব্যাপারী? সেটা আবার কী?”
শিউলি অধৈর্য হয়ে বলল, “তুই বুঝবি না। চুপ করে দেখ কোনদিকে যায়।”
বল্টু আর খোকনের পিছনে শিউলি নিজেকে আড়াল করে রাখল, তারা দেখল ছোট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মোল্লা কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি রাস্তা পায় হয়ে অন্য পাশে চলে গেল। দূর থেকে শিউলি বল্টু আর খোকনকে নিয়ে তাদের লক্ষ করতে থাকে। ফোরকান আলি কফিলউদ্দিনকে কিছু-একটা বলল, তারপর দুজন মিলে হনহন করে হাঁটতে থাকে। শিউলি ফিসফিস করে বল্টু আর খোকনকে বলল, “চল পিছুপিছু, দেখি কোথায় যায়।”
বড় রাস্তা পার হয়ে তারা একটা ছোট রাস্তা পার হল, সেখান থেকে আবার একটা রাস্তা, সেখানে বড় একটা দালানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। শিউলি দেখল দালানটির মাঝামাঝি এক জায়গায় একটা বড় সাইনবোর্ড, সেখানে লেখা ‘বিউটি নার্সিং হোম।
কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি বেশ দূরে, শিউলির কথা শোনার কোনো আশঙ্কা নেই, তবুও শিউলি গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এইখানে নিশ্চয়ই কিডনি বিক্রি হয়।”
বল্টু আবার জিজ্ঞেস করল, “কিডনি জিনিসটা কী?”
“তুই বুঝবি না গাধা।”
“এখন কী করবে?”
“দেখি কী করা যায়।”
কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি দুজনে নিজেদের মধ্যে কিছু-একটা বলাবলি করে ভেতরে ঢুকে গেল। শিউলি খুব চিন্তিতমুখে বলল, “বিপদ হয়ে গেল!”
“কী বিপদ?”
“কফিল চাচা আর ঐ মানুষটা মনে হয় বাচ্চাটাকে এনেছে তার কিডনি কেটে ফেলার জন্যে।”
“কিন্তু কিডনিটা কী জিনিস?”
”তুই বুঝবি না গাধা।”
বল্টু বিরক্ত হয়ে বলল, “বলেই দেখো না বুঝি কি না।”
“শরীরের ভেতরে থাকে। কলিজার মতন। অনেক দামে বিক্রি হয়।”
খোকন মুখ বিকৃত করে বলল, “যাহ্!”
“খোদার কসম। রইস চাচা আমাকে না বাঁচালে কফিল চাচা এতদিনে আমার কিডনি বিক্রি করে ফেলত।”
“সত্যি?”
“সত্যি।” শিউলি তখন দুএক কথায় তার কিডনি বিক্রি করার ঘটনাটা বলার চেষ্টা করল।
বল্টু ঠোঁট কামড়ে বলল, “তুমি বলছ এই বাচ্চাটার কিডনি এখন কেটে ফেলবে?”
“মনে হয়।”
“সর্বনাশ! তা হলে তো কিছু-একটা করতে হবে।”
“চল আগে আমরাও ভেতরে ঢুকি।”
“চলো।”
তিনজনে খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তিনতলায় বিউটি নার্সিং হোমে হাজির হল। কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা গেল ভেতরে একটা ওয়েটিংরুমের মতো, সেখানে একটা সোফায় কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি বসে আছে। কফিলউদ্দিনের কোলে ছোট বাচ্চাটা। তার হাতে একটা লজেন্স ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা চাটছে।
শিউলি গলা নামিয়ে বল্টুকে বলল, “তুই একটা কাজ করতে পারবি?”
“কী কাজ?”
“এই দুইজনের পকেট মেরে যা যা কাগজপত্র আছে সবকিছু নিয়ে আসতে পারবি?”
“না।”
“না কেন?”
“পীরের তাবিজ না হলে আমি পারব না। শরীরবন্ধন ছাড়া যাওয়া ঠিক না।”
“ধুর, গাধা, তাবিজ ছাড়াও শরীরবন্ধন হয়।”
“মক্কেল বসে আছে, এইরকম কেস কঠিন–মনোযোগ অন্য জায়গায় না থাকলে করা ঠিক না।”
খোকন দুজনের কথা শুনছিল, বলল, “যদি মনোযোগ অন্য জায়গায় দেওয়া যায়?”
