০৮. বাড়ি ফিরে

বাড়ি ফিরে অবাক হলাম।

সব কিছুই অন্যরকম লাগছে। চারদিকে কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। সব কিছুই অন্যরকম হয়ে গেছে। সেতারাকেও মনে হল এই তিন মাসে অনেকখানি বড় হয়ে গেছে। সবচে বদলেছেন বাবা। কী যে খারাপ হয়েছে তার স্বাস্থ্য। চোখ হলুদ। মাথার সামনের দিকের চুল সব পড়ে গেছে। আমি তাঁর ঘরে গিয়ে ঢুকতেই তিনি বলবেন, কে, রেনু?

আমি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, বাবা আমাকে চিনতে পারছেন না?

চিনতে পারব না কেন? কখন এসেছিস?

এই তো কিছুক্ষণ আগে।

বস মা আমার কাছে।

বাবা তার রোগা একটা হাত আমার কোলে তুলে দিলেন।

তুমি আমাকে একটা চিঠিও লেখোনি বাবা।

শরীরটা খারাপ মা। খুব খারাপ।

ঠিক তখন নীলু চা নিয়ে ঢুকল। বাবা মাথা তুলে বললেন, কে, রেনু?

নীলু অত্যন্ত যত্নে বাবাকে বালিশে হেলান দিয়ে বসাল। পিরিচে ঢেলে ঢেলে চা খাওয়াল। নীলু দেখি অনেক কাজ শিখেছে। গিনি গিন্নি ভাব।

সে কোমরে আঁচল জড়িয়ে ছুটোছুটি করে অনেক কাজ করছে। এক ফাঁকে বলল, সংসারের হাল ধরেছি।

তাই দেখছি।

কি যে ঝামেলা গেছে তুই তো জানিস না। তোকে জানানো হয়নি।

তা জানাবি কেন, আমি কে?

তাও ঠিক।

নীলু হাসল।

আমি বললাম–তুই খুব সুন্দর হয়ে গেছিস নীলু নীলু কিছু বলল না। অন্য সময় হলে সে কিছু-একটা ঠাট্টার কথা বলত। আজ দেখলাম লজ্জা পাচ্ছে।

নীলু তুই কেমন অন্য রকম হয়ে গেছিস।

অন্য রকম মানে কী রকম?

তোর মধ্যে কেমন একটা মা মা ভাব চলে এসেছে।

নীলু এবারও লজ্জিত ভঙ্গিতে আবার হাসল। সত্যি সত্যি সে বদলে গেছে। কিন্তু এই নীলুকেও ভাল লাগছে। আমি মৃদু স্বরে বললাম, আজ রাতে আমরা দু’জন একসঙ্গে শোব, কেমন নীলু?

ঠিক আছে।

সারারাত গল্প করব।

নীলু হাসল। ছোট বোনদের পাগলামী কথাবার্তা শুনে বড় বোনটা যেমন প্রশ্রয়ের হাসি হাসে সে রকম হাসি। ওরা আমার ঘরটি ঠিক আগের মতো করে সাজিয়ে রেখেছে। টেবিলের ওপর বইপত্র যা ছিল সব সে রকমই আছে। একটা বাজারের লিস্ট করেছিলাম, সেই লিস্টটা পর্যন্ত বুলিয়ে রেখেছে।

আমার বিছানায় এখন কে শোয় নীলু? সেতারা?

হুঁ সেতারা বুঝি সে রকম? ও এখনো আমার সঙ্গে ঘুমায়। আরো অনেক মজার ব্যাপার আছে সেতারার।

সেতারা বলল, ভাল হবে না। আপা।

আমি বললাম, কী ব্যাপার?

সেতারাকে কে যেন প্ৰেমপত্র লিখেছে। রুল টানা কাগজে।

নীলু খিলখিল করে হেসে উঠল। কে বলবে এই বাড়িতে কোনো দুঃখ-কষ্ট আছে?

নিলু বলল, নজমুল চাচা তাঁর মেয়ের কাছে যাচ্ছেন জানিস?

না তো।

সামনের মাসের মাঝামাঝি যাবেন। ওর মেয়ের কি যেন একটা অপারেশন হবে। গল ব্লাডার না কি যেন, ঠিক জানি না। মেয়ে বাবার জন্যে টিকিট পাঠিয়েছেন।

নজমুল চাচা নিশ্চয়ই খুব খুশি?

না, খুব না। এত দূর একা একা যেতে ভয় পাচ্ছেন।

ভয়ের কি?

কি জানি চাচার হেনতেন। কত কথা, আসলে যাবার ইচ্ছা নেই।

যাচ্ছেন তো?

তা যাচ্ছেন।

নজমুল চাচার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। নজমুল চাচা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে লাগলেন। যেন আমি তার হারিয়ে-যাওয়া একটি মেয়ে, কোনোদিন ফিরে পাবেন ভাবেননি, হঠাৎ ফিরে পেয়েছেন। তার কাণ্ড দেখে দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে নীলু হাসতে লাগল। চাচা রাগী গলায় ধমক দিলেন, হাসছিস কেন?

নীলু মুখ টিপে বলল, এমনি হাসছি। কাঁদলে দোষ নেই, হাসলে দোষ।

তুই নিচে যা তো নীলু

ঠিক আছে যাচ্ছি। কিন্তু বিলু ভেবে যাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা হচ্ছে সে কিন্তু বিলু নয়। আমি বিলু।

নজমুল চাচা হকচাকিয়ে গেলেন। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতে লাগলেন। তাঁর মনে সন্দেহ ঢুকে গেল।

তুই কে নীলু না বিলু?

আমি বিলু।

সত্যি করে বল।

সত্যি বলছি।

না, তুই নীলু বড় ফাজিলে হয়েছিস, যা বিলুকে পাঠিয়ে দে। আমি হাসতে হাসতে নিচে নেমে গেলাম। বাড়িতে এসে বড় ভাল লাগছে।

দোতলার নতুন ভাড়াটেদের সঙ্গেও দেখা হল। নীলু বলেছিল নাকি-স্বরে কথা বলেন। কোথায় কী দিব্যি ভাল মানুষের মত কথাবার্তা। নীলুটা এমন বানাতে পারে। ভদ্রমহিলাকে আমার বেশ পছন্দ হল। তবে একটু কথা বেশি বলেন। আমার সঙ্গে দুতিন মিনিট কথা হল, এর মধ্যে হড়বড় করে একশ গণ্ডী কথা বলে ফেললেন। তবে যে সব মেয়েরা বেশি কথা বলে ওদের মনে কোনো ঘোরপ্যাচ থাকে না। এইটা খুব সত্যি। বেশি কথা বলা মেয়েরা খুব দিলখোলা হয়।

সমস্ত দিন আমি অন্য এক ধরনের ভাল লাগা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দুপুরে নীল আমাকে বাগানে নিয়ে গেল। পেয়ারা গাছে নাকি ডাসা পেয়ারা হয়েছে। খুব মিষ্টি।

বাগান পরিষ্কার করেছে কে?

দোতলার ঐ ভদ্রমহিলা করিয়েছেন। এখন ভাল লাগছে না?

হুঁ। চমৎকার লাগছে।

এ ভদ্রমহিলা আর তার হ্যাঁসবেন্ড প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা বাগানে বসে চা খান। একদিন দেখি হাত ধরাধরি করে হাঁটছেন। খুব রোমান্টিক।

আমি ঘাসের ওপর বসতে বসতে বললাম, তোর রকিব ভাই আর চিঠি-ফিঠি লেখে না?

নীলু লাল হয়ে বলল, লেখে মাঝে মাঝে।

কী লেখেন?

এই সব আজেবাজে তেমন কিছু না।

তুমি নিশ্চয়ই খুব লিখিস?

নীলু জবাব দিল না।

কী রে, লিখিস না তুই?

লিখি মাঝে মাঝে।

তুই কী লিখিস নীলু?

নীলু চুপ করে রইল।

বল না।

যা মনে আসে তাই লিখি। বাবার কথা লিখি, মার কথা লিখি। তোর কথা সেতারার কথা সবার কথা লিখি।

লিখতে খুব ভাল লাগে?

হুঁ।

আমি একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে হালকা স্বরে বললাম, তোদের বিয়ে হলে বেশ মানাবে। দুজনেই চিঠি লেখার ওস্তাদ।

নীলু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। হয়ত তার চোখে পানি আসছে। চাচ্ছে না। আমি দেখে ফেলি।

 

সন্ধ্যাবেলা আমরা তিন বোন নদীর পাড়ে হাঁটতে গেলাম। মা যখন ছিলেন তখন আমরা প্রায়ই হাঁটতে আসতাম। প্ৰায় মাইলখানিক হাঁটা হয়ে যেত। এক সময় ক্লান্তিতে পা ভারী হয়ে আসত, তবু মায়ের হাঁটার শেষ নেই।

নীলু বলত, আর পারব না। ক্ষমা চাই। আমি এখানে বসে থাকব, তোমরা যাও। মা বলতেন, অল্প কিছু দূর যাব। সামনেই নদীটা খুব সুন্দর। একই রকম নদী। একই দৃশ্য দুপাশে। তবু কিছু কিছু জায়গায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলতেন, আহ। কী সুন্দর! তেমন বিশেষ সৌন্দর্যের কিছু আমরা দেখতে পেতাম না। কিন্তু মার মুগ্ধ ভাব আমাদের ও স্পর্শ করত। নীলু হাই তুলে বলত, মন্দ না, ভালই। মা চলে যাবার পর আমরা আর নদীর কাছে আসি নি। না কথাটা ঠিক না। বাবার সঙ্গে এসেছিলাম একদিন। গত শীতে আগের শীতে বাবার হঠাৎ সখ হল আমাদের নিয়ে বেড়াবেন। খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ফ্রাস্কে করে চা নিয়ে যাব। নদীর পাড়ে বসে চা খাব, কী বলিস? আমরা কেউ তেমন উৎসাহ দেখলাম না। শুধু সেতারা খুব উৎসাহ দেখাতে লাগল।