“কীভাবে দিবি?”
“মনে করো আমি আর বল্টু ভাই ভেতরে গেলাম, দুজন বসে নিজেদের ভেতরে কথা বলছি তখন হঠাৎ যদি ছোট বাচ্চাটা কথা বলে ওঠে?”
শিউলি মাথা নাড়ল, “এত ছোট বাচ্চা কথা বলবে কেন?”
“আসলে তো আমি বলব। মুরগিকে দিয়ে কথা বলিয়ে দিয়েছি, এইটা তো সোজা_”
শিউলির চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস আইডিয়া! বাচ্চাটা কথা বললেই কফিল চাচা আর ফোরকান আলি একেবারে সাংঘাতিক অবাক হয়ে যাবে, পুরো মনোযোগ থাকবে বাচ্চার দিকে।
বল্টু খুব চিন্তিত মুখে বলল, “দেখি চেষ্টা করে। আল্লাহ মেহেরবান।”
বল্টু কোনো-একটা দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ভেতরে ঢুকল, পেছনে পেছনে খোকন। তাদের দুজনকে দেখে কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি সরুচোখে তাদের দিকে তাকাল। কোনো একটা-কিছু নিয়ে কথা বলা দরকার তাই বল্টু বলল, “আমাদেরকে এখানে আসতে বলেছেন না?”
খোকন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। এইখানে।”
“কয়টার সময় জানি আসবে?”
“পাঁচটার সময়।”
“তা হলে এখনও যে আসছে না?”
“মনে হয় জ্যামে পড়েছে।”
“ও।”
কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি এই দুইজনের কথাবার্তা শুনে একটু সহজ হল, কেউ-একজন ছেলে দুজনকে এখানে এসে অপেক্ষা করতে বলেছে, এই নার্সিং হোমে সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
ফোরকান আলির পাশে বসল বল্টু, তার পাশে খোকন। সেখানে বসেও তারা নিজেদের মাঝে কথা বলতে শুরু করে, তখন কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলিও নিচুগলায় কথা বলতে থাকে। হঠাৎ একটা বিচিত্র জিনিস ঘটল, ছোট তিন-চার মাসের বাচ্চাটা হাত নেড়ে বলল, “এই শালা কফিলউদ্দিন!”
কফিলউদ্দিন একেবারে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। কাঁপা গলায় বললেন, “এই বাচ্চা দেখি কথা বলে!”
ছোট বাচ্চাটা হাতের লজেন্সটা একবার চেটে বলল, “কথা বলব না কেন? একশোবার বলব।”
কফিলউদ্দিন হঠাৎ ভয় পেয়ে বাচ্চাটাকে ফোরকান আলির কোলে বসিয়ে দিল। বাচ্চাটা ফোরকান আলির দিকে তাকিয়ে বলল, “ই ফোরকাইন্যা!”
“এ্যাঁ!” ফোরকান আলি ভয় পেয়ে বলল, “কী বলে এই ছেলে?” বাচ্চাটা স্পষ্ট গলায় বলল, “এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব।”
ফোরকান আলি যেন কোলে একটা বিষাক্ত সাপ নিয়ে বসে আছে এরকম ভান করে বাচ্চাটাকে প্রায় ঠেলে নিচে বসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ছোট বাচ্চাটা এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “শালা কফিলউদ্দিন আর ব্যাটা ফোরকাইন্যা তোরা ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না?”
“তু-তু তুমি কী বলছ?”
“আমি ঠিকই বলছি। পুলিশ আসুক তখন বুঝবে ঠ্যালা!”
কফিলউদ্দিন প্রায় ফ্যাকাশে-মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি এর মাঝে নাই, গেলাম আমি, গেলাম। তারপর ফোরকান আলিকে কিছু বলতে না দিয়ে প্রায় ঝড়ের মতো ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
“দাঁড়ান, দাঁড়ান কফিল ভাই–”বলে পেছনে পেছনে ছুটে গেল ফোরকান আলি এবং দেখা গেল দুজনে সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে নেমে যাচ্ছে। বল্টু আর খোকন কী করবে বুঝতে পারল না, এরকম কিছু-একটা যে হতে পারে সেটা তারা একবারও চিন্তা করেনি। বাচ্চটিকে রেখে যাবে, না সাথে নিয়ে যাবে চিন্তা করে না পেয়ে বল্টু বাচ্চাটাকে ধরে ঘর থেকে বের হয়ে এল। সিঁড়ির কাছে শিউলি দাঁড়িয়ে ছিল, সে কাছে এসে অবাক হয়ে বলল, “কী হল? দুইজন এইভাবে দৌড়ে কোথায় পালিয়ে গেল?”
খোকন খিকখিক করে হেসে বলল, “ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে।”
“কী দেখে ভয় পেয়েছে?”
বল্টু কোনোমতে পেটের সাথে ধরে রাখা নাদুসনুদুস বাচ্চাকে দেখিয়ে বলল, “এই বাচ্চাকে দেখে! কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলিকে এমন ধোলাই দিয়েছে যে দুইজন ভয়ে একেবারে চিমশি মেরে গেছে!”
“ধোলাই?”
খোকন আবার খিকখিক করে হেসে বলল, “আমি এর মুখ দিয়ে কথা বলিয়েছি।”
“কিন্তু এখন এই বাচ্চাটাকে নিয়ে আমরা কী করব?”
”আমি জানি না” বলে খোকন শিউলির কাছে বাচ্চাটাকে ধরিয়ে দিল।
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শিউলি বলল, “ইশ, কী গাবদা-গোবদা বাচ্চাটা! দেখে কী মায়া লাগে!
বল্টু ভুরু-কুঁচকে বলল, “কী বলছ! মায়া লাগে? যদি পিশাব করে দেয়?”
“বাজে কথা বলবি না। তোর ধারণা, ছোট বাচ্চা হলেই সে পেশাব করে দেয়?”
শিউলির কথা শেষ হবার আগেই ঝিরঝির করে একটা শব্দ হল এবং মনে হল শিউলিকে সবার সামনে অপদস্থ করার জন্যেই বাচ্চাটি তাকে ভিজিয়ে দিয়েছে।
খোকন হিহি করে হেসে বলল, “ছোট বাচ্চাদের পুরা সিস্টেম উলটাপালটা।”
শিউলি চোখ পাকিয়ে থোকনের দিকে তাকাল, তারপর বাচ্চাটিকে হাত বদলে সাবধানে ধরে রেখে বলল, “এখন একে কী করব?”
বল্টু আবার বলল, “আমি জানি না। আমাকে পকেট খালি করে আনতে বলেছ খালি করে এনেছি। ব্যাটার পকেটে কোনো টাকা-পয়সা নাই, খালি কাগজপত্র। বাচ্চাকাচ্চা কী করবে আমি জানি না।
খোকন বলল, “এই বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে যাই। রইস চাচা যদি আমাদের তিনজনকে রাখতে পারে তা হলে আর একজন বেশি হলে ক্ষতি কী?
বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “একটা ছোট বাচ্চা দশজন বড় মানুষের সমান।”
“কেন?”
“একজন বড় মানুষ কি কখনো ঘরের মাঝখানে পিশাব করবে? করবে না–কিন্তু এই বাচ্চা করে দেবে। একজন বড় মানুষ কি সারারাত গলা ফাটিয়ে চিল্লাবে? চিল্লাবে না–কিন্তু এই বাচ্চা চিল্লাবে। কোনো মানুষকে পছন্দ না হলে একজন বড় মানুষ আরেকজন বড় মানুষের মুখে খামচি মারবে? মারবে না–কিন্তু এই বাচ্চা মারবে।”
“হয়েছে হয়েছে, অনেক হয়েছে।” শিউলি মুখ-ভেংচে বলল, “এখন বোলচাল থামা।”
খোকন আবার বলল, “নিয়ে যাই-না এইটাকে বাসায়। দেখো, কী সুন্দর! একেবারে পুতুলের মতন।”
শিউলি মাথা নাড়ল, “উঁহু। নেয়া যাবে না।”
“কেন নেয়া যাবে না?”
“রইস চাচা বলেছে, আর নতুন কোনো বাচ্চা আমদানি করা যাবে না।”
ছোট বাচ্চাটাকে বগলে চেপে ধরে শিউলি হাঁটতে থাকে। বগলে চেপে ধরে রাখার এই ভঙ্গিটা মনে হল বাচ্চাটারও খুব পছন্দ হল, সে হঠাৎ তার ফোকলা দাঁত বের করে ফিক করে হেসে দিল। সেই হাসিটা এতই মধুর যে দেখে বল্টু পর্যন্ত নরম হয়ে পড়ল, বলল, “শিউলি আপু, চলো এইটাকে বাসায় নিয়ে যাই। একটা ছোট বাচ্চা আর কতটুকু জায়গা নেবে?”
খোকন বলল, “আর কতই-বা খাবে!”
বল্টু বলল, “আমরা নাহয় লুকিয়ে রাখব, রইস চাচা টেরই পাবে না।”
“যখন চাচাবে?”
“তখন বলল খোকন তার ভেন্টি-কুন্টি না কী যেন সেইটা প্র্যাকটিস করছে।”
শিউলি বলল, “একটা ইঁদুরের বাচ্চা, না হলে চড়ুই পাখি বাচ্চা লুকিয়ে রাখা যায়–তাই বলে আস্ত একটা মানুষের বাচ্চা?”
“কিন্তু তুমি করবেটা কী? এই বাচ্চাটাকে রাস্তায় ফেলে দেবে? তার চেয়ে চলো একবার বাসায় রাখার চেষ্টা করে দেখি।”
শিউলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে, চল দেখি।” বাচ্চাটাকে লুকিয়ে রাখার বুদ্ধিটা যে তার খুব পছন্দ হল তা নয়, কিন্তু তার আর কিছু করার ছিল না।
তিনজন যখন বাচ্চাটাকে নিয়ে বাসায় পৌঁছাল তখনও রইসউদ্দিন বাসায় পৌঁছাননি। বল্টু মতলুব মিয়াকে রান্নাঘরে ব্যস্ত রাখল, সেই ফাঁকে শিউলি আর খোকন লুকিয়ে বাচ্চাটাকে তাদের নিজেদের ঘরে নিয়ে গেল। বাচ্চাদের ঘুমানোর এবং জেগে থাকার বিচিত্র সময় রয়েছে, বিকেলবেলা যখন ছুটোছুটি হৈচৈ করার সময় তখন বাচ্চাটি ঘুমিয়ে একেবারে কাদা হয়ে গেল। বাচ্চাটাকে কোথায় লুকানো যায় বুঝতে না পেরে শিউলি আর খোকন তাকে বিছানার নিচে ছোট একটা বিছানা তৈরি করে সেখানে ঘুম পাড়িয়ে রাখল। ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাটা নিশ্চয়ই খেতে চাইবে, তখন তাকে কী খাওয়াবে এবং কেমন করে খাওয়াবে সেটা নিয়ে শিউলি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ছোট বাচ্চারা কী খায় সেটা তারা ভালো করে জানে পর্যন্ত না। বল্টু আর খোকন মিলে এক গ্লাস দুধ আর খানিকটা ভাত চুরি করে সরিয়ে রাখল, বাচ্চাটা যখন খেতে চাইবে তখন তাই তাকে খাওয়ানো যাবে।
সেদিন গভীর রাতে রইসউদ্দিন হঠাৎ চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন, শুনলেন শিউলি বল্টু আর খোকনের ঘর থেকে ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসছে, একা একা থেকে তিনজন বাচ্চার কোনো-একজন মন-খারাপ কান্নাকাটি করলে তিনি এমন কিছু অবাক হতেন না। কিন্তু এটি একেবারে ছোট শিশুর কান্না। রইসউদ্দিন হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে বাচ্চাদের ঘরে এলেন, অবাক হয়ে দেখলেন এত রাতেও তিনজনই জেগে আছে। জিজ্ঞেস করলেন, “ছোট বাচ্চা কাঁদছে কোথা থেকে?”
শিউলি বলল, “খোকন।”
“খোকন?”
“হ্যাঁ।”
শিউলি বলল, “খোকন ভেন্টি-কুন্টি না কী যেন সেইটা প্র্যাকটিস করছে।”
“ভেন্ট্রিলোকুইজম?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ।” শিউলি খোকন আর বল্টু একসাথে জোরে জোরে মাথা নাড়তে শুরু করল।
“এতে রাতে ভেন্ট্রিলোকুইজম?”
খোকন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “দিনের বেলা সময় পাই না তো–তাই রাত্রের বেলা প্র্যাকটিস করি।”
রইসউদ্দিন একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন কেন এত রাতে ছোট বাচ্চার কান্না ভেন্ট্রিলোকুইজম দিয়ে প্র্যাকটিস করতে হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলেন না। বাচ্চাকাচ্চা সম্পর্কে তিনি আগেও বেশি জানতেন না, গত কয়েকমাস থেকে এই তিনজনকে একসাথে দেখে যেটুকু জানতেন সেটা নিয়েও নিজের ভিতরে সন্দেহ হতে শুরু করেছে।
রইসউদ্দিন বিছানায় শোওয়ার জন্যে ফিরে গেলেন এবং সারারাত একটু পরেপরে খোকনের ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দের ভেন্ট্রিলোকুইজম শুনে চমকে চমকে জেগে উঠতে লাগলেন।
ভোরবেলা রইসউদ্দিন অফিসে চলে যাবার পর শিউলি মতলুব মিয়াকে রান্নাঘরে ব্যস্ত রাখল তখন খোকন আর বল্টু মিলে ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে শিউলি যতক্ষণ স্কুলে থাকবে ততক্ষণ বল্টু আর খোকন মিলে বাচ্চাটিকে দেখেশুনে রাখবে। বাসার ভেতরে থাকলে চঁচামেচি কান্নাকাটি করতে পারে বলে এই ব্যবস্থা।
স্কুলে যতক্ষণ থাকল আজ শিউলি খুব আনমনা হয়ে থাকল, বাচ্চাটির জন্যে মনটা খুব নরম হয়ে আছে। এইটুকুন একটা বাচ্চা, সারা পৃথিবী তাকে দেখে রাখার কোনো মানুষ নেই, তাদের মতো তিনজনকে তাকে দেখে রাখতে হচ্ছে ব্যাপারটা চিন্তা করেই তার কেন জানি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কতদিন বাচ্চাটিকে লুকিয়ে রাখতে পারবে কে জানে–একটা ছোট মারবেলকে লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু একটা মানুষকে কি লুকিয়ে রাখা যায়?
স্কুল ছুটির পর শিউলি বাইরে বের হয়ে এসে দেখে বল্টু আর খোকন ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। বাচ্চাটিকে খোকন তার ঘাড়ে বসিয়ে নিয়েছে এবং সে মহা আনন্দে তার মাথায় চুল দুই হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। শিউলি জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা হয় নাই তো?”
বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “হয় নাই আবার!”
শিউলি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
বল্টু শিউরে উঠে বলল, “আমি ঘাড়ে করে বাচ্চাটাকে নিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ মনে হল গরম কী যেন ঘাড়ের মাঝে থেকে শরীরের মাঝে কিলবিল করে ঢুকে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম কী না কী হঠাৎ দেখি বাচ্চার পিশাব! সর্বনাশ!”
শিউলি খিকখিক করে হেসে বলল, “এইটা আবার এমন কী ব্যাপার! ছোট বাচ্চা মানুষ করতে হলে এটা সহ্য করতে হবে।”
খোকন বলল, “শিউলি আপু, আমি এর নাম দিয়েছি গাণ্ড।”
“গাগু?”
“হ্যাঁ। যখন তার মনে আনন্দ হয় সে বলে গা-গা-গা–আর যখনই রেগে যায় তখন বলে গু গু গু তাই নাম হচ্ছে গাগু। ভালো হয়েছে না নামটা?”
বল্টু বিরসমুখে বলল, “কচু হয়েছে। গাগু একটা নাম হল? একটা ছেলের নাম কখনো গাগু হয়?”
শিউলি অবাক হয়ে বলল, “ছেলে? ছেলে কোথায় পেলি? জানিস না এটা মেয়ে?”
“মেয়ে নাকি?”
বল্টু মনে হল ভয় পেয়ে দুই পা সরে গিয়ে বলল, “সর্বনাশ!”
শিউলি চোখ পাকিয়ে বলল, “সর্বনাশ? তুই মেয়ের মাঝে সর্বনাশের কী দেখলি?”
বল্টু পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “মেয়ে মানেই সর্বনাশ! আর সেই মেয়ে যদি ছোট হয় তা হলে সাড়ে সর্বনাশ!”
শিউলি বাচ্চাটিকে নিজের কোলে নিয়ে বলল, “এত লক্ষ্মী একটা মেয়েকে তুই সাড়ে সর্বনাশ বলিস, এমন দাবড়ানি দেব যে নিজের নাম ভুলে যাবি!”
শিউলির পক্ষে সেটা সত্যিই সম্ভব তাই বল্টু আর কোনো কথা বলল না। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তিনজনে হাঁটতে থাকে, খোকন হাঁটতে হাঁটতে বলল, “গাগুকে সব উলটাপালটা জিনিস শিখাচ্ছি।”
“উলটাপালটা?” “হ্যাঁ। হাতকে দেখিয়ে বলেছি পা, পা-কে দেখিয়ে বলেছি হাত। নাককে দেখিয়ে বলেছি পেট, পেটকে দেখিয়ে বলেছি চোখ। গাগু যখন বড় হবে সবকিছু উলটাপালটা বলবে, মজা হবে না?”
শিউলি একটু অবাক হয়ে বলল, “মজা? কোন জায়গাটায় মজা?”
“যেমন মনে করো যখন রেগে উঠবে তখন খিলখিল করে হাসবে, আর যখন খুব হাসি পাবে তখন ভেউভেউ করে কাঁদবে! সবকিছু উলটাপালটা শিখিয়ে দেব।”
শিউলি মাথা নেড়ে বলল, “খোকন তুই যখন বড় হবি তখন খবরদার বিয়ে করবি না। আর যদি বিয়ে করিস খবরদার যেন বাচ্চাকাচ্চা না হয়। হলে অনেক বিপদ আছে।”
বল্টু পিচিক করে আবার থুতু ফেলে বলল, “বিপদ হবে আমাদের।”
“কী বিপদ?”
“গাগুর জন্যে আজকে স্কুলে যেতে পারলাম না, সন্ধ্যেবেলা দারোগা আপা না আবার বাসায় এসে যায়!”
.
সন্ধ্যেবেলা সত্যি সত্যি দারোগা আপা এসে হাজির হয়ে গেলেন। তখন শিউলি, বল্টু আর খোকন মাত্র গাগুকে খানিকটা দুধ খাইয়ে বিছানার নিচে শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
আপাকে দেখে বল্টু এবং খোকন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, শিউলি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে খুব খুশি হয়ে যাওয়ার ভান করে বলল, “আসেন আপা আসেন। আসেন আসেন। ভালো আছেন আপা? স্কুলটা ভালো আছে আপা? স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সব ভালো আছে?”
আপা মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। আমার স্কুলটাও ভালো আছে। ছাত্র-ছাত্রী সবাই ভালো আছে কি না জানি না, তাই খোঁজ নিতে এসেছি।”
আপা বল্টু এবং খোকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? স্কুলে আসনি কেন আজ?”
“ইয়ে আপা আমরা খুব একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম ইয়ে মানে সাংঘাতিক ঝামেলা–”
ঠিক এরকম সময় রইসউদ্দিন তাদের ঘরে এসে হাজির হলেন, মতলুব মিয়া তাঁকে খবর দিয়েছে যে বল্টু আর খোকন নিশ্চয়ই কিছু-একটা গোলমাল করেছে, স্কুলের মাস্টারনি আবার বাসায় চলে এসেছেন। রইসউদ্দিনকে দেখে শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “এই যে রইস সাহেব, কেমন আছেন?”
“ভালো। মানে ইয়ে–কোনো সমস্যা?”
“না না, কোনো সমস্যা নেই। আমার সবচেয়ে ব্রাইট দুজন ছাত্র স্কুলে যায়নি তাই খোঁজ নিতে এসেছিলাম।”
“স্কুলে যায়নি?” রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বলু আর খোকনের দিকে তাকালেন। ঠিক এরকম সময় বিছানার নিচে থেকে গাগুর আনন্দধ্বনি শোনা গেল, “গা গা গা গা–”
শিরিন বানু চমকে উঠলেন, “ওটা কিসের শব্দ?”
শিউলি ঢোক গিলে বলল, “খোকন ভেন্টিকুন্টি–”
রইসউদ্দিন শিউলিকে শুদ্ধ করিয়ে দিয়ে বললেন, “ভেন্ট্রিলোকুইজম। আমাদের খোকন একজন এক্সপার্ট ভেন্ট্রিলোকুয়িস্ট, যে-কোনো জায়গায় শব্দ বের করতে পারে।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।”
সত্যি সত্যি বিছানার নিচে আবার স্পষ্ট শোনা গেল, “গা-গা-গা-গা–” বিছানার নিচে গাণ্ড কী দেখে এত আনন্দ পেয়েছে কে জানে? যতক্ষণ আনন্দে থাকবে সমস্যা নেই, রেগে গেলেই বিপদ।
শিরিন বানু খোকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “করো দেখি আবার।”
“কী করব?”
“কোনো-একটা শব্দ করো।”
আবার বিছানার নিচে থেকে শব্দ বের হয়ে এল। এবার”গু-গু-গু–” শিউলি একটু ঘাবড়ে গেল, মনে হচ্ছে গাগু বিছানার নিচে রেগে যাচ্ছে।
শিরিন বানু মুগ্ধ হয়ে থোকনের দিকে তাকালেন, এইটুকু ছেলে কী চমৎকার ভেন্ট্রিলোকুইজম করছে, স্পষ্ট মনে হচ্ছে শব্দটা আসছে বিছানার নিচে থেকে। রইসউদ্দিন না বললে তিনি নিশ্চয়ই বিছানার নিচে উঁকি দিয়ে দেখতেন।
বিছানার নিচে থেকে আবার ”গু-গু-গু-গু” শব্দ বের হয়ে এল। শিরিন বানু স্পষ্ট দেখলেন শিউলি, বল্টু এবং খোকন তিনজনের মুখে কেমন জানি ভয়ের একটা ছাপ পড়েছে। তার কিছু-একটা সন্দেহ হল, তিনি মাথা ঘুরিয়ে আবার বিছানার নিচে তাকালেন এবং হঠাৎ করে চমকে উঠলেন–একটা ছোট শিশুর হাত দেখা যাচ্ছে। বিছানার নিচে থেকে একটা ন্যাদান্যাদা বাচ্চা গড়িয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছে।
শিরিন বানু রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “রইস সাহেব, খোকন খুব বড় ভেন্ট্রিলোকুয়িস্ট! শুধু বাচ্চার গলার শব্দ নয়–সে একটা আস্ত বাচ্চা তৈরি করে ফেলেছে!”
রইসউদ্দিন হতচকিত হয়ে বললেন, “কী বলছেন আপনি!”
“এই দেখেন” বলে শিরিন বানু বিছানার নিচে থেকে গাবদাগোবদা একটা বাচ্চাকে বের করে আনলেন, বাচ্চাটি তখনও হাত নেড়ে নেড়ে কোনো-একটা জিনিস নিয়ে প্রতিবাদ করে বলছে, গু-গু-গু!”
রইসউদ্দিনের কয়েক সেকেন্ড লাগল ব্যাপারটা বুঝতে–যখন বুঝতে পারলেন তখন কেমন যেন আতঙ্কিত হয়ে শিউলি, বল্টু আর খোকনের দিকে তাকালেন। কাঁপা গলায় বললেন, “কী? এটা কী? কী হচ্ছে এখানে?”
শিউলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রইসউদ্দিন তখন হঠাৎ একটা খুব সাহসের কাজ করে ফেললেন, শিউলিকে ধমক দিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে এখানে শিউলি?”
শিউলি একেবারে কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল, কাঁচুমাচু-মুখে বলল, “আমি গাগুকে আনতে চাইনি রইস চাচা। কিন্তু কফিল চাচা কিডনি কাটার জন্যে এনেছিল, ভয় পেয়ে রেখে দিয়ে পালিয়ে গেল।”
রইসউদ্দিন চমকে উঠে বললেন, “কী? কী বললে?” শিউলি পুরো ঘটনাটা খুলে বলল, “রইসউদ্দিন প্রথমে হতভম্ব এবং তারপর আস্তে আস্তে হঠাৎ রেগে আগুন হয়ে গেলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “আমি যদি ব্যাটা কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলির মুণ্ডু ছিঁড়ে না ফেলি!”