প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা বেড়াতে বের হলাম। বাবার কাঁধে ফ্লাস্ক। আমরা তিন বোন হাত ধরাধরি করে তাঁর পিছু পিছু যাচ্ছি। কুয়াশায় চারদিক ঢাকা। দেখার মতো কিছুই নেই। নদীটিও শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। বাবার উৎসাহ মিইয়ে এসেছে। মৃদু স্বরে বললেন, ফিরে যাবি নাকি? নীলু বলল, কোথাও বসে চা শেষ করি। এত কষ্ট করে ফ্লাস্কটা আনলে। কোথাও বসার মত জায়গা পাওয়া গেল না। সব শিশিরে ভিজে আছে। বাবা অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। সেই আমাদের শেষবারের মতো যাওয়া।

বাবা সুস্থ থাকলে বাবাকে নিয়ে আসা যেত। তিনি আমাদের তিন বোনকে বেরুতে দেখে আগ্রহ নিয়ে বলেছিলেন, কোথায় যাচ্ছিস তোরা? সেতারা বলেছে, নদীর পাড়ে হাঁটতে যাচ্ছি। বাবা। তিনি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভাল, খুব ভাল।

বেশিক্ষণ থাকব না। যাব। আর আসব।

যতক্ষণ ইচ্ছা থাকিস মা। আমার জন্যে ভাবতে হবে না। আমি ভালোই আছি। খুব ভাল।

আমরা হাঁটছি নিঃশব্দে। অনেকেই কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। দু’একজন বুড়োমত ভদ্রলোক সেতারাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাল আছ?

নীলু বলল, সেতারাকে সবাই চেনে। ইস আগে যদি মন দিয়ে গানটা শিখতাম।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে শহরের শেষপ্রান্তে চলে এলাম প্ৰায়। সেখানে প্রকাণ্ড একটা ঝাঁকড়া রেন্টি গাছ। তার শিকড় নেমে গেছে নদীর দিকে। কয়েকজন কলেজের ছেলে-টেলে হবে গাছের গুড়ির ওপর বসে সিগারেট টানছিল। ওরা আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়াল। একজন এগিয়ে এসে বলল, আপনারা বসবেন?

নাহ।

বসুন না একটু আমাদের সঙ্গে। বসুন।

সেতারা বলল, কিন্তু আপনারা গান গাইতে বলতে পারবেন না।

সব কটি ছেলে একসঙ্গে হেসে উঠল। আমরা তিন বোন পাশাপাশি বসলাম। ছেলেগুলি বসল। আমাদের সামনে।

নীলু বলল, আপনারা রোজ এখানে আসেন? জায়গাটা খুব সুন্দর।

ছেলেগুলি কোনো উত্তর দিল না।

সেতারা বলল, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি যাওয়া দরকার।

আমরা আপনাদের পৌঁছে দেব। আমরা উত্তর দীঘির পাশ দিয়েই রোজ যাই।

আমরা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ছেলেগুলি সেতারাকে গান গাইতে বলল না। কিন্তু সেতারা নিজ থেকেই গুনগুন করতে শুরু করল। খোলা মাঠ। অদূরেই শীর্ণকায় ব্রহ্মপুত্র। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে গাছে গাছে। এর মধ্যে সেতারার কিন্নর কণ্ঠ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল—

‘চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনি মদির চোখে চাহিও
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল
লুকাতে সে জল করিও না ছল…’

আমাদের তিন বোনের চোখ ভিজে উঠল। আমরা কতগুলি অপিরিচিত ছেলেকে সামনে বসিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। কান্নার মতো গভীর তো কিছু নেই। একজনের দুঃখ অন্যজনকে স্পর্শ করে না। কিন্তু একজনের চোখের জল অন্যকে স্পর্শ করে। ছেলেগুলি দেখলাম। একে একে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাচ্ছে। পুরুষরা তাদের চোখের জল মেয়েদের দেখাতে চায় না।

একটি ছেলে কোমল স্বরে বলল, আরেকটা গাইবেন?

কোনো অলৌকিক জগৎ থেকে সেতারার গান আসে? বুকের মধ্যে প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে শুনলাম সে গাইছে, ‘নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখি জল।’

ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা মিলিয়ে এল। ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে উড়ে আসতে লাগল শীতল হাওয়া। অন্ধকার ঝোপগুলিতে চিকমিক করতে লাগল জোনাকী। ছেলেগুলি আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। সেতারা বলল, ভেতরে আসবেন?

জি না, জি না।

কিন্তু ওরা চলেও গেল না। গোটে বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।

একজন মৃদু স্বরে বলল, আপনার বাবার শরীর কী এখন ভাল?

নীলু বলল, একটু ভাল।

কিন্তু বাবার শরীর ভাল নয়। আমি জানি বাবা মারা যাবেন খুব শিগগিরই। মৃত্যু টের পাওয়া যায়। তার পদশব্দ ক্ষীণ কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। বাবা মারা যাবার পরপরই আমরা একা হয়ে যাব। কেউ কি তখন এগিয়ে আসবে আমাদের কাছে? একমুখ দাড়িগোফ নিয়ে রকিব ভাই হাসিমুখে বলবেন-কে বিলু আর কে নীলু? গাঢ় ভালবাসার সুবিশাল বাহু প্রসারিত করবে। আমাদের দিকে। হয়ত করবেন, হয়ত করবেন না। এখানে কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না।

 

বসবার ঘরে বাতি জ্বলছিল। আমরা ঘরে ঢুকেই দেখলাম আমাদের লাল রঙের সোফাটিতে মা বসে আছেন। কেমন অদ্ভুত একটি শান্ত বিষন্ন ভঙ্গি। মা মাথা নিচু করে বললেন, তোমাদের বাবাকে দেখতে এলাম। নজমুল সাহেব টেলিগ্রাম করেছিলেন।

মার পরনে সাদার উপর নীল নকশার একটা শাড়ি। মাথায় আঁচল দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বয়সের ছাপ পড়েছে চোখে-মুখে। কাপালের কাছে এক গোছ রুপালি চুল। তবুও কি চমৎকারই না লাগছে তাকে।

মা বললেন, তোমরা কেমন আছ?

কেউ কোনো জবাব দিলাম না। মা কি আমাদের তুমি করে বলতেন না তুই কবে বলতেন কিছুতেই মনে পড়ল না।

সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে। এবং খুব সুন্দর হয়েছ সবাই। বস। কথা বলি তোমাদের সঙ্গে।

আমরা বসলাম।

মা বললেন, তোমরা নাকি নদীর পাড়ে গিয়েছিলে?

আমরা সে কথার জবাব দিলাম না।

মা থেমে থেমে বললেন, কয়েকদিন আগে সেতারার গান শুনলাম রেডিওতে। বিশ্বাসই হয় নি। আমার একটি মেয়ে এত সুন্দর গান গায়।

সেতারা তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কিছু-একটা দেখতে চেষ্টা করছে মার মধ্যে। নিজের মনের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে হয়ত।

তুমি মা খুব নাম করবে। দেশের মানুষের ভালবাসা তুমি পাবে এখনই অবশ্যি পেয়েছ, আরো পাবে।

নীলু বলল, আপনি কখন এসেছেন?

কিছুক্ষণ আগে এসেছি।

বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

মা ইতস্তত করে বললেন, না।

যান বাবার কাছে যান। উনি আপনার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে আছেন।

মা নড়লেন না। বসেই রইলেন।

আমি বললাম, আসুন, আপনাকে বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।

বাবার ঘরে ঢোকা মাত্র বাবা তার অভ্যাসমত বললেন, কে, রেনু?

মা দরজার পাশে থমকে দাঁড়াল। বাবা বললেন, ভাল আছ রেনু?

 

সেই রাতেই বাবার অসুখ বেড়ে গেল। বুকে হাত দিয়ে বহু কষ্টে টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগলেন। কথাবার্তা জড়িয়ে গেল। তবু একটু কোনো শব্দ হতেই মাথা তুলে বলতে লাগলেন, কে, রেনু?

মা তাঁর এত পাশে দাঁড়িয়ে কিন্তু তাকে চিনতে পারলেন না।

আমি চলে এলাম আমার ঘরে। নীলুর বিছানার ওপর দেখি একটি নীল খাম পড়ে আছে। রকিব ভাইয়ের লেখা চিঠি নিশ্চয়ই। নীলু হয়ত আজই পেয়েছে। রেখে দিয়েছে গভীর রাতে একা একা পড়বার জন্যে।

চারদিকে সুনসান নীরবতা। আমি বসে আছি চুপচাপ। আমার পাশেই ভালবাসার একটি নীল চিঠি। আমি হাত বাড়িয়ে চিঠিটি স্পর্শ করলাম। ঠিক তখনি নিচ থেকে একটি তীব্র ও তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দ ভেসে এল।

মা কাঁদছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